বিরোধ

বিরোধ

আমি যখন গ্রামের পথ ধরে হাটছি তখন প্রায় সন্ধ্যা।
একটু আনমনা হয়ে পথ হাঁটছিলাম।
: কি মিয়া আছো কেমন?
তাকিয়ে দেখি দাদার এক শিষ্য। মাহফিল উপলক্ষ্যে প্রতি বছর এই সময়টাতে সকলে এসে জড়ো হয়।
ঃ ভাল… আপনি?
ঃ গতিক ভালা ঠেকতাছে না। বুঝলা মিয়া। খবর পাইলাম এইবার সব পেন্ডেল ভাঙ্গা হবে। আমরা দুর দুরান্ত থেকে তোমাগো এলাকায় আহি। এইবার দেহি বিপদে পইরা যাইব। তুমি আইয়া পড়ছো , মনে একটু শক্তি পাই। যাও ফকির সাবকে বড় অস্থির দেইখা আইলাম। তোমার কথা বারবার জিগাইতেছিল।
গ্রামের এই পশ্চিম দিকটার খোলা মাঠে আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। পেন্ডেল টানানো হয়েছে। মঞ্চ তৈরী হয়েছে। প্রতি বছর এখানে মারফতী আর বাউল গানের উৎসব চলে । সকাল থেকে শুরু হয় ভোজের আয়োজন। ডেকের পর ডেক খিচুরি রান্না হয়। ছন্নছাড়া, ভিক্ষুক, ভবঘুরের দল পেট পুরে খায়। সাথে বাউল আর ফকিরের দল। গ্রামের মধ্যে পড়ে যায় উৎসবের সাজ সাজ রব। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দাদার শিষ্যরা আসেন। রাতে গানে গানে মেতে ওঠে সকলে। শেষ রাতে দাদার সুর মূর্ছুনায় মাতাল থাকে সমস্ত অর্ডিয়েন্স।

বাড়ির উঠানে পা দিতেই টের পাই, একটা চাপা উত্তেজনা। কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরলো,ি
বলল: শুন মিয়া এর একটা বিহিত করতে হবে।
: এবার রক্তারক্তি হইয়া যাইবো। আমরা পিছপা হবো না।

আমি চুপ করে থাকি। দাদার ঘরের দিকে পা বাড়াই।
চোখ বুজে আছেন ফকির সাহেব। শান্ত চেহারা। উত্তেজনার লেশ মাত্র তাঁর মুখবায়বে পড়ে নি। আমি পায়ের কাছে বসি ।

আফসার উদ্দিন ফকির। সকলে আছু ফকির বলে ডাকে। মাটি থেকে উঠে আসা এক সাধক পুরুষ। তার পূর্বপুরুষ সামর্থবান গৃহস্থ ছিলেন। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু- এই প্রবাদের তারা ছিলেন স্বার্থক চিত্ররূপ। বালক বেলা থেকে ফকির ছিলেন উদাসীন। ভাইয়েরা জমিতে লাঙ্গল নিয়ে করতো চাষের আয়োজন, পিছন থেকে পালিয়ে ফকির চলে যেতেন গানের আয়োজনে। শাস্ত্রীয় কোন গান বাজনা নয় , মাটির গান, সহজ সরল তার কথা আর সুর । আবাল্য থেকেছেন গানের সাথে মিশে । যৌবনে এসে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি কখনো এব্যাপারে কথা বলেননি। শুনেছি তাঁর শিষ্যদের কাছ থেকে। বছুরউদ্দিন মুন্সি নামে এক কামেল ফকির তার সমস্ত সত্তা কেড়ে নেন। মারফতের গোপন সাধনার দীক্ষা নেন। সমস্ত জীবন এই সাধনায় কাটিয়ে দিবার ব্রত নেন। কিন্তু একদিন মুন্সি বললেন- আছু বাড়ি যা সংসার কর, সংসার তোরে ডাক দিয়েছে। তারই ফলশ্র“তিতে আমার পিতা আসেন পৃথিবীতে। এপর্যায়ে কিছুকাল গৃহস্তিতে মন দেন। কিন্তু গানের নেশা ছাড়তে পারেন নি। আস্তে আস্তে তার ভক্ত বাড়তে লাগলো। সারাদিন ভক্তদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। রাতে চলে গভীর সাধনা, একে একে রচনা করতে থাকলেন গানের পর গান।

আমার পিতার রক্তে তার রক্ত যেন বইল না। তিনি বিষয়ী লোক । ব্যবসাটা বুঝে নিয়েছিলেন খুবই ভাল। ক্রমে ক্রমে তার সহায় সম্পত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকলো । আর সব ধনীদের মতো তিনিও আমাদের নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে পারি দেন। সেই সব অনেক দিন আগের কথা।

চোখ মেলে তাকালেন ফকির। আমাকে দেখে বললেন-
ঃ ভ্রমনের কান্তি তোমার চোখে মুখে। হাত মুখ ধোও , খাওয়া দাওয়া সারো। কথা আছে।
ঃ আমি তেমন ক্লান্ত নই। চারিদিকে একটা চাপা উত্তেজনা। যে কোন সময় একটা হুলস্থুল লেগে যেতে পারে! দৃঢ় ভাবে এটা থামানো দরকার। আমরা এর দায় ভার নিতে পারি না।

ফকির পূর্ববৎ স্থির হয়ে আছেন। তবে আমি ল্ক্ষ্য করলাম তারচেহারায় বিষাদের ছায়া। অন্তরের গভীর ভালোবাসার জায়গায় আঘাতে আহত হলে মানুষের দু:খ-মিশ্রিত ভাবাবেগে একধরনের প্রতিবাদ জন্ম লয়, তেমনি এক গহীন উচ্চারণে ফকির বললেন-
ঃ গান করে কি গভীর অপরাধ করেছি? বলো কবি, আমার কবি, তুমি যে কবিতা লিখ সেখানে কি তাল, ছন্দ নেই? ঐ যে পাখি ডাকে, হু হু বাতাস বহে সেখানে কি সুর তুমি খুজে পাও না ? আমি তো এদেশের মাটির সন্তান, বর্ষকালে ভেজা মাটির বুকে হেটে যাই একা একা , কান পেতে শুনি , সৃষ্টির উন্মাদনা তার পরতে পরতে, আমি হাটি আর মাটি তার রহস্যের পর্দা খুলে দেয়, আমি মুগ্ধ হই, দুলতে থাকি প্রকৃতির ছন্দে , বাতাস এসে সুর দিয়ে যায়, আমি শুধু আমার ছন্দে তাদের কথা বলি। বলো কি আমার অপরাধ? কেন তারা আমার এই মিলন মেলা ভেঙে দিবে? গান অপরাধ! এই যে লেংটা পোলাপান পেট পুরে খায়, তার কি কোন মূল্য নেই?
নিশ্চুপ থাকি আমি।
ঃ ঐ যে বেটারা আমাদের হুমকি ধমকি দিতাছে, আমি এর জবাব দিতে পারি , দাতভাঙ্গা জবাব। আমি তার জবাব দিব না। জবাব দিবে তুমি , তোমার মতো করে।

বলে হাতের ইশারায় সকলকে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন। শুধু আমি আর ফকির। জানালার পাশ দিয়ে পূর্নিমার চাঁদ এসে উঁকি মারলো। জোৎস্নার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত প্রাঙ্গন। রূপালী আলোতে মায়ার পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল আমাদের। জানালাটা বন্ধ করার ইশারা পেয়ে আমি জানালাটা বন্ধ করে দেই। একটা থমথমে নিথর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অন্ধকারে মনে হলো ফকির তার চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি কোন শব্দ উচ্চারণ করলাম না।

হঠাৎ যেন এক আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ দূর থেকে ডাক পাঠালো আমাকে ।
বললেন: কাছে এসো।
আমি কাছে গেলাম।
বললেন: চোখ বন্ধ করো।
চোখ বন্ধ করলাম। হঠাৎ বুক জুড়ে এক বাহুবন্ধনের মর্মস্পর্শী চাপ অনুভব করলাম। এ কেমন অনুভুতি আমি এর কোন ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারব না। আমি আমাতে থাকতে পারছি না। আমার সমস্ত আমি ক্রমাগত লীন হতে থাকলাম। লীন হতে হতে আমি মিশে যেতে থাকলাম সমস্ত প্রকৃতির সাথে। এই পাড়াগাঁ, শহর , বন্দর, দেশ, মহাদেশ হতে হতে আমি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরের সমস্ত অস্তিত্বের সাথে মিশে যেতে থাকলাম। নিজেকে বড়ই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হতে থাকলো। যেন আমি বিন্দুর বিলিয়াংশের চেয়ে ক্ষুদ্র এক অস্তিত্ব। সমগ্র ইতিহাস মানুষের-প্রগতি আর যুদ্ধকে শুন্য মনে হলো। মানুষের সমস্ত বিজয় মুহুর্তের মধ্যে এতটা নগন্য মনে হতে থাকলো যেন গো-খুড়ের আঘাতাক্রান্ত ধূলি। তারপর আমি মিশে যেতে থাকলাম সমস্ত প্রকৃতির সাথে। একফোটা জল যেমন সমুদ্রের অংশ তেমনি আমি নিজের মাঝে উপলব্ধি করতে লাগলাম সমস্ত প্রকৃতিকে। এক অভাবনীয় ক্ষমতা উপলব্ধি করলাম নিজের মাঝে।
বাহু বন্ধন শিথিল হয়ে এলো। আমি থমকে দাঁড়ালাম। সমস্ত শরীর থরো থরো কম্পমান।
আমি পুরোপুরি হিপনোটাইজ হয়ে গেলাম। ক্ষণে ক্ষণে নানা অনুভূতি আমার মাধ্যে উৎঘাটিত হতে থাকলো। আর সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে আমার একটি কথা বারবার মনে হতে থাকলো আজকের এই যে হামলা তা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত লোক-সংস্কৃতির যে ধারা বহমান এ হামলা তার স্রোতকে থমকে দিবার প্রাথমিক পদক্ষেপ। এ হামলা পরিকল্পিত কিনা তা বুঝতে না পারলেও তা প্রতিহত করার এক ব্যাপক তাগিদ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকলাম।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। উঠান জুড়ে লোকে লোকারন্য। বুঝতে পারি একটা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় দন্ডায়মান সকলে। মহিলারা হলুদ , মরিচ, পেয়াজ-রসুন বাটা স্থগিত করে দিয়েছে। বিশাল আয়োজন হয় প্রতিবছর। এবারও তার সমস্ত প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে আনা হয়েছিল। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সকলেই স্তম্ভিত।
আমি ইশারা দিতেই সকল মহিলারা আপন আপন কাজ শুরু করে দিল। সারারাত ধরে চলবে এসব প্রস্তুতি পর্ব। শেষ রাতের দিকে লাকড়ির চুলায় রান্না শুরু হবে। আমার ইশারায় স্থগিত হয়ে যাওয়া সকল কর্মকান্ড পুনরায় শুরু হয়ে গেল।

একা একা হাটতে হাটতে আমি পুবের ক্ষেতের দিকে চলে এলাম । জোৎস্নার প্লাবনে থই থই করছে সমস্ত প্রান্তর আর আমার বুক জুড়ে চলছে সুর্যের অন্তর্গত বিস্ফোরনের অগ্নিবান। নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রন রাখতে পারছি না। হেলোসিনেসন হচ্ছে হয়তো। একটার পর একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি-

একটা বিকট আওয়াজ। ছিন্নভিন্ন মানুষের দেহাংশ, এবরো থেবরো এখানে সেখানে কাঁপছে । ছোপ ছোপ রক্ত। এলোপাথারি ছুটাছুটি, কান্নার আহাজরী।

লাঠির আঘাতে আহত একজন যুবক। আর একটি, আর একটি। পতন। এক,দুই, তিন অসংখ্য আঘাত। রক্ত, নিথর দেহ। লাশের উপর মানুষের উল্লাস।

পাথরের তৈরী মূর্তিতে দড়ি দিয়ে বেধে টান। টান মারো টান, হইয়ো…… । পাথরের তৈরী খন্ডিত একতারা। মুখমন্ডল খানি যেন ফকিরের, দাড়িওয়ালা, মাথায় পাগড়ী।

না , না বলে চিৎকার করতে করতে দৌঁড়াতে শুরু করি। সরাসরি ফকিরের পা আকড়ে ধরি। কাঁপতে কাঁপতে বলি- আমার ভিতর থেকে সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তিকে তুলে নিন। আমি কিছুই দেখতে চাই না। আমি কিছু দেখতে চাই না।

6 thoughts on “বিরোধ

  1. নিবিড় মনযোগে লিখাটি পড়লাম। আছু ফকির সাহেবের ব্যাখ্যা লিখাটিকে অনন্য এবং সত্য মর্যাদা দিয়েছে। গল্পের কোথাও কোথাও প্লট পরিবর্তনের সময় প্যারার অভাব অনুভব করলেও সার্থক গল্প বলতে একজন পাঠকের দ্বিধা থাকার কথা নয়।

    শুভ সকাল বন্ধু।

  2. সত্যি ঘটনা মনে হলো
    সিলেটে এ রকম শুনেছি
    লিখা সুন্দর এক নিশ্বাসসেই পড়লমhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. লিখাটি এক নিশ্বাসে পড়া গেল জেনে নিজেকে কিছুটা স্বার্থক মনে হচ্ছে।

      ধন্যবাদ।

  3. “অন্তরের গভীর ভালোবাসার জায়গায় আঘাতে আহত হলে মানুষের দু:খ-মিশ্রিত ভাবাবেগে একধরনের প্রতিবাদ জন্ম লয়”……….. গল্পটি পড়লাম। দুই দুইবার।

    ভালো লেগেছে

    1. জেনে ভাল লাগছে যে আপনি গল্পটি দুইবার পড়েছেন।

      শুভ কামনা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।