গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
চার
গান কিন্তু শুরুতে এমন ছিল না যা সে এখন হয়েছে। গৈ ধাতুর অর্থ বলা, মানে সুর ক’রে পাঠ। গৈ থেকে আসছে গায়ত্রী — একটা ছন্দ, গান নয়। আসছে গীতা, কৃষ্ণার্জুন সংলাপ। ঋকবেদের সূক্তগুলো সুরে আবৃত্তি হবে, ওইটুকুই পারমিশান ছিল।
ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন, সামস্তোত্রের সুরকাররা ঋকবেদীয় ঋষিদের এই বাধা ডিঙোতে চেষ্টা করে। লৌকিক গান তো আর্য সভ্যতার বহু আগে থেকে বয়ে চলছে, তার চল ছিল নারী আর অন্ত্যজদের মধ্যে। সামবেদীয় গায়কেরা লোকগানের প্রভাবে শ্লোক আবৃত্তির মাঝখানে ধুয়ো টানার মতো হা-হা, হো, হুম, হোয়ি এইসব সুরেলা ধ্বনি করতো — যাকে স্তোভবর্ণ বলা হত সে-সময়ে। আর্য ঋষি ও যজমানেরা তাই সামগান দুচোখে দেখতে পারতো না।
অরিজিৎসিংগীতে এই স্তোভবর্ণের ব্যবহার ভীষণভাবে ফিরে এসেছে। দুটো উদাহরণ দেবো।
হ্যারি মেট সেজাল ছবিতে হাওয়ায়েঁ গানটা। সুর করেছেন প্রীতম।
দ্বিতীয় গান ফির কভি, এম এস ধোনি ছবি থেকে, সুরকার অমল মালিক।
এছাড়া আপনি অরিজিতের যে-কোনও পনেরো মিনিট থেকে আধঘন্টার প্রোগ্রামের রেকর্ডিং শুনুন, সাধারণত মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যেগুলো হয়, দেখবেন সে ওই অল্প সময়ে অনেকগুলো গানের টুকরো গাইছে আর একগানের সঙ্গে অন্যগানের সেতু তৈরি করছে স্তোভবর্ণের হামিং-এর ভেতর দিয়েই।
‘বেদগান’-এর বাইরে বেরিয়ে এলিটদের প্রথম সংগীত কি? নিশ্চয়ই ধ্রুপদ। এক শ্রেণীর মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ধ্রুপদ গেয়ে পেট চালাতেন। এটাও ‘ছোটলোক’-এর গান, অতএব পণ্ডিতদের ভয়ানক বিরোধিতার সামনে পড়েছিল। তারপর প্রতিভাবান গায়কেরা এই সংগীতের চালু প্রকরণকে ঘ’ষেমেজে ‘শুদ্ধ’ করে নিলেন, পেলেন সংগীতপ্রেমী রাজাদের সমর্থন। ধ্রুবপদের জাতে ওঠা আর আটকানো যায়নি।
পাঁচ
তো, ফার্দিনান্দ দ্য সসুর ভাষাবিদ্যার চর্চায় Synchrony আর Diachrony ব’লে দুটো পরিভাষা এনেছিলেন। সিনক্রনিক মানে সমকালীন বা সমলয় ভাষাতত্ব কোনও ভাষাকে সময়ের সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিচার করে, তার গড়ে ওঠার ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামায় না। আবার ডায়াক্রনিক অথবা কালবর্ষীয় ভাষাবাদ একটা ভাষার মূল্যায়ন করে শুধু তার বিবর্তনের ইতিকথা দেখেই।
এলিট আর অন্ত্যজের সংস্কৃতির মধ্যে চিরকাল ঘোর অবনিবনা থাকলেও অভিজাতদের রক্ষণশীল অংশ যেমন ছোটলোকের কালচারকে ঘেন্না করে এসেছে, তাদেরই আরেক দল নিজেদের শিল্পের ঝাঁপি ভরেছে লৌকিক সংস্কৃতির উপাদান নিয়েই। একে বলতে পারেন, গ্রাম বা মফস্বলের ছোট ছোট কারখানা থেকে জুতো কিনে তাতে নিজেদের ব্র্যান্ড নেমের স্টিকার মেরে দ্বিগুণ দামে বাজারে ছেড়ে দেওয়া। সামগান আর ধ্রুপদের বেলায় শুধু না, ভারতীয় সংগীতের গোটা ইতিহাস জুড়েই এমনটা সত্যি।
ছয়
ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন, বেদাঙ্গে ‘নারদীয় শিক্ষা’ নামে একটা বই রয়েছে। সেখানে এইরকম শ্লোক পাওয়া যায়:
আচার্য্যা সমমিচ্ছন্তি পদচ্ছেদস্তু পণ্ডিতাঃ।
স্ত্রিয়ো মধুরমিচ্ছন্তি বিক্রুষ্টমিতরে জনাঃ।।
ক্ষিতিমোহনের অনুবাদে: গানে আচার্যগণ চাহেন সমতা, পণ্ডিতেরা চাহেন পদচ্ছেদ, নারীরা চাহেন মাধুর্য, ইতরজন চাহে বিক্রুষ্ট অর্থাৎ স্বরবৈচিত্র্য।
আমার মনে হয়, গানে অভিজাত শ্রেণীর কনট্রিবিউশানও ওইটুকুই, সমতা আর পদচ্ছেদ। এই লেখার প্রথম অংশে আমি যে লুপ-এর ধারণা এনেছিলাম, সেটা এই সমতা-র আইডিয়ার সঙ্গে মিলছে। আর পদচ্ছেদ বলতে ধ্রুপদকে নিজেদের সংগীতগোষ্ঠীতে টেনে পণ্ডিতেরা কথার শরীর চারটে পর্বে ভাগ করে দিলেন — স্থায়ি অন্তরা সঞ্চারী আভোগ।
মেয়েদের মনে প্রচুর আবেগ, যা গানের প্রাণবস্তু; আর খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে লড়াই, বিপদ, নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই উচ্চবর্ণের নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই তাদের গানে স্বরের বিচিত্র গতি থাকতো। তার মানে শুধু গানের স্ট্রাকচার তৈরি করে দিয়েছেন অভিজাতরা, কাঠামোর ভেতরে যা মালমশলা সবই অন্ত্যজের অবদান।
[সমাজপতিদের সাহায্য পেয়ে ক্ল্যাসিকাল গানের বিবর্তন আর উন্নতি হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি, সেই তুলনায় মূল লোকগান লটকন ফুলের মতো একটা সীমাতেই আটকে আছে]।
তাহলে গানের ডায়াক্রনিক বিচার করতে গেলে বোঝা যাবে, ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে এলিট-অন্ত্যজ বা বড়লোক-গরীব বাইনারিটা খুব প্রধান ব্যাপার, বিষয় বদলালেও সংঘাতের চরিত্র পালটায়নি। ধরুন, ধ্রুপদের পরে এল খেয়াল, তারপর লঘু রাগসংগীত, তারপঢ় রামপ্রসাদ, তারপর রবি ঠাকুরের গান। তারপর জানা গেল লালনকে, তারপরের সৃষ্টি বামপন্থীদের গণসংগীত — এই রকম। প্রত্যেকবার পণ্ডিতেরা রে রে করে উঠলেন, প্রত্যেক দফাতেই আস্তে আস্তে বিরোধ-সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে সেই গান হয়ে উঠল অভিজাতেরই সম্পত্তি। তার মানে, এই মুহূর্তে যে শ্রোতা টপ্পা বা গজল ভালোবাসেন, কিন্তু এখনকার হিন্দী সিনেমার গান একেবারে সহ্য করতে পারেন না — হতে পারে তিনি গানের ডায়াক্রনিক অ্যাসেসমেন্টের ফসল। সুতরাং গানের ইতিহাসে যেটা মতভেদ-মুক্ত হয়ে অফ ফেমে চলে গেছে, তাকেই পছন্দ করবেন। যে এখনও এলিট-বিচারে গৃহীত নয় (এখানে হিন্দি সিনেমার গান), সেই সংগীতে তার আস্থা থাকবে না।
আর সিনক্রনিক বিচার ঠিক কেমন? ধরা যাক,আমার অল্প বয়েসে মহম্মদ রফির ফিল্মি গান শুনতাম, তাই আমার কে এল সায়গল ভালো লাগে না, কুমার শানুও অপছন্দ। আমার দাদা শ্রোতা ছিল সুমিত্রা সেনের রবীন্দ্রগানের, তাই সে সাহানা দেবীতেও নাক কোঁচকায়, স্বাগতালক্ষ্মীতেও। অর্থাৎ আমরা যে সময়বিন্দুতে শ্রোতা হিসেবে জন্ম নিই, শুধু সেই স্থানাংই আমাদের কাছে সত্যি। সামনে-পেছনের কালখণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করতে পারি না।
গণসংগীত রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত নিয়ে গানের যে নিরক্ষরেখা টানার চেষ্টা হয়েছে এই লেখায়, সেটা সিনক্রোনিক বা ডায়াক্রোনিক কোনও এলাকার ওপর দিয়েই যায় না, যেহেতু গণসংগীত অরিজিৎযুগে অস্তিত্বহীন বলে সমকালীন (Synchronic) বিচারে এই তিন ধাঁচের গানকে এক সঙ্গে বুকে জড়ানো প্রায় অসম্ভব। আবার যেহেতু অরিজিৎ সিং-এর গান এখনও অভিজাতশ্রেণীভুক্ত হয়নি, তাই কালবর্ষীয় (Diachronic) বিচারেও সে কল্কে পাবে না।
অরিজিত সিং-এর গান কি থেকে যাবে, যেমন স্থায়ি হয়েছেন কিশোরকুমার গাংগুলি?
আমার হ্যাঁ-এর বাজি নিয়ে শেষ কিস্তিতে আসবো।
হেভিওয়েট আলোচনা। বোদ্ধা পাঠককূল আপনার অপরাপর পূর্ব পোস্ট গুলোন পড়ে নিতে পারলে বুঝতে সুবিধে হবে। বিশ্বাস করি আপনি একজন সার্থক আলোচক।
ধন্যবাদ প্রিয় চন্দন দা। শুভ সকাল।
অনেক গবেষণালব্ধ লেখা। আপনার যুক্তি আমি বিষ্ময় দৃষ্টিতে পড়ি। নমষ্কার দাদা।