রাখি বন্ধন এক মৈত্রীর বন্ধন
রাখি নিয়ে অনেক মুনির অনেক মত আছে। যেমন –
১. আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতায় আর্যদের সময় রাখির প্রচলন ছিল।
২. দৌপদীর বস্ত্রহরণ এর পরে দৌপদীর ঋণ থেকে যায় কৃষ্ণের কাছে। কুরুক্ষেত্র যদ্ধের সময় কৃষ্ণ যখন ভীষণ আহত হয়ে পড়েন। তখন কৃষ্ণের ক্ষত কবজিতে দৌপদী তাঁর বস্ত্রখণ্ড ছিঁড়ে কৃষ্ণের ক্ষত স্থান বেঁধে দেন। রাখির সূচনা সেখান থেকেও হতে পারে। রাখি অর্থাৎ রক্ষা বন্ধন।
৩. দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বলির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না স্বামী ফিরে আসেন, ততদিন যেন বলি তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন হিসেবে পালন করে।
৪. কথিত আছে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতে। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।
৫. ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হয়ে রাজপুতানায় এসেছিল রাখি। চিতোরের রানি কর্ণবতী ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠান। গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানি কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর রাখী প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তবে সেনা পাঠাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ রানির দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান। ঐতিহাসিক রাখী পাঠানোর গল্পটি মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাথায় উল্লেখ পাওয়া যায়।
৬. তবে অতীত যাই বলুক না কেন, বাঙালির রাখির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন ভীষণভাবে।
১৯০৫ সাল। নানা কারণেই এই বছরটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই বছরটিতেই তখনকার ভাইসরয় লর্ড কার্জন নবচেতনায় জেগে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শ্বাসরোধ করার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করেন। সে সময়ে কার্জন অসমে চট্টগ্রাম ডিভিশন এবং ঢাকা ও ময়মনসিং জেলার অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিলে সারা বাংলা জুড়েই বিক্ষোভের ঢেউ উত্তাল হয়। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন রাজনৈতিক নেতারা, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জমিদাররা। ক্ষোভে ফেটে পড়েন বাংলার সাধারণ মানুষ। কার্জনের এই প্রস্তাবের বিরোধিতায় সমগ্র বাংলা জুড়ে বহু সভা ডাকা হয়। এই প্রস্তাবকে ধিক্কার জানিয়ে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলায়ই তখন ৫০০টি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। ১৯০৫ সালের ২০ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। ঐ বছরেরই ১৬ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করার কথা বলা হয়। শ্রেণি বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল মানুষই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি বলেন, আইনের সাহায্যে বাংলা ভাগ হতে চলেছে ৩০ আশ্বিন, কিন্তু ঈশ্বর বাংলার মানুষকে বিভক্ত করেননি। সেই কথা মাথায় রেখে এবং তা প্রকাশ্যে তুলে ধরতে ঐ দিনটি বাঙালির ঐক্যের দিন হিসেবে উদযাপিত করা হবে। তারই নিদর্শনস্বরূপ তারা একে অপরের হাতে বেঁধে দেবেন হলুদ সুতো। দিনটিকে রাখি বন্ধনের দিন হিসেবে পালন করার ডাক দেন বিশ্বকবি। অপরদিকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদিও অনশনের মাধ্যমে দিনটিকে শোকদিবস হিসেবে উদযাপনের প্রস্তাব দেন। দুটি প্রস্তাবই গৃহীত হয়।
১৯০৫ সালের ১৬ ই অক্টোবর ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি কলঙ্কের দিন আবার আনন্দের দিনও। এই দিন টুকরো হয়ে যাচ্ছে বিশাল বাংলা ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারনে আবার বাঙালীরা স্মরণ করছে তাঁদের সু-প্রাচীন ঐতিহ্যকে। একই সঙ্গে দুঃখের ও প্রতিবাদের কারনে দিনটিকে একটি বিশেষ ভাবে পালন করার চিন্তা করেন, যাতে অসংখ্য বাঙালীর আপামর স্বপ্নের বাংলা-বিভক্ত কারনে শেষ হয়ে না যায়। ঠিক হল এইদিন কলকাতার জোঁড়াসাকোর বাড়িতে রান্না হবে না। আর সকালে গঙ্গায় স্নান করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালীরা একে অপরের হাতে বেঁধে দেবে রাখি। যে হিন্দু-মুসলিম ভাইদের আইনের প্যাঁচে ফেলে ভাঙতে চাইছেন ব্রিটিশ সরকার, তা রাখি সেই বন্ধন রক্ষা করবে। জোঁড়াসাকো থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদের এই মিছিল চলে জগন্নাথ ঘাটের দিকে। মিছিলটার নেতা হিসাবে পুরোই ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। পাশে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে, তাঁরা যখন মিছিলে বেরিয়েছিলেন রাস্তার দুধার দিয়ে বাড়ির মহিলারা ছাদ বা ফুটপথ সব জায়গা থেকে খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে, উলু দিচ্ছে। সবকিছু যেন কোনোকিছুর শোভাযাত্রার মত। গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে সকলেই চলল … “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।” এই গানটি সেই সময়েই তৈরী হয়েছিল। ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারন্য। রবীন্দ্রনাথকে দেখার জন্য চারিদিকে ভীড় জমে গেল। স্নান করে সঙ্গে নেওয়া একগাদা রাখি একে-অপরের হাতে বাঁধা হল। রাখি পরানো নিয়ে মেতে উঠলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ছোট-বড় কেউ বাদ নেই … জাতি ধর্ম নেই … সকলেই সকলের জন্য মেতে উঠলেন। কেউ ভাবেননি যে একজন হিন্দু একজন মুসলিমের হাতে রাখি বাঁধছেন। তারপর ঘাট থেকে এগিয়ে গেল সেই শোভাযাত্রা। চিৎপুরে এসে রবীন্দ্রনাথ এক মসজিদে ঢুকে মৌলবীদের হাতে রাখি পরালেন। না হল কোনো হাঙ্গামা, না হল কোনো অসন্তোষ। মৌলবীরা সাগ্রহে মেনে নিলেন, আর নেবেন না কেন। এইভাবে শুরু হল রাখি বন্ধনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
এসবেরই অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ঐ দিন এক বিশাল মিছিল গঙ্গার উদ্দেশে রওনা হয়। মিছিলে অংশ নেন সমাজের বিশিষ্ট ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। ঐদিন সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। রাস্তায় কোন যানবাহনও ছিল না। বাংলার স্বাভাবিক জীবন ছিল সেদিন অচল। গঙ্গায় ডুব দেওয়ার পর তারা একে অপরের হাতে রঙিন সুতো বেঁধে দেন। বাংলা তথা বাঙালির ঐক্য, বাঙালির সংস্কৃতি, তাদের আশা আকাঙ্খা তুলে ধরে গান লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন সারাদিনই কলকাতা তথা সমগ্র বাংলা জুড়ে ঐ গানটি ধ্বনিত হতে থাকে-
‘বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’, মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ কবিগুরুরই লেখা একটি গান গাইতে থাকেন। তারই কিছু অংশ-
‘চিরদিন টানবে পিছে, চিরদিন রাখবে নীচে-এত বল নাই রে তোমার, সবে না সেই টান।।
আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে, বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরীখান।।’
এর মধ্যে দিয়েই ব্রিটিশের একগুঁয়েমিকে ধিক্কার জানান বিশ্বকবি। সারা বাংলা সে সময় গুঞ্জরিত হতে থাকে এই সব গানে। কোন কোন গানে উঠে আসে রাজনৈতিক অধিকার কায়েমের ব্যর্থ বা লজ্জাজনক প্রচেষ্টা, কোথাও বা নদী ঘেরা ছায়া সুশীতল বাংলার গৌরবের কথা, শস্যশ্যামলা বাংলার ধানক্ষেতের কথা, তার তরুচ্ছায়াবৃত গ্রামগুলির কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেন তার সেই বিখ্যাত গান-
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।”
তিনি চেয়েছিলেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী এক থাকুক অটুট বন্ধনে। পরবর্তীকালে এই দিনটিই একটি ইতিহাস হয়ে রইল। এ উৎসব বন্ধুত্বের, এ উৎসব ভ্রাতৃত্বের, এ উৎসব সম্প্রীতির।
আমরাও বলবো … জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী এক থাকুক অটুট বন্ধনে। উৎসব হোক বন্ধুত্বের, উৎসব হোক ভ্রাতৃত্বের, উৎসব হোক সম্প্রীতির। ভালোবাসা প্রিয় বন্ধু।
আপনিও ভাল থাকুন বন্ধু। শুভেচ্ছা নিন।
বাহ ! চমৎকার ! চমৎকার !
এতকিছু জানা ছিল না রাখি বন্ধন নিয়ে। আপনাকে ধন্যবাদ কবি।
শুভ রাখি বন্ধন।
আপনাকেয়ো ধন্যবাদ প্রিয় কবি।
তথ্যপূর্ণ লেখা। ভাল লাগল। শুভেচ্ছা দিদিভাই।
ধন্যবাদ এবং প্রণাম দাদা।
শুভকামনা সবসময়।
আমিও চাই, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী এক থাকুক অটুট বন্ধনে। উৎসব হোক বন্ধুত্বের, উৎসব হোক ভ্রাতৃত্বের, উৎসব হোক সম্প্রীতির। বাঙ্গালীর পরিচয় একমাত্র বাঙ্গালী, আর কিছু নয়।
ভালোবাসা প্রিয় বন্ধু
ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী থাকুক অটুট বন্ধনে। ভালবাসা আপনাকেয়ো।
রাখি বন্ধন এক মৈত্রীর বন্ধন
**





আজকের দিনে অনেক শুভেচ্ছা কবি দা।
বাহ!জেনে আনন্দিত হলাম রাখি বন্ধন আসলে হিন্দু-মুসলিম সকলেরই একটি বিশেষ প্রথা
আমিয়ো আনন্দিত হয়েছি শেয়ার করতে পেরে। ধন্যবাদ ইলহাম দা।
রাখি বন্ধন এক মৈত্রীর বন্ধন।
তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
এক থেকে পাঁচের কথাগুলি খুব মন দিয়ে পড়লাম; ইতিহাসটুকুও। সংস্কৃতি নিয়ে লেখা; অনেক ভালোলাগা কুড়িয়ে নিলাম।
১ থেকে ৫ পর্যন্তই পড়লাম। বাকিটুকু বাকি রইলো।