নোটস ফ্রম জ্বরের বিছানা

চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে একটা প্রশ্ন মাথায় এল। আচ্ছা, আমরা “রিভিলিং ক্লোদস” কথাটা বলি কেন?

এক
পোশাক শরীরকে আচ্ছাদন দেয় — যে-পরিমানে প্রতিটা মানুষ নিজেকে নিজের মতো করে নগ্নতা আর প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে আড়াল করে। [সেই সঙ্গে নিশ্চয়ই ঢেকে রাখার ধরণটা যতখানি সম্ভব সুন্দর করে তুলতে চায়। তাই বোরখাতেও নানা রঙ আর সুতোর কারুকাজ]। অবাক লাগল ভেবে যে “প্রকাশকারী” আর “জামাকাপড়” এই দুটো শব্দের যাত্রা তো একে অন্যের উলটো দিকে, কাজেই ক্লোদস-এর আগে রিভিলিং বসালে সেটা অক্‌জিমোরোন-এর উদাহরণ হয়ে উঠবে শুধু!

শব্দার্থ আরেকটু খুঁটিয়ে জানার জন্যে ডিকশনারির সাহায্য নেওয়া যাক। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান খোলাখুলি লিখেছে, রিভিলিং জামাকাপড় তাই, যা পরিধানকারীর দেহের অনেকখানি দেখিয়ে দেওয়াকে অনুমোদন দিচ্ছে। কেমব্রিজ ইংরেজি অভিধান বলল, যা প্রথার (usual) চেয়ে বেশি শরীর দেখায়, তাই রিভিলিং। এমন কিছু উন্মোচন করে যেটা আগে জানা বা দেখা ছিল না।

কাজেই, দ্বিতীয়বার আরও বড় করে অবাক হওয়ার সুযোগ সামনে এসেছে! কিছু ড্রেস তাহলে শরীর ঢাকে না মোটেই, বরং উন্মুক্ত করে? রিভিলিং অঙ্গবাস জানলার মতো, নিজেই দেখায়! তার কাজই হচ্ছে…না নিজেকে দেখানো নয়। গোটা অঙ্গকে? উঁহু, তাও নয়। শরীরের শুধু আ-ঢাকা অংশ, অথবা, যা আবৃত হয়েও অনাবরণকে ফুটিয়ে তুলছে — তাকে দেখাবে [এখানে লেখা উচিত ‘না-ঢাকা’ — মানে যা ইচ্ছে করেই অপ্রকাশ রাখা হয়নি]।

খুব অদ্ভুত লাগে শুনতে, না? সাধারণ ভাবনায় মনে আসে, জামাকাপড় দেহের না-ঢাকা অংশ দেখাবে কেমন করে? যেটুকুতে আড়াল থাকবে না, তা তো আপনা থেকেই দৃশ্যমান! সুতরাং, অঙ্গবাসের নিজের ভূমিকাকে এখানে উলটে দেওয়া হয়েছে। যে সান্ত্রী, সে-ই গোপনে সিন্দুক খুলছে! অথচ দেখুন, কম্পিউটার আমাদের কতকিছু দেখিয়েছে, শিখিয়েছে; তবু রিভিলিং কম্পিউটার তো বলি না কেউ!

মজার কথা হল, প্রায় একই ধরণে একটা “সেন্স রিভার্সাল” হয়েছে “রিভিলিং” শব্দের গঠনেও।
“রিভিল” ইংরেজিতে এল ওল্ড ফ্রেঞ্চ reveler বা ল্যাটিন revelare থেকে। শব্দটার দুই অংশ: re মানে আবার, আর velum বলতে veil। সুতরাং, রিভিল-এর মূল অর্থ: পুনরায় আবরণ পরানো বা পুনর্গোপন করা। কিন্তু “re” উপসর্গ এখানে বিপরীত মানেতে ব্যবহার করা হয়েছে — “আবার”-এর বদলে “কখনও নয়” অর্থে। অনেক ভাষাতেই এমন উদাহরণ পাই, বাংলায় যেমন “অপ” একটা নেগেটিভ উপসর্গ। অপ আসছে অপগত থেকে যার মানে বিগত, পলায়িত, প্রস্থিত, দূরীভূত, মৃত, রহিত। তাহলে যার রূপ নেই সে-ই তো অপরূপ হওয়ার কথা? এদিকে আমাদের ভাষায় “অপরূপ” মানে অপূর্ব বা অতুলনীয় সৌন্দর্য, যার সামনে পড়ে কবিদেরও বিশেষণ হাতড়ে বেড়াতে হয়!

[দেরিদা The Animal That Therefore I Am লেখাতে মানুষ আর পশুর প্রতিতুলনায় নগ্ন (naked/nude) আর সজ্জিত (clothed) নিয়ে কথা বলেছেন। ওঁর নজর নিশ্চয়ই রিভিলিং শব্দটায় পড়েনি। তাহলে হয়তো আর একটা প্রবন্ধ পেতাম যেখানে মানুষজাতির মধ্যে আলোচনা সীমিত রেখে দেরিদা বলতেন, কোনও কিছুকেই উন্মোচিত করা যায় না, দেখানোর অর্থ আসলে নতুন করে তাকে ঢেকে দেওয়া। আর এইভাবে নগ্ন-সজ্জিত বাইনারির মধ্যের তফাতটাকে দিতেন অস্পষ্ট করে]।

দুই
বেশ, তাহলে বসন জীবিত এক অস্তিত্ব। সে সক্রিয় কর্তা। পোশাকের এই রকম এক নির্ণায়ক ভূমিকার কথাই পেলাম ওপরের আলোচনায়। কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ হচ্ছে না।

অভিধান একটা উদাহরণ এনেছে “রিভিলিং” শব্দটার ছবি মনে ভালোভাবে গেঁথে দেওয়ার জন্যে — “একজন মানুষ সত্যি সত্যি কী ভাবছে সে-ব্যাপারটা খুব রিভিলিং হয়ে উঠতে পারে তার বলা একটা জোকসের ভেতর দিয়ে”।

তাহলে বোঝা গেল, স্পিচ যেভাবে জীবিত সত্তার বৈশিষ্ট্য, বেশবাস সেরকম তো বটেই। তার ওপর, ঠিক যেমন কথ্য বা লিখিত শব্দের চেতনা আছে, পোশাকও নিজস্ব বোধ বহন করে চলে।

কনজিউমার সংস্কৃতিতে এই ব্যাপারটা আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। জীবের অধিগমন চলছিল জড়ের দিকে এবং উল্টোটাও। মনের যাত্রা হচ্ছে শরীর-পানে আবার বিপরীত স্রোতও মিথ্যে নয়। সেই একই “রোল রিভার্সাল” বা ভূমিকা বদলের গল্প। কেননা, যদি কেউ মনকে কমিয়ে শরীরের মাপে এনে ফেলতে চায়, তাহলে তাকে জড়বস্তুতে সজীবের মহিমা আরোপ করতেই হবে। উদাহরণ হিসেবে পোশাক-ব্যবসাকেই নেওয়া যাক। “অনেস্ট শার্ট” — এই বিখ্যাত ব্র্যান্ডে সততা যেন শার্টের সুতো, রঙ আর ডিজাইনের গায়ে লেগে আছে। স্থানান্তরিত বিশেষণের উদাহরণ, আমরা স্কুলে পড়তাম। অর্থাৎ সততা আপনার ভেতর-সত্তা থেকে “উভর কে” শার্টের শরীরে চলে এসেছে। যে লোকটা জানে সে সৎ নয়, সে-ও (ফলত সকলেই) ওই ব্র্যান্ডের একটা জামা পরে নিতে উদ্বুদ্ধ হবে। একইভাবে “দ্য কমপ্লিট ম্যান”-এ ট্যাগ লাইনটা বোঝায়, রেমন্ডস-এর কাপড়ের সুতোয় বোনা আছে একজন দায়িত্ববান বাবা, যত্নবান সন্তান, আবেগময় প্রেমিক — এক কথায় সম্পূর্ণ পুরুষ সত্তা।

তিন
এই পর্যন্ত এসে আমার নিজের কাছে যে প্রশ্নটা দাঁড়ায়: “প্রকাশকারী পোশাক” (revealing clothes) এই পরিভাষা একটা নারীবাদী পাঠ দাবী করছে কি না।

প্রথমত, “রিভিলিং ক্লোদস” শব্দদুটো এখনও পৃথিবী জুড়ে শুধু মেয়েদের সজ্জার বেলাতেই ব্যবহার করা হয়।
দ্বিতীয়ত, মেয়েদের মন থেকে তার শরীর আরও দূরবর্তী হয়ে গেল মাঝখানে “ড্রেস” নামের “তৃতীয়” ঢুকে পড়ায়। মনের এজেন্ট, মুখপত্র যেন সে — এই অঙ্গাবরণ। তারপর ভোগবাদের মহিমায় নারীর চেয়ে তার পরিচ্ছদ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠল। ধরুন, আপনি একটা মেয়েকে সান্ধ্য পার্টিতে নেমন্তন্ন করেছেন। তার মানে আপনি আসতে বলেছেন তিনজনকে: তার ড্রেস, তার শরীর আর সবশেষে সে নিজে।

তৃতীয়ত, যখন সৎ শার্ট বা সম্পূর্ণ পুরুষের কথা বলা হচ্ছে, পরিচ্ছদের চেতনা আর পরিধানকারীর চেতনা পরস্পরের হাত ধরে আছে, বিদ্যুতের সার্কিটে একটা “সিরিজ”-এ যুক্ত হয়ে থাকার মতো। ফলত পুরুষের সত্তার নেট লাভ হচ্ছে এ-থেকে; যদিও আবেশিত (induced), উদ্ভাস আসছে তার সত্তায়। কিন্তু “রিভিলিং ক্লোদস”-এর চেতনা মেয়েটার মানসিক গুণাবলীর সঙ্গে “প্যারালাল” সার্কিট তৈরি করে আছে, তার দীপ্তি কমিয়ে দিচ্ছে। তাই সত্তা অন্ধকার, তিনের মধ্যে তৃতীয়, মঞ্চে না উঠতে পেয়ে সাজঘরে দাঁড়িয়ে। সমাবেশে যাচ্ছে তার সজ্জা আর সজ্জা কর্তৃক রিভিলড গতরটি। কারণ, এখনও পর্যন্ত আপনি একই সঙ্গে মাইন্ড আর বডিকে সমান উচ্চতায় ধরে রাখতে পারেন না, কেননা সমাজমননে এখনও এ-দুটো বিপরীতগামী বলে কথিত, একে অন্যের আলো নিভিয়ে দেয়, তাই কনজিউমারিজম দুটোর কোনও একটা পক্ষ বেছে নিয়েছে। পুরুষের বেলায় সে মূলত তাদের অর্জিত গুণকে আন্ডারলাইন করে যার মধ্যে অবশ্যই অর্থসম্পদ পড়ছে — আর নারীর ক্ষেত্রে এখনও অনেক সহজ তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শরীরী সম্পদের ঘোষণায় ব্যস্ত থাকা।

তবে বদল তো আসছেই। মেয়েদের পোশাকের বিজ্ঞাপনকে একদিন অক্‌জিমোরোন-মুক্ত হতে বাধ্য করবে মেয়েরা। রিভিলিং মাইন্ড কথাটা সেখানে বাজবে বাঁশির মতো।

6 thoughts on “নোটস ফ্রম জ্বরের বিছানা

  1. জানার অনেক কিছু আছে। এই আলোচনাতে শেখার অংশ পেলাম।
    প্রাসঙ্গিক এবং সমকালীন আলোচনার জন্য ধন্যবাদ চন্দন দা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।