গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা ( বিকাশ পর্ব -০২)

এ পর্বে যা পাবেন:
আত্মজীবনীতে নেরুদার চমকপ্রদ এক ঘটনা
আধুনিক কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা

কবিতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আত্মজীবনীতে নেরুদার চমকপ্রদ এক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন-
এলিয়টকে তো সবাই জানেন। অলঙ্করণবিদ ও নাট্যকার এবং অত্যুজ্জ্বল সমালোচক হওয়ার আগে তিনি আমার কবিতা পড়তেন। জেনে কৃতার্থ বোধ করছি। তাঁর চেয়ে ভাল বোদ্ধা আর কে? তারপর একদিন হলো কি, তিনি আমাকে তাঁর কবিতা পড়ে শোনাতে লাগলেন। আমি স্বার্থপরের মতো দৌড়ে পালাতে থাকি : –পড়বেন না, পড়বেন না, শোনাবেন না আমাকে। আমি বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিই কিন্তু এলিয়ট দরজার বাইরে দাড়িয়ে পড়েই যাচ্ছেন। আমার মনটা দমে গেল। ওদিকে ফ্রজার, স্কটল্যান্ডের কবি বলে উঠলেন—-এলিয়টের সাথে আপনার এ কেমন ধারার ব্যবহার? আমি তখন উত্তর দেই: শুনুন, আমি আমার পাঠক হারাতে চাই না। তাকে আমি সযত্নে ধীরে ধীরে তৈরী করেছি। সে আমার কবিতার চামড়ার কোঁচকানো বলিরেখা পর্যন্ত দেখতে পায়। এলিয়টের প্রতিভা কত্ত দিকেই না। তিনি আঁকতে পারেন, প্রবন্ধ লেখেন তিনি। কিন্তু আমি যে আমার পাঠক ধরে রাখতে চাই। ফেজার, প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন।

এরপর প্রসঙ্গের ইতি টেনেছেন এই বলে যে, কারণ হলো, সত্যি সত্যি এমনটাই যদি ঘটতে থাকে কবিরা কেবল লিখবেন অন্য কবিদের জন্য, তো হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা, কবি কবিতা লিখে যাচ্ছেন অন্য কবিদেরই জন্য, এইটা আমাকে টানে না…….. কবিতা তার পাঠকের সাথে সম্পর্ক হারিয়ে বসে আছে, কোন পাঠকই আর ধারে কাছে নেই……. তাকে কিন্তু ফিরিয়ে আনতে হবে……… কেবল তখনই আমরা সত্যিকার কবি হয়ে উঠব…….. কবিতাতো বাঁচবে এ লক্ষ্য নিয়েই।

আধুনিক কবিতা:

আধুনিক কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের, যার নাম আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ, যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে এবং ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র গ্রহব্যাপী। রোমান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্য শিল্পান্দোলন আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ, যা সারা পৃথিবী জুড়ে সৃষ্টি করেছে অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা। আধুনিকতাবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্প-সাহিত্যান্দোলন, যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা রীতিতে। আধুনিকতাবাদেও চরিত্র হচ্ছে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রথাগত রাষ্ট্রসীমা ভেঙ্গে ফেলা; এর স্বভাব আন্তর্জাতিকাবাদ। আধুনিকতাবাদের আগে, পশ্চিমে, শিল্পকলার জগতে বিপ্লব ঘটেছে প্রত্যেক শতকেই, বদলও ঘটেছে সংবেদনশীলতার, কিন্তু তা কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি, ওই বদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে, আধুনিকতা আসে এক মহা বিপর্যয় রূপে, যা আগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণভাবে। এর স্বভাব বিপর্যয়কর।

১৮৮০ সালকে মনে করা হয় আধুনিকতার সূচনাকাল, যখন দেখা দেন প্রথম আধুনিকেরা- মালার্মে, গতিয়ে, বদলেয়ারের কাছে। পশ্চিমে এ সময়, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ঈশ্বরকে বাজে কথায় পরিনত করা হয়। কতগুলো বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিসকে কেন্দ্র গড়ে উঠা মতবাদের প্রভাবে তারা ঈশ্বর বিমুখ হয়ে পড়েন, তারা সমালোচনা করেন বুর্জোয়া সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের; এবং চারপাশের সমাজ তাদের মনে শুধু বমনের উদ্রেগ করে। তারা শুরু থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী, শ্রদ্ধেয় ছিলেন না, তাদের লেখা অর্জন করে কেলেংকারির ও শিল্পকলায় সাফল্য। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ সালকে মনে করা হয় আধুনিকবাদের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়ে বিশ শতক দগ্ধ হয় অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে, প্রথম মহাযুদ্ধে, মেতে উঠে রক্তপাতে, যুদ্ধের পর অসীম অবিশ্বাস আর হতাশা থেকে জন্ম নেয় বিশ শতকের শিল্পকলা, যার মধ্যে আধুনিক কবিতা প্রধানতম। আধুনিকবাদের নিজের বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ১৯২২ কে যে বছর এলিয়টের পোড়ামাটি, রিলকের অর্ফিয়ুসের প্রতি সনেটগুচ্ছ, জয়েসের ইউলিসিস, লরেন্সের অ্যারন্স রড পভৃতি।

বাংলা সাহিত্যের তিরিশের দশকের অতি আধুনিকদের মধ্যে দু’জন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে- টি. এস. এলিয়টের কাব্যভাবনা, কবিতাশৈলী ও কাব্যভাষার মধ্যে দিয়ে তাদের নির্মাণ ও সৃষ্টির প্রভাময় উদ্যানকে করে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ। বাংলায় ১৯২৫ ‘আধুনিকবাদ’-এর সূচনা বছর; আর কয়েক বছর পরই বেরোয় পরিপূর্ণ আধুনিক চেতনা সম্পন্ন কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০), জীবনান্দ দাসের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), অমিয় চক্রবর্তীর ‘খসড়া” (১৯৩৮)। পশ্চিমে আধুনিকবাদ আসে দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কিন্তু বাংলায় ছিলনা কোন রকম প্রস্তুতি। আধুনিকতা পূর্ব বাংলা কবিতা সরল আবেগের কবিতা, কৈশোর বা প্রথম যৌবনের আবেগ, স্বপ্ন কাতরতাই বিষয় প্রথাগত বাঙলা কবিতার; আর ওই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যে অভিজ্ঞতা, তা সার্বজনীন অভিজ্ঞতা, তা শুধু কবির নয়, পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সার্বজনীন সাধারণ অভিজ্ঞতার বদলে প্রকাশ করে কবির অনন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা অধিকাংশ সময়ই মানসিক; আর আধুনিক কবিতা তা প্রকাশ করেছেন অভিনব ভাষায় ও অলংকারে। বিশ দশকে সূচনা ঘটে যে কবিতা, আর ষাটের দশকে ঘটে যে ধারার কবিদের শেষ উন্মেষ, সে কবিতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ ধারায় প্রথম পাঁচ জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু,বিষ্ণু দে-এ ধারায় শ্রেষ্ঠ কবি। আধুনিক ধারার কবিরা বাংলা কবিতায় এনে দিয়েছে অনেক সমৃদ্ধি এবং নিয়েছে পাঠকহীনতার দুর্নাম। এই ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশই একমাত্র কবি যিনি গেঁয়ো, শব্দ ব্যবহারে অসংযমী, এই অঞ্চলের প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে গিয়ে গহীন ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে কবিতা লিখেছেন। আর এই কারণেই সময়ের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি হয়ে উঠেছেন আরো গ্রহণীয়।

রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা:

আধুনিকবাদের মূল সূর যে প্রথাকে অস্বীকার করা তার চর্চা রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন করলেও আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘পূর্ববর্তী কাব্যচেতনাকে সম্পূর্ন রূপে অস্বীকার করা’ তার সাথে তিনি একমত পোষণ করেননি।
১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে বলেন –
মডার্ন বিলিতি কবিদের সম্বন্ধে আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। কাজটা সহজ নয়। কারণ, পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে। এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও বারবার সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ণ। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।

প্রথম বয়সে যে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল তাঁরা বাহিরকে নিজের অন্তরের যোগে দেখেছিলেন; জগৎটা হয়েছিল তাঁদের নিজের ব্যক্তিগত। আপন কল্পনা মত ও রুচি সেই বিশ্বকে শুধু যে কেবল মানবিক ও মানসিক করেছিল তা নয়, তাকে করেছিল বিশেষ কবির মনোগত।

ওয়ার্ডসওয়ার্থের জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়, শেলীর ছিল শেলীয়, বাইরনের ছিল বাইরনিক। রচনার ইন্দ্রজালে সেটা পাঠকেরও নিজের হয়ে উঠত।
দেখা যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজী কাব্যে পূর্ববর্তীকালের আচারের প্রাধান্য ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দিকে বাঁক ফিরিয়েছিল। তখনকার কালে সেইটাই হল আধুনিকতা। কিন্তু, আজকের দিনে সেই আধুনিকতা মধ্য ভিক্টোরিয়া প্রচীনতা সংজ্ঞা দিয়ে তাকে পাশের কামরায় আরাম-কেদারায় শুইয়ে রাখাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনকার দিনে ছাঁটা কাপড় ছাঁটা চুলের খট্খটে আধুনিকতা। আধুনিক কালের মনের মধ্যেও তাড়াহুড়া, সময়ের অভাব। জীবিকা জিনিসটা জীবনের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। তাড়া-লাগানো যন্ত্রের ভিড়ের মধ্যেই মানুষের হু হু করে কাজ করে, হুরমুর করে আমোদ-প্রমোদ।

গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা এত কর্কশ, এত নিষ্ঠুর হয়েছিল, তার বহুযুগ প্রচলিত যত-কিছু আদব আব্র“ তা সাংঘাতিক সংকটের মধ্যে এমন অকস্মাৎ ছারখার হয়ে গেল; দীর্ঘকাল যে-সমাজস্থিতিকে একান্ত বিশ্বাস করে সে নিশ্চিত ছিল তা একমুহূর্তে দীর্ণবিদীর্ণ হয়ে গেল; মানুষের যে শোভনরীতি কল্যাণনীতিকে আশ্রয় করেছিল তার বিধ্বস্ত রূপ দেখে এতকাল যা-কিছুকে সে ভদ্র বলে জানত তাকে দুর্বল বলে, আত্মপ্রতারণার উপায় বলে, অবজ্ঞা করাতেই যেন সে এক উগ্র আনন্দবোধ করতে লাগল; বিশ্বনিন্দুকতাকেই সে সত্যনিষ্ঠতা বলে আজ ধরে নিয়েছে। মধ্য ভিক্টোরীয় যুগ বাস্তবকে সম্মান করে তাকে শ্রদ্ধেয়রূপেই অনুভব করতে চেয়েছিল, এ যুগ বাস্তবকে অবনামিত করে সমস্ত আব্র“ ঘুচিয়ে দেওয়াকেই সাধনার বিষয় বলে মনে করে। অতএব মধ্য-ভিক্টোরীয় যুগকে যদি অতিভদ্রয়ানার পান্ডা বলে ব্যঙ্গ কর তবে এডায়ার্ডি যুগকেও ব্যঙ্গ করতে হয় উল্টো বিশেষণ দিয়ে। ব্যাপারখানা স্বাভাবিক নয়, অতএব শাশ্বত নয়। সায়েন্সেই বল আর আর্টেই বল, নিরাসক্ত মনই সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন; য়ুরোপ সায়েন্সে সেটা পেয়েছে কিন্তু সাহিত্যে তা পায় নি।”

রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা:

গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক সমস্ত মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ সফল। কিন্তু তার সেরা সফলতা ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজী অনুবাদ যা তাঁকে এনে দিয়েছিলো বিশ্ব স্বীকৃতি। ‘গীতাঞ্জলী’র কবিতাগুলি অনুবাদ করার সময় এবং পরবর্তীতে তার প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গদ্য-কবিতা লেখায় মূল উৎসাহ যোগায়। তিনি বলেন –
‘গীতাঞ্জলি’র গানগুলি ইংরেজী গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্য শ্রেণীতে গন্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্য ছন্দের সুষ্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা।

চলবে….।

3 thoughts on “গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা ( বিকাশ পর্ব -০২)

  1. প্রথমেই আপনার এবং আপনার পরিবার বর্গের প্রতি শান্তি কামনা।

    এ পর্বে (গদ্য কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ) যে বিষয়গুলি বর্ণনা করছেন- তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে যুগ এর প্রসঙ্গ— উদ্ধৃতি স্বরূপ নদীঃ এঁকেবেঁকে চলে আর প্রতিটি বাঁকে নতুন শাখার জন্ম দেয়। (কোনদিকে যাবে সে- কেউ জানে না; শুধু চলে যাবার পর থেকে যায় তার পদচিহ্ন- অম্লান হৃদয়ে।)

    গদ্য কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধে মূল দূর্গটি আবিষ্কার হবে এবং জয় হবে কবিতার- আশা রাখি।

  2. কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধটি বেশ সুচারুভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
    অভিনন্দন মি. ফকির আব্দুল মালেক। শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

  3. দীলখুশ মিঞারhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    হাই হ্যালো।

    আপনার এই প্রবন্ধ পড়ছি আর ভাবছি এই ধরনের প্রবন্ধ আপনি আর লিখছেন না কেন? শুধু প্রবন্ধ লিখে আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক হতে পারতেন।

    আপনার ভালো হোক।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।