গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

তেরো
রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে যতটা প্রিয় শব্দ, রাবীন্দ্রিক ততটাই অপছন্দের। রবীন্দ্রনাথ শিল্পের নাম হলে রাবীন্দ্রিক তার মাথায় পা রেখে দাঁড়ানো সংস্কৃতি। প্রাইমারি টেক্সটকে একা থাকতে দেওয়া খুব জরুরি, যেন একটা পুরনো দুর্গ, চারপাশে গোল করে কাটা পরিখা। তার বাইরে যে এক চিলতে চত্বর সেখানে রবিবারের ভিড়, টিকিট কেটে হুড়মুড় দর্শক ঢুকে প’ড়ে এক একজন গাইডকে ঘিরে মৌচাক বানিয়েছে।

এই পরিচালকেরাই রবীন্দ্রসংস্কৃতির পিলার বা পুরোহিত। কিন্তু আমরা তো বুদ্ধকে চাই, বৌদ্ধদের নয়। দুর্গের দিকে থুতনি তুলে গল্প শোনায় আগ্রহ নেই, গাইড বরং পাটাতন হয়ে শুয়ে পড়ুক, জনগণ পিঠের ওপর দিয়ে পরিখা পার হয়ে যাবে।

অথবা ধরা যাক, বালুচিস্তানের সুলেইমান পাহাড়ের গায়ে এক পুরনো কবরখানা থেকে বা সুইডেনের এরেসান্ড প্রণালীর তীব্র লবণজলে ডুবে যাওয়া জাহাজের খোল থেকে গীতবিতান আবিষ্কৃত হয়েছে। উদ্ধারকারী দলের সদস্য হিসেবে আমি বইটা হাতে পাওয়ামাত্র প্রেমপর্যায় পড়তে শুরু করলাম।

“দুঃখ দিয়ে মেটাবো দুঃখ তোমার
স্নান করাব অতল জলে বিপুল বেদনার।।
মোর সংসার দিব যে জ্বালি, শোধন হবে এ মোহের কালি,
মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার।।”
(প্রেম, ১৩৬ নম্বর)

কথা, নাকি হাজার বিভাবে পরিপূর্ণ একটি খতরনাক ব্যাপার! যত পড়ছি, চৌসা আমের মতো ক্যাডবেরি ফাইভ স্টারের মতো চটচটে মিষ্টি লাইনগুলোর মধ্যে এত রাগ-ভয়-অবিশ্বাস-অভিযোগ-অভিমান-সন্দেহ-মোহভঙ্গ-উদ্বেগ দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছে! বেশির ভাগ লেখা থেকে টেনশানের গরম বাষ্প বেরিয়ে গায়ে ছ্যাঁকা লাগায়।

ঘর-বাইরের দ্বন্দ্ব “আমার যেতে সরে না মন”-এ; “গেল গো ফিরিল না চাহিল না”-য় ঝটকা দেওয়া অভিমান; অনাদর আর অবহেলা পাওয়ার স্মৃতি “এই কথাটি মনে রেখো” গানে; “ডেকো না আমারে ডেকো না” বা “যাক ছিঁড়ে যাক”-এ অবহেলা ছলনার অভিযোগ; “আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি” জিগেস করেও ঠোঁট ফোলানো; তবু সকল অভিমানের সেরা “সেই ভালো সেই ভালো”। কনফিউশান দ্যাখা দিচ্ছে “যে ছিল আমার স্বপনচারিণী” বা “ও দ্যাখা দিয়ে যে চলে গেল” অথবা “ফিরে যাও কেন ফিরে ফিরে যাও”-তে। আবার কোথাও দুজনের মধ্যে প্রেমের টক্কর লেগেছে — “আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা”। যদি ভুল করে পস্তানো হয় “হায় হতভাগিনী” বা “সে কোন ঝড়ের ভুল”, কঠিন বিচ্ছেদকষ্ট থাকবে “আর নহে আর নহে” গানে; শেষে যথেষ্ট হয়েছে, থাকলো তোর প্রেম ব’লে আমি “ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে” কেটে পড়ছি। এই রকমই মুক্তসত্তার দ্যাখা পাবেন “এক রাস্তা হ্যায় জিন্দগী”-সম (সিনেমা কালাপাত্থর) “কে ডাকে। আমি কভু ফিরে নাহি চাই” লিরিকে।

আবার, প্রেমিকার দিকে আঙুল তোলায় শুরু হয়ে শেষে হাহাকারে মিশে যাচ্ছে “গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা”। যদিও রবি ঠাকুর প্রেমে ভুল বোঝাবুঝি ব্যাপারটাকে চিরস্বীকৃতি দিয়েছেন “কেহ কারো মন বুঝে না”-য়, তবু “না বুঝে কারে তুমি ভাসালে” বা “বিদায় করেছ যারে নয়নজলে” অথবা “হল না লো হল না সই”-এর মতো নানা বাণীতে সেই আক্ষেপ-টেনশান। এদিকে অপূর্ণতার বোধ বারবার এসে ছলাৎছল দুলিয়ে দিচ্ছেঃ “আমি যাব না গো অমনি চলে” বা “মম দুঃখের সাধন” গানগুলোয়। অভিমানে টইটম্বুর রবি ঠাকুর — “যদি বারণ কর তবে গাহিব না”; প্রবল অবিশ্বাসী যখন — “না বলে যায় পাছে সে” কিম্বা “তবে শেষ করে দাও শেষ গান”। নাকি অবিশ্বাস নয়, আত্মভরসার অভাব “তবু মনে রেখো”-তে? দ্বিধা জুড়ে আছে মন — “সখী আমারি দুয়ারে কেন আসিল”, অতৃপ্তি এসেছে “আকুল কেশে আসে” গানে, ভয়-সংশয়ের এক্সপ্রেশান “জয় করে তবু ভয় কেন তোর” বা “মুখপানে চেয়ে দেখি”-তে আর যেন কবিকে ডিসিভ করেছে প্রেমিকা “হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া…”।

মিলনের মুহূর্তেও বিচ্ছেদচিন্তা রবীন্দ্রনাথকে পাগল করে রাখেঃ “এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে” বা “বসন্ত যে যায় তো হেসে” অথবা “কেন ধরে রাখা, ও যে যাবে চলে” বলেন যখন। কোটি কোটি বিরহ ডানা মেলে ”ও আমার ধ্যানেরই ধন” আরাধনায়। যেন বিচ্ছেদ সত্য, মিলন মিথ্যে, “ওকে বাঁধিবি কে রে” বা সকালবেলার আলোয় বাজে”তে; মিলনে শুরু বিরহে শেষ “শেষ বেলাকার শেষের গানে”। বিদায় জানানোর গান, “জানি, জানি হল যাবার আয়োজন”, নাড়ি-ছেঁড়ার যন্ত্রণা “আমার যাবার বেলা পিছু ডাকে”, বিদায়বাঁশি বাজছে “কেন আমায় পাগল করে যাস”… শেষে বলেই দিলেন, “আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ-মিলন, আমাদের বিরহ-মিলন”। এতদ্বারা প্রেমিকাকে জানানো যাইতেছে, দূরত্বকেই সংলগ্নতার সমশব্দ ভেবে নিতে হবে। কিছু করার তো নেই।

এত সমস্ত না লিখে একটা গোটা গানই তুলিঃ

কোন্‌ বাঁধনের গ্রন্থি বাঁধিল দুই অজানারে
এ কী সংশয়েরই অন্ধকারে।
দিশেহারা হাওয়ায় তরঙ্গদোলায়
মিলনতরণীখানি ধায় রে
কোন্‌ বিচ্ছেদের পারে।।
(শ্যামা, প্রেম ২১৯)

দেখুন, পাঁচ লাইনের প্রেমগীতে সংশয়, অন্ধকার, দিশেহারা(ভাব) এবং শেষে বিচ্ছেদ!

তাহলে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানে কমেডি নেই, আস্থা নেই, নেই আনন্দ? না না, ভরপুর আছে সমস্ত চ্যানেল। তবে মোটের ওপর সে মিলন পারফোরেটেড, ভরসার পংক্তিগুলো ছোট, আনন্দ বিরহভয়ে সারা। কিন্তু আশা-হতাশা মিলিয়ে শ্রাবণারণ্যে এমন মোহনছায়া বোনা হল যে আমরা কাঁদি-কোঁকাই না, বরং প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ বনগাঁ লোকালে জানলার পাশে ফাঁকা সিটের মতো অলৌকিক হাতছানি দেন শ্রোতাকে। যখন গানের ভাব আঘাত করে, তখন আশ্রয় দিচ্ছে শব্দ-ব্যবহার, ইমেজারির প্রয়োগ; যখন লেখাও তার রক্তাক্ত হাতে জড়িয়ে ধরছে না আমাকে, যেমন ওই ১৩৬ নম্বর বা ২১৯, তখন সিওর সাকসেস শান্তি দেয় সুর।

খেয়াল-প্রভাবিত ভারতীয় সংগীতমানস নিয়ম করেছে যে গানের কথা হবে দু’বছরের বাচ্চা আর তার সুর ৪৪ সাইজের পাঞ্জাবি। হয়তো সেখান থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান বাণীপ্রধান এমন ধারণা আরম্ভ চালু শুরু হয়ে গেল। উনি কিন্তু ব্যবহার করেছিলেন “ভাবপ্রধান” শব্দটা, বলেছিলেন গানে কথাসুর সমানাংশ নিক। আমি তো প্রেম পর্যায়ের গানে বহু জায়গায় দেখেছি যে ছেলেমানুষ গীতবিতানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, উদ্ধার করছে প্রেমিক স্বরবিতান। আমার কাছে অনেক সময় রবি ঠাকুরের গানের কথার চেয়ে সুর বেশি কমপ্লান গার্ল।

মিলন-বিরহে এই যে রবীন্দ্রনাথ বিভাজিত, এটা অ্যাসরটেড সাইজের বিস্কুট নয়, ভাববৈচিত্র‍্যও নয় কবির। সুলেইমান পাহাড় সংলগ্ন এরেসান্ড প্রণালীর মানুষ হওয়ার জন্যে তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, কিন্তু প্রেমের গান ওল্টাতে গিয়ে মনে হল তার একটা ঘটনা ছিল, কোনও প্রাচীন কেস। যেন ওই প্রেম নিয়েই ভূমিষ্ঠ হন গায়ের চামড়ার মতো, তারপর দাড়িগোঁফের মতো বৃদ্ধির মাঝখানে যে হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেছে নেপালের ভূমিকম্পে। এবং যদি আপনি সুপার কোয়ালিটির একটা প্রেম পেয়ে গিয়েও হারিয়ে ফেলেন তবে জিন্দগিভর সে আপনার অবসেশান হবে, হবে বেঁচে থাকার উপায় ও মরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। সমান মূল্যবান কথা এই, ভবিষ্যতের সব সম্পর্ককে ওই শুরুতে সার্থক শেষে ব্যর্থ প্রেমের বাটখারায় মাপবেন আর সীতাহারের মতো ফেলে দেবেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে। এগিয়ে যাবেন কিন্তু ভিড়তে পারবেন না, ফলত এই সম্পর্কগুলো হবে বিশ্বাসহারা, অভিযোগময়, হালকা, হতাশাউৎপাদক, অসমাপ্ত।

আন্ডার দ্য অ্যাবাভ, আমরা হয়তো বুঝি প্রেমের গানে কেন রবীন্দ্রনাথ বারবার সমর্পণের দরজা থেকে ফিরে আসেন।

(আরও লিখবো)

3 thoughts on “গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

  1. আরও লিখবেন এটাই তো চাই দাদা। এতো এতো ইনফরমেশন মাথায় রাখেন কী কোরে !! বলবেন। কেবলই কি অধ্যাবসায় নাকি সফল একজন চারু শ্রোতাও বটে ?

  2. রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে যতটা প্রিয় শব্দ, রাবীন্দ্রিক ততটাই অপছন্দের। রবীন্দ্রনাথ শিল্পের নাম হলে রাবীন্দ্রিক তার মাথায় পা রেখে দাঁড়ানো সংস্কৃতি।

     

    * অসাধারণ যুক্তি ও তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা ভালো লেগেছে।

    শুভরাত্রি।

  3. অসাধারণ আপনার তৃতীয় নয়ন প্রিয় চন্দন দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।