গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা
ভূমিকাঃ সূচনা পর্ব।
গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা
বিকাশ পর্ব-০১
গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা
বিকাশ পর্ব-০২
শেষ পর্বঃ
এই পর্বে যা পাবেন:
আধনিকবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা লাভের সময়টাতে কি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি আত্মনিমগ্ন থেকেছেন?
আধুনিক কবিতা ও গদ্য কবিতা:
সম্ভবনা
আধনিকবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা লাভের সময়টাতে কি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
১৯৩৩ অব্দে প্রকাশিত হয় ‘পুনশ্চঃ’, ১৯৩৬-এ শেষ সপ্তক, ১৯৩৬-৩৭ এ ‘পত্রপুট’, ১৯৩৭-এ ‘শ্যামলী’ প্রকাশিত হয়। মোটামোটি বলা চলে কবিতায় এই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথ এ কাজগুলি করছিলেন।
‘পুনশ্চঃ’ কাব্যের কবিতাগুলো নিয়ে তিনি লিখেন-
“যখন কবিতাগুলো পড়বে তখন পূর্বাভাস মতো মনে করো না এগুলো পদ্য। অনেকে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে রুষ্ঠ হয়ে ওঠে। গদ্যের প্রতি গদ্যের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত। পুরুষকে সুন্দরী রমণীর মতো ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে, সে মেয়ের সৌন্দর্য নয়।
‘পুনশ্চঃ’ কবিতাগুলোকে কোন সংজ্ঞা দেবে? পদ্য নয়, কারণ পদ নেই। গদ্য বললে অতিব্যপ্তি দোষ ঘটে। পঙ্খিরাজ ঘোড়াকে পাখি বলবে না ঘোড়া বলবে? গদ্যের পাখা উঠছে এ কথা যদি বলি তবে শক্রপ বলে বসবে ‘পীপিলিকার পাখা গজে মরিবার তরে’। জলে স্থলে যে সাহিত্য বিভক্ত, সেই সাহিত্যে এই জিনিসটা জল নয়, তাই বলে মাটিও নয়। তাহলে খনিজ বলতে দোষ আছে কি? সোনা বলতে পারি এমন অহংকার যদি বা মনে থাকে, মুখে বলবার জো নেই। না হয় তাঁমাই হলো, অর্থাৎ এমন কোন ধাতু যা দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ চলে। গদাধরের মূর্তিও হতে পারে, তিলোত্তমাও হতে হয়। অর্থাৎ রূপরসাত্মক গদ্য, অর্থ ভারবহ গদ্য নয়, তৈজস গদ্য।”
‘শেষ সপ্তক’ প্রসঙ্গে কবি লিখেন-
সম্প্রতি কতগুলো গদ্য কবিতা জড়ো করে ‘শেষ সপ্তক’ নাম দিয়ে একখানি বই বের করেছি। সমালোচকরা ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি বলবেন। আমি কাব্যের পসারি, আমি শুধাই- লেখাগুলোর ভিতর কি স্বাদ নেই, ভঙ্গি নেই, থেকে থেকে কটাক্ষ নেই, সদর দরজার চেয়ে এর খিড়কির দুয়ারের দিকেই কি ইশারা নেই, গদ্যের বকুনির মুখে রাশ টেনে তার মধ্যে কি কোথাও দুলকির চাল আনা হয়নি, চিন্তাগর্ভ কথার মুখে কোনখানে অচিন্ত্যের ইঙ্গিত কি লাগল না, এর মধ্যে ছন্দোরাজকতার নিয়ন্ত্রিত শাসন না থাকলেও আত্মরাজকতার অনিয়ন্ত্রিত সংযম নেই কি? সেই সংযমের গুনে থেমে-যাওয়া কিংবা বেকে-যাওয়া কথার মধ্যে কোথাও কি নীরবের সরবতা পাওয়া যাচ্ছে না? এই সকল প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে এর সমালোচনা।
১৯৩৬-৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পত্রপুট’।
তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘পৃথিবী’ এই কাব্যের অন্তর্ভূক্ত। ‘পৃথিবী’তে তাঁর দক্ষতার অসাধারণ পরিচয় মিলে। তাঁর চিন্তা-চেতনা, ভাষা বিন্যাস, শব্দ চয়নে, রূপকে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিরলঃ
আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণ হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য্য হারিয়েছি
অকস্মাৎকল্লোলোচ্ছ্বাসে
‘শ্যামলী’তে যুক্ত হয় আমি, বাঁশিওয়ালা, ‘হঠাৎ দেখা’ প্রভৃতি অসাধারন কবিতা।
আধুনিক কবিতা ও গদ্য কবিতা:
আধুনিক কবিতা মূলত তার অভিব্যক্তির জন্য বৈশিষ্ট্যময় আর গদ্য কবিতা তার আঙ্গিক গঠনে। গদ্যে আধুনিক কবিতা লিখা যেতে পারে যেমন পারা যায় রোমান্টিক ধারার কবিতা, তখন তাকে গদ্য-কাব্যই বলা যাবে কিন্তু গদ্য-কাব্য হলেই তাকে আধুনিক কবিতা বলা যায় না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য-কবিতা। জীবনানন্দ দাস কিছু অসাধারন গদ্য কবিতা লিখেছেন যা সম্পূর্ন আধুনিক ধারার স্বার্থক কবিতা। আধুনিক কবিতা ছন্দে লিখা যায় কিন্তু গদ্য কবিতা ছন্দ মুক্ত থাকে।
কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি আত্মনিমগ্ন থেকেছেন?
যে অসময়টাকে সারা পৃথিবীর কাব্যজগত কেঁপে উঠেছিল ‘আধুনিকবাদ’ কবিতায় তিনি কি ঐ ধারাকে ঠিক আত্মস্থ করতে পারেনি? নাকি তিনি সচেতনভাবেই সেই ধারাকে উপেক্ষা করে গেছেন আর দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, আগামী দিনের কাব্য হবে গদ্য-কাব্য !
আধুনিক ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা তাকে এনে দিয়েছে অনন্য অবস্থান। রবীন্দ্রনাথের পরে, এমনকি কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ সহ বিচার করেও জীবনানন্দ দাশকে বাংলা কবিতায় দেন শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান। শিল্পকলায়, কবিতার সাথে কামের রয়েছে একটি গভীর সম্পর্ক, কোন কিছুই উৎকৃষ্ট শিল্পকলা হয়ে উঠে না যদি না তার ভেতর বয়ে চলে কামের উজ্জ্বল ধারা। যৌবন, যৌনতা, সৃষ্টিশীলতা উৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। যৌবনে রবীন্দ্রনাথ যে সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠেছিলেন ‘সোনার তরী’ ‘চিত্রা’কাব্যে, মধ্য বয়সে ‘ক্ষণিকা’ আর ‘বলাকা’য় এবং গানের ভুবনে যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন শেষ জীবনে এসে আধুনিকবাদের তোলপাড় করা ভাঙ্গাচূড়ার সময়টাতে তিনি যে কাব্যচর্চা করেছেন তা অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেও তা রবীন্দ্রনাথের মানের সাথে তাল মেলাতে পারেনি বলে বলা যায়। গদ্য কাব্যে রবীন্দ্রনাথ যেন এক নেতা, পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, সৃষ্টিশীলতার যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি হয়ে লড়তে পারেননি। পক্ষান্তরে প্রায় একই সময়ে অনন্য কবি প্রতিভা জীবনানন্দ দাশ যৌবনের সৃষ্টিশীলতার গগনচুম্বী অবস্থানে আধুনিক ধারায় আরো স্পষ্ট করে বললে রবীন্দ্র বলয় থেকে বাইরে এসে লিখেছেন ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) আর আরো কিছু পরে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭)।
জীবনানন্দ দাশ সহ আরো যারা আধুনিক ধারায় চর্চা করেছিলেন, তারা এক একজন অনন্য কবি প্রতিভা, উচ্চ শিক্ষিত, সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যে যারা সাবলীল বিচরণ করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে নেতা মেনে তার কমান্ডে বা দেখানো পথে কবিতা চর্চা করেননি। ফলে গত শতাব্দীর মধ্যে থেকে শেষের দিকে আধুনিক কবিতার ব্যাপক চর্চা হয়। ছোট বা বড় অনেক কবিই আধুনিক ধারায় লিখেন এবং সফল হন। তাই বলা চলে গদ্য কাব্য তেমনভাবে চর্চা হয়নি যদিও আধুনিক ধারার অনেক কবিই তাদের কাব্যগ্রন্থে দু’চারটি গদ্য কাব্য লেখার চেষ্টা করেন।
স্পষ্টত: বলা চলে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যে গদ্য-কাব্যের ধারা তৈরী করার পথ দেখিয়েছিলেন আধুনিক কবিতার ব্যাপক প্রভাবে তা স্থবির হয়ে পড়ে।
সম্ভবনাঃ
বিশ্ব সাহিত্যেও নানা চড়াই উৎরাইয়ের পর এক পর্যায়ে গদ্য-কাব্য স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে Simic তার গদ্য-কাব্যের বই The World doesn’t End পুলিৎজার পুরস্কার পাবার পর আবার গদ্য-কাব্যের নানা সংস্করণের প্রকাশনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইতিহাসের প্রায় প্রতি অধ্যায়েই গদ্য-কাব্য ছিল পরীক্ষামূলক বা বিকল্প ধারার সাহিত্য চর্চা কিন্তু বর্তমানে তা এখন মূলধারায় প্রতষ্ঠিত রূপ নিচ্ছে। বর্তমানে গদ্য-কাব্যের সংকলন প্রায়ই চোখে পরে। এখন প্রায়শই দেখা যায় মূলধারার কবিরা গদ্য-কাব্যের পূর্ণ বই লিখছেন। ১৯৮০ সালের শেষের দিকে এই ধারার লেখা জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয় এবং বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন নামী দামী জার্নালে যারা পূর্বে গদ্য কবিতাতে মনোনিবেশ করেননি তারাও গদ্য কবিতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
যারা প্রতিভাবান, বয়সে তরুণ, যৌবনের সৃষ্টিশীলতায় উদ্দীপ্ত তারা গদ্য কাব্যের এই ধারাটিকে আত্মস্থ করে চর্চা করতে পারেন। হয়ত এতে কবিতারই জয় হবে। তবে স্মরণ রাখতে হবে গদ্য কাব্য যেহেতু ছন্দের স্বাধীনতা নিয়ে কাব্য চর্চা করে তাই যথেচ্ছার ভাবে অযোগ্য লোকের দ্বারা হাস্যস্পদ উপাদানে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে পুনরাবৃত্তি করেই এই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই-
ছন্দে লেখা রচনা কাব্য হয়নি তার হাজার প্রমাণ আছে, গদ্য রচনাও কাব্য নাম ধরলেও কাব্য হবে না তার ভুরি ভুরি প্রমাণ জুটতে থাকবে। গদ্য সহজ সেই কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়। সহজের প্রলোভনেই মারাত্মক বিপদ ঘটে, আপনি এসে পড়ে অসতর্কতা। অসতর্কতাই অপমান করে কলালক্ষীকে, আর কলালক্ষী তার শোধ তোলেন অকৃতার্থতা দিয়ে। অসতর্ক লেখকদের হাতে গদ্যকাব্য অবজ্ঞা ও পরিহাসের উপাদান স্তুপাকার করে তুলবে এমন আশঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু এই সহজ কথাটা বলতেই হবে, যেটা কাব্য সেটা পদ্য হলেও কাব্য, গদ্য হলেও কাব্য।