আমরা যে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি, তা কোথায় আছে? ইউরোপে-আমেরিকায়? না- নেই। মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্যের কথা বাদই দিলাম। আপনারা কেউ যান তো নিউইয়র্ক টাইমসে একটি বিজ্ঞাপন দিতে, বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ওরা আপনার বিজ্ঞাপন নেবে? না- নেবে না।
বলুন আমরা প্যালাস্টাইনে গণহত্যার বিচার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতে চাই। ওরা ছাপবে না। কেন ছাপবে না? কারণ দুনিয়ার কোথাও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। যা আছে- তা মেকি। লোক দেখানো। একটা তন্ত্রশাসিত স্বেচ্ছাচারিতার নামই আজ গণতন্ত্র। সবখানেই। ট্রাম্প সাহেবের নাম না হয় না-ই নিলাম।
বাংলাদেশে এই সময়ে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র নামে এক ধরণের পেশবাজি চলছে। যার যা ইচ্ছে তা বলছে। রাষ্ট্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তারা এই মাতৃভূমির বিরুদ্ধেই দাঁড়াচ্ছে কখনও কখনও। চিত্রসাংবাদিক শহিদুল আলম এই সময়ে একটি বড় উদাহরণ। তিনি আল-জাজিরা টিভির সাথে যা বলেছেন, তা সবাই দেখেছেন। ফেসবুকে লাইভ যা বলেছেন তাও অনেকেই দেখেছেন। আমিও দেখেছি। আর দেখেছি বলেই, এই লেখাটি লিখছি। দেখেন নি আমাদের জাফর ভাই। মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই সময়ের প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী তিনি আমাদের। তিনি এই বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি তরুণকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত করেছেন। আমরা তার কাছে ঋতী। না- তিনি শহিদুল আলমের ফেসবুক লাইভ দেখেন নি। তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন একটি লেখায়। যা গত ১০ আগস্ট ২০১৮ শুক্রবার দেশের অনেকগুলো জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম-‘আমরা জানতে চাই’। তিনি লিখছেন- ‘তার দ্বিতীয় অপরাধ হিসেবে ফেসবুক লাইভে তার বক্তব্যের কথা শুনতে পাচ্ছি। ফেসবুক লাইভ বিষয়টি কী আমি সেটা সঠিক জানি না। সেখানে তিনি কী বলেছেন সেটাও আমি জানি না, কিন্তু যেটাই বলে থাকেন সেটা তার বক্তব্য। এই বক্তব্য দিয়ে তিনি বিশাল ষড়যন্ত্র করে ফেলেছেন, সেটি তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপত্তিকর কিছু বলে থাকলে, কেন সেটি বলেছেন সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে, আলোচনা হতে পারে, তারচেয়ে বেশি কিছু তো হওয়ার কথা নয়। আমি শুনেছি তার থেকেও অনেক বেশি আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়ার পরও অভিনয় শিল্পীদের অনেকে পার পেয়ে গেছেন, তাহলে খ্যাতিমান সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই আলোকচিত্র শিল্পীর ওপর এই আক্রমণ কেন? যদি সত্যিই তিনি ষড়যন্ত্র করে থাকেন, আমরা সেটি জানতে চাই।’
এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। ‘দৃক’ গ্যালারির শহিদুল আলম একজন খ্যাতিমান চিত্রসাংবাদিক। দেশে বিদেশে তার অনেক পরিচিত জন আছেন। তিনি অধ্যাপিকা রেহনুমা আহমেদ এর স্বামী। চিত্রসাংবাদিক শহিদুল আলমের পিতার নাম ডা. কাজী আবুল মনসুর। তিনি ১৯৯৬ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদক’ পান। ১৯৯৬ এর মার্চ মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই পদক ঘোষণা করেন। মনে রাখা দরকার, ৫ বছর মেয়াদ শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার সরকার গঠন করেন খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ আবার পদত্যাগ ও করেন বেগম খালেদা জিয়া। তাই পদক প্রদানের এই সময়টি সকলের খেয়াল রাখা দরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬ এর ১২ জুন নির্বাচনে জিতে। ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠনের মাধ্যমে। তাই আওয়ামী লীগ ডাঃ কাজী আবুল মনসুর কে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দিয়েছিল এই বিষয়টি সত্য নয়। পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ডা. মনসুরের স্ত্রী, আনোয়ারা মনসুরের হাতে পদকটি তুলে দেওয়ার রুটিনওয়ার্ক সম্পন্ন করেছিলেন শেখ হাসিনা।
উইকিপিডিয়ায় সকল তথ্য সংরক্ষিত আছে। বলে রাখি, আনোয়ারা মনসুর মূলত ছিলেন ৭১ সালে পাক বাহিনীর এজেন্ট। যা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে সবিস্তারে লিখেছেন। আমরা শহীদ জননীর ভাষ্য থেকে জানতে পারি- ‘১৯৭১ সালে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের মা ড. কাজী আনোয়ারা মনসুরের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টর কমা-ার খালেদ মোশারফের দুই কন্যাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গৃহবন্দী করে রাখে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাদল খালেদ মোশাররফের স্ত্রী ও তার মাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। যদিও বাদলের মাথার ওপর মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছিল। কিন্তু তা সত্বেও ঢাকার বিখ্যাত ক্রাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা বদি (মোহাম্মদ বদিউল আলম বীর বিক্রম-পরে শহীদ), কাজী, স্বপন, চুল্লু ড. আনোয়ারা মনসুরের বাসা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ড. কাজী আনোয়ারা মনসুরের বাসা এলিফ্যান্ট রোডের ‘নাসেমন’ সরকারী ভবনে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে যায়। নিচে চুল্লু গাড়ি স্টার্ট করে বসে থাকে। সেখানে ড. আনোয়ারা মনসুরের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের খালেদ মোশাররফের মেয়ে বেবী ও রূপনকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে তর্কাতর্কি হয়, এ সময় কেউ একজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে খবর দেওয়ার জন্য টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা স্বপন দেয়ালে গুলি করেন। ড. আনোয়ারা মনসুরের বড় বোন বাঁধা দেওয়ার জন্য আসলে তার পা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। গুলি পায়ের চামড়া ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। ড. আনোয়ারা মনসুরের মাথায় স্টেনগান দিয়ে আঘাত করে মুক্তিযোদ্ধারা, তখন তিনি খালেদ মোশাররফের ছোট মেয়ে রূপনকে জাপটে ধরেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বেশি সময় ছিল না। তারা রূপনকে রেখে বেবীকে কোলে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। নিচে লোক জমা হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত গাড়ি নিয়ে মিলিয়ে যায়। তারপর তারা খালেদ মোশাররফের ক্যাম্পে গিয়ে তার বড় মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়।
উল্লেখ্য, ড. শহিদুল আলমের মা ড. কাজী আনোয়ারা মনসুর ছিলেন ঢাকার আজিমপুরে অবস্থিত অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। (তথ্যসূত্র: ‘একাত্তরের দিনগুলি’,পৃষ্ঠা-২৩০ সন্ধানী প্রকাশনী, চতুর্বিংশ মুদ্রণ, প্রকাশকাল: ২০০৩)
শহিদুল আলমকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কেন করেছে, তার কিছু কারণ দেখা দরকার। শহিদুল আলম আল-জাজিরা টিভিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেটি দেখলেই বুঝা যায় – নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের বিষয়ে প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করার সাথে সাথেই তিনি বর্তমান সরকারকে অবৈধ আখ্যায়িত করে তার ক্ষোভ ঝাড়তে থাকেন একতরফা। আন্দোলনে দাবি মানা হয়েছে, ছাত্রদের সংযত হওয়া দরকার এমন একটি কথাও বলেননি এই সিনিয়র সাংবাদিক। বরং তার বক্তব্য ছিল এরকম, যেন এই মুহুর্তেই সরকারের পতন হোক!
শহিদুল আলম এই কাজটি খুব জোরেশোরেই করে আসছিলেন তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে। ৪ আগস্ট ২০১৮ তার নিজের ফেসবুকে তিনি বেশ কয়েকবার লাইভে আসেন। দেড় থেকে তিন মিনিটের স্থায়ী এসব লাইভ ভিডিওতে তিনি চোখে মুখে বেশ আতংক নিয়ে ইংরেজিতে কথা বলেন। যা পুরোটাই ছিল সরকারবিরোধী। ছাত্র আন্দোলনের বিষয়গুলো ছিল তার ভাষ্যে অত্যন্ত গৌণ। একটি বিষয় আমরা দেখছি, প্রতিদিন বাংলাদেশে শত শত প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়ায় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করে উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধ, রিপোর্ট, চিঠিপত্র লেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রের পুলিশ কি সবাইকে গিয়ে গ্রেফতার করছে? না করছে না।
তাহলে শহিদুল আলম কেন গ্রেফতার হলেন? এর কারণ হলো, তিনি খুব সচেতনতার সাথে ইংরেজিতে লাইভ করে বিদেশিদের দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের দিকে এবং তা তিনি করেছেন দেশের অভ্যন্তরে থেকেই। সংঘবদ্ধ একটি চক্রের মুখপাত্র হিসেবে তিনি বিবেকহীন প্রোপাগান্ডায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। রিমান্ডের নামে কোনো নির্যাতনই গ্রহণযোগ্য নয়। তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাকে ডাক্তার দেখানো থেকে বঞ্চিত করাও রাষ্ট্রের কাজ নয়। ছাত্ররা ঘরে ফিরেছে। সড়ক ও পরিবহন আইন হচ্ছে।
এই ছাত্র আন্দোলন কিন্তু শুরুতে গণ অধিকার আন্দোলন ছিল। কিন্তু এটাকে যখনই রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে- তখনই তা ইমেজ হারিয়েছে। আমরা দেখছি আজ একটি মহল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য পিটিশন সাইন কালেক্ট করছে। এরা কারা ২০০১-২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন জঙ্গীরাষ্ট্রের তকমা পেতে যাচ্ছিল- তখন কোথায় ছিলেন তারা? বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে হরে দরে দোষ দিয়ে লাভ হবে না। এই দেশে ছাত্রদল, শিবির, থাকলে ছাত্রলীগও থাকার অধিকার রাখে। আজ হঠাৎ করে যারা আওয়ামী লীগকে বধ করতে গিয়ে বিশ্বে গোটা দেশ ও জাতিকেই পদদলিত করার পায়তারা করছেন- তাদের আসল মতলব কী? তারা সরকার বদল চান। এর জন্য ভোটে আসতে হবে। তারা তো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও জয় পাচ্ছেন। তাহলে পেছনে ছুরি মেরে সরকার পতনের এতো খায়েশ কেন তাদের?
গণ-অধিকার আন্দোলনের মোড়কে সরকার পতন ঘটানো যায় না। আরব বসন্তের আদলে ‘বাংলা বসন্ত’র হাওয়া যারা গায়ে লাগাতে চেয়েছিলেন তারা চিহ্নিত হচ্ছেন ক্রমশ। এখন দেখা যাচ্ছে হেলমেটধারী যারা ধরা পড়ছে এরা বহিরাগত এবং বিএনপি-জামায়াতের সদস্য। রাষ্ট্রকাঠামোর আয়নায় মানুষের আশা-আকাঙ্খা দেখা যায়। দাবি করতে হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে। নিরাপদ সড়কের দাবি তেমনই ছিল। এটাকে দলীয় হীন স্বার্থে কারা ব্যবহার করলো- আমরা এদের প্রকৃত পরিচয় জানতে চাই।
_________________
ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।
একমত এবং আপনাকে ধন্যবাদ।
পড়লাম প্রিয় ইলিয়াস ভাই। পাঠক মনের কথা সমূহই তুলে ধরেছেন।
একটি বিষয় আমরা দেখছি, প্রতিদিন বাংলাদেশে শত শত প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়ায় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করে উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধ, রিপোর্ট, চিঠিপত্র লেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রের পুলিশ কি সবাইকে গিয়ে গ্রেফতার করছে? না করছে না।
তাহলে শহিদুল আলম কেন গ্রেফতার হলেন?
দুনিয়ার কোথাও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই।
*

