কুরবানি/০৫ (শেষ পর্ব)

যার মন নেই; তার আবার কি মনে হবে? তবুও মাঝে মাঝে অনুভবের শিকল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পাড়ভাঙা নদীর মতো সেও টাচলাইন ছুঁয়ে দিতে চায়। কবিতার মতো কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চায়। চরম পুলক সুখানুভূতি অনুভব করতে চায়। কিন্তু চীনের মহাপ্রাচীরের মতো বাঁধার পাহাড় ডিঙোতে পারে না। তবুও মাকড়শার মতো স্বপ্নের জাল বোনতেই থাকে। শেষ হয় না। সকালদের কথা বলছিলাম। ঝড়-বৃষ্টির মাতম একটুও থামেনি। অবশ্য এতে কারো আসা আটকে থাকেনি। শুভ কাজের গন্ধ পেয়ে কাজি সাহেব আগেই এসে হাজির হয়েছেন। তাঁব হাতে মোটা পলিথিনে মোড়ানো বিশাল সাইজের রেজিস্ট্রি খাতা। হয়ত এতে নীলুর মতো এমনি কতো কিশোরীর অব্যক্ত কান্নার ছবি আঁকা। নীলুর হবু বরকে দেখলাম। মেঘে ঢাকা মধ্যাহ্নের সুর্য। তেজ নেই। প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই লিকলিকে যুবক। শরীরের তুলনায় মোটা উদর। হাতির মতো ছোট ছোট এক জোড়া কোটরাগত চোখ। তবে পাত্র হিসাবে সোনার টুকরা। কোনো যৌতুক দেয়নি। হাড় কিপ্টে বাবার একমাত্র সন্তান। তবুও।

নীলুর কথাটি এখনো আমার কানে আসা-যাওয়া করছে। মেয়েটি হয়ত জানে না সে কতোটা শক্ত কথা বলেছে। তবুও এই কথার রশি ধরেই আমি এখনও তেলাপোকার মতো টিকে আছি। বলা যায়, অথৈ সাগরের মাঝখানেও উদ্ধারকারী জাহাজের মাস্তুল দেখতে পাচ্ছি। সকাল কি ভাবছে বুঝতে পারছি না। আমার কাছে মনে হয় সে ভাবছে রাত আগে না দিন আগে। আমার অভিজ্ঞতা বলে সমস্যা যতো জটিল এর সমাধান ততোটা জটিল নাও হতে পারে। অনেক দামী জিনিষও অনেক সময় জলের দামে পাওয়া যায়। সকাল আবার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ দেখে কিছুতেই বুঝার উপায় নেই যে, কিছুক্ষণ পরেই কুরবানি পর্ব আরম্ভ হবে।

একটা বিষয়ে আমার শংকা আছে। অন্ধকার কতোটা দ্রবীভূত হয়। আমি চাইছিলাম যে করেই হোক আজকের এই অন্ধকারটা যতোটা সম্ভব কাব্যিক হউক। ছনমনে হউক। ভালোবাসার মহাকাব্য নিয়ে আমার নিজস্ব কোনো হাইপোথিসিস নেই। কেবল সরল-গরলের কিছু লেনাদেনা আছে। এইটুকু সম্বল নিয়েই সকালকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবে সকাল?
আমার তেমন কিছু বলার নেই। শুধু আপনার পরিচয়..
আমার বলার মতো বড়ো কোনো পরিচয় নেই। ভবঘুরে টাইপ একজন মানুষ। অমানুষও বলতে পারো।
আমি আসলে ওসব জানতে চাইনি। আপনি কোন পক্ষের মেহমান?
ও আচ্ছা। আমি নীলুর দূরসম্পর্কের ভাই। দুই গ্রাম পরে আমাদের বাড়ি। লোকে বলে, আমাদের গ্রামে কোনো আলো নেই। ভালোবাসার আলো। এইদিক থেকে অবশ্য তুমি খুব সৌভাগ্য। অন্তত একজনের ভালোবাসা পেয়েছ।
এক জীবনে তেমনটা কয়জনে পায় সকাল?
অন্য কোনোদিন হলে আমি আপনার এই কথার জবাব দিতাম। কেনো জানি আজ দিতে পারছি না। মন থেকে সাড়া পাচ্ছি না।
ঠিক আছে। বাদ দাও ওসব। পানি একদিকে না একদিকে গড়াবেই। নীলু কি আত্মীয়?
জী। ও আমার আপন খালাতো বোন। নীলুর জন্মের সময় খালা আর আমার মা আমাদের দুজনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। আমি যেমন সেটা জানি নীলও তেমনি নীলুও সেটা জানে।

আমি আবারও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা হোঁচট খেলাম। হঠাৎ আমার হিমালয় হিমালয় ভাবটা জাগ্রত হয়ে উঠলো। আমি ঠাস করে বলে ফেললাম, সকাল আজ নীলুর বিয়েটা হবে না।
এমন অসম্ভব একটা কথা বলার পরও সকাল এতোটুকু চমকে উঠলো না। সন্ধ্যা তারার মতো মিটিমিটি হাসতে লাগলো। বিয়ে হউক আর না হউক সকালের মুখের এই এক চিলতে হাসি আমার কাছে এই মুহুর্তে ত্রিভুবনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি দামী।।

2 thoughts on “কুরবানি/০৫ (শেষ পর্ব)

  1. সার্থক পরিসমাপ্তি। কবিতাকেও মাঝে মাঝে অবসরে পাঠানো সঠিক … এই গদ্য লিখাটির মাধ্যমে সেটাই প্রমাণ রেখেছেন প্রিয় কবি। শুভ সন্ধ্যা। :)

    1. আপ্লুত হলাম।। অফুরান কৃতজ্ঞতা জানবেন।।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।