জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর সকল পোস্ট

মুখ ও মুখোশ

মন ভালো রাখতে ব্রহ্মপুত্রের কাছে এসেছিলাম
এখানেও তিল রাখার মত জায়গা নেই
পঙ্গপালের মত গিজগিজ করা মানুষ
দুই চোখ… চার চোখ…
কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে… কোনটা
বুড়ো আর কোনটা আইবুড়ো বুঝা মুশকিল
লাল ফিতার দৌরাত্মার চেয়েও মেকাপের দাপট বেশি!

সেই কবে পড়েছিলাম- শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি
আজ এখানে মুখের চেয়ে মুখোশ বেশি!

নজরুল কাব্যে দ্রোহ, অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রেম

ja

যে কীর্তিমান মহাপুরুষের জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্য অপূর্ণ থাকতো, তিনিই আমাদের বাঙ্গালি জাতিসত্তার কবি, প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার সম্পর্কে অল্প কথায় কিছুমাত্র বলার সাধ্য আমার নেই। এক সমুদ্র জল থেকে এক ‘আজলা ভরে যতটা তুলে আনা যায় ঠিক ততটুকু অথবা তারচেয়েও কিছুটা কম। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সাহিত্যে প্রতিভার বিচারে তাঁর ধারে কাছেও কেউ নেই। তিনি এক অবিসংবাদিত, অতুলনীয় এবং অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যের সকল শাখায় যার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল পদচারণা। কবিতা, ছড়া, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস সহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। জীবন ও জগতের সুগভীর দর্শন তাঁর লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদেরকে ঋণী করে গেছেন। যেই ঋণের দায় পরিশোধ করা আমাদের জন্য অসাধ্য। তবে তাঁর চিন্তা, চেতনা, দর্শন আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিছুটা হলেও এই দেনা লাঘবের সুযোগ রয়েছে। চলুন এবার আসা যাক মহাপ্রাণ এই সত্তার বিদ্রোহী সত্তায়। কবি বলেছেন,

“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।” বিদ্রোহী/ কাজী নজরুল ইসলাম —- আজ কোথায় সেই চিরায়ত বিদ্রোহের সুর? যেখানে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন — সেখানেই কোথায় প্রতিবাদ? তেলবাজ, পদলেহী, চাটুকারদের দৌরাত্ম্য আজ সাহিত্য জগত থেকে শুরু করে সবখানে উন্মাদ জলের মতোন সয়লাব। প্রতিবাদহীন এই নপূংশক সমাজ চারাগাছ থেকে আজ বিশাল মহীরুহ। সবাই কেবল নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই তিরতির করে উঠে যাচ্ছে খাটের তলা থেকে আগরতলা। পারলে ছুঁয়ে দেয় আকাশ! মানবতার নূণ্যতম বালাই নেই। নেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা। মানবিক বোধের দরজা-জানলা বন্ধ করে সবাই যেন মেতে উঠছে অমানবিক এক পৈশাচিক খেলায়। বলতে কিছুমাত্র দ্বিধা নেই যে, এতে করে মানুষ হিসাবে আমরা কেবলই পরাজিত হচ্ছি। কোনো এক অজানা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। এমন এক অন্ধকূপ অথবা জন্মান্ধ গুহায় নিজের ঠিকানা খুঁজে নিজেই খুঁজে নিচ্ছি যেখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। মুক্তির কোনো পথ থাকবেও না।

তবে কি এভাবেই আমরা তলিয়ে যাব? এভাবেই তলিয়ে যেতে থাকব? অথচ গর্ব করার মতোন বিষয় মানুষ হিসাবে আমরাই মহাবিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রাণি! আমাদের পতাকা এখন চাঁদে উড়ছে, মংগলে উড়ছে। ভবিষ্যতে শনি, বুধ, বৃহস্পতি, নেপচুন, প্লুটো সহ ছায়াপথ, গ্যালাক্সি জুড়ে চলতে থাকবে আমাদের জয়রথ। শুধু আফসোস থেকে যাবে এতোকিছুর পরেও আমরা কেবল মানুষ হব না– সত্যিকারের মানুষ! সাম্যের কবি, প্রাণের কবির “মানুষ” কবিতাটির অংশ বিশেষ পড়া যাক—

মানুষ/ কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!’

, হ্যা.. আমরা অবশ্যই মানুষ; তবে তা নামিক মানুষ। নাম সর্বস্ব মানুষ। প্রশ্ন থেকে যায়, এইসব নাম খাওয়া স্ত মানুষ আর ইতর প্রাণির মাঝে কতটুকু পাথর্ক্য আছে? বনের সিংহ নিরীহ হরিণের মাংশ খুবলে খায়, মহিষের তাজা খুনে উৎসব পালন করে। এরাও কেউ নিজের মাংশে হাড়ি চাপায় না, উদরপূর্তি করে না। প্রকৃতির দেয়া নিয়ম-কানুন তারা যথার্থই নেমে চলে। কেবল আমরা মানুষেরা মানুষের রক্তে হাত রাঙাই। ভাই ভাইয়ের অধিকারে খড়গ হস্ত হই, দুর্বলের টুটি চেপে ধরে হাতুড়ি চালাই, শাবল, চালাই, গাইতি চালাই, বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিই অনাগত স্বপ্ন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও কেবল নিজস্ব স্বার্থ এবং পশু প্রবৃত্তির তাগিদে, ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তির লিপ্সায় পশুদের সাথে একই কাতারে দাঁড়াই। দাঁড়াতে এতোটুকুও দ্বিধা করি না। এই যদি হয় আমাদের প্রকৃত অবস্থা, তাহলে আমার বলতে দ্বিধা নেই, যে থুতু আজ আমরা অন্যের দিকে নিক্ষেপ করছি, তা একদিন অবশ্যই কালের চক্রে নিজের দিকেই ফিরে আসবে। আসবেই। আসতেই থাকবে। মানবতা, সাম্য এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় মানব নামের এই জাতিটিকে নিশ্চিতভাবেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। এতে কোনোরকম সন্দেহ নাই। অসাম্যের বিরুদ্ধে চির সোচ্চার কবি এজন্যই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, “আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের।”

নজরুল সত্তায় নারী প্রেম যেন এক চিরজাগ্রত চেতনা। নারীকে ইতিহাসের পানশালা থেকে, নর্দমার পঙ্কিল আবর্ত থেকে হাত ধরে, বুকে আগলে, মাথায় তুলে যে মহাপুরুষ পুরুষের সাথে একই সারিতে এনে দাঁড় করিয়েছেন… তিনিই আমাদের জাতি সত্তার, আমাদের ভালোবাসার কবি, প্রেমের কবি নজরুল। যে নারী একদিন কেবল ছিল পুরুষের সেবাদাসী, পুরুষের শষ্যার নিরীহ এবং নিষ্পৃহ সংগিনী… সেই অবহেলিত, বঞ্চিত, পদদলিত নারী সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।“(উৎস- ‘নারী’ কবিতা)

কী অসাধারণ সরল স্বীকারোক্তি! শুধু তাই নয়, এ যেন শিশ্নধারী প্রবল প্রতাপশালী পুরুষের উঁচু নাকে একটা ঘুষি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সুউচ্চ সিংহাসন থেকে পুরুষকে টেনে হিচঁড়ে নারীর কাতারে নামিয়ে আনার নামান্তর। পুরুষের আজন্ম লালিত অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার শামিল। ঘরে-বাইরে, সমরে-সংগমে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে তিনি আরও বলেছেন,
কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পূরুষের তরবারী; প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষী নারী।” (উৎস -‘নারী’ কবিতা)।

নারী ও পুরুষের চিরন্তন ভালোবাসার স্বীকৃতি তাঁর লেখায় মানব শরীরের ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের মতোন প্রোজ্জ্বল। কিশোর প্রেমের স্মৃতি আওড়াতে তিনি তাঁর “চৈতি হাওয়া” কবিতায় বলেছেন, “হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল/ গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল”। কী দুর্দান্ত অথচ সাবলীল উপমার মায়াজাল! নারী আর চিরমোহিনী প্রকৃতি যেন একই রুপের চিরন্তন আঁধার। নারী-পুরুষের প্রেম-ভালোবাসার এই স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রেমের নামে৷ ভালোবাসার নামের শরীর ভোগ করার বিষয়ে চরম হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, কামনা আর প্রেম দুটি হচ্ছে ম্পুর্ণ আলাদা। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা মাত্র আর প্রেম হচ্ছে ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন।”

তিনিই নজরুল যিনি সারাজীবন সাম্যের গান গেয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়গান গেয়েছেন, সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে হুংকার দিয়েছেন। মানুষকে জাত-পাত, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু নয়—- কেবলই মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন। হৃদয় থেকে প্রতিটি মানুষকে শ্রদ্ধা করেছেন, ভালোবেসেছেন। প্রিয় পাঠক, আসুন প্রিয়কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কবিতাটির অংশবিশেষ একবার পাঠ করা যাক।

সাম্যবাদী// কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।

এই একটি কবিতাই প্রমাণ করে দেয়, “অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি এবং লেখকদের মধ্যে নি:সন্দেহে কাজী নজরুল ইসলাম শীর্ষস্থানীয়। তিনি তার অসংখ্য কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছেন। বিশ্বের সমস্ত মানুষকে মানবতার একই পতাকা তলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান’।

প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানবতার কবি নজরুলকে বোঝার জন্য কিংবা বোঝানোর জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ তার সৃষ্টি অসংখ্য এমন চরণ। বিদ্রোহী হয়ে ওঠা বা বিদ্রোহ প্রকাশের ধরন যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে উৎক্ষিপ্ত। মানবসত্তা বিকাশের জয়গান মূলত যে কোনো বিদ্রোহী সুরের সঙ্গেই একাট্টা হয়ে অনুরণিত হয় ব্যক্তিমানসে। যা থেকে প্রথমে দ্রোহ এবং পরবর্তীতে বিদ্রোহী চেতনার জন্ম নেয়। কাজী নজরুল ইসলাম তার সময়কে ভেদ করে এগিয়েছেন। যেটুকু কাব্য ও সাহিত্য চর্চার সময় তিনি পেয়েছেন ব্যক্তি জীবনে; কাজ করে গেছেন সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই।
গাহি সাম্যের গান-, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান। এটি নজরুলে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি।

নজরুলের মানবসত্ত‍া এবং তার বিদ্রোহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ নজরুলকে বহুবিধ বিশ্লেষণে ভূষিত করেছেন। যার মধ্যে বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, মানবতার মুক্তিদূত এবং সর্বতোভাবে প্রেমের কবি অন্যতম। শুধু তাই নয় প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে নজরুলের আরেক ধরনের বিদ্রোহ সামনে ভেসে আসে। যেখানে কখনও প্রেমিকসত্তা নিরঙ্কুশভাবে বিলীন প্রেমাস্পদের কাছে অথবা কখনও বা প্রেমবিদ্রোহ জাগরুক থাকে বিরহের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিয়ে।

আগের বলেছি, বিশাল সমুদ্র থেকে এক আজলা ভরে যতটা জল আনা যায়, আমার আলোচনাও তাই। একজন সত্যিকার মানুষ হিসাবে, একজন কবি-লেখক হিসাবে, একজন শিল্পী হিসাবে, একজন অভিনেতা হিসাবে, একজন প্রেমিক হিসাবে, একজন পিতা হিসাবে, একজন স্বামী হিসাবে নজরুল সত্তার কোনো তুলনা নাই। তাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজেই। মানুষকে কতটা ভালোবাসলে একজন মানুষ বলতে পারেন, “মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই।“

সবশেষে প্রাণের কবি, মন, মানস, বোধের কবি, বাঙালি জাতিসত্তার কবি চির বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।।
——————–

একটি কবিতার চারাগাছ

আখাম্বা সময় একদিন একটা গাধা ছিলো..
এখন সে দুরন্ত টগবগে ঘোড়া হয়েছে;
ছায়াপথের মায়া ছেড়ে সে এখন আমার
এই শহরে এসে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে!

তবুও আমি পিতলের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ করি
ভাগ্যিস ভাগ্যের চাকা এখন যত্রতত্র ওড়ে
আর আমার বুভুক্ষু সময় কেবলই মাটি খুঁড়ে!

এতোকিছুর পরেও আমার হৃদয় ফুঁড়ে
একটি কবিতার চারাগাছ জন্ম নেয়; সেও জন্মান্তরে
পত্রিকার পাতার হাত ধরে বৈতরণী খুঁজতে চায়
আমি ছাড়া আর সব তা পাখিরা জানে
আমার সেই চারাগাছ আজ বড় হতে চায়!
আমার সেই চারাগাছ আগাগোড়া জল চায়!

সে জানে না.. সমুদ্রে কত বিশাল জলরাশি
কেবল পান করার মত কোনো জল নাই..!!

সে কবিতা নয়

কলমের নিব ঘষে যে পাখি বের হয়ে আসে….
পতপত করে ওড়ে যায় সাদা কাগজের গায়
গায়ের জোরে হয়ত কামড় বসায় কোনো না
কোনো কোরা, আনকোরা পত্রিকার
পাতায়
হয়ত ছাতাও বিস্তার করে বৈসাবি রোদের মাথায়!

আমার কাছে কেনো জানি কেবলই মনে হয়…
সে আর যা-ই হোক…. সে কবিতা নয়;
বরং
যে পাখি হাজার প্রচেষ্টাতেও উড়তে পারে না,
শরমেই মরে থাকে লাল দালানের বন্দি বাঁদর
মেহনতিরে দিতে পারে না একচিমটি বুনোআদর
ছুঁয়ে দিতে পারে না কোনোএক ভোরের সবিতা
কেবল ধুঁকে ধুঁকে মরে পড়ে থাকে হৃদয় কাবায়
আমার মতে, সেই হলো কবিতা. সেই কবিতা!

ভাদ্র মাসের তাল

কথা প্রসঙ্গে এবার ভাদ্রের কথায় আসি
আগে যখন কালে-ভদ্রে ভাত বাসি হতো
এখন বাসি হয় নগদ টাকায় কেনা হাসি
তবুও আমি এই ভাদ্র মাস বড় ভালোবাসি!

আগের দিনে ভাদ্রের গরমে পাকতো তাল
এখন কথায় কথায় গরম হয় মাথার চাল
আগে চুল পাকলে ফকফকা সাদা হতো
আর এখন হয় নিঁখুত কালো অথবা লাল!

তেজারতিতে তেজি ভাব মোটেই আর নেই
তবুও বায়নার চৌকাঠে সখিনা ফুলায় গাল
আপাদমস্তক কাপড়ে ঢাকা তবুও উলংগ দেহ
আশেপাশে দশ-বারোজন হাঁটে… তবু্ও
মুখ খিচিয়ে বলে..আমার সঙ্গী নাই কেহ!
——————

পোড়ারমুখী

আজ আর কোনো কবিতা লেখা হয়নি
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে কেবল কাজ আর কাজ
রেললাইনের মতোন একটা সর্পিল জীবন
এতো যে হারে তবুও নেই লাজ….তবুও
সামনে-পেছনে দলা পাকায় কাজ আর কাজ!

আজ সারাদিন নুন ছিলো না রান্নার ঘর
আমি ইতি যাই.. উতি যাই কে রাখে খবর
তবু দেবদারু গাছ একটা শিক্ষা দেয় জবর!

এই ভাদ্রে তালপড়া দেখিনি কত না দিন
ভুলে গিয়েও ভুলতে পারিনি আশ্বিনের ঋণ!
তবুও পোড়ারমুখী শুধু চাল-ডাল খুঁজে
নুন-ই যে লবণ সেই কথাটি কি আর সে বুঝে!!

ডাক ডুগ-ই বাজাই

রেললাইনের পাশেই চায়ের স্টলে বসে আছি
মাঝেমধ্যে সাপের মতোন ট্রেন আসে-যায়
আমি তাকিয়ে থাকি এই আছি.. এই না-ই!

এখানে হাজার কিসিমের মানুষও আসে
কেউ কেউ চা খায়—
আর কেউ নাক দিয়ে…মুখ দিয়ে ধোঁয়া ওড়ায়!

ওড়াতে ওড়াতে মানুষগুলো রঙিন ঘুড়ি হয়
মুখে মুখে কথার খৈ ফুটে
রাজনীতি, সমরনীতি.. কাঁচাবাজারে ছুটে!

আমি কেবল হাবাগোবার মতো বসে থাকি
কিছুতেই ঠাহর করতে পারি না
এখন দিন না-কি…. এখন রাত না-কি!
তবুও মনে মনে সরস পঙক্তিতে কবিতা সাজাই
তবুও নিজের ভেতর নিজেই ডুগডুগি বাজাই!!

কালের কাক

আমার কিছু হয়নি সমুদ্রের ঘোড়া রোগ
শীতটা যেমন তেমন কেটে গেছে, ডাকেনি ডাহুক
এখন চলছে বসন্ত অন্তহীন
আমার পোড়া অন্তর কবিতার আওয়াজ ক্ষীণ!

এখনও পোড়া ধ্বনি শুনি
শুনি প্রতিধ্বনি আদিম
কামনার শর বারবার আঘাত হানে
কেউ জ্বালে না ভালোবাসার পিদিম!

নৌকো করে জলে ভাসি
বিষণ্ণ প্রহর সেও আমাকে বলে, বড়ো ভালোবাসি
আমার আশেপাশে ঘুরে কালের কাক
যতখুশি ভুল বুঝো প্রেমী, আমিও হয়েছি নির্বাক!!

ছোঁয়াচে রোগ

একদিন বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাওয়া কিছু কথা
আজ বৃষ্টির জলের সাথেই ফিরে এসেছে
দৈবাৎ কোনো শকুনের চোখ পড়েনি
দৈবাৎ কোনো প্রকাণ্ড দেহি চিল ছোঁ মারেনি!!

হয়ত এভাবেই ফিরে আসবে পড়শির অধিকার
হয়ত এভাবেই ফিরে আসবে বাপ-দাদার উত্তরাধিকার!

ওদের কারো কারো চুনকাম করা অদ্ভুত মুখ
কেউ কেউ বিপন্ন প্রজাতির গুটি বসন্তে খুঁজে
ফিরছে পঞ্চম প্রজন্ম আগের হারানো সুখ!

তবুও আমাদের বেঁচে থাকে ভোগ আর সম্ভোগ
তবে কি…
করোনার মতোন এও কোনো ছোঁয়াচে রোগ?

চেতনাহীন কবিতা ও একটি জীবন্ত লাশ!

জন্ম আর মৃত্যু সব সময় মুখিয়ে থাকে
সে ব্রহ্মপুত্রের নাদান চর হোক কিংবা রাজপ্রাসাদ!
কালেভদ্রে কেউ কেউ দ্বিগুণ হয় জন্মসাল
আর কেউ জন্মের আগেই কুড়িয়ে নেয় মহাকাল!

প্রতিটি জন্মের মতো কবিতারও জন্ম হয়
প্রসব বেদনায় শিরোনাম খুঁজে নেয় পাগল পাঠক
শব্দ ও ভাবের কারাগারে যখন হয় সে আটক!
অতঃপর আসে কবিতার মৃত্যু স্বাদ…
পাঠকহীন কবিতাগুলোও তেমনি বারবার মরে
পড়ে থাকে যুদ্ধের মাঠে চরম বিস্বাদ!

যেভাবে লড়াইয়ের ময়দানে মরে পড়ে থাকে
পলায়নপর আহত কাপুরুষ সৈনিক,
যেভাবে অলসের প্রতিটি ক্ষণের মৃদু মৃত্যু হয়
সেভাবেই চেতনাহীন কবিও জিয়ন্তে লাশ হয়!

উত্তর পুরুষ

হামাগুড়ি না দিয়েই যে শিশু হাঁটে সে কতোটা শিশু?
বাবা বলতেন, কালের আগে আগে চলতে শিখো
সবকিছুর মতো কালও নাকি রুপান্তরিত শিলাস্তর!

আমার পাললিক প্রেম মাঝেমধ্যে পথিক হয়
তখন পৌষের চিরকেলে কেবল চাকার শ্লোগান
দাদা বলতেন, সাদ্দামের প্রতিটি আঙুলই এক একটি
স্টেনগান!

আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতোন শুনে যেতাম উত্তর পুরুষ
অতঃপর পুরো মাঠ একাই খেলে গেলো নির্মম বুশ
আমি নতমুখে শাস্তিগুহার কথা ভাবি
অবরোহী হবো নাকি আরোহী হবো.. ভাবতে ভাবতেই
দেখি শেকড় ছাড়াই শিখরে আরোহনের ধ্রুপদী গল্প
মা বলেন, খোকা বাগাড়ম্বর করে হালে পানি পাওয়া
যায় না; মধ্যমপন্থাই উত্তম পন্থা; সবকিছুতেই অল্পস্বল্প!

নিস্পৃহ সময়ের গান

নিস্পৃহ সময়ের কথা খুউব মনে পড়ে
তখন অকবিতারাও বেসুরো গান হয়
নদী আর নারী একই সুরে কথা কয়!

আজকাল দীঘির কালচে জলে নক্ষত্র জ্বলে
জোনাকিরা বেজায় ভয় পায়
ওদের কে বুঝাবে…?
যখন সাপ আর ব্যাঙ একসাথে ঘুমায়
তখন মহাবিশ্বের কারো কোনো ভয় নাই.!!

তবে ক্ষয় আছে মহাসমুদ্র কিংবা পাহাড়
জীবন যুদ্ধে টিকে থাকাই অতি বড় বিজয়
বিপদের দিনে অতিকায় হাতিও মশার আহার!!

কবিতায় জেগে উঠি

আজকাল নিজের থেকে নিজেই যখন পালিয়ে বেড়াই
তখন দেখি হাঁচি লুকানোর মত জায়গাও নেই..
অথচ সবকিছু আগে যেমন ছিল, এখনো সেই!

তবুও শুন্যতা দিয়ে শুন্যতা ভরাই…
তেলাপোকার মতো নিজেকে সান্ত্বনা দিই
নিজেকে ছাড়া আমি আর কাকে ডরাই!

তথাপি মাঝে-মধ্যে কবিতায় জেগে উঠি
রাতদুপুরে নিজেই চেপে ধরি নিজের টুটি!
তখন অভিধানের সব অপয়া শব্দেরা হাসে
তবে কি
ওরাই কেবল এই আমাকে ভালোবাসে?

বৃত্তরেখা

বৃত্তের বাইরে আসতে কড়িকাঠ পুড়িয়েছি
ঘোলা করেছি কতো কতো জল
পরিণামে কিছুমাত্রও ভয় পাইনি
তবুও ক্ষণে ক্ষণে বেড়েছে কেবল সাধের অনল!

কবিতার হাত ধরে চায়ের স্টলে উড়িয়েছি ঘুড়ি
তবুও ধোঁয়ার আস্তর ভেদ করে হয়েছে মন চুরি
দিনশেষে দেখি ঝিঁঝিঁ ডাকে ভারিভুরি!

তবুও পাইনি কাঁহাতক বৃত্তরেখার নাগাল
তবে কি আর সবার মতো আমিও অধরা প্রেমের কাঙাল..?

জল-বারুদের গন্ধ

ও কিছু নয়, মাত্রতো কয়েকটি আলোকবর্ষ; নির্লিপ্ত প্রহর!
বেশতো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল জলছটা, জলছত্র থেকে সবিতা ভোর
কুঁড়িয়ে এনেছিলাম, বেশ লাগছিলো তোমার ঝামেলা ডট কম!
কবিতার মায়াজালে বন্দিত্ব মেনে নিয়েছিলাম বলে, আমিও
তোমার মতো আরও কয়েকটি আকাশ কিনতে চেয়েছিলাম,
বাবার জায়নামাজের মতো ওরা সবাই আমার কবিতার খাতা!

একদিন আঁষটে দুপুর উন্মনা করেছিলো কীর্তনখোলার জলভোগ,
লকলকে উদার জমিন, ককটেল ফুটেছিল গোলাপের কাঁটার মতো,
এখন জলবারুদের গন্ধে মাতৃগর্ভেও শিশু কবিতা লিখে না!
প্রেমহীন ভালোবাসা অথবা ভালোবাসাহীন প্রেম
দুপুরের খররোদে সগর্বে আঁচড় কাটে!

আর একদিন যে কবি বিপ্লবের নামে ঝাঁঝালো শপথ নিয়েছিলো
একদিন টাউনহলের মোড় একাই দখল করার প্রতিজ্ঞা করেছিলো
তিনিও এখন বেশতো আছেন;
এখন একটার পর একটা পানকৌড়ি ডুব, সদ্য কন্যা সন্তানের
গর্বিত পিতা হওয়ার নগদ টিকেট!
তাঁকেও এনে দিয়েছে শৃঙ্গারের চরম পুলক সুখ।
অথচ বারবনিতার প্রেম এমনি হয়,
সবাই জানে, আবার কেউ জানে না…!!