চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

ছায়া, দগ্ধের ওপরে

এক
এ-জীবন কোনও কিছুর অপেক্ষায় রাখো
ছাদ-অপেক্ষায় রাজমিস্তিরি,
বাঁশি থাকে হাওয়া-সাধনার…

কখন ভাসানে ক’রে রোদ উঠে গেল
তুমি ব’সে আছ, মেরুদণ্ডে বেঁধানো কুঁড়িটা

একটা পুজোর গান অপেক্ষায় রাখত গোটা পাড়া
একটি শাড়িনী রাস্তার চৌমাথাভরা ইয়াং ছেলেদের।
তেমন আতিথ্য নিয়ে জলের পিঠে দাও
ছোট হাতের ভরসা
ঘাসের হাড়ে যেন ফের ঘাস না গজায়
সন্ধে আসে জীবন-অনুভূমিক

দুই
সন্ধে নেমে আসার পদ্ধতি আমি দেখেছি কাছ থেকে
দিনকে কমিয়ে ডীম ক’রে আকাশের হাতে
তুলে দেওয়া — মা-দিদিমা বাসনমাজার থালা ডোবালে জলের মধ্যে, কাঁসাপেতলের মুদিত চোখ পেছন-পেছন ঘাটে আসা আমাদের যেটুকু দেখেছে
তেমন সাপের তলপেট, চাঁদ থেকে লাফ দিচ্ছে
সন্ধের ক্রশিং
যেন কোথাও জাগ দেওয়া ছিল কুচিকুচি
সজনে পাতার নিচে, এখন সুরৎ বোম্বাই
সা-নি-ধা নামছে, “আহা কোন বাগানে ছিল”
বলছে সন্ধের হকার, আমাদের সন্ধ্যাতারাবাবু

তিন
আমি সন্ধে নামাই সমুদ্রবেদিতে
অভাবে পুষ্কর, ডোবাও চইলবেক
চারিদিকে বনগন্ধ পরাক্রম, “ও আমার
দলে খেলবে” ব’লে ইলেকট্রিক খুঁটিকে
গাছ বানিয়েছে জার্মানিলতা
উল্কাসনে ব’সে এক-তরোয়ালে চিরে দিচ্ছি
আকাশের পেট থেকে জমির নাবাল
চুঁয়ে নামল কালো প্রস্ফুটিত
পাটগন্ধ, পাটশব্দ, একমুঠো ধুলোর তণ্ডুল…

আমি সন্ধ্যা নামাইয়া থাকি

.
[‘নবরত্ন কারাদণ্ড সবুজ’ বইতে আছে]

ওহে জয়দেব

এক
মাটি থেকে ছিটকে উঠে মাটিতেই ভেসে যাবে,
জানা।
ঝরনা হল মাথার পাগড়ি, তাতে গোঁজা ময়ূরের ডানা
ঝরনার কোমরে বাঁকা নদী, চার চাঁদের আলোয় ঝলসাচ্ছে কাজল
ও মন ময়না ময়না ময়না… কৃষ্ণকথা বল

দুই
আমার যে ভবঘোরা — সুন্দর হবে
বনপাস স্টেশনে আচমকা ট্রেন থেমে গেলে
ব্যাগ থেকে বের করব রিভল…, নাহ বিস্কুট
কষ্টের নাড়িভুঁড়ি দুহাতে ভেতরে ঠেলে
গুণছুঁচ দিয়ে খুলি সেলাই করেছি
এবার এক প্যাকেট সবুজ আমলকি… খুচরো পয়সা
মেঝেয় ফেলে দিয়ে হকার মেয়ের পা ছোঁব।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান থাকবে এ-জীবনে;
প্রুফে একটা বানান ভুল তন্ন তন্ন করার মতো
আমি খুঁজব প্রেম…

খুঁজতেই তো এসেছি

তিন
সে গৌরহরি সেবাশ্রমই হোক, কি
পবন বাউলের আখড়া
আমাকে দুপুরদুপুর ভাতে বসিয়ে দাও
সে হোক অজয়ে সোয়া-নগ্ন মেয়েবউ, কি
লোভে ফাজিল সাধু
আমাকে ঘুরঘুর করাও গাঁজাকলকের চারপাশে
গোল অন্ন-মুগডাল গোল পাতে
গোল ডাবুহাতায় বিতরণ করো
সে ফানাফানা কলার কাঁদি হোক, বাস্‌নায় জড়ানো,
মুসলমান কুটুমবাড়ি নেবে
কিম্বা দুশোমতো কুঠোভিখিরি
নদীকাটা দুধারি রাস্তায়;
আমাকে ভ’রে উঠতে দাও কান্নাসজলে

যেটুকু যাবে, তার সঙ্গে অবশিষ্ট উব্‌জে চলে যায়
তারপর যাবজ্জীবন আমার পরিবেশনা
আর তোমাদের ‘দারুণ খেলাম’!

দাঁড়াও, আগে নিজে মুগ্ধ হয়ে নি’

চার
তোমাকে কৃষ্ণনগরে দেখেছি না, দাঠাকুর?
আমি রবি, বউ খুঁজে পাচ্ছি না, সেবাইতকাকা।
জয়দেব-পদ্মাবতী মিলনমন্দির থেকে নেমে
আমরা আলাদা হয়ে গেনু। মেলায় পুলিশ আছে
নাম জিগ্যেস করার জন্যে। লিখে নিয়ে
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাইকে অ্যালাউন্স ক’রে দেবে।
কিন্তু বউটা বড় কাঁচা আমার, পূর্ণিমা।
এবারে যে-সে ডাক দেবে — পূর্ণিমা ধীবর,
এদিকে এসো; পূর্ণিমা ধীবর, চলো আমার সঙ্গে…

বউ হারিয়ে গেছে, ফিরে পাব
চলে গেলে আর ফেরত আসবেনি

পাঁচ
গৌরীদাসের সঙ্গে চৈতন্যের মিলন হল কোথায়?
কেউ বলছেন শ্রীখণ্ডে, কেউ কাটোয়ায়,
কেউ বা মাধাইতলা। আমরা বলি,
স্থান গুরুত্বের নয়, কথা হল কাল।
কোন কালে দেখা?
যেথা যেথা নিত্য হরিনাম সংকীর্তন।
সেথায় নিত্য নবদ্বীপধাম, নিত্য বৃন্দাবন।।

গোরাচাঁদ নিত্যানন্দাদি বন্ধু ও শিষ্যদের নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন, বদনে হরিনাম — এমনি সময়ে গৌরীদাস উপস্থিত। তাকে দেখতেই গৌরাঙ্গের মনে পড়েছে শ্রীরাধার কথা। কেননা,
এই গৌরীদাস তো আর কেউ নন,
তিনি বৃন্দাবনের সুবল। মহাপ্রভু গৌরীকে জড়িয়ে ধ’রে “রাধা রাধা” ব’লে উচ্চস্বরে…

আহা, সে কী অশ্রু! কোনও ভক্ত বলছেন
প্রভুর দু’চোখ বেয়ে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে। আবার কোনও ভক্ত — না না, গড়িয়ে পড়ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভক্তিরূপ গাল বেয়ে মুক্তি গড়িয়ে পড়ছে গো!

.
[প্রথম অংশ। ‘ভুবনভোজন চলছে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে।]

প্রাইভেট ফার্মে এটা হবে

এক
আমার ভালোবাসার সামনের দুটো দাঁত ফাঁকা
ভালোবাসলে বীভৎস দেখায়!

দুই
ইরানি ট্রফির প্রথম পনেরোতেও যেদিন আস্তানা দিলে না, তবে থেকে ঘুমের হসসোউকার
খুলে হাওয়া। আজ অবসর ঘোষণার পর যন্ত্রণায়
দাঁড়ি পেল মুটিয়া মন

শুধু ভারি চোখদুটো
শুক্রথলি ভারি হয়ে আছে

তিন
আমার লাইফ রজনীকান্ত্‌
একমুখ দাড়ি কেটে চুলটা একটু ফুলিয়ে নিলেই
ছাপ্পান্ন সপ্তাহ
কিন্তু আসলে ফাঁকা বাড়িতে একা
খালি পেটে শুয়ে থাকে রজনীকান্ত্‌
তাকে কেউ ভালোবাসে না (না-টা ইকো হবে)

জ্বলন্ত সিগারেট ডিগবাজি খেয়ে নামছে
পেট্রোলসাগরে

চার
তুমি হাই-প্রোফাইলের কাছে গেছ
এই সপ্রতিভ যাওয়া তোমাকে জীবনের
‘কভি গম’ অংশটুকু দেবে না
তুমি আকর্ষণীয় চোখ, দারুণ পিআর
আর দিনে পঞ্চাশটা পুশ আপের কাছে…
একটা জব হাতে থাকতেই
বেটার অপশানে চলে গেছ

প্রাইভেট ফার্ম বলেছে কেন, বস!

পাঁচ
ও-জানোয়ার তোকে বিখ্যাত ক’রে গেল
বুঝতে পারছিস না?
রেসিপি খসছে না হৃদয় থেকে?
এই সুযোগ, দুর্দান্ত সব আইটেম নামা, চন্দন!
ফুসফুসে আইসক্রিম জমিয়ে শিরায়
গাজরের স্টু সাজাবি, আর কাঁদতে কাঁদতেই ব্যালাডের সুরে ঠোঁটের স্যালাড কুচিয়ে নে
কতদিন রক্তেমাংসে ট্রিট দিসনি আমাকে, বাবুজান

ছয়
এই প্রেম বারোমাস
এই প্রেম চিরদিনের
আমি বনগাঁ লাইনের সেই দৃষ্টিহীন প্রেমিক
তবে ইশারা করলে দিতে পারব না
হাত বাড়িয়ে স্পর্শ ক’রে চেয়ে নেবেন

আমিই সে
প্রতিদিনের পরিচিত
সোনামুগ ডালে কাঠকয়লার আঁচে তৈরি
বাংলার ঝিরিঝিরি নিজস্ব ভালোবাসা

আছি, বলবেন

.
[‘সহ্যকে যন্ত্রণা করি’ বই থেকে]

রবীন্দ্ররচনা বলি

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে তুমি একটা কথা কিছুতেই শুনতে পাচ্ছ না উদাসীন যে পাঁচ হাজার টাকার কমে পাঁচজনের সংসার চলে না। প্রণামীর খুচরোয় রোজকার সবজি-বাজারটা হতো, হারামির হাতবাক্স বসিয়ে সেও মন্দিরকমিটি খেয়ে গেছে

এদিকে গত বছর দিব্যি আকাশভরা সূর্যতারার মধ্যে বাবার স্ট্রোক হয়ে গেল। পুঁজিপাটা খুইয়ে পাথুরিয়াঘাটায় মালিকের বাড়ি গিয়েছি — দেখি পাইকা হরফের ওপর গণেশের বাহন অধিষ্ঠান, মালিক প্রেসের মেশিন বেচে ভাড়াটে বসাবে। ফিরে এসে তিন দিন মুখ খুলি না, কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালাব ভেবে ভেবে শুক্কুরবার সাইকেলে ফের দত্তবাড়ির নিত্যপুজোয় বেরিয়ে তো-ছি, এখন ডানহাতে প্যারালিসিস শালগ্রামশিলা আর বাঁহাতে হ্যান্ডেল ধরলে ব্রেক নেই, বাকশক্তি থেকেও রহিত… তা যা হবার তাই হবে — রব্বা রব্বা অ্যাক্সিডেন্ট হবে

এর চেয়ে বড় শট খেয়েছি ছোটবেলায়, ইলেকট্রিকের কাজ করতে গিয়ে। কাল যখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টেনেহিঁচড়ে আনছ তোমরা, তার মধ্যেই ভেবে নিলাম, আবার নিলামে উঠে কারেন্টের মিস্ত্রি হয়ে যাব, গোলকিপার হয়ে এবার সব শট আটকে দেব রোনাল্ডো-রিভাল্ডোর। আজ এই ব’লে তোমার জ্ঞানচক্ষুর শাটার তুলে দিয়ে যাচ্ছি উদাসীন যে, তু-মি যা-রে জা-নো সে তো কেহ নয়, আমরাই ‘বিশ্বকবি’ সিনেমায় নায়কের স্টান্টম্যান সাজি রোজ, ধ্রুবকাল…

.
[‘জগৎমঙ্গল কাব্য’ বই থেকে]

মাদারিং সানডে

images এক
ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ারের পটভূমিতে লেখা গ্রাহাম সুইফটের উপন্যাস ‘মাদারিং সানডে’। নাম না বদলে সিনেমা করেছেন ইভা হাসন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে দশ বছর হল, কিন্তু তার ছেটানো রক্ত লেগে নাগরিকের জীবনে। শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত নিভেন-পরিবারের সন্তানেরা যুদ্ধে নিহত, তাদের বন্ধু শেরিংহাম ফ্যামিলিতে শুধু বেঁচে আছে পল নামের ছেলেটা।

১৯২৪ সালের মাদারিং সানডে, এদিন বাড়ির প্রত্যেক কাজের লোককে ছুটি দেওয়ার নিয়ম যাতে তারা নিজেদের মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। নিভেন-পরিবারের হাউজমেড জেন ফেয়ারচাইল্ডও ডে-অফ পেয়েছে, যদিও জেন অনাথ, দেখা করার মতো মা নেই তার। দিনটাকে উদ্‌যাপন করার জন্যে নিভেনরা প্রতিবেশী শেরিংহাম আর হবডে-দের সঙ্গে মিলে পিকনিকের ব্যবস্থা করল।

এদিকে, পলের সঙ্গে জেনের গোপন যৌনসম্পর্ক। জেন ভালোবাসে তাকে। লন্ডনের আইন-কলেজের ছাত্র পল “পড়ার চাপ, একটু পরে যাচ্ছি” ব’লে আপ্‌লি টাউনে নিজের বাড়িতে একা থেকে গেল আর চুপিচুপি ডেকে নিল জেনকে। দুজনে গভীর শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় কাটাচ্ছে কয়েকটা ঘন্টা।

দুই
একশো বছর আগে ইংল্যান্ডের কাউন্টির সৌন্দর্য এই ছবির প্রথম তুক। সমান ক’রে ছাঁটা ঘাসের লম্বা মাঠ, ফুলগাছে সাজানো ফার্মহাউজ, পেশি-ঝলসানো ঘোড়ার চারণভূমি দেখতে দেখতে ইয়োরোপের সুস্বাদু শীত অনুভব করা যায় নিজের জিভে। আর অভিজাততন্ত্রের রেশ টেনে চলা ধনী ব্রিটিশদের বাড়ির ভেতরটাও যেন ঈশ্বরের মতো — পুরনো, সুমহান, নড়চড়বিহীন।

পল চড়ুইভাতির জন্যে রওনা হলে নগ্ন তরুণী সেই বাড়ি ঘুরে ঘুরে দ্যাখে। গোঁফদাড়িভরা তেলরঙের পূর্বপুরুষ পার হয়ে আলমারি খুলে পলের পোশাকের গন্ধে বিভোর হয়, পৌঁছোয় পারিবারিক লাইব্রেরিতে — চামড়ায় বাঁধানো, নিশ্ছিদ্র সার দেওয়া বইয়ের আবলুশ যক্ষপুরী। বেরোনোর আগে পল ব’লে গেছে এমা হবডে-র সঙ্গে তার আজ এনগেজমেন্ট, যে-এমা পলের বন্ধু ও নিভেনদের ছেলে জেমসের বাগদত্তা ছিল। প্রেমিকের সঙ্গে নিজের বিয়ে সে কল্পনাতেও আনেনি, তবু খবরটা শোনার পর জেন ক্যামন ভ্যাবলা মেরে গেছে। পল বলছিল, আমরা দুজন সারা জীবন খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকব, কেমন? জেন মরা চোখে তাকিয়ে পুতুলের মতো ঘাড় নেড়েছে। পলের সিগারেটের নেশা, কিন্তু এ-পর্যন্ত একটাও স্টিক না-ধরানো জেন পল-বিদায়ের পর থেকে নন-স্টপ ধোঁয়া টেনে যাচ্ছে (সিনেমার শেষ পর্যন্ত তার ঠোঁট থাকবে সিগারেটে)। এবং সে আর পোশাকও পরছে না (কী আসে-যায়)! আমরা যারা ছবির শুরুতে লিংকনশায়ারের ল্যান্ডস্কেপে রঙিন বৃক্ষবসন্তে ডুবে গেছিলাম — বাড়ির ভেতরে নিষ্পত্র ওকগাছের মতো, বরফভাসা ঝর্নাজলের মতো বাদামি খোলা চুলের আর এক প্রকৃতিকে দেখি। যৌবনের আদুল পরমাকৃতি যতদূর বিষণ্ণ হতে পারে ততখানি ফুঁপিয়ে ওঠে সংগীত-পরিচালক মরগ্যান কিবি-র পিয়ানো। কিছুক্ষণ পরে জেন আপ্‌লি থেকে নিভেনদের বাড়ি ফিরে যায় এবং শোনে পল গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। এবার তার দ্বিতীয় পরীক্ষা। উচ্চবংশীয় প্রেমিকের বিয়ে মেনে নিতে হয়েছিল, এখন সে মরে গেছে জেনেও আকাশ চুরমার করা কান্না গিলে ফেলতে হবে।

তিন
এই ছবির প্রথম অংশে ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে তাক লাগানো নিসর্গদৃশ্য আর নারীশরীরের উদ্ভাসে, দ্বিতীয় অংশে বিদ্যুৎগতিতে এসেছে-গেছে ফ্ল্যাশ ব্যাক আর ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড।

জেন অসম্ভব পড়তে ভালোবাসে। তাকে একবার নিজের বাড়ির লাইব্রেরিতে স্টিভেনসনের কিডন্যাপড-এর পাতা ওলটাতে দেখে ফেলেছিল হতবাক নিভেন-কর্তা গডফ্রে। পল চলে যাওয়ার পরে সে পরিচারিকার পেশা ছেড়ে একটা বুকশপে কাজ নেয় এবং লিখতে শুরু করে। ওই দোকানেই বইয়ের তাকের গলিঘুঁজিতে জেনের পরিচয় দর্শনের ছাত্র অনুভূতিপ্রবণ কালো যুবক ডোনাল্ডের সঙ্গে। তাদের ভালোবাসা এবং বিয়ে হল। সে জেনকে জিগ্যেস করেছিল, তোমার লেখক হওয়ার পেছনের কারণ কী? জেন বলে, তিনটে। এক : তার জন্ম (না হলে লিখত কী করে?), দুই : টাইপরাইটার উপহার পাওয়া, তিন… তিন… তিন নম্বরটা থাকগে। ডোনাল্ডের ধরা পড়ল দুরারোগ্য ব্রেন টিউমার। মৃত্যুশয্যায় সে তৃতীয় কারণ জানতে চাইলে বউ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল — আমি তোমাকে ভালোবাসি।

পরের ঘটনা সামান্য। জেন বড় লেখক হল, বৃদ্ধ হল (অভিনয়ে গ্লেন্ডা জ্যাকসন), প্রচুর পুরস্কার জুটল তার। এমনই এক স্বীকৃতি পাওয়ার দিন সাংবাদিকেরা বাইট নিতে এসেছে, এই দৃশ্যে সিনেমা শেষ।

চার
এ-ছবিতে খল নয় কেউ, পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী যেন, শুধু শ্রেণিপার্থক্য বয়ে আনে দুঃখঅপমান। পল জোর ক’রে প্রেমিকাকে বশ করেনি, ক্যাপ পরলে গর্ভধারণ এড়ানো যাবে শুনে মেয়েটি চোখ কপালে তুললে সস্নেহে বলে, তোমার ইচ্ছে না হলে থাক। তখন মনে পড়ে, জেনের মাও গর্ভবতী পরিচারিকা ছিলেন। এদিকে, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পলের এমাকে বিয়ে করতে হচ্ছিল, তাই তার মৃত্যু আদতে আত্মহত্যা কিনা এটা বারবার ভাবিয়েছে গডফ্রে নিভেনকে। আবার গডফ্রে-র স্ত্রী ক্ল্যারি যখন কাঁদতে কাঁদতে জেনকে চুমু খাচ্ছে, বলছে, তোমার সৌভাগ্য তুমি জন্ম থেকে অনাথ, আত্মজন নেই ব’লে বিচ্ছেদকষ্টও নেই (You’re comprehensively bereaved at birth — ঠিক এই বাক্যটা), তখন জেনের সঙ্গে আমরাও চমকে উঠি! তাই কি হয়, মানুষ তার দীর্ঘ জীবনে কত অপরিহার্য সংযোগ তৈরি ক’রে বসে, সেসব কি রক্তের বাঁধনের চেয়ে কিছু কম? এভাবে অভিজাত আর নিম্নবর্গের শোকস্রোত পাশাপাশি বয়ে যায়, কেউ কাউকে বুঝতে পারে না।

কত কত স্মরণযোগ্য দৃশ্য আছে ছবিতে! ঘন্টা-বাজা এক মিষ্টি চার্চ থেকে বেরনো নতুন দম্পতিকে দেখে জেন জিগ্যেস করছে, ওরা কি সব সত্যি বলবে একে অন্যকে? অথবা জেনের শরীর উন্মোচিত করতে করতে পল হাসিমুখে : You are slightly interesting than law books, বা ওই দৃশ্যটা যখন আদরকালীন জেন প্রেমিককে গুনগুনিয়ে বলল, তোমার বীজ মাটিতে ফ্যালো, আমরা দুজন তাতে সার-জল দেব, গাছ বড় হবে। আবার, আপ্‌লির বাড়ি থেকে বেরনোর আগে ফুলদানি থেকে একটা হোয়াইট ক্রিম ছিঁড়ে বুকের ভেতর ভ’রে নিল জেন। কিম্বা ধরো, এক পলকে গা কাঁপিয়ে দেওয়া খবরের কাগজের হেডলাইন — প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ছ’লাখ ব্রিটিশ সেনা মারা গেছে!

এত নিখুঁত চিত্রনাট্য, এমন যত্নে বানানো ফিল্ম, পর্দায় সিগারেটের প্রত্যেক টানে শুকনো পাতা পোড়ার শব্দ। যেমন ‘অভি’ থেকে ‘নয়’ আলাদা হওয়ার নয়, আমার কাছে জেন মানেই ওডেসা ইয়ং। আবার, নগ্ন প্রেমিকের ধাপে-ধাপে পোশাকে সেজে ওঠা দেখে জোশ ওকনোর ছাড়া আর কাকেই বা সে বলত, তুমি বড্ড হ্যান্ডসাম? তেমনি শোপে ডিরিসু ছাড়া আর কারও মুখেই মিলত না উদারতা-সারল্য-প্রজ্ঞার থ্রি ইন ওয়ান।
তবু ছবির শেষ পর্যন্ত জেগে থাকে জেনের লেখক হওয়ার তৃতীয় অজুহাত… তারপর দেখি এক স্বপ্নদৃশ্যে পল জেনের পাশে ব’সে বলছে : তোমার লিখতেই হবে। আমার জন্যে এই অতীত পুনর্নির্মিত করো। তোমার নিজের জন্যেও।

সেই মুহূর্তে আরও একবার মনে হয় — আমাদের কীই বা করার আছে, এই ক্ষুদ্রমহৎ জীবন লিখে যাওয়া ছাড়া — যতদিন না ঘরের টেলিফোনে বাইরের অনন্ত ডাক পাঠায়, যে-শব্দে জেনকে তার প্রেমিক ডাকত। বৃদ্ধ জেনের পাদুটো আজও সেই বাজনা শুনলে থামে, কথা মুছে দিয়ে স্তব্ধ হয় সে।

শ্রেষ্ঠ শিল্পও দর্শককে এভাবে বারবার নিথর করবে।

mot

[সিনেমা : মাদারিং সানডে। কাহিনি : গ্রাহাম সুইফট। পরিচালনা : ইভা হাসন। ক্যামেরা : জেমি রামসে। সুর : মরগ্যান কিবি। অভিনয় : ওডেসা ইয়ং (জেন) , জোশ ওকনোর (পল), শোপে ডিরিসু (ডোনাল্ড)। মুক্তি : কান চলচ্চিত্র উৎসব, ২০২১। সময় : ১০৪ মিনিট। দেশ : ইউকে।]

হে আমার সন্ন্যাসীরা…

আজ আপনাদের এই শেষ কথা বলার ছিল যে,
দর্শনের গতি চক্রাকার
রাতের জুঁইফুল, তবু সারাদিন যে-গন্ধের শবদেহ
বয়ে বেড়াতে হবে তার নাম যৌনতা
পা টলমল করছে, অথচ মাথা নীচু
সে হচ্ছে সন্তান

একদিন দৈবাৎ গেলাস উঁচু ক’রে জল খেতে গিয়ে
মানুষের চোখে আকাশ পড়ে গেছে
ওমনি আকাশ-সাঁতলানো হাওয়া নেমে এসে
কিছুটা কচুপাতার চিবুকে, তো কিছুক্ষণ ফুসফুসে
আর বাকি অংশ সাইকেলের গতির ভেতরে।
জানানোই শ্রেষ্ঠ জানা ভেবে মানুষ বাক্য লিখে গেছে
আমাদের সব ভাষা অন্যের, কৃত্রিম
আমাদের যত গল্প নিজের, পুরনো

তাই আগামিকাল যেভাবে শেষ হল,
গতআজও তেমন অস্ত যাবে
কাকের মধ্যে বায়স, পায়রার দেহে কবুতরকে
আবিষ্কার করব আমরা
উঠোনের দুপাশে ফুল আর কুড়ুলে
ভেঙে পড়া দুই গাছ
মাঝখানে যে খর্বকায় মুক্তির দেবতা
তার ডানায় শেষ চুম্বন রাখব
যেভাবে সন্ত্রাসবাদী তার বিস্ফোরকে চুমু খায়

.
[‘তিনটি ডানার পাখি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে]

সুড়ঙ্গে মাথা

মরলে একটু নাড়াচাড়া পড়ে
রিখটার স্কেল চার সাড়ে-চারে
চেপে যা এখন, লুকো শেলটারে

আমরা মিছিল-ঘেরাওয়ের জোট
নবযুগ আনা সেরা হুজ্জোত
চুমু ছিল যারা, গুটিয়েছে ঠোঁট

নেট প্র‍্যাকটিসে দেখে নিতে হয় —
জুনিয়ার ব্যাট। এক হিটে ছয়?
বিপ্লবী নল দৃঢ় নিশ্চয়!

এসব বোঝে না মধ্যবিত্ত
নিচু শির, ভয়পূর্ণ চিত্ত
বেঁচে থেকে ছেলে কীই বা ছিঁড়ত!

তাকিয়া সাজিয়ে উঁচু নম্বর,
হেলান দিয়েছি পয়গম্বর;
সুড়ঙ্গে মাথা, মুক্ত গতর

প্রশাসন আর রাজনৈতিক
টেবিলে বসেছে আধিভৌতিক
স্টেপ নেবে ঠিক স্টেপ নেবে ঠিক…

জলের আঙুর


এক বর্ষায় সব পালটি খেয়ে গেছে হুতাশন।
পাতায় পাতায় এমন প্রফুল্ল গাঁট
সমস্ত পাখির মুখ খুলে গিয়ে;
নারকোলডাঁটির দুপাশে ঘন দুর্গাভুরু তোলা,
তাতে জলকুহেলি।
এমন নবরত্ন কারাদণ্ড সবুজ চেপে ধরেছে
আমাদের…
গাছই উচ্চারণ করছে আর পল্লব সহ্য করব না।
এই বর্ষার পেছন পেছন এল উদ্দালক
খুনের হুমকি থেকে বেঁচে;
মনের মধ্যেও ফের আরম্ভ চালু শুরু, ভাই,
জলের মোড়লি; আর তাতে পাছা-উবদি হাঁস


মাতাল-বিরক্ত পথ, টর্চ হাঁটছে
এক্কা-দোক্কা লাফ দিয়ে দিয়ে
কচি-শসা রাস্তাটায় বৃষ্টির লবন মাখানো

সব উঠোনে ঘুরে গেছে সবুজ প্যারামবুলেটার
সাদা ফুলতোলা ফ্রকের জলশিশু
তার মধ্যে আধ-শোয়া

ভেজা, হিম, ভিতু কাক হয়ে
এডাল-ওডাল উড়ে বসছে প্রেম


মনসিজ পানির ভেতরে বৃষ্টির আচ্ছন্ন ফুল
কোমর পর্যন্ত অতিকায়

ছাদ তুলতে ওস্তাদ মিস্তিরি ত্রিপলের নীচে
বালিতে পাথরকুচি — চালের উদরে ডাল —
ঠেসে দিয়ে হাভাতে ইঁটের ছোট হিল্লে করে দিল

একবার আটচালা ছেড়ে, মাটির গৌরাঙ্গ, তুমি
উঠোনে দাঁড়াও। কত আস্ত থাকে দেখি
চোখ, চূড়া, দুটি ছিচরণ!

.
(‘নবরত্ন কারাদণ্ড সবুজ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

জগন্নাথ

যিনি আমাদের জন্ম দিলেন
এবং তার চেয়েও চিরজীবী মৃত্যু দিতে
সব সময় প্রস্তুত

সেই অপাপবিদ্ধকে প্রণাম
যিনি আমাদের চালেডালে মিশিয়ে খাওয়ালেন,
আর দু’মুহূর্তের মধ্যে আদেশ দিলেন
কালান্তক ভেদবমি
সেই যমগন্ধবাহী উদ্দীপনাকে প্রণাম

যে-আচার্য গরমকালে থোকা থোকা কারখানা বসিয়ে, বৃষ্টিকালে সেখানে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে,
এই শরতে তালা খুলে বাস্তুকারকে দেখাচ্ছেন মেশিনের পেটে পাক দিয়ে ওঠা কাশফুল,
সেই হালকা বাতাস ও উপজাতিনৃত্যকে প্রণাম

কেননা, তিনি ভিক্ষুককে ভিখারি হতে
আশীর্বাদ করেন, বোবাকে দেখান
জিভ টেনে উপড়ে নেওয়ার ভয়
তারই দয়ায় হৃৎপাত্রে ভালোবাসা অবিশ্বাস সমান-সমান, মৃৎপাত্রে
অশ্রুকণা পায়েসান্ন সমান-সমান
তাই জগন্নাথ হাতদুটিতে এক লক্ষ নমস্কার রাখি যদি, তো প্রশান্ত দু’পায়ে সমকক্ষ ধিক্কার প্রণাম

.
(‘তিনটি ডানার পাখি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

বোলপুর

এই বোলপুরে
নাইন্টিথ্রি-ফোরে
বাড়িঘর অর্ধেকও ছিল না
চাদর নয়, ডানলোপিলো না
এক হেঁড়ে তক্তপোষে মাদুর বিছিয়ে শুতাম
ফরসা ফরসা বাদুড় ঝুলত ছাদ থেকে
মাঝরাতে হাত বাড়িয়ে তাদের তলপেট ছুঁতাম

.
(“ছোটলেখকি” বইয়ের ছড়া)

ধরিত্রীফুলগাছ

সৌন্দর্য, আমাকে স্নিগ্ধ চোখে চোখে রাখো

বাতাস শান্তিপীড়িত, বাতাস কীটবাসস্থান
আর প্রেমিক-প্রেমিকা ফোঁড় আছে অন্ধকারে
সিক্ত-অভিষিক্ত দুই পাখি
গালে ছোট ছোট সুশ্রী চাঁদের কারখানা

ওই যে ষোলো শাখার ধরিত্রীফুলগাছ
কিছু না কিছু পাপড়ি সবার মাথায়
আমি সেখানে লেখা কুড়োতে যাই
দেখি রোগা এক আহা রে ইঁদুর, তার দিন শুরু হল
আলো এসে বসেছেন ঝিঙেক্ষেতে স্বয়মাগতা
তারপর আজ রাতে যতবার তোমার শরীরে গিয়েছি
ছোট্ট সোঁতায় শুধু মাছ চমকে ওঠার শব্দ

তুমি আর বিবাহ ক’রো না
আমার শান্ত পোতাশ্র‍য় হয়ে যাও

ভালোবাসার জলকামান দুজনে ঘুরিয়ে দেব
পৃথিবীর দিকে

কিছু কম হবে না, কিছু বেশিও না

এক
সাহার ফুটপাথ ধ’রে হেঁটে যাচ্ছি
লোকজন বেঞ্চিতে ব’সে চা খায়,
মাটিতে শুয়ে বেমালিক কুকুর।
মানুষ কার, তাই বা কে জানে

সাদা চপারের নীচে সলিড চলছে দুশোকুড়ি।
ট্যাক্সি অথবা মেঘলা দিন, লাল শার্ট কিম্বা কাকের
লাফিয়ে লাফিয়ে বাঁচা — পুরোটাই মনের ওপর।
একদিন আমরা অশ্বত্থগাছকে সম্বর্ধনা দিতে
রাজি হব। তার আগে শ্রীকৃষ্ণ এসে দাঁড়িয়েছে ওষুধের দোকানে আর শ্রীরাধা বিকেলে খোলে
ব্লাউজ সেন্টার

জীবন অল্প এসে বেশি চলে গেল
তর্জনীতে পেনসিল দাঁড় করানোর
খেলা খেলল প্রেম।

বেড়ালের বাচ্চা ছাড়া আদর করার কেউ আছ? —
সাহা একবার চেঁচিয়ে উঠেছিল!
একবার ফুটপাথে ঠেলা সাজিয়ে :
প্রতিটা ভোর পঁয়ত্রিশ টাকা,
যে আলোই ফুটুক — পঁয়ত্রিশ।

হে সাহা, মম হৃদয়ে রহ…

জিততে গেলে হেরে যাব

সাত
— চাঁদ, যা দিদিকে ডেকে আন তো। রুটিক’টা বেলে দিক।
— এই ছোড়দা, দিদিকে ডাক।
— আমার বয়ে গেছে।

শিউলিকে পাচ্ছ না? দ্যাখো গে’ খুকুর কাছে ব’সে। খুকুর খোঁজ নেই? সে নিশ্চিত শিউলিদের ঘরে। চাঁদ তিনটে ফ্যানাভাতের গন্ধ, সাত সুপুরিগাছ আর তেইশটা রোদ্দুর পেরিয়ে সুশীলকাকুর বাড়ি পৌঁছে গলা খাঁখারি দিল। বারান্দায় উপুড় টিনের কৌটো, পাঁচছটা পুরনো পুঁতির মালা থেকে ভালো পুঁতিগুলো ছিঁড়ে শিউলি মাটিতে রাখছে… নাকি নিজেই খ’সে যাচ্ছে টাপুস-টুপুস; আর খুকু, ভালো নাম অশোকা, সেগুলো লাল কারে গেঁথে নিলেই নতুন মুক্তোহার!
— খুকুদি, তোমার বন্ধুকে মা ডাকছে।
— আমার বন্ধু সবাই। তুইও তো।
— আমি তোমার ভাই না? সবুজ রঙের ফ্রক পরা বন্ধুকে ডাকছে।

দুজনে এক-নদী হেসে গড়িয়ে পড়ল।
— এখানে সবুজ ফ্রক পরা কোনও মেয়ে নেই।
— না না সবুজ না, নীল।

এবার ফুঁসে উঠবে দাঁতের ফেনা-ঘেরা হাসির সমুদ্র।
— হোই রঙকানা, মাসিমা যাকে ডাকছে তার নাম বল।

নাম মুখে আনার নিয়ম নেই, খুকুদি ভালো ক’রেই জানে। কিন্তু চাঁদের বুদ্ধি কি কিছু কম?
— তালিবোশ্‌শ’য় রোশ্‌শি, রস্‌সোউ, ল’য় রোশ্‌শি।

আট
শিউলি কদবেলমাখা ক’রে সবাইকে দেওয়ার সময়ে দিদিমা বলেছিল :
—আমার ভাগেরডা তুই নে গে, বুনডি। আমার দাঁত কদবেল খালি ট’কে যায়।
এ-বাবা, ফলস দাঁত আবার টকে কী ক’রে! বাসু অবাক।
— তোমাগো ফলস দাঁত আছে যে জানবা?

তার এই আনজাস্ট এনরিচমেন্ট ঠেকাতে চাঁদ পেছন থেকে ডিঙি পেড়েছে বুঝে শিউলি টপাৎ ক’রে গোটা দলাটা মুখে পুরে দুটো বিশেষণ ছুঁড়ে দেয় : ১/ ছোঁচা ২/ পাতকুড়োনি, আর উড়ে আসা কিলের কথা ভেবে কুঁচকে রাখে পিঠ।

ওসবে না গিয়ে ভাই তার বাঁহাত খুঁজছে… শিউলি হাত মুঠো ক’রে পেছনে লুকোলো। ছেলেটা তখন মগ জলদস্যু, এক চোখে কালো কাপড়ের ঠুলি, দিদির কব্জি কামড়ে ধরেছে। ওর গজদাঁত দিয়ে ঝরঝর ক’রে পানখাওয়া রক্ত পড়ছিল নিশ্চয়ই, নাহলে মুঠো চিৎকার ক’রে খুলে যাবে কেন? ওমনি চাঁদ নিজের বাঁহাতের কড়ে আঙ্গুল শিউলির কনিষ্ঠায় পেঁচিয়ে ছেড়ে দেয় — আড়ি!

আড়ি, বলতে গেলে, ভালো। বাড়িতে যখন ঢের সারে বাচ্চা, তাদের ক্লোজড গ্রুপে দাঙ্গা ঠেকাতে আক্রোশকে খসখসে অভিমানে মুড়ে ফেলার নামই আড়ি। আর অভিমান কিছুদিন পরে বাতাসের জলীয় বাষ্প শুষে খামের ভেতরের রাগটাকে পচিয়ে দেবে। হয়ত তখনও রাস্তায় কারফিউ, কিন্তু বাগানের দুই গাছই মাথা দুলিয়ে ‘রাজি’ বলছে।

বড়দের কি আড়ি হয় না? গত বছর মান্নাপাড়ায় ভাড়াটে-বাড়িওলা তুমুল ক’রে দুজনেই কোর্টে কেস ঠুকে দিয়ে এল। মহকুমা আদালতে ডেট পড়ে; কোনও দিন এনার উকিল গায়েব, কোনওদিন ওনার। একই ট্রেনে কোর্টে হাজির হয়ে ঠনঠনে রোদে শিরিষতলায় দুজন-দুদিকে-মুখ ব’সে থেকে থেকে আবার একই ট্রেনে একই বাড়ি।

তার মধ্যে হঠাৎ বাড়িওলা শসা কিনে কলাপাতা-সমেত বাড়িয়ে দিয়েছে ভাড়াটের দিকে। সে আড়ষ্ট হাতে গ্রহণ ক’রে রোদের তেজ কমলে নিল দুটো চা। পাশাপাশি ভাঁড়ে চুমুক, ছেলের পরীক্ষা বা বাজারদর নিয়ে শৌখিন কথা; ভেতরে ভেতরে তখন ওই কবিতাটা হচ্ছে — কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য, অশুচি…।

মায়া ভেবেচিন্তেই চাঁদকে পাঠিয়েছিল দিদিকে ডেকে আনতে, তারপর সে ‘ও গৃহস্থ’ ডাকা লোকটার কাছে গিয়ে বসে :

— আপনার ছোট পুত্র আর বড় কন্যার তো মুখ-দেখাদেখি বন্ধ আজ দুই সপ্তা।
— ও, আড়ি? আড়ি-তে গাইছে দুজন? দুরূহ কাজ কিন্তু, শমের আধ মাত্রা পরে ধরতে হবে। গাইতে পারলে অন্যরকম চার্ম তৈরি হয়! যেমন, ‘আজু বহোত সুগন্ধ পবন সুমন্দ মধুর বসন্ত্‌’, রাগ বাহার। হাতে তালি দিয়ে নির্মল দেখাতে থাকে — ধা দেন্‌ তা, তেটে কতা, গদি ঘেনে, ধা-আজু বহোত…।

আট
রেল স্টেশন থেকে কাঁচা রাস্তায় নামল দুটো পালতোলা নারী-পুরুষনৌকো। দেখে পুকুরঘাটে কাপড়-আছড়ানো ঘোমটা স্থির, বটতলায় বিড়িটানা আঙুল নেমে এল ঠোঁট ছুঁতে গিয়ে — কতটা লম্বা দেখেছ, কী সুন্দর জুতো, কী ভারি-ভারি গয়না, সঙ্গে আবার চাকর, তার কাঁধে কত বড় ব্যাগ! সব পয়সাওলাই রাস্তার চোত্‌রাপাতা-চোরকাঁটা বাঁচিয়ে, কুকুর-মানুষের গু বুঝে পা ফেলে তারপরেও দুটি হোঁচট খেয়ে গ্রামের কুটুমবাড়ি পৌঁছোয়। কিন্তু কলকাতার বড়লোকদের কাঁধের পেছনে আলোর ঝালর থাকে — জাদুকর ম্যানড্রেক! তারা কোথাও হাজির হলে আচমকা বায়ুপ্রবাহ বেড়ে যাবে; শিমূলগাছ দুটো তুলোফল ঝরাতে গিয়েও — থাক বাবা, যদি মাথায় লাগে; শালিখপাখি ঘেঁটি বেঁকিয়ে পাড়ার বেড়ালকে জিগ্যেস করবে — কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, আইডিয়া আছে?

চাঁদ বাড়ি ফিরে দ্যাখে ভবানীপুরের মাসি উঠোনে চৌকিতে ব’সে হ্যাঁচ্চাই এক ব্যাগ খুলে জিনিস বের করছে তো করছেই — বাবার জন্যে সাধনা-র চ্যবনপ্রাশ, দিদিমার জন্যে নতুন থান, চাঁদের কেডস, গোপুর জন্যে বর-বউ পুতুল, শিউলির ফ্রক… মায়ের কিছু নেই? এই যে, দুকেজি সরষের তেল! দেখতে দেখতে উঠোনটাই দোকান, পাড়ার লোকেরা নেড়েচেড়ে দেখছে জিনিসপত্র, মাসি উঁচু গলায় দাম শোনাচ্ছে, তার মধ্যে দিদিমা : সঞ্জুভাই, বালতিতে জল ভরো, অশ্বিণী চান করবে। উঠোনে আর একটা জলচৌকিতে মেসো গা আগ্‌লা ক’রে বসলে চাঁদ আর গোপু ছোট ছোট থাবায় তার আঁচিলখচিত পাহাড়-পিঠে তেল ড’লে দিচ্ছে। বদলে দুজনের চ্যাটচেটে হাতে পাঁচ পাঁচ দশ নয়া।

রানীর রাজপুত্রকন্যা নেই, সেই যন্ত্রণার ওপর সে ধনসম্পদের ডাকটিকিট চিটিয়ে রাখতে চায়। মায়াকে বিদ্রূপ করে বছর-বছর বাচ্চা বিয়োনোর জন্যে, আবার খুব ইচ্ছে দিদির একদুটো সন্তান নিজের পরিচয়ে মানুষ করবে। তারা ঘটাং-ঘটাং কাশবে না, চপর-চপর ভাত চেবাবে না, কুজড়িমুজড়ি জামাকাপড় প’রে বেরোবে না রাস্তায়, কলকাতার সবচেয়ে ভালো স্কুলের ছাত্র হবে।

দিদির ‘হ্যাঁ’ না পেয়ে রানী নিমতিতা কলোনিতে আসা কমিয়েছে, এলে দুকেজি সরষের তেলের হিংসেঝাঁঝ ছড়িয়ে যায়।
শিউলি ভাইয়ের পেছন পেছন বাড়ি ফিরে মাকে ধরল।
— মাসি এই আমাদের বাড়ি এসে আবার এই বারাসাত চলে যাচ্ছে কেন?
— যাচ্ছে পদ্মর সঙ্গে দেখা করতে। দুই বাঁজায় ব’সে পরের সংসারের মুন্ডুপাত করবে না?

নয়
ঋজুদার মতো পদ্মপিসির গল্পটাও অ্যাডাল্ট, শিউলি দিদিমাকে তুইয়ে-তাইয়ে শুনে নিয়েছে :

সাত-আট বছর বয়েসেই পদ্মকুঁড়ির বিয়ে হল পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলের সঙ্গে। রাত্তিরে সে ঘরে ঢুকলেই বউ আপাদমস্তক চেঁচাত। কিছুদিন পরে মা ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিল; প্রথম জন ফিরল তার মাসির শ্বশুরবাড়ি, সিদ্ধান্তপাড়ায়।

আস্তে আস্তে সে-মেয়ে বড় হয়, অতি নম্র, মাটি দিয়ে হাঁটলে মাটিতে আওয়াজ হবে না; আর এমন রূপসী, পুকুরঘাটে গেলে বৌঝিরা কথা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে। তখন খবর পেয়ে তার বর লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্মর কাছে আসতে লাগল। এদিকে তোমাদের বাড়িতে অনেক দিনের পুরনো এক কুরির মেয়ে ছিল, সে জন্ম-বোবা।

— কুরি মানে কী, দিদ্‌মা?

কুরি হচ্ছে ময়রা। কাজের মেয়ে হলে কী হবে, জোচ্ছোনার ভীষণ দাপট। বাড়িতে ভিখারি এলে নাদু চাল-আলু দিতে গেছে, সে বারান্দায় ব’সে ইশারা করছে — অত চাল দিয়ো না। শীত হোক বর্ষা হোক, জ্যোৎস্না শুতো বাড়ির বারান্দায়। সে ধরে ফেলল, পদ্মর বর গভীর রাতে তার কাছে আসে, পদ্ম নিঃসাড়ে দরজা খুলে দেয়, আবার শেষ রাতে ঘর থেকে তাকে লুকিয়ে বের করে।

যদি মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে পড়ে, কী হবে! হিন্দুদের মধ্যে দুই বিয়ে তখনও করে কেউ কেউ, কিন্তু এক বউয়ের হাল হয় রক্ষিতার মতো। বাণীনাথ শালীর মেয়েকে বললেন, জামাকাপড় গোছাও। বাগেরহাটে গরীব বাপমা-র কাছে ফিরে গেল পদ্ম, সেখান থেকে দেশভাগের পর দুই ভাই বৈদ্যনাথ আর অজিতের সঙ্গে হিন্দুস্তানে।

কিন্তু দুঃখের কথা কি জানিস? পদ্মপিসির কোনওদিনও সন্তান হতো না। শরীর খারাপই হতো না ওর। তোদের ঠাকুর্দা জানত না, বলার সাহসও কেউ দেখায়নি।

— দিদ্‌মা, পিসি এখনও শাঁখাসিঁদুর পরে ক্যান্‌?
— বরের তো কোনও দিশে-হদিশ নেই, আইনমতোন ছাড়াছাড়িও হয়নি। ওই শাঁখাসিঁদুর নিয়েই চিতেয় উঠতি হবে পদ্মর।

শিউলি কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে ব’সে থাকে। তারপর হাসি পায় তার ঠোঁটদুটোর :
— বলো দিদ্‌মা, সারা জীবন মাছ খাতি পারবে পদ্মপিসি!

.
(চলছে)

ডাক

ফেরিয়ালার ডাকে হুঁ না-যোগানো কি অপরাধ —
বহুদিন ভাবি।
তার গলা রঙওঠা নাইলন-দড়ি, আমাদের ভিজে জামাকাপড় পিঠে নিয়ে ঝুঁকে আছে।
ফেরিয়ালার সুর তাকে বিধানসভায়
কোকিলের পাশে বসাল
দুপুরে সে প্রচুর আধ-ময়লা ঢকঢক জল,
তারপর দুহাতে ছেঁড়ে শিম্পাঞ্জি টিফিন।
আজ শিউলিপুকুর সরণিতে ঢুকব না,
ডান দিকে কাত হয়ে বাথানিয়া গ্রামে —
আলোরও যথেষ্ট নেই এই স্বাধীনতা।
আমি কত সুর্মাটানা চাবি সারিয়েছি
তার কাছে দশ টাকা দিয়ে

গাছের ভেতর দিয়ে শের আফগান, শোকের ভেতর দিয়ে সংবাদদাতা, আলাপের মধ্যে দিয়ে আপেলমিথ্যেরা হেঁটে যাচ্ছে।
কী যেন বেচতে এসে ওদেরই সওদা করে সে।
বাড়ি পৌঁছে খুচরো গোনার মতো গোনে
তার কোন ডাকে মোরগ রেগেছে, কোন ওঁকারে মেয়েদের হাতখরচের টাকা গর্ভ থেকে খসতে গিয়ে কোনা ছিঁড়ে গেল, কোন ছলাৎছলে পোলিয়োর দু’ফোঁটা ছেলেমেয়ে সন্ধের চুমুর দিকে
সাইকেল চালায়

নামদেহ

যেসব সুমন এখনও পুরনো নামে আছে
মুখের চামচে টলমলে পহচান নিয়ে
পা-টিপে হাঁটছে রাস্তায়
তারা মৌরলা মাছের দাম ভাবছে
স্বাতী নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে
রোববার চুলকাটা সেলুনে বিষণ্ণ ছেলেকে নিয়ে লাইন দিয়েছে

যেসব সুমন নিজের শিরোনাম একরোখে চালিয়ে দেয়নি মেয়েদের বিভক্ত ব্যথার ওপর
লোকমান্য ইফতারে দোকানে ফলের গায়ে
হাত রেখে ছ্যাঁকা খেয়েছিল
এই ভিড় ট্রেনে যারা গলার পেছন দিয়ে গান গায়
রাত্তিরে বিছানায় চুপচাপ খোলে
বউ-লেখা ব্যাজার সুটকেস

তাদের লটারি নম্বর, শোলার মটুক কিম্বা
ফেসকাটিং-এ আলো পড়ল না।
যারা সাতের পিঠে পাঁচবার এক-বোয়েম খটাখট লজেন্স বেচার স্বাধীনতা —
নিজেদের নাম-দেহ ছুঁয়ে উঠোনে ব’সে আছে, আর
বড়রাস্তায় নিউ সুমনের স্বপ্নে থোকা-থোকা বিজ্ঞাপনের বিরতি