অণুগল্পঃ মুহিতের কোটি বছরের পাঠ

বিষয়টা কাকতালীয় কিনা মুহিতের জানা নেই। এই সপ্তাহে আজ নিয়ে তিনদিন সে দিনের কিছুটা সময় বাসায় একা থেকেছে; যা সচরাচর ঘটেনা এবং বেছে বেছে এই তিন দিনই ঠিক একা থাকাকালীন সময়ে সামিয়া বাসায় এসেছে। প্রথম দুদিন মুহিত তাকে দরজার ওপার থেকে বিদায় করে দিয়েছিল।

সামিয়া ইসলাম; সম্পর্কে মুহিতের অল্প দূরত্বের শ্যালিকা। মুহিতের বিয়ের পর পর সামিয়া বিশেষ কারণে প্রায় মাস খানেক এই বাসায় ছিল। সহজ সরল এবং খুব বিনয়ী। কাছের লোকেরা বলে, “একেবারে ফার্স্ট ক্লাস একটা মেয়ে”!

সামিয়া আজ শীতের পিঠা নিয়ে এসেছে। হয়তো “ভ্যালেন্টাইন ডে” মাথায় রেখে। হার্ট-শেপ পিঠা। মুহিত মনে মনে ভাবে, মেয়েটা কেন তার বোনকে ফোন করে আসেনা? ওর বাসা বেশি দূরে নয়- কেবল এজন্যই কী?

-তোমার বোন দুই ব্লক পরেই একটা বাসায় গেছে; তোমার আসার কথা ওকে জানাচ্ছি
-না থাক, আমি এখনি চলে যাবো।
কথাটা বলার সময় সামিয়ার মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল।

-আচ্ছা, ঠিক আছে।
মুহিত জবাব দিলো।

ডাইনিং স্পেসে বসতে দিয়ে সে সামিয়ার মেয়ের কুশল জেনে নিলো। বছর দেড়েক আগে সে বিধবা হয়েছে। উনত্রিশ বছর বয়সে। মুহিতের মাও প্রায় একই বয়সে বিধবা হয়েছিলো। সামিয়াকে আবার সংসার করার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েকবার বলা হয়েছে। কিন্তু যতোবার এসব নিয়ে কথা হয়েছে ততোবার সে কেঁদে দুচোখ ভাসিয়ে দিয়েছে।

“উনত্রিশে তো অনেকে বিয়ে করে”, মুহিত ভাবলো এবং বিষন্ন হয়ে সে একবার সামিয়ার দিকে তাকালো।

-তোমার বাবার শরীর এখন কেমন?
সামিয়ার বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। হার্ট ফাউন্ডেশনে ডাক্তার দেখাতে তিনি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ওঠেছেন।

-বুঝতে পারছিনা। এঞ্জিওগ্রামে ব্লক এসেছে। কিন্তু ডক্টর রিং পরাননি। ওপেন হার্ট সার্জারির পরামর্শ দিয়েছেন।
সামিয়া জবাব দিলো।

এরপর দুজন কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। সামিয়ার গা থেকে পারফিউমের তীব্র গন্ধ তার নাকে আসছে। মুহিত চাইছিলো সামিয়া তাড়াতাড়ি চলে যাক; তাই সে অনর্থক কথা বাড়াচ্ছেনা। আসলে আগের দুদিন ঘরে ঢুকতে না দেয়ার অপরাধবোধ থেকে সে আজ ওকে ভিতরে বসতে দিয়েছে। নইলে আজও তাকে কৌশলে দরজা থেকে বিদায় করে দিত। মহিলা বলে নয়; একা থাকলে সে কাউকেই ভিতরে আনার আগ্রহ দেখায়না। একাকীত্ব নয়; “কিছু সময় একা থাকা” সে উপভোগ করে। তখন সে নিজের ভিতরের আরেকজন মুহিতকে খুঁজে পায়। সে বিশ্বাস করে, দিনের কিছুটা সময় একা থাকতে পারলে তখন মানুষ কার্যকরভাবে একাকীত্ব দূর করতে পারে। বহুজনে মানুষ বরং বেশি নিঃসঙ্গ হয়!

-কিছু বলবে সামিয়া?
নিরবতা ভেঙ্গে মুহিত জানতে চাইলো। কিছুদিন আগে সামিয়া বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। মুহিত ভাবলো, আজ হয়তো সেজন্যই এসেছে। লজ্জায় বলতে পারছেনা।

কিন্তু সামিয়া কোন জবাব দিলোনা। সে মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ফ্লোর ঘষতে লাগলো।

মুহিত আবার প্রশ্নটা করলো।
এবার সামিয়া মাথা তুলে তাকালো।

মুহিত দেখলো সামিয়ার দুচোখে বিশ্বটাকে পুড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্রমাগত আগুন জমা হচ্ছে। সেগুলিকে মুহিত তার হিসেবের যন্ত্রে নিয়ে যোগ বিয়োগ করার চেষ্টা করলো। সে অনুমান করলো, গত দেড় বছরে সামিয়ার চোখে এতো বেশী আগুন জমা হয়েছে যে তা পড়তে কোটি বছর লেগে যাবে।

সামিয়া চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ালো। কিন্তু মুখে বললোনা যে, “আসি”। এর মানে, যাওয়ার জন্য সে ওঠে দাঁড়ায়নি। মুহিতের বুঝতে অসুবিধা হলনা যে সামিয়া হঠাৎ খুব সাহসী হয়েছে; সে এখনি হয়তো তার দিকে পা বাড়াবে।

তার ধারণাই ঠিক হলো।

কিন্তু সামিয়া যতোই এগোতে থাকলো মুহিতের ভিতরের মুহিত ততো প্রবল ভাবে জেগে ওঠতে লাগলো। সেই মুহিত তখন সামিয়ার আঁচল জুড়ে লেখা কেবল একটা শব্দই বৃহৎ হতে বৃহত্তর হতে দেখলো, “মা”!

11 thoughts on “অণুগল্পঃ মুহিতের কোটি বছরের পাঠ

  1. ছোট বা অণু লিখনের অন্যতম উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখিয়েছেন মিড দা। বুনন সুন্দর।

  2. রীতিমত চমকেই গেলাম শেষ দৃশ্য টুকু কল্পনা করে। হোয়াট এ সাসপেন্স মি. মিড !!

    1. মন ভরে যায় এমন মন্তব্যে। যারপর নাই আনন্দিত হয়েছি !

      অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা মিঃ মুরুব্বী!

  3. শেষটায় এসে অতিপ্রাকৃত মনে হলেও আমার কাছে অণুগল্পটি ভালো লেগেছে।

  4. * অনুগল্প রচনায় আপনার সিদ্ধহস্ততার পরিচয় মেলে… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  5. আপনার কমপ্লিমেন্টে আনন্দিত হয়েছি।

    অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কবি!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।