আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

চিকেনিজম ভাবান্দোলন

প্রগতিশীল ও উন্নত রাষ্ট্র বলতে মানসলোকে যে ধারণা পুস্পপত্রে পল্লবিত হয়ে ওঠে ওয়েস্ট শেয়ালপুর রিপাবলিক ঠিক তাই। ফলে শিয়ালপুরের রাজধানীর নাম চিকেনডাঙা শোনার পর বিস্ময় জাগেনি। এই রাজধানীতেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্ব মুরগিসুন্দরী প্রতিযোগিতা’।

বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার কথা শুনলেও বিশ্বমুরগি সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিষয়ে পুরোই অজ্ঞ ছিলাম। শেয়ালডাঙার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী স্যার মোরগালিয়াম কুককুরুক যখন এ তথ্য জানালেন তখন বিস্ময় গোপন করতে পারিনি। অগাধ কৌতূহল নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম-
: স্যার, এ প্রতিযোগিতা আয়োজনের কারণ কি?
: চিকেনিজম ভাবান্দোলনের ফসল এই প্রতিযোগিতা। মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী মুরগিবাদীদের চলমান সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানাতে শেয়ালপুর রাষ্ট্রীয়ভাবে এ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে।

নিজ অজ্ঞানতাকে মনে মনে ধিক্কার জানিয়ে প্রশ্ন করলাম-
: এ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন কি কি পুরষ্কার পান?

শেয়ালপুর রিপাবলিকের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী বেশকিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন-
: যে প্রতিযোগী চ্যাম্পিয়ন হন তিনি অনেক পুরষ্কারইই পান। মুরগিধিকার আন্দোলনের ব্রাণ্ড এম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। তবে সবথেকে বড় পুরষ্কার হলো মুরগি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় তারা আমৃত্যু শেয়ালদের সাহচর্য পান।

আবার বিস্মিত হবার পালা, সারাজীবন জেনে এসেছি শেয়াল আর মুরগীর সম্পর্ক খাদক ও খাদ্যের, আর মন্ত্রী মশাই বলছেন সাহচার্যের কথা! কৌতূহল চাপতে না পেরে বললাম-
: মন্ত্রী মশাই, শেয়ালদের সাহচর্য বিষয়ে যদি একটু খোলাসা করে বলতেন-
: ভেরী সিম্পল। চ্যাম্পিয়নসহ ফার্স্ট ও সেকেন্ড রানার্স আপ বিশ্ব মুরগিসুন্দরী শেয়ালদের সাথে রাত কাটিয়ে জানিয়ে দেন- মুরগিস্বাধীনতা হরণ করা যাবেনা।

যত জানছি ততই কৌতূহল বাড়ছে, জানতে চাইলাম-
: এতে শেয়ালদের লাভ কি?

মন্ত্রীমশাই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানালেন-
: সবকিছুতেই লাভ থাকতে হবে! শেয়ালদের মনে মুরগিদের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা নেই- এ ধারণা সম্পূর্ণ অবান্তর। শেয়ালদের মত এতো বেশী করে কে আর মুরগিদের ভালোবাসে!

মন্ত্রী মশায়ের কাছে ক্ষমা চাইলাম। কিন্তু তার রাগ কমেছে বলে মনে হোলো না। কিছুটা ভয় নিয়েই প্রশ্ন করলাম-
: বাকী প্রতিযোগিরা কি সুযোগ পান?

মন্ত্রীমশাই ঝাঁঝালো স্বরে বললেন-
: আপনার কি মনে হয়?

বিনয়ের সাথে উত্তর দিলাম-
: স্যার, আমার কোনো ধারণা নেই। তাই আপনার কাছে প্রকৃত তথ্যটা জানতে চাইছি-

স্যার মোরগালিয়াম ক্ষোভে ফেটে পড়লেন-
: শেয়ালপুর রিপাবলিকের মোরগরা কি মরে গেছে! বাকী প্রতিযোগীরা এই মোরগদের সাহচর্য পায়। তারপরেও দু:খজনক সত্য হোলো মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় মোরগদের ভূমিকা সবসময়েই ফোকাসের বাইরে থেকে গেছে। মুরগী আগে না ডিম আগে প্রশ্ন থেকেই এই অবহেলার শুরু, যেনো ডিমোৎপাদনে মোরগের কোনো ভূমিকা নেই।

আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হলো না। মন্ত্রী মশায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি কানে কানে বললেন- ‘মুরগির প্রয়োজন হলে বলবেন, সংকোচ করবেন না। মুরগিধিকার প্রতিষ্ঠায় চিকেনিজম বিশেষজ্ঞ ৩৪-২৬- ইনফিনিটি মুরগি পাঠিয়ে দেবো, জাস্ট রুম নাম্বারটা জানাবেন।’

.
#খসড়া অণুগল্প
১৩১০২০১৮

বাঙালি সেকুলারের মনের পশু সঙ্কট

abu

১.
কোরবানি ঈদের পরদিন, রাত ৮টা। সুনসান পাড়া, নিরবতা বিদীর্ণ করে কেউ একজন তীব্র গতিতে বাড়ির কলাপসিবল দরজা ঝাঁকাচ্ছে। কল বেল থাকার পরও এভাবে দরজা ঝাঁকানো ভীতিকর, ভয় পেতে শুরু করেছি।

আতঙ্ক আর কৌতূহল মিশ্রিত মন নিয়ে দ্রুত দরজার সামনে গেলাম, মহল্লার এক ভায়ের ভয়ার্ত চেহারা, দু’হাতে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন, ভেঙে ফেলতে চাইছেন। আমাকে দেখে কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেলেন, কাতর স্বরে বললেন,
– জলদি দরজার তালা খুলো, আমারে বাঁচাও.. প্লিজ বাঁচাও।

তাকে ঘরে এনে বসালাম। পরপর দুই গ্লাস পানি খেলেন। বোঝা গেলো খুব বিপজ্জনক কিছু ঘটেছে। জিজ্ঞেস করলাম,
– কি হইছে ভাই!
– তুমি তো জানো আমি দুইটা কোরবানি দেই। একটা পারিবারিকভাবে ঈদের দিন, আরেকটা একা দেই, ঈদের পরদিন।
– আমি তো জানতাম একটা দেন।

গত এক যুগ ধরে এই ভাইদের বাসায় একটা গরু কোরবানি দিতে দেখে আসছি, তিনি দুইটা পশু কোরবানি দেবার কথা বলায় কিছুটা বিস্মিত হলাম। সেই বিস্ময় ভাঙাতে তিনি জানালেন,
– না, একটা না। ঈদের দিন পারিবারিকভাবে কোরবানি দেই বনের পশু, আর ফেসবুকে সিরিয়াস হবার পর থেকে ঈদের পরদিন একা একা কোরবানি দেই মনের পশু।

একটা ঢোক গিলে জানতে চাইলাম,
– তা সমস্যাটা কি, ভাই?
– বিশাল সমস্যা। আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মনের পশুটারে জবাই দিবার জন্য পায়ে বাইন্ধা একটানে মাটিতে ফেলছি, মুহুর্তের মধ্যে ঝাড়া দিয়া খাড়ায়া গেলো, ফ্র‍্যাকশন অব সেকেন্ড খাড়ায়া রইলো, তারপর দিলো ঝাইররা দৌড়।
– বলেন কি! তারপর?
– আমিও পশুর পিছনে দিলাম দৌড়, টের পায়া ওই পশু গিয়া ঢুকলো সেলিনাদের বাসায়।
– সেলিনা? কোন সেলিনা! আপনাদের বাড়ির পাঁচ ছ’টা বাড়ির পর যে থাকে! মানে আপনার এক্স মানে প্রাক্তন..

কথা শেষ করতে না দিয়ে মহল্লার ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন-
– চুপ। একদম চুপ। বিশ্বাসঘাতিনী, আইয়ূব বাচ্চু তাই বলেছেন ‘সেলিনা এখন অন্য কারো/আমার কেউ নয়..’
– ওহ! আচ্ছা। তবে সেলিনার কথা থাক, আপনার মনের পশুর কথা বলেন-
– বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সেলিনাদের গেটে দাঁড়ায়ে আছিলাম, কিন্তু মনের পশুটা ঢুকছে তো ঢুকছেই। বের আর হয়না। একটু আগে বের হইলো সেলিনার বড় ভাই, সাথে তার মনের পশু, তার মনের পশু আবার দুইটা- যমজ এলসেশিয়ান কুত্তা।
– বলেন কি!
– হ রে ভাই! সেলিনার বড় ভাইরে দেইখা সালাম দিলাম, তিনি সালামের জবাব নিয়া জিগাইলেন, ‘এইখানে কি করতাছো, বিলাল?’
– তারপর!
– আমি জবাব দিবার আগেই সেলিনার ভায়ের মনের পশু দিলো ধাওয়া, আমার পাছায় কামড়ায়া কিচ্ছু বাকী রাখে নাই, ধাওয়া খাইতে খাইতে এইখানে আয়া পরছি।

মহল্লার ভায়ের মনের পশু গেছে পালিয়ে, তার ওপর প্রাক্তনের বড় ভায়ের মনের পশু এক জোড়া এলসেশিয়ানের ধাওয়া খাওয়ার ভয়ে চুপচাপ আমার বাসায় বসে আছেন, দেখে মায়া লাগছে, কষ্টও হচ্ছে।

২.
মাঝরাতে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। এমন বৃষ্টিতেই চার পাঁচজন বন্ধু মিলে পাহারা দিয়ে মহল্লার বড় ভাইকে বাসায় পৌছে দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙলো ভায়ের ডাকে, বৃষ্টি নেই কিন্তু বারান্দায় গোড়ালি পর্যন্ত পানি। রাস্তায় পানি বেশী, ময়লাও। ওই পানি পেরিয়ে মহল্লার ভাই চলে এসেছেন। বিস্ময় গোপন করে জানতে চাইলাম,
– এতো সকালে! কোনো সমস্যা, ভাই?
– সমস্যা মানে বিশাল সমস্যা।

একটা মাত্র জীবনে মানুষকে বহু বিশাল বিশাল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়! ভোরের আলোয় মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো, বিষাদভরা কণ্ঠে বললাম,
– চলেন, ছাদে বসি। চা খেতে খেতে কথা বলি..

দু’জনে ছাদে উঠেছি। ক’টা চড়াই, বাবুই আর দোয়েল খাবার খাচ্ছে। প্রতিদিন এদের খাবার দেওয়া হয়, না দিলে ভোরে এসে চেঁচামেচি শুরু করে। পাখিগুলো আমাদের দেখে উড়ে গেলো না, ভাই বললেন,
– এগুলির দেখি অনেক সাহস!
– উড়ে যাবার পাখা আছে, ভয় কেনো পাবে?
– তা ঠিক! তা ঠিক!

চায়ে চুমুক দিচ্ছি, ভাই উশখুশ করছেন কিন্তু কথা শুরু করতে পারছেন না। অগত্যা আমিই প্রশ্ন করলাম-
– কি সেই বিশাল সমস্যা!
– প্রথম সমস্যা হলো, সেলিনার ভায়ের মনের জোড়া কুত্তা যে আমারে কামড়াইলো, এর জন্য কি নাভির গোড়ায় ইনজেকশন নিতে হইবো!

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
– না, ভাই। মনের ইনজেকশনই বড় ইনজেকশন। দ্বিতীয় সমস্যাটা কি?

ভাই একটু কেশে নিয়ে শুরু করলেন,
– কোরবানি ঈদের পরদিন মানে গতকাল তো মনের পশুরে কোরবানি দিতে পারিনি, দৌড়ায়া সেলিনাদের বাড়িতে পালাইলো।
– হুম।
– কিন্তু কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘইটা গেছে-
– ছি: ছি: বলেন কি!
– হ, আমার মনের পশু তো সেলিনার মনের পশুরে নিয়া জঙ্গলে ভাগছে..
– ওহ! এতে আর সমস্যা কি?
– এইটাই তো সমস্যা! মনের পশু এখন তো আর মনের পশু নাই, পুরাই বনের পশু হয়া গেলো।
– এইভাবে তো ভাবি নাই! তবে আগামী ঈদের পরদিন কোরবানি দিবেন কি!

ভাই স্বস্তির স্বরে জানালেন,
– ওইটা নিয়া চিন্তা নাই। মনের পশু পালানোর আগে তিনটা বাচ্চা দিয়া গেছে, নাদুস নুদুস, মনের মাঠে নাপাম ঘাস খায়া খায়া বড় হইতাছে–

খুব কৌতূহল নিয়েই জানতে চাইলাম-
– বলেন কি! আচ্ছা ভাই, বছরে বছরে মনের পশু কুরবানি না দিয়া, মনের পশুর খামারটারে এক্কেবারে উচ্ছেদ করলে হয়না!

আমার বোকামিতে ভাই মৃদু হাসলেন,
– এইটা একটা কথা হইলো! মনের পশু কুরবানি দিতে কইছে, খামার উচ্ছেদ করতে তো কয়নি। তাছাড়া খামার বন্ধ করলে প্রতি ঈদে ফেসবুকের পাকপবিত্র ময়দানে মনের পশু কোরবানি দিমু কেম্নে!

‘কে এমনটা বলেছে’ এই প্রশ্নের উত্তর জানার সাহস হলো না, তাই চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,
– সমস্যা কি আরও কিছু আছে?
– হুম
– কি সেটা?
– আমার গফরে বুঝাইতে পারিনা আমি শুধু তারেই ভালবাসি, আমার ১২টা গফের একটা গফও আমার এই কথাটা বিশ্বাস করে না।

মুরগির ডিম ফুটে ছাগলের বাচ্চা বের হলেও এতটা তাজ্জব হতাম না, তাজ্জবতা কাটিয়ে বললাম,
– দু:খজনক, মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক–, এ তো অনেক বড় প্রব্লেমেটিক সমস্যা।
– এটা বড় সমস্যা না, সমস্যা হইলো আমার মনের পশুর লগে ওদের মনের পশুও যদি ভাইগা যায় তবে তো বিশৃঙ্খলা হয়া যাইবো।
– ভাগতে চাইলে ভাগতে দেন, বিশৃঙ্খলা হইবো ক্যান!
– বিশৃঙ্খলা হইবো না! ওগো ১২জনের মনে ১২টা পশু, আর আমার মনে পশু মাত্র ৩টা। অবস্থাটা বোঝা একবার, এক্কেবারে পরকীয়া হয়া যায় না!

সাহস নিয়ে বললাম,
– আপনার গফদের মনে আর বনে আসলে একটাই পশু, মানে ১২জন মিলে ১টা পশুরেই শেয়ারে পালতাছে, চিন্তা কইরেন না।
– এইটা হইলে তো ভালোই। কিন্তু একটারে নিয়া যদি বারো পশু পালায়! কিয়েক্টা অরাজকতা! এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নাই!!

এই বিশাল সমস্যার সমাধান খুব কঠিন নয়, ভায়ের মনে হাইব্রিড পশু চাষ করলেই হবে। কিন্তু বলার ইচ্ছে হলো না, বাঙালি সেক্যুলারের মন বুঝা খুব কঠিন, তাদের মনের পশুরে বুঝা কঠিনতর, তাই ভায়ের চেহারার সাথে মিলিয়ে নিজের চেহারায় চিন্তার ভাব ধরে রাখি, যেনো কোরাসে চিন্তা করছি।

.
পুরানো লেখা।

অকবিতা

বাড়ছে বয়স চর্যাপদের গীতে
বনস্পতির ছায়ায় শুকোই ঘাম,
বোতাম ছেড়া শার্ট
ভীষণ আনস্মার্ট
হয়নি শেখা বাঁধতে জুতোর ফিতে,
পারফিউমের দেইনি কোনো দাম।

আমার নেশা কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণে
ঘোড়ার চালেই কিস্তি বাজিমাৎ,
আগুন বনে একা
ফুলকি ছুঁয়ে দেখা
ভস্ম করার খায়েশ প্রবল প্রাণে,
পুড়তে পুড়তে পোড়াই অকস্মাৎ।

কলার জুড়ে ঘামের মলিন দাগ
কলব ভরা অনেক হিসেব ঋণে,
তোমার চোখে রাখা
ইকারুসের পাখা
আমারও চাই ভালবাসার ভাগ,
উড়ালকাতর আলিঙ্গনের দিনে।

.
অকবিতা/২০১৭

নীলমাছি

gty

পায়ের কাছে জানলা খোলা। বাইরে ঝাঝা রোদ। গ্রীষ্ম দুপুরের তালুফাটা গরম। জানালার গ্রীলে তিন চড়ুই শলাপরামর্শ করছে। ধীর গতিতে পাখা ঘুরছে।

কাথা মুড়ে শুয়ে আছি। তিন দিন ধরে ভীষণ জ্বর। আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে, বরফ চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বাড়ছে আর বিছানাটা কেমন সবুজ মাঠ হয়ে যাচ্ছে। দূর্বা ঘাসের ঘ্রাণ, মাথার কাছে ফুটে আছে ঘাসফুল। ফড়িংয়ের ঝাক উড়ে গেলো- এলোমেলো। একটা চকচকে নীল ডুমো মাছি নাকের কাছে অনেকক্ষণ ভনভনালো। কোথায় উড়ে গিয়ে ফিরে এলো। কাথার উপরে বসলো,
— আবার জ্বর বাঁধিয়েছ?
— জ্বর কি ছবির ফ্রেম না পুকুরের ঘাট যে বাঁধাবো?

আমার বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না মাছি,
— হাহাহাহাহা… ভনভনানিতে রাগ করছ?

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মাছি কথা শুরু করল,
— ভনভনিয়ে কি খুঁজছিলাম জানো?
— কি!
— পাকা ল্যাংড়া আমের রসের ঘ্রাণ।

বিরক্তির মাত্রা অসহ্যের সীমা অতিক্রম করল,
— আমি কি ল্যাংড়া আম! তোমার তাই মনে হয়! যুক্তিসহ ব্যাখ্যা কর..

মাছির স্বর কিছুটা বিব্রত,
— ধ্যাত, তুমি ল্যাংড়া আম হবে কেন! সেই জ্বর জ্বর দুপুরের কথা একটুও মনে নেই তোমার!
— কোন দুপুরের কথা?
— সেই যে চারদিন আগে তোমার দাদিজান মারা গেছেন। উনার চেহলাম। দুপুরে ক’জনকে খাওয়ানো হবে। মা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে করলাভাজি, পুঁইশাক দিয়ে বড় চিংড়ি, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছেন। রুইমাছের তরকারীতে জিরা ভেজে গুড়ো করে দিয়েছেন। সজনের ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শোক আর ঘ্রাণে উথলে ওঠা দুপুর। নামাজ শেষে মিলাদ, তারপরে খাওয়ানোর পর্ব শুরু হবে। যাদের পাতে দু’বেলা সাদামাটা ভাত জোটে কি জোটে না, এমন ক’জন খাবেন। কি মনে আছে?

বিরক্তি কিছুটা কমে, স্মৃতির ঘায়ে কণ্ঠ কিছুটা কোমল হয়ে আসে,
— হ্যা, মনে আছে। সেসব বহু যুগ আগের স্মৃতি। তুমি এসব জানো?
— জানবো না কেনো! আমিও যে ছিলাম।

বিস্মিত হই,
— নীলমাছি, তুমিও ছিলে?
— হুম। সেদিন তোমার বেশ জ্বর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা মাথায় পানি দিচ্ছেন। জ্বর কমছে বাড়ছে, কিন্তু এক্কেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। ঘরের এক কোণে শুয়ে আছো- গুটিশুটি ছোট্ট মানুষ।
— হুম, গায়ে লেপ। দাদিজানের কাফনের মত শাদা কভার। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ।

নীলমাছি মাথা দোলায়,
— তোমার স্মৃতি দেখছি খুব টনটনে। মেহমানদের জন্য ফল আনা হয়েছে— ল্যাংড়া আম, শক্ত কোষের কাঁঠাল আর তরমুজ। বাবা একটুকুরো আম কেটে তোমার মুখে দিলেন। সেই আমের রস টুপ করে শাদা কাভারে পড়লো।

মনের ভেতর উৎলে উঠে বিষাদ,
— বাবা মারা গেছেন বাইশ বছর হয়ে এলো। সে কথা থাক, তোমার কথাই বলো…

স্মৃতিকাতর মাছি বলে চলে,
— সেদিন গরম আর ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। চিন্তা না করেই লেপের কভারে পড়া দু’তিন ফোঁটা রস খেতে শুরু করলাম। তুমি অবাক হয়ে খাওয়া দেখছিলে।

মাছির ভুল ভাঙাই,
— তোমার খাবার দেখছিলাম না। তোমার নীল শরীরে আলোর ঝিলিমিলি দেখছিলাম।
— খাওয়া শেষে ভাবলাম একটু জিরোই। তুমি অসুস্থ শিশু এক— আমায় কি আর ধরতে পারবে!
— হিসেবে খুব বড় ভুল করেছিলে..

মাছির অকপট স্বীকারোক্তি,
— হ্যা, আত্মঘাতী ভুল করেছিলাম। হঠাৎ মুঠোর ভেতরে ধরে ফেললে। সে কি ভয়! জীবন হারানোর আশঙ্কা ও আতঙ্ক! পায়ে সুতো বেঁধে আমৃত্যু উড়াবে— ভাবতেই বুক ফেঁটে কান্না এলো।
— আহারে! হাহাহাহাহাহাহা…
— হাসছো কেনো! তখন কি জানতাম যে কয়েক মুহূর্ত দেখে ছেড়ে দিবে!

মাথা ব্যথা আর গায়ের তাপ দুইই বাড়ছে, ক্লান্ত স্বরে জানতে চাই,
— আজ সেসব কথা ভনভনাতে এসেছো!

মাছি শোনায় অদ্ভুত কথা,
— রূপকথার অভিশাপে অমরত্ব পেয়েছি। মরে যাই— ফের একজীবনের স্মৃতি নিয়ে জন্মাই। আজ দুপুরে সেই দুপুরের কথা মনে হতেই ছুটে এলাম।

জ্বরের ঘোরে রসিকতা করি,
— নীল মাছির আগমন, শুভেচ্ছায় স্বাগতম। তা কি দেখলে!
— তোমার মুখে এখনো আমের রসের ঘ্রাণ লেগে আছে।
— এখনো ঘ্রাণ লেগে আছে! কত বছর আগের কথা! সময় চলে গেছে কত!
— ধ্যাত! সময় যাবে কোথায়! সময় তার প্রতিটা বিন্দুতে স্থির।

রূপকথার অভিশাপে অভিশপ্ত মাছির কাছে কৌতূহল গোপন করি না,
— ও নীলমাছি, সময় তবে কোথাও যায় না?
— না, যায় না। সময় তার প্রতি বিন্দুতে স্মৃতি সঞ্চয় করে রাখে।
— তবে আমাদের যে বয়স বাড়ে? দিন ফুরোয়?
— বয়স বাড়বে না কেনো বলো! তোমাদের মানুষ হবার কত তাড়া। পায়ের তলায় সর্ষে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু যাওয়া আর যাওয়া।
— সবাই তো যায়, কি যায় না!

নীল মাছির কণ্ঠে বিষাদ ভর করে,
— যেয়ে লাভ কি! সময়বিন্দুকে অতিক্রম করে যেতে যেতে একদিন একেবারে থেমে যাওয়া। থেমে যাবার আগে মনে হওয়া- এই ইঁদুর দৌড়, এই দিনযাপন অর্থহীন… সব অর্থহীন! শুনতে পাওয়া কে যেনো ডাকনাম ধরে ডেকে বলছে, “তোমার না মনসুখিয়া যাবার কথা ছিলো!”

কথা খুঁজে পাই না। নীল মাছি বিজ্ঞের মত বলে,
— এসব কথা থাক। এত ঘনঘন তীব্র মাথাব্যাথা আর গাঢ় জ্বর আসার লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। তুমি কি পুষছো?
— জ্বরের লক্ষণ বিচার পরে করো। ও নীল মাছি, মনসুখিয়ায় কবে যেতে পারবো! ছুঁতে পারবো অভ্রজোনাকের পাখা!

নীল মাছি কোনো উত্তর দেয় না। জ্বর বাড়ছে, তৃষ্ণা তীব্রতর হচ্ছে। ঘরের সিলিং কখন নীলাকাশ হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে কত প্রিয়মুখ। সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আম কাটছেন বাবা, ধবেধবে শাদা পাঞ্জাবী হাওয়ায় উড়ছে যেন মনসুখিয়ার নিশান।

.
নীলমাছি | ২০১৬ | বর্তমানে ‘মনসুখিয়া‘ বইটি আউট অব স্টক।

মনসুখিয়া

abu

১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে– আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম… আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম…।

আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নেভাই। গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই ধমকে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি,
— সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।

বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।’

কথা শেষ হতে না হতেই ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকাল যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠলাম, ঘুঘুবউ ফের ধমক লাগাল-
— হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।

মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না। সিগারেট নিভিয়ে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম,
— বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
— আজ, এবং এখন।
— বাহ! জারী করলেন কে?
— কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।

চলচ্চিত্রে দেখা উকিলের ঢংয়ে জানতে চাইলাম,
— মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
— ২৪ঘণ্টার জন্য।
— মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেন?
— কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিব না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
— বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি,
— ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছ। ভোরেও শুরু করেছো!
— হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।

টিকটিকের স্বরে দার্শনিকতা ভর করে,
— মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….

কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলি-
— সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ টাজ নেই তোমার!
— দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
— বাহ! বাহ। তুমি দেখছি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
— জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,
— কে তোমাকে কষ্ট দিল টিকটিমনি!
— কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছ, মানুষ।
— কখন! কখন কষ্ট দিলাম!

টিকটিকি একটু লেজ নাড়ে, সদা নীতি শিক্ষায় নিয়োজিত মুরুব্বীর স্বরে বলে,
— ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
— এজন্য এতো কষ্ট!
— হু
— কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।

টিকটিকির স্বরে দ্বিধা,
— অর্থহীন! কেনো বলো তো!
— শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
— কি যে বলো! কিছুই বুঝি না।
— কিছু বুঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। একদিন এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠি না, সেখানে জম্মের শেষ।

টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে,
— তাই না কি, মানুষ! তোমার প্যাঁচাল শুনে ঘুম পাচ্ছে।

টিকটিকিকে আর কিছু বলা হয় না। নিজের অজান্তেই ক’টা দীর্ঘতম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দ ছাপিয়ে তারস্বরে করুণ শিস দিয়ে যাচ্ছে দু’টা দোয়েল। কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর বিষাদ তাদের!

৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটা হোক, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।

রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি। তাদেরও হয়তো উস্কানি দিচ্ছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
— ভাই, ওঠেন।
— কোথায় যাব জানেন?
— হ, জানি।

রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, দু’পাশের হুডে গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে। পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে। পাকস্থলীর টানে কামলা ছুটেছে কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভাঙেন,
— কুনুদিন এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
— এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
— কন কি ভাই! আকাল হইব ক্যান!
— অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম। পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা চাবাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।

রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। হাসতে হাসতে বলেন-
— আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইতাছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।

৪.
তুমুল রোদের দিন ছিল সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুননিসার আহ্লাদি স্বর,
— নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
— একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
— এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।

ভিকারুননিসার মুখে অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঁঝাল রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুননিসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দেয়,
— শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুননিসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।
ভিকারুননিসার কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ,
— আমি কি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে বললে!
ভিকারুননিসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে বলে,
— প্রিয় ভিকারুননিসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর চেয়ে দামী উইশ আর কি আছে!
— এটা দামী উইশ!
— অবশ্যই অমূল্য উইশ। কেন অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
— হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হয় তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।

নটর ডেম বলতে শুরু করে-
— প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
— যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
— না, ভিকারুননিসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
— কি যে বলো না, নটরডেম!
— জন্মানোর পর মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবে না- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
— তা তো হতে হবেই।
— ভিকারুননিসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না।
— ধ্যাত! এ কথার অর্থ কি!

নটর ডেম প্রথমে কথা গুছিয়ে নেয়, তারপর ধীর লয়ে বলে চলে,
— জন্মানোর পরই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে পরম উৎসাহে যোগ দেয় আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে। সবাই মিলে সে’ই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেন নাই। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
— একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
— গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
— কি হয়!
— অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারে নাই। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।

গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের চোখে তাকায় ভিকারুননিসা, টেবিলের ওপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
— আমি কেমন মানুষ হব- বলে দাও।
— ভিকারুননিসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পড়লাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মতো মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
— থ্যাংক ইউ নটর ডেম।

কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুননিসা আবেগঘন স্বরে বলে-
— যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেন, তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
— কথায় কথায় মরতে হবে না, মনে রেখ– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর এবং দীর্ঘতম।
— এত্ত কিছু জানি না নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেন কখনোই তোমাকে না হারাই।

হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
— ভিকারুননিসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেক, হারিয়ে যেও না।

পৃথিবীতে আর কোন শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে আছে, দুজনের দৃষ্টি মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না…

৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে খুন করেছিল, তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয় নাই। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুননিসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।

রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবে না, সে চিনে না মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’

কোনো উত্তর পাই না, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চল মন মনসুখিয়ার কাছে
তার গভীরে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’

.
মনসুখিয়া। বর্তমানে বইটি অউট অব স্টক।

না, আমার বলার কিছু ছিলো না

জরুরী প্রয়োজনে পেনসিল আর কাটার কিনতে হবে, স্টেশনারিজ আইটেমের পরিচিত দোকানে ঢুকেছি। কাউন্টারে দাঁড়ানো নতুন সেলসম্যান, এক মাস আগেও তাকে দেখি নাই।

নতুন সেলসম্যানের কাছে এক প্যাকেট পেনসিল আর কাটার চাইলাম, সে অতি দ্রুততার সাথে হাসিমুখে এক প্যাকেট স্টেনসিল পেপার এগিয়ে দিলো।

এমন অবস্থা দেখে তাকে ভেঙে ভেঙে বললাম, প্রথমে এক প্যাকেট পেনসিল দিন, তারপর পেনসিল কাটার, যাকে শার্পেনারও বলে, তা দিন।

সেলসম্যান হাসিমুখে বলল, প্রথমেই বুঝছিলাম আপনে পেন্সিল কাটার চাইছেন, তবু টেনসিল পেপার (স্টেনসিল তার কাছে টেনসিল) দিয়া শিওর হইলাম।

সেলসম্যানের স্মার্টনেসে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনে আগে কোথায় জব করেছেন?

সে হাসিমুখে উত্তর দিলো ‘কেজিবি’তে ছিলাম। গত মাসে এখানে জয়েন করছি।’ সেলসম্যানের উত্তর শুনে যতটা বিস্মিত হলাম, জায়েদ খান হেলিকপ্টার চালিয়ে আমার মাথায় ল্যান্ড করলেও ততটা বিস্মিত হতাম না।

সেলসম্যানের বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছর হবে। এদিকে পরাক্রমশালী রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি বন্ধ হয়ে এফএসবি চালু হয়েছে, সেও প্রায় তিন দশকের বেশী হয়ে এলো। অথচ মেঘমেঘ দুপুরে উপশহরের স্টেশনারিজ স্টোরে কেজিবি’র এক তরুণ স্টাফের মুখোমুখি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি।

ঘোর কাটিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কেজিবি’তে ছিলেন? কিন্তু কেজিবি তো ত্রিশ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

দোকান কাঁপিয়ে হেসে উঠলো সেলসম্যান, হাসতে হাসতে বললো, ভাই, আমাদের কেজিবি মানে কিশোরগঞ্জ ব্রাঞ্চ চালুই তো হইছে চাইর বছর আগে, আপনে এইটা কি কইতাছুন!

না, আমার বলার কিছু ছিলো না।

গত জন্মের স্মৃতি, রঙ বদলের আগের শৈশব

পোয়া মাইল দূরে দোষ লাগা হিজল গাছ, তার আগে নদীর ঘাট, থৈ থৈ রইদ, আব্বাসের চায়ের দোকান, টিনের চালার নিচে আরামের ছায়া, কাহিল কুত্তার মতন ঝিমায় ছুটির দুপুর।

তামচিনির প্লেটে দুইটা গরম জিলাপি, সিরায় চুবচুবা, টেবিলে রাইখা যায় আব্বাসের ছোট পোলা, আব্বায় হাঁক দেয় “আব্বাইসা ডবল পাত্তি মাইরা এক গ্লাস চা, চিনি দিবা কম।”

জিলাপি খাওয়া শেষে হাঁটি, আব্বায় ধইরা রাখে হাত, পোয়া মাইল দূরে আগাছার বাগান, বাগানের শেষ পাড়ে একা হিজল, ডালাপালা ছড়ায়া একাকার, তার আধখানা ছায়া দীঘিতে সুনসান।

বাকী আধখানায় আব্বায় বিছায় চাদর, ব্যাগ থেকা বাইর করে চিনিগুড়া চাউল ভাজা ছাতু, পাওরুটির গুড়া, ঘিয়ের তালানি, সরষার মধু, মিঠাইয়ের গাদ, আর গোপন তত্ত্বে বানানো কালচা চাড়।

মৌন দরবেশ এক বানায় অনারোগ্য রোগের নিদান, টোপে মিলায় পিপড়ার বসত ভাঙা ডিম, কে জানে ওই ডিমে লাইগা আছে কোন অভিশাপ, দূর থেকা আড়চোখে আমাদের দেখে দুইটা গুই সাপ।

ছয় কাটা বড়শিতে অব্যর্থ রসুন টোপ, রুই মাছ ধরা হবে আজ, দোষ লাগা গাছের কাছে আসে না কেউ, আব্বার পিঠ ঘেইষা বইসা থাকি নিশ্চুপ, ফাতনায় দোল খায় ঘোর লাগা ঢেউ।

ডাঙ্গায় থাইকা মাছের লগে যুদ্ধ চলে না, টোপ গিলার পর শুরু হইবো হয়রানির খেলা, হিজলের ডালে একটা গিরগিটি রঙ বদলানো ভুইলা দেইখা যায় সব, এসব গত জন্মের স্মৃতি, রঙ বদলের আগের শৈশব।

০৬০৭২৩

কোনো কান্নাই চিরস্থায়ী নয়

আর ক’টা সিঁড়ি পেরুলেই ছাদ। ছাদে থৈ থৈ জোছনা। হঠাৎ থামতে হলো। পেয়ারা গাছের ব্যারিকেড ভেঙে ছলকে আসছে এক টুকরো আলো।

ছলকে আসা আলোর রেখাপথে ঝিকমিক করছে অতি মিহি সুতো, অথবা চোখের ভুল। খুব সাবধানে কাছাকাছি যেতে ভুল ভাঙলো। ছোট্ট এক মাকড়সা জাল পাতছে।

একটা ধাপ উঠলেই জালটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আমার প্রবল arachnophobia বা মাকড়সাভীতি আছে। তবে এমন ছোট মাকড়সা ভীতি জাগায় না, এই জাল অনায়াসে ছিন্নভিন্ন করে যেতে পারি।

কি যে হলো, জোছনা দেখার পরিবর্তে ছোট্ট মাকড়সার জাল বুনন দেখতে শুরু করলাম। জাল তার আশ্রয়, খাদ্য সংগ্রহের ফাঁদ, বিশ্রামের ঘর।

সেও কখনো সখনো হয় তো আশ্রয় হারায়, ক্ষুধায় কাতর হয়। নতুন ঘর বাঁধতে ক্লান্ত শরীরে আবার জাল বুনতে শুরু করে।

জাল ছিড়ে ছাদে যেতে ইচ্ছে করলো না। ওর রাত ভালো কাটুক। পথ ভুলে দুই একটা ছোট পোকা ওর ফাঁদে আটকে যাক। পোকাদের সংসারে কান্নার রোল উঠুক।

পৃথিবীতে কোনো কান্নাই চিরস্থায়ী নয়। বিচ্ছেদ দিগন্তে যায়, বিরহ তত দীর্ঘ নয়।

.
০৫০৭২৩

রোজা আফজা

index-1

এমন বৈশাখ কে দেখেছে আগে! দুপুরে গরম প্রকট, রাতে বিপরীত। মফস্বল শহরের নদী সংলগ্ন এক পাড়ায় নির্জন দোতলার ছাদে দাঁড়াই, মাঝরাত, চারদিকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুমন্ত বাড়িঘর। অল্প ক’টা বাড়ির বাইরে লাগানো বাল্ব থেকে আলোর বিচ্ছুরণ- নিস্তেজ, দুর্বল। জলরঙের কম্পোজিশনের মত আলো মিশে যাচ্ছে বৃহত্তর অন্ধকারে। চারদিকে নিভু নিভু সিগারেটের ধোঁয়ার মত ছোপ ছোপ কুয়াশা। নদীর সকল বিষাদ বাষ্পীভূত হয়ে মিশছে হাওয়ায়, তাই হাওয়া নৈরাশ্যের মত শীতল।

হঠাৎ একরাশ ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়, ছাদের টবে টবে লাগানো গাছের পাতারা খসখসিয়ে ওঠে। নিরাপদ খাঁচা হতে পোষা কবুতরগুলো ডেকে উঠে, দু’মিনিট পরই থেমে যায়। কে যেনো ক্যানকেনে স্বরে প্রশ্ন করলো,
– ওই লোকটাকে মনে আছে, মানুষ?
চোখ গেলো কিছুদিন আগে টিনের ড্রামে লাগানো পেঁপে গাছের পিছনে। ওখানে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকনাটা, ওই আবার জানতে চাইলো,
– ও মানুষ, ওই লোকটার কথা তোমার মনে আছে?
কৌতূহল গোপন করে খুব স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করলাম,
– কোন লোকটা?
– ওই যে পুরান ঢাকায়, বহু দিন আগে, তখন তোমার বয়স অনেক কম, তখন যে লোকটা আসতো ওই লোকটাকে মনে আছে?
অর্থহীন কথায় বেশ রাগ হয়, রাগটা ধীরে ধীরে কমেও যায়। কথা প্যাঁচালে রাগের সাথে যোগ হয় বিরক্তি, রাগ কমলেও বিরক্তি কমে না। বিরক্তি গোপন করলাম না,
– হয় স্পষ্ট করে বলো নয়তো এক্কেবারে চুপ থাকো। বিরক্ত করো না তো।
– বিরক্ত করছি না তো। ওই যে লোকটা মাঝরাতে আসতো, তার এক হাতে আমার মত টিনের ঢাকনা আর অন্য হাতে চিকন লাটি। লাটি দিয়ে হালকা করে ঢাকনায় ক’টা টোকা দিত, টিনের শব্দ থামলে সুর করে বলতো, “ওঠঠোওওও… জাগগোওওও.. রোজদারো.. ইনসানো ওঠঠোওওও। সেহরি খানেওয়ালা.. রোজা রাখনে ওয়ালা… নামাজ পড়নেওয়ালা.. যাকাত দেনেওয়ালাআআআ ওঠঠোওওও… জাগগোওওও…।”

২.
চোখের পলকে মফস্বলের ছাদটা রূপান্তরিত হয় পুরান ঢাকার এক বাড়ির ছাদে। ছাদের পূর্ব দিকে একটা মাত্র ঘর, মাঝরাতে ঘরের জানলা দিয়ে দক্ষিণ দিকের রাস্তায় তাকিয়ে আছে ক্লাশ এইট, অপেক্ষা করছে কখন আসবে ওই লোকটা। মোড়ে দাঁড়াবে, টিনের ঢাকনায় তিন চারটা বাড়ি দিবে, তাতে বিশ্রী আওয়াজ না হয়ে কেমন সুরেলা আওয়াজ হবে, যেনো বিলম্বিত দাদরা তালে বাজছে বাদ্যযন্ত্র, এরপর সুর করে বলবে, “ওঠঠোওওও.. রোজদারো.. ইনসানো…ওঠঠোওওও। সেহরি খানেওয়ালা.. রোজা রাখনে ওয়ালা… নামাজ পড়নেওয়ালা.. যাকাত দেনেওয়ালাআআআ ওঠঠোওওও… জাগগোওওও…।” এই লোকটা হেটে একটু সামনে যাবে, দাঁড়িয়ে টিন বাজাবে এবং সেহেরি খাওয়ার জন্য জাগার আহ্বান জানাবে, আবার সামনে যাবে। কতদূর সে যাবে জানা নেই।

লোকটার একটা চোখ অন্ধ, অবস্থাও দরিদ্র, অথচ কণ্ঠে হাহাকার নেই। সময় জুড়ে রোজা রাখার আহ্বানের কোমল তৃপ্তি ছড়িয়ে যেতে যেতে তার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসবে। আর, তখনই স্পষ্ট শোনা যাবে নিচতলায় মা জেগে রান্নাঘরের দরজা খুলেছেন, ভাত রান্না করছেন। কিছুক্ষণ পর তরকারি গরম করবেন, হাওয়ায় ভাসবে সুবাস। আশপাশের বাড়ি থেকেও আসবে রান্নাঘরের শব্দ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জেগে উঠবে সবাই। বাড়ির ছাদে ছাদে বাচ্চারা রেলিং ধরে দাঁড়াবে, রাস্তায় টিউব লাইটের আলোয় কখন ফুটে উঠবে হ্যাজাকবাতির আলোর আভাসের তার অপেক্ষায়। এরপর হ্যাজাকের আলো সামনে এগিয়ে আসবে, সাথে কাসিদা দলের গান, “নীলাকাশে চাঁদ উঠেছে ওঠো মোমিন মুসলমান/রোজা রাখো নামাজ পড়ো আখেরাতে পাবে দান”, এই গানের শেষে শুরু হবে “হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়/সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায় —/সে যে আমার কমলিওয়ালা — কমলিওয়ালা।।”

এরই ফাঁকে মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিন ঘোষণা দিবেন, “প্রিয় রোজদার ভাই ও বোনেরা, সেহেরি খেয়ে নিন। সেহেরির সময় শেষ হতে আর এক ঘণ্টা বাকী।” টিনের ঢাকনায় আওয়াজ, কাসিদার গান, মুয়াজ্জিনের ঘোষণা- এসবে রাতের নির্জনতার ছন্দপতন ঘটবে না, এসব বাঙালির রমজানের মধ্য রাতের চিরায়ত অনুষঙ্গ।

ক্লাশ এইট নিচে নেমে আসতেই মা তরকারির বাটি হাতে দিয়ে বলবেন, “এটা শরফু দাদাকে আর এই বাটিটা ফুপুআম্মাকে দিয়ে আসো।” পাড়াতো দাদা, বয়স্ক মানুষ, অবস্থা স্বচ্ছল নয়। এমন আরও কিছু পরিবারকে মা, চাচী এবং প্রতিবেশীরা মিলে ঠিক করে নিতেন কবে কে তোফা পাঠাবেন। এই তোফাকে যেনো দান মনে না হয়, কেউ যেনো একক কৃতিত্ব দাবি করতে না পারে, তাই ওমন ব্যবস্থা। নীরবে প্রতিযোগিতাও চলতো, তোফা মানে উপহারের খাবারটা যেনো ভালো হয়, মাছ বা মাংসের টুকরোটা যেনো বড় হয়, আর রান্নাটা যেনো খুব স্বাদের হয়। ফুপু আম্মার বাসা থেকে আরেক বাটি তোফা নিয়ে ফিরতে হতো। পাড়াতো দাদাও তোফা দিতেন, দুটো খেজুর বা আম বা কলা জোড় করে ধরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, “খাইতে খাইতে বাড়িতে যাও, ভাই।”

ক্লাশ এইটের মনে পড়ে সুবীরদের কথা। সুবীরের মা মানে মাসিমা একবার মা’কে বলেছিলেন,
– আপা, আপনারা যে রাতে জেগে উঠেন, সেহরি খান, দেখতে খুব ভালো লাগে। খাবারের ঘ্রাণও খুব ভালো লাগে।
এমনিতে মা প্রায়ই খাবার পাঠাতেন, মাসিমা পাঠাতেন নারকেলের নাড়ু আর আনারসের চাটনি। মাঝে মাঝে নিরামিষ আর লুচি। তবু মা জানতে চাইলেন,
– তোমাকে সেহরি পাঠালে খাবে! ধর্মের বাঁধা নেই তো!
– না, আপা।
এরপর প্রায়ই মাসিমা’কে সেহরির সময় খাবার পৌছে দিতে হত। মা দুটো টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার গুছিয়ে দিতেন, অন্তত চারজন মানুষের তিনবেলা যেনো হয়ে যায়। ক্লাশ এইট জানতো তখন সুবীরদের খুব খারাপ দিন চলছে, এজন্যই মা সেহরির নামে তিন বেলার খাবারই পাঠাচ্ছেন। মাসিমা যেনো বিব্রত না হন তাই বলেছেন, সেহরি অল্প করে দেওয়ার রেওয়াজ নেই।

৩.
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ড্রামে লাগানো পেঁপে গাছের পাতা, বলে,
– তোমার এত কিছু মনে আছে, মানুষ?
এ কথায় ক্লাশ এইট ফিরে আসে মাঝ বয়সে, বলে,
– অনেক কিছুই মনে নেই।
– যেমন?
– ঘরে ফিরে দেখতাম মা শীতল পাটি বিছিয়েছেন। সবাই মিলে একসাথে সেহরি খেতে বসতাম। খাওয়ার ফাঁকে..
– খাওয়ার ফাঁকে কি?
– বাবা নিজের পাত থেকে মাংস বা মাছের টুকরো ভাইবোনদের পাতে তুলে দিতেন, একেক দিন একেক জনের পাতে।
পেঁপে গাছের পাতা খসখসে স্বরে বলে,
– এই যে মনে আছে!
– স্মৃতিটা মনে আছে সত্য, কিন্তু বহুদিন হয় বাবার গায়ের ঘ্রাণটা ভুলে গেছি।
– ওহ। তোমাকে কষ্ট দিলাম, মানুষ!
হাওয়ায় মিশে যায় দীর্ঘশ্বাস,
– না, কষ্ট নয়, বিষাদ। জানো, বাবা ডানহিল সিগারেট খেতেন।
– সিগারেট খাওয়া মোটেও ভালো কথা নয়, হু।
– ওই সময়ে কি আর এসব বুঝতাম! ডানহিলের গাঢ় লাল রঙের প্যাকেট, তাতে সোনালী বর্ডার- খুব প্রিয় ছিলো। প্যাকেটগুলো জমাতাম। যখন ক্লাশ এইটে, তখন বাবার ছোট্ট কারখানায় আগুন লাগলো। সব পুড়ে গেলো।
– তারপর!
– বাবা কেমন যেনো হয়ে গেলেন! ডানহিলের পরিবর্তে সস্তা স্টার সিগারেট খেতে শুরু করলেন। হাসি গেলো কমে, খেতে আর খাওয়াতে ভালবাসতেন। কষ্ট হলেও খাওয়ানোর রেওয়াজটা ধরে রাখলেন, কিন্তু খাওয়ার অভ্যাস অনেকটাই ত্যাগ করলেন।
হাওয়ায় দোল খায় পেঁপে পাতা, খাঁচার ভেতর বিষাদের মত ডেকে ওঠে এক জোড়া কবুতর,
– জানি… আমরা জানি.. আমাদের আগের জন্মের স্মৃতি.. আমাদের আগের জন্মের সব স্মৃতি..
– মানে?
– খুব সহজ, মানুষ। তোমার বাবা কিছুই বুঝতে দেননি কোথায় পুড়েছে কতটা। কে করেছে বিশ্বাসঘাতকতা আর কে লাগিয়েছে আগুন। নিজে পুড়েছেন প্রত্যহ।
– সত্যিই তাই।
– তিনি সবটাই নীরবে সয়েছেন, সবার চাওয়া পূরণ করেছেন সাধ্যমত। কারো প্রতি ছিলো না অভিযোগ।
– হ্যা।
একটা কবুতর প্রশ্ন করে,
– আমাদের এই জন্মে তুমিও কি ক্রমশ তোমার বাবার মত হয়ে উঠছো, মানুষ?
– কি জানি, জানিনা তো।
– তোমারও দেখি কি নিজের জন্য সময় নেই?

এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, উত্তর জানাও নেই। খোলা ছাদে মাঝ বয়সের মানুষটা আবার ফিরে যায় ক্লাশ এইটে। সেহরি খাওয়ার পর সবাই মিলে চা খাওয়া হচ্ছে। বাবা বহু দিন আগের ওই ছাদে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে নাড়াচাড়া করছেন, কিন্তু ধরাচ্ছেন না। ক্লাশ এইট জানে চা’য়ে শেষ চুমুক দিয়ে বাবা সিগারেটটা প্যাকেটে ভরে রেখে দিবেন, এই মাসটায় চেন স্মোকার বাবা সিগারেটে একটা টানও দিবেন না।

সেহরির সময় শেষ হয়ে আসে। মুয়াজ্জিন জানান, “আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকী, সেহরি খাওয়ার সময় শেষ হতে আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকী।” কাসিদার গান আবার ক্ষীণ থেকে স্পষ্ট হয়ে আসে। এবার তারা ফিরতি পথে যাচ্ছে, দলের মধ্যে সবচাইতে সুরেলা কণ্ঠ যার, সে আকুল হয়ে গায়, “এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল/মিঠা নদীর পানি…” বাকীরা পরের লাইনে কোরাস ধরে, “খোদা..তোমার মেহেরবানী/খোদা..তোমার মেহেরবানী।”

সেহরির সময় শেষ হওয়ার পর মসজিদের অল্পবয়সী মুয়াজ্জিন পৃথিবীর সকল প্রেম কণ্ঠে ধারণ করে গাইতে শুরু করে,
“খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই প’ড়ে
ছেড়ে’ মস্‌জিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধ’রে।।
দুনিয়াদারির শেষে আমার নামাজ রোজার বদ্‌লাতে
চাইনে বেহেশ্‌ত্‌ খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত ক’রে।।”

মহল্লায় একটা সতেজ আলস্য নেমে আসে, কেউই যেনো নামাজ রোজার পুরস্কার স্বরূপ বেহশত চায় না, পরম করুণাময়ের প্রেমে বেহুশ হয়ে থাকাতেই সবার পরমানন্দ। মুয়াজ্জিনের গান থেমে যায়, আবেশ থাকে অনেকটা সময়, এরপর আজান, খাইরুন মিনান নাউম.. খাইরুন মিনান নাউম…। একটা নতুন দিনের শুরু।

৪.
প্রতিদিন সকালে নিকোলাস স্যারের কাছে ক্লাশ এইটের কোচিং থাকে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মী বাজারের এক গলির ভেতর কোচিং সেন্টার। ওই বাড়ির মালিক ছিলেন সংগীত বিশারদ সমর দাস। ক্লাশ এইট সময়ের আগেই কোচিংয়ে পৌছাতো, বাড়ির ভেতর থেকে গ্রান্ড পিয়ানোতে ভেসে আসতো মনভুলানো সুর। প্রায়ই পিয়ানো বাজিয়ে কেউ গাইতো, “আ..নন্দলোওওওকে মঙ্গলালোওকে বিরাজও..ও..ও সত্য সুন্দরও…।”

কোচিংয়ে পালা করে প্রথম ক্লাশ নিতেন হাকিম স্যার আর অর্জুন স্যার। অর্জুন স্যার ক্লাশে ঢুকেই বলতেন,
– কারা কারা রোজা আছো হাত তুলো।
যারা হাত তুলতো তাদের দুই পিরিয়ড পর ছুটি দিয়ে বলতেন,
– সোজা বাসায় চইলা যাইবা। এবাদতের ফাঁকে পড়া শেষ করবা।

হাকিম স্যার বেশী সময় ধরে ক্লাশ নিতেন। কেউ উশখুশ করলে বলতেন, বেশীক্ষণ ক্লাশ করলে তোমাগো ক্ষিধায় ধরবো না। আরামে রোজা করতে পারবা। অর্জুন স্যার আগে ছুটি দিলে ক্লাশ এইট একা একাই ঘুরে বেড়ায়, রাস্তার দুইপাশে দেখার কতকিছু। মাঝে মাঝে সদরঘাটের লিয়াকত এভিনিউর দোকানগুলো থেকে গল্পের বই ভাড়া নিয়ে বাসায় ফিরে। বই পড়ার মাঝেই বাড়ির প্রয়োজনে বাজারে আর মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাওয়া হয়। ফিরে আবার বইয়ে ডুব।

আসরের নামাজ আদায় করেই মা ব্যস্ত হন ইফতার তৈরী করতে। রমজান মাসে তার উপর খুব চাপ যায়। প্রতিদিনই দুই তিনজন প্রতিবেশীকে ইফতার পাঠানো হয়। মা’র ক্লান্তি নেই। রোজা রেখেও এ মাসে অন্তত দু’দিন নির্ঘুম কাজ করতে হবে তাকে, একদিন সকল প্রতিবেশীর বাড়িতে ইফতার যাবে, অন্যদিন মসজিদের ইমাম ও মুসুল্লিদের জন্য। এত কাজের পরও মা’র চেহারায় খেলা করে অপার সুখ ও তৃপ্তির আভা। ক্লাশ এইট বইয়ে মগ্ন হয়ে থাকে, মাঝে মাঝে রান্নাঘরে মায়ের আশপাশ দিয়ে ঘুরে আসে। মায়ের ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে, মায়ের ঘ্রাণ মন ভরে নিলেও রোজা ভাঙেনা।

সময় গড়ায়। ক্লাশ এইটের ঘোর ভাঙে আসরের নামাজের বহু পরে, নাসির চাচার সুরেলা চিৎকারে, “এইইইইই পাহাইড়া বরফ…. এইইইইই পাহাইড়া বরফ…এইইইই…।” কাঠের কুড়ো দিয়ে ঢাকা বরফের পাটা, গাঢ় খয়েরি রঙয়ের কাঠের কুড়োর দুই একটা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুধ সাদা বরফ। কি যে সুন্দর! ঘরে ফ্রিজ আছে, এরপরও পাহাইড়া বরফ কেনা চাই। ক্লাশ এইট জানে এ বরফের জন্ম কোনো এক কারাখানায়, এ বরফ পাহাড় থেকে আসা নয়। তবু ভাবতে ইচ্ছে করে, বহুদূরের কোনো পাহাড় থেকে কেউ একজন বরফগুলো নিয়ে এনেছে, শুধু পানি নয়, গলে যেতে হবে জেনেও পানির সাথে পাহাড়ের সহস্র স্মৃতি জমাট বেঁধে জন্ম নিয়েছে এ বরফ, শীতল শুভ্র বরফ।

মফস্বলে রাত গভীর হয় দ্রুত। খোলা ছাদে স্মৃতিকাতর মাঝবয়সী মানুষের ভাবনায় সুর মিলায় রাতের হাওয়া, ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমি সেই পাহাড়ের কথা জানি, মানুষ। আমি সেই পাহাড়টা চিনি।
– তাই! কোথায় সেই পাহাড়?
– বহুদূর। বহু… বহু… দূর।
মানুষ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,
– আমাকে ওই পাহাড়ের কাছে নিয়ে যাবে, প্রিয় হাওয়া?
হাওয়ার স্বর করুণ হয়ে আসে,
– ওই পাহাড় ডাক পাঠালে তবেই যাওয়া যায়, এর আগে নয়।
– ও তুমি মনসুখিয়ার চিরশুভ্র চিরশীতল পাহাড়ের কথা বলছো!
– হ্যা, মানুষ। আমি ওই পাহাড়ের কথাই বলছি। আমি ওখান থেকেই মাঝে মাঝে আসি, তোমায় দেখি, আবার ফিরে যাই।
মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠে,
– প্রিয় হাওয়া, তুমি মনসুখিয়ার পাহাড়কে বোলো, সে যেনো ডাকে আমায়। তাকে আরও বোলো জমাটবাধা বরফ যেমন উত্তাপে গলে যায়, আমিও প্রতিনিয়ত গলে যাচ্ছি, দ্রুত.. খুব দ্রুত।
হাওয়া কিছুই বলে না। পেঁপে গাছের পাতা, তেলের ড্রামের ঢাকনা, খাঁচার ভিতর কবুতরগুলো নিরব হয়ে থাকে, শুধু রাতের একটা তারা জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে এত দ্রুত গলতেই হবে, এ তোমার কেমন নেশা মানুষ!” উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না, যে গলে যাচ্ছে তার কাছে এসব প্রশ্ন ও উত্তরের কোনো অর্থ নেই।

ডায়নোসরের মাংস

আহা রে ধনী হওয়ার কষ্ট! শুক্রবার সকাল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কাঁচাবাজারে প্রচুর ভিড় হয়। অভিজাত ধনীরাও এই দিনটাতে কেনকাটা করতে বাজারে যায়। প্রাণ খুলে দুই হাতে বাজার করে। তাদের বাজার করাটা সবাই দেখে। হিংসা করে। কিন্তু পছন্দের জিনিস কেনার জন্য ধনীদের সংগ্রামটা অনুভব করে না। এই যেমন তহুরা বিবি আজ আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে নিজে ডায়নোসরের মাংস কিনতে বাজারে এসেছিলেন।

বাজারে ভিতরে কয়েক সারি মাংসের দোকান। দোকানগুলিতে থরে থরে মাংস সাজানো, লোহার সিকের আংটায় ঝুলছে টুকরো টুকরো মাংস। তহুরা বিবি পৃথিবীর সবচে দামী মাংস, অর্থাৎ ডায়নোসরের মাংস কিনবেন। তিনি ধনী মানুষ, ঘুম থেকে জাগলেই তার মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। প্রতিদিনই ধনী হয়ে ওঠেন। একজন আদর্শ ধনী হিসেবে সাপ্তাহিক ছুটি উদযাপনে ডায়নোসরের মাংস ছাড়া তিনি আর কি’ই বা খেতে পারেন!

আমি তহুরা বিবির তুলনায় কম ধনী। প্রতি সপ্তাহে ডায়নোসরের মাংস কেনার সামর্থ্য নাই। খুব বেশী হলে মাসে অন্তত একবার কিনতে পারি। কিন্তু বৃটেনের মানুষ টমেটো কিনতে হিমশিম খাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ দু’বেলা খাবার যোগাতে পশুর মত লড়ছে, অস্ট্রেলিয়ায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলো পান্তা ভাতে নুন পর্যন্ত যোগাতে পারছে না, তখন ডায়নোসরের মাংস খাওয়া অমানবিক বলে মনে করি। শতবার চেষ্টা করলে এতটা অমানবিক হতে পারব না।

গোরু, খাসি আর মুরগির সস্তা দামের নিম্নমানের মাংস হল গখাদ্য। গখাদ্য মানে গোখাদ্য নয়, গরীবের খাদ্য। এসব মাংস কিনলে আমার মত ধনীর মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। রুচি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। কেও কেও টিপ্পনি কেটে বলবে, “লাখ টাকার কাঁথায় শুয়ে দশ টাকার স্বপ্ন দেখা! ছি:. ছি:. ছি।” তাই ডায়নোসরের তুলনায় সস্তা কিন্তু গখাদ্যের তুলনায় দামী ম্যামথ হাতির মাংস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্ষুধাকাতর বিশ্বে একমাত্র আমাদের বাজারগুলিই ব্যতিক্রম, লক্ষ লক্ষ বছর আগের প্রাণীর মাংসেও স্বয়ংসম্পূর্ণ।

দেরী করে বাজারে আসার কারণেই হয় তো হাতির মাংস পেলাম না। সোবহান কসাই বলল, “সরকারপন্থী মিডিয়া হাউজগুলি ভাবমূর্তির দামে হাতির মাংস কিনে নিচ্ছে। তাই ব্রেকিং নিউজে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও খালি চোখে মাংস দেখা যাচ্ছে না।”

হাতির পরিবর্তে প্রাগৈতিহাসিক কালের দাঁতাল বাঘের মাংস কিনব কি নেহারি খাওয়ার জন্য দাঁত কিনব সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। তখনই কাজের বুয়া তহুরা বিবির সাথে দেখা হল। সাধারণ কুশল বিনিময়ের পর বললেন, “ডায়নোসরের মাংস কিনতে এসেছিলাম। কোনো দোকানে টিরানোসরাসের মাংসও পেলাম না।”

তহুরা বিবির চেহারায় গভীর ক্লান্তি আর বিষন্নতার ছাপ। তার দুর্দশা দেখে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলাম। আনন্দে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। ধনীদের দুর্বিপাকে আনন্দ অনুভব করা গরীবদের সহজাত অভ্যাস, তাই বলে এতটা গরীব হই নাই যে হাসির স্তর পর্যন্ত নামব। তিনি আরও জানালেন, মাছবাজারে তিমি বা হাঙর মাছ নেই। অন্যসব মাছের সাথে তেলেপিয়া ও পাঙ্গাসের দাম এত কমেছে যে একমাত্র গরীব ছাড়া কারো পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।

তহুরা বিবি দীর্ঘশ্বাসের সাথে “ধনীরা কি খেয়ে বাঁচবে!” বলার পর প্রস্তাব দিলাম, “তবে মুরগী পট্টিতে যাওয়া যাক।” ধনী হবার পরও, পকেট ভর্তি টাকা আর পাকস্থলী ভর্তি উন্নয়ন থাকার পরও, শুধু ছুটির দিন উদযাপনের স্বার্থে দু’জন বড়লোক মিলে মুরগি পট্টিতে যাই। ব্রয়লারের দাম এত কমেছে যে কিনতে রুচি হয় না। দু’জন মিলে ভাগা হিসাবে সাজানো ডায়নোসরের পায়ের মত দেখতে ব্রয়লার মুরগির ঠ্যাং কিনি, হাতির মাংসের পরিবর্তে ব্রয়লারের গিলা-কলিজা কিনি।

বাজার শেষে বাসায় ফেরার পথে আমরা দু’জন ঐক্যমত পোষণ করি যে, দেশটা স্বল্পসংখ্যক গরীবের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে৷ দয়ায় টইটুম্বুর সরকার শুধু গরীব শাবকদের স্বার্থই রক্ষা করছে। অথচ ধনীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অঢেল প্রাচুর্য, প্রতিদিন বেড়ে যাওয়া মাথাপিছু আয়, দু’হাত খুলে বাজার করা আর রাজকীয় বিলাসিতায় মগ্ন ধনীদের বসবাসের জন্য দেশটা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে।

বিশ্রাম

ক’দিন ধরেই মা’র জ্বর। সারাদিন জ্বরকে সামাল দেন, রাতে হেরে যান। শরীরের তাপ বাড়ে। বিছনায় নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন। চোখ সামান্য খোলা, চোখের মণি মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে ওঠে। কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোন। না, ঘুমোন না। মা ঘুম আর জাগরণের মাঝে পেণ্ডুলামের মত দোল খান। দোল খেতে খেতে মাঝে মাঝে কুঁকড়ে ওঠেন, অস্ফুট স্বরে বলেন,
– মাহমুদা, পা’টা একটু টিপে দেরে মা..

মাহমুদা নেই। জ্বরের ঘোরে মা ভুলে যান। অভাবের সংসারে কেইবা থাকে! যতদিন সে ছিল মেয়ের মত হয়েই ছিল। মায়ের ভুল ভাঙাই না। মাহমুদা হয়ে পা টিপে দেই। মাথায় বিলি কাটি। ফিডিং কাপে করে পানি খাওয়াই। ওষুধ খাওয়াই। জ্বরের ঘোরেই তিনি জানতে চান,
– রোকন ফিরেছে! খেয়েছিস তোরা!

মাহমুদা হয়েই ছোট করে উত্তর দেই,
– হু।

ভোর হয়। মা জেগে ওঠেন, কিছুটা অপরাধীর মত করে বলেন,
– আজও জেগে ছিলি!
– হ্যা, তুমি আরেকটু ঘুমাও না হয়।

ঘুমের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মা বলেন,
– রোকন, মাহমুদাকে কোনোভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না!

কোনো উত্তর দেই না। মা জেগে উঠেন, আমার চোখে ঘুম নেমে আসে। রাতজাগার কারণে ঘুম গাঢ় হয়ে আসার কথা, আসেনা। ঘোর ঘোর ঘুমে শুধু চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে, মন জেগে থাকে। ওই ঘুমের মাঝেই ক’দিন ধরে একটা গল্প আসছে। লাইনের পর লাইন লিখছি, কাটাছেড়া করছি প্যারাগ্রাফ ঠিক করছি। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর গল্পটা আর মনে থাকে না।

দুপুরে মায়ের সাথে খেতে বসি। মা জিজ্ঞেস করেন,
– ছুটি শেষ হতে আর ক’দিন বাকী?
– ১১ দিনের মত।
– ও।

আমার পাতে একটুকরো তেলেপিয়া মাছ তুলে দিতে দিতে অনুনয়ের স্বরে বলেন,
– আমাকে ক’দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবি! ক’টা দিন থাকবো, বিশ্রাম নিবো। মনটা খুব টানছে।
– এই বর্ষায় যাবে? চারদিকে পানি আর পানি…

মা কিছু বলেন না। হঠাৎ করেই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়, স্বপ্নে লেখা গল্পটার প্রথম লাইন ছিলো ‘চারদিকে পানি আর পানি..।’ প্রতিটা লাইন এখন একের পর এক মনে পড়ছে। দ্রুত খেয়ে উঠে পরি। টেবিলে বসে লিখতে শুরু করি, ‘চারদিকে পানি আর পানি। অথৈ স্রোতের ঘূর্ণি…।’ লেখা চলছে তরতরিয়ে।

মা টেবিলে চা রেখে গিয়েছিলেন। খেয়াল করিনি। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মাথার ভেতর গল্পের অলিখিত অংশটা ভরে নিয়ে রান্নাঘরে যাই। নতুন করে চা রান্না করি। দুটো কাপে ঢালি। মা’র ঘরে যাই। মা ঘুমোচ্ছেন। শেষ বিকেলের নরম আলোর আভায় মা’র চেহারায় কোমল জ্যোতি, মায়ামায়া। চা খাওয়ার জন্য মা’র ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনা।

কোনো শব্দ না করেই কিছুক্ষণ পা টিপি। এরপর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বুঝতে পারি গল্পটা আর লেখা হবেনা। মাকে নিয়ে গ্রামে যেতে হবে। চারদিকে পানি আর পানি, এর মাঝে একখণ্ড শুকনো জমিতে মা’কে রেখে আসতে হবে, মা থাকবেন, মায়ের এখন অথৈ বিশ্রাম।

.
#বিশ্রাম
১০০৮২০২০

নব টোনাটুনি

index

এক ছিলো টোনা আর এক ছিলো টুনি। একদিন টোনা আহ্লাদ করে টুনিকে বলে,
— টুনি, ও টুনিইই..

টুনি হাই তুলে,
— হ্যা, বলো।
— আমার খুব ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে।

টুনি রাগে চোখ পাকায়,
— তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে!
— পিঠা, ভাপা পিঠা।
— তোমার সুগার লেভেল হাই। শরীরে চর্বি জমছে। ফ্যাটি লিভার। আর ডায়েট না করে তুমি ভাপা পিঠা খেতে চাইছো! হাও সিলি!!

টোনার মন খুব খারাপ হলো। চোখে পানি চলে এলো। টুনিকে কান্নাভেজা স্বরে বলে,
— তোমার চটপটি খেতে ইচ্ছে হলো, বৃষ্টির মধ্যে আমি গিয়ে ননভেজ চটপটি কিনে আনিনি! তোমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে হলো, তোমাকে কানিবগের ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টে নিয়ে চিকেন ফুচকা খাওয়াইনি! আর আজ আমি সামান্য দুটো ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছি বলে.. তুমি এভাবে..

“এক্কেবারে ঢং করবে না” বলে টুনি ধমকে উঠে। এরপর ঠোঁটে পায়ের নোখ কাটতে কাটতে বলে,
— জানু, ভাপা পিঠা খাবে বললেই তো বানানো যায়না। এর জন্য জিনিসপত্র লাগে। তুমি ঢং না করে জিনিসপত্র এনে দাও, ভাপা পিঠা বানিয়ে দিচ্ছি।

টোনার মনে খুব আনন্দ হয়। পাখায় চোখ মুছে বলে,
— কি কি জিনিসিপত্র লাগবে, সোনামনু?
— চালের গুড়ি লাগবে। গুড় লাগবে, মাওয়া লাগবে, নারকেল লাগবে। মাটির ঢাকনা লাগবে, ওই ঢাকনা বসানোর জন্য হাড়ি লাগবে, গ্যাস সিলিন্ডার লাগবে আর আমার মোবাইলে পাঁচ জিবি ডাটা লাগবে।

টোনা অবাক,
— ভাপা পিঠা বানাতে ৫জিবি ইন্টারনেট ডাটাও লাগবে!
— হ্যা, লাগবে। বেশী কথা না বলে এখনি বাজারে যাও।

টোনা বাজারে গিয়ে চালের গুড়ি, গুড়, মাওয়া, নারকেল, মাঝখানে ফুটো করা মাটির ঢাকনা, ঢাকনা বসানোর হাড়ি কিনে। বাজারের বাইরে এসে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার কিনে। টুনির মোবাইলে ৫জিবি ডাটা ভরে, সব নিয়ে বাসায় ফিরে।

টোনার মনে খুব সুখ — আজ ভাপা পিঠা খাবে। ওইদিকে টুনি ইউটিউবে ঢুকে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। বারবার আসছে শুধু নুডলসের রেসিপি। নুডলসের খিচুরি, নুডলসের চাটনি, নুডলসের পুড় দেওয়া বেগুনের স্যান্ডুউচ। স্ক্রল করতে করতে নুডুলস দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর একটা রেসিপিও পেয়ে গেলো। ভিডিওটা খুলতেই মনে পড়লো ঘরে নুডলস নেই। এখন টোনাকে নুডুলস আনার কথাও বলা যাবে না। খুব রাগ করবে। ভাববে টুনি ভাপা পিঠা না বানানোর বাহানা করছে। টুনি আবার চালের গুড়ি দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজতে শুরু করে। কথায় বলে, যেখানে মাহফুজের ভয় সেখানে হিরো আলম হয়, আসল রেসিপি খুঁজতে যেতেই বাফারিং শুরু হয়। ইটারনেটের গতি এক্কেবারে স্লো হয়ে আসে।

টুনি বারবার চেষ্টা করছে। বারবার রিফ্রেশ দিচ্ছে। রিলোড অপশনে ক্লিক করছে। কিন্তু নেট গাল ফুলিয়ে বসে আছে। কাজই করছে না। এমন সময় পাশের গাছের বাসা থেকে চড়ুই গিন্নি মাথা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে ,
— টুনি ভাবীইইই, টুনি ভাবীইইই আপনার ইন্টারনেট কি কাজ করছে!
— কি যে বলেন ভাবী, ইউটিউবের ভিডিওটা এক ঘণ্টায়ও ওপেন করতে পারলাম না।
— আমি ‘নাজুক দিল’ সিরিয়ালটা দেখছিলাম। নায়িকা সবে শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া শুরু করেছে, গেলো হ্যাং হয়ে। সিরিয়ালের ফ্রিজ শট মনে করে তাকিয়ে আছি। পরে দেখি ইন্টারনেট স্লো। নায়িকার জন্য খুব টেনশন ফিল করছি ভাবী..
— ওহ, তাই! এদিকে আমি খুঁজছিলাম ভাপা পিঠার রেসিপি।

এ কথা শুনেই চড়ুই গিন্নি অভিমানী স্বর,
— হায় খোদাআআ! ভাবীইইই আপনারা একা একা ভাপা পিঠা খাবেএএএএন! আমাদের কথা মনেই পড়লো না ভাবীইইই, আজ চড়ুই না হয়ে বুলবুলি হলে ঠিকই দাওয়াত দিতেন ভাবীইইইই..

টুনি বিব্রত হলেও নিজেকে সামলে নেয়,
— কি যে বলেন, ভাবী! আপনাকে দাওয়াত দিতে হবে কেনো! আপনি তো ঘরের মানুষ, সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।
— থ্যাঙ্কু ভাবীইইই। আপনার হাতে বানানো ভাপা পিঠা খেতে আমরা তো আসবোই ভাবীইইইই। আমাদের উপরের ডালে কাজিন থাকে, ওর ফ্যামিলিকেও সাথে নিয়ে আসবো, ভাবীইইইইই।

টুনি রেগে মনে মনে “ঢং দেখলে শরীরটা জ্বইল্যা যায়” বললেও, মুখে হাসি মেখে উত্তর দেয়,
– অবশ্যই নিয়ে আসবেন। খুব খুশি হবো।

চড়ুই গিন্নী বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতেই টুনি ধমকের সুরে টোনাকে বললো,
— চড়ুই ভাবী এলে এক্কেবারে রংঢং করবে না। যদি করো তবে চালের গুড়ির ভেতর তোমার মাথা পুরে সিদ্ধ করে মাসালা ভাপা পিঠা বানাবো, মনে থাকে যেনো, হু।

কোকিল পাখির গাওয়া কাকসংগীতের একটা সিডি লো ভলিউমে টোনা আয়েশ করে শুনছে আর ভাবছে কখন বানানো হবে ভাপা পিঠা। এদিকে বাফারিং হতে হতে টুনির মোবাইলের চার্জ শেষ। মোবাইল সেটটা চার্জে দিয়ে টুনি নারকেল কুড়ালো। গুড় মিহি করে টুকরো টুকরো করলো। চালের গুড়ির সাথে মাওয়া মিশালো। হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় বসালো।

সবকিছু ঠিকঠাক করে টুনি মোবাইল অন করে। মোবাইল অন করে মন খারাপ হয়ে যায়, দেখে ইন্টারনেট স্পিড এক্কেবারে কম। মাত্র ভাবতে শুরু করেছে ইউটিউব না খুললে ভাপা পিঠা বানাবে কিভাবে, তখনই বটগাছের পূব পাশের মগডালের ওপেন এয়ার ডুপ্লেক্সে বাস করা ব্যাচেলর চিলটা উপরের ডালে উড়ে এসে বসে,
— হ্যালো টুনি ভাবী, বাসায় আছেন?

চিলের কথা শুনে উচ্ছসিত টুনি বলে,
— কি আশ্চর্য! ভাইয়াআআআ, এদ্দিন পর আমাকে মনে পড়লো!
— না, ঠিক তা না। রোজই আপনার কথা মনে হয়, কিন্তু..

কথা শেষ করতে না দিয়েই টুনি কপট রাগ দেখায়,
— থাক.. থাক। বানিয়ে বানিয়ে আর মিথ্যে বলতে হবে না, ভাইয়ায়ায়ায়া। আপনার তো শুধু ডাহুক ভাবী, পায়রা ভাবীর কথা মনে পড়ে, ভাইয়ায়ায়া। আমার মত ছোট্ট টুনির কথা কি আর মনে পড়বে, ভাইয়ায়ায়ায়া।

চিল প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,
— টুনি ভাবী, ইন্টারনেটের স্পিড কি ঠিক আছে?
— না, ভাইয়ায়ায়া, ঠিক নেই। খুব স্লো, ভাইয়ায়ায়া।

টুনির এমন বিগলিত অবস্থা দেখে ঘরের ভেতরে টোনা রাগে দু’বার পাখা ঝাপটালো। বিষয়টা বুঝতে পেরে চিল টিটকারি মারে,
— কত স্লো, ভাবী! টোনার মত? প্রতি মৌসুমেই তো আপনার ডিম পাড়তে দেরী হয়ে যায়।

লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে টুনি। চিল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে,
— এত আয়োজন কার জন্য?
— আপনার ভায়ের ভাপা পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে হয়েছে, ভাইয়ায়ায়া। সব রেডি কিন্তু ইন্টারনেট স্পিড কম বলে পিঠা বানাতে পারছি না, ভাইয়ায়ায়ায়ায়।

চিল ভিরমি খেয়ে দুটো ঢোক গিলে বিস্ময় প্রকাশ করে,
— ভাপা পিঠা বানাতেও আজকাল ইন্টারনেট লাগে না কি!
— হ্যা, ভাইয়ায়ায়া। ইন্টারনেট না থাকলে ইউটিউবে রেসিপি দেখে পিঠা বানাবো কিভাবে!
— ও আচ্ছা।

টুনি আন্তরিক স্বরে বলে,
— ভাইয়ায়ায়ায়া, আজ কিন্তু আপনার দাওয়াত, না বলতে পারবেন না।

ঘরের ভেতর টোনা রাগে আবার পাখা ঝাপটায়। পাখা ঝাপটানোর শব্দ কানে যেতেই মুচকি হেসে চিল বলে,
— ঠিক আছে টুনি ভাবী। আপনি দাওয়াত দিচ্ছেন, এ দাওয়াত কি মিস করা যায়! আপনার হাতের পিঠা বলে কথা..

টোনা আগেই রেগে ছিল। ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হচ্ছে না দেখে টোনার রাগ খুব বাড়লো। কখন ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হবে তা জানাতে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করতেই শালিকের লাস্যময়ী কণ্ঠ,
— সম্মানিত গ্রাহক, আমাদের সার্ভিসে আপনাকে স্বাগতম। মোবাইল রিচার্জের জন্য এক চাপুন। কল রেট জানতে দুই চাপুন। ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে তিন চাপুন। দশটাকায় পাঁচটা ফ্রি এসএমএস পেতে চার চাপুন। যে কোনো অভিযোগ জানাতে ডিসকানেক্ট বাটন চাপুন।

টোনা ডিসকানেক্ট বাটনে চাপাতে লাইন কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল সেন্টারে ফোন করতেই ভেসে এলো ফিঙের কণ্ঠ,
— সম্মানীত গ্রাহক, আপনার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স নেই। কথা বলতে হলে রিচার্জ করুন। দ্রুত ডিম পাড়াতে হলে সঠিক পদ্ধতিতে টুনিকে আদর করুন। কল অপারেটরকে গালাগাল করার জন্য মোবাইল সেটের ‘পাওয়ার অফ’ অপশনে ক্লিক করুন এবং ইন্টারনেট স্পিড ছাড়া ভাপা পিঠা খেতে চাইলে মা’কে অনুরোধ করুন।

.
নব টোনাটুনি।
সাঈদের গল্প বইয়ের একমাত্র রম্যগল্প।

ফুলকপি (বড়দের গল্প) /পর্ব-২

প্রায় তিন যুগ আগের কথা, “নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/নতুন করে আজ শপথ নিলাম” গান আর “আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে” শ্লোগানে ক্ষমতাসীন এরশাদ ও তার অনুসারীরা দশদিক মুখরিত করে রেখেছে। এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এশীয় কবিতা উৎসব আয়োজিত হচ্ছে। একদল শক্তিমান কবি এরশাদকে ঘিরে রয়েছে। এরশাদও কবি, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তার কবিতা ছাপা হয়। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তৃতীয় জাতীয় সংসদের আয়ু অকালে ফুরিয়ে এসেছে। তবে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রধান হিসেবে এরশাদ বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় রয়েছে। তার পকেটে ঢুকে পড়া জাসদ (সিরাজ), ফ্রিডম পার্টি আর গুরুত্বহীন বামপন্থীদলসহ কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের জোট সম্মিলিত বিরোধীদলকে সাথে নিয়ে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যদিও সবাই জানে ভোট হোক বা না হোক ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিই জিতবে।

অপরদিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েও এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার স্মৃতি টাটকা থাকায় শেখ হাসিনা কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছেন। বিধবা গৃহবধূ থেকে খালেদা জিয়া জাতীয় নেত্রী হয়ে উঠেছেন। দুই নেত্রীর নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন চলছে। যে সব্যসাচী লেখক এরশাদকে পল্লীবন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়, তিনিও পক্ষ বদল করেছেন। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান আর একুশে বইমেলার স্টল থেকে ভেসে আসে আলী যাকেরের উদাত্ত আবৃত্তি “জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।” এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের কিছুই কৃষি কামলা বজলুকে স্পর্শ করে নাই। কার্তিকের মঙ্গায় একটানা সাত দিন কলাগাছের কান্ড সেদ্ধ খেয়ে আর সহ্য করতে পারে নাই। এক মুঠো ভাতের আশায় রংপুরের এক গ্রাম থেকে বজলু রাজধানীর পথে পা বাড়িয়েছিল। সাথে ছিলো বউ আর ওবায়দুলসহ চার সন্তান।

চিরদিনের জন্য গ্রাম ছাড়তে বজলুর বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নাই। পিছুটানের মায়া তাড়া করে নাই। তার কোনো কৃষি জমি ছিল না। নিজ হাতে বানানো একচালা খড়ের ঘরে বউ আর চার সন্তান নিয়ে থাকতো। ওই জমিও নিজের নয়। নিজের বলতে ছিল সীমাহীন অভাব, তীব্র ক্ষুধা আর একপাল গরীব আত্মীয় ও স্বজন। এসবের প্রতি কে’ই বা পিছুটান অনুভব করে! তীব্র ক্ষুধা আর যাত্রাপথে রংপুর শহরে লাগানো সোডিয়াম বাতির অদ্ভূত আলো দেখার বিস্ময় নিয়ে পরিবারসহ আরও অনেকের সাথে বজলুরা ঢাকা শহরে এসেছিল। শহরের রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছিল। সবচে বিস্মিত হয়েছিল তেল ছাড়া বাত্তি জ্বলা এই শহরে সারাদেশ থেকেই বহু গরীব এসেছে এবং আসছে দেখে।

রাজধানী ঢাকার চরিত্রে একটা নির্লিপ্ত আভিজাত্য বা অহঙ্কার রয়েছে। এ শহর গরীবদের সাড়ম্বরে স্বাগত জানায় না। দূর দূর করে তাড়িয়েও দেয় না। অনারোগ্য অসুখের মত মেনে নেয়। তিলে তিলে বুঝিয়ে দেয় তাদের দায়িত্ব শহরের করুণা ও দয়ায় নির্ভর করে বাঁচার চেষ্টা করা। চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সন্তুষ্ট থাকা। স্বাধীন রাষ্ট্রে সম্পদের সুষম বন্টনের দাবী তোলা নয়। কাজের খোঁজে চার পাঁচ দিন এলোমেলো ঘুরার সময়ে বজলু নিজের মত করে বিষয়টা বুঝে নিয়েছিল।

স্ব-পরিবার নিয়ে দশ/বারো দিন কমলাপুর রেলস্টেশনের মালগাড়ির প্ল্যাটফর্মে কাটানোর পর এক দেশী ভায়ের হাত ধরে বজলু পরিবারসহ কাওরান বাজার রেল বস্তিতে আশ্রয় পায়। পাঁচ হাত বাই ছয় হাত সাইজের একটামাত্র ঝুপড়ি ঘরে ছয়জন মানুষের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়। আরেক ভায়ের কল্যাণে বজলু একটা মজবুত বড় টুকরি কিনে কাওরান বাজারে কুলির দলে নাম লেখায়।

বড় ছেলে হাফিজুলের বয়স পনেরো বছর। মেজো ছেলে মফিজুল এক বছরের ছোট। তাদের ভাগ্য ভাল। কাওরান বাজারের এক হোটেলে চাকরী জুটিয়ে নিতে পারে। দায়িত্ব অতি সহজ – সারাদিন কল থেকে পানি টানা। প্লেট, বাটি, জগ ও হাড়িপাতিল ধোয়া। টেবিল পরিস্কার করা। হোটেল ঝাড়ু দেওয়া। সামান্য ভুলে মালিক, ম্যানেজার বা কাস্টমারের হাতে চড়-থাপ্পড় খাওয়া এবং বিনা প্রতিবাদে হজম করা। কার্লমার্ক্স পড়া নাই বলে ‘পেটে ভাতে’ বেতনপ্রথাও তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। একটানা ষোল সতেরো ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে তারা দৈনিক দুই বেলা ভাত খেতে পাবে। কখনো লবণ, পেঁয়াজ আর ডাল দিয়ে ডলে খাবে। কখনো তরকারির ঝোলের সাথে এক আধ টুকরা আলু আর ভেঙে যাওয়া মাছের কাঁটা। কোনো কোনো দিন মিলে যাবে অমৃতের মত কাস্টমারের এঁটো ভাত। পরিমাণে বেশী হলে বাসায়ও নিয়ে যেতে পারবে। ভাতের জন্য যারা রাজধানীতে আসে, রাজধানী তাদের বিমুখ করে না।

ভোরের আলো ফোটার আগে বজলু ও দুই ছেলে কাজে চলে যায়। ময়মুনা আর ওবায়দুল ঘুমায়। বজলুর বউ সবিরা বসে থাকে। অস্ফুট স্বরে বিলাপ করে কাঁদে। তার মোটা ঠোঁট আর ভাঙা গ্রীবা তিরতির করে কাঁপে। বোঁচা নাকের পাটি ফুলে উঠে। সবিরার একটা মাত্র শাড়ি। আমপাতা রঙ জমিনে খয়েরি পাড়। টেনেটুনে আট হাত হবে। রং জ্বলে তার ত্বকের মত খসখসে কালচে হয়ে গেছে। সে ছেড়া আঁচলে চোখ মুছে, নাক মুছে। সবিরা নতুন শাড়ির জন্য কাঁদে না। আধা উদোম অবস্থায় শরীরের শাড়ি শরীরে শুকানোর দুর্ভাগ্যের প্রতি অভিসম্পাত করেও অশ্রু বিসর্জন করে না। তাকে কাঁদায় ছেড়ে আসা মহিষমুড়ি গ্রাম- নিজের গ্রামে ফেরার আকুতি এবং ‘আর কোনোদিনও ফেরা হবে না’র মত নির্মম সত্য মিলেমিশে তাকে কাঁদায়। কান্নার বেগ থিতিয়ে এলে প্রত্যেকদিন ঝুপড়ি ঘর কাঁপিয়ে হুইসেল দিতে দিতে একটা যাত্রীবোঝাই ট্রেন খুব ধীর গতিতে কমলাপুর স্টেশনের দিকে যায়।

বেলা বাড়ে। রোদ উঠে। সবিরা পানি আনতে যায়। বস্তির কলপাড়ায় ঝগড়া করে পানির অধিকার আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠে নাই। প্রতিদিন কেউ না কেউ দয়া করে কলসিতে পানি ভড়ার জন্য তাকে কল ছেড়ে দেয়। সে পানি নিয়ে ঘরে ফিরে। ফিরার পথে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে না। মহিষমুড়ি নয়, দীর্ঘশ্বাসের কারণ আসন্ন বাস্তবতা। অভাবী সংসারে ভাঙনের শুরুটা এত মোলায়েমভাবে হয় যে সবার পক্ষে আঁচ করা সম্ভব হয় না। তবে মেয়েরা বুঝতে পারে। সংসারে ভাঙনের বীজ বুনা হয়ে গেছে। বুঝতে পারলেও দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া সবিরার করার কিছু নাই। সে দীর্ঘশ্বাসই ফেলে যায়। সে বুঝতে পারছে সংসারের সবাই একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। একই শহরে থাকলেও তারা পরস্পরের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। কে কোথায় থাকবে কে জানে! ফিরে ঘরে ময়মুনা আর ওবায়দুলকে দেখতে পায় না। খুঁজেও না। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। সে বাজার নিয়ে ফিরলে পেটের আগুন নিভাতে চুলার আগুন জ্বালাবে।

বজলুর একমাত্র মেয়ে ময়মুনার বয়স বারো হলেও অপুষ্টির কারণে তাকে দশ বছর বয়সী ওবায়দুলের থেকেও ছোট মনে হয়। ময়মুনাও সম্ভবত ওবায়দুলের ছোট হয়েই থাকতে চায়। ওবায়দুলের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায় যেনো ওবায়দুল ওর মুরুব্বী। বস্তির অন্য কিশোর-কিশোরীদের মত তাদের জীবনেও সকালের নাস্তা নামক কোনো বস্তুর উপস্থিতি নাই। মা পানি আনতে গেলে ভাইবোন মিলে বেরিয়ে পড়ে। নাস্তার আবশ্যিকতা তাদের আটকে রাখতে পারে না। পেট ভরা ক্ষুধা এবং মন ভরা আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খুব বেশী দূরে তারা যায় না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে তারা রেলবস্তি হতে সামান্য দূরের অদ্ভুত জগত দেখে। তারা ওই জগত দেখে হাসে। ওই জগতের মানুষের মুখের ভাষা শুনে হাসে। তাদের কাজ কারবার দেখে হাসে। পোশাক দেখে হাসে। স্কুলে যাওয়া হাফপ্যান্ট আর স্কার্ট পড়া সমবয়সী শিশুদের দেখে বিস্মিত হয় এবং হাসে। ক্ষুধার জ্বালায় যে তারা ত্যাক্ত হয় না এমন নয়। ত্যাক্ত হলেও খাওয়া মিলবে না এই চরম সত্য জেনে যাওয়ায় ত্যাক্ত হয়েও হাসে।

কিছুদিন পর বস্তিতে নির্বাচনের ক্যাম্প বসে। ক্যাম্পে সারাদিন গান বাজে “নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/নতুন করে আজ শপথ নিলাম।” গানের অর্থ না বুঝলেও বস্তিবাসীর এই গান মুখস্থ হয়ে যায়। এই গানের প্রতি বজলু বিশেষ ধরণের মায়া অনুভব করে। সে শুনেছে এই গানটা প্রেসিডেন্ট এরশাদ লিখেছে। প্রেসিডেন্ট মানে দেশের রাজা। বজলু গুনগুনিয়ে গানটা গায়, বেশ গর্বের সাথে বলে, “আজা হামার অমপুরের ছাওয়াল, বাহে। আজায় গান ন্যাকছে..।” তার এই গর্ব অন্যরা উপভোগ করলেও নিজের ঘরে বলে শান্তি পায় না। সবিরা মুখ ঝামটা দিয়ে গজগজ করে, “হাগার থাকি ঢ্যাড়ঢ্যাড়ি বেশী। পাচাত নাই ত্যানা, ভাসুরে বাজায়ই ব্যানা। পুঁটকিত নাই চাম, আদা কৃষ্ণ নাম।”

নির্বাচনী ক্যাম্পের আশপাশে ওবায়দুল আর মায়মুনা ঘুরঘুর করে। রোজ মিছিল হয়। মিছিলের সাথে গেলে ওবায়দুল এক টাকা পায়। মায়মুনা কোনো টাকা পায় না। উপার্জিত টাকায় কখনো মোয়া কখনো আচার কিনে সমান ভাগ করে খায়। এক একদিন মায়ের জন্যও নিয়ে যায়। নির্বাচন শেষ হয়ে যায়। আবার সব আগের মত। পাঁচ মাস পরে শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। বন্যার প্রথম দিকে কাওরান বাজারের রেল বস্তিতে পানি না উঠলেও বজলুর পরিবারে শোক নেমে আসে। ডায়রিয়া আক্রান্ত ময়মুনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় সকাল থেকে পড়েছিল। নিস্তেজ হতে হতে সন্ধ্যায় মারা যায়। ময়মুনা সারাদিনে কোনো চিকিৎসা না পেলেও তড়িত গতিতে ডেথ সার্টিফিকেট পেয়েছিল। মায়মুনা কখনো ওবায়দুলের থেকে বড় হতে চায়নি, এখন সে সকল চাওয়া ও না চাওয়ার বৃত্তের বাইরে চলে গেছে।

ময়মুনার মৃত্যু ওবায়দুলকে একা করে দেয়। বাবা আর বড় দুই ভাই প্রতিদিন আগের মত কাজে চলে যায়। ফার্মগেটের দুই মেসে মা রান্নার কাজ করে। পরিবারে একমাত্র বেকার ওবায়দুল। মন চাইলে ঘরে শুয়ে থাকে। মন চাইলে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। তাকে কেউ কাজের কথা বলে না। শহরে মিছিল হয়। মাঝে মাঝে হরতাল হয়। হরতালের দিন ওবায়দুল হাঁটতে হাঁটতে কাওরান বাজার বা তেজগাঁও মোড়ে যায়। পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে ভালো লাগে। আরও পরে, নব্বই সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে দু’বার ককটেল ফুটিয়েছিল। নেতা নগদ দশ টাকা করে মজুরী দিয়েছিল। বয়স কম বলেই হয় তো দশ টাকা উপার্জনের আনন্দ ওবায়দুলের কাছে বোন হারানোর শোক ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে নাই। দু’টা পাঁচ টাকার নোট মুঠোয় পুড়ে ময়মুনার অভাব বোধ করছিল। খুব কান্না পাচ্ছিলো, বুক চুরমার করা অবর্ননীয় কষ্টের কান্না।

ফার্মগেটের মেসে মা’র বেশী দিন কাজ করা হয় নাই। একদিন কাজ থেকে ফিরে খুব গোমড়া হয়ে রইলেন। তিন চারবার গোছল করলেন। পরদিন ভোর হবার আগে বাবা আর বড় দুই ভাই কাজে চলে গেলে ওবায়দুলকে ধরে অনেকক্ষণ শুয়ে রইলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওবায়দুলের ঘুম গাঢ় হয়ে এলো। প্রতিদিনের মত পানি আনতে গেলেন। কিন্তু ফিরলেন না। তুমুল চেঁচামেচিতে ওবায়দুলের ঘুম ভাঙলো। জেগে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। একজন তাকে জোড় করে টানতে টানতে এনে ঠেলে রেল লাইন ঘিরে থাকা জটলার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। সে দেখলো ট্রেনের চাকায় পিষ্ট একটা নারী শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। কেউ তাকে বলে নাই, তবু সে বুঝতে পারলো এটা মায়ের শরীর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত, মাংস, চর্বি, হাড় আর ঘিলু দেখে মায়ের জন্য কান্নার পরিবর্তে তার বমি পেলো। মায়ের আত্মহত্যার পর কিছু ঘটনা খুব দ্রুত ঘটলো – বাবা আবার বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেল। দুই ভাই কাওরান বাজারের রেল বস্তির ঘর ছেড়ে আগাওগাঁও বিএনপি বস্তিতে চলে গেল। বিশাল এই দুনিয়ায় ওবায়দুলের আর কেউ রইলো না, সে একা হয়ে গেলো।

কাওরান বাজারে ওবায়দুল বহুবার ঢুকেছে। বারো বছর বয়সে প্রথমবারের মত ঢুকলো কাজের সন্ধানে। মুরগি পট্টির গন্ধ সহ্য করতে না পারলেও কিছু দিন মুরগি জবাই ও নাড়িভুড়ি পরিস্কারের কাজ করলো। এরপর সবজীর ব্যবসা বেছে নিলো। পোকায় ধরা ও পঁচা সবজি টুকিয়ে ও কিনে , পঁচা অংশ কেটে বাদ দিয়ে ভালো অংশটা ছালায় সাজিয়ে বিক্রি করতো। তিন দশক পরে এসে একই বাজারে তার দুইটা পাইকারী আলু বিক্রির দোকান। মাঝে কেটে গেছে প্রায় বত্রিশ বছর।

তিন দশকে ওবায়দুল নিজেকে, নিজের পরিবার আর ঢাকা শহরকে বদলে যেতে দেখেছে। কাওরান বাজরও পরিবর্তনের বাইরে থাকে নাই। নাম বদলে হয়েছে কারওয়ান বাজার। ওবায়দুলের চোখে এই পয়ত্রিশ বছরে কারওয়ান বাজারে জিনিসপত্রের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাংবাদিকের সংখ্যা। এদের অনেকে এক কেজি আলু বা এক’শ গ্রাম কাঁচামরিচও পাইকারি দরে কিনার জন্য তোলপাড় করে। ফকিরাপুল হতে প্রকাশিত আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার সবুজ ভাই এমনই এক সাংবাদিক এবং ওবায়দুল তার কাছে হাতে-নাতে ধরা খেয়েছে। ঘটনার নায়ক বা খলনায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যান্টিনের ম্যানেজার জাফর নিরাপদে থাকলেও ওবায়দুলের দুঃসহ সময় কাটছে।

(চলবে)

ফুলকপি (বড়দের গল্প)

‘ফুলকপি’ বড়দের গল্প। আয়তনেও বড়, নভেলা বলা যায়। গল্পটা টাইমলাইনে শেয়ার করার আগে কিছু বলা দরকার- এখন একটানা তিন চার লাইনের বেশী লিখতে পারি না, চোখে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। চোখের চাপ ছড়িয়ে যায় মাথায়। ছাইপাশ বা অখাদ্য যাই লিখি, হিরো আলমের গানের এসব লেখারও কিছু পাঠক আছেন। এদের অনেকে নতুন লিখার জন্য তাগাদা দেন- হাসিমুখে এড়িয়ে যাই। তবে Asif Iqbal-এর নিয়মিত তাগাদা – “তুমি কিন্তু ক’মাস ধরে তেমন কিছুই লিখছো না, কিছু লিখ। মনসুখিয়া বা গল্প- যা হোক লিখ।” ওকে বলা হয় না, “লিখতে তো চাই, কিন্তু পারি না।” শেষ পর্যন্ত ঘরবন্দী অবস্থায় ভয়েজ টাইপিং’য়ে ধীরে ধীরে “ফুলকপি” গল্পটা লেখা হলো, প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ। খসড়াটা কথাসাহিত্য ডটকমে প্রকাশ করেছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে এডিট করতে গিয়ে আকার আরও বড় হলো। বড়দের বড়গল্প ‘ফুপকপি’ ভালো না খারাপ সে প্রশ্ন যৌক্তিক, তবে বাংলায় বাটারফ্লাই ইফেক্ট প্রভাবিত এই ধরণের পলিটিক্যাল স্যাটায়ার লেখার সংখ্যা খুবই কম, হয় তো আগে লেখাই হয়নি, কেউ লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন নাই।
আজ ফুলকপি গল্পের প্রথম পর্ব শেয়ার করলাম-

ফুলকপি (বড়দের গল্প)
ফুলকপি (বড়দের গল্প/ফাইনাল)

১.
ফুলকপি দু’টা কি করবে – দ্বিধাগ্রস্ত হানিফ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। প্রতিদিন ভোর ৫টার মধ্যে তার দোকানদারি শেষ হয়ে যায়। আজ সোয়া চারটার মধ্যে দু’টা বাদে সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। লাভসহ চালান উঠে এসেছে। এখন ভোর পৌনে ছ’টা, ফুলকপি নিয়ে বিভ্রান্ত হানিফ দাঁড়িয়ে আছে।

হানিফ মাঝরাতে কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে ঠিকায় দু’শ ফুলকপি আর এক’শ বাঁধা কপি কিনে। খুচরা বাজারে নিজের দোকানে সাইজ অনুযায়ী সাজায়। ক্রেতার চাহিদার পরিমাণ অনুযায়ী সাইজ ভেদে পাইকারি ও খুচরা দামে বিক্রি করে। এই কৌশলে তুলনামূলক বেশী লাভ হয়। বর্তমানে ফ্যাশন অনুসারে হানিফকে সবজী উদ্যোক্তা বলা যায়, কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সী হানিফ পঁচিশ বছর ধরে একই কৌশলে ব্যবসা করে আসছে।

অবিক্রীত ফুলকপি জোড়া হানিফের মনে বাবার স্মৃতি জাগিয়ে তুলে। বাবা বেঁচে থাকতে ধমক খাওয়া ছাড়া হানিফকে কোনো কিছু করতে হয় নাই- না পড়ালেখা, না কাজ। এই কথাটি অবশ্য আংশিক সত্য, কারণ পড়ালেখার দৌড়ে সে ক্লাশ সেভেনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত টিকেছিল। এরপর বস্তির বখাটে বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠতার শুরু। এক একদিন একা বা দলবেঁধে দয়াগঞ্জ রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বা ঢাকার কমলাপুরে চলে যাওয়া, বস্তির বাইরের ক্লাব ঘরে ক্যারাম খেলা, নিয়মিত সিগারেট খাওয়া এবং মাঝে মধ্যে খুচরো মাস্তানি – এসবকে যদি কাজ বলা যায়, তবে সে কাজও করেছে। এসব কাজের চাপে হানিফ এক ফূর্তিময় জীবন যাপন করছিল।

বাবা রিকশা চালাতেন। স্বল্প আয়, তবু খাবার ব্যাপারে তার জমিদারের মত বাছবিচার ছিল। অন্য রিকশাচালকরা আকিজ বিড়িতে অভ্যস্ত হলেও তিনি স্টার সিগারেট টানতেন। ফুলকপি ছিলো তার অপছন্দের সব্জী। ফুলকপির গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না। মুখে তোলা তো দূরের কথা, পাতেও তুলতেন না, বলতেন, “মাইনষ্যে ফুল্কফি খায় ক্যাম্নে!” এই বিস্ময় বা প্রশ্নের মিমাংসা জরুরী ছিলো না, তাই গ্রহণযোগ্য উত্তর পাবার আগেই শীতের এক কুয়াশাঘন সকালে তিনি বিদায় নিলেন। টিকাটুলি মোড়ে “সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন” গোত্রের ট্রাক তাকে পিষ্ট করে পালালো। তার থেতলে যাওয়া দলাপাকানো শরীরটা তিন চারবার ঝাঁকি দিয়ে স্থির হয়ে গেল । আইনী প্রক্রিয়া মেনে থানা থেকে মেডিকেল কলেজ, ফের মেডিকেল কলেজ থেকে থানার চক্কর কেটে সন্ধ্যায় লাশ দয়াগঞ্জ বস্তিতে আনার পর হানিফ, একমাত্র ছোট বোন আর তার মা’কে স্বজন হারানোর বেদনা নয়, আসন্ন দিনের অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছিল।

বাবা মারা যাওয়ার পর হানিফের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল – বাবার পেশা রিকশা চালানো বা দয়াগঞ্জ বস্তির বেল-বাটি পার্টিতে যোগ দেয়া। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট বাবার দলাপাকানো শরীরটা বহুদিন হানিফকে আতঙ্কে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রিকশার প্যাডেলে পা রাখার সাহস হয় নাই। বেল-বাটি পার্টিতে যোগ দিলে রিকশার বেল চুরি, ছিনতাই এবং ফেনসিডিল ও হিরোইনসহ মাদক কারবার করা যায়। স্বাধীন পেশা, ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ নীতি সত্ত্বেও উপার্জন বেশ ভাল। তবে দু’টা ঝুঁকি রয়েছে- নেতারা পুলিশের সাথে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা করলে বা পত্রিকায় বেল-বাটি পার্টির দৌরাত্ম্য ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বিষয়ক খবর ছাপলে পুলিশ অতি তৎপর হয়ে পার্টির সাধারণ সদস্যদের গ্রেফতার করে অমানবিক ধোলাই দেয়। দ্বিতীয় ঝুঁকি আরও মারাত্মক- পাবলিকের হাতে ধরা পড়লে নির্বিবাদী ও ভীতু মানুষগুলিই দানবে পরিণত হয়, পৈশাচিকভাবে পিটায়। মেরে ফেলার কৃতিত্বে উল্লসিত হয়। সাহসের অভাবে বেল-বাটি পার্টিতেও হানিফের যোগ দেওয়া হলো না।

রিকশার মহাজনের দেওয়া পাঁচ’শ টাকা পূঁজি নিয়ে হানিফের নতুন জীবনের শুরু। বয়স তখন চৌদ্দ কি পনেরো বছর, ফজরের ওয়াক্তে পুরান ঢাকার শ্যামবাজার থেকে কাঁচামরিচ, লেবু, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, শসা পাইকারি দামে কিনে সকালে সূত্রাপুর বাজারে খুচরা দামে বিক্রির মাধ্যমে হানিফের সব্জী ব্যবসায়ে হাতেখড়ি। সময়ের পরিক্রমায় রায় সাহেব বাজার ও জুরাইন বাজার পেরিয়ে, কিছুদিন ঠাটারিবাজারে মাছের ব্যবসা শেষে টানা আট বছর ধরে হানিফ কারওয়ান বাজারের সব্জী কারবারি। ক্ষুদ্র পূঁজির পাইকার। বাঁধা ক্রেতাদের অনেকেই তাকে ‘মাহাজন’ বলে ডাকে।

হানিফ সবুজ রঙের মাফলারটা গলা থেকে খুলে কোমড়ে বাঁধে। লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা গোল্ডলিফের প্যাকেট বের করে। সিগারেট ধরায়। চা’য়ের জন্য আশপাশে তাকায়। মোখলেস নামের দশ বারো বছরের একটা ছেলে মাঝরাত থেকেই ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করে। মোখলেসকে বাজারের সবাই মেসি নামে ডাকে, কেনো ডাকে হানিফ জানে না। সম্ভবত মোখলেসের মেসি হবার ঘটনা কেউই জানে না। আশেপাশে মেসিকে দেখা গেলো না। হানিফ সিগারেটে টান দেয়। প্রথম টানের ধোঁয়া ছাড়তেই মনে জিহাদী হুজুরের চেহারা ভেসে উঠে। জিহাদী হুজুর ওয়াজে সিগারেট টানার এমন অভিনয় করে যে সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। ইউটিউবে যতবার জিহাদী হুজুরের ওয়াজ দেখেছে ততবারই হাসির দমকে হানিফের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু এখন হাসি পাচ্ছে না, গোঁফ চুলকে ভাবছে- আজকের লটের সবচে সুন্দর ফুলকপি দু’টা বিক্রির জন্য আরও অপেক্ষা করবে না প্রতিদিনের মত বাড়ির ফেরার পথ ধরবে।

চলতি মৌসুমে ফুলকপির সরবরাহ বেশ ভালো। বাজারে শীতের সবজি আসার শুরুর দিকে মাঝারি আকারের এক জোড়া ফুলকপি দেড়’শ থেকে দু’শ টাকায় বিক্রি করতে পেরেছে। এখন দাম কমে জোড়া ষাট থেকে সত্তুর টাকায় নেমে এসেছে। হানিফ সিগারেট খাওয়া শেষে ফুলকপি দু’টোর দিকে তাকায়। সবুজ ডাটার মাঝখানে বরফ শাদায় হালকা হলুদ আভায় আচ্ছাদিত বৃত্ত। জমাট বাঁধা ফুল- চূড়োয় মধ্যবিন্দুকে রেখে ফুটবলের অর্ধাংশের মত সুষমভাবে স্ফিত হয়ে আছে। ফুলের কারণে সামান্য এবড়োথেবড়ো হলেও কোমল ও মসৃণ। হানিফ কপির ডাঁটি দুটো ফুলের তোড়ার মত দুই হাতে শক্ত করে ধরে। ঘ্রাণ নেওয়ার ভঙ্গিতে নাকের কাছে এনে শুঁকে। মুহুর্তের মধ্যে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বাজারের কোলাহলকে দখল করে গাঢ় নিরবতা। বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে আবছায়া ঘর, ছোটো জানালায় লাগানো প্রিন্টের পর্দা ফুড়ে ঢুকা নরম আলোয় সবুজ ব্লাউজ খোলা মাকসুদার ফর্সা বুক। শ্বাস নেবার দোলায় উঠছে নামছে। ফুলকপির ডাঁটির মত পাতলা-শুকনা একটা গতরে এত স্ফিত বুক কিভাবে হয়- হানিফের কাছে এ এক অমিমাংসিত রহস্য।

দ্রুতই নিজেকে সামলে নেয় হানিফ। কিছুটা লজ্জাও পায়। কল্পনার রাজ্য ছেড়ে কোলাহল আর প্যাচপেচে কাদা ও সব্জীর মিশ্রণে সৃষ্ট গন্ধ ভরা বাজারে ফিরে আসে। মাথার ভিতরে জেগে থাকে মাকসুদা। মাকসুদার এই উপস্থিতি তাকে অন্যান্য দিনের মত ফুলকপি জোড়া বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করে। মাকসুদা সব কিছুই খুব ভালো রান্না করে। কিন্তু ফুলকপির তরকারি রান্না করতে পারে না। ফুলকপির তরকারিতে এত বেশী হলুদ দেয় যে খেতে বিস্বাদ লাগে। বিস্বাদ ফুলকপির তরকারি উগরে আসা বমি চেপে হাসিমুখে খেতে হয়। খাওয়া শেষে প্রশংসা করতে হয়। কঠিন কিছু বললে মাকসুদা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে, হানিফের কষ্ট হয়। আজ সে নির্যাতিত হবার মত বস্তু নিয়ে ঘরে ফিরবে না, কম দামে হলেও ফুলকপি বিক্রি করে তারপর ফিরবে।

মাকসুদাকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে হানিফ রাজী ছিলো না। বাবা মারা যাবার এক বছরের মাথায়, বাবার অভাবটাহাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছে, মধ্যবয়সী মা এক ঠেলাওয়ালাকে বিয়ে করে আগারগাঁও বস্তিতে চলে গেলেন। তখনই হানিফ প্রতিজ্ঞা করেছিল বিয়ে করবে না। সে মরে গেলে বউ অন্য পুরুষের সাথে সংসার করবে, রঙ্গ তামাশা করবে, এক বিছানায় শুবে – এ কথা ভাবতেই বিয়ের প্রতি অনাস্থা এবং সংসারের প্রতি তীব্র বৈরাগ্য ও ঘৃণা জন্মেছিল। একমাত্র ছোটবোন তাকে বিয়ের জন্য ত্যাক্তের চূড়ান্ত করলো। “ভাই, তোমার বয়স বাড়তাছে, সেবাযত্ম দরকার” এবং “তোমার থেকা বুইড়া বয়সে মাইনষ্যে বিয়া করে, তোমার বিয়া করতে সমস্যা কি” – এই যুক্তিতে ছোটবোনের নেতৃত্বে সাঁড়াশি আক্রমণে যোগ দিলো বোন জামাই, ভাগ্না-ভাগ্নি আর এক চাচা। হানিফ শেষ পর্যন্ত বিয়েতে সম্মত হলো।ছোটবোন নিজ উদ্যোগে চল্লিশ বছর বয়সী ভাইকে দূর সম্পর্কের বাপ-মা মরা এতিম বিশ বাইশ বছর বয়সী ননদ মাকসুদার সাথে বিয়ে করালো। বয়সের ফারাকজনিত হীনমন্যতার কারণে অল্প বয়সী রূপবতী বউয়ের প্রতি হানিফ কঠোর হতে পারে না।

হানিফের দোকানের তিন-চার দোকান পরই ওবায়দুলের আলুর দোকান। ওবায়দুল অনেকক্ষণ ধরে হানিফকে খেয়াল করছিল। চোখাচোখি হতেই ওবায়দুল ইশারায় হানিফকে ডাকে। হানিফ কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ওবায়দুল বলে,
– ফুলকপি দুইটারে বুড়া হাত্তির বিচির মত ঝুলায়া দুই ঘণ্টা ধইরা খাড়ায়া আছো ক্যান? বাড়িতে লয়া যাও।
– আইজ বাড়িতে লইয়া যাইত্তাম না।

ওবায়দুল হাসে,
– ক্যান! ফুলকপি লয়া গেলে ভাবী মাইর দিবো! ভাবীরে ডরাও! ভাবী চিল্লাইবো! বাড়িত থেকা বাইর কইরা দিবো! রাইতে একলগে..

ওবায়দুলের রসিকতা হানিফের ভালো লাগে না। ওবায়দুলের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠে,
– ডাইকছো ক্যান! কি কইতে চাও তা কও!

ওবায়দুল হাসে,
– বাড়িতে না নিয়া গেলে আমারে দাও, আমি লয়া যাই। শইল মাছ দিয়া রাইন্ধা বউপোলাপান লয়া খাই।

ওবায়দুলের রসিকতায় তেঁতে থাকা হানিফ ঝাঁঝের সাথে বলে,
– দাম দিয়া নিবা! মাগনা দিতাম না।

ওবায়দুলের স্বরে ঝাঁঝ,
– ওই মিয়া! দামের গরম আমার লগে দেখাইও না। দাম দিয়াই লমু। ওবায়দুল মাগনা কিছু লয় না। বুড়া হাত্তির বিচির দাম কত চাও, কও?

হানিফ নরম হয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে ওবায়দুলকে দেয়। ওবায়দুল সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লে হানিফ বলে,
– চ্যাতো ক্যান! আমি কি কইছি তুমি মাগনা নিবা! ফুলকপির আজকার দাম তো তুমি জানোই। ওই দাম লাগবো না। আমার বাড়িত যাওনের বাস ভাড়া বিশ টাকা, তুমি বিশ টাকা দিলেই সই। এমন কপি সারা বাজারে নাই।

এতক্ষণ পর ফ্লাস্ক হাতে মেসিকে দেখা যায়, হানিফ মেসিকে ডেকে ওবায়দুলকে বলে,
– চা খামু। তিয়াস পাইছে। খাওয়াইবা!

ওবায়দুল ফুলকপির দাম বাবদ বিশ টাকা দেয়, হানিফের সাথে নিজেও রঙ চা আর কাচ্চা বিস্কুট খায়। হাসিমুখে হানিফকে বিদায় দেয়।

ওবায়দুল ফুলকপি দু’টার দিকে মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একজোড়া সরস ফুলকপি, দেখলেই মন ভরে যায়। হানিফ মাত্র বিশ টাকার বিনিময়ে এই ফুলকপি বিক্রি করেছে- ভাবতেই আশ্চর্য হচ্ছে। সকাল ৮টার পর খুচরা ক্রেতার কাছে এই কপি দু’টা খুব কম করে হলেও দেড়’শ টাকায় বিক্রি করা যাবে। নগদ লাভ এক’শ ত্রিশ টাকা। কিন্তু ওবায়দুল বিক্রি করবে না। সবকিছুতে টাকার লাভ দেখলে চলে না। আরও অনেক বড লাভ প্রাপ্তির লক্ষ্যে সে এই ফুলকপি জোড়া বিনিয়োগ করবে।

(চলবে)

আধুনিকতার সঙ্কট

শীতের রোদে বসে ভাবনা এলো-

বহু আগের শীতকালে, আমাদের কৈশোরে দেখেছি ভাত খাওয়ার শুরুতে দুই তিন লোকমা/গ্রাস ভাত সরিষা তেল, পিঁয়াজ কুচি/ঝাঁঝপূর্ণ লাল মুলোর টুকরো দিয়ে মেখে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। বহু যুগের অভিজ্ঞতা হতে মুরুব্বীরা দাবী করতেন- এতে মুখের স্বাদ/খাওয়ার রুচি বাড়ে এবং সর্দি/কাশি লাগে না। আমরা অভিজ্ঞতার পরিবর্তে অনুকরণকে প্রাধান্য দিয়ে এসব বর্জন করে আধুনিক হলাম, এবং আধুনিকতার দেমাগে (ইচ্ছে করেই অহঙ্কার শব্দটা ব্যবহার করলাম না) ভুলে গেলাম যে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ হতে স্থানীয় পরিবেশ ও প্রকৃতি, অভ্যাস, সংস্কৃতিজাত সঞ্চিত বহু যুগের অভিজ্ঞতা উত্তম।

দুই দশক আগে, যেসব মুরুব্বীরা জীবিত ছিলেন, তাদের চাহিদা বা অভ্যাসজনিত কারণেই ঘরে ঘরে লেবুর আচারসহ বিভিন্ন আচার কাচের বোয়ামে বানিয়ে রাখা হত। আমের মোরব্বাও থাকতো। তবে লেবুর আচার আর আমের মোরব্বার বিশেষ মূল্য ছিলো, অসুস্থ বা যাদের ক্ষুধা কম ছিলো তাদের ভাতের সাথে সামান্য লেবুর আচার দেওয়া হত, হাতে হাতে ফলাফল।

ডাক্তার বললেন, “রোজ সকালে বিশ/ত্রিশ মিনিট রোদে বসবেন, শরীরে রোদ লাগাবেন।” উপদেশ শুনে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠতেই ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, “হাসির কি হলো?” বিনয়ের সাথে তাকে বললাম, “না, হাসির কিছু হয় নাই। ছোটবেলা থেকে যৌবনের প্রথমভাগ পর্যন্ত সকালে ঘুম থেকে জেগে রোদে বসা, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার জন্য মুরুব্বীদের প্রবল চাপ ছিলো, তারা ভিটামিন ‘ডি’ও চিনতেন না ‘মর্নিং ওয়াক’ কাকে বলে তাও জানতেন না।

করোনা মহামারীর দিনগুলোতে সবাই রোগের নিদান খুঁজছেন। শরীরের ইম্যুনিটি বাড়ানোর জন্য প্রিয় একজন প্রকৌশলী বন্ধু নিজ গরজে ঐতিহ্যবাহী/প্রাচীন ভেষজ ফুড সাপ্লিমেন্ট ‘চ্যাবনপ্রাশ’ বানালেন। হোমমেড চ্যাবনপ্রাশ কাছাকাছি যারা নিলেন তারা একবাক্যে এর উপকারিতা স্বীকার করলেন। কিন্তু বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া গেলো না। কারণ, আধুনিক আমরা অমিতাভ বচ্চনের বিজ্ঞাপন করা ‘চ্যাবনপ্রাস’ বা জেমসবন্ড হিরো পিয়ার্স ব্রসনানের বিজ্ঞাপন করা ‘পান মাসালা’ মেনে নিতে পারি, কিন্তু ঘরে বানানো চ্যাবনপ্রাশ মেনে নিতে গেলে কি আর আধুনিকতা রক্ষা হয়!