চকবন্দি চরাচর (৭) উপন্যাসাংশ

মহরমের প্যান্ডেল নিয়ে চাঁদ ওঠার আগে থেকেই উদ্যোগী না হলে চলেনা। আশমানি দ্যাওরদের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয় সব।
– আর বোলোনা ভাবি, গেল পাঁচ বচ্ছর ধরে চন্দননগর থেকে আলোকশিল্পী নিয়ে এসে প্যান্ডেল – পাড়া সব সাজাচ্ছি। এবছর এমন একটা রগচটা লোক পাঠিয়েছে যে তাকে কিছু বলাই যাচ্ছে না। লাখ টাকার বাজেট, তা তেনাকে কোন সাজেশন দেওয়া যাচ্ছেনা।

– এক এক মানুষ থাকে এমন। ভাবে, তার ওপর কেউ আস্থা রাখছেনা।

– তাই বললে হবে? এতো টাকা খরচ করছি, ভাল- মন্দ কিছু বলতে পাবো না?

– তা আলোর কাজটায় কি চাইছিস তোরা?

– মূল মঞ্চে তো বিশেষ পরিবর্তন করা যাবে না। সেখানে বরাবরের মতোই কারবালা যুদ্ধের দৃশ্য। ঢাল, তরবারি, বল্লম নিয়ে যুদ্ধ। ছুটন্ত ঘোড়া— চলন্ত রথ —

– রথ কি করে আনবি রে! একি মহাভারতের কর্ণ- অর্জুনের যুদ্ধ নাকি! আর, আরবের মরুভূমিতে রথ চলে নাকি!!

– না চলুক। আমরা চালাবো। স্টেজের দুপাশে দুটো কামান ও বসিয়ে দিয়েছি।

– তাহলে তো জাতশিল্পী চটে লাল হবেই।

– অত লাল- নীল হবার কি আছে? দিন বদলাচ্ছে, আর মানুষের চাহিদা বদলাবে না?

– আর এবারে যেন স্টেজের মাঝখানের কাটা হাতের পাঞ্জার নিচে বড় বড় করে “হজরত হোসেন” কথাটা লিখে দিস।

– সে আর বলতে! তবে শুধু শহুরে আনাড়িদের জন্য ওই বাড়তি কাজটা করতে হবে। অদ্ভুত বুদ্ধি! বলে কিনা, “আপনাদের এই অনুষ্ঠান কি কংগ্রেস পার্টি স্পনসর করছে?”

ওর বলার ঢঙে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আশমানির আবারো প্রশ্ন :
-আর গ্রামের চার দিকের চার গেট – এর জন্য কি ভেবেছিস?

জবাব দিতে একসঙ্গে সবাই উৎসাহে ফেটে পড়ে : এইবারের আইডিয়াটা এক্কেবারে সাম্প্রতিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই সবে সবে ইয়াহিয়া খানের কবল থেকে মুক্ত হ’ল বাঙালিজাতি – এখন মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাঙালির মাথায় আর কোন আইডিয়া আসতে পারে? বঙ্গবন্ধু মুক্তবাংলায় দাঁড়িয়ে স্যালুট নিচ্ছেন, আলোয় ভেসে উঠছে “জয় বাংলা”।

– এতো গেল পুবপাড়ার গেট।আর গুলো?

– পশ্চিম পাড়ার গেটে থাকবে পুরো সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে পূর্ববঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়েছেন জেনারেল মানেকশ। এখানেও প্রেক্ষাপটে আলোর মালায় লেখা: “সাবাস বঙ্গবন্ধু — জয় বাংলা।”….. আর দক্ষিণ পাড়ায় থাকছে পি- সি- সরকারের ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার আলোকসজ্জা। কিন্তু যত মুশকিল ওই উত্তর পাড়ার গেটসজ্জা নিয়ে, কিছুতে কাজ এগোতে দিচ্ছেনা। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া… কথায় কথায় খালি শরিয়ত টানছে….

– ছেড়ে দাও– কোরান- হাদিসের নির্দেশও যারা মানতে চায়না, কি বোঝাবে তাদের। সবচেয়ে বড় হ’ল হৃদয়ের ভালবাসা। ভালবাসতে কোন আইন জরুরী নয় — “মহব্বত হরওয়ক্ত্ বেদলিল হোতি হ্যয়”।

– ভালবাসা থাকলে কি আর ভাইয়ে ভাইয়ে এত হানাহানি হয়? —
পরমূহুর্তেই আবার সুর পাল্টে বলে,…
– কিন্তু ওদের ভাই ই বা বলছি কেন? ধর্মে মুসলমান হলেই কি ভাই হয়ে গেল? তাহলে তো হজরত হোসেনের হত্যাকারী এজিদ কেও ভাই বলে গলা জড়িয়ে ধরতে হয়, সে যে রীতিমতো পাঁচওয়াক্ত্ নামাজ পড়া মুসলমান। প্রথম ছুরিটা যে হজরত হোসেনের বুকে বসিয়েছিল, সেই সীমারও তো মুসলমান।

– সে তোমরা ভাই বলো আর না বলো, সীমার কিন্তু সত্যি সত্যিই হোসেনের সম্পর্কিত ভাই।
– সে কিগো! এযে ফের কুরুক্ষেত্রের গল্প শোনাচ্ছ….
– গল্প নয়। ইতিহাস। ফতেমার মৃত্যুর পর হজরত আলি সীমারের এক পিসি উম্মুল বানিন্ কে বিয়ে করেন।তো, সীমার খুবই ঈর্ষান্বিত ছিল এই ভেবে যে, তার পিসির সন্তানেরা বর্তমান থাকতেও হজরত আলির উত্তরাধিকারের ইসলামি দুনিয়ার খিলাফত কেবলমাত্র হজরত হোসেনই পাবেন।

– কেন, হাসান পেতেন না?

– তাঁকে তো আগেই বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। কুঁজি বুড়ি মন্হরার মতো কুটনি বুড়ি মায়মুনা এজিদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ছক অনুযায়ী হাসানের স্ত্রী জায়েদাকে দিয়ে হাসানের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। স্বপত্নী বিদ্বেষ। আরো একটা ব্যাপার ছিল, এজিদ জায়েদাকে বিবাহের প্রলোভন দেখায়। ওরা সম্পর্কিত ভাই – বোন ছিল। কাজ উদ্ধারের পর বিয়েটা কিন্তু আদৌ করেনি।

– এতো পুরো রামায়ন – মহাভারতের গল্প গো!
– এজিদ নিজেও ছিল হাসান- হোসেনের সম্পর্কিত মামা।
– সেই কংসমামার উপাখ্যান?
-হজরত মহম্মদের দ্বাদশ স্ত্রী উম্মে হাবিবা এজিদের আপন পিসি। হাসান- হোসেনের মা ফতেমা তাহলে এজিদের পিসতুতো বোন।

– ওরে ব্বাস্! সম্পর্কের এতো লতাপাতায় জট পাকিয়ে…….
– না। শুধু তাই নয়।এত সহজ নয় হিসেবটা। মূলকারন সুবিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বেষ-বিদ্বেষ জড়িয়ে……..
-একাধিক বিয়ে,নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে, সুস্থ সম্পর্ক তৈরীতে বাধা দেয়, বলো?
– খানিকটা তো দেয়ই। তবে এখানেও সেই একই কথা… হিসেবটা অত সহজ নয়।

তা যদি হতো, তাহলে সীমার যে ভাইদের জন্য হজরত হোসেনকে নিজে হাতে খুন করেছিল, সীমারের শত অনুরোধ স্বত্ত্বেও তারা কিন্তু শত্রু শিবিরে যোগদান করেনি। হোসেনের বৈমাত্রেয় ভাই হজরত আব্বাস আলি ও তাঁর ভাই ও সৈন্যসামন্ত সমেত কারবালা প্রান্তরেই নির্মম শহীদত্ব বরণ করেন। বিশ্বাসঘাতকের দলে নাম লেখাননি।

– দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ, আর নয়তো রামায়নের তরণীসেন।
– বলতে পারিস। তরণীসেনের কাটামুন্ড যেমন রামনাম করেছে, আব্বাসের কাটামুন্ডও “হায় হোসেন– হায় হোসেন” ধ্বনিতে শোকাকুল করে তুলেছিল কারবালার প্রান্তর।

(পরের বারে শেষ)

4 thoughts on “চকবন্দি চরাচর (৭) উপন্যাসাংশ

  1. অসাধারণ এক উপন্যাসের স্বাক্ষী হয়ে রইলাম দিদি ভাই। প্রণাম।

    1. প্রণাম নয় রিয়া,হাতে হাত রাখো।

      ভাল থাকো। 

  2. আপনার এই উপন্যাস … বলা যায় খণ্ডাংশ পড়ে পুরো বইটাই পড়ার ইচ্ছে জাগলো বন্ধু। ভালো থাকবেন। পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা আপনাকে। ধন্যবাদ।

  3. আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। ভাল থাকুন।     

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।