অণুগল্প : পীতনগর

পীতনগর

রাজধানী শহরে বিজয় দিবস উদযাপন শেষে শফিক বাড়ি ফিরছে। ডিসেম্বরের শীত শীত রাতে কুয়াশা কেটে কেটে কুড়িগ্রামের দিকে ছুটছে বাস।

পুরো বাসে নেমে এসেছে ঘুম, শফিকের ঘুম আসছেনা। ওর মনের ভিতর মার্চ পাস্ট করে যাচ্ছে প্যারেড গ্রাউন্ডের কুচকাওয়াজ, যুদ্ধ বিমানের হাওয়ায় ডাইভ দিয়ে উর্ধ্বমুখী উড়াল, টিএসসি’র কনসার্ট আর বাসে ওঠার সময় কণার জলে ভেজা চোখ।

বাস ছুটছে, আবার ফিরবে বলেই ভার্সিটির ছুটিতে বাড়ি ফিরছে শফিক। শীতের হবো হবো ভোরে পলাশবাড়ি পেরুতেই কিছু একটা হলো, খুব জোড়ে ধাক্কা খেয়ে মহাসড়কের পাশের জলাশয়ে ছিটকে পড়লো বাস- শফিকের স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু ও কিছুতেই তা মেলাতে পারছে না। কারণ, ওর জ্ঞান ফিরতেই অচেনা এলাকায় আবিষ্কার করে নিজেকে।

এক ব্যস্ত শহরের পথে পথে হাটছে শফিক। রোদের নরম রোদে জাগছে শহর। শিশুরা ব্যাগ কাঁধে ছুটছে স্কুলে, বড়রা অফিসে। দোকানপাট খুলছে ধীরে ধীরে। বাসের হেল্পার ‘সিট খালি.. সিট খালি’ বলে চেঁচাচ্ছে। সাই সাই করে পাশ কেটে যাচ্ছে ঝকঝকে গাড়ি। ফুটপাতে যারা একটু আগেও শুয়ে ছিলো, তারা দিব্যি জাদুর মত নাই হয়ে গেছে। সূর্য যত উপরে উঠছে, শহর তত ব্যস্ত হচ্ছে। কারো দিকে তাকাবার সময় কারো পর্যন্ত নেই।

শফিকের ক্ষিধে পাচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষিধে। ও একটা হোটেলে ঢুকে নাস্তা সারে। তারপর আবার হাটতে শুরু করে, এ এক আজব শহর বা দেশ। কত উঁচুউঁচু দালানের সারি, রঙচঙ কত বিলবোর্ড। দু তিন মোর পার হতে না হতেই মাথার ওপর ফ্লাইওভার। এ শহরও সেজেছে বিজয় দিবসের জৌলুস সাজে, হলুদ নিশান আর হলুদ ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে।

এমন এক ফ্লাইওভারের নিচেই একটা বাস থেতলে দিয়ে গেছে কারো মাথা- সেখানেও মিডিয়ার লোকজন ছাড়া আর কারো কোনো শোক- কৌতূহল বা হা-হুতাশ নেই।কোনো একটা বাহিনীর সদস্যরা কারো চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে- কারো কোনো প্রশ্ন নেই। মিছিলে আটকে আছে সম্ভবত শহরের ব্যস্ততম শহর কারো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

শফিক অবাক হয়ে লক্ষ্য করে এ শহরে মিডিয়া, বাহিনী, ড্রাইভার সবার পোশাক হলুদ, এমন কি শহরবাসির পোশাকেও হলুদ রঙের নাগরিকত্বের ব্যাজ। এ শহরে সবাই ব্যস্ত, একমাত্র ওর কোনো তাড়া নেই। ওর সাথে হাটতে হাটতে সকাল পৌছে গেছে বিকেলে, এখন বিকেলও বলছে যাই যাই। তবু ওর হাঁটা থামেনা।

ব্যস্ত শহরে সন্ধ্যা পেরিয়ে নামছে রাত। শহরবাসীর ফেরার জন্য প্রবল তড়িঘড়ি। এই প্রথম শফিকের গায়ের পশম আতঙ্কে দাঁড়িয়ে যায়, একটার পর একটা শীতল স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে আসে, দাঁড়িয়ে থাকার মত জোড় হারায় হাঁটু। ও ফুটপাতে বসে পড়ে, আর দেখে- এ শহরে কোনো বাড়ি নেই, শহরবাসীরা নিজ নিজ কবরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ছে। কবরের ভিতরে জ্বলে উঠছে আলো, হাওয়ায় ভেসে আসছে খাওয়ার ঘ্রাণ আর টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের আওয়াজ।

12 thoughts on “অণুগল্প : পীতনগর

    1. ধন্যবাদ মুরুব্বী আজাদ ভাই। :)

  1. লেখাটি আমার কাছে ভাল লেগেছে। পড়ে গেলাম।

  2. * আমার কাছে অতিপ্রাকৃত মনে হয়েছে…

    1. অনেকটা তাই। ধন্যবাদ কবি হুসাইন ভাই। :)

  3. অসাধারণ লিখা। শুভেচ্ছা হরবোলা আবু সাঈদ ভাই। 

    1. ধন্যবাদ কবি সুমন ভাই। :)

  4. পড়লাম ভাই আবু সাঈদ আহমেদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. ধন্যবাদ কবি সৌমিত্র ভাই। :)

    1. ধন্যবাদ কবি শাকিলা তুবা। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।