মিড ডে ডেজারট এর সকল পোস্ট

মিড ডে ডেজারট সম্পর্কে

I shall say bye to my sleepless night if “tomorrow” comes to me with a message that I’m waiting for last twenty years, Then I shall pray for one more “tomorrow” to send you back pieces of clouds bottle of dew and a “one-sea tears”!

স্মৃতিকথনঃ হয়তো সেই “ভুল মনে হওয়াটা”ও ভুল ছিলো

সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম ড্রাইভার বললো,
“একটু ডানে তাকান”।

একজন ত্রিশোর্ধ্ব মহিলা তাকিয়ে ছিলেন।

জানতে চাইলাম,
“কে উনি?”

“কয়েক মাস ধরে যে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।”
পোস্তুন ড্রাইভার জবাব দিলো।

আমার বাঙালি বাবুর্চি খাবার পরিবেশনের সময় বেশ কবার মহিলাটির অনুরোধের কথা জানিয়েছিলো। সে ইউএস প্রবাসী; রহস্যময় কারণে পাকিস্তানে অবস্থান করছিলো। বাবুর্চি ছাড়া আরো কেউ বিষয়টা জানতো ধারণা করিনি।

যে বিশ্বাস নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করিনি তখন সেটাকে ভুল মনে হলো।

হয়তো সেই “ভুল মনে হওয়াটা”ও ভুল ছিলো।
কে জানে?!

প্রেমের পিদিম বাতাসে নিভেনা

ট্রেনটা যখন জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে থামলো তখন মধ্যরাত। আসিফের মনে হল, কেউ একজন তাকে ট্রেন থেকে টেনে নামাচ্ছে। বাস্তবে ছেলেবেলায় একবার ঘোড়ার গাড়ি থেকে তাকে টেনে নামানোর ঘটনা ঘটেছিল। পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলো; নায়লা তাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে বলেছিল, “এই, তুমি আমার সাথে খেলতে চাওনা কেন?” দুজন তখন একই স্কুলে পড়তো। নায়লা উপরের ক্লাসে হলেও আসিফ তাকে তুই সম্বোধন করতো। নায়লার বউ-জামাই খেলার আবদারে সে সব সময় লজ্জা পেতো।

জগন্নাথগঞ্জ ঘাটই শেষ স্টেশন। ট্রেনটা ফিরে যাবে। কিন্তু আসিফ দেখলো, কেবল সেই ই নেমেছে। তাইলে ট্রেনে কী আর কোন যাত্রি নাই? নাকি এই রকম রাতে আর কেউ নামার সাহস পাচ্ছেনা? এক দৌড়ে সে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। সে আবার তাকালো। নাহ, আসলেই কেউ নামছেনা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আসিফ বৃষ্টির মধ্যেই হাটা শুরু করলো। কয়েক কদম হাঁটার পর দেখলো, রাস্তাটা তিনদিকে গেছে। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। যদি তেমন কাউকে পায় পথ চিনে নিবে। মিনিট পাঁচেক পর অদ্ভুত পোশাকে এক জটাধারী লোককে আসতে দেখলো। তার হাতের লাঠি পা ফেলার সাথে তাল মিলিয়ে ঝুনঝুন বাজছিলো।

-মাহীপুর কোন পথে?

লোকটা কাত হয়ে আসিফের দিকে তাকিয়ে বললো,
-হকক মওলা

শব্দটার আকস্মিকতায় আসিফ চমকে ওঠলো।
লোকটা আর কিছুই না বলে চলে গেলো। আসিফ ভেবে পাচ্ছিলোনা এখন সে কী করবে? তার মনে পড়লো, লোকটা তার হাতের লাঠি অল্প উত্তরমুখি করেছিলো। আসিফ উত্তরের পথটাই বেছে নিলো।

বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর বামে একটা নদি পড়লো। এমনি হবার কথা। নায়লা চিঠিতে একবার নদির কথা বলেছিল। অল্প দূরে একটা নৌকায় পিদিমের আলো দেখা যাচ্ছে। আসিফের বুকটা হুহু করে ওঠলো। নায়লা তার চেয়ে আগে শরীরে কৈশরের চিহ্ন পেয়েছিলো। তখন সে নিজে থেকেই বউ-জামাই খেলা বাদ দিলেও আড়ালে আবডালে আসিফকে কাছে টেনে নিয়ে বলতো, “বিয়ে হলে আমরা মধ্য নদিতে পিদিমের আলো জ্বালিয়ে বাসর করবো। করবেনা?” এর মাস কয়েক পর আসিফ তাঁকে একটা পিতলের পিদিম উপহার দিয়েছিল; নামের প্রথম অক্ষর খোঁদাই করে।

আরেকটু পর একটা বাঁশবন পড়লো। বেশ অন্ধকার। সে দ্রুত পা চালালো। বনটা পেরোনোর পর পরই মাথার ওপর দিয়ে কিছু একটা শব্দ করে উড়ে গেলো। আসিফ ভাবলো, কোন পাখি হয়তো পথ হারিয়েছে। আরো দশ পনের মিনিট পর একটা বাড়ির মতো কিছু একটা তার চোখে পড়ল। আরো কাছাকাছি হবার পর স্পষ্ট হলো, আশপাশে কোথাও কিছু নাই; কেবল ওই বাড়িটাই। ভিতরে আলো জ্বলছে। একটু অদ্ভুত লাগলেও আসিফ বাড়িটাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আরো কতো পথ যেতে হবে কে জানে? ভারি পানি পিপাসা লেগেছে।

-কেউ আছেন?

আসিফ কোন উত্তর পেলোনা।

আবার ডাকলো,

-বাড়িতে কেউ আছেন?

এবারও সে কোন উত্তর পেলোনা।

অতঃপর যেই সে হাটা শুরু করলো- দেখে সম্মুখে সেই জটাধারী লোকটি; অকস্মাৎ উপস্থিত হয়েছে!

লোকটা এবার পথ চিনিয়ে যাচ্ছে।
তার হাতে ঝুনঝুন লাঠির বদলে নাম খোঁদাই করা একটা খোলা পিদিম; এতো বাতাসেও নিভছেনা!

প্রেমের পিদিম বাতাসে নিভেনা!

লেখা চুরি এবং আজকের পত্রিকার একটা খবর

ফেইসবুকের কল্যাণে লেখা চুরি বা নকলবাজির ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। কেউ হুবহু নকল করে, কেউ বিদঘুটে কিছু শব্দ যোগ করে মূল লেখায় একটু পরিবর্তন এনে অন্যের লেখাকে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। কেউ আবার থিমটা চুরি করে। এসব প্রতিদিনই দেখছি। এদের আবার গ্রুপ আছে; ভক্তগ্রুপ। কিছু বলতে যাবেন তো ভক্তকুল নাকানি চুবানি খাওয়ায়ে ছাড়বে; নানান রকমের যুক্তি দিয়ে চুরির সংজ্ঞা বদলে দেবে।

বহু পুরানো একটা গল্প; যারা স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিয়েছেন তারা সবাই হয়ত সেটা জানেন। গল্পটার সারাংশ মোটামুটি এমনঃ প্যারেন্টের ট্রাঙ্কের ভিতর মূল্যবান কিছু আছে এই লোভে সন্তানেরা ফন্দি আঁটে এবং শেষে ওতে আত্মার সম্পদ ছাড়া বৈষয়িক কিছুই খুঁজে পায়না। এমন অতি পরিচিত একটা গল্পকেও অল্প বদলে নিজের করে ফেলেছে এমন একটা “চুরি-মাল” ফেবুতে জাস্ট দেখে এসেই এই কথাগুলি লিখছি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ঐ চুরি-মালের ভূয়সী প্রশংসা করে এখন অবধি হৃৎপিণ্ড চাপড়াচ্ছে! কী লজ্জার!

এই লজ্জাজনক চুরির ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হল, এদের ভক্তের অভাব নেই। কেউ না জেনে এদের ভক্ত হয়; কেউ জেনে। দ্বিতীয় জনেরা এই চোরদের মতই পাপী।

ওপরে যা বললাম তা আসলে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা মাত্র। মূল বিষয় হল, কালের কন্ঠ পত্রিকায় আজ প্রকাশিত একটা খবর। “একজনের লেখা চুরি করে আরেকজন প্রকাশ করলেন আস্ত বই”। পত্রিকার এই সংবাদ এবং ফেবুতে একটু আগে দেখা চুরির মালটার কারণে আমার পুরানো প্রশ্নের একটা আপাতঃ জবাব পেয়েছি, “ফেবুতে চোর-চোট্টার সংখ্যা নেহায়েত কম না।“ এদের কেউ আবার ভক্তদের কাছে “জিনিয়াস” হিসেবে স্বীকৃত। ফেবুতে এখন যাকে দেখে এলাম এবং পত্রিকায় যার কথা উল্লেখ আছে তারা দুজনই দেখলাম তাদের নিজ নিজ ভক্তদের কাছে খুব সমাদৃত।

কোন সন্দেহ নেই, লেখা চুরির দায়ভার মূলত চোরের। কিন্তু পুরোটাই কী? যারা জেনে শুনে এইসব চোরকে সাধু সাধু বলছে তারা কী এই দায় এড়াতে পারবে?

প্রক্ষালন, হাগন কুঠি এবং অসহায় কবিতা পাঠক

একঃ
গতকাল শুক্রবার ছিল। বন্ধু মাজহারের চেম্বারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
-এখানে “প্রক্ষালন” কোথায়?
এক মিলিটারি বন্ধু মাজহারকে প্রশ্ন করলো।

উপস্থিত অন্য বন্ধুরা যে যার মতো করে প্রক্ষালনের অর্থ করে মাজহারকে একই প্রশ্ন করতে লাগলো। প্রশ্নে জর্জরিত বন্ধুটি তখন উল্টা জানতে চাইলো,
-তবে কী ইহা কোন মিলিটারি জারগন?
-নহে, নহে। ইহা “হাগন কুঠি”!
মিলিটারী বন্ধু জবাব দিল।

দুইঃ
কবিতার খাতা হাতে দিয়ে একদিন এক আত্মীয়া বললেন, “দেখো তো বাবা, কেমন হয়েছে”! পড়ে দেখলাম। তাঁর ছেলের লেখা কবিতা। ছেলে সবেমাত্র “ও” লেভেল উত্তীর্ণ তখন। আমি গ্র্যাজুয়েশন করছিলাম।

কঠিন সব শব্দ দিয়ে কবিতার নামে সেই আত্মীয়া-পুত্র যে কী লিখেছিল সেদিন তা উদ্ধার করতে পারি নাই। পরে জেনেছিলাম, কোন বড় কবির লেখা টুকিয়ে শব্দগুলি যতোটা সম্ভব পরিবর্তন করে সে নিজের বলে চালিয়ে দিতো। এজন্য সে অভিধান থেকে কঠিনতম সব প্রতিশব্দ খুঁজে বের করতো। তারপর আমি আর তার লেখা পড়ার সাহস করি নাই।

আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা। আমার ফেবু লিস্টে এক কবি যুক্ত হলেন। তিরিশোর্ধ। কয়েকটা কবিতা দেখেই মোটামুটি ঠিক করে রাখি, তার কবিতা পড়ে অনর্থক সময় ব্যয় করবোনা। গয়-গত্তিকে যদি হঠাৎ তার লেখা পড়ে ফেলতাম; তখন নির্মমভাবে মনে হত, “বাংলা কী সত্যিই আমার মাতৃভাষা?!”

প্রায় একই রকম শতটা গল্প আছে। কোন কোন লেখা আমাকে মিসলিড করেছে। প্রথমে সেসবের কাব্যসুখে উচ্ছ্বসিত হয়েছি। পরে নকল জেনে লজ্জিত হয়েছি। আমি আর তাদের লেখার পাঠক থাকিনাই।

একটু মন দিয়ে পড়তে গিয়ে যে বিষয়টা উদ্ধার করেছি সেটা হল, ওপরের ঐসব কবির অনেকেই হয়ত তাদের কবিতার কোন অর্থ দাঁড় করাতে পারবেনা। কারণ উদ্ভট সব শব্দযোগে অনেক সময় তারা শুদ্ধ বাক্যও গঠন করতে পারেনাই। তারা সবাই আসলে কবিতা নকল করতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছে।

তিন (শেষ)ঃ
আগে একটা গ্রুপে যেতাম। ওটাকে কবিতার জন্য সবচে উন্নত গ্রুপ মনে হতো। গ্রুপটা সম্ভবত এখন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছে। সেই জৌলশ নাই; আমিও তাই গ্রুপটাতে যাইনা। একেবারেই সময় পাইনা; তবুও মাঝে মধ্যে ভালো লেখা পড়তে ইচ্ছে করে। সম্প্রতি একটা ফেবু গ্রুপে যুক্ত হয়েছি। সেখানে একজনের কবিতা পড়ে আমি কোনভাবেই কোন অর্থ দাঁড় করাতে পারছিলাম না। তখন আগের কথাটা নির্মমভাবে মনে এলো, “বাংলা কী সত্যিই আমার মাতৃভাষা?!” কিছুটা কিউরিয়াস হয়ে এই একটু আগেই তার ওয়ালে গেলাম; এবং সেখানে যা (কবিতা) পেলাম তাতে গতকাল সকালের আড্ডাটা খুব মিস করতে লাগলাম!

কারণ গতকালের আড্ডাটা যদি আজ এখন হোত তাইলে কবিতাটা দেখায়ে বন্ধুদেরকে বলতে পারতাম, “পাইয়াছি পাইয়াছি; তোরা দ্যাখ, এইতো এই যে প্রক্ষালন পাইয়াছি!”

কবিতা, কবিতা চুরি এবং

বেশ আগে এই ব্লগে কবিতা নিয়ে লিখেছিলাম। সেখান থেকে একটা কথা উল্লেখ করিঃ কবিতা হল মূলত বিনির্মাণ। এই কথাটার সাথে তখন এখানে সবাই একমত হয়েছিলেন। কবিতার আরেকটা জরুরি অনুষঙ্গ হল অভিঘাত। এটা খুব জেনে বুঝে পুরো কবিতার সাথে একটা সুসম্পর্ক রেখে করতে হয়। নইলে তা হাস্যকর এবং অর্থহীন হয়।

কবিতার যাবতীয় প্রকরণের বাইরের অথচ আবশ্যকীয় একটা বিষয় হল পরিচ্ছন্নতা। কোন যুক্তি দিয়েই কবিতায় অশ্লীলতাকে/নগ্নতাকে জায়গা দেয়া যায়না।

আমার নিচের কবিতাটা একজন চুরি করেছে। চুরি করার পর যা হয়েছেঃ
ক) আমার কবিতাটা চোর তার মত করে সাজাতে গিয়ে হাস্যকর অবস্থার তৈরি করেছে। বিনির্মাণগুলির বেহাল অবস্থা হয়েছে। চোর কী আর বিনির্মাণ বুঝে?!
খ) সে অভিঘাত জানেনা নিশ্চিত। কিন্তু কবিতাটায় অনুরুপ (অভিঘাত) কিছু করতে গিয়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে !

আফসোস হয়, আমার কবিতাটা এমন একজন চোরের হাতে পড়েছে যে ঘোষনা দিয়ে ১৮+ কবিতা লিখে যা কখনো কখনো একটা সম্পূর্ণ পর্ণ মুভির মতো হয় !

ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে এসব থাকবেই জানি। তবুও যখন জেনেছি তখন মনে মনে বলেছি, চুরিই যদি করবি তো কবিতা কেন?

—–

মনলতা ওয়ার্মিং

ঘটনাটা হঠাৎ করেই ঘটে গেল-
ঈশ্বরকে চমকিয়ে দিয়ে উত্তর মেরুতে
কোটি গুণ বেশি বেগে বরফ গলতে শুরু করলো;
ফলে সমুদ্রতীর থেকে শহরে এবং
দেশ থেকে দেশে বানের মতোন
মানুষের ঢল নামলো।

আবহাওয়ার জোরালো ফোরকাস্ট মিথ্যে করে দিয়ে
শীতপ্রধান দেশে শীত শতগুণ হলো
এবং মঙ্গলসহ জলশূন্য সব গ্রহ নক্ষত্র
জলে ডুবে গেলো।
মহাকাশ স্টেশণ ছেড়ে নাশার বিজ্ঞানীরা
হন্যে হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে
নূহের নৌকা খুঁজতে লাগলো।

পরিণামে দেশে দেশে যুদ্ধ হলো,
রাস্তায় নারীরা ভ্রষ্ট হলো;
আকাশ ভাঙ্গলো
চন্দ্র ভাঙ্গলো
সূর্য গলে বৃষ্টি নামলো;
এইভাবে তিনদিন কেটে গেলো !

অতঃপর একটু আগেই ব্রেকিং নিউজ হয়েছেঃ
মহাবিশ্বের কোথাও আর অস্বাভাবিক বরফ গলছেনা
এবং সমুদ্রের সব বাড়তি জল আজ ভোরে উত্তর মেরুতে ফিরে গেছে !
কারণ তিনদিন পর আজ ভোরেই
মনলতার
গায়ের
জ্বর
নেমে গেছে !

—————————————
#গ্লোবাল ওয়ার্মিং অনুকরণে নাম দেয়া হয়েছে। ধারণা করা হয়, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ এরকমই কিছু ঘটবে।

ছোটগল্পঃ নীরাপুরের চিঠি

“…………পরে অবশ্য ভাবিয়াছি, আমি তাহার কাছে বন্ধক রাখা কোন সম্পত্তি নহি যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া আমার মরিবার বা বাঁচিয়া থাকিবার সব আয়োজন করিতে হইবে! আড়াইকুড়ি বছর পার করিবার পরও তাই আজ স্বপ্ন দেখিতেছি, যদি আমার চোখে তুমি একটা ঝলমলে রাতের আকাশ আঁকিয়া দাও !”

এইটুকু পড়ে রাশেদুল ইসলাম চিঠির খাম হাতে নিলো। নীরাপুর থেকে মেহেরুন নেছা তার স্বামীকে নিয়ে এই চিঠিটা লিখেছে। প্রাপকঃ রাশেদুল ইসলাম।

কালো কালির সীলমোহরে পোষ্ট করার তারিখ উল্লেখ আছে; ৯ই মার্চ ১৯৫৯। রাশেদুলের হাতে পৌঁছতে প্রায় তিন মাস সময় লেগেছে। সে ঝটপট গোছগাছ করে নীরাপুরের ট্রেন ধরলো। তেমন প্রস্তুতি নেই। মেহেরুনের ঝলমলে আকাশটা আঁকার জন্য অবশ্য সে অন্তর ভরে জোছনা নিয়েছে।

ইতোমধ্যে নানান যাত্রীতে বগি ভরে গেছে। পুরুষ আছে, মহিলা যাত্রীও কম নয়। খোলা মাঠ, বন-পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ট্রেনটা ছুটে চলেছে। ট্রেনের হুইশেলের সাথে রাশেদুলের বুকটা মেহেরুনের জন্য হুহু করতে লাগলো। ব্যাগে রাখা পানের বাক্স থেকে এক খিলি পান মুখে নিয়ে চিবাতে লাগলো। কি জানি কী মনে করে সে মেহেরুন নেছার বর্তমান ঠিকানা আবার দেখে নিলো। বর্তমান ঠিকানাটা আদৌ বর্তমান আছে কিনা কে জানে? চিঠির একটা অংশে তার চোখ আটকে গেলো।

“মধুরাতে নরনারীর সুখ খুঁজিবার চিরন্তন আকুলতার বদলে সে কিছু একটা বুঝিয়া লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। যখন সে একটুকরা সফেদ কাপড় বিছানোর প্রস্তুতি লইতেছিল আমার বুঝিতে বাকি রহিলোনা যে, আদতে সে একটা ভোগ্য পণ্য যাচাই করিতে যাইতেছে। সফেদ কাপড়ের জমিনে দুই এক ফোঁটা লাল চিহ্ন দিয়াই কী তাহা হইলে জীবন সঙ্গীর দাম নির্ধারিত হয়?! বিষয়টা ভাবিয়া আমি খুব বিষণ্ন হইয়া পড়িলাম। জানালা খুলিয়া দেখিলাম, আকাশে কোথাও কোন তারা নাই”।

চিঠিতে এরপর একটু গ্যাপ দিয়ে মেহেরুন নেছা প্রশ্ন করেছে, “রাশেদুল তুমিই বলো, আত্মা কি বন্দীত্ব মানে?”
প্রশ্নটার জবাব রাশেদুল খুঁজলোনা। সে তার নিজের চোখের গহীনে একটা সমুদ্রের অস্তিত্ব অনুভব করলো। সেটার তীরভাঙ্গা জল ছিটকে গিয়ে চিঠির খামে পড়লো; ঠিক ওখানটায় যেখানে নীরাপুর লেখা আছে।

পরবর্তী স্টপেজের জন্য ট্রেন ছেড়ে দিলো। যতো যাত্রি নেমে গেছে তারচে কিঞ্চিত বেশী যাত্রি ওঠেছে বলে রাশেদুলের মনে হল। নতুন যাত্রিদের কারো কারো দিকে একটু চোখ রেখে সে চিঠির পরের অংশ পড়তে লাগলো।

“আমার তো মরিবার বয়স হইয়াছে। কিন্তু আমার স্বামী মধুরাতের মতোই এখনো আমাকে নিরন্তর যাচাই করিয়া চলিয়াছে। আমার গায়ের তাপমাত্রা আন্দাজ করিয়া এমন ইঙ্গিত করে যে, মন ভার হইয়া যায়। এই পঞ্চাশে গায়ে বেশি তাপ থাকিবার তো কতো কারণই থাকে ! তাহার ধারণা সঠিক হইলেও স্ত্রী হিসাবে আমি কী বলিবার অধিকার রাখিনা যে, পুরুষ তুমি নপুংসক হইলেই আমাকে কেন সব সক্ষমতা হারাইতে হইবে?

ইদানিং শরীরটা ভালো যাইতেছেনা। তুমি আসিলে বিষদ জানাইব। কয়দিন হইলো নতুন একটা বিষয় যোগ হইয়াছে। সে আমার অন্তর-সিন্দুকের চাবি চাহিতেছে। মনেতে কোন পুরুষের বসত রহিয়াছে কিনা সম্ভবত তাহা জানিতে চায়। তুমিই বলো, গোপন সিন্দুকের চাবি কী অন্য কাহারও হাতে কাজ করে?

আমার শরীর কেমন আচরণ করিবে এই জীবনে তাহা না হয় উনার কাছেই বন্ধক রাখিলাম; কিন্তু আত্মা? ইহা কিভাবে বন্ধক রাখিব? উনি তো আমার ঈশ্বর নহেন !

আচ্ছা রাশেদুল, আমাকে যদি সাথে লইয়া যাও; তুমি কি আমার ঈশ্বর হইবে?”
চিঠিতে আবার একটু গ্যাপ দিয়ে মেহেরুন নেছা প্রশ্ন করেছে; “ঈশ্বর না হয় পুরুষই হইলেন; কিন্তু স্বাধীনতার কী কোন লিঙ্গ আছে?”

প্রশ্নটা রাশেদুল বুক পকেটে ভাজ করে রেখে দিলো। সে জানে,যে সমান্তরাল রেললাইন দুটোতে ভর করে সে নীরাপুর যাচ্ছে সেই লাইন দুটো মিলনের চেষ্টা করলে এই রেলগাড়িটা কখনোই নীরাপুর যাবেনা!

অণুগল্পঃ কসাই

আতিকউল্লাহ সাদিক প্রথম দুই দিন ঝিম মেরে ছিল। গভীর সমুদ্রে নিম্নচাপের মত। তৃতীয় দিন তার ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটে। তখন সে খুব চিৎকার করতে থাকে।
-চম্পা; চম্পা আআআআ !
চম্পা তখন ওর ছোট বোন টুম্পার সাথে ফোনে কথা বলছিল।
-এই বুবু, ঈদের দিনেও আতিক্যা অমন হাম্বা হাম্বা করতাছে কেন রে?
-জানিনা। কয়দিন ধইরা সে এল-নিনোয় আক্রান্ত হইছে। মনে হয় ব্যবসায় লস খাইছে
-নতুন কোন ব্যবসা আবার?
-হ
-কিসের?
-মরুভূমিতে রুম হিটার সাপ্লাইয়ের
-যাহ; কী হইছে ঠিক কইরা ক। ওকে ঠকাস নাই তো? তোর প্রেম, পুরান প্রেমিক এসব কী জানি কইতাছে?

টুম্পার শেষ প্রশ্নের কোন জবাব চম্পা দেয়না। উত্তেজনায় মোবাইল না কেটেই সে আতিকুল্লাহর সাথে যেন সম্মুখ রণেতে নামে। টুম্পা মোবাইল ডিসকানেক্ট না করে সব শুনতে থাকে।
-আমার পচিশ বছর আগের প্রেম নিয়া এমন করতাছ?! তেইশ বছর তো সংসার করলা। কী করতে চাও এখন? ডিভোর্স? আমি প্রস্তুত !
আতিকউল্লাহর চেয়ে দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে চম্পা জবাব দেয়।

চম্পার গলার স্বরে আতিকউল্লাহ কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়ে। সে আর কথা বাড়ায়না। তবে তখন পাশেই অবস্থান করা সন্তানকে সব বলে দেয়! সব মানে চম্পার পুরান প্রেমিক ইনবক্সে আতিকউল্লাহকে সত্যমিথ্যা যা কিছু বলেছে তার সবই। মোবাইলের অন্যপাশ থেকে টুম্পা সব কথাই শুনে।

ঈদের দিনেও আতিকউল্লাহর অমন কান্ড দেখে টুম্পার মন বিষন্ন হয়। সে মোবাইল ডিস্কানেক্ট করে বেশ কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর সে চম্পাকে একটা টেক্সট করেঃ
“ডিভোর্সের জন্য যতো বড় যুক্তিই থাকুক না কেন ডিভোর্স করলি তো তুই বাতিল মেয়ে মানুষের ক্লাবে আজীবন সদস্য হয়ে গেলি। অথচ অনেক দেশে তোদের মত করে এভাবে জোড়াতালি দিয়ে থাকার ভাবনাটাকেই বাতিল করে দেয়।”

ছোট বোন টুম্পার মেসেজটা চম্পা গুরুত্ব দিয়ে পড়ে। কিন্তু জবাব না দিয়ে সে গলির রাস্তায় একজনকে নিবিরভাবে দেখতে থাকে। লোকটার পরনে প্রায় হাটু পর্যন্ত লম্বা ধবধবে সাদা স্যান্ডু গেঞ্জি এবং একই রঙের পায়জামা। সে সম্মুখের রাস্তা দিয়ে ঘনঘন যাওয়া আসা করছিল। তার পুরো গায়ে গরুর রক্ত। বুঝতে সমস্যা হয়না যে, এই কুরবানীর ঈদে সে একজন হেড কসাই।

লোকটাতে চম্পা একবার তার পুরান প্রেমিকের মুখ দেখে; একবার তার স্বামী আতিকুল্লাহ সাদিকের। কোথাও জীবনানন্দের খোঁজ পায়না!

বানানো ঘটনাঃ চন্ডিদাসত্রয়

-হারিকেনের সলতে কমাইয়া দিলি ক্যান?
রাশেদ কিছুটা রাগান্বিত স্বরে মাজহারকে বললো।
-নদির পাড় থেইক্যা যারা দেখবে তাদের কাছে এইটাই ভালো লাগবে; তাই কমাইয়া দিলাম।
-মানে?
-ঐ দেখ, মশালের মতো কিছু একটা জ্বালাইয়া মানুষ জন যাইতাছে। ওরা হয়ত অনেক দূর পথ এইভাবে আলো জ্বালাইয়া যাবে। হাতের ঐ মশালটা নিভবার আগেই পথের আশপাশ থেইকা পাটের খড়ির মতো কিছু জোগাড় কইরা ওরা আরেকটা মশাল বানাবে। কাছে গেলে বুঝতি, ওরা পথের দিকে একমনে তাকাইয়া তাকাইয়া যাইতাছে। ওদের কেউ যদি এদিকে একবার তাকায় তাইলে কী হবে জানিস?
-কি?
-ওরা সবাই দেখবে, মাঝ নদিতে একটা নৌকা হারিকেনের অল্প আলোয় জাইগা আছে। তখন ওরা ক্ষণিক থামবে এবং ভাববে, “জেগে থাকাই সবচে বেশী জরুরি”।
-কেমনে বুঝলি?
-আমি জানি। যারা রাতের পথিক তারা সাধারণত দার্শনিক হয়। ওরাও তাই।
-আর?
-আর নদির কাছে এলে সকল পুরুষ প্রেমিক হয়! আমি কুড়ি রাত জাইগা জাইগা সিদ্ধান্তে পৌঁছাইছি যে, চন্ডিদাসের কোনই দোষ ছিলনা।

হঠাৎ শিয়ালের ডাকে মাজহার ওর কথা থামালো। পরপর আরও কয়েকটা শিয়াল ডেকে ওঠলো। প্রথম ডাকটার ক্যাসকেইড ইফেক্টের মতো অন্য ডাকগুলি যেনো।

-এখন কী মাঝরাত?
-হুম। গাও গেরামে মাঝরাতের ঘণ্টি ওই হুক্কা-হুয়া ডাক।
মাজহার বিজ্ঞের মত করে রাশেদের প্রশ্নের জবাব দিল।
-কিন্তু আমরা তো সবেমাত্র একটা মাছ ধরছি ! ছোট্ট একটা ইছা মাছ। আমাদের মধ্যরাতের নদি-ডিনারের কী হবে?
রাশেদ গলায়, চোখে-মুখে বেশ হতাশা!

-ঐ যে আলো মিটমিট করতাছে ওটা জেলে পাড়া। তোরা যাবি?
জাহানগীর প্রস্তাব করলো। সে নৌকার অন্য গলুইয়ে চুপচাপ বড়শির ছিপ ধরে বসে ছিল।
-ক্যান যামু সেইটা আগে ক;
রাশেদ জানতে চাইলো।
-ঐ পাড়ায় জাবু নামে একজন জেলে আছে। আমার বাবার আমলের লোক। তার ভারী সুন্দর একজন মেয়ে আছে।
-তাকে তোর পছন্দ?
-না। তারে আমি একবারই দেখছি। মাধুরী দীক্ষিতের চেয়েও সুন্দরী। ওখানে গেলে আমরা মাছ পাইতে পারি।

কারো সম্মতির অপেক্ষা না করে মাজহার জোরসে বৈঠা ধরলো। পাড়াটাতে যেনো তাকে যেতেই হবে। জাহানগীর আর রাশেদও জলে পা নামায়ে দিলো বৈঠার বিকল্প হিসেবে।

হেঁইয়ো হেঁইয়ো আওয়াজ তুলে ওরা জেলে পাড়ার দিকে যাচ্ছে। এনাটমির ডিসেকসন হল পালিয়ে মধ্যরাতের ঝিনাই নদিতে তখন তিন যুবক; জাবু কন্যার তিন চন্ডিদাস !

ছোটগল্পঃ দড়ি জীবন

একঃ

দরজা খুলে পূর্ণিমাকে দেখেই জামিল প্রাণ খুলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগলো,
-আমাকে উইশ কর, ডিয়ার
-কেন? পূর্ণিমা জানতে চাইলো
-আজ বিশ্ব সুখী দিবস, তাই। জামিল জবাব দিল
-এই দিনের কথা তো কোনদিন শুনিনাই !
-তোমাকে দেখে আমার মনে হল তোমার এই আগমনের চেয়ে ভালো কোন ঘটনা এই দুনিয়ায় ঘটে নাই; তাই আজ ওয়ার্ল্ড হেপিয়েস্ট ডে আমার কাছে।
-বিশ্ব সুখী দিবস জামিল
-থ্যাঙ্ক্যু পূর্ণিমা

বহু বছর পর জামিল ঢাকা থেকে তার গ্রামের বাংলো বাড়িতে এসেছে। ডিমলার নাওতারা গ্রামে কুড়ি বিঘা জমির ওপর বাড়িটা। পূর্ণিমা কানাডার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতো। দেড় বছর আগে রিটায়ার করে সে দেশে ফিরে এসেছে। ডিমলা প্রোপারেই তার বাপদাদার বাড়ি। স্বামীর সাথে তার কোনদিন বনিবনা হয় নাই। বিয়ের শুরুর দিকে তাদের প্রায় ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। পরে ওদের সামাজিক মিটমাট হয়ে গেলে সপরিবারে কানাডা চলে যায়। এখন সে দেশে একলা থাকে।

-বিশ্ব সুখী দিবস উপলক্ষ্যে কী খাওয়াবে? পূর্ণিমা মুচকি হেসে জানতে চায়
-পান্তা শুটকি দেই? জামিল জবাব দেয়
-পান্তা শুটকি কেন?
– এদেশের অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, ওটা সুখী মানুষের সবচে প্রিয় মেনু
– তাইলে দাও
-না, শুটকি করতে সময় লাগবে। তারচে বরং ডিম ভাজি করি, কী বল? জামিল মত বদলাতে চায়
-ওটাও পান্তার সাথে ভালো যাবে। পূর্ণিমা সায় দেয়।

একটা ছোটগল্পের খসড়া পূর্ণিমার হাতে দিয়ে জামিল কিচেনে ঢুকে।
.
দুইঃ
(গল্পের খাতাটা হাতে নিয়ে পূর্ণিমা পড়তে থাকে। মূল চরিত্রের নাম হাওয়া বেওয়া।)
.
হাওয়া বেওয়া বারবার আকাশের দিকে তাকায়। যদি বৃষ্টি নামে এই আশায় ! কারণ তাতে তিস্তার চরে তার নৌকা চলার সহজতর একটা পথ হবে! জায়গায় জায়গায় আধাজাগা চর থাকায় লাগা তিনদিন নৌকাটা ঠেলে সে এই পর্যন্ত এসেছে।

-হাওয়া, ওওও হাওয়া !
মাজেদা বেওয়ার আচমকা ডাকেও হাওয়ার কোন ভাবান্তর হয়না। চরে সে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে থাকে।

হাওয়ার মা মাজেদা বেওয়া। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আড়াই বছর আগে মাজেদার বিয়ে হয়। সেই হিসেবে তার বয়স এখনও সত্তর হয় নাই। কিন্তু চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সে তার একমাত্র সন্তান হাওয়ার সংসারেই থাকে। তারও একসময় নৌকায় সংসার ছিল। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তার এক ছেলে হয়। মাজেদা বেওয়ার মনে আছে, যেদিন দেশ স্বাধীন হয় সেদিন তিস্তার দুইপাড়ে কী যে আনন্দ হয়েছিল! টানা কয়েকদিন সেই আনন্দ উল্লাস চলে। কিন্তু তৃতীয় দিনে মাজেদার ঘরে গজব নেমে আসে। একমাত্র ছেলেটা কখন তিস্তায় পড়ে হারিয়ে যায় তা কেউ টেরই পায়নি।

ছেলের মৃত্যুর পাক্কা এগার বছর পর মাজেদার পেটে এই হাওয়া বেওয়া আসে। সেজন্য অবশ্য মাজেদাকে কম চেষ্টা তদবির করতে হয় নাই! হাওয়া যখন হামাগুড়ি দেয়া শেখে তখন মাজেদা আর ভুল করে নাই। হাওয়ার কোমরে একটা রঙ্গিন দড়ি বেধে দিয়েছিল। সাঁতার শেখা অবধি দড়িটা কোমরেই বাধা ছিল।

-ওওও হাওয়া; হাওয়া বেওয়া।
মাজেদা আবার ডাক দেয়। হাওয়া এবারও মায়ের ডাকে সাড়া দেয় না।

হাওয়ার চার বছরের শিশুকন্যা একবাটি পানি তার নানীকে এগিয়ে দেয়। শিশু মেয়েটির কোমরেও দড়ি বাঁধা; সাত আট মাস বয়স থেকেই। তাও প্রায় সাড়ে তিন বছর হতে চলল। মেয়েটা যখন পেটে ছিল তখন হাওয়ার স্বামী প্রায় অর্ধেক বয়সের এক কিশোরীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। মাস ছয় সাত পর তার স্বামী ফিরে আসতে চাইলেও হাওয়া আর রাজি হয়নি।
হঠাৎ ঢোলের আওয়াজে হাওয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটে। সে সামনের দিকে তাকায়। নানান রঙের নানান ঢঙ্গের পোশাক পরে একদল নারী পুরুষ নেচে গেয়ে আসছে। যাত্রার দল। পায়ে হেঁটে নদী পার হবে। হাওয়া প্রশ্ন করায় একজন জানায়, তারা প্রথমে ডিমলা এবং পরে জলঢাকা শহরে যাত্রা পালা করবে।

-যাত্রায় পাঠ করবা গো সুন্দরী?
হাওয়ার খোলা পেটে হাত দিয়ে যাত্রাদলের বুড়ো মতোন একজন ফিসফিস করে বলে।

শুধু বুড়োরা নয়। হাওয়ার শরীরের বাঁক, ঢেউ দেখে অর্ধেক বয়সের ছেলেরাও যেন তাকে গিলে খায়। রোদে গায়ের রঙ বসে গেলেও ভারী মিষ্টি চেহারা তার।

-ওওও হাওয়া; খিদা লাগছে রে মা !
এবার হাওয়া তার মায়ের দিকে তাকায়। দড়িতে বাঁধা শিশু কন্যার দিকেও চোখ পড়ে। তার বুকটা হুহু করে ওঠে। হাওয়া শুনেছে, তিস্তার উজানে খাস জমিতে সরকার ভূমিহীনদেরকে ঘর তোলার জন্য জায়গা দিচ্ছে। সেইজন্যই সে এভাবে নৌকা ঠেলে যাচ্ছে। একটা ঘর ওঠাতে পারলেই সে তার মাকে একটা লাঠি জোগাড় করে দিবে। তখন সে একটু আধটু হাঁটবে। শিশু কন্যার কোমরের দড়িটাও সে খুলে দেবে। হাওয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অল্প পানিতে হাত পা ধুয়ে নৌকায় ওঠে বসে। তিনজন মিলে পান্তা ভাত খায়। তারপর সন্ধ্যার আগে আগে চরে নেমে সে খুন্তি চালিয়ে নৌকা যাওয়ার একটা চ্যানেল তৈরি করে।

নৌকায় ওঠে হাওয়া আবার একটু জিরিয়ে নেয়। এক ঢোক জল পান করে সে পেছনের গলুইয়ে যায়। তারপর নিচে নামে। আকাশে ভরা চাঁদ। কালো মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা মাঝে মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল। সেই আলোতে হাওয়া চ্যানেল বরাবর নৌকা ঠেলতে থাকে। একটু জিরায়; আবার ঠেলে। আবার জিরায়। হঠাৎ দেখে, মানুষের একটা ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে। ছায়াটা হাওয়া বেওয়ার ডানপাশে এসে খাঁড়ায়।

আধাঢাকা চাঁদের আলোয় হাওয়া আগুন্তকের মুখ দেখতে পায়। তিরিশ পয়ত্রিশ বছরের একজন পুরুষ। তিস্তার ডালিয়া পয়েন্ট অতিক্রম করার সময় হাওয়াকে দেখে সে মুচকি হেসেছিল। গতকালও নৌকার কাছে এসে সে ভাব জমানোর চেষ্টা করে এবং হাওয়ার হাতে তিনটা পেয়ারা দিয়ে বলে;
-সুন্দরী কৈন্যা পাইলে বিবাহ করিতাম।

তখন লোকটাকে হাওয়ার অল্প অল্প মনে ধরে। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে সে জবাব দেয়,
-তো মুই কী কোরিম?

আজ সন্ধ্যায়ও সে এসেছিল। খুন্তি চালিয়ে হাওয়া যখন তার নৌকা চলার পথ তৈরি করছিল তখন সে বলে,
-তিস্তার পাড়ের সবাই জানে দেবতা সন্তুষ্ট না হইলে মরা তিস্তায় জল আসিবেনা। ভোগ লাগিবে গো, দেবতার জন্য ভোগ।
-তা কী ভোগ লাগিবে?
হাওয়া বেওয়া জানতে চায়।

লোকটা মিটমিট করে হাসে। কোন জবাব না দিয়ে চলে যায়। তারপর এইতো এখন এই রাতের অন্ধকারে পা টিপে টিপে সে আবার এলো।
– তোমার নাম কি বাহে?
হাওয়া জানতে চায়।

লোকটা হাওয়ার হাত তার নিজের মুঠোয় নেয়। তারপর মৃদু চাপ দিয়ে ফিস ফিস করে জবাব দেয়,
-মুই আদম আলী।

কিছুক্ষণ পর হাওয়া কিছু পুরুষ কন্ঠ শুনতে পায়। তাদের কথা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হওয়ায় সে ধারণা করে তিন চার জন পুরুষ তার নৌকার দিকে আসছে। মিনিট কয়েক পর লোকগুলি ধারে কাছে কোথাও থেমে যায় মনে হয়। একটা মেয়ে কণ্ঠও শোনা যায়। একসময় মেয়েটা চিৎকার করে ওঠে। ভয়ে হাওয়া কাঁপতে থাকে। হাওয়াকে তখন আদম আলী কাছে টেনে নেয়। এইভাবে মিনিট কুড়ি। সেই লোকগুলির আর কোন আওয়াজ শোনা যায়না। কিন্তু তবুও হাওয়ার কাঁপন বাড়ে। সাথে আদমেরও।

এরই মধ্যে এক সময় নৌকাটা সামনে নেয়ার জন্য আদম ও হাওয়া এক হয়ে জোরে একটা ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে তিস্তার বুক জুড়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে!
.
তিনঃ
কিচেন থেকে এক বাটি পান্তা ভাত, নুন, পেয়াজ, কাঁচা মরিচ এবং ডিম ভাজি নিয়ে জামিল হাজির হয়।
-পান্তা মাখি? জামিল জানতে চায়
-সমস্যা নাই। পূর্ণিমা জবাব দেয়।

একটা সময় ছিল ওরা প্রতিদিন দুজন দুজনকে চিঠি লিখতো। একদিন চিঠি না পেলে খুব অস্থির হতো।
-গল্প পড়া শেষ করেছ? জামিল জানতে চায়
-হ্যাঁ। পূর্ণিমা জবাব দেয়।
-গল্পটা ওখানেই শেষ নয়। শেষ অধ্যায় লিখা হয় নাই। তুমি চাইলে না লিখা অংশটুকু আমি শোনাতে পারি।
.
চারঃ
(জামিল অসমাপ্ত গল্পটুকু বলতে শুরু করে)

সপ্তাহ খানেক পর এক ভোর বেলা।
তিস্তা তখন জলে টইটুম্বুর। দলে দলে লোক নদীর দিকে যাচ্ছে। কারণ ভাটির জলে এক নারীর লাশ ভেসে ওঠেছে। তার বয়স ঠিক বোঝা যায়না। কেউ কেউ বলছে, পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে।

যারা লাশটা দেখে বাড়ি ফিরছিল তাদের কেউ কেউ বলছিল, “ওটা কোন সাধারণ মরা না; সাক্ষাৎ জলদেবতার ভোগ। তার অঙ্গজুড়ে কেমন রঙ্গিন দড়ি গো!”
.
-স্কিউজ মি।
গল্প বলা শেষ হওয়ার আগেই পূর্ণিমা তার মোবাইল নিয়ে ঘরের বাইরে গেল। মিনিট কয়েক কথা বলে সে ফিরে এলো।
-সরি জামিল, আমাকে এখনই যেতে হবে
-খাবেনা?
-কানাডা থেকে মোবাইল স্ক্রিণে “সে” আমার গাড়ির অবস্থান দেখছে।

পূর্ণিমার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে জামিল তীব্রভাবে অনুভব করে, আজ আসলে তার জীবনের সেডেষ্ট ডে।

“দড়ি জীবন” গল্পটা জামিল নতুন করে লিখবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো।

কবিতা এবং বিনির্মাণ

আমার অধিকাংশ বন্ধু চিকিৎসক। কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার। অন্যান্য এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ডে তেমন কেউ নেই বললেই চলে। আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন পঞ্চম বর্ষের হিমাংসু দা, আমি এবং প্রথম বর্ষের একজন (পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি; আর কিছু মনে নেই) এই তিনজন লিখতাম। আর কেউ লেখে কিনা এখন পর্যন্ত জানিনা। এটা বললাম এই জন্য যে, আমার বন্ধু বলয়ে সাহিত্য চর্চা হয়না বললেই চলে; এবং আমিও তাদের খুব একটা ব্যতিক্রম নই। তবুও মাঝে মধ্যে সাহিত্য সমালোচক হতে সাহসী হই। যাহোক, এক বন্ধু আমাকে সেদিন প্রশ্ন করেছিল, “এই যে কবিতা সমালোচনায় এতো “বিনির্মাণ” কথাটা বলিস এতে তোরা কী বুঝাস?

কবিতায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ “বিনির্মাণ” নিয়েই আজ কিছু কথা বলব। আমার মত করে। কারো দ্বিমত থাকতেই পারে।

কবিতা বলতেই আমি বিনির্মাণ বুঝি। যদি কেউ এক শব্দে কবিতার সংজ্ঞা জানতে চায় তখনও আমি বলব, কবিতা স্পষ্টতই “বিনির্মাণ”।

বিনির্মাণ কী সেটা আগে বলে নেই।

বিনির্মাণ শব্দটাকে ভাঙ্গলে বি নির্মাণ হয়। “বি” তে বিশেষ। অর্থাৎ “বিশেষভাবে নির্মাণ”। কেউ কেউ কবিতার বুননের সাথে এটাকে গুলিয়ে ফেলেন। উদাহরণ দিয়ে বলি।

জ্যোৎস্নাটা কই?
জ্যোৎস্না গেছে মেঘের বাড়ি আকাশ দূরে
মেঘছেড়া জল ফসকে গিয়ে সূর্য পুড়ে। (মিড ডে ডেজার্ট/শব্দনীড়)

সূর্য হল কল্পনাতীত শক্তিশালী আগুনের পিণ্ড। যে চোখের জল এই সূর্যকে পোড়ানোর শক্তি রাখে সেটা কতোটা বিরহে (জ্যোৎস্নার জন্য) কাতর তা এই বিনির্মাণের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

আরো একটু খুলে বলি।

উপরের কবিতাটিতে “মেঘছেড়া জল ফসকে গিয়ে” কথাটা না বলে সরাসরি “বৃষ্টিপাত” বলা যেতো। কিন্তু তার বদলে চারটি ভিন্ন শব্দ (মেঘছেড়া + জল +ফসকে +গিয়ে) ব্যবহার করে “বৃষ্টিপাত” বিষয়টাকে অলংকৃত করা হয়েছে। এই বিনির্মাণ তখন সম্পন্ন হয়েছে যখন শব্দ চারটি (বা সম্মিলিতভাবে একটি) “সূর্য পুড়ে”র আগে বসে নিজেকে ভীষন (নান্দনিক) শক্তিশালী প্রমাণ করেছে !

আরেকটা ভিন্ন এবং ছোট উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। মোনালিসা একজন নারীর নাম; অর্থাৎ ওটা একটা নাউন। কিন্তু ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি যুক্ত করে দ্যা ভেঞ্চি এই নামটাকে বিনির্মাণ করেছেন। “মোনালিসা” উচ্চারণ করলেই ওটাকে আমরা যতোনা নাউন মানি তারচে অনেক বেশি এডজেক্টিভ মানি। মোনালিসা, বনলতা এসবই বিনির্মাণের উদাহরণ !

একটা গদ্য বা আখ্যানকে যদি ছোট ছোট লাইনে ভেঙ্গে এবং শেষ লাইনে একটু টুইস্ট করে সেটা কবিতা বলে চালিয়ে দেই সেটা কবিতা হবে? উত্তরটা আমি এভাবে দেই। এরকম লেখা (কবিতা?) ফেবুতে অহরহ দেখি এবং মনে মনে প্রশ্ন করি, “বিনির্মাণ হয়েছে কী?”

এই বিনির্মাণের সাথে ভাব-ব্যঞ্জনার যেনো সই পাতা আছে। বিনির্মাণ হলেই তাতে ব্যঞ্জনা আসে। যেমন- মোনালিসার হাসিটা অসাধারণ ব্যঞ্জনাময়। একটা শৈল্পিক বিনির্মাণে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের সম্মিলন আপনা আপনি ঘটে। তাই কবিতা মানেই আমি বিনির্মাণ বুঝি। আরেকটা অকাট্য যুক্তি দেই। কবিতা; ইংরেজিতে Poetry গ্রিক শব্দ poiesis থেকে এসেছে যার অর্থ “নির্মাণ”।

কবিতাঃ মেলা

সেদিন হঠাৎ করেই একটা প্রজাপতির ভারে
আকাশ ভেঙ্গে পড়লো;
তাতে চাপা পড়ে একটা নিঃসঙ্গ সমুদ্রের মৃত্যু হয় !
কয়েক টুকরা আকাশ নিয়ে এক বৃদ্ধ আজ
মেলায় এসেছিল;
সাথে একটা মৃত গাঙচিল!
সমুদ্র বাঁচাতে গিয়েই নাকি গাঙচিলটার মৃত্যু হয়েছে !
বৃদ্ধ লোকটা বলছিল,“আমি বহুবার দেখেছিঃ
আকাশ ভেঙ্গে পড়লে সমুদ্র একাই কেবল মরেনা;
আরো কিছু সঙ্গে নিয়ে মরে !”

ওখান থেকে অল্প দূরে অন্য একটা স্টলঃ
তামাম দুনিয়ার নামি দামি শখানেক পাহাড়
সটান দাঁড়িয়ে ছিল।
ইন্ডিয়ার Ooty, Manali থেকে শুরু করে
অস্ট্রেলিয়ার Thredbo; এমনকি
আমেরিকার The great smoky mountain !
উচ্চতায় সবগুলি আকাশ ছুঁই ছুঁই বটে
কিন্তু গড়নের ভিন্নতায় পাহাড়গুলির অন্দর ভিন্ন ছিল!

এর ইমিডিয়েট পরের স্টলে গেলাম;
এক বিধবা অষ্টাদশি আঁচল ভরে
রংধনু নিয়ে উদাস বসে ছিল।
তার স্টলে নানান বয়সী মানুষের ভিড়
মুটে মুজুর থেকে রাজার লোকেরাও!

আবার বেশ কয়েক মিনিট হেঁটে
আরেকটা স্টলে গেলাম।
দীঘি থেকে শুরু করে নদি
এবং কয়েকটা সমুদ্র চোখে ভরে নিয়ে
এক বালক স্টল সাজিয়েছে ।
ওখান থেকে বড় দেখে একটা নদি কিনলাম;
কিন্তু ওটার উৎসমুখ যে পাহাড়টায়- সেটা মেলায় ছিলনা
তাই মিল রেখে সমুদ্রও কেনা হলোনা!

ফিরে আসছিলাম; শেষের দোকানি হাত উচিয়ে ডাকলোঃ
এই যে—–
একবার এখানে এসো !
কাছে গেলাম; সে একজন বৃদ্ধ নারী
ছায়াপথে বৃষ্টি ঢেলে দিয়ে
দুঃখ বানিয়েছে; হোমমেইড দুঃখ!
আমি চোখ মেলে ধরে বললাম, “এসবের কিছুই চাইনা
এই দেখুন, বড় একটা নদি কিনেছি;
এখন কেবল কয়েক দানা নুন চাই; সমুদ্র বানাবো!”

কবিতাঃ সুন্দরের অভিধান

সুন্দর বলতে আমি তোমার কাজল-দীঘি চোখ দুটি বুঝি!
স্নানশেষে তুমি যখন চুল ছেড়ে দাও
আকাশ বেয়ে একটা রাত্রিকে আমি নেমে আসতে
দেখি;
সুন্দর বলতে আমি সেই রাতটাকে বুঝি
হাওয়া উড়ু উড়ু চুল বুঝি
তোমার অঙ্গ জুড়ে বয়ে যাওয়া একটা আলুথালু নদি বুঝি
ঢেউ বুঝি
বাঁক বুঝি
ভাঙ্গন বুঝি;
নদিটার খাড়া পাড়ের মতো তোমার ঠোঁট দুটি বুঝি !

তোমার গায়ে চাঁদ গুড়গুড় জোছনাপাত
এবং
খোঁপায়
গুচ্ছ গুচ্ছ জোনাকি দেখে আমি চিৎকার করে উঠি,
“এই মহাবিশ্বে
প্রথম
এবং শেষ সুন্দর তুমি”!

সুন্দর বলতে তোমার হেঁটে যাওয়া বুঝি
দাঁড়িয়ে থাকা বুঝি
তোমার স্নান বুঝি
ঘুম বুঝি
নাকের ডগার ঘাম বুঝি
বৃষ্টির গায়ে গায়ে তোমার জলবৎ মিশে থাকা বুঝি !

তুমি কাঁদলে এক কোটি বছর
আর বৃষ্টি হয়না;
তুমি হাসলে ভর দুপুরে দপ করে তারা জ্বলে ওঠে
নিশীথ রাত নিমিষেই
ভোর হয়ে যায়;
সুন্দর বলতে আমি এসবই বুঝি!

তুমি যখন কথা বল তখন বাতাসে বাজনা বাজে;
সুন্দর বলতে আমি সেই বাজনাটা বুঝি!
তোমার দুধভাত-রুপ সুন্দর বুঝি
তোমার দজ্জাল-রুপ সুন্দর বুঝি
তোমার তেজপাতা-রুপ সুন্দর বুঝি
তোমার আলো ঝলমল চানতারা-রুপ সুন্দর বুঝি!

তোমার নাম লিখে সাদা কাগজ শূন্যে ভাসালে
কাগজটা গাঙচিল হয়ে মেঘবাড়ি যায়;
তোমাকে ভেবে বিষন্ন হলে রাতভর বৃষ্টি নামে
তাতে ভিজে ভিজে মেঘবাড়িটার জ্বর হয়!
সুন্দর বলতে তোমার একটা গাঙচিল আছে বুঝি;
সুন্দর বলতে তোমার জন্যে মেঘবাড়ির জ্বর হয় বুঝি!

সুন্দর বলতে তোমার চোখের কোণে
আমার প্রগাঢ় চুম্বন বুঝি !

কবিতাঃ অদৃশ্য কালি

মিরপুর-১ থেকে বিরতিহীন বাসে উঠলাম;
পাঁচ সিকি ভাড়া।
পথে এখানে সেখানে একজন দুইজন করে প্যাসেঞ্জার নেমে যাচ্ছিল;
এসব দেখে একজন চেঁচিয়ে ওঠলো, “এমন তো হবার কথা নয়!”
তার সাথে কয়েকজন যোগ দিল
এবং পরে আরও অনেক জন!
অবশেষে অবনত হয়ে কন্ডাক্টর বললো, “কী হচ্ছে
কিংবা কী হবার কথা,
তা আমি নিজেও জানিনা;
সম্ভবত আমরা কেউই তা জানিনা”!
অতঃপর যারা চিৎকার করছিল তারা থেমে গেল
কেননা তাদেরই একজনকে হঠাৎ পথে নেমে যেতে হলো।
পঞ্চাশ মিনিট পর বাসটা যখন গোলাপশাহ মাজারে পৌঁছলো;
আমি আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে, অনির্ধারিত ভাবে
আমাকে পথে নেমে যেতে হয়নি।”

মাজারটার পাশেই এক লোক আইস্ক্রিম বেচছিল।
“একটার দাম কত?”
“দশ পয়সা থেকে শুরু করে আট আনা পর্যন্ত আছে;
তুমি কোনটা নেবে?” – লোকটা জবাবে বললো।
চার আনা দিয়ে একটা কাঠি আইস্ক্রিম কিনে
খেতে খেতে গুলিস্তান সিনেমা হলের পাশে গেলাম;
সেখানে ফুটপাথে সারি ধরে সব হকার বসে আছে।
একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “অদৃশ্য রঙের কালি হবে?”
আসলে নীলখামে জল ভরে চিঠি পাঠাবো
সাথে অদৃশ্য কালিতে লেখা একটা শব্দ!
হকার লোকটা বেশ বৃদ্ধ মতোন; চোখে হাতল ভাঙ্গা গোল চশমা
মাথা চুলকাতে চুলকাতে তিনি একবার আমার দিকে তাকালেন;
একবার আকাশের দিকে।
তারপর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন;
থামিয়ে দিয়ে বললাম,”ওই যে —-বুঝলেন কিনা–
গোপন চিঠির জন্য যে কালি!
এবার তিনি মৃদু হাসলেন, “হবে;
দাম পড়বে গুণে গুণে পাঁচ টাকা”।
“আড়াই টাকাতেই পাওয়া যায়; পাঁচ টাকা কেন”?
প্রশ্নটা করলাম বটে; তবে
পাঁচ টাকা দিয়েই চট জলদি এক প্যাকেট কিনে নিলাম।
কারণ তখন পেছনে আমার মতন এক কিশোর ছিল
তার পেছনে একজন যুবক ছিল
যুবকটার পেছনে একজন বৃদ্ধ
তার পেছনে কয়েকজন ভিক্ষুক, এবং রাজার লোকেরাও!
একটা ময়লা ঠোঙ্গায় ওটা ভরে দিতে দিতে
তিনি বললেন, “বুঝলে বাপু, আজকাল সবাই সবকিছুর আড়াল খুঁজে
মুখোশের ডিমান্ড তাই বেশ বেড়ে গেছে”!
তারপর কয়েক পিছ নীল খাম কিনে ঘরে ফিরলাম;
ওতে আশিটা সমুদ্র ভরে আজই একটা চিঠি পাঠাতে হবে;
প্রতি, মনলতা
সাকিন- অন্তরপুর!

ঠিক সাতদিন পর-
তাপে অদৃশ্য কালি ভেসে না উঠার অভিযোগ নিয়ে
যখন সেই হকারের কাছে গেলাম;
দেখি আমার সম্মুখে সেই কিশোর
তার সম্মুখে সেই যুবক, বৃদ্ধ, ভিখিরি এবং রাজার লোকেরাও!
হকার লোকটা তার ভাঙ্গা চশমা পরছিলেন আর খুলছিলেন
খুলছিলেন আর পরছিলেন।
আবার মাথা চুলকাতে চুলকাতে তিনি বললেন,
“বুকের উত্তাপে না পোড়ালে কোন কিছুই প্রাণময় হয়না।
মুখোশে রঙের প্রলেপ থাকে; উত্তাপ থাকেনা! “

একদিন পর-
আবার যখন সেই লোকটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম;
আবছা কাঁচের চশমাটা চোখে পরতে পরতে তিনি বললেন,
“অন্তরের লেখা পড়তে অন্তর পোড়াতে হয়”।

কবিতাঃ সাতদিন ধরে

সাতদিন ধরে রাজারা হন্যে হয়ে নুলো ভিখারি খুঁজছে;
সিংহাসন ছেড়ে তারা গয়া চলে যাবে!
গত সাতদিনে কবিরা কলম ফেলে
সাত কোটি ভোর হত্যা করেছে; এবং পাখির শিস ও ফুল!
সাতদিন ধরে জলজ-পপুলেশনে আত্মহত্যার ধুম পড়ে গেছে;
গত সাতদিনে একবারও আকাশ নীল হয়নি!

সাতদিন ধরে ধর্ষকেরা ছুঁয়ে দিলেই
নোংরা
পাথর সব
জুঁইফুল হয়ে যায় !
গত সাতদিন তনু, ত্বকী, নুসরাতের মরণোত্তর ফাঁসি চেয়ে
বিশ্ব সুশীল একযোগে মিছিল করেছে !
সাতদিন ধরে রোমিওদের অশ্লীল চিঠি শূন্যে ভাসালেই
গাংচিল হয়ে তা জলে নেমে আসে!

পৃথিবীর কোন প্রান্তেই গত সাত দিন
প্রেমিক তার প্রেমিকার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়নি!
আকাশ মেঘের বদলে তিন চৈত্রের মাঠে ভরে আছে;
এবং
জলের বদলে গত সাতদিন
দুনিয়া জুড়ে ঝুম পাথর-বৃষ্টি হয়েছে।

সাতদিন ধরে নদির স্রোত থেমে গেছে;
সমুদ্রে ঢেউ নেই; ফুলে পরাগ নেই
অঙ্কুরোদগমের জন্য জলের বদলে এসিড খুঁজছে সকল কৃষক!
গত সাতদিনে একটা প্রজাপতিকেও উড়তে দেখা যায়নি;
ওরা নাকি আর উড়বেনা বলে
শতবর্ষী এক কিশোরীর চোখের কোণ ছুঁয়ে কসম করেছে !

এভাবে যদি আর সাতদিন যায়; আইনস্টাইন হঠাৎ কাল
ঘুম ভেঙ্গে সতর্ক করে গেছেঃ সকল সমুদ্রে একযোগে স্যুনামি হবে;
সাধের আকাশটাকেও তখন আর বাঁচানো যাবেনা!
নাসার বিজ্ঞানীরা তাই বাজুতে অষ্টধাতুর তাবিজ বেঁধেছে;
স্পেইস ক্র্যাফট ছেড়ে তারা
পাহাড়ে পাহাড়ে হন্যে হয়ে ন্যূহের নৌকা খুঁজছে!

ঈশ্বর সূত্রে জানা গেছে, মনলতা গৃহে না ফিরলে এই অনাচার চলবেই ;
নিযুত কোটি ন্যূহের নৌকায় ভর করেও এই পৃথিবীটা আর বাঁচবেনা!

কবিতাঃ সাতষট্টি পিছ দুঃখ

একটা দিয়াশলাই এর কাঠি খুঁজছি;
হবে?
সমুদ্র পোড়াবো।
আকাশটার প্রচ্ছদে মেঘ দেব
ছুঁয়ে দিলেই যেন জল হয়;
জমিন ভিজাব!

সমুদ্র পুড়ছে; আকাশটার জন্য এখন কেবল
নিখাঁদ কিছু দুঃখ চাই; রাত্রি বানাবো।
মাত্র
সাতষট্টি পিছ
দুঃখ; মেইড ইন চকবাজার।

হবে?!