ট্যাগ আর্কাইভঃ কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা (শেষ পর্ব)

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা
ভূমিকাঃ সূচনা পর্ব।

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা
বিকাশ পর্ব-০১

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা
বিকাশ পর্ব-০২

শেষ পর্বঃ

এই পর্বে যা পাবেন:
আধনিকবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা লাভের সময়টাতে কি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি আত্মনিমগ্ন থেকেছেন?
আধুনিক কবিতা ও গদ্য কবিতা:
সম্ভবনা

আধনিকবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা লাভের সময়টাতে কি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ?

১৯৩৩ অব্দে প্রকাশিত হয় ‘পুনশ্চঃ’, ১৯৩৬-এ শেষ সপ্তক, ১৯৩৬-৩৭ এ ‘পত্রপুট’, ১৯৩৭-এ ‘শ্যামলী’ প্রকাশিত হয়। মোটামোটি বলা চলে কবিতায় এই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথ এ কাজগুলি করছিলেন।

‘পুনশ্চঃ’ কাব্যের কবিতাগুলো নিয়ে তিনি লিখেন-
“যখন কবিতাগুলো পড়বে তখন পূর্বাভাস মতো মনে করো না এগুলো পদ্য। অনেকে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে রুষ্ঠ হয়ে ওঠে। গদ্যের প্রতি গদ্যের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত। পুরুষকে সুন্দরী রমণীর মতো ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে, সে মেয়ের সৌন্দর্য নয়।

‘পুনশ্চঃ’ কবিতাগুলোকে কোন সংজ্ঞা দেবে? পদ্য নয়, কারণ পদ নেই। গদ্য বললে অতিব্যপ্তি দোষ ঘটে। পঙ্খিরাজ ঘোড়াকে পাখি বলবে না ঘোড়া বলবে? গদ্যের পাখা উঠছে এ কথা যদি বলি তবে শক্রপ বলে বসবে ‘পীপিলিকার পাখা গজে মরিবার তরে’। জলে স্থলে যে সাহিত্য বিভক্ত, সেই সাহিত্যে এই জিনিসটা জল নয়, তাই বলে মাটিও নয়। তাহলে খনিজ বলতে দোষ আছে কি? সোনা বলতে পারি এমন অহংকার যদি বা মনে থাকে, মুখে বলবার জো নেই। না হয় তাঁমাই হলো, অর্থাৎ এমন কোন ধাতু যা দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ চলে। গদাধরের মূর্তিও হতে পারে, তিলোত্তমাও হতে হয়। অর্থাৎ রূপরসাত্মক গদ্য, অর্থ ভারবহ গদ্য নয়, তৈজস গদ্য।”

‘শেষ সপ্তক’ প্রসঙ্গে কবি লিখেন-
সম্প্রতি কতগুলো গদ্য কবিতা জড়ো করে ‘শেষ সপ্তক’ নাম দিয়ে একখানি বই বের করেছি। সমালোচকরা ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি বলবেন। আমি কাব্যের পসারি, আমি শুধাই- লেখাগুলোর ভিতর কি স্বাদ নেই, ভঙ্গি নেই, থেকে থেকে কটাক্ষ নেই, সদর দরজার চেয়ে এর খিড়কির দুয়ারের দিকেই কি ইশারা নেই, গদ্যের বকুনির মুখে রাশ টেনে তার মধ্যে কি কোথাও দুলকির চাল আনা হয়নি, চিন্তাগর্ভ কথার মুখে কোনখানে অচিন্ত্যের ইঙ্গিত কি লাগল না, এর মধ্যে ছন্দোরাজকতার নিয়ন্ত্রিত শাসন না থাকলেও আত্মরাজকতার অনিয়ন্ত্রিত সংযম নেই কি? সেই সংযমের গুনে থেমে-যাওয়া কিংবা বেকে-যাওয়া কথার মধ্যে কোথাও কি নীরবের সরবতা পাওয়া যাচ্ছে না? এই সকল প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে এর সমালোচনা।

১৯৩৬-৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পত্রপুট’।
তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘পৃথিবী’ এই কাব্যের অন্তর্ভূক্ত। ‘পৃথিবী’তে তাঁর দক্ষতার অসাধারণ পরিচয় মিলে। তাঁর চিন্তা-চেতনা, ভাষা বিন্যাস, শব্দ চয়নে, রূপকে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিরলঃ

আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণ হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য্য হারিয়েছি
অকস্মাৎকল্লোলোচ্ছ্বাসে

‘শ্যামলী’তে যুক্ত হয় আমি, বাঁশিওয়ালা, ‘হঠাৎ দেখা’ প্রভৃতি অসাধারন কবিতা।

আধুনিক কবিতা ও গদ্য কবিতা:

আধুনিক কবিতা মূলত তার অভিব্যক্তির জন্য বৈশিষ্ট্যময় আর গদ্য কবিতা তার আঙ্গিক গঠনে। গদ্যে আধুনিক কবিতা লিখা যেতে পারে যেমন পারা যায় রোমান্টিক ধারার কবিতা, তখন তাকে গদ্য-কাব্যই বলা যাবে কিন্তু গদ্য-কাব্য হলেই তাকে আধুনিক কবিতা বলা যায় না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য-কবিতা। জীবনানন্দ দাস কিছু অসাধারন গদ্য কবিতা লিখেছেন যা সম্পূর্ন আধুনিক ধারার স্বার্থক কবিতা। আধুনিক কবিতা ছন্দে লিখা যায় কিন্তু গদ্য কবিতা ছন্দ মুক্ত থাকে।

কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি আত্মনিমগ্ন থেকেছেন?

যে অসময়টাকে সারা পৃথিবীর কাব্যজগত কেঁপে উঠেছিল ‘আধুনিকবাদ’ কবিতায় তিনি কি ঐ ধারাকে ঠিক আত্মস্থ করতে পারেনি? নাকি তিনি সচেতনভাবেই সেই ধারাকে উপেক্ষা করে গেছেন আর দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, আগামী দিনের কাব্য হবে গদ্য-কাব্য !
আধুনিক ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা তাকে এনে দিয়েছে অনন্য অবস্থান। রবীন্দ্রনাথের পরে, এমনকি কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ সহ বিচার করেও জীবনানন্দ দাশকে বাংলা কবিতায় দেন শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান। শিল্পকলায়, কবিতার সাথে কামের রয়েছে একটি গভীর সম্পর্ক, কোন কিছুই উৎকৃষ্ট শিল্পকলা হয়ে উঠে না যদি না তার ভেতর বয়ে চলে কামের উজ্জ্বল ধারা। যৌবন, যৌনতা, সৃষ্টিশীলতা উৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। যৌবনে রবীন্দ্রনাথ যে সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠেছিলেন ‘সোনার তরী’ ‘চিত্রা’কাব্যে, মধ্য বয়সে ‘ক্ষণিকা’ আর ‘বলাকা’য় এবং গানের ভুবনে যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন শেষ জীবনে এসে আধুনিকবাদের তোলপাড় করা ভাঙ্গাচূড়ার সময়টাতে তিনি যে কাব্যচর্চা করেছেন তা অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেও তা রবীন্দ্রনাথের মানের সাথে তাল মেলাতে পারেনি বলে বলা যায়। গদ্য কাব্যে রবীন্দ্রনাথ যেন এক নেতা, পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, সৃষ্টিশীলতার যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি হয়ে লড়তে পারেননি। পক্ষান্তরে প্রায় একই সময়ে অনন্য কবি প্রতিভা জীবনানন্দ দাশ যৌবনের সৃষ্টিশীলতার গগনচুম্বী অবস্থানে আধুনিক ধারায় আরো স্পষ্ট করে বললে রবীন্দ্র বলয় থেকে বাইরে এসে লিখেছেন ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) আর আরো কিছু পরে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭)।

জীবনানন্দ দাশ সহ আরো যারা আধুনিক ধারায় চর্চা করেছিলেন, তারা এক একজন অনন্য কবি প্রতিভা, উচ্চ শিক্ষিত, সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যে যারা সাবলীল বিচরণ করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে নেতা মেনে তার কমান্ডে বা দেখানো পথে কবিতা চর্চা করেননি। ফলে গত শতাব্দীর মধ্যে থেকে শেষের দিকে আধুনিক কবিতার ব্যাপক চর্চা হয়। ছোট বা বড় অনেক কবিই আধুনিক ধারায় লিখেন এবং সফল হন। তাই বলা চলে গদ্য কাব্য তেমনভাবে চর্চা হয়নি যদিও আধুনিক ধারার অনেক কবিই তাদের কাব্যগ্রন্থে দু’চারটি গদ্য কাব্য লেখার চেষ্টা করেন।

স্পষ্টত: বলা চলে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যে গদ্য-কাব্যের ধারা তৈরী করার পথ দেখিয়েছিলেন আধুনিক কবিতার ব্যাপক প্রভাবে তা স্থবির হয়ে পড়ে।

সম্ভবনাঃ

বিশ্ব সাহিত্যেও নানা চড়াই উৎরাইয়ের পর এক পর্যায়ে গদ্য-কাব্য স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে Simic তার গদ্য-কাব্যের বই The World doesn’t End পুলিৎজার পুরস্কার পাবার পর আবার গদ্য-কাব্যের নানা সংস্করণের প্রকাশনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইতিহাসের প্রায় প্রতি অধ্যায়েই গদ্য-কাব্য ছিল পরীক্ষামূলক বা বিকল্প ধারার সাহিত্য চর্চা কিন্তু বর্তমানে তা এখন মূলধারায় প্রতষ্ঠিত রূপ নিচ্ছে। বর্তমানে গদ্য-কাব্যের সংকলন প্রায়ই চোখে পরে। এখন প্রায়শই দেখা যায় মূলধারার কবিরা গদ্য-কাব্যের পূর্ণ বই লিখছেন। ১৯৮০ সালের শেষের দিকে এই ধারার লেখা জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয় এবং বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন নামী দামী জার্নালে যারা পূর্বে গদ্য কবিতাতে মনোনিবেশ করেননি তারাও গদ্য কবিতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

যারা প্রতিভাবান, বয়সে তরুণ, যৌবনের সৃষ্টিশীলতায় উদ্দীপ্ত তারা গদ্য কাব্যের এই ধারাটিকে আত্মস্থ করে চর্চা করতে পারেন। হয়ত এতে কবিতারই জয় হবে। তবে স্মরণ রাখতে হবে গদ্য কাব্য যেহেতু ছন্দের স্বাধীনতা নিয়ে কাব্য চর্চা করে তাই যথেচ্ছার ভাবে অযোগ্য লোকের দ্বারা হাস্যস্পদ উপাদানে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে পুনরাবৃত্তি করেই এই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই-

ছন্দে লেখা রচনা কাব্য হয়নি তার হাজার প্রমাণ আছে, গদ্য রচনাও কাব্য নাম ধরলেও কাব্য হবে না তার ভুরি ভুরি প্রমাণ জুটতে থাকবে। গদ্য সহজ সেই কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়। সহজের প্রলোভনেই মারাত্মক বিপদ ঘটে, আপনি এসে পড়ে অসতর্কতা। অসতর্কতাই অপমান করে কলালক্ষীকে, আর কলালক্ষী তার শোধ তোলেন অকৃতার্থতা দিয়ে। অসতর্ক লেখকদের হাতে গদ্যকাব্য অবজ্ঞা ও পরিহাসের উপাদান স্তুপাকার করে তুলবে এমন আশঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু এই সহজ কথাটা বলতেই হবে, যেটা কাব্য সেটা পদ্য হলেও কাব্য, গদ্য হলেও কাব্য।

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা ( বিকাশ পর্ব -০২)

এ পর্বে যা পাবেন:
আত্মজীবনীতে নেরুদার চমকপ্রদ এক ঘটনা
আধুনিক কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা

কবিতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আত্মজীবনীতে নেরুদার চমকপ্রদ এক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন-
এলিয়টকে তো সবাই জানেন। অলঙ্করণবিদ ও নাট্যকার এবং অত্যুজ্জ্বল সমালোচক হওয়ার আগে তিনি আমার কবিতা পড়তেন। জেনে কৃতার্থ বোধ করছি। তাঁর চেয়ে ভাল বোদ্ধা আর কে? তারপর একদিন হলো কি, তিনি আমাকে তাঁর কবিতা পড়ে শোনাতে লাগলেন। আমি স্বার্থপরের মতো দৌড়ে পালাতে থাকি : –পড়বেন না, পড়বেন না, শোনাবেন না আমাকে। আমি বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিই কিন্তু এলিয়ট দরজার বাইরে দাড়িয়ে পড়েই যাচ্ছেন। আমার মনটা দমে গেল। ওদিকে ফ্রজার, স্কটল্যান্ডের কবি বলে উঠলেন—-এলিয়টের সাথে আপনার এ কেমন ধারার ব্যবহার? আমি তখন উত্তর দেই: শুনুন, আমি আমার পাঠক হারাতে চাই না। তাকে আমি সযত্নে ধীরে ধীরে তৈরী করেছি। সে আমার কবিতার চামড়ার কোঁচকানো বলিরেখা পর্যন্ত দেখতে পায়। এলিয়টের প্রতিভা কত্ত দিকেই না। তিনি আঁকতে পারেন, প্রবন্ধ লেখেন তিনি। কিন্তু আমি যে আমার পাঠক ধরে রাখতে চাই। ফেজার, প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন।

এরপর প্রসঙ্গের ইতি টেনেছেন এই বলে যে, কারণ হলো, সত্যি সত্যি এমনটাই যদি ঘটতে থাকে কবিরা কেবল লিখবেন অন্য কবিদের জন্য, তো হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা, কবি কবিতা লিখে যাচ্ছেন অন্য কবিদেরই জন্য, এইটা আমাকে টানে না…….. কবিতা তার পাঠকের সাথে সম্পর্ক হারিয়ে বসে আছে, কোন পাঠকই আর ধারে কাছে নেই……. তাকে কিন্তু ফিরিয়ে আনতে হবে……… কেবল তখনই আমরা সত্যিকার কবি হয়ে উঠব…….. কবিতাতো বাঁচবে এ লক্ষ্য নিয়েই।

আধুনিক কবিতা:

আধুনিক কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের, যার নাম আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ, যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে এবং ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র গ্রহব্যাপী। রোমান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্য শিল্পান্দোলন আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ, যা সারা পৃথিবী জুড়ে সৃষ্টি করেছে অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা। আধুনিকতাবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্প-সাহিত্যান্দোলন, যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা রীতিতে। আধুনিকতাবাদেও চরিত্র হচ্ছে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রথাগত রাষ্ট্রসীমা ভেঙ্গে ফেলা; এর স্বভাব আন্তর্জাতিকাবাদ। আধুনিকতাবাদের আগে, পশ্চিমে, শিল্পকলার জগতে বিপ্লব ঘটেছে প্রত্যেক শতকেই, বদলও ঘটেছে সংবেদনশীলতার, কিন্তু তা কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি, ওই বদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে, আধুনিকতা আসে এক মহা বিপর্যয় রূপে, যা আগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণভাবে। এর স্বভাব বিপর্যয়কর।

১৮৮০ সালকে মনে করা হয় আধুনিকতার সূচনাকাল, যখন দেখা দেন প্রথম আধুনিকেরা- মালার্মে, গতিয়ে, বদলেয়ারের কাছে। পশ্চিমে এ সময়, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ঈশ্বরকে বাজে কথায় পরিনত করা হয়। কতগুলো বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিসকে কেন্দ্র গড়ে উঠা মতবাদের প্রভাবে তারা ঈশ্বর বিমুখ হয়ে পড়েন, তারা সমালোচনা করেন বুর্জোয়া সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের; এবং চারপাশের সমাজ তাদের মনে শুধু বমনের উদ্রেগ করে। তারা শুরু থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী, শ্রদ্ধেয় ছিলেন না, তাদের লেখা অর্জন করে কেলেংকারির ও শিল্পকলায় সাফল্য। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ সালকে মনে করা হয় আধুনিকবাদের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়ে বিশ শতক দগ্ধ হয় অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে, প্রথম মহাযুদ্ধে, মেতে উঠে রক্তপাতে, যুদ্ধের পর অসীম অবিশ্বাস আর হতাশা থেকে জন্ম নেয় বিশ শতকের শিল্পকলা, যার মধ্যে আধুনিক কবিতা প্রধানতম। আধুনিকবাদের নিজের বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ১৯২২ কে যে বছর এলিয়টের পোড়ামাটি, রিলকের অর্ফিয়ুসের প্রতি সনেটগুচ্ছ, জয়েসের ইউলিসিস, লরেন্সের অ্যারন্স রড পভৃতি।

বাংলা সাহিত্যের তিরিশের দশকের অতি আধুনিকদের মধ্যে দু’জন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে- টি. এস. এলিয়টের কাব্যভাবনা, কবিতাশৈলী ও কাব্যভাষার মধ্যে দিয়ে তাদের নির্মাণ ও সৃষ্টির প্রভাময় উদ্যানকে করে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ। বাংলায় ১৯২৫ ‘আধুনিকবাদ’-এর সূচনা বছর; আর কয়েক বছর পরই বেরোয় পরিপূর্ণ আধুনিক চেতনা সম্পন্ন কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০), জীবনান্দ দাসের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), অমিয় চক্রবর্তীর ‘খসড়া” (১৯৩৮)। পশ্চিমে আধুনিকবাদ আসে দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কিন্তু বাংলায় ছিলনা কোন রকম প্রস্তুতি। আধুনিকতা পূর্ব বাংলা কবিতা সরল আবেগের কবিতা, কৈশোর বা প্রথম যৌবনের আবেগ, স্বপ্ন কাতরতাই বিষয় প্রথাগত বাঙলা কবিতার; আর ওই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যে অভিজ্ঞতা, তা সার্বজনীন অভিজ্ঞতা, তা শুধু কবির নয়, পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সার্বজনীন সাধারণ অভিজ্ঞতার বদলে প্রকাশ করে কবির অনন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা অধিকাংশ সময়ই মানসিক; আর আধুনিক কবিতা তা প্রকাশ করেছেন অভিনব ভাষায় ও অলংকারে। বিশ দশকে সূচনা ঘটে যে কবিতা, আর ষাটের দশকে ঘটে যে ধারার কবিদের শেষ উন্মেষ, সে কবিতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ ধারায় প্রথম পাঁচ জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু,বিষ্ণু দে-এ ধারায় শ্রেষ্ঠ কবি। আধুনিক ধারার কবিরা বাংলা কবিতায় এনে দিয়েছে অনেক সমৃদ্ধি এবং নিয়েছে পাঠকহীনতার দুর্নাম। এই ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশই একমাত্র কবি যিনি গেঁয়ো, শব্দ ব্যবহারে অসংযমী, এই অঞ্চলের প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে গিয়ে গহীন ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে কবিতা লিখেছেন। আর এই কারণেই সময়ের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি হয়ে উঠেছেন আরো গ্রহণীয়।

রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা:

আধুনিকবাদের মূল সূর যে প্রথাকে অস্বীকার করা তার চর্চা রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন করলেও আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘পূর্ববর্তী কাব্যচেতনাকে সম্পূর্ন রূপে অস্বীকার করা’ তার সাথে তিনি একমত পোষণ করেননি।
১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে বলেন –
মডার্ন বিলিতি কবিদের সম্বন্ধে আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। কাজটা সহজ নয়। কারণ, পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে। এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও বারবার সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ণ। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।

প্রথম বয়সে যে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল তাঁরা বাহিরকে নিজের অন্তরের যোগে দেখেছিলেন; জগৎটা হয়েছিল তাঁদের নিজের ব্যক্তিগত। আপন কল্পনা মত ও রুচি সেই বিশ্বকে শুধু যে কেবল মানবিক ও মানসিক করেছিল তা নয়, তাকে করেছিল বিশেষ কবির মনোগত।

ওয়ার্ডসওয়ার্থের জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়, শেলীর ছিল শেলীয়, বাইরনের ছিল বাইরনিক। রচনার ইন্দ্রজালে সেটা পাঠকেরও নিজের হয়ে উঠত।
দেখা যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজী কাব্যে পূর্ববর্তীকালের আচারের প্রাধান্য ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দিকে বাঁক ফিরিয়েছিল। তখনকার কালে সেইটাই হল আধুনিকতা। কিন্তু, আজকের দিনে সেই আধুনিকতা মধ্য ভিক্টোরিয়া প্রচীনতা সংজ্ঞা দিয়ে তাকে পাশের কামরায় আরাম-কেদারায় শুইয়ে রাখাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনকার দিনে ছাঁটা কাপড় ছাঁটা চুলের খট্খটে আধুনিকতা। আধুনিক কালের মনের মধ্যেও তাড়াহুড়া, সময়ের অভাব। জীবিকা জিনিসটা জীবনের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। তাড়া-লাগানো যন্ত্রের ভিড়ের মধ্যেই মানুষের হু হু করে কাজ করে, হুরমুর করে আমোদ-প্রমোদ।

গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা এত কর্কশ, এত নিষ্ঠুর হয়েছিল, তার বহুযুগ প্রচলিত যত-কিছু আদব আব্র“ তা সাংঘাতিক সংকটের মধ্যে এমন অকস্মাৎ ছারখার হয়ে গেল; দীর্ঘকাল যে-সমাজস্থিতিকে একান্ত বিশ্বাস করে সে নিশ্চিত ছিল তা একমুহূর্তে দীর্ণবিদীর্ণ হয়ে গেল; মানুষের যে শোভনরীতি কল্যাণনীতিকে আশ্রয় করেছিল তার বিধ্বস্ত রূপ দেখে এতকাল যা-কিছুকে সে ভদ্র বলে জানত তাকে দুর্বল বলে, আত্মপ্রতারণার উপায় বলে, অবজ্ঞা করাতেই যেন সে এক উগ্র আনন্দবোধ করতে লাগল; বিশ্বনিন্দুকতাকেই সে সত্যনিষ্ঠতা বলে আজ ধরে নিয়েছে। মধ্য ভিক্টোরীয় যুগ বাস্তবকে সম্মান করে তাকে শ্রদ্ধেয়রূপেই অনুভব করতে চেয়েছিল, এ যুগ বাস্তবকে অবনামিত করে সমস্ত আব্র“ ঘুচিয়ে দেওয়াকেই সাধনার বিষয় বলে মনে করে। অতএব মধ্য-ভিক্টোরীয় যুগকে যদি অতিভদ্রয়ানার পান্ডা বলে ব্যঙ্গ কর তবে এডায়ার্ডি যুগকেও ব্যঙ্গ করতে হয় উল্টো বিশেষণ দিয়ে। ব্যাপারখানা স্বাভাবিক নয়, অতএব শাশ্বত নয়। সায়েন্সেই বল আর আর্টেই বল, নিরাসক্ত মনই সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন; য়ুরোপ সায়েন্সে সেটা পেয়েছে কিন্তু সাহিত্যে তা পায় নি।”

রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা:

গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক সমস্ত মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ সফল। কিন্তু তার সেরা সফলতা ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজী অনুবাদ যা তাঁকে এনে দিয়েছিলো বিশ্ব স্বীকৃতি। ‘গীতাঞ্জলী’র কবিতাগুলি অনুবাদ করার সময় এবং পরবর্তীতে তার প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গদ্য-কবিতা লেখায় মূল উৎসাহ যোগায়। তিনি বলেন –
‘গীতাঞ্জলি’র গানগুলি ইংরেজী গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্য শ্রেণীতে গন্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্য ছন্দের সুষ্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা।

চলবে….।

গদ্য কবিতাঃ সূচনা, বিকাশ, সম্ভবনা ( বিকাশ পর্ব-০১)

এই পর্বে যা পাবেন:

গদ্য কবিতা কি?

গদ্য কবিতা কি কবিতা?

হুইট ম্যানের সংক্ষিপ্ত জীবনী।

রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক অনুবাদকৃত হুইটম্যানের একটি কবিতা ও পদটিকা।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি প্রতিভা পাবলো নেরুদা।

গদ্য কবিতা কি ?

গদ্য কবিতা সে-ই কবিতা যা গদ্যে লিখিত হয়; অন্য কথায় পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রত উৎকৃষ্ট জাতীয় কবিতার নাম গদ্য কবিতা। প্রকৃতির বাস্তবতার কাব্যিক ব্যঞ্জনার নাম গদ্য কবিতা। গদ্য কবিতা প্রচীন যুগে হিব্রু স্কলারদের দ্বারা প্রথম লিখিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে নাম-না-জানা কয়েকজন লেখক ইংরেজীতে গ্রীক ও হিব্রু বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন। স্বীকার না করে উপায় নেই যে, সলোমনের গান ডেভিডের গাথা সত্যিকার কাব্য। এই অনুবাদের ভাষায় আশ্চর্য শক্তি এদের মধ্যে কাব্যের রস ও রূপকে নিঃসংশয়ে পরিস্ফুট করেছে। এই গানগুলোতে গদ্যছন্দের মুক্ত পদপেক্ষ লক্ষণীয়। তথাপিও বলা যায় ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হয় Aloysius Bertand -এর Gespard La nuit যা গদ্য কবিতাকে প্রথম স্বীকৃতি এনে দেয়। এর ছন্দোময় ও কাব্যিক ভাষা পরবর্তীতে অনেককে এই ফরমেটে কবিতা লেখাতে আগ্রহী করে তুলে। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয় Bandelaire-এর Petis poems en Prose. অন্য লেখকদের মধ্যে Rimbond এবং Oscar Wilde, Amy Lowell এই ধারায় লেখার প্রয়াস পান। Virginia Wolf কমপক্ষে একটি উপন্যাস এই ধারায় অনুসরণ করেন যেমন করেন Gertrnde Stien- Tender Buttons-এ। এর শুরু হয় ফ্রান্স থেকে এবং পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সাউথ আমেরিকায় Pablo Neruda এবং Borges, রাশিয়ার Turgenev, ইতালীতে Marinetti এবং ডেনমার্কে J. B. Jacobson, উত্তর আমেরিকায় Whitman, Robert Bly, W. S. Merwin প্রমুখ এই ধারার স্বার্থক ও প্রমাণিত কবি।

গদ্য কবিতা কি কবিতা?

এই বিষয়ে তর্কের শেষ নেই। কারো মতে গদ্য কবিতা একটি বিশেষ ধারার কবিতাই বটে কেননা এটা রূপক ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। অপর কারো মতে গদ্য কবিতা গদ্য। আধুনিকবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী T. S. Eliot গদ্য কবিতার বিপক্ষে জোড়ালো বক্তব্য তুলে ধরেন যদিও তিনি নিজে দু-একটি চেষ্টাও করেছেন এই ধারায়। বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশক যিনি তার কর্মের মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্যে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রসঙ্গে বলেছেন -গদ্যকাব্য নিয়ে সন্দিগ্ধ পাঠকের মনে তর্ক চলছে। এতে আশ্চর্যের বিষয় নেই। ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাত রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, মনকে দুলিয়ে তোলে , এ কথা স্বীকার করতে হবে। তবে ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে, ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় তার আনুসঙ্গ হয়ে। সহায়তা করে দুই দিক থেকে। এক হচ্ছে স্বভাবতই তার দোলা দেবার শক্তি আছে, আর- এক হচ্ছে পাঠকের চিরাভ্যস্ত সংস্কার। এই সংস্কারের কথাটা ভাববার বিষয়।
একদা নিয়মিত অংশে বিভক্ত ছন্দই সাধু কাব্য ভাষায় একমাত্র পাঙ্ক্তেয় পদ্য ছিল। তখন ছন্দে মিল রাখাও ছিল অপরিহার্য। এমন সময় মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে আমাদের সংস্কারের প্রতিকুলে আনলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। তাতে রইল না মিল। তাতে লাইনের বেড়াগুলি সমানভাবে সাজানো বটে, কিন্তু ছন্দের পদক্ষেপ চলে ক্রমাগত বেড়া ডিঙিয়ে। অর্থাৎ এর বঙ্গি পদ্যের মতো কিন্তু ব্যবহার চলে গদ্যের চালে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের মিলবর্জিত অসমতাকে কেউ কাব্যরীতির বিরোধী বলে কাজ মনে করেন না। অথচ পুর্বতন বিধানকে এই ছন্দ বহুদূর লঙ্ঘন করে গেছে। কাজটা সহজ হয়েছিল, কেননা তখনকার ইংরেজী শেখা পাঠকেরা মিল্টন , শেক্স-পিয়ারের ছন্দকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কী হতে পারে এবং হতে পারে না, তা হওয়ার উপরই নির্ভর করে, লোকের অভ্যাসের উপর করে না, এ কথাটা ছন্দই পূর্বেই প্রমাণ করেছে। আজ গদ্যকাব্যের উপর প্রমাণের ভার পড়েছে যে, গদ্যেও কাব্যের সঞ্চরণ অসাধ্য নয়।
সবশেষে এই একটি কথা বলবার আছে, কাব্য প্রত্যহিক সংসারের অপরিমার্জিত বাস্তবতা থেকে যতদূরে ছিলো এখন তা নেই। এখন সমস্তকেই সে আপন রসলোক উত্তীর্ণ করতে চায়, এখন সে স্বর্গারোহন করবার সময়ও সংগের কুকুরটিকে ছাড়ে না। বাস্তব জগৎ ও রসের জগতের সমন্বয় সাধনে গদ্য কাজে লাগবে; কেননা গদ্য সুচিবায়ুগ্রস্ত নয়।

আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে গদ্যে কাব্য রচনা ওয়াল্ট হুইটম্যান।
তিনি ১৮১৯ সালের ৩১ মে নিউ ইয়র্কের ওয়েষ্ট হিলে জন্মগৃহণ করেন। তার মা ছিলেন ডাচ্ বংশদ্ভোত কোর্য়াকার (জর্জ ফান কর্তৃংক প্রতিষ্ঠিত খ্রিষ্টধর্ম সম্প্রদায় বিশেষ) বিশ্বাসী ও ধর্মের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা ছিল, আর ছিলেন স্বল্প- শিক্ষিত, হুইটম্যানের মা তাঁর কবিতা কখনো পড়েননি কিন্তু তিনি তাকে দিয়েছেন শর্তহীন ভালোবাসা। পিতা কাঠ ও রাজমিস্ত্রি ছিলেন। সন্দেহ কারার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, হুইটম্যানের পিতা কখনো তার কবিতা পড়েছেন কিনা কিম্বা পড়লেও বুঝতেন কিনা। তিনি নয় সন্তানের জনক ছিলেন এবং সংসার নিয়ে বিব্রত ছিলেন।
নয়জনের দ্বিতীয়, বালক ওয়াল্ট হুইটম্যান এগারো বছর বয়সে ছাপার জগতের সাথে যুক্ত হন উপার্জনের তাগিদে এবং লিখা ও ছাপার অক্ষরের প্রেমে পড়ে যান। তিনি মূলত ছিলেন স্ব-শিক্ষিত এবং ক্ষুধার্ত পাঠক। জীবনের শুরুতেই তিনি হোমার, দান্তে, শেক্সপিয়ার ও স্কট প্রমুখের লেখার সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি বাইবেল বিস্তারিত অধ্যয়ন করেন এবং ঈশ্বর-প্রেমিক কবিদের মতো ধর্ম ও মানবতার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ রচনা করতে চাইতেন।
সম্পূর্ণভাবে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ার পূর্বে তিনি ভিন্ন ধারার শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। Brooklyn Free man নামে বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় -মুক্ত মানবের ছোট নদী- একটি পত্রিকা তিনি প্রকাশ করেন। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৫ সালের মধ্যে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম Leves of gress-এর কবিতাগুলো প্রকাশ করেন। তার দ্বারা পাবলো নেরুদা ব্যাপকভাবে আলোড়িত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তার -শেষ সপ্তক–এর গদ্য কবিতাগুলো লিখছিলেন তখন তার দ্বারা প্রভাবিত হন বলে ধারনা করা যায়। তিনি Leves of gress কাব্যের I saw in Lonisiana a Live-oak growing কবিতা অনুবাদ করেন। তরজমাটা নিম্নরূপ-
লুইসিয়ানাতে দেখলুম একটি ওকগাছ বেড়ে উঠছে;
একলা সে দাঁড়িয়ে, তার ডালগুলো থেকে শ্যাওলা পড়ছে ঝুলে।
কোন দোসর নেই তার, ঘন সবুজ পাতায় কথা কইছে তার খুশিটি।
তার কড়া খাড়া তেজালো চেহারা মনে করিয়ে দিলে আমারই নিজেকে।
আশ্চর্য লাগল কেমন করে এ গাছ ব্যক্ত করছে খুশি-ভরা
আপন পাতাগুলো যখন না আছে ওর বন্ধু, না আছে দোসর।
আমি বেশ জানি আমি তো পারতুম না।
গুটিকতক পাতাওয়ালা একটি ডাল তার ভেঙে নিলেম,
তাতে জড়িয়ে দিলেম শ্যাওলা।
নিয়ে এসে চোখের সামনে রেখে দিলেম আমার ঘরে;
প্রিয় বন্ধুদের কথা স্মরণ করাবার জন্যে সে তা নয়।
(সম্প্র্র্রতি ঐ বন্ধুদের ছাড়া আর কোন কথা আমার মনে ছিল না।)
ও রইল একটি অদ্ভুত চিহ্নের মতো,
পুরুষের ভালোবাসা যে কী তাই মনে করাবে।
তাই যাই হোক, যদিও সেই তাজা ওকগাছ
লুইসিয়ানার বিস্তীর্ণ মাঠে একলা ঝল্মল্ করছে,
বিনা দোসরে খুশিতে ভরা পাতাগুলো প্রকাশ করছে চিরজীবন ধরে,
তবু আমার মনে হয় আমি তো পারতুম না।

কবিতাটি তরজমা শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখেন- এক দিকে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ ওকগাছ, একলা আপন আত্মসম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতায় আনন্দময়, আর একদিকে একজন মানুষ, সেও কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ, কিন্তু তার আনন্দ অপো করছে প্রিয় সঙ্গের জন্য এটি কেবলমাত্র সংবাদরূপে গদ্যে বলবার বিষয় নয়। এর মধ্যে কবির আপন মনোভাবের একটি ইশারা আছে। একলা গাছের সঙ্গে তুলনায় একলা বিরহী-হৃদয়ের উৎকন্ঠা আভাসে জানানো হল। এই প্রচ্ছন্ন আবেগের ব্যঞ্জনা, এই তো কাব্য; এর মধ্যে ভাব বিন্যাসের শিল্প আছে, তাকেই বলব ভাবের ছন্দ।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি প্রতিভা পাবলো নেরুদা। কবিতা-নির্মাণ-কুশলতায় কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য এবং নিসর্গ এবং ঐতিহ্যের চেতনায় বলীয়ান হয়ে তিনি যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন আন্তর্জাতিক কবিতা অঙ্গনে এ আজ পরম বিস্ময়ের বিষয়। এই কবির জন্ম ১৯০৪ সালে চিলিতে এক রেলশ্রমিক ও স্কুল শিক্ষিকার ঘরে। তার শৈশব কেটেছে কোন্সেপ্সিওন্ প্রদেশে দক্ষিণে। বন্যা, প্রবল বর্ষণ, নিসর্গ, নদী, ঘন বন এই অঞ্চলের প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। শৈশবের নদী, নিসর্গ ও জীববৈচিত্র্য তার জীবনচর্যায় প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কুড়িটি প্রেম এক্ষং একটি বিরহের গান- নামক কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সাথে সাথেই সমঝদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল চিলির এক অখ্যাত লেখকের দিকে, ইনি নিজের পরিচয় দিতেন পাবলো নেরুদা রূপে।
কুঁড়িটি…………….গান বইখানিতে কোন আড়ম্বর ছিলনা, কিন্তু যারা এই বইটি পড়ল তারাই বুঝল যে, এমন একজন কবির জন্ম হয়েছে, তিনি বাঁধাধরা নিয়ম থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন, নিজের পথ খুঁজে বের করে নিতে পারবেন।
পাবলো নেরুদা এমন মহৎ কবি যিনি জীবদ্দশায় হয়ে উঠেছিলেন নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে সত্যিকার অর্থেই কিংবদন্তিতুল্য। ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কার পান। আর সেই বছর তিনি যে নোবেল ভাষণ দেন তাতে তাঁর কবিতা রচনার জন্য যে ভেতরমুখী তাগিদ কাজ করছিল, তার উল্লেখ আছে। সেই বক্তৃতায় তিনি বলেন-
ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, আমি কোন বই পড়ে কবিতা লিখতে শিখিনি। কাউকে আমি শিখাতেও পারবো না কি করে কবিতা লিখতে হয়। আজকের এই পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সেই দিনটার কথা মনে করলে কিছু ভাবনার সৃষ্টি হয়। সেই ভাবনাগুলো আমি ভেজাল শব্দ দ্বারা প্রকাশ করিনা, কিন্তু নিজের কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। তাই আমার পথ চলার কাহিনী দিয়ে একটি কবিতা তৈরী হয়ে যায়। তাতে আমি মাটি থেকে উপাদান নেই। আমার কাছে একাকীত্ব, ভাবনার বিশ্বস্ততা, আবেগ ও গতি, নিজের কাছে আসা, মানুষের কাছে আসা, প্রকৃতির গোপনীয়তা প্রকাশ, আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি মানুষ তার ছায়ার সাথে, আচরনের সাথে কবিতার সাথে যে আটকে আছে, মানুষের যে সমাজবদ্ধতার চেতনা, তা সম্ভব হয়েছে কারণ মানুষের প্রচেষ্টা আছে স্বপ্ন আর বাস্তবকে একসাথে মেলাবার। কবিতা এই স্বপ্ন আর বাস্তবকে মেলাবার কাজটা করে।

হুইটম্যানকে তিনি মিলিয়ে নিয়েছিলেন গভীরভাবে তাঁর সত্ত্বার সাথে। সে কথা বারবার বলেছেন নানা সাক্ষাৎকারে। হুইটম্যানের কাব্যকৃতিকে তিনি মান্য করতেন। ১৯৯৬ সালে ১২ জুলই নিউ ইয়র্কে নেরুদা এক সাক্ষাৎকারে রবার্ট ব্লাইকে বলেন–
দক্ষিন আমেরিকার কবিতা কিন্তু পুরোপুরি অন্যরকম ব্যাপার। জানেনইতো আমাদের দেশগুলোয় এমন অনেক নদী আছে যাদের কোন নাম নেই, আছে এমন অনেক গাছ যাকে কেউই জানেনা, আছে এমন অনেক পাখি যাদের কেউই কখনো বর্ণনা দেয়নি। আমাদের পক্ষে বরং পরাবাস্তবিক হয়ে উঠাই সহজ, কারণ আমরা যা যা জানি সবই নতুন। আমরা যেভাবে বুঝেছি, আমাদের কাজ তাই মনে হয় যার কথা কেউ কখনও শোনেনি তারই কথা শোনালেন। সবকিছুই আঁকা হয়ে গেছে ইউরোপে, সবকিছুই গান গাওয়া হয়ে গেছে ইউরোপে কিন্তু আমেরিকায় তা নয়। সেই অর্থে, হুইটম্যান ছিলেন মহান শিক্ষক। কারণ হুইটম্যান আসলে কী বা কে? তিনি শুধু প্রখরভাবে সচেতনই ছিলেন না, ছিলেন দুচোখ খোলা মানুষ। তাঁর ছিল বিশাল ডাগর দুই চোখ, সবকিছু দেখার জন্য উৎসুক তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন কেমন করে কিছু দেখতে হয়। তিনি আমাদের কবি।
তাছাড়া অনেক মার্কিন কবি শুধু এলিয়টকে অনুসরণ করেই ভেবেছিলেন হুইটম্যান ছিলেন বড্ড গেঁয়ো, বড্ড আদিম, অথচ তিনি আদপেই কিন্তু সহজ সরল কিছু নন। হুইটম্যান-তিনি ছিলেন আন্তর্গূঢ় জটিল মানুষ, আর যেখানেই তিনি সেরা সেখানেই সবকিছু জটিলতায় ভরা। তার চোখ ছিল জগতের দিকে খোলা, আর তিনিই আমাদেরকে কবিতা সম্বন্ধে শিখিয়েছেন, আরো কতোকিছু শিখিয়েছেন। আমরা তাকে খুব ভালোবাসতাম। আমাদের উপর এলিয়টের প্রায় কোন প্রভাবই পড়েনি। হয়ত তিনি খুবই বুদ্ধিবাদী বলেই, আর আমরাতো খুবই সেকেলে, আদিম। তাছাড়া প্রত্যেককেইতো নিজের নিজের পথ বেছে নিতে হয় -সে কি হবে সূক্ষ্ম, বুদ্ধি নির্ভর পথ, নাকি অনেক খোলামেলা, ভাই-বন্ধুতে ভরা, সাধারণ মানুষের পথ, যে চেষ্টা করেছে তার চারপাশের জগৎটাকে বুকে টেনে নিতে, নতুন জগৎটাকে আবিস্কার করতে?

চলবে…. আশা করি সাথেই পাব।
ধন্যবাদ।

গদ্য কবিতা: সূচনা, বিকাশ ও সম্ভবনা ( প্রথম অংশ)

কবিতা কি?

ড. হুমায়ুন আজাদ তার -আমার অবিশ্বাস- গ্রন্থে কবিতাকে নির্ণয় করতে বর্ণনা করেছেন — যা কিছু প্রিয় আমার, যা কিছুর জন্য নিরর্থক জীবনধারনকে তাৎপর্য মনে হয়, বেঁচে থাকাকে সুখকর মনে হয়, তা রাষ্ট্র নয় সংঘ নয় সুধীদের কর্মীদের রাজনীতিবীদদের বিবর্ণতা নয়, সেগুলো খুবই সামান্য ব্যাপার, আর সে শুরুতেই রয়েছে কবিতা। সমাজ, বিশেষ করে রাষ্ট্রের কবিতার দরকার নেই; কোন রাষ্ট্রই মনে করেনা যে তার সুষ্ঠু পরিচালনের জন্য কবিতা দরকার, দরকার কবি। ১০০০ মানুষের জন্য আমাদের ৫০ জন চিকিৎসক দরকার, এক জেলার জন্য দরকার ১০০ প্রকৌশলী, ৩০০ নির্বাহী কর্মকর্তা, ৪টি নির্বাচিত ১টি মনোনীত প্রতিনিধি এবং ১৫০০ পতিতা কিন্তু কোন কবির দরকার নেই। তবে ব্যক্তির দরকার কবিতা, সমাজের দরকার কবিতা, সভ্যতার দরকার কবিতা। মানুষ সৃষ্টিশীল, তার সম্ভাবনা অশেষ, কবিতা মানুষের সৃষ্টিশীলতার এক শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।

কিভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা? কি থাকে কবিতায়?

কবিতায় কি থাকে, তা খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়, মানবিক-অমানবিক সব কিছুইতো থাকে কবিতায়, থাকে ভাষার ইন্দ্রজাল, অপরিসীম কল্পনা; কিন্তু কিভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা, তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারিনা। … কবিতার কাঠামো, তার ছন্দ ও মিল বা অমিল সম্পর্কে কিছুটা শিক্ষা দেয়া সম্ভব কিন্তু প্রতিটি প্রকৃত কবিতাই অভূতপূর্ব, রচিত হওয়ার আগে তার রচয়িতাও সেটি সম্পর্কে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পরই শুধু উপলব্ধি বা অনুভব বা বিচার করে দেখা সম্ভব সেটা কবিতা হয়েছে কিনা, বা হয়েছে কতটা অসাধারণ।….

মানুষ তার আপন মনের ভাবনাকে প্রথমত শারিরীক অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে অন্যজনকে প্রকাশ করে, অত:পর নানাবিধ ধ্বনির সাহায্যে। যেহেতু ধ্বনি একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রতিস্থাপিত হয় ইথারের স্পন্দনের মাধ্যমে তাই সেই ধ্বনিকে একটি নির্দিষ্ট গাথুনিতে বেধে দিয়ে তৈরি করা যায় একটা রিদম। ভাষার উৎপত্তির শুরু থেকে মানুষের সৃষ্টিশীল ভাবনা এই ধ্বনিগুচ্ছ নানাবিধ গাথুনিতে গেথে অন্যজনে পৌছে দিত। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায়ই তাই প্রথম উদ্ভব হতে দেখা যায় পদ্য বা গান। মানুষের মস্তিষ্ক অন্তঃস্থিত যে মেমোরি সেল রয়ে গেছে সেখানে শ্রুতি বা দৃশ্য দর্শনের মাধ্যমে যেসব তথ্য পাঠানো হয় তাকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে স্মরণযোগ্য করে রাখার জন্য এবং প্রয়োজনীয় সময়ে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি সুনির্দিষ্ট গাথুনি বা ঘটনার পরস্পরা। একটি ছন্দময় গাথুনি দিয়ে বেধে ধ্বনিপুঞ্জকে যদি মস্তিষ্কে প্রেরণ করা যায় তবে তা সহজেই স্মরণে রাখতে পারে।

ধ্বনিগুলোকে ক্রমাগত সাজিয়ে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে, কথা বলে। কিন্তু কথ্য ভাষার সকল শব্দই একটি নির্দিষ্ট রিদমে ফেলা যায় না। যে সমস্ত ধ্বনি সমষ্টি একটি নির্দিষ্ট রিদমে গেথে মনের ভাবকে প্রকাশ করা যায় সেই সকল ধ্বনি সমষ্টিকে ক্রমাগত সাজিয়ে পদ্য রচিত হয় যা দ্বারা মনের আবেগকে অন্যের মাঝে সঞ্চারিত করা যায়। কিছু কিছু ভাব বিন্যাস শব্দের গাথুনিতে এতোটাই মাধুর্যমন্ডিত হয়ে উঠে যে, মস্তিষ্কে তা গেথে যায় এবং বারবার উচ্চারিত হয়ে আনন্দিত হয়।

মনের ভাবকে প্রকাশ করার জন্য বা মানুষের অভিজ্ঞতাকে অন্যের মাঝে বর্ণনা করার জন্য প্রয়োজন হয়ে উঠে রূপকের। একটি অজানা বস্তুকে বুঝাবার জন্য জানা বস্তুর সাথে বা অজানা ভাবকে বুঝাবার জন্য জানা ভাবকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো এই সকল রূপক শ্রুতিমধুর ধ্বনিপুঞ্জের সাহায্যে কেবল তথ্য বা খবরের সন্ধান দেয় না, তৈরী করে এক ধরনের অনির্বচনীয় আবেগ, আপ্লুত করে মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে। নির্মল আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে মানুষের মন।

মানুষের মস্তিষ্কের প্রকৃতিই এমন যে, প্রথম অভিজ্ঞতায় সে যে আনন্দে ভেসে যায় তার বহু ব্যবহারে সে বিরক্ত হয়ে উঠে। তার সৃষ্টিশীলতা নতুন অভিজ্ঞতাকে প্রয়োজনীয় করে তুলে। মানুষের মস্তিষ্ক একস্থানে স্থির অবস্থান নেয়না কখনো। তার পর্যবেক্ষণ তাকে ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে চলে। নানবিধ পর্যবেক্ষণে প্রকৃতির নানা রীতিনীতকে আত্মস্থ করে তার জ্ঞানের উন্মেষ ঘটতে থাকে। বদলে যেতে থাকে জীবন যাত্রার মান। জটিল থেকে জটিলতর সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে এগুতে থাকে মানুষ। এই যে মানুষের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তাও নানারূপ ছন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুতে থাকে। রূপকে আসতে থাকে নানা বৈচিত্র্য। ভাবে চলে আসে সমৃদ্ধি। তৈরী হতে থাকে কাব্য চেতনা। তৈরী হয় অসাধারণ ভাবের প্রকাশ, শব্দের নানাবিধ বিন্যাসে। ছন্দগুলো সরলীকরণের পথ অতিক্রম করে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। চলে আসে মাত্রায় গাণিতিক প্রয়োগ।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চেতনায় এনে দেয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চলে আসে লিখিত অবয়ব। যে ছন্দগুলো ধ্বনিপুঞ্জের তালের সাহায্যে এগুতে ছিল তা-ই এক পর্যায়ে অক্ষর মাত্রায় রূপান্তরিত হয়।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড পরিচালনা হতে জন্ম নেয় এক ধরনের ভাষা যাকে গদ্য বলা হয়। পরিবর্তিত পৃথিবী অনেক যুদ্ধ, প্রতিহিংসা, সামাজিক অনাচার আর বিপ্লবের মাধ্যমে এগুতে থাকে। কিন্তু মানুষের সৃষ্টিশীলতা থেমে থাকেনি। তার সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের জন্য তৈরী হতে থাকে শক্তিশালী বাঁধন, গদ্যের বাঁধন। ভাব প্রকাশের যে মাধ্যমটি ছিলো নারীর মতো কোমল, স্নিগ্ধ, রিদমিক তা কঠিন প্রকৃতির মতো গদ্যে রূপান্তরিত হতে থাকে। তৈরী হতে থাকে এক পৌরুষদীপ্ত ফরমেট। জন্ম নেয় গল্প, ছোট গল্প, উপন্যাসের মতো শক্তিশালী মাধ্যম। পদ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্বিত হয়। কল্পনাপ্রবণ মানুষ সৃষ্টিশীলতাকে নিবেদন করতে থাকে নানামুখী ফরমেটে। পদ্যের শারিরীক কোমল গঠনের কারণে যেখানে সে স্থবির থাকে আর এগুতে পারেনা, সেখানে গদ্য তার ভূমিকায় অনন্য হয়ে উঠে। মানুষের জীবনে জটিলতাকে অত্যন্ত শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা চেতনার সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে থাকে।
মানবজাতির সূচনার সেই সহজ-সরল অভিব্যক্তি ছন্দের তালে তালে যে স্পন্দিত হতে ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে সেও তার ফরমেটে পরিবর্তন নিয়ে আসে। কেননা সৌন্দর্য আর মননশীলতা প্রকাশের এই যে অনন্য মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তার ভিতর রয়ে গেছে এক ধরনের মাদকতা যাকে কোন কালেই মানুষ হারাতে পারেনি। কবিতায় ক্রমে ক্রমে ভাষাগত ছন্দের আঁটা-আঁটির সমান্তরে ভাবগত ছন্দ উদ্ভাসিত হয়েছে। তার শ্রাব্য সীমারেখা ছাড়িয়ে হয়ে উঠে প্রধানত পাঠ্য। যে সুনিবিড় সুনিয়মিত ছন্দ আমাদের স্মৃতির সহায়তা করে তার অত্যাবশ্যকতা হারিয়ে গেছে। একদিন খনার বচনে চাষাবাদের পরামর্শ লেখা হয়েছিল ছন্দে। আজকালকার বাংলায় যে -কৃষ্টি- শব্দের উদ্ভব হয়েছে, খনার এই সমস্ত কৃষ্টির ছড়ায় তাকে নিশ্চিত এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের কৃষ্টি প্রচারের ভার আজকাল গদ্য নিয়েছে। ছাপার অক্ষর তার বাহন, এই জন্য ছন্দের পুঁটুলিতে ঐ বচনগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াবার দরকার হয় না। কাব্য, বুদ্ধির সাথে এর বোঝাপড়া নয়, একে অনুভব করতে হয় রসবোধে। আর এই কাব্য রসবোধকে সুসমন্নত রেখে শুরু হয় গদ্যে কাব্য রচনা।

চলবে….