বিভাগের আর্কাইভঃ সাহিত্য

শ্মশান বন্ধু কোকার গল্প

IMG_20250605_231606_(480_x_500_pixel)ভোর তখন সবে ফুটছে। শীতের পাতলা কুয়াশা তখনও নারায়ণগঞ্জ শ্মশানের পরিবেশকে এক বিষণ্ণ চাদরে ঢেকে রেখেছে। চিতার কাঠগুলো তখনও জলে ভিজে, ছাইয়ের স্তূপ থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে। শ্মশানের কোণায় বসে ছিলেন শ্মশান বন্ধু কোকা, বছর ষাট ছুঁই ছুঁই। তাঁর চুল-দাড়ি সবই শ্মশানের ছাইয়ের মতোই ধূসর, আর তাঁর চোখ দু’টোতে যেন গত কয়েক দশকের সব শোকের প্রতিচ্ছবি। শ্মশান বন্ধু কোকা এই শ্মশানে তাঁরাই এলাকার প্রায় সব মরদেহ নিয়ে আসেন প্রায় পঁচিশ বছর ধরে। এজন্যই তাঁর নাম হয়েছে, নন্দ গোপাল (কোকা) থেকে শ্মশান বন্ধু কোকা। তাঁর কাছে শ্মশান শুধু মৃতদেহ পোড়ানোর জায়গা নয়, এ যেন জীবনের এক বিরাট পাঠশালা।

আজ সকালেই শ্মশান বন্ধু কোকা নিজ হাতে করেছে  এলাকায় থাকা এক অসহায় বৃদ্ধার সৎকার শেষ করেন। মরদেহ (শবদেহ) শ্মশান বন্ধু কোকা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে শ্মশানে এসেছিল রাতেই, কিন্তু শ্মশানের আনুষ্ঠানিকতার খরচাদি মেটানোর জন্যই শবদেহ সৎকার শেষ হতে সকাল হয়েছে। অসহায় বৃদ্ধার দুই মেয়ে তখনও শ্মশানের ভেতরেই নির্বাক বসে, তাদের চোখে জল নেই, যেন সব অশ্রু শুকিয়ে গেছে। শ্মশান বন্ধু কোকা তাদের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানেন, এই নীরবতা শোকের গভীরতম রূপ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের এই নীরব শোকের সাক্ষী শ্মশান বন্ধু কোকা।

তাঁর মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগের কথা। যখন তিনি প্রথম এলাকার পরিচিত একজনের মরদেহ শ্মশানে এনে সৎকার শুরু করেন, তখন তাঁর মন সবসময়ই ভারাক্রান্ত থাকতো। প্রতিটি চিতায় যেন নিজেরই কোনো আত্মীয়কে তিনি দেখতেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি শিখতে শুরু করেন জীবনের এই অলঙ্ঘনীয় সত্যকে মেনে নিতে। তিনি বুঝতে পারেন, শ্মশান শুধু শেষ যাত্রার স্থান নয়, এটি জীবনের এক নতুন শুরুরও প্রতীক। এখানকার ধোঁয়া কেবল ভস্মীভূত জীবনের স্মারক নয়, তা যেন শোককে উড়িয়ে নিয়ে এক নতুন পথের সূচনা করে।

কিছুক্ষণ পরই শ্মশান থেকে বের হয়ে যাবার পালা। শ্মশান বন্ধু কোকা শ্মশান থেকে বের হবার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে বৃদ্ধার দুইকে কাছে ডাকেন। দুই মেয়ে-সহ মৃত বৃদ্ধার নাতি-নাতনীরা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে সামনে এলেন। তাদের মুখপানে চেয়ে শ্মশান বন্ধু কোকা খেয়াল করলেন, বৃদ্ধ মাকে হারিয়ে তারা যেন পাথর হয়ে গেছে। তারা এমনভাবে ভেঙে পড়েছিলেন যে শ্মশান বন্ধু কোকা দেখে স্থির থাকতে পারেননি। তিনি নিজের হাতে তাদের জন্য জল এনে দেন, পাশে বসে সান্ত্বনা দেন। শ্মশান থেকে বের হবার কিছু নিয়মকানুন শিখিয়ে দিয়ে শ্মশান বন্ধু কোকা তাদের বলেছিলেন, “মৃতদেহ শুধু পঞ্চভূতে বিলীন হয়। কিন্তু ভালোবাসা আর স্মৃতি অমর হয়ে থাকে। সে আপনার মায়ের  মতোই আপনাদের সঙ্গেই থাকবে”।

তারপর শ্মশান বন্ধু কোকা আঙুল উঁচিয়ে দেখালেন, গেটে লেখা আছে – “জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, সব বিধাতার ইচ্ছা”। তিনি আরও বলেন, “এই শ্মশান যেন এক বিশাল শিক্ষালয়, যেখানে প্রতিটি মানুষ আসে এক অনিবার্য সত্যকে উপলব্ধি করতে। এখানে ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিবের কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই আসে একই পরিণতি বরণ করতে, একইভাবে ছাই হয়ে মিশে যেতে”।

তাদের শান্তনা দিয়ে শ্মশান বন্ধু কোকা অনুভব করেন, প্রতিটি চিতার আগুন এক একটি জীবনের গল্প বলে যায়। কখনো সে গল্প অকালমৃত্যুর বেদনা, কখনো দীর্ঘ জীবনের পরিসমাপ্তি, আবার কখনোবা হঠাৎ করে আসা বিদায়ের শোক। কিন্তু সব গল্পের শেষে একটাই বার্তা – জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ভালোবাসার রেশ চিরন্তন।

সূর্য তখন শ্মশানের আকাশে উঁকি দিয়েছে। কুয়াশা কেটে এক নতুন দিনের আলো শ্মশানের পরিবেশকে এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা দিচ্ছে। শ্মশান বন্ধু কোকা-সহ শ্মশানের যারা এসেছিল, সবাই “হরি হরি বলা, বল হরি” ধ্বণিতে শ্মশানের গেইটের দিকে এগুতে থাকেন। শ্মশান প্রহরী ডোম সম্প্রদায়ের দুইজন শ্মশানের গেইটে এসে কিছু মন্ত্র পাঠ করে তাদের প্রাপ্য দক্ষিণা বুঝে নিয়ে শ্মশান গেইট পাড় করে দিলেন। শ্মশান বন্ধু কোকা সাথে আসা সবাইকে নিয়ে নিজ এলাকার গন্তব্যে পৌঁছাতে দুটো ছোট বাহনে চেপে বসলেন। একসময় নিজেদের গন্তব্যে এসে পৌঁছালেন।

তাঁর কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, “আমি যতদিন এই ধরণীর বুকে বেঁচে থাকি, ততদিন এই এলাকার যেকেউ মৃত্যুবরণ করলে আমি নিঃস্বার্থে সৎকার করে শ্মশানে ছুটে যাবো তাদের প্রিয়জনের শেষ যাত্রায় অংশ নিতে। প্রতিটি শোকের নীরব সাক্ষী হতে নিজেকে নিয়জিত রাখার চেষ্টা করবো। এটাই আমার জীবনের প্রতিজ্ঞা”। শ্মশান বন্ধু কোকা—

কানার হাটে আলো বিক্রি

গোধূলি

কানার হাটে আমি আলো বিক্রি করি।
আলো—যা তারা দেখতে পায় না, বুঝতেও চায় না।
তবু আমি দাঁড়িয়ে থাকি। প্রতিদিন। প্রতিক্ষণ।
হাতের ঝোলায় কিছু সূর্যরশ্মি, পকেটে মুঠো মুঠো ভোরের আলো,
আর চোখে এক বিন্দু নির্ভার দৃঢ়তা।

এই হাটের মানুষ অন্ধ। শুধু চোখে নয়—
চিন্তায়, চেতনায়, অনুভবে অন্ধ।
তাদের জন্য আলো মানে বৈদ্যুতিক বাল্ব,
আর আমার আলো মানে—
ভেতরের জানালা খুলে দেয় যে আলো,
যা দেখে মানুষ তার নিজের ছায়াকেও ভালোবাসতে শেখে।

তারা বলে, “আলো? আমাদের লাগে না!
আমরা তো দিব্যি বেঁচে আছি এই অন্ধকারেই।
এখানে প্রশ্ন নেই, ব্যথা নেই, দায় নেই—
তোমার আলো এনে এসব জাগিয়ে দেবে কেন?”

আমি শুনি। শুনে থাকি।
কারণ জানি—
আলো কখনো জোর করে ঢুকে না কারো চোখে,
সে অপেক্ষা করে।
যেন কোনো প্রাচীন প্রেমিক—
যার হাতে গোলাপ নেই, তবু হৃদয়ে এক অমল চৈত্র।

কখনো কখনো,
এই হাটের এক কোণে বসে থাকা ছোট্ট ছেলেটি আসে—
সে দেখে না, তবু হাত বাড়ায়।
আমি তার হাতে রাখি এক টুকরো ভোর।
সে হাসে। আর সেই হাসির আলোর ছায়ায়
পড়ে যায় একটা চুপচাপ কান্নার রেখা।

তখন মনে হয়,
এই বিক্রির পণ্য বুঝি বিকোবে না কখনোই—
কারণ আলো কিনতে হলে দেখতে হয় নিজের অন্ধকার।
তবু আমি বিক্রি করি।
দিনশেষে হয়তো বিক্রি হয় না একটিও আলো,
তবু সন্ধ্যার আগে আগে
আমি আমার নিজের চোখে কিছু নতুন রোদ খুঁজে পাই।

এই হাটে আসা মানুষগুলো নিজেরাই জানে না,
তারা কী বিক্রি করে, কী খোঁজে—
আমি শুধু জানি, আলো বিক্রি করি মানেই আলো ছড়াই।
কারণ আমারও একদিন কেউ
কানার হাটে এসে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল এক বিন্দু দীপ্তি,
যা দিয়ে আমি আজো হেঁটে চলি।

তাই প্রতিদিন, প্রতিরাত,
আমি কানার হাটে আলো বিক্রি করি—
ভাঙা মণির মতো কিছু আলো,
যা হয়তো তারা আজ নেবে না,
কিন্তু একদিন,
যখন অন্ধকারও ক্লান্ত হয়ে যাবে,
তারা ঠিক খুঁজে নেবে সেই আলো,
যা আমি ফেলে রেখে গিয়েছিলাম
তাদের অদেখা চোখের ঠিক পেছনে।

আনন্দ খেলাঘর

ঘুরে ফিরে বারে বারে হয় কত কারুকাজ
শুক্লপক্ষের জ্যোছনায় ভেসে যায় আকাশ!
হালকা ধাচের সাদা মেঘ অরূপ মায়ার সাজে
খানিক আধারে চুমু দিয়ে ছুটে চলে যায় লাজে!
চারদিকে দিগন্তজোড়া দালানের উঁচু নিচু ছাদ।
পাতাভরা গাছের মাথায় উঁকি দিয়ে চাঁদ-
যাচ্ছে লুকোচুরি খেলে
সুন্দর আজ প্রাঙ্গনে হেসেছে অবগুণ্ঠন মেলে।

এই যে আকাশ ভরা তারা
সংখ্যাতে হতে হয় দিশেহারা
বৈচিত্র্যময় গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কা, ধুমকেতু
নীহারিক, গ্যালাক্সি ঘূর্ণন হেতু
কোথা থেকে কোথা চলছে ছুটে
আমিও তাদের অংশ হয়ে থাকি চিত্রপটে।

এই যে জলবাহী পবনের উড়ন্ত স্রোতধারা
আছড়ে পড়ে মিটায় জমিনের খড়া
গাছ গাছালি মাটি ফুড়ে এসে
কেঁপে কেঁপে উঠে প্রাণের উল্লাসে।
আগে শুন্য, অজানা রইল পর
শুধু এইখানে আজ বুঝি এই আনন্দ খেলাঘর!
আমার হৃদয়ের অপার্থিব স্পন্দিত ফল্গুধারা
সাগর- ঊর্মি, হরিত- প্রান্তর, প্লাবিত বসুন্ধরা
আমারে ডুবায়ে নিয়ে যায়, ভাসায়ে নিয়ে যায়,
আমারে না জানি কোথায় হারাইয়া লইয়া যায়!

তিন শূন্যের পৃথিবী

তিন শূন্যের পৃথিবী
সাইদুর রহমান.

সবুজ শ্যামল সোনার বাংলার
এত উর্বর মাটি,
গরিব কৃষান ভাবে দেশটি
যেন শস্যের ঘাঁটি।।

তবুও হায় রে দারিদ্রতা
ছাড়ে না তার পিছু,
কখনো হায় উপোষ কাটায়
জুটে নাকো কিছু।

মোদের সকল ছেলে মেয়ে
শিক্ষা নিয়ে শেষে,
কাজের খোঁজে সকল দ্বারে
ঘুরে চাতক বেশে।

বাবা মায়ের বুকের স্বপ্ন
ভেঙে হয় গো চুরমার,
বেকারত্বের সে কি জ্বালা
কে শুনে সে চিৎকার ?

আজ কী শুধু শব্দ দূষণ
খাদ্যে ভেজাল চারপাশ,
হেথা হোথা কার্বন দূষণ
বিষে ভরে নিঃশ্বাস।

ছড়ায় ক্যানসার আয়ু কমে
প্রাণ স্পন্দন যায় থেমে
পাই পরম সুখ কার্বন দৃষণ
শূন্যে যেই যায় নেমে।

দেশে বেকার আর দারিদ্র
যদি আর না থাকে,
এই পৃথিবীর সবাই ভাববে
তখন স্বর্গ তাকে।

মূলঃ নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ ইউনূস
ছন্দ মাত্রা স্বরবৃত্তঃ ৪+৪/৪+২

তিন শূন্য সমীপে

Tin_Shunner_Prithibi-Dr_Muhammad_Yunus-0254a-454383

তিন শূন্য সমীপে…
ফকির আবদুল মালেক

আকাশে উড়বে টাকা
সিঙ্গাপুর সিটি! ঢাকা-
কবি তুমি লিখ কবি’তা
রঙীন কল্পনা বাহ্বা!

তোমার মানুষ ভুখা
দিনে খাবার হয়না
শব্দের উপর শব্দ
কবি তুমি নিস্তব্ধ!

ওই শুনি মুক্ত ক্ষুধা
বেকার মুক্তির ধাঁধা
কার কাছে তুমি চাও
ঢাকা সিউল বানাও!

পৃত্থি নিয়া উনি আছে
বক্তৃতা দিতাছে মিছে
নিজ দেশের মানুষ
ভুখা আছে নেই হুশ!

কবি ধনী বাসনা ছাড়
যারা আছে নিচে, ধর-
খাই যদি এক মুঠো
খাব একসাথে , ওঠ।

image-52538-1738221104

অবচেতন ইশারা

নিঃস্ব

থুথু ফেলে দিয়ে আবার
মাটি থেকে চেটে খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার,
তবুও মাঝে মাঝে সন্দেহের বোরাক
চেপে ধরে মাটিতে।

তখন অসহ্য যন্ত্রণায় তিতো লাগে সকল অস্তিত্ব,
একটু বেঁচে থাকার জন্য
হাঁসফাঁস করতে করতে উঠে বসি।

বর্তমান তরঙ্গের সাথে
বাঁচা-মরার প্রতিশ্রুতিতে আক্ষেপ থেকে যায়,
সেও বুঝি চোখ বন্ধ করে!
হৃদয়-চোখে হাজার প্রশ্নের ঝড় তুলে,
লণ্ডভণ্ড করে আমায়!

কি জানি! কি পাপ করেছি এ প্রকৃতির সাথে,
যে শুধু দাবিয়ে রাখার খেলায়
আমি একটি বস্তু মাত্র—
অবচেতন ইশারায়
আমাকে বারবার ঠুকি দিয়ে চলে যায়।

মনগড়া কলেমায় আমি থেকে যাই
পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের খলনায়ক চরিত্রে।
কে জানে!
নিয়তির এ দুর্গমগিরির অন্ধকার পথে,
পাশে থেকেও,
আর কতটা পথ একা একা হাঁটা লাগে?

স্বাধীনতা তুমি কি?

ইকরামুল শামীম
স্বাধীনতা, তুমি কি?
কখনো হবে এই অদম্য প্রেরণা বিলীন?
নাকি উত্তপ্ত, রক্তাক্ত পথ ধরে
হবে এক নতুন ইতিহাস রঙিন?

স্বাধীনতা, তুমি কি?
কখনো হবে নতজানু লজ্জাবতীর কাঁটা?
নাকি বদ্ধ ঘরে নির্যাতিত কিশোরীর আর্তনাদে
ফুরাবে নীলিমার নীল আলো ছাটা?

স্বাধীনতা, তুমি কি?
কখনো থাকবে কৃষকের হাসিতে?
নাকি উজান বয়ে যাওয়া স্রোতের মতো
মিশে যাবে কালো অন্ধকারের কণ্ঠরোধিত রীতিতে?

স্বাধীনতা, তুমি কি?
কখনো সইবে বেকারের হাহাকার?
নাকি এলিট শ্রেণির মুখোশী ভাষায়
হবে স্বপ্ন ভঙ্গের নিষ্ঠুর উপহার?

স্বাধীনতা, তুমি কি?
কখনো বইবে নিরপরাধের আর্তনাদ?
নাকি জনদরদী তারার মতো
ঝলমলিয়ে হারাবে অবিচারের বিষাদ?

স্বাধীনতা, তুমি কি?
পেয়েছো কি ত্রিশ লক্ষ প্রাণের প্রতিদান?
নাকি কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা
একটি ধূমকেতুর মতো দিশাহীন উড়ান?

স্বাধীনতা, তুমি কি?
কখনো আসবে মিলনের স্বপ্ন নিয়ে?
নাকি বইয়ের পাতায় আঁকা ইতিহাস হয়ে
হারাবে জীবনের বাস্তব সৃষ্টিতে?

স্বাধীনতা, তুমি কি?
কখনো ফুটবে সুবাসিত রজনীগন্ধা ফুল?
নাকি বিষাক্ত সমাজের রুগ্ন হাতে
হয়ে যাবে বিষে ভেজা এক কুটিল ভুল?

রৌদ্র ছায়া

=====রৌদ্র ছায়া

বাঁধিতে তারে
বেবস হৃদয়ে মোহ
নাহি চেতন ফিরে
ধরত্রী মোহ হয়ে করেছে হরণ;
যা ছিল সম্বল!

আঁধার ক্ষয়ে,
বিলাপে মিশে নিত্য নতুন সঙ্গ লয়ে।
বেবস তন্দ্রা তাই
সহসাই জেগে উঠে; হৃদয় যাপনে।

মন ছাপিয়ে
সহসা কতক বিদ্রোহ আঁকে?
হৃদয়ে মোহ;
ক্ষণতাপে, প্রতাপে
দ্রোহ সনে আঁতাতে
বিদ্রোহ কপাট খুরে রয়!

আজ ২৫ মাঘ ১৪৩১

নিত্য নতুন মোহ!

=====নিত্য নতুন মোহ!

নিত্য নতুন মোহ!
বাসনায় বাঁচে; আঁচল পেতে বসে
করিতে হরণ যা আছে তলানীতে জমা, যত সামান্য
কিঞ্চিত কড়ি! ফুরালো তা বুঝি
লোভের আতশবাজি পুড়িয়ে।

কোন পথে যে চলা?
কোথা হতে কোন মেঘ ভেসে আসে?
আঁধার রাতে সিদঁকেটে সব লুটেছে;
যা ছিল সম্ভ্রম!
বাসনা টুকু ছাড়া।

তাড়না ভারি মোহ ভুলায় মন
চঞ্চল ভারি তেলে জলে মৌনতা ভুলায়।

আজ ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

এই জনমের আগে

শীতের মধ্য রাত
রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দে
ঘুম ভেঙে যায়
মনে পড়ে যায় এই দেশে এই পথে
এসেছিলাম এর আগে
এই জনমের আগে
আরো একবার শতবার কিংবা সহস্রবার।

এই আনাচের ক্ষেত
এই ধুন্দল মটর মশুর ডালের ক্ষেত পেরিয়ে
এই জলাশয়ে জাগ দেয়া পাট শুকানোর গন্ধ নিয়ে
এই গোধুলী সন্ধায় ধোঁয়াটে কুয়াশা চাদরের
মাঠ দেখতে দেখতে
এই বড়াল ব্রীজ চাটমোহর ঈশ্বরদী পেরিয়ে
চলে গেছি সুদূর দিনাজপুেরে,
দেখা হয়েছিল সেখানে
ক্যাডাভিয়ার সাথে,
কথা হয়েছিল তার সাথে, তাহার সাথে
উষ্ণ নিশ্বাস ছেড়ে বলেছিল সে আমারে
এক পৃথিবী ভালোবাসা দিলাম আজ তোমারে।

সেই রাতে ডানা ঝাপটিয়েছিলো এক রাতজাগা পাখি
দেখেছিলাম আমরা মেলে আমাদের চারিটি আঁখি
ভয় পেয়েছিলো সে রাতে আমার ক্যাডাভিয়া
চারিদিকে ছিলো অন্ধকারের বিমূর্ত ছায়া
তাকিয়েছিলো ক্যাডাভিয়া সেই রাতে নক্ষত্রের পানে
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেছিলো আমার কানে কানে
চলে যেয়ো না কখনো তুমি আমাকে ছেড়ে
কেউ যেনো তোমাকে নেবে আমার থেকে কেড়ে।

দিয়েছিলাম কথা আমি তারে, তাহারে
যাবো না কখনো আমি তোমাকে ছেড়ে
রাখতে পারনি আমি সে কথা তার, তাহার
তাইতো ফিরে আসি আমি বারেবার
বহু দেশ ঘুরে ঘুরে খুঁজেছি তারে
পাইনিকো দেখা তারে, তাহারে
হয়তো বা কোন এক বলাকার বেশ ধরে
কিংবা কখনো আকাশে বালিহাঁসে ভর করে
মনে পড়ে যায় এই দেশে এই পথে
এসেছিলাম এর আগে
এই জনমের আগে
আরো একবার শতবার কিংবা সহস্রবার।

ভ্রূণের শহর ছেড়ে

ভ্রূণের শহর ছেড়ে চলে আসা নদীর কাছে জানতে চাই,
পুষ্পেরা কেমন আছে। উত্তরে হাসে নদী, বলে –
ভাসাই বলেই আমি জোয়ারের জনক
আর যারা ভালোবাসার মর্মার্থ জানে,
তারাই বলতে পারে- কী মহান বিরহের ত্বক।

উজানের উৎস থেকে উঠে আসা মেঘের কাছে
জানতে চাই, তুমি কি পারো হে বন্ধু
পুঁতে যেতে ভাসানের বীজ..
আমাকে উদাস রেখে মেঘ চলে যায়,
পৃথিবীর অন্যবাঁকে, যমজ শিশু
আমাকে দেবে বলে, দুহাতে কুড়ায় খনিজ।

পীড়িত দৃষ্টিপাত

ভোরের দেয়ালে লাগানো আয়না।
ক্রমশ বদলে যাচ্ছে আয়নার ভেতর-
দৃশ্যগুলো ক্লান্ত বহুকাল।
দৃশ্যের ফাঁকে আমরা বড় একা-
আটকে আছি অসুস্থ সময়ের আচ্ছাদনে।
তবুও আতঙ্ক আর দীর্ঘশ্বাস-
গোপন করে আকাশের দিকে তাকাই
দেখি, আমাদের বারান্দায় আকাশ থেকে-
ঝরছে নতুন চাঁদের ভাঙা ভাঙা আলো।

আমরা আধভাঙা বিশ্বাস নিয়ে—
তাকিয়ে থাকি সেই বারান্দার দিকে।

মুখ ও মুখোশ

মন ভালো রাখতে ব্রহ্মপুত্রের কাছে এসেছিলাম
এখানেও তিল রাখার মত জায়গা নেই
পঙ্গপালের মত গিজগিজ করা মানুষ
দুই চোখ… চার চোখ…
কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে… কোনটা
বুড়ো আর কোনটা আইবুড়ো বুঝা মুশকিল
লাল ফিতার দৌরাত্মার চেয়েও মেকাপের দাপট বেশি!

সেই কবে পড়েছিলাম- শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি
আজ এখানে মুখের চেয়ে মুখোশ বেশি!

ছায়া, দগ্ধের ওপরে

এক
এ-জীবন কোনও কিছুর অপেক্ষায় রাখো
ছাদ-অপেক্ষায় রাজমিস্তিরি,
বাঁশি থাকে হাওয়া-সাধনার…

কখন ভাসানে ক’রে রোদ উঠে গেল
তুমি ব’সে আছ, মেরুদণ্ডে বেঁধানো কুঁড়িটা

একটা পুজোর গান অপেক্ষায় রাখত গোটা পাড়া
একটি শাড়িনী রাস্তার চৌমাথাভরা ইয়াং ছেলেদের।
তেমন আতিথ্য নিয়ে জলের পিঠে দাও
ছোট হাতের ভরসা
ঘাসের হাড়ে যেন ফের ঘাস না গজায়
সন্ধে আসে জীবন-অনুভূমিক

দুই
সন্ধে নেমে আসার পদ্ধতি আমি দেখেছি কাছ থেকে
দিনকে কমিয়ে ডীম ক’রে আকাশের হাতে
তুলে দেওয়া — মা-দিদিমা বাসনমাজার থালা ডোবালে জলের মধ্যে, কাঁসাপেতলের মুদিত চোখ পেছন-পেছন ঘাটে আসা আমাদের যেটুকু দেখেছে
তেমন সাপের তলপেট, চাঁদ থেকে লাফ দিচ্ছে
সন্ধের ক্রশিং
যেন কোথাও জাগ দেওয়া ছিল কুচিকুচি
সজনে পাতার নিচে, এখন সুরৎ বোম্বাই
সা-নি-ধা নামছে, “আহা কোন বাগানে ছিল”
বলছে সন্ধের হকার, আমাদের সন্ধ্যাতারাবাবু

তিন
আমি সন্ধে নামাই সমুদ্রবেদিতে
অভাবে পুষ্কর, ডোবাও চইলবেক
চারিদিকে বনগন্ধ পরাক্রম, “ও আমার
দলে খেলবে” ব’লে ইলেকট্রিক খুঁটিকে
গাছ বানিয়েছে জার্মানিলতা
উল্কাসনে ব’সে এক-তরোয়ালে চিরে দিচ্ছি
আকাশের পেট থেকে জমির নাবাল
চুঁয়ে নামল কালো প্রস্ফুটিত
পাটগন্ধ, পাটশব্দ, একমুঠো ধুলোর তণ্ডুল…

আমি সন্ধ্যা নামাইয়া থাকি

.
[‘নবরত্ন কারাদণ্ড সবুজ’ বইতে আছে]

পর্যটন নিশি

তপ্ত নিশ্বাসে উবে যায় ঘুম..
অধীর ত্রাসে
মিশে থাকে নিঝুম পর্যটন
অচিন পর্বতারোহণের নেশা;
জ্যোৎস্নার বনে
পুনমী আলো ছায়া
সুগন্ধি মোহন মৃগ
অস্থির…
ঠুমরীর তালে নাচে নটরাজ
গোপন মুদ্রায়
স্ফুরিত মধুপের সুক্ষ্ণ কারুকাজ!