গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

চোদ্দ
আমরা জানি যে রবীন্দ্রনাথ কিছু প্রেমপর্যায়ের পূজা-র গানও লিখেছেন। “বাঁশি আমি বাজাইনি কি পথের ধারে ধারে” সেই রকম ম্যান্ডোলিন বাদকের আসরে এক সরোদিয়ার ঢুকে পড়াঃ

“মিলন-ছোঁয়া বিচ্ছেদেরই অন্তবিহীন ফেরাফেরি
কাটিয়ে দিয়ে যাও গো নিয়ে আনাগোনার পারে”

এখানে প্রেমিকা ঈশ্বরী ছাড়া আর কিছুমাত্র নন। এখানে ঝপ করে মনে পড়বে কবীরঃ
প্রেম পন্থ মে পগ ধরৈ, দেত না শীশ ডরায়
সপনে মোহ ব্যাপে নহী, তাকো জনম নসায়

[প্রেমের পথে পা রাখা মানুষের নিজের মাথা কাটা যাওয়ার ভয় থাকে না। সে বিভ্রমের শিকার হয় না স্বপ্নেও, আর তার পুনর্জন্মেরও সমাপ্তি হয়ে যায়]।

উপনিষদ বলছে, প্রকৃতিতে জন্মের গ্রন্থি হল অহংকার। কাজেই অহং নষ্ট হলে তার বেঁচে থাকারও হেতু নেই।

ম্যান্ডোলিন-সাম্রাজ্যে আবার এক পিস সেতার ঘুস্পেঠ ক’রে “ওরে কী শুনেছিস ঘুমের ঘোরে” বানিয়েছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বললেনঃ

“যেন জীবন মরণ একটি ধারায় তার চরণে আপনা হারায়
সেই পরশে মোহের বাঁধন রূপ যেন পায় প্রেমের ডোরে”।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রেম-অপার্থিবগুলো রবি ঠাকুরের ভালোবাসা পর্যায়ের অন্য সব গানের তুলনায় দলছুট; সীমান্ত পাহারায় একটু হালকা দিলেই ফ্লোর ক্রস করে পূজা-শিবিরে ঢুকে পড়বে।

আত্মনিবেদনের আংশিক তালিকা এখানে টাঙিয়ে দেওয়া হলঃ
“আমার পরাণ লয়ে কী খেলা খেলাবে ওগো”, “আমারে করো তোমার বীণা”, “ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ”, “আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার”, “আমার জীবনপাত্র উচ্ছ্বলিয়া”, “হে সখা বারতা পেয়েছি মনে মনে”, “বড় বেদনার মতো”, “তুমি রবে নীরবে”, “আমার নিশীথ রাতের বাদলধারা”, “বিজয়মালা এনো আমার লাগি”, “তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে”, “চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে”, “নিশি না পোহাতে”, “বলো সখী, বলো তারি নাম”, “এবার উজাড় করে লও হে আমার”, “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ”, “তারে দেখাতে পারি না কেন প্রাণ”, “আমার এই রিক্ত ডালি”, “এসেছি গো এসেছি”, আমার থাকতে দে না”, অথবা “কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে”।

নোটিশবোর্ডের গানের কথাগুলো হাতে তুলে একটু নাড়াচাড়া দিলে দেখবেনঃ (ক) প্রায় সবখানে ‘আমি’ আর ‘তুমি’ এই দুই আলাদা সত্তা সমুপস্থিত। তাদের মধ্যে একটা বিভব-প্রভেদ বা পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স কাজ করছে এবং পদার্থবিদ্যার সহজ ধারণায় পুরুষ V(A) থেকে নারীর V(B) দিকে ছুটছে সেই সমর্পণের প্রবাহ। কিন্তু আত্মোৎসর্গ অধুরা হয়ে আছে বেশির ভাগ সময়ে, V(A) = V(B) হয়নি যেহেতু!

যেমন, “তারে দেখাতে পারি না কেন প্রাণ”-এ অন্তরার শেষ লাইনে বললেনঃ সে আমার এত সাধ এত প্রেমের অপমান করছে, তবু আভোগে এসে চাইলেন নিজের ভালোবাসাকে প্রেমিকার পায়ে রেখে দিতে। মানে, উৎসর্জনের পায়েসবাটিতে মান-অপমানবোধ নামের দুটো কালোজিরে মাথা তুলেই থাকল।

এভাবে আপনি আমার লিস্টিতে চোখ রাখলে আরও খেয়াল করবেনঃ (খ) নিবেদনের গানগুলো বেশিটা আসছে মেয়েদের বচনে, আর সেই নারীর চেতনায় লেগে থাকছে রাধা-অনুষঙ্গ। বলা যায়, চৈতন্যদেবের ঈশ্বরসাধনার অ্যাপ্লায়েড দিক ছিল ‘রাধাভাবে কৃষ্ণভজনা’। অবিভক্ত বাংলার ট্রাজেডি এই যে আমরা মিনসেরা কখনও হৃদয়ে কৃষ্ণানুভব করে কৃষ্ণকে ডাকতে পারলুম না, নিজেকে সঁপে দিতে গেলে মেয়েদের স্বর নকল করতে হল — যে ব্যর্থতা হয়তো আসলে পুরুষতন্ত্রেরই।

__________
(অশেষ… )

2 thoughts on “গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

  1. আজকে আপনার পরপর দুটি পোস্ট প্রকাশ হয়েছে। এই পর্ব পড়লাম। এখন পরেরটায় চললাম। ধন্যবাদ দাদা ভাই। নমষ্কার।

  2. যেহেতু এই আলোচনার শুরু থেকে আছি সে কারণে অন্য যে কারু সাথে বিষয়টি আমার কাছেও যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় চন্দন দা। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।