বিভাগের আর্কাইভঃ ইতিহাস-ঐতিহ্য

শুভ জন্মাষ্টমী

sh

শুভ জন্মদিন যোগমায়া ও শ্রীকৃষ্ণ।
সে অনেক অনেক বছর আগের কথা। ভাদ্র মাসের অষ্টমীর এক দুর্যোগময় রাতে গোকুলে আজকের দিনেই জন্মেছিলেন একটি শিশুকন্যা এবং একই দিনে একই সময়ে মথুরার কারাগারে জন্মেছিলেন একটি শিশুপুত্র।

শিশুকন্যাটির বাবার নাম নন্দ, মায়ের নাম যশোদা। শিশুপুত্রটির বাবার নাম বাসুদেব মায়ের নাম দেবকী। এদিকে বাইরে প্রবল ঝড় বৃষ্টি। সদ্যোজাত মেয়েটির মা প্রসব যন্ত্রণায় অচেতন। অসম্ভব দুর্যোগের রাত। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে! তার মধ্যেই উত্তাল যমুনা পেরিয়ে এলেন বসুদেব। তাঁর বুকের কাছে পরম যত্নে ধরে রাখা সদ্যোজাত শিশুপুত্রটি। অচেতন যশোদার কোলে সেই শিশুকে রেখে সর্ন্তপণে তুলে নিলেন শিশুকন্যাটিকে। জন্মের কয়েক মুহূর্ত পরেই চিরকালের জন্য শিশুকন্যাটি তাঁর মায়ের কোল হারালো। সে জানতেও পারেনি মায়ের ভালোবাসা, আদর, যত্ন। কখনও সে জানেনি বাবার কাছে অবদার কাকে বলে। বলি হওয়া সেই একরত্তির মেয়েটির নাম যোগমায়া।

সেই বসুদেবের বুকে পরম যত্নে রাখা ছেলেটির কী হল? তার জন্য অপেক্ষা করছিল যাবতীয় সাফল্য আর সমৃদ্ধি। সে বড় হল মেয়েটির বাবা মায়ের কাছে পরম আদরে যত্নে। কৈশোরে দুরন্ত প্রেমিক সে। তাঁর বাঁশির সুরে উথলে ওঠে হাজার নারীর প্রাণ। বহু বছর পর অবশেষে সামনে এল প্রকৃত সত্য। জানা গেল সে কাদের সন্তান, কী তাঁর দায়িত্ব। ছেলেটি মথুরায় ফিরে গিয়ে অবসান ঘটালো অত্যাচারী কংস রাজার। দখল নিল সিংহাসনের। বাসুদেব এবং দেবকীকে কারাগার থেকে মুক্ত করলো। তাঁরা ফিরে পেলো তাঁদের সন্তান। দুনিয়া নতজানু হল ছেলেটির সামনে। স্বীকার করল তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। তাঁকে ঘিরে থাকে অক্ষৌহিনী নারায়ণী সেনা, বিপুল ঐশ্বর্য।
শিশুপুত্রটিই শ্রীকৃষ্ণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

মেয়েটির কিন্তু কোনও খোঁজ করেনি কেউ। কখনো কোনও নিভৃতক্ষণে যশোদার মনে পড়েছিল তাঁর মেয়ের কথা? আমরা জেনে এসেছি যুগ যুগ ধরে আত্মত্যাগেই নারীজন্মের পরম সার্থকতা।

আজ জন্মাষ্টমী। কৃষ্ণের সাথে সাথে আজ যোগমায়ারও জন্মদিন। মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে যোগমায়াই হলেন আদ্যা শক্তি মহামায়া। অগ্নিপুরাণ এবং ভাগবত মতে, তিনি কৃষ্ণের জন্মলগ্নে যশোদার কোল আলো করে জন্মেছিলেন আহ্লাদিনী হয়ে। কংসের হাতে নিজের প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে যান ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে।

যোগমায়া বলিপ্রদত্ত এক নারীর নাম। আবহমান কাল ধরেই হয়ে চলেছে নারীর প্রতি অবহেলা ও বঞ্চনা। তাদের আত্মত্যাগের করুণ কাহিনী তলিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।
——–

. চিত্র : আঁকা – আমি।

ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস ও বর্তমান ভবিষ্যত

gh01
ডিএনডি বাঁধের বর্তমান লেক। ছবিটি বার্মাস্ট্যান্ড থেকে তোলা।

প্রিয় পাঠক, আপনি জানেন কি ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস? এবং কেন-ই-বা এই বাঁধ তৈরি করেছিলো? আর কি-ই-বা উদ্দেশ্য ছিলো তৎকালীন সরকারের? যদি আপনার জানা না থেকে, তো আমার এই লেখাটা শেষ পর্যন্ত পড়লে ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস এবং বর্তমান হালহকিকত সবকিছু জানতে পারবেন, আশা করি। তো চলুন শুরু করা যাক!

ডিএনডি’র সারমর্ম:
ডি=ঢাকা, এন=নারায়ণগঞ্জ, ডি=ডেমর। মানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা, এই তিন জায়গার কিছুকিছু অংশ জুড়ে ডিএনডি বাঁধ। যা, বর্তমান ঢাকা-৪ ও ৫ এবং নারায়ণগঞ্জ-৩ ও ৪ সংসদীয় আসন নিয়ে ডিএনডি বাঁধের অবস্থান।

ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস:
জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা এলাকার ৮ হাজার ৩শ ৪০ হেক্টর জমি নিয়ে ইরীগেশন প্রকল্প তৈরীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তৎকালিক পূর্ব পাকিস্তান সরকার। যা বাস্তবায়ন করা হয় ১৯৬৮ সালে। নামকরণ করা হয় ডিএনডি বাঁধ।

তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য:
তখনকার সময় শুধু ইরিধান চাষের জন্যই সরকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে তৎকালীন সরকারের ব্যয় হয়েছিল, ২৩৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা। এর অভ্যন্তরে জমির পরিমাণ ছিলো, ৫ হাজার ৬৪ হেক্টর। এই ৫ হাজার ৬৪ হাজার হেক্টর জমিই ছিলো সেচের আওতায়।

কি কি ছিলো এই ডিএনডি প্রকল্প অভ্যন্তরে?
ডিএনডি বাঁধ এলাকায় পানি সেচ দেয়া ও নিষ্কাশনের জন্য বড় ‘কংস নদ’ নামে একটি প্রশস্ত খাল ছিল। এ খালের সাথে আরো যুক্ত ছিল নয়টি শাখা খাল। ছাড়াও ২১০টি ছিল আউট লেক, ১০টি নিষ্কাশন খাল। এসব খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৮৬ কিলোমিটারের মতো।

এরমধ্যে নিষ্কাশন খালের দৈর্ঘ্য ছিলো ৪৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার। আর ইরীগেশন খালের দৈর্ঘ্য ছিল ৫১ দশমিক ২০ কিলোমিটার। ডিএনডি এলাকায় যদি বৃষ্টিতে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, সেজন্য পানি সেচের জন্য তৈরী করা হয় শিমরাইল এলাকায় ডিএনডি পাম্প হাউজ।

বসানো হয় জাপানের তৈরী করা ৪টি বড় পাম্প, যা প্রতি সেকেন্ডে ৫’শ১২ ঘনফুট পানি নিস্কাশনের ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। দুইটি প্রধান পানি নিষ্কাশনের খাল কাটা হয়েছিল প্রথম পর্যায়ে, তা ছিল ৫৫ পয়েন্ট ২০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৫ পয়েন্ট ৪০’ কিলোমিটার। এবং দুইটি প্রধান সেচ খাল কাটা হয় প্রথম পর্যায়ে ১৪’শ ১০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৪’ কিলোমিটার।

খড়া মৌসুমে জমিতে পানি সেচ দিতে ও বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন করতে সরকার এ খাল গুলো তৈরী করেছিল। সেসব খালগুলো এখন প্রায় সবই অকেজো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় চিটাগাং রোড সংলগ্ন সেচ পাম্পের সামনে গেলে। শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সুবিশাল প্রশস্ত খাল এই পাম্পের সাথে সংযোগ, আছে সুইচ গেইট।

ডিএনডি বাঁধের বর্তমান:
সুখ-দুঃখ নিয়েই ভবসংসারে মানুষের জন্ম। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যেমন সুখ খোঁজে, একদিন নিদারুণ কষ্ট জীবনে আসতে পারে সেই চিন্তাও মানুষ করে। তাই বলে বছর বছর লাগাতার কষ্ট করে জীবন চলবে এটা কোন ধরনের কষ্ট? এটা একটা বেড়িবাঁধ এলাকার স্থায়ী জলাবদ্ধতার কষ্ট।

যাদের প্রতিবছরই নিদারুণ কষ্টে থাকতে হয় জলাবদ্ধতার করণে। তারাই হলেন এক সময়ের ২৩৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প, ডিএনডি বেড়িবাঁধ এলাকার বসবাসকারী মানুষ।

বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় ডিএনডি বাঁধের ভেতরে জলাবদ্ধতা। থাকতে হয় তাদের বর্ষাঋতুর শেষ পর্যন্তই পানিবন্দী হয়ে। সামান্য বৃষ্টিতেই ১২ লাখ (বর্তমান এর সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি) ডিএনডিবাসী পানিবন্দি হয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই। একনাগাড়ে দুই-তিনদিন বৃষ্টি হলেই তাদের কষ্টের আর সীমা থাকে না। সেই কষ্টের চিত্র দেখা যায় সরেজমিনে গিয়ে। কীভাবে পানিবন্দি হয়ে ডিএনডিবাসী জীবনধারণ করছে।

এর কারণ শুধু একটাই, তা হলো, চাষের জমির সংখ্যা দিনে দিনে অনেক কমে যাচ্ছে। সাথে পানি নিষ্কাশনের খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সাথে বেড়েছে জনবসতি ও নীট গার্মেন্টস-সহ নানারকম কলকারখানা।

এই গড়া আর জমি কেনা শুরু হয়েছিল ১৯৮৮-১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকে। তখন ঢাকার আশেপাশের মানুষ মনে করেছিল, একরকম ভয়াবহ বন্যা এই বঙ্গদেশে ধারাবাহিকভাবেই হতে থাকবে। সেই ভাবনা থেকেই মানুষ উঠেপড়ে লেগে যায়, ডিএনডি বেড়িবাঁধের ভেতরে একটি বাড়ি তৈরি করার জন্য। এখনও অনেক টাকাওয়ালা মানুষ মনে করে ডিএনডি বাঁধের ভেতরে একটি বাড়ি করা, আর চাঁদের দেশে বাড়ি করা সমান কথা।

কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, এ প্রকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে ও অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যেই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন। একই সাথে রাজধানী ঢাকায় অবস্থানকারীদের জন্য সতেজ রবি শষ্য সরবরাহ করা। বর্তমানে এর ফল দাঁড়িয়েছে উল্টো। ভবিষ্যৎ হতে পারে হবে আরও ভয়াবহ, আর না-হয় আরও তৈরি হতে পারে সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

ডিএনডি বাঁধের ভবিষ্যৎ :
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে নানা দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার শিকার হয় ডিএনডির ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা। এসময় জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন কল-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের পানি। ফলে বছরের প্রায় ৫ মাস জলাবদ্ধতার মধ্যেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় ডিএনডি বাঁধবাসীদের।

02
ডিএনডি বাঁধের বর্তমান লেক। ছবিটি বার্মাস্ট্যান্ড থেকে তোলা।

এসব পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট একনেক সভায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) সেচ প্রকল্প এলাকায় নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ৫৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ডিএনডি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন (ফেইজ-২)’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ডিএনডি এলাকার পানি নিষ্কাশনের উন্নয়নে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী।

হাতিরঝিলের আদলে সাজবে ডিএনডি এলাকা:
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ডিএনডি এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবেশগত মান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন-সহ ডিএনডি বাঁধের জনগণের স্বাভাবিক জীবনমান নিশ্চিত হবে বলে সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে।

হাতিরঝিলের প্রকল্পের কাজকে মাথায় রেখেই এগিয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। এখানকার খালগুলো দখলমুক্ত করার পর এর পাড়গুলো বাঁধাই করে দেওয়া হচ্ছে। দুই পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। খালগুলোয় চলবে ওয়াটার ট্যাক্সি। ওই ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া করা যাবে। এছাড়া ইটিপির (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট নিয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

প্রকল্পটি ‘রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে’র কথা উল্লেখ করে এটি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অথবা সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।

বর্তমানে প্রকল্পের কাজ পায়ই শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আশা করা যায় আর এক থেকে দেড়বছরের মাথায় শেষ হবে। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে ডিএনডি বাঁধবাসী তাদের আগামী দিনের সুখের দিন হয়তো দেখতে পারবে।

শীতলক্ষ্যা নদীর উপর কালের সাক্ষী ভাসমান ডকইয়ার্ড

fghy
ভাসমান ডকইয়ার্ড, বন্দর, চৌরাপাড়া, নারায়ণগঞ্জ।

শীতলক্ষ্যা একটি নদীর নাম। যা নারায়ণগঞ্জ শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে, যুগযুগ ধরে। স্বচ্ছ পানির জন্য সুনাম অর্জনকারী শীতলক্ষ্যা নদী বঙ্গদেশের সবার কাছেই পরিচিত। স্বচ্ছ পানির সুনাম বর্তমানে না থাকলেও, নদীর দুই পাড় নিয়ে সুখ্যাতি আজও অখ্যাত রয়ে গেছে।

শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে রয়েছে প্রচুর মিল-ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা বাণিজ্য সহ আরও অনেককিছু। এসব নিয়ে লিখে শেষ করা যায় না। তাই আর কিছু লিখলামও না। লিখতে চাই শীতলক্ষ্যা নদীর পানির উপরে ভেসে থাকা বি.আই.ডব্লিউ. টি.সি’র ভাসমান ডকইয়ার্ড নিয়ে।

এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটিও প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের একটা ঐতিহ্য। যা যুগযুগ ধরে শীতলক্ষ্যা নদী, আর নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য বহন করে চলছে। এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটি পানিতে চলাচলকারী জাহাজ, লঞ্চ-ইস্টিমার, কার্গো, ট্রলার সহ আরও বহুরকম নৌযান মেরামত করার সময়োপযোগী স্থান।

আমরা সবাই সচরাচর দেখি ডকইয়ার্ড থাকে, নদীর পাড় ঘেঁষা খোলা জায়গায়। কিন্তু এটি নদীর পাড় ঘেঁষা কোনও খোলা জায়গা বা ভূমিতে নয়! এটি হলো পানির উপরে ভাসমান (ভেসে থাকা) অবস্থায়। নদীতে চলাচলকারী নৌযান মেরামত করার সহজ এবং উপযোগী স্থান।

জানা যায়, এরকম ভাসমান ডকইয়ার্ড এই বঙ্গদেশে আরও দু’টি আছে। একটি বরিশাল, আরেকটি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। আর এটি হলো তৃতীয় ভাসমান ডকইয়ার্ড । এটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার চৌরাপাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন। এটি বি.আই.ডব্লিউ.টি.সির নৌযান মেরামতের ইর্মাজেন্সি বিভাগ হিসেবে পরিচিত ভাসমান ফ্লোটিং ডকইয়ার্ড ।

fgh
ভাসমান ডকইয়ার্ড, বন্দর, চৌরাপাড়া, নারায়ণগঞ্জ।

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এই বি.আই.ডব্লিউ.টি.সির নৌযান মেরামত করার ডকইয়ার্ডটিকে। এই ডকইয়ার্ডের সাথেই ছিল আমাদের বসবাস, সাবেক আদর্শ কটন মিলস্। বর্তমান শোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস্। স্কুলে যাবার আগে বন্ধুদের সাথে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে ভাসতে আসতাম এই ডকইয়ার্ডে। এসেই সবাই মিলে শুরু করে দিতাম লাফালাফি আর ডকের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি।

এসব করার সময় ডকইয়ার্ডে কর্মরত কর্মচারীদের অনেক বকুনিও শুনেছি। আবার কোনও কোনওদিন বিকালবেলা মাছ ধরার জন্য বরশী নিয়ে চলে আসতাম ডকইয়ার্ডের সামনে। এই ডকইয়ার্ডটির চারিপাশ ছিল মাছের অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের ছয়-ঋতুর প্রায় সব ঋতুতেই এর চারদিক মাছে থাকত ভরপুর। বরশী ফেলার সাথে সাথেই পাওয়া যেত নানারকম মাছ।

বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পাড়ে যত্রতত্র নীট গার্মেন্টস ও ড্রাইং কারখানা গড়ে উঠেছে । সেসব ডাইং কারখানার নির্গত কেমিক্যালের পানি শীতলক্ষ্যায় মিশ্রিত হয়ে পুরো নদীর পানি এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে। যার কারণে আর ডকইয়ার্ডের আশে-পাশে আগের মতো মাছ থাকে না। সেসব কথা না-হয় নাই-ই-বা লিখলাম। এখন ডকইয়ার্ডটির খুঁটি-নাটি নিয়ে কিছু লিখতে চাই।

জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আলফেজ উইলিয়ামস এন্ড ডোভস লিমিটেড ১৯৪৫ সালে এটি নির্মাণ করে। জাহাজের ত্রুটিপূর্ণ তলদেশ মেরামত এবং দ্রুত বিকল ইঞ্জিনের ত্রুটি সারানোর কাজে এই ভাসমান ফ্লোটিং ডকইয়ার্ডের জুড়ি নেই।

এ ডকইয়ার্ডে ৫ টি পন্টুন আছে। পন্টুনগুলোর অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক মটরপাম্পের সাহায্যে ডকইয়ার্ডটির ভেতরে পানি ঢুকিয়ে, সম্পূর্ণ ডকইয়ার্ডটি পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। তখন ডকিংয়ে ত্রুটি সারতে আসা জাহাজটিকে আরেকটি ছোট ইঞ্জিনচালিত জাহাজে ঠেলে ডক ইয়ার্ডের ভিতরে নিয়ে যায়। তখন ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটিকে বসানোর জন্য থাকা সমান উচ্চতায় থরে থরে সাজানো কাঠের বড় বড় স্তম্ভের উপর বসিয়ে দেয়া হয়।

এরপর পাম্পের সাহায্যে পন্টুনের পানি আবার সেঁচতে শুরু করে দেয়, ডকইয়ার্ডে এই কাজে নিয়োজিত থাকা কর্মচারিরা। পুরো ডকে পানি ঢুকিয়ে ডকইয়ার্ডটি ডুবাতে যতক্ষণ সময় লেগেছিল, তার চাইতে অধিক সময় ব্যয় করে জাহাজ সহ নিমজ্জিত ডকটি জাগিয়ে তোলা হয় আস্তে-ধীরে।

এরপর শুরু হয় ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটির সংস্কার কাজ। মেরামতের জন্য আসা কোনও নৌযান বা জাহাজের যন্ত্রাংশ যদি তৈরি করতে হয়, তাহলে ভাসমান ডকইয়ার্ডেই করা হয়। এর সাথেই আরেকটা সুবিশাল ভাসমান বোর্ড আছে।

এই ভাসমান বোর্ডেটি হলো ওয়ার্কশপ। এটিকে অনেকে ভাসমান ওয়ার্কশপও বলে থাকে। এই ওয়ার্কশপে মেরামত বা তৈরি করা যন্ত্রাংশ দিয়েই, ত্রুটিপূর্ণ নৌযানগুলো মেরামত করা হয়। একেকটা জাহাজ মেরামত করতে অনেকদিন সময় লেগে যায়। ত্রুটি সারতে আসা কোনও কোনোও জাহাজ মাস খানেক যাবত এই ডকইয়ার্ডে থাকতে হয়। সম্পূর্ণ মেরামতের পর জাহাজটি নামাতে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

যখন বছরের শেষ ডিসেম্বর মাসের আগমন ঘটে, তখন নদীতে এমনিতেই পানি কমে যায়। সেসময় ডকইয়ার্ডটি ডুবাতে আর জাগাতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, ডকইয়ার্ডে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের। কারণ এই ডকইয়ার্ডটি চৌরাপাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন নদীর পাড় ঘেঁষা। সেই কারণে বর্ষা মৌসুম ছাড়া সেখানে পানি থাকে খুব কম। ডকইয়ার্ড ডুবাতে জাগাতে তা মাটিতে ঠেকে যায় যায় অবস্থা হয়।

শোনা যায়, কখনো কখনো মাটিতে ঠেকেও যায়। তখন সবার অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য। নদীতে জোয়ার না-হওয়া পর্যন্ত আর মেরামত হওয়া জাহাজটিকে ডেলিভারি দিতে পারেনা ডক কর্মচারীরা। যখন জোয়ার আসে তখন আবার শুরু হয় ডকইয়ার্ড ডুবানো জাগানোর পালা। এভাবেই চলছে এর কাজ।

আর একইভাবে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের ঐতিহ্যও রক্ষা করে চলছে ভাসমান ডকইয়ার্ডটি। যেভাবে ভাসমান ডকইয়ার্ডটি যুগযুগ ধরে শীতলক্ষ্যা নদীর বুকে ভেসে আছে, এভাবে যেন চিরদিন কালের সাক্ষী হয়ে শীতলক্ষ্যার বুকে ভেসে থাকে সেই কামনা করি।

প্রতিবছর ঈদ কেন ১১দিন আগে হয়?

ffty

আচ্ছা, প্রতিটি ঈদ কেন প্রতিবছর ১০-১১ দিন আগে হয়?
যেমন: গত হয়ে যাওয়া ঈদ-উল-ফিতর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৪ই মে ২০২১ইং। একবছর পরপর যদি ঈদ হয়, তা হলে তো এ বছর ১৪ ই মে অথবা মে মাসের ১৫ তারিখ পবিত্র ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তা-ই নয় কি?

কিন্তু সেটা না হয়ে এবার কেন ২-৩ মার্চ ২০২২ ইং ঈদ-উল- ফিতর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা একটু ভাবার বিষয় নয় কি?

তবে হ্যাঁ, এবিষয়ে ভাবনা-চিন্তার কিছুই নেই! কারণ, এখানে সবকিছুই চাঁদের হিসাবে অর্থাৎ চান্দ্র মাসের হিসাবেই হচ্ছে। তাই প্রতিবছর গত বছরের ১০-১১ দিন আগেই পবিত্র মাহে রমজান-সহ ঈদুল ফিতর অথবা ঈদ-উল-আযহা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোনো-কোনো বছর মাহে রমজান শীতকালে আরম্ভ হয়। আবার কোনও বছর প্রচন্ড রোদে ঝড়-বৃষ্টি আর বান-তুফানেও মাহে রমজান আরম্ভ হয়ে থাকে। কিন্তু ইংরেজি অথবা বাংলা সনের কোনও নির্দিষ্ট সময়ে হচ্ছে না। এর কারণ শুধু একটাই। আর তা হলো চন্দ্র মাসের হিসাব।

আমরা জানি ইংরেজি ৩৬৫ দিনে একবছর। আবার কোনো-কোনো বছর ৩৬৬ দিনেও হয়ে থাকে। আর তা হয় প্রতি চার বছর পরপর। আরও সহজভাবে বললে বলতে হয়, যেকোনো ইংরেজি সালকে অর্থাৎ ২০২০ সালকে ৪ দিয়ে ভাগ করলে যদি ভাগফল অবশিষ্ট কোনও সংখ্যা না থাকে, তা হলে সে বছর বা সেই ইংরেজি সালই হবে ৩৬৬ দিনে। যাকে বলে লিপ ইয়ার। ঐ বছরই ফেব্রুয়ারি মাস ২৮দিনের পরিবর্তে ২৯ দিন হবে। যেমন: ২০২৪÷৪= ৫০৬ এখানে ভাগফলের শেষে কোনও অবশিষ্ট সংখ্যা নেই। তার মানে হলো, ২০২৪ ইংরেজি সাল হবে ৩৬৬ দিনে, আর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস হবে ২৯দিনে। সোজা কথায় ২০২৪ ইংরেজি সাল হবে লিপ ইয়ার।

এবার আসি আমাদের বাংলা সন নিয়ে আলোচনায় : জানা যায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা একাডেমি ইংরেজি বর্ষের সাথে মিল রেখে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলা সনের হিসাব সংস্কারের একটি সুপারিশও প্রণয়ন করেছে। পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায় যে, বাংলা সনের প্রস্তাবিত সংস্কারে বৈশাখ থেকে আশ্বিন ৬ মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে। ফাল্গুন ব্যতীত কার্তিক থেকে চৈত্র ৫ মাস হবে ৩০ দিনের। ২৯ দিনে ফাল্গুন ধরা হবে। বছরে দিনের সংখ্যা ৩১x৬ (১৮৬) + ৩০ x ৫ (১৫০) +২৯= ৩৬৫ ঠিক রাখা হয়। বাংলা একাডেমির ভাবনামতে এ প্রস্তাবের ফায়দা হল ৮ ফাল্গুন ও ২১ ফেব্রুয়ারি, ১২ চৈত্রে ২৬ মার্চ, ২৫ বৈশাখে ৮ মে, ১১ জ্যৈষ্ঠে ২৫ মে এবং ১ পৌষে ১৬ ডিসেম্বর প্রাতিষঙ্গিক হবে। কিন্তু একসময় বাংলা বর্ষেও কোনো-কোনো মাস ৩২ ও ২৯দিনেও হতো। তবে এখন আর সেটা নেই। তবু্ও কিছুকিছু হিন্দুরা সেই আগেকার বাংলা বর্ষপঞ্জিই অনুসরণ করে আসছে। এর পেছনে আবার একটা কারণও আছে। কারণ হলো, ইংরেজি তারিখ গণনা শুরু হয় রাত ১২টার পর সময় ০০ থেকে। আর বাংলা তারিখ গণনা শুরু সূর্যোদয়ের সাথে। তাই অনেক হিন্দুরা ক্যালেন্ডারের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপন না করে এর পরদিন তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সবই পালন করে থাকে।

তা করুক, সেটা যার যার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির আওতায় পরে। তা হলে বুঝাই গেলো যে বাংলা এবং আন্তর্জাতিক ইংরেজি সাল হুবহু একই নিয়মে চলছে। ব্যতিক্রম শুধু ইংরেজি চার বছর পরপর লিপ ইয়ার। যা হয় ৩৬৬ দিনে।

এবার হিজরি সন নিয়ে আলোচনা : হিজরি সন হল চাঁদের হিসাবে। যাকে বলা হয় ইসলামি চন্দ্রমাস। এই হিজরি সাল হলো ইসলামী চন্দ্র পঞ্জিকায ব্যবহৃত পঞ্জিকা। জানা যায় যার প্রথম বছর শুরু হয়েছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সেই থেকে হিজরি মুহররম মাসকে ইসলামি নববর্ষের প্রথম মাস ধরা হয়।

জানা যায় হিজরি সালের এই প্রথম বছরে মহানবী ও তার সাহাবীরা মক্কা থেকে ইয়াসরিবে (বর্তমানে মদিনা) দেশান্তরিত হন। এই ঘটনাটি ইসলামি পরিভাষায় হিজরত নামে পরিচিত যা ইসলামে প্রথম মুসলিম সম্প্রদায় (উম্মাহ) সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রাখার জন্য স্মরণীয়। তাই মনে হয় এই হিজরত থেকেই হিজরি নামকরণ করা হয়েছে।

তো যাইহোক, বাংলা এবং ইংরেজি সালের সাথে ব্যতিক্রম হলো, মাস এবং বছরের দিন। হিজরি মাস চাঁদের হিসাবে হওয়াতে বছরের প্রতিটি মাসই ২৯.৫০ মানে সাড়ে ঊনত্রিশ দিনে হয়ে থাকে। যেমন: ৩৫৪÷১২=২৯.৫, আবার ৩৫৫÷১২=২৯.৫৮৩৩৩৩। সে হিসাবে হিজরি চন্দ্র পঞ্জিকায় একবছর গণনা করা হয়, ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে। তা হলে দেখা যায় ইংরেজি সাল ৩৬৫দিন—হিজরি চন্দ্র পঞ্জিকা ৩৫৪দিন হলে ইংরেজি থেকে হিজরি ১১ দিন কম হয়। এই ১১দিন কম থাকার কারণে প্রতিবছর ইংরেজি বাংলা সালের নির্দিষ্ট কোনো তারিখে ঈদুল ফিতর অথবা ঈদ-উল-আযহা উদযাপন হয় না। প্রতিবছরই গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ বা ১১ দিন আগেই মাহে রমজান-সহ ঈদুল ফিতর ও ঈদ-উল- আযহা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু হিজরি ইসলামি চন্দ্র পঞ্জিকার ঠিক তারিখেই হচ্ছে।

বি:দ্র: লেখা আরও একবছর আগের।

শুভেচ্ছান্তে: নিতাই বাবু। আমি একজন হিন্দু। লেখায় ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। আর লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়া পর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করতে ভুলবেন না। পরিশেষে সাবাকে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা’র অগ্রীম শুভেচ্ছা জানালাম।

গণেশের আসল মাথা ও হাতির দেহ কোথায়? এবং সেগুলো কীভাবে পূজিত হচ্ছে?

images-2

আমি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী। মানে আমি হিন্দু। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, কাকা-কাকী, মামা-মামী-সহ হিন্দু সমাজের সকলেই ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনা করে আসছে। নিজেও নিজের এলাকায় প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া প্রায় সব কয়টা পূজায় অংশগ্রহণ করে ভক্তিভরে পালন করি। বেশি আনন্দ উপভোগ করি আমাদের হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ দূর্গা পূজায়। আর প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের দিনটি শুরু করি গণেশ পূজা করে। বাংলা নববর্ষের এই দিনে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে দেবতা গণেশের পূজা করার সময় নিজে নিজেকে প্রশ্ন করি, ❝আচ্ছা, এই দেবতা গণেশের হাতির মাথা কেন? তা যেভাবেই হাতির মাথা হয়েছে তো হয়েছেই, কিন্তু গণেশ দেবতার আসল মাথাটা কোথায় কীভাবে পূজিত হচ্ছে? আর হাতির দেহটি কোথায় আছে এবং কীভাবে পূজিত হচ্ছে?❞

এ শুধু নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করি, কিন্তু উত্তর মেলাতে পারি না এবং কোনও পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেও সদুত্তর পাই না। তারপরও থেমে থাকি না। এমনিতেই আমার জানার ইচ্ছেটা খুবই বেশি! সেই ইচ্ছে থেকেই শিব পুরাণ ঘেঁটে পেলাম গণেশ দেবতার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কাহিনী। কিন্তু গণেশ দেবতার আসল মাথা ও হাতির দেহের অবশিষ্ট কোনও কাহিনী খুঁজে পেলাম না। একদিন আমার বড় দাদা জীবিত থাকতে দাদাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। (আমার বড় দাদা বর্তমানে স্বর্গীয়)। জিজ্ঞেস করার পর বড় দাদা বিস্তারিত ঘটনা বললেন। আমি শুনলাম! নিজের প্রশ্নের সাথে বড় দা’র কথা মেলালাম। মিলিয়ে দেখি বড় দাদার কথা আর আমার প্রশ্ন হুবহু মিলেছে।

তা কীভাবে মিললো, সেটা আমি আমার এই লেখার মাঝে প্রকাশ করছি। আগে শিব পুরাণ ঘেঁটে পাওয়া দেবতা গণেশের দেহ থেকে মাথা কীভাবে বিচ্ছিন্ন হলো এবং কীভাবে দেবতা গণেশের দেহে হাতির মাথা স্থাপন হলো, সে বিষয়গুলো তুলে ধরছি। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

শিব পুরাণে উল্লেখ রয়েছে, একদিন নাকি কৈলাসে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, দেবী পার্বতী। সে সময় তিনি দরজায় পাহারায় বসিয়ে রাখেন শিবের বিশ্বস্ত অনুচর নন্দীকে। আদেশ দেন, যতক্ষণ পার্বতী স্নানঘরে থাকবে ততক্ষণ কাউকে যেন ভিতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়। নন্দী পার্বতীর আদেশ পালন করতে পাহারায় বসলেন।

এদিকে সেই সময় সেখানে হাজির স্বয়ং মহাদেব। নন্দী ছিলেন শিবের ভক্ত ও অনুচর। নন্দী শিবের ভক্ত হওয়াতে শিবকে পার্বতীর স্নানঘরে প্রবেশ করতে বাঁধা দিতে পারে না। যখনই শিব পার্বতীর স্নানের সময় স্নান ঘরের সামনে আসে নন্দী শিবকে ভেতরে ঢুকতে দিতে বাধ্য হয়। এতে সময়সময় এরকম পরিস্থিতিতে পার্বতী খুবই বিরক্তিকর অবস্থায় পড়েন।

ঐরকম বিরক্তি থেকেই পার্বতী অন্তত স্নান করার সময় নন্দীর পরিবর্তে একজন বিশ্বস্ত পাহারাদার কামনা করলেন। সেই কামনা থেকেই পার্বতী নিজের শরীরে মাখা হলুদ থেকে সৃষ্টি করলেন এক মূর্তি। সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে নাম রাখলেন ‘গণেশ’।‘গণেশ’ হলো পার্বতীর আজ্ঞাবহ পুত্র। আর এই আজ্ঞাবহ পুত্রই গণেশ হলেন পার্বতীর স্নান ঘরের বিশ্বস্ত পাহারাদার। পার্বতী স্নানঘরে ঢোকার আগে স্নান ঘরের দরজায় গণেশকে পাহারায় বসিয়ে রাখতো, আর গণেশের প্রতি আদেশ থাকতো স্নানঘরেকেউ স্নানঘরে প্রবেশ করতে না পারে। ঠিক তা-ই হতো। পার্বতীর আদেশ তাঁর আজ্ঞাবহ পুত্র গণেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনও করতেন।

একদিন পার্বতী স্নানঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পর মহাদেব স্নান ঘরের সামনে এসে দেখে তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর নন্দী নেই! অপরিচিত এক বালক স্নান ঘরের দরজার দাঁড়িয়ে আছে। মহাদেব স্নানঘরে প্রবেশ করতে চাইলে গণেশ মায়ের আদেশ রক্ষার্থে বাঁধা দেয়। গণেশ বাঁধা দিলে মহাদেব ভীষণ রেগে যায়। মহাদেব রেগেমেগে গণেশকে মহাদেব বলল, ‘জান আমি কে?’। গণেশ বলল, ‘আপনি যে-ই হোন-না-কেন আমি অন্তত আপনাকে মা পার্বতীর স্নানঘরে ঢুকতে দিব না’।

গণেশ’র এই কথার পরই মহাদেব ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর হাতে থাকা ত্রিশূল নিক্ষেপ করে গণেশের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর স্নানঘর থেকে পার্বতী দৌড়ে এসে দেখে মাটিতে পরে আছে গণেশের দেহ ও মাথা । তা দেখে পার্বতী রেগে অগ্নিশর্মা। পার্বতী মনস্থির করলেন, প্রলয় নিত্য করে পৃথিবী মুহূর্তেই ধ্বংস করে ফেলবেন। পার্বতীর এই অবস্থা দেখে মহাদেব পড়লেন বিপাকে! মহাদেব পার্বতীর রাগ থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই পার্বতীর রাগ থামাতে না পেরে মহাদেব ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা ঘটনাস্থলে আসলেন। ব্রহ্মা গণেশের ছিন্ন মস্তক জোড়া লাগিয়ে পুনরায় সেই আগের গণেশ করে দিবেন বলে পার্বতী ব্রহ্মা কথা দেন। ব্রহ্মার কথায় পার্বতী স্থির হলে ব্রহ্মা মহাদেবকে আদেশ দিলেন, ‘উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকা যেকোন প্রাণী বা পশুর মাথা কর্তন করে এনে গণেশের দেহের সাথে স্থাপন করতে। তা যেন হয় অতি তাড়াতাড়ি। দেরি হলে বিপাকে পরতে হবে। ব্রহ্মার কথামতো মহাদেব একজন বিশ্বস্তকে পাঠালেন, কোথাও উত্তর মুখী শুয়ে থাকা কোনও প্রাণী বা পশু পাওয়া যায় কিনা। পাওয়া গেলেই সেই প্রাণী বা পশুর মাথা কর্তন করে আনতে।

মহাদেব’র আদেশে ওই বিশ্বস্ত সহচর সাথে সাথে রওনা দিলেন, সোজা উত্তর মুখী। অনেক দূর যেতেই উত্তর মুখী শুয়ে থাকা একটা হাতি দেখতে পেলেন। সাথে সাথে মহাদেবের ঘনিষ্ঠ সহচর হাতির দেহ থেকে মাথা কর্তন করে এনে ব্রহ্মার হাতে দিলেন। ব্রহ্মা তন্ত্রমন্ত্র যোগে ওই হাতির মাথা পার্বতীর আজ্ঞাবহ পুত্র গণেশের দেহে স্থাপন করলে। গণেশ হাতির মাথায় পুনঃজীবন লাভ করলেন। গণেশের জীবন ফিরে পাবার পর দেবতা ব্রহ্মা গণেশের দেহ থেকে ছিন্ন হওয়া মাথা আর হাতির দেহ একসাথে নির্দিষ্ট একস্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে বললেন। দেবতা ব্রহ্মার কথামতো ঠিক তা-ই হলো, তাই করলো।

তারপরও যখন পার্বতীর মনোকষ্ট তখনো দূর হচ্ছিল না। তা দেখে ব্রহ্মা পার্বতীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখনও রাগ কেন?’। উত্তরে পার্বতী বললেন, ‘গণেশ তো পুনঃজীবন লাভ করলো ঠিকই। কিন্তু গণেশের আসল মাথার বিহিত কী হবে, আর নিরীহ অবুঝ প্রাণী হাতির দেহের বিহিত কী হবে, তার একটা সুরাহা দরকার। আর গণেশের হাতির মাথা দেখে দেবকুলে ঘৃণার প্রাত্র যাতে না হয়, এই বিষয়গুলোর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই আমার রাগ থামবে না।’
পার্বতীর কথা শুনে ব্রহ্মা ওই তিনটে বিষয়ের বিধান দিলেন, এরকম: (১) ❝গণেশের হাতির মাথা দেখে কেই ঘৃণা করতে পারবে না। গণেশ হবেন গণপতি। (২) সকল দেবতার পূজার আগে গণেশের পূজা করতে হবে। আর গণেশের আসল মাথাও বিফলে যাবে না। আসল মাথাও সকল দেবতার পূজার আগেই থাকবে। (৩) হাতির দেহও গণপতি গণেশের সাথেই থাকবে এবং সকল দেবদেবীর পূজার আগে গণেশের সাথেই পূজিত হবে।❞ সেই থেকে দেবকুলে আর সৃষ্টিকুলে সেভাবেই সেই বিধান মেনেই সকল দেবদেবীর পূজার আগে গণেশের পূজা হয়ে আসছে। একইভাবে দেবতা গণেশের আসল মাথা ও হাতির আসল দেহ পূজিত হচ্ছে।

গণেশ দেবতার মাথা নিয়ে এরকম আরও কাহিনী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে প্রচলিত আছে। তারমধ্যে একটি কাহিনী হলো, এরকম ↓↓↓

যেমন: ❝শনিদেব হলেন পার্বতীর ভাই। সেইমতে গণেশ হলেন শনিদেবের ভাগিনা। গণেশকে একনজর দেখে আশীর্বাদ দেয়ার জন্য পার্বতী ভাই শনিদেবকে কৈলাশে আসতে বললে, শনিদেব বললেন, ‘আমি ভাগিনাকে দেখলে ভাগিনার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই আমি ভাগিনাকে দেখতে যাবো না।’ এরপরও পার্বতীর বিশেষ অনুরোধে শনিদেব গণেশকে দেখতে কৈলাশে গেলেন, বোন পার্বতীর বাড়ি। বোনের বাড়ি গিয়ে ভাগিনাকে দেখামাত্র ভাগিনা গণেশের দেহ থেকে সাথে সাথে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতঃপর উপরোল্লিখিত ব্রহ্মার আদেশের মতোই শনিদেব একই আদেশ দিলেন। সেই আদেশ মতে উত্তর মুখী শুয়ে থাকা একটা হাতির মাথা কর্তন করে দেবতা গণেশের দেহে স্থাপন করা হয়।❞

এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হলো, গণেশের আসল মাথা কোথায়, আর হাতির দেহ-ই-বা কোথায় এবং কীভাবে সকল দেবদেবীর পূজার আগে এই দুটোর (১) গণেশের আসল মাথা (২) হাতির দেহ’র পূজা হচ্ছে?

হ্যাঁ, হচ্ছেও ঠিক তা-ই। দেবতা ব্রহ্মার বিধান ঠিকঠাকমতো বলবত আছে। তা কীভাবে আছে? আছে এভাবে! উপরোল্লিখিত ↑↑↑ দেবতা ব্রহ্মা বিধান দিয়ে পার্বতীর রাগ থামিয়ে আরও বললেন, ‘এখন গণেশের আসল মাথা ও হাতির দেহ একসাথে একটা নির্দিষ্ট স্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে হবে। সেখান থেকে একটা নারিকেল গাছ সৃষ্টি হবে। সেই নারিকেল গাছের নারিকেল হবে গণেশের আসল মাথা। আর হাতির দেহও যখন মাটির সাথে মিশে যাবে, তখন পৃথিবীর সব স্থানের মাটির সাথেই মিশে যাবে। ওই মাটি দিয়ে মানুষ তৈরি করবে ঘট। এই ঘটই হবে হাতির দেহ। প্রত্যেক পূজার আগে দেবদেবীর মূর্তির সামনে ঘট স্থাপন করতে হবে।

images-3

সেই ঘটে থাকবে জল। এর উপরে থাকবে একটা আম্রপল্লব। তার উপরে থাকবে নারিকেল। তার উপরে থাকতে হবে একটা বস্ত্র। এই ঘট আর নারিকেল মিলেই হবে গণেশের মাথা আর হাতির দেহ। এই ঘটকে আগে পূজা দিয়ে প্রত্যেক দেবদেবীর পূজা শুরু করতে হবে । এছাড়াও বছরের প্রথম দিন যেমন:পহেলা বৈশাখ। এই দিন শুরু হবে গণেশ দেবতার পূজার মধ্যদিয়ে। সেই থেকে এখনও বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এইদিন বা বছর শুরু করে গনেশ পূজা দিয়ে।

তাহলে আমরা কী বুঝতে পারলাম? আমরা বুঝতে পারলাম যে, দেবতা গণেশের আসল মাথা হলো “নারিকেল”, আর হাতির আসল দেহটি হলো “ঘট”। নারিকেল, আম্রপল্লব, আর মাটির তৈরি ঘট মিলিয়ে হলো যেকোনো পূজার “মঙ্গলঘট”।

আশা করি এখন গণেশের আসল মাথা আর হাতির দেহ নিয়ে কারোর প্রশ্ন থাকতে পারে না।

ঘট, ঘটের উপরে আম্রপল্লব তার উপরে নারিকেল এবং বস্ত্রেরও একটা বিধান আছে। তা আর এই লেখায় আমি উল্লেখ করলাম না লেখার শব্দ সংখ্যা অধিকতর বেড়ে যাবার কারণে। আজ এখানে এ-পর্যন্তই।

টুকটাক রমযান ৪

আজ ২৪ রমযান। আগামী সপ্তাহে আজকের দিনে হয়তো ঈদ পালন করব। দুর্বার গতিতে রোযা চলে গেল ভালো করে ধরতে পারলাম না। জানি না এবারের রোযায় আল্লাহর আদেশ কতটুকু পালিত হয়েছে। জানি না আন্তরিক মনে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পেরেছি কিনা, আল্লাহ ভালো জানেন।

গতকাল বাংলা বছরের প্রথম দিন ছিল। আজ থেকে অনেক বছর আগে বাংলা ১৩৮৯ সালে বছরের প্রথম দিনে ‘বৈশাখী’ নামে ক্ষুদ্র এক সংকলন সম্পাদনা করেছিলাম। তখন আমার বয়স ১৩। এই সংকলনের কোন অস্তিত্ব এখন অবশিষ্ট নেই। ১৩৯০ অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় মৌলভীবাজার শহর তলিয়ে গেলে অনেক কিছুর সাথে ‘বৈশাখী’ও তলিয়ে যায়।

৮৪ বন্যার পরে ‘বৈশাখী’ না করতে পারলেও ‘ষড়ঋতু’ নামে আরেকটা ছড়া সংকলন সম্পাদনা করতাম। ‘ষড়ঋতু’ বেশ কয়েক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম। ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ, এই সংকলনে বিভিন্ন ঋতুকে চিহ্নিত করে ছড়া ছাপা হতো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কিশোর ছড়াকাররা লিখতেন। পত্র যোগাযোগে সারাদেশের ছড়াকারদের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এখন কুড়িগ্রাম হাতের মুঠোয় থাকলেও তখনকার সময়ে কুড়িগ্রামের ছড়াকারের কাছে পৌঁছাতে কমপক্ষে এক মাস লেগে যেত। তবু চেষ্টার কমতি না দিয়ে আমরা পৌঁছাতাম। ষড়ঋতু সেই সময় বেশ জনপ্রিয় ছড়া সংকলন ছিল। ‘ষড়ঋতু’র দুই এক কপি এখনো অবশিষ্ট আছে।

আমাদের কৈশোরে পাড়ায় পাড়ায় সাহিত্য সাংস্কৃতিক কিংবা ক্রীড়া সংগঠন ছিল। আমরা ছিলাম এসব সংগঠনের নিবেদিত প্রাণ কর্মী। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। দিনের গাম্ভীর্য বজায় রেখে নিজেদের মত আনন্দ ফুর্তি করতাম। আমরা প্রতিবছর দিবস ভিত্তিক সংকলন করতাম, স্থানীয় লেখকদের সাথে অন্যান্য জেলা কিংবা রাজধানীর লেখকদের লেখা ছাপতাম। একটা সংকলন কিংবা একটা অনুষ্ঠানের জন্য সেই বয়সে যে দৌড়ঝাঁপ করতাম এখন এসব স্বপ্নের মত মনে হয়। সেই বয়সে অফুরন্ত শক্তি ছিল, প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর সেই কৈশোর আর ফিরে আসবে না। নতুন একটা দেশকে নিজেদের মতো সাজাবো বলে আমরা কষ্ট করতাম, কিন্তু কষ্ট কি কোনদিন কষ্ট মনে করতাম না।

এখনকার কী অবস্থা বলতে পারবো না। এখনকার কিশোর আমাদের মত রাত জেগে প্রেসে বসে থাকে কিনা জানি না। শহীদ দিবসের ভোরে নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারের দিকে হেঁটে যাওয়ার ব্যাকুলতা তার আছে কিনা জানিনা।

কৈশোরে আমরা স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। ঘুম থেকে জেগেও স্বপ্নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। দেশ স্বপ্নে নয় বাস্তবে পেয়েছি, দেশকে নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করাই আমাদের ব্রত ছিল।
গতকাল ছিল বাংলা বছরের প্রথম দিন। প্রথম দিনকে ধরব বলে সেহরি খেয়ে বিছানায় যেতে ইচ্ছে হলো না। ভোরের আলোর সাথে সাথে পড়লাম…

নমো নমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ-সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি|
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি-
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি|
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ-
স্তব্ধ অতল দিঘি-কালো জল নিশীথ শীতলস্নেহ
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে-
মা বলিতে প্রান করে আনচান, চোখে আসে জল ভর।

দেখলাম আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, চেষ্টা করেও কান্না চেপে রাখতে পারছি না। হায় প্রবাস জীবন…

শুভ নববর্ষ

নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ ও আনন্দ। প্রতিটি দিন হোক সবার জীবনের সেরা সময়। প্রতিটি মুহূর্ত হোক সবার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। প্রতিটি স্মৃতি হোক জীবনের সাফল্যে পৌঁছানোর প্রেরণা। সবার জন্য শুভ কামনা।

আজ ২ এপ্রিল ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’

আজ ২ এপ্রিল ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই দিনটি পালন করা হয় নীল রঙের পোশাক পরে।

‘অটিজম’ বা ‘অটিস্টিক’ শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। অনেক পরিবার বা ব্যক্তি আছেন যাঁরা অটিজম বা অটিস্টিক শব্দটির সঙ্গে তখন পরিচিত হয়েছেন যখন তাঁরা জানতে পারেন যে তাঁদের পরিবারে বা তাঁদের কাছাকাছি কেউ এই অটিজম সমস্যায় ভুগছেন। অনেকে এটাকে রোগ বলে অভিহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে অটিজম কোনো রোগ নয়, এটা স্নায়ুগত বা মনোবিকাশ জনিত সমস্যা। এ সমস্যাকে ইংরেজিতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলে। শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

কিছু মানুষকে বাকিদের থেকে আলাদা করে দেয় অটিজম। মূলত আচরণেই তা বোঝা যায়। ভিড়ে মেলামেশার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় কারও। কারও আবার ভাবনার প্রকাশ হয় আর পাঁচ জনের তুলনায় অন্য রকম। অটিস্টিক শিশু মানে বোকা বা অমেধাবী নয়। অটিস্টিক শিশুরা স্কুল-কলেজ এমনকি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে সফলতা অর্জন করার যোগ্যতা রাখে।

অটিস্টিক হওয়া মানে সব কাজেই ব্যাঘাত ঘটবে, এমন নয়। ইতিহাসে এমন বহু বিখ্যাত মানুষ রয়েছেন, যাঁদের বিভিন্ন আচরণ বলে যে তাঁরাও ‘অটিজম স্পেকট্রাম’-এর মধ্যে পড়েন। জেনে নেওয়া যাক তেমনই কিছু মানুষের কথা। আগে অটিজম নিয়ে সচেতনতা তেমন ছিল না। ফলে সে সময়ে হয়তো জানা যায়নি যে তিনি অটিস্টিক। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা পরে বুঝেছেন, এই ব্যক্তিরা অটিস্টিক ছিলেন।

বিখ্যাত সংগীত শিল্পী লেডি হাক এবং ডারিল হান্না, ড্যান হারমন,ড্যান আইক্রয়েড, কোর্টনি লাভ, টিম বার্টন,আব্রাহাম লিঙ্কন, মোৎসার্ট, আলবার্ট আইনস্টাইন, এমিলি ডিকিনসন, চার্লস ডারউইন, কার্টুন ছবির আবিষ্কারক সাতসি তাহেরিসহ বহু বিখ্যাত ব্যক্তি অটিস্টিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁদের সফলতায় অটিজম কোনো বাঁধা হতে পারেনি। অটিস্টিক শিশুদের সুস্থ বিকাশে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা।

ভালো থাকুক পৃথিবীর সব শিশুরা …
সহানুভূতির নয় বদলে সমানুভূতি আসুক।
বিশ্বজয় করুক পৃথিবীর সব শিশুরা ….

339

গ্রীক সভ্যতা: উৎস এবং দার্শনিকদের জন্মভূমি

33 গ্রীক সভ্যতা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রভাবশালী সময়কালের একটি। এটি তার মহান চিন্তাবিদ, শিল্পী, লেখক, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের জন্য বিখ্যাত যারা পশ্চিমা সংস্কৃতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। গ্রীক সভ্যতার সূচনা এবং প্রাথমিক ইতিহাস পৌরাণিক কাহিনী এবং কিংবদন্তিতে আবৃত, যা কল্পকাহিনী থেকে সত্যকে আলাদা করা কঠিন করে তোলে। যাইহোক, এই নিবন্ধটি গ্রীক সভ্যতার উত্স এবং প্রাথমিক ইতিহাস অন্বেষণ করার চেষ্টা করবে এবং সক্রেটিস এবং প্লেটোর কিছু পটভূমির তথ্য প্রদান করবে, যা প্রাচীন গ্রীক দর্শনের সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দুটি।

গ্রীক সভ্যতার উৎস এবং প্রাথমিক ইতিহাস
গ্রীক সভ্যতার উৎপত্তি নিওলিথিক যুগে (৬০০০-৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে পাওয়া যায়, সেই সময়ে গ্রিসে ছোট চাষী সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। এই সম্প্রদায়গুলি ধীরে ধীরে আকার এবং চেতনা ও শক্তি সামর্থের মধ্য দিয়ে নানা রকম শক্তির অপূর্ব জটিলতায় বৃদ্ধি পায় এবং মাইসেনিয়ান সভ্যতার (১৬০০-১১০০বিসি) বিকাশের ভিত্তি তৈরি করে, যা এর উন্নত স্থাপত্য, শিল্প এবং সামরিক দক্ষতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল।

Mycenaean সভ্যতা অন্ধকার যুগ (১১০০-৮০০বিসি) দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছিল, একটি সাংস্কৃতিক পতন এবং উত্থানের সময়, এই সময়ে মাইসেনিয়ানদের অনেক অর্জন হারিয়ে গেছে বা ভুলে গেছে। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে গ্রীস অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে এবং প্রাচীন কাল (৮০০-৪৮০ বিসি) নামে পরিচিত সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়ে প্রবেশ করে।

প্রত্নতাত্ত্বিক যুগে, গ্রীস উপনিবেশের সময়কাল অনুভব করেছিল কারণ গ্রীকরা ইতালি, সিসিলি, উত্তর আফ্রিকা এবং কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল সহ ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন অংশে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এই সম্প্রসারণের ফলে নতুন বাণিজ্য নেটওয়ার্কের বিকাশ ঘটে এবং গ্রীক সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে, যা ভূমধ্যসাগরীয় এবং তার বাইরের সভ্যতাগুলিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিক যুগে গ্রীক নগর-রাষ্ট্র বা পলিসের বিকাশও দেখা যায়, যা এর স্বতন্ত্র সরকার, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সম্প্রদায়ের দৃঢ় অনুভূতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। পলিস ছিল গ্রীক সমাজের মৌলিক একক এবং এটি একটি শহর বা শহর এবং এর আশেপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত।

সক্রেটিস
সক্রেটিস (৪৬৯/৪৭০-৩৯৯বিসি) ছিলেন একজন দার্শনিক যিনি গ্রীক সভ্যতার ধ্রুপদী যুগে বসবাস করতেন। তাকে পশ্চিমা দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তার প্রশ্ন করার পদ্ধতির জন্য পরিচিত, যা এখন সক্রেটিক পদ্ধতি নামে পরিচিত।

সক্রেটিস কোন লিখিত কাজ ফেলে যাননি, তাই আমরা তার সম্পর্কে যা জানি তার অনেকটাই আসে তার ছাত্রদের লেখা থেকে, বিশেষ করে প্লেটোর লেখা থেকে। সক্রেটিস তার সহকর্মী নাগরিকদের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে তীব্র প্রশ্ন করার জন্য পরিচিত ছিলেন, যা প্রায়শই উত্তপ্ত বিতর্ক এবং বিতর্কের দিকে নিয়ে যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা শুধুমাত্র কঠোর প্রশ্ন এবং আত্ম-পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে এবং তিনি বিখ্যাতভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে “অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।”

সক্রেটিসের দর্শন ছিল সত্যের সাধনা এবং নৈতিক চরিত্রের গুরুত্বকে কেন্দ্র করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং পুণ্য পরস্পরের সাথে জড়িত এবং প্রকৃত জ্ঞান শুধুমাত্র একটি পুণ্যময় জীবন যাপনের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। তার নীতির প্রতি সক্রেটিসের প্রতিশ্রুতি এতটাই দৃঢ় ছিল যে তিনি তার বিশ্বাসের সাথে আপস করার পরিবর্তে মৃত্যুবরণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং হেমলক পান করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে তিনি বিখ্যাতভাবে এথেন্স থেকে পালাতে অস্বীকার করেছিলেন।

প্লেটো
প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৩৪৮/৩৪৭বিসি) সক্রেটিসের একজন ছাত্র ছিলেন এবং তাকে পশ্চিমা ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দার্শনিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি এথেন্সে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, যা পশ্চিমা বিশ্বের উচ্চ শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান।

প্লেটোর দর্শন তার পরামর্শদাতা সক্রেটিসের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা শুধুমাত্র কঠোর প্রশ্ন এবং আত্ম-পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। যাইহোক, প্লেটো সত্যের অন্বেষণে সক্রেটিসের জোরের বাইরে গিয়েছিলেন এবং একটি বিস্তৃত দার্শনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যা অধিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি এবং জ্ঞানতত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে।

প্লেটোর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে একটি হল “প্রজাতন্ত্র”, যা একটি সংলাপ যা ন্যায়বিচারের প্রকৃতি, আদর্শ সমাজ এবং বাস্তবতার প্রকৃতিকে অন্বেষণ করে। “প্রজাতন্ত্র”-এ প্লেটো তার আদর্শ সমাজের একটি বিশদ বিবরণ উপস্থাপন করেছেন, যা তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে দার্শনিক-রাজাদের দ্বারা শাসিত হবে যারা বাস্তবতার প্রকৃত প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এবং জ্ঞান ও গুণের সাধনার জন্য গভীর প্রতিশ্রুতি রাখে।

প্লেটো ফর্মের তত্ত্বও তৈরি করেছিলেন, যা বিশ্বাস করে যে শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয় ফর্ম বা ধারণাগুলির একটি রাজ্য রয়েছে যা ভৌত জগতের অন্তর্গত। প্লেটোর মতে, রূপের জ্ঞান হল জ্ঞানের সর্বোচ্চ রূপ, এবং এটি শুধুমাত্র যুক্তি এবং দার্শনিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে।

“প্রজাতন্ত্র” ছাড়াও, প্লেটো আরও অসংখ্য কথোপকথন লিখেছিলেন যা প্রেমের প্রকৃতি, বাস্তবতার প্রকৃতি, জ্ঞান এবং বিশ্বাসের মধ্যে সম্পর্ক এবং আত্মার প্রকৃতি সহ বিস্তৃত দার্শনিক বিষয়গুলি অন্বেষণ করে।

গ্রীক সভ্যতার সূচনা এবং প্রাথমিক ইতিহাস একটি আকর্ষণীয় এবং জটিল বিষয় যা এখনও অনেক বিতর্ক এবং অধ্যয়নের বিষয়। এই সময়কালকে ঘিরে অনেক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও, এটা স্পষ্ট যে গ্রীকরা তাদের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

সক্রেটিস এবং প্লেটো হলেন প্রাচীন গ্রীক দর্শনের দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, এবং তাদের ধারণা এবং শিক্ষাগুলি আজও অধ্যয়ন এবং বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সক্রেটিসের প্রশ্ন এবং আত্ম-পরীক্ষার উপর জোর দেওয়া এবং প্লেটোর একটি ব্যাপক দার্শনিক ব্যবস্থার বিকাশ পশ্চিমা দর্শন ও চিন্তাধারার বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

ভূমিকা
প্লেটো এবং সক্রেটিসের জীবন ও কাজ দর্শন, রাজনীতি এবং ধর্মের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। উভয় পুরুষই প্রাচীন গ্রীসে বাস করতেন, একটি মহান বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সময়ে, এবং তাদের ধারণাগুলি আজও পশ্চিমা চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করছে। এই নিবন্ধটি প্লেটো এবং সক্রেটিসের জীবনী, সেইসাথে দর্শন, রাজনীতি এবং ধর্মে তাদের অবদানগুলি অন্বেষণ করবে। উপরন্তু, আমরা যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তারা বসবাস করতেন, এবং কীভাবে তাদের ধারণাগুলি তাদের সময়ের ঘটনা ও ধারণার দ্বারা রূপান্তরিত হয়েছিল তা পরীক্ষা করব।

সক্রেটিসের জীবনী
সক্রেটিস ৪৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সোফ্রোনিস্কাসের পুত্র, একজন স্টোনমাসন এবং ফেনারেতে, একজন ধাত্রী। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে তিনি নিজেকে দর্শনে নিয়োজিত করার আগে পাথর কাটার কাজ করেছিলেন। সক্রেটিস কোন লিখিত কাজ রেখে যাননি, এবং আমরা তার সম্পর্কে যা জানি তার বেশিরভাগই তার ছাত্র প্লেটো এবং জেনোফোনের লেখা থেকে আসে।

সক্রেটিস তার প্রশ্ন করার পদ্ধতির জন্য পরিচিত ছিলেন, যা সক্রেটিক পদ্ধতি নামে পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান আবিষ্কারের সর্বোত্তম উপায় হল সংলাপের মাধ্যমে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা এবং উত্তর খোঁজার মাধ্যমে। সক্রেটিসের প্রশ্ন প্রায়শই তিনি যাদের সাথে কথা বলেছিলেন তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে, এবং তিনি তার কথোপকথনকারীদের তাদের নিজস্ব বোঝার অভাব উপলব্ধি করার ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

সক্রেটিস তার নৈতিক শিক্ষার জন্যও পরিচিত ছিলেন, যা একটি সৎ জীবন যাপনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জীবনের উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান অন্বেষণ করা এবং নৈতিক নীতি অনুসারে জীবনযাপন করা এবং তিনি বিখ্যাতভাবে দাবি করেছিলেন যে “অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।”

তার শিক্ষা সত্ত্বেও, সক্রেটিসকে এথেন্সে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসাবে দেখা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে যুবকদের কলুষিত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাকে হেমলক পান করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি, এবং এটি শিল্প ও সাহিত্যের অসংখ্য কাজকে অনুপ্রাণিত করেছে।

প্লেটোর জীবনী
প্লেটো ৪২৮/৪২৭খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার পিতা অ্যারিস্টন ছিলেন এথেন্সের রাজাদের বংশধর। প্লেটো সক্রেটিসের একজন ছাত্র ছিলেন এবং তার প্রাথমিক কাজগুলি মূলত তার শিক্ষকের স্মৃতি সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত।

সক্রেটিসের মৃত্যুর পর, প্লেটো এথেন্স ছেড়ে ভূমধ্যসাগরে ভ্রমণ করেন। তিনি অন্যান্য দার্শনিকদের সাথে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তার নিজস্ব ধারণা তৈরি করেছিলেন, যা তিনি সংলাপের একটি সিরিজে রেকর্ড করেছিলেন। প্লেটো তার সংলাপের ফর্ম ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত, যেখানে চরিত্রগুলি একটি দার্শনিক আলোচনায় জড়িত।

প্লেটোর দর্শন প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছিল ফর্মের রাজ্য বা ধারণার অস্তিত্বে তার বিশ্বাসের দ্বারা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভৌত জগৎ হল রূপের জগতের একটি ছায়া, যা চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। প্লেটোও আত্মার অমরত্ব এবং পুনর্জন্মের ধারণায় বিশ্বাস করতেন।

প্লেটো এথেন্সে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ছিল পশ্চিমা বিশ্বের উচ্চ শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। একাডেমিটি দার্শনিক অধ্যয়নের কেন্দ্র ছিল এবং এটি সমগ্র গ্রীসের ছাত্রদের আকর্ষণ করত। এর ছাত্রদের মধ্যে অ্যারিস্টটল ছিলেন, যিনি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হয়ে উঠবেন।

প্লেটোর রাজনৈতিক দর্শনও ছিল প্রভাবশালী। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ “দ্য রিপাবলিক”-এ তিনি একটি আদর্শ সমাজের জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন, যা দার্শনিক-রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে শুধুমাত্র যারা জ্ঞান ও গুণ অর্জন করেছে তারাই শাসন করার উপযুক্ত, এবং তিনি গণতন্ত্রকে একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা হিসাবে দেখেছিলেন যা সহজেই ডেমাগোগদের দ্বারা চালিত হতে পারে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সক্রেটিস এবং প্লেটো প্রাচীন গ্রীসে মহান বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের সময়ে বাস করতেন। এথেন্স ছিল এই সাংস্কৃতিক নবজাগরণের কেন্দ্র, এবং এটি ছিল আবাসস্থল।

সেনেকার জীবন ও দর্শন
সেনেকা ছিলেন একজন রোমান দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক এবং ট্র্যাজেডিয়ান যিনি ৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টোইক দার্শনিকদের একজন হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তার কাজগুলি পশ্চিমা দর্শনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।

প্রারম্ভিক জীবন এবং শিক্ষা
লুসিয়াস আনায়াস সেনেকা খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে স্পেনের কর্ডোবায় একটি অশ্বারোহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেটি সেনেটোরিয়াল শ্রেণীর নীচে একটি সামাজিক শ্রেণী ছিল। তার পিতা, মার্কাস আনাস সেনেকা ছিলেন একজন সুপরিচিত বক্তৃতাবিদ এবং অলঙ্কারশাস্ত্রের শিক্ষক এবং তার মা ছিলেন হেলভিয়া। সেনেকা ছিলেন তার পিতামাতার দ্বিতীয় পুত্র, এবং তার একটি বড় ভাই ছিল, গ্যালিও, যিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন।

সেনেকা একটি চমৎকার শিক্ষা লাভ করে, যার মধ্যে অলঙ্কারশাস্ত্র, দর্শন এবং সাহিত্য শেখার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি অ্যাটালাস, সশন এবং প্যাপিরিয়াস ফ্যাবিয়ানাস সহ তার সময়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট শিক্ষকদের অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি এপিকিউরাস এবং স্টয়িক সহ গ্রীক দার্শনিকদের কাজ দ্বারাও প্রভাবিত ছিলেন।

দার্শনিক ধারণা
সেনেকার দার্শনিক ধারণাগুলি স্টোইসিজম দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, যা গুণ, যুক্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি সুখী জীবনের চাবিকাঠি হল একটি গুণী চরিত্র গড়ে তোলা এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করা। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে ব্যক্তিদের বাহ্যিক জিনিসের সাথে সংযুক্ত করা উচিত নয়, যেমন সম্পদ বা ক্ষমতা, কারণ তারা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।

সেনেকার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে একটি হল “লুসিলিয়াসের চিঠি”, যা তার বন্ধু লুসিলিয়াসকে লেখা চিঠির একটি সংগ্রহ। এই চিঠিগুলিতে কীভাবে ভাল জীবনযাপন করা যায় এবং কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় সে সম্পর্কে প্রচুর উপদেশ রয়েছে। সেনেকা “মেডিয়া” সহ বেশ কয়েকটি নাটকও লিখেছেন যা প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজেডির উপর ভিত্তি করে ছিল।

রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং নির্বাসন
সেনেকা ৩১ খ্রিস্টাব্দে রোমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন যখন তিনি quaestor নিযুক্ত হন। তিনি ৪০ খ্রিস্টাব্দে একজন ধর্মপ্রচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ৫৭ খ্রিস্টাব্দে কনসাল নিযুক্ত হন। অফিসে থাকাকালীন তিনি তার সততা এবং সততার জন্য পরিচিত ছিলেন এবং রোমের লোকেরা তাকে সম্মান করতেন।

যাইহোক, সেনেকার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিতর্কমুক্ত ছিল না। তিনি রোমের সম্রাট ক্লডিয়াসের স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং কয়েক বছরের জন্য কর্সিকা দ্বীপে নির্বাসনে বাধ্য হন। পরে ক্লডিয়াসের উত্তরসূরি নিরো তাকে রোমে ফিরিয়ে আনেন এবং তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের একজন হয়ে ওঠেন।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার
নিরোর সাথে সেনেকার সম্পর্ক জটিল ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সম্রাটকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে ফেলা হয়। ৬৫ খ্রিস্টাব্দে, নিরো সেনেকাকে আত্মহত্যা করার নির্দেশ দেন এবং তিনি তার কব্জি কেটে তা করেছিলেন। তার মৃত্যুকে রোমান সাম্রাজ্যের দুর্নীতি ও ক্ষয়ের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

তার বিতর্কিত জীবন সত্ত্বেও, সেনেকার দার্শনিক ধারণাগুলি পশ্চিমা চিন্তাধারায় স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। যুক্তি, গুণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের উপর তার জোর আধুনিক নীতিশাস্ত্রের বিকাশে প্রভাবশালী হয়েছে এবং তার নাটকগুলি আজও সঞ্চালিত ও অধ্যয়ন করা অব্যাহত রয়েছে।

তার সময়ের চিন্তাবিদরা
সেনেকা রোমে মহান বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক উত্থানের সময়কালে বসবাস করতেন। তিনি অন্যান্য অনেক বিশিষ্ট দার্শনিক এবং লেখকের সমসাময়িক ছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে:

১. সিসেরো – একজন রাজনীতিবিদ, দার্শনিক এবং বক্তা যিনি রোমান ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে বিবেচিত।

২. Epictetus – একজন গ্রীক দার্শনিক যিনি শিখিয়েছিলেন যে ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং কর্মের উপর মনোযোগ দিয়ে সুখ এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি অর্জন করতে পারে।

৩. লুক্রেটিয়াস – একজন রোমান কবি এবং দার্শনিক যিনি “অন দ্য নেচার অফ থিংস” মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, যা মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং এতে মানুষের ভূমিকা অন্বেষণ করেছিল।

৪. প্লুটার্ক – একজন গ্রীক জীবনীকার এবং প্রবন্ধকার যিনি বিখ্যাত গ্রীক এবং রোমানদের জীবন নিয়ে ব্যাপকভাবে লিখেছেন।

৫. সেনেকা এবং তার সমসাময়িক চিন্তাবিদদের ছাড়াও, এই সময়ের মধ্যে অনেক দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যারা দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এখানে তাদের কিছু:

৬. মার্কাস অরেলিয়াস – একজন রোমান সম্রাট এবং দার্শনিক যিনি বিখ্যাত বই “মেডিটেশন” লিখেছিলেন, যা জীবন, মৃত্যু এবং মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে।

৭. প্লোটিনাস – একজন দার্শনিক যিনি নিওপ্ল্যাটোনিজমের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এক, বুদ্ধি এবং আত্মার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিল।

৮. সেক্সটাস এম্পিরিকাস – একজন গ্রীক দার্শনিক যিনি জ্ঞান অর্জনের সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন যে মানুষের বিশ্ব সম্পর্কে রায় স্থগিত করা উচিত।

৯. আলেকজান্দ্রিয়ার ফিলো – একজন ইহুদি দার্শনিক যিনি ইহুদি ধর্মকে হেলেনিস্টিক দর্শনের সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন এবং যিনি ঈশ্বর এবং মহাবিশ্বের প্রকৃতির উপর ব্যাপকভাবে লিখেছেন।

এই দার্শনিক এবং চিন্তাবিদরা একটি প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির অংশ ছিলেন যা রোমান সাম্রাজ্যকে আকার দিয়েছে এবং আগামী শতাব্দীর জন্য পশ্চিমা চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে।

বাংলা ভাষা

ভাষার লড়াই

বাংলা ভাষা আমার মায়ের
ভালোবাসি খুবই,
কথা কই বা কাব্য লিখতে
ছন্দ মালায় ডুবি।

বীর বাঙালি রক্ত ঢেলে
আনল বাংলা ভাষা,
জনগণ তাই বেজায় খুশি
পূর্ণ মায়ের আশা।

সালাম রফিক বরকত জব্বার
বাংলা ভাষার তরে,
রক্ত স্রোতে ভাসিয়ে প্রাণ
আনে বাংলা ঘরে।

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
বছরে যেই আসে,
বাংলার মানুষ আনন্দেতে
জয় উল্লাসে হাসে।

ফুল দেয় সবাই স্মৃতিসৌধে
অনেক দোয়া মাগে,
ভুলে না কেউ ভাষা পেলাম
তাঁদের প্রাণের ত্যাগে।

স্বরবৃত্তঃ ৪+৪/৪+২

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রপ্রভাব

3170

বাংলা সাহিত্যের কথা বললেই যে নামটি সর্বাগ্রে আসে তিনি আর কেউ নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। যিনি “গুরুদেব”, “কবিগুরু” “বিশ্বকবি” ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত। ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ, অসংখ্য গান ও অন্যান্য গদ্য সংকলনই তার আধিপত্য এবং শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর বহন করে। সাহিত্যের এহেন শাখা নেই, যেখানে তার দীপ্ত পদচারনা নেই।

সেই হিসাবে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র প্রভাব খুবই স্বাভাবিক। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে গবেষণাকর্ম, এমনকি সাধারণ পাঠকের কাছে এখনও তার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। তবুও আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প, উপন্যাসে তার দুর্দান্ত প্রভাব নিয়ে সামান্য আলোচনার চেষ্টা করব। প্রথমেই কাব্য প্রসঙ্গ। অনেকের মতে, সন্ধ্যা-সঙ্গীত’ কাব্য থেকেই কবি তার নিজস্ব পথ খুঁজে পান। স্তবক রচনা, মিল সম্পাদন, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের নানারীতির প্রবর্তন এবং গদ্যছন্দের আবিষ্কারে তিনি বাংলা কবিতায় বৈচিত্র্য এনেছেন। ভাবের ক্ষেত্রেও তার অনুভূতি বিস্ময়কর। বিশেষ করে গীতি-কবিতা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে সার্থকরূপ পরিগ্রহ করেছে। উনিশ শতকের শেষ পর্যায় থেকে বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত তিনি অজস্র রচনার দ্বারা পাঠকের রসপিপাসা নিবৃত্ত করেছেন। ভাবের ঐশ্বর্যে, কল্পনার বৈচিত্র্যে, ভাষার মাধুর্যে, প্রকাশের অসাধারণত্বে তার কবিতাগুলি অতুলনীয়। মানসী’ থেকে রবীন্দ্রকাব্যে পরিণতির ছাপ লক্ষণীয়। যদিও তার প্রথমদিকের কাব্যগুলিতে বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রভাব কিছুটা দেখা যায়। অবশ্য এরপরের কাব্যগাঁথা কেবলই রবীন্দ্রময়। এই যে এতো কবিতা লিখেছেন; তবুও শেষ জীবনে নিতান্তই আক্ষেপের সুরে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমার কবিতা জানি আমি.. গেলেও বিচিত্র পথে হয়নি সর্বত্রগামী”! কবিগুরুর এই যে অতৃপ্তি, আক্ষেপ তা তাকে আরও মহিমান্বিত করেছে। তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

একথা অনস্বীকার্য যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পের প্রথম সার্থক রূপকার। ‘সাধনা’ পত্রিকার মাধ্যমে তার ছোটগল্পের শুরু। তবে বাংলা ছোটগল্প যে পাশ্চাত্য গল্পের কাছে ঋণী, এমন কি রবীন্দ্রনাথ নিজেও এডগার অ্যালান পো-র মতোন বিদেশি সাহিত্যিকের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, এ তথ্য আজ প্রমাণিত। প্রসঙ্গত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কৃতিত্বের কথা স্মরণ করার পাশাপাশি লিখেছেন, “উপন্যাসের মত, ছোটগল্প জিনিসটাকেও আমরা পশ্চিম হইতে বঙ্গসাহিত্যে আমদানি করিয়াছি।”

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প দু’টি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বের গল্পগুলিতে পদ্মা তীরবর্তী উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ জীবনই প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন জটিল নাগরিক পরিবেশ থেকে এই পটভূমির পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। দ্বিতীয় পর্বের ছোটগল্প মূলত সবুজপত্রে প্রকাশিত গল্প। এগুলোর ভাব, বিষয় ও রূপকল্পে সম্পূর্ণ নতুনত্ব লক্ষণীয়। তবে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের আসল পালাবদলের শুরু ‘ষষ্ঠনীড়’ রচনার কাল থেকে। তার উত্তরবঙ্গের জীবন অভিজ্ঞতা নির্ভর গল্প ৫৯টি আর নতুন জীবনবোধে সিদ্ধ গল্প ২৩টি। যেগুলো পরবর্তীতে গল্পগুচ্ছে স্থান পেয়েছে। অবশ্য এরপরেও রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখেছেন, তবে সেগুলিতে রবীন্দ্রমানসের প্রতিফলন ততটা নেই। তবুও বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ।

এবার আসা যাক সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা উপন্যাস প্রসঙ্গে। কিশোর রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীর প্রেরণায় প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন ‘করুণা’। প্রায় বছর খানেক ধরে ‘ভারতী’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে লিখেছেন ঐতিহাসিক, সামাজিক, স্বদেশ চেতনা, রাজনৈতিক, কাব্যোপম এবং রোমান্টিক উপন্যাস। রবীন্দ্র উপন্যাসের ভাষাশৈলী সন্দেহাতীত ভাবে বাংলা সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ। যদিও প্রথম দিকের ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের ভাষায় সাধু গদ্য এবং বঙ্কিমী গদ্যের প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু পরবর্তীকালে তার উপন্যাসে বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখা দেয়। আর এই পরিবর্তন শুরু হয় ‘ঘরে বাইরে’ থেকে। সর্বোপরি, সাহিত্যের যে কোনো শাখার নাম নিলেই চেতনে অথবা অবচেতনে যে নামটি চলে আসবেই… তিনিই আমাদের রবি। যাকে ছাড়া বাংলা সাহিত্যের বিকাশ এবং সমৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব ছিল।।

টিম্বাকতু

1-69

বিস্তির্ণ প্রেইরি নয়-
ছুঁই ট্রপিক্যাল নিষ্পাদক প্রান্তর,
অলসভাবে বহমান নদ-নদী
ধরিত্রীর বুক ছিন্ন ভিন্ন করে বয়ে যায়।

শ্রাবণের প্লাবনে পুষ্টিবর্ধক ভূমি
গুল্ম, ঝোপ, ক্বচিৎ ঘাসে পূর্ণ হয়;
গ্রস্ত উপত্যকা, পর্বত, মালভূমি পেরিয়ে
সতেরোটি নীল পদ্ম এনেছি, চন্দ্রমহিনী।
বহু দীর্ঘ, শীর্ণ, গভীর হ্রদের পদ্ম!

অবিরাম রোদে পুড়ে দগ্ধ হয়েছি,
চির হরিৎ বৃক্ষের নিবিড় অরণ্যে
রেইন ফরেস্ট পেরিয়ে, স্মৃতিধৃত ইতিহাস।
যেখানে বৃষ্টিপাত ক্রমে ক্ষীয়মাণ-
দুটি সমান্তরাল চ্যুতির মধ্যস্থান, টিম্বাকতু।

এক অনন্য দলিল: ২০১৪ তে লিখেছিলেন জিহান আল হামাদী

f71gm4k4

“৭ মার্চ ১৯৭১।
রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চ প্রস্তুত। উপস্থিত সম্মিলিত দর্শক শ্রোতারা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁদের অবিসংবাদিত নেতার জন্য। অবশেষে তিনি এলেন এবং উঠে দাঁড়ালেন জনসমুদ্রের মঞ্চে। তিনি শুরু করলেন। তাঁর প্রতিটি শব্দ আছড়ে পড়তে লাগল, ঢেউ খেলে গেল জনসমুদ্রের মাঝে।
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
তারপর-
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।”

রক্তদানের অহংকারে অহংকারী তাঁর কণ্ঠস্বর, তা শোনাল আশার বাণীও। আর এই আশার বাণী হল স্বাধীনতা, যার জন্য দেশের প্রতিটি জনগন ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে এবং তাঁর নির্দেশনায় দীর্ঘ নয় মাস জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা।

এই অবিসংবাদিত নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিভক্ত ভারতবর্ষের গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি ১৭ মার্চ, ১৯২০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা শেখ লুত্‍ফর রহমান আর মা মোসাম্মত্‍ সায়েরা বেগম৷ পরিবারের প্রথম পুত্র। ৪ বোন ও ২ ভাইয়ের মাঝে তৃতীয় এ সন্তানকে আদর করে ডাকা হতো ‘খোকা’। ছেলেটির ভালো নাম রাখা হয় ‘শেখ মুজিবুর রহমান’।

খুব মোটাসোটা নন তিনি। হ্যাংলা, ছিপছিপে দৈহিক গঠন, তবে সুশ্রী। তাঁর বেড়ে ওঠা শুরু হয়৷ ছায়া-ঢাকা পথ-ঘাটহীন শহর থেকে দূরে নিভৃত পল্লীতে, তাঁর লালিত-পালিত ও পরিবর্ধিত হওয়া। বাড়িতেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি, পণ্ডিত সাখাওয়াত্‍ উল্লাহর কাছে। বড় হতে থাকেন তিনি। সামনের সময় অপেক্ষা করছে তাঁর ইতিহাস হয়ে ওঠার পথের দিকে চেয়ে।

৭ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে তাঁর স্কুল শিক্ষার শুরু গমা ডাংগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯২৯ সালে। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা ছিলেন মাদারীপুর দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার। ১০/১১ বছর বয়সে তিনি পুত্রকে নিজের কাছে মাদারীপুরে নিয়ে যান। সেখানকার মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় চতুর্থ শ্রেণীতে। ১৯৩৬ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন।

মাদারীপুর থাকার সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের বেরিবেরি রোগের কারণে চোখে ছানি পড়ে। শেখ লুত্‍ফর রহমান ছেলেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা. টি আহমদের কাছে নিয়ে যান। সেখানে সফল অস্ত্রপচারের পর তিনি সুস্থ হলেও ডাক্তারের পরামর্শে তখন থেকেই চশমা পড়তে শুরু করেন।

নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়, মিশন স্কুলে ছাত্রদের সভা হবে। এসডিও ১৪৪ ধারা জারি করে সেই সভা বন্ধ করে দেন। ছাত্ররা সমবেত হয়ে মসজিদে গিয়ে সভা করে। শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে দু’একটা কথা বলতেই তাঁকে গ্রেফতার করে সেকেন্ড কোর্টে হাজির করে দু’ঘন্টা আটক রাখা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ ও চাপে শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকেই তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এটাই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের প্রথম গ্রেফতার।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সাথে। পরবর্তীকালে এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।

১৯৪০ সালে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন কাজ শেষে বাংলোতে ফেরার পথে এক ছাত্র তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায়। অকপটে বলে যায়, ছাত্রাবাসের ছাদ চুইয়ে পড়া পানিতে বর্ষাকালে ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হবার ভোগান্তির কথা। তা মেরামতের দাবি জানায় সে। প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাত্‍ তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১,২০০ টাকা মঞ্জুর করেন এবং ছাত্রাবাসটি মেরামত করার নির্দেশ দেন।

সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির সত্‍ সাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হন। পিয়ন মারফত স্লিপ পাঠিয়ে বাংলোতে এনে নানারকম আলাপ-আলোচনা করেন ও প্রীত হন ছেলেটির প্রতি। এই ছেলেটি আর কেউ নয় পরবর্তীকালের অনেক বিদ্রোহের অগ্রপুরুষ ও সময়ের প্রয়োজনে অনেক মহান বাক্য উচ্চারণ করা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি সোহরাওয়ার্দীকে রাজনৈতিক গুরু বলে স্বীকার করতেন। আর শেরেবাংলা পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নাতি’ বলে সম্বোধন করতেন।

১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। তখন থেকেই মুসলীম লীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকেই ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-হাসিম গ্রুপের সাথে তিনি ছিলেন সক্রিয়ভাবে যুক্ত। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত করে।

১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরই তিনি আবার গ্রেফতার হয়ে যান। তাই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবন আর সমাপ্ত হয়নি। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব।

এ বছরের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলীম লীগ” গঠিত হলো। একজন রাজবন্দি হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন। কারাবন্দি থেকেই শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অক্টোবরে আর্মানীটোলা থেকে এক বিশাল ভুখা মিছিল থেকেই গ্রেফতার হলেন মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক আর শেখ মুজিব।

১৯৫২ সাল। তিনি তখনও জেলে৷ ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ তখন উত্তপ্ত। ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনটিকে ঘোষণা করা হলো ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করলে গভীর রাতে কিছু ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেন। শেখ মুজিব কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন।

২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর শহীদ হন। কারাগারে স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাওলানা ভাসানী স্বীয় ক্ষমতাবলে শেখ মুজিবকে আওয়ামী মুসলীম লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯৫২ সালে মহাচীনের রাজধানী বেইজিং নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু, তাঁর মতো শেখ মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন। দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিপরিষদ (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মুজিব ছিলেন দক্ষ সংগঠক। তিনি ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং অগ্রসর হতে সক্ষম হন। সোহরাওয়াদী তখনও রাজনৈতিক দলসমূহ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না এবং এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে সকলের কাজের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিব এনডিএফ ত্যাগের ঘোষণা দেন।

২৫ জানুয়ারি, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সেই সভায় মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবছর প্রথম তিন মাসে শেখ মুজিব ৮ বার গ্রেফতার হন।
এ সময় রাজনৈতিক অঙ্গন অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ৬ দফা প্রকাশ হওয়ায় বাঙালিদের হৃদয়ে আশার নতুন আলো দেখা দেয়। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেসনোটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়। এর পূর্বের ২০ মাসও শেখ মুজিব জেলে আটক ছিলেন।

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি সমাপ্ত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ মামলার অন্যতম প্রধান আইনজীবী ছিলেন। একই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন। এ সময় ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে ঢাকাসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস, কারফিউ, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারায় দেশ অস্থির হয়ে ওঠে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ৷ অবশেষে সরকার ‘প্যারোলে’ মুক্তি নিয়ে শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন। মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নিরঙ্কুশ এ বিজয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ১৯৯টি আসন লাভ করে।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর যে দাবি ভূট্টো করেছিল বঙ্গবন্ধু তার তীব্র সমালোচনা করে তা প্রত্যাখান করেন। ১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত্‍ প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১লা মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা দিলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। দেশ জুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।

রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। এ সেই দিন, যেদিন তিনি প্রদান করেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ। তাতে ছিল নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা।

এরই মাঝে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসে আলোচনার জন্য, যা ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত রেখে হঠাৎ ইয়াহিয়া গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। এদিকে ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা নিরীহ জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করে। গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চিফ মারফত খবর পান ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তিনি দলীয় হাই কমান্ডের নেতা ও অন্যান্য নেতাদের আত্মগোপনে যাবার নির্দেশ দেন। নিজে রয়ে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং পরে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাইকমান্ড গোপনে ভারতে চলে যায়। সেখানে অন্যান্য নেতাদের সহযোগিতায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে সরকার শপথ গ্রহণ করে। প্রবাসী এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা এবং বহিঃর্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, প্রতীক্ষা।

স্বাধীন দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকার তাদের কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ তিনি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এদিন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর শিরোনাম ছিল “ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে৷” দৈনিক পূর্বদেশ- “ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়” আবারও রেসকোর্স ময়দানে এসে দাঁড়ান তিনি। লাখো মানুষ আনন্দাশ্রু ভেজা চোখে তাদের জাতির জনককে বরণ করে নেয়।

এবার তিনি হাত দেন দেশ গঠনে। মন্ত্রী পরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁকে অত্যন্ত প্রতিকূলতা এবং বিধ্বস্ত অবস্থার মাঝে কাজ করতে হয়।

তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি অসংখ্য সমস্যা-সঙ্কুল, সাড়ে ৭ কোটি জনমানুষ অধ্যুষিত দেশের সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু করেছিলেন শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, তাদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, অনাহারি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন যোগান এবং আরো নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়। বিপুল অস্ত্র তখনও দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে রয়ে গেছে। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশ জুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য রক্ষী বাহিনী গঠন করেন। এ পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়। এরই সাথে তাঁর সরকারের মাঝে অবস্থানকারী কতিপয় ক্ষমতালোভী, চাটুকার, স্বার্থলোভীর নির্লজ্জ কর্মতত্পরতায়, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শেখ মুজিবের সাথে তাঁর দুঃসময়ের অনেক প্রকৃত সাথীর দূরত্ব বেড়ে যায়।

এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য শেখ মুজিব একদলীয় ‘বাকশাল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু কোনো সুখকর উন্নতি আসার আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্বাধীনতা বিরোধীদের তাবেদার এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাসী, সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য। এ সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর এক অংশের মাঝে তাঁর উপর পুঞ্জিভূত ক্ষোভের কথা তাঁকে অবগত করেন। কিন্তু তিনি বলতেন-’এরা আমার সন্তানের মতো।’ তাঁর স্বভাব-সুলভ উদারতা তাঁর বিপদ ডেকে আনে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল৷ রাতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সেনারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঘেরাও করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাঁর পুত্র, পুত্রবধু, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনসহ ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া নেওয়া হয় এবং তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ মদদে এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। বাঙালি জাতি চিৎকার করে কাঁদার পরিবর্তে স্তম্ভিত হয়ে যায়। দেশের স্বাধীনতার জনক তাঁর বুলেট বিদ্ধ ঝাঁঝড়া বুক নিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন যে এই মাটিতেই। এ যে লজ্জা, শোক কি তাকে অতিক্রম করতে পারে?

আজ ১৭ই মার্চ, বাঙালি জাতির জীবনের এক আনন্দের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী। আজও আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ দেহ, সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট, পেছনে আঁচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ৷ শুধু সে পাইপ থেকে এডিনমুর’স তামাকের সুবাস বের হয় না।

তথ্যসূত্র :
১. বাংলা পিডিয়া। ২. উইকিপিডিয়া। ৩. “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি” – আমির-উল ইসলাম। ৪. “দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা” – মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নুরুল কাদির। ৫. “পলাশী প্রান্তর থেকে বাংলাদেশ” – খুরশীদ আলম সাগর। ৬. “দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান” – লে. জে.এ. কে. নিয়াজী। ৭. “শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ” – শাহজাহান বিন মোহাম্মদ। ৮. “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” – সিরাজ উদ্দীন আহমদ। ৯. “বাংলাদেশ গড়লেন যারা” – সিরাজ উদ্দীন আহমদ। ১০. “ভুট্টো, শেখ মুজিব বাংলাদেশ” – রাও ফরমান আলী।”

এখনি সময় দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রেমিক প্রমাণ দেওয়ার

202110

কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান কী পবিত্র কোরআন শরীফের অবমাননা করবেন?
কোনো ধর্মপ্রাণ হিন্দু কী তার মন্দির ও প্রতিমাকে অবমাননা করবেন?
না, কেউ করবেন না।
তাহলে পবিত্র কোরআন শরীফ মন্দিরে রাখলো কে?
নিশ্চিত এমন কেউ রেখেছে যারা “ডিভাইড এন্ড রুল” গেম খেলে ফায়দা লুটতে চায়। যারা দেশ কে অশান্ত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়।

এই কুচক্রী দেশ বিরোধী বিদেশী শক্তির দালালেরা নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে ভুল বুঝিয়ে, ধর্মীয় আবেগের টোপে ফেলে মানুষের জানমালের ক্ষতি করতে প্ররোচনা দিতেছে। তারা আপনার আমার সবার শত্রু। এরাই পবিত্র কোরআন শরীফকে মন্দিরে রেখে মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে দাঙ্গা বাধিয়ে মানুষের জান-মাল এর বিনিময়ে রাজনীতি কিংবা স্বর্গীয় টিকেট বিক্রি করে। আপনার আমার আশেপাশে গোপনে ঘাপটি মেরে আছে এই বেজন্মা দেশবিরোধী সকল ধর্মের শত্রু গুলি। এদের অপপ্রচার, উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড হতে নিজেকে দূরে রাখুন।

ধর্ম এবং রাজনীতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিদেশী গুপ্তচর ও তাদের দেশীয় দালালদের প্রতিহত করে দেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান মিলেমিশে থাকার যে ধারা তা অব্যাহত রাখতে ভুমিকা পালন করবো। দেশ আমার এবং আপনার দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব সবার। পৃথিবীতে সাম্যের একমাত্র বীজ বপনকারী আমাদের নবীকে অনুসরণ করে চলি। মতলববাজ, সন্ত্রাসী এবং বিকৃত মনের লোকই অন্য ধর্মের জান-মাল বিনষ্ট করতে পারে। ইসলাম মানা কোনো মানুষ এইভাবে অন্যের মন্দির মূর্তি বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে পারে না। সাম্য ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী সন্ত্রাসী প্রতিহত করুণ তাদের কুকর্মের ভিডিও ধারণ করতেও চেষ্টা করবেন।

Cyber Police Centre, CID, Counter Terrorism & Transnational Crime, Rapid Action Battalion (RAB) Bangladesh এর ম্যাসেঞ্জারে ছবি, ভিডিও পাঠিয়ে সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিন।

আমার প্রথম সিনেমা দেখা এবং বর্তমান চলচ্চিত্রের হালচাল ও সিনেমা হল!

images-6a
১৯৭২ সালে নির্মিতি ছায়াছবি ‘মানুষের মন’ এর পোস্টার। আমার জীবনে সিনেমাহলে প্রথম দেখা ছায়াছবি।

ক’দিন আগে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম আমার বড়দি’র বাসায়। বড়দি’র বাসা থেকে সামান্য একটু দূরেই গুলশান সিনেমা হল। এই সিনেমা হলের সামনে দিয়েই দিদি’র বাসায় যেতে হয়। যখন গুলশান সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যেতে থাকি, তখনই মনে পড়ে গেলো সেসময়ের কথা। যেসময় এই গুলশান সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে আসতাম। একটা টিকেট সংগ্রহের জন্য কতরকম চেষ্টা চালাতাম তা লিখে শেষ করা যাবেনা। তবু লিখবো একসময়ের সিনেমা দেখা আর এদেশে অতীত বর্তমান চলচ্চিত্র ও সিনেমা হল নিয়ে কিছু কথা।

IMG_10082021_143753_(500_x_400_pixel)
কোনো একসময়ের গুলশান সিনেমা হল। এর আশেপাশে সকাল থেকেই থাকত শতশত লোকের আনাগোনা। এখন নীরব, শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সিনেমা হলটির সামনেই ডায়মন্ড সিনেমা হল, সেটিও এখন নেই। ডায়মন্ড সিনেমা হল এখন বহুতল ভবন নির্মাণাধীন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস আমার জন্মেরও ৭/৮ বছর আগের। যেহেতু আমার জন্ম ১৯৬৩ সালে। আর বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ ছায়াছবিটি মুক্তি পায় ৩ আগস্ট ১৯৫৬ সালে। এ অঞ্চলের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করে ‘মুখ ও মুখোশ’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন আবদুুল জব্বার খান। আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগে বর্তমান আজাদ প্রেক্ষাগৃহে (তৎকালীন মুকুল প্রেক্ষাগৃহ) ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। জানা যায়, প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। ছবিটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় একযোগে মুক্তি পেয়েছিল।

IMG_10082021_200544_(500_x_400_pixel)
বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এর পোস্টার। ছবি সংগ্রহ গুগল।

চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে আগে বলতে হয় এর পূর্বসূরি বায়োস্কোপের কথা। যা আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, হাটবাজারে বা কোনো ঐতিহ্যবাহী মেলায় অথবা নিজেদের বাড়ির উঠানে। বায়োস্কোপের সাথে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো বিশেষ কোনোকিছুর দরকার নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আগেপাছে গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে খুবই এক পরিচিত নাম বায়োস্কোপ। শুধু গ্রামেই এর পরিচিতি ছিলনা, শহরের অলিগলিতে আর বিভিন্ন লোকজ মেলায়ও ছিল এর পরিচিতি। ১৯৮০ দশকের পর যাদের জন্ম, তাদের কাছে মনে হতে পারে বায়োস্কোপ একটি খেলনার বাক্স। আসলে তখনকার সময়ে এই বায়োস্কোপ মোটেই খেলনার বাক্স ছিলনা। সত্যিকারার্থে এই বায়োস্কোপেই ছিল তখনকার আমলের গ্রাম বাংলার মানুষের সিনেমা হল। বায়োস্কোপের বাক্সটা মাথায় নিয়ে বায়োস্কোপওয়ালারা হাতে একটা ঝুনঝুনি বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যেত, তখন তার পেছনে পেছনে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বায়োস্কোপ দেখার স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াতে থাকতো।

91662_172
বাংলার বায়োস্কোপ, যা একসময় ছিল গ্রামবাংলার মা-বোনদের সিনেমাহল।

আমি নিজেও কোনো একসময় বায়োস্কোপ দেখার জন্য দৌড়াতাম। বায়োস্কোপ দেখতাম ধান না হয় চাউল দিয়ে। বায়োস্কোপওয়ালা থাকতে থাকতে দৌড়ে আসতাম বাড়িতে। প্রথমে মায়ের কাছে চাইতাম দুই আনা পয়সা অথবা ধান চালের জন্য। মা যদি দিতে অমত করতো, পরে আবদার করতাম বড়দি’র কাছে। ব্যাস, হয়ে গেল বায়োস্কোপ দেখার খরচ। দৌড়ে যাতাম বায়োস্কোপের সামনে। দেখতাম বায়োস্কোপ। এখন আর সেই বায়োস্কোপ চোখে পড়েনা। টিভি, ভিসিডি আর আকাশ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে এই বায়োস্কোপ আজ হারিয়ে গেছে। কয়েকবছর পর হয়তো এই বায়োস্কোপ যাদুঘরে প্রদর্শিত করার জন্যও খুঁজে পাবেনা।

বায়োস্কোপের যুগ শেষ করে আমরা পা রেখেছি চলচ্চিত্রের যুগে। চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় সিনেমাহলে। এই চলচ্চিত্রও কোনো একদিন হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে কালের বিবর্তনের সাথে তালমিলিয়ে। যাক সেটা পরের কথা। এবার আসি নিজের কথায়।

সিনেমা হলে গিয়ে যখন সিনেমা দেখতাম, তখন চলচ্চিত্র কী এবং কীভাবে এর নির্মাণ কাজ তা আমার জানা ছিলনা। শুধু বুঝতাম চলচ্চিত্র হলো সিনেমা মুভি বা ছায়াছবি আর কী? বর্তমান ডিজিটাল যুগের অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে বুঝলাম, চলচ্চিত্র এক প্রকারের দৃশ্যমান বিনোদন মাধ্যম। চলমান চিত্র তথা “মোশন পিকচার” থেকে চলচ্চিত্র শব্দটি এসেছে। এটি একটি বিশেষ শিল্প মাধ্যম। বাস্তব জগতের চলমান ছবি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে বা এনিমেশনের মাধ্যমে কাল্পনিক জগৎ তৈরি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বাংলায় চলচ্চিত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে ছায়াছবি, সিনেমা, মুভি বা ফিল্ম শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। এবার আলোচনায় আসি আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে, কখন শুরু এবং বর্তমান অবস্থা কী?

ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ
জানা যায় ১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়া শিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। উল্লেখ্য তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারী চরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন। ছোটবেলায় আমি নিজেও দেখেছি অনেক যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক। দেখেছি সেসব যাত্রাপালায় ও মঞ্চনাটকে কোনো মেয়ে নায়িকা ছিলনা। অভিনয়ে যারা ছিল সবাই পুরুষ। ম্যাকাপ আর পরচুলা ব্যবহার করে মেয়ে রূপধারণ করে সেসব যাত্রা আর মঞ্চনাটকে অভিনয় করতো পুরুষেরা। আমি যখন কক্সবাজার সংলগ্ন মহেশখালী লবণের মিলে চাকরি করতাম, তখন সেই মিলে আমরা শ্রমিকেরা যাত্রাপালা করেছিলাম। যাত্রাপালার নাম ছিল ‘চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে’। সেই যাত্রাপালায় নায়িকা চাঁদ কুমারীর অভিনয় করানো হয়েছে মিলের এক ২০ বছর বয়সী ছেলেকে দিয়ে। এমনভাবে মেকআপ করা হয়েছে, কেউ ধরতেও পারেনি যে এটা পুরুষ। পরদিন এলাকার সবাই আমাদের জিজ্ঞেস করছিলেন, এই নায়িকা আমরা কোত্থেকে এনেছিলাম। সেসব এভাবেই পুরুষদের দিয়েই মেয়েদের কাজ সামলানো হতো।

১৯৫৬ সালের কোনো একসময় আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির মধ্যদিয়ে শুরু হয় এদেশের চলচ্চিত্রের পথচলা। পরিচালক নাকি নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু, পরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এর উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিরাট ভূমিকা পালন করে।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর ‘আকাশ আর মাটি’, মহিউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’, এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর দশকে নির্মিত পাঁচটি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন। অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শুদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। বেবী ইসলামের ‘তানহাও’ উর্দু ভাষার নির্মিত। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। জানা যায় উইকিপিডিয়া থেকে।

১৯৭২ সালে মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এফডিসি থেকে মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি ‘মানুষের মন’। এতে অভিনয় করেন নায়করাজ রাজ্জাক, ববিতা ও আনোয়ার হোসেন। আমার বয়স ৮/৯ বছর। অর্থাৎ ১৯৭২ সাল, দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের একবছর অতিক্রম করছিল। সেসময় আমরা সপরিবারে আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে থাকি। বাবা আর বড়’দা থাকতো নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিলে। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ভালমন্দ বুঝার একটু-আধটু জ্ঞান তখন আমার হয়েছিল। একদিন আমার মাসিমা আর বড়মামা আমাদের বাড়িতে এসেছিল বেড়াতে। বড়মামাকে দেখে আমরা বাড়ির সবাই মামার কাছে আবদার করলাম সিনেমা দেখার জন্য। আমাদের আবদারে মামা রাজি হয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চৌমুহনী দর্পণ সিনেমা হলে নিয়ে যায় সিনেমা দেখানোর জন্য। আহ! কী আনন্দ সবার, সাথে মা, মাসিমা, আমার জেঠিমা, কাকী, দুইজন বড়দিদি। সকাল ৯ টায় মর্নিং শো, ছায়াছবি ‘মানুষের মন’।

তখন নোয়াখালীর দর্পণ সিনেমা হল ইট সিমেন্টের ছিলনা, ছিল টিনের বেড়া। মামা সবার জন্য টিকেট কিনে এনে সবাইকে নিয়ে সিনেমা হলের ভিতরে সিটে বসালো। সবাই সিটে বসলেও আমার ভাগ্যে আর সিট জুটেনি, আমি আমার মায়ের কোলেই বসে থাকলাম। তখন টাকার খুব দাম! সবাইকে সিনেমা দেখানো তো মামার দম যায়যায় অবস্থা। সিনেমার শো শুরু হলো, সিনেমা দেখলাম।

তার কিছুদিন পর আমরা সপরিবারে নোয়াখালী থেকে ঘরবাড়ী নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে চলে আসি নারায়ণগঞ্জে। বড় হতে থাকি আরো দশজন ছেলেপেলের সাথে হেসেখেলে। অনেক ছায়াছবি দেখেছি টেলিভিশনে আর সিনেমাহলে গিয়ে।

p20170604-1824272
আমাদের চৌধুরীবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে প্রথমেই চোখে পড়ে ‘নিউ মেট্রো সিনেমাহল’ এটিও এখন বন্ধ। আগে সবসময় ছিল লোকে লোকারণ্য, এখন নীরব নিস্তব্ধ।

সেসময় একটা ছায়াছবি মুক্তি পাওয়ার একমাস আগে থেকে রেডিও টেলিভিশনে এডভার্টাইজিং করা হতো। মানে রেডিও টেলিভিশনের ছায়াছবির আংশিক সংলাপ ও কিছুকিছু গানের প্রথমাংশ শোনানো হতো। এর কারণ ছিলো সিনেমায় দর্শক বাড়ানো। তখন এমন একটা সময় ছিল যে, সিনেমা সবার কাছে ছিল গ্রহণযোগ্যতা। সিনেমা মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই একসাথে সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ করতো। তখন মানুষের মনে সিনেমা ছিল আনন্দের, শখের। আস্তে আস্তে সেই আনন্দ আর শখ নষ্ট হতে শুরু করে যখন ভিসিয়ারের আগমন ঘটে।

বেশিরভাগ মানুষ তখন ভারতীয় ছায়াছবির দিকে ঝুকে দেশীয় বাংলা ছায়াছবি থেকে মুখ ফেরাতে থাকে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনগণ কেন সিনেমা হল বিমুখী হলেন, তার একটা কারণ মোটামুটি সবারি জানা। এর কারণ শুধু একটাই। আর তা হলো ভিসিআর, স্যাটেলাইট চ্যানেল এর আগমনের পাশাপাশি দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে যখন সামাজিকতার ছোয়া ওঠে গেলো। আর ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশের ডিসএন্টেনায় সরাসরি দেখার সুযোগে সৃষ্টি হলো, তখন থেকে বাংলাদেশী দর্শকশ্রেণী আস্তে আস্তে দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে বিমুখ হতে শুরু করলো। এর ফলে দেশীয় চলচ্চিত্র হলো সবার কাছে একরকম অবহেলিত। আর দেশীয় চলচ্চিত্রের দৈন্যদশার যাত্রা হতে থাকলো শুরু।

আমাদের দেশের মানুষ যখন হল বিমুখী হওয়া শুরু করলেন, ঠিক তখন থেকেই সিনেমার সাথে সাথে হলগুলোর পরিবেশও খারাপ হওয়া শুরু করলো। অবস্থা এতটাই খারাপ হল যে, আমি নিজেও যদি কোনোদিন সিনেমাহলে যাই, তাহলে অন্তত কয়েকবার এদিক সেদিক ভালো করে দেখে নেই, কেউ আবার দেখে ফেললো কিনা। তাহলে তো বিপদ! মানে মানসম্মান যাবে যাবে বলে অবস্থা। আবার হলে গিয়ে সিটে বসে যদি দেখি পাশের সিটে বসা আমার ছেলের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, তাহলে তো একেবারেই মানইজ্জত শেষ হবার পালা!

p20170604-182356
চৌধুরীবাড়ি ‘বন্ধু সিনেমাহল’ গত কয়েক বছর আগে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। এখন এই বন্ধু সিনেমা কমিউনিটি সেন্টার।

এর কারণ হলো বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের নাম যদি হয় নগ্ন হামলা, খাইছি তোরে, বোমা হামলা, লাল কোট কালো চশমা ইত্যাদি ইত্যাদি, তাহলে বুঝাই যায় যে এসব ছায়াছবিতে কী দেখাবে। ছবিতে দেখা যায় বিশ্রী ভাষায় গালাগালি, অর্ধনগ্ন পোশাকে নাচগান আর কাটপিসের ছড়াছড়ি। আবার খ্যাতিমান নায়ক-নায়িকাদের দেশত্যাগ ও চিত্রজগত ছেড়ে দেওয়া, নায়ক-নায়িকার অভাব। বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্র শুধু শাকিব নির্ভরই বলা চলে। তিনি ছাড়া আর গুটিকয়েক তারকা হয়তো আছে এদেশের চিত্রজগতে।

তাহলে বোঝাই যায় বাংলা চলচ্চিত্রের হালচিত্র বুঝতে মোটেই বেগ পেতে হয় না। যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মতো করে সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা না হয়, তাহলে আর কখনো বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী সুদিন ফিরে আসবে না বলে মনে হয়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ হয়তো একদিন সিনেমা হলের কথাও মনে রাখবে না। এই সময়ের মধ্যেই কিন্তু মানুষের মন থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে বাংলা ছায়াছবি দেখার ইচ্ছা আর স্বাদ ও আনন্দ। বেশিরভাগ সিনেমাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকের অভাবে। অনেক সিনেমা হলের নাম চিহ্নও নেই। যা-ও আছে, তা কেবল গুটিকয়েক।

দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে তো এই অবস্থা চলছেই, প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রায় সবগুলো সিনেমাহল এখন আর নেই। কোনোকোনো সিনেমাহলের জায়গায় এখন সুবিশাল মার্কেট, নাহয় গার্মেন্টস। বুঝি করারও কিছুই নেই! দর্শক ছাড়া মাসের পর মাস সিনেমাহলের কর্মচারীদের বেতন, নানাবিধ খরচাদি বহন করা মালিক পক্ষের দ্বারা সম্ভবও নয়। যদি সিনেমাহলে দর্শকই না আসে, তাহলে হল মালিকরা তা পোষাবে কি করে? যারা দর্শক, তারা তো আজ ডিশএন্টেনা সহযোগিতায় ঘরে বসেই দিনেরাতে শ’খানেক ছায়াছবি দেখতে পারে। তাহলে কষ্ট করে হলে যাবে কেন? আর আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে তো আগের মতো সামাজিক কাহিনী নেই। আছে ডিজিটাল যুগের ফুফা আর নগ্ন নৃত্যের ঝলকানি। যা সপরিবারে একসাথে বসে দেখা যায়না।

একটা সময়ে অশ্লীল চলচ্চিত্রের দৌরাত্ম্য দেখা গিয়েছিল যে, সেই দুর্গন্ধটা যেন আজীবন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের গায়ে থেকেই গেল। সেই দুর্গন্ধ দূর করতে হলে চাই সুস্থ্যধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তৈরি চলচ্চিত্রগুলি অনুসরণ করা, নতুন নতুন নায়কনায়িকা খুঁজে বের করাও জরুরী। তা নাহলে এদেশ থেকে একদিন বাংলা চলচ্চিত্রের নাম মুছে যাবে। সেই নাম আর কোনোদিন জেগে উঠবে না। তাই ভাবি আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি কবে দেখব? নাকি সেই দেখা এই জন্মেও দেখা হবে না। যেসব সিনেমাহল বিলুপ্তি হয়ে গেছে, সেই পরিমাণ সিনেমাহল কী এদেশে আর কখনো গড়ে উঠবে? নাকি যেগুলি আছে সেগুলিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে?