ফকির ইলিয়াস এর সকল পোস্ট

ফকির ইলিয়াস সম্পর্কে

কবিতা লিখি, থাকি নিউইয়র্কে।

ভ্রূণের শহর ছেড়ে

ভ্রূণের শহর ছেড়ে চলে আসা নদীর কাছে জানতে চাই,
পুষ্পেরা কেমন আছে। উত্তরে হাসে নদী, বলে –
ভাসাই বলেই আমি জোয়ারের জনক
আর যারা ভালোবাসার মর্মার্থ জানে,
তারাই বলতে পারে- কী মহান বিরহের ত্বক।

উজানের উৎস থেকে উঠে আসা মেঘের কাছে
জানতে চাই, তুমি কি পারো হে বন্ধু
পুঁতে যেতে ভাসানের বীজ..
আমাকে উদাস রেখে মেঘ চলে যায়,
পৃথিবীর অন্যবাঁকে, যমজ শিশু
আমাকে দেবে বলে, দুহাতে কুড়ায় খনিজ।

দ্রবণের প্রতিবেশী

নিশ্চয়ই পূর্বজনমে আমরা একই সমুদ্রে বসবাস করেছিলাম।
দ্রবণে ছিলাম তবে নোনাজল,
আর আমাদের প্রতিবেশী ছিল মনুষ্যপাথর সকল।

পাথরের ভিন্নচোখে দেখা হয়, যে ভবিষ্যত
মানুষের পদরেখা সে ছায়ায় একা হয়ে থাকে
কেউ পড়ে শিরোনাম, কেউ বসে মুখছবি আঁকে।

আমরা কি তবে সেই এঁকে রাখা জীবনের আলো
কালি আর রঙ মাখা- নগরের আদিম দর্শক
আঁকাবাঁকা নদীদের সহোদর- শাপলায় ডুবে থাকা বক।

ড্রামা ও ড্রাকুলা

পর্দা নামার আগেই সরে যাচ্ছে খলনায়কের দল। যারা
বাঁশি বাজিয়েছিল, পরিচালক কেড়ে নিচ্ছে তাদের হাতের
বাঁশি। নেপথ্যের সুরে যারা দিয়েছিল কণ্ঠ- ধমক দিয়ে
কেউ থামিয়ে দিচ্ছে তাদের গলা।

কেউ কেউ বদলে দিতে চাইছে রক্তদাগ মুছে ফেলার পদ্ধতি।
বলছে, একাত্তরেও রক্তাক্ত হয়নি এই মাটি,
যারা’ ভুল করে যুদ্ধ করেছিল, এখন বরং তারাই
করছে অনুতাপ’ – এমন কথাও বলছে কেউ কেউ।

তারপরও শরতের চাঁদকে সাক্ষী রেখে একটি কিশোরী
পা ভিজাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। ভরা আশ্বিনে সাইকেল
চালাতে চালাতে একটি কিশোর রোমন্থন করছে তার
বালকবেলা। যুবা কৃষকের লাঙল আর অষ্টাদশী তরুণীর
সেলাই মেশিনে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশ।
#

তোমাদের সংলাপ থেকে

তোমাদের সংলাপ থেকে আমার নাম মুছে ফেলতে পারো নি,
সে কৃতিত্ব আমার নয়। বরং সেই সমুদ্রের গান শোনে যে পাখি
উড়ে গিয়েছিল উত্তরে, আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম
আমার প্রিয় পতঙ্গেরা যেন নীলান্তেই খুঁজে পায় আমার নাম,
তাদের রিসাইকেল বিনেও যেন খুঁজে পায় আমার সদ্য
ডিলিট করা ছবি………

কিংবা আমার পোষা টিয়ে, যদি একদিন ফিরে আসে
এই ভিটেতে- সে যেন জানতে পারে,
আমার কাব্যলেখায় আমি ব্যবহার করেছিলাম
তার পালক। শুধু ‘কবি’র খাতায় নাম লেখাবো বলে।
#

ভালো থাকা ভোরগুলো

‘তোমরা সবাই ভালো থেকো’- বলতে বলতে একটি ছায়া
আচমকা মিলিয়ে যায়। একশত সতেরো বছর,
বেঁচেছিলেন লালন- ডাক তুলে একটি টিয়ে এসে
বসে সবুজ কার্নিশে। একটি ভোর তার সমগ্র যৌবন নিয়ে,
লিখেছিল যে কবিতা, সেই কবিতাটি কেবল
‘কবি,কবি’ বলে সারা দুপুর ভরে কাঁদে।

আসলে কান্নাকামী সমুদ্রই কেবল জানে সকল
প্রাণের দুঃখবাদ। নতুন ভোর উঠবে বলে যে কদমফুল
মাটিতে ঝরে পড়ে, সে ও নিজস্ব নিয়মে লিখে,
বিগত বোশেখের সরল পংক্তিমালা। আর মাটির গভীরে
ক্রমশ বড় হতে থাকে কঙ্কালের বিশালত্ব।

‘ভালো থেকো ভোর, ভালো থেকো কালের সুদূর’
এমন উপাখ্যান ছড়িয়ে নদী ও মেঘ গড়ে প্রবাহের মিতালী।
বড় অসহায় হয়ে এর পাশে এসে দাঁড়ায় জীবনের স্মৃতিগুলো।
#

………………………………………
[ সৈয়দ শামসুল হক- শ্রদ্ধাষ্পদেষু ]

একটি বাউল গান [] তোমার কোনো পরিচয় নাই

তোমার কোনো পরিচয় নাই,
আমি যদি ডাক না দেই
আমি তোমার ছবির বাহক
সাথেই আছি- কোথায় নেই!

১। সব কর্তৃত্ব আমায় ঘিরে
পাপ আর পূণ্যের সব বিচার,
তোমার হুকুম পালন করি-
আমার তো নাই অধিকার,
আমি ছাড়া তুমি বেকার,
লুকিয়ে আছ আলোতেই ।।

২। যুগে যুগে তোমায় খুঁজে
করছে যারা আত্মদান,
কোথায় নিয়ে রাখছো তাদের
কিসের বিচার, কি বিধান!
বলো প্রেমের কি প্রতিদান
দূরে সরাও নিমিষেই ।।

৩। ফকির ইলিয়াস বলে মায়ার
কঠিন শিকল নিয়ে পা’য়
পারি না আর চলতে আমি
বেড়েই চলছে দেনা-দায়
বাঁঁচবো আছি এই ভরসায়
শুধু তোমার পরশেই ।।

.
#
নিউইয়র্ক

বাংলাদেশ, দ্যা ল্যান্ড অব মুজিব

ff

আপনার ছবির দিকে তাকালেই
অনেকগুলো আকাশ এসে আমার
হাতের মুঠোয় ধরা দেয়!
অনেকগুলো পথ, পথের মিছিল,
আর মিছিলের মানুষেরা,
‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে
অতিক্রম করে বিশ্বের না না প্রান্ত
‘লিটল বাংলাদেশ’ কিংবা
‘শেখ মুজিব ওয়ে’ তে দাঁড়িয়ে
এই প্রজন্ম, মার্কিনী হাওয়ায়
ওড়ায় বাংলাদেশের পতাকা।

আপনার ছবির দিকে তাকালেই
অনেকগুলো কবিতা,
আমার মগজের কোষে ঢেউ তোলে,
একটি দোয়েলের জন্যে ভালোবাসা
একটি শাপলার জন্যে প্রেম;
লিখিত হতে থাকে পত্র-পল্লবে-
আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে স্যালুট
জানায় পৃথিবীর তাবৎ লাল ও সবুজ।

‘বাংলাদেশ, দ্যা ল্যান্ড অব মুজিব’
বলে যে মেক্সিকান সাংবাদিক
আমার বুকপকেটে হেলে থাকা
কোটপিনটি সোজা করে দিয়েছিলেন;
সেটাতে ওই মানচিত্র ছিল-
পতাকা দেখেই তিনি জড়িয়ে
ধরেছিলেন আমাকে,
আর বলেছিলেন-
উঁচু-শির মুজিবের মতোই এগিয়ে
যাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ।

🇧🇩

নিউইয়র্ক / ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জলপাহাড়

এত বৃষ্টি চারদিকে,
তবু ধুয়ে নিতে পারছে না আমাদের সম্মিলিত পাপ…
এত আগুন চারদিকে
তবু পুড়ে যাচ্ছে না অজগরের লকলকে জিভ

ঘূর্ণির প্রতিবেশী হয়ে থাকি
তবু উড়িয়ে নেবার শক্তি দেখি না
সবাই আমার চোখের দিকেই তাকায়
তবু পরিচিত কোনও মানুষ দেখি না…

পাখির ভাষা, মানুষের চলার পথ

পাখিভাষ্য শিখতে পারে না মানুষ। কিন্তু মানুষ পোষে পাখি,
উড়ে যেতে চায় পাখির ডানায়- চলে ও চালায়
জীবন, জীবনের ছায়া- জলের একান্ত প্রতিবিম্ব।

মানুষ যে অক্ষর ধারণ করে বুকের পাঁজরে- তার মাঝে
কি থাকে পাখির জন্য সামান্য ভালোবাসা!
অথবা যারা বৃক্ষ হত্যা করে, নগর পোড়ায়,
দখল করে নদী- তাদের প্রতি কি থাকে পাখির ধিক্কার!

পাখি ও মানুষ একই মাটিতে বসবাস করে পাশাপাশি-
তবু কি এক পরিতাপ এসে বিদ্ধ করে
আমাদের ঋতুকাল, আমাদের সংলগ্ন সবুজ।

মৃত ঘোড়ার মুখ দেখে

হর্সরেস শেষ হয়ে গেছে বেশ আগেই। যারা দেখতে এসেছিল ঘোড়দৌড়
তারা সবাই ফিরে গেছে নিজ নিজ গন্তব্যে। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।
আমার নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য না থাকায়— পথ থেকে পথে দীর্ঘদিন বড়
সুখে বাজিয়েছি সানাই। উৎসব নয়, তবু আনন্দে নেচেছি নদীর মতো।
আর আকাশের সীমানা থেকে ধার নিয়ে কিছু ছায়া, সাজিয়েছি নিজের
চৌহদ্দি। খুঁটি ও খড়ম দেখে যে পুরুষ নির্ণয় করতেন নিজের নিশানা—
ঠিক তার মতোই পিছু হাত দিয়ে তাকিয়েছি তারাবিহীন রাতের দিকে।

এই ঘোড়দৌড়ে এসেও আমি দেখতে চাইনি হার-জিতের ক্ষুদ্রতালিকা।
তাকিয়েছি লাগাম ধরা সওয়ারের দিকে। যে তার নিজের গন্তব্য জানে না,
তার ললাট লিখন দেখে হেসেছি অনেক ক্ষণ। তৃষ্ণায় কাতর ঘোড়াটির
হ্রেষাধ্বনি শুনে ভেঙেছে আমার পাঁজর। তারপর দেখেছি মাঠের মধ্যখানেই
হঠাৎ থেমে গেছে ঘোড়টির বুকের স্পন্দন। ধরাধরি করে ওরা সরিয়ে
নিয়েছে লাল অশ্বদেহ। আর দূরে পড়ে আছে শতবর্ষের পুরনো লাগাম।

মৃত ঘোড়ার মুখ দেখে নিজেকেই পরাজিত মনে হয়েছে বার বার। যে দৌড়
আজ থেকে অর্ধশতক আগে আমি দিয়েছিলাম— সে দিনটি কি বুধবার ছিল !

এই আষাঢ়ের চিঠি

দূরের পাখিরা জানে এই আষাঢ়ের অন্যনাম- তোমার চিঠি। অথবা ভালোবাসার
পুরনো খাম- নতুন অক্ষরে সাজানো একটি কদমফুল। ভুল করে উজানে বয়ে
যাওয়া নদীর প্রশ্বাস জমা রাখা দুপুর।

হতে পারে ভোর- কিংবা বাঁশির সুর। যে সময়ের কাছে রেখে এসেছি আলোর অতীত।
মনে পড়ে ? এই আষাঢ়েই আমরা গেড়েছিলাম আরেকটি বিশ্বাসের ভিত !

আর জীবনের সপ্তকলায় পরস্পরের
মুখ দেখে দেখে-
ঝড়ের প্রতীক্ষায় কাটে দিন- মাস
নতুন কোনো সংগ্রামের
মানচিত্র এঁকে।

এত রক্তপাতের পরও

যে কাঁটা গলায় বিঁধার কথা ছিল, তা বিঁধেছে চোখে
কিছুই দেখছি না আর,
কিছুই মনে করতে পারছি না, আদৌ
মানুষ ছিলাম কী না, কোনো জনমে
দাঁড়িয়েছিলাম কী না- কোনো মানুষের পাশে।

উড়ে যাচ্ছে পাথর। উড়ছে রক্ত- বাষ্প হয়ে
তারপরও আমাদের নিষ্ক্রিয় নাসারন্ধ্র, পাচ্ছে না
কোনো গন্ধ, পরখ করতে পারছে না বর্ণের ভাষা।
আর আমাদের পবিত্র(!) জনেরা বসে আছেন
যে পিঁড়িতে,
সে স্থান বড় উঁচু, যেখান থেকে মোটেও
দেখা যায় না সমতল পৃথিবী। তাদের মুখে
এঁটে আছে যে কুলুপ, সেটাও প্রাগৈতিহাসিক,
কালো কোনো দৈত্যের মৃত দাঁতখণ্ড।

মানুষের দিকে তাকালেই

মানুষের দিকে তাকালেই, আমার চোখের দিকে
উড়ে আসে একগুচ্ছ ছাই,
বৃক্ষের দিকে কান পাতলেই, বেজে ওঠে
একটি পুরনো করাতের ক্রন্দন ধ্বনি-
আর নদীর দিকে!
না, কী দেখি তা আর বলা যাবে না।

বলতে পারছি না অনেক কিছুই,
দেখতে পাচ্ছি না কবি কিংবা চিত্রশিল্পীদের
মুখ। যারা বাঁশি বাজায়, কিংবা যারা একান্তই
একলা থাকতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমি
সাজাতে পারছি না গাঁদাফুলের হলুদ সৌরভ।

ঢাকার যে সড়কগুলোকে নিরাপদ করার জন্য
আজ সন্তানেরা আন্দোলন করছে-
তাদের মনে করিয়ে দিতে পারছি না, প্রজন্ম হে!
ভাবো – ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’

অনর্থক এই বেঁচে থাকা নিয়ে যে আমরা
ভুলে যাচ্ছি ক্ষোভ,
তারা কি কখনও পরখ করেছিলাম মোমবাতির
মন! জানতে চেয়েছিলাম লাইটভালবের
বিবর্তন ধারা!

আমাদের জনপদে সূর্যগুলো আলোহীন হয়ে পড়ছে,
এই দুঃখ-গল্প আর কাউকে বলতেও চাই না।
অনেক আগেই কমেছে আমাদের বক্তাসংখ্যা,
এখন আমরা একে একে গুনছি,
কমে যাওয়া স্রোতাসংখ্যার সর্বশেষ স্রোতগুলো।

.
[ ১১ আগস্ট হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুদিনে ]
√ নিউইয়র্ক @ ১১ আগস্ট ২০১৮

বিশ্বস্ত বন্ধুদের প্রতি

এখন রপ্ত করতে চাই কীভাবে পালাতে হয়, কীভাবে দীর্ঘ করা যায়
বিভিন্ন ছুটিদিবস- কীভাবে অন্য কোনো গ্রহে পৌঁছে নেয়া যায়
মুক্ত নিশ্বাস। জানি সেদিন হয়তো থাকবে না আর এই শ্বাসকষ্ট,
এই পোড়ামাটিচিহ্ন লেগে থাকবে না আমার হাতে, অথবা যে ছবিগুলো
একদিন ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, সেগুলোও জোড়া লাগাবার প্রয়োজন
পড়বে না আর।

এবার শিখে নিতে চাই নাম-নিশানা মুছে ফেলার কৌশল, কেউ
জানবে না এই নগরের ভোটার তালিকায় আমারও নাম ছিল,
একদিন কলমও ছিল আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আর কাগজে
যে কাটাকুটিগুলো আমার পাঁজর ছিল- মূলত এরাই ছিল আমার কবিতা।

আমি পালিয়ে যেতে চাই,
মানুষ আমাকে পরাজিত পথিক বলুক
তারপরও,
যেতে চাই এই নগর থেকে অন্য কোথাও
যেখানে কেউ আমাকে আর চিনবে না
কেউ জানবে না পূর্বজনমে আমি আদৌ মানুষ ছিলাম কী না !

চাহনীর দূরমালা

আজকাল আমার, আমাকেই মনে পড়ে খুব-
আর মনে পড়ে সেই সড়ক, যে তার নাম ভুলে
গেছে অনেক আগেই। সবুজ শুশ্রূষা পেয়ে সেরে
উঠেছে যে নগর, তার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে একাকী
বেহালা বাজায় যে বিবাগী বাউল,মনে পড়ে তার
চাহনীর দূরমালা,কীভাবে স্পর্শ করে আকাশের মেঘ।

আজকাল নিজের নাম লিখে বর্ণিল অক্ষরে সাজাই তার
চারপাশ। রঙ দেখে চিনি আলোর ইন্ধন। লাল – কালো
রূপের তপস্যা। দেখি খুব কাছেই নোঙর ফেলছে নতুন,
আত্মকেন্দ্রিক ভোরের ছায়া। আর পুরাতন বিকেলগুলো
কিছুই পারেনি ভেবে ক্রমশ হারিয়ে যেতে চাইছে পূবের
দিগন্তে। ভাবি, মানুষও তো এমনিভাবে হারায় নিজেকে,
ভুলে যায় নিজ নাম। তারপর স্মরণের বেলায়, পোষে পাখি
নাম শিখিয়ে, উড়িয়ে দেবে বলে।