অণুগল্পঃ দেড়খানা রুটি

ইটের ওপর হাতুরির কয়েকটা ঠোকা দিয়েই সে খুকখুক করে কেশে ওঠলো। লোকটার নাম সনোজ। তনির সনোজ দা। বয়োবৃদ্ধ; দেখতে ষাটের ওপরে লাগে। লম্বা রোগা গড়ন। পুরানো শ্বাস কষ্টের রোগ আছে। তার জন্য তনির বড় মায়া হয়।

সনোজের দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে এনে তনি আকাশের দিকে তাকালো। এরপর সে আঁচল দিয়ে নিজের চোখ কচলালো। কপাল বরাবর হাত রেখে সে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের অবস্থান দেখলো। বেশ বেলা হয়ে গেছে।

-দাদা খাইবেন না? তনি জানতে চাইলো
-তোমার বৌদি তো এখনো খাবার নিয়া আইলোনা। সনোজ জবাব দিল।

দুপুর হলেই তার স্ত্রী কাপড় দিয়ে বিশেষ কায়দায় থালা বেঁধে খাবার নিয়ে আসে। আজ আর আসবে কিনা তনির শঙ্কা হচ্ছে।

সনোজের সাথে কথা না বাড়িয়ে তনি দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। খাবার মানে নরম গুড় দিয়ে রুটি। অমৃতের মতো স্বাদ। সাথে কাঁচা মরিচে কামড় দিতে পারলে আরও স্বাদ হতো। দেড়টা রুটি খেয়ে বাকি দেড়খানা সে রেখে দিলো। মোট তিনটা এনেছিল। সনোজের স্ত্রী যদি খাবার নিয়ে আসে তাইলে বাকি দেড়খানাও সে খেয়ে নেবে । ইট ভাঙ্গা বড়ই কঠিন কাজ; খুব ক্ষুধা লাগে।

তনির পুরো নাম তনিমা বালা। মধ্যবয়সী। তবে গায়ে গতরে সে একেবারে যুবতী। চোখে কাজল পরে সে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যায় পাড়ার যুবক পোলাপান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয় থাকে।

সনোজের মতো তনিও এই জায়গায় বহুদিন ধরে ইট ভাঙ্গার কাজ করে। ছোটকালে বাবা মা জোর করে তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছিল ঠিক; কিন্তু তার সংসার হয়নাই। ভিন্ন কিসিমের মেয়ে সে। ভাবতে জানে, বুঝে নিতে জানে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। আরজ আলী মাতব্বর কয়েকবার পড়েছে। সারাদিন ইট ভেঙ্গে ঘরে গিয়ে সে তার মতো করে হিসেব করে, কতোটা জীবন ভাঙ্গলো আজ !

তনি খেয়েছে তাও প্রায় আধা ঘণ্টা হয়ে গেলো। সনোজের খাবার এখনো আসেনাই। এরকম অনিয়ম ইদানিং মাঝে মধ্যেই হয়। কারণ তার স্ত্রী দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জ্বরে ভুগছে। অল্প অল্প জ্বর; বিকালের দিকে ওঠে। কেউ কেউ বলে, ওটা ক্ষয়রোগ। সনোজই এই খবর সবাইকে বলেছে। তনির মনে হয় তার সনোজ দারও ক্ষয়রোগ আছে। সে নিজের চোখে দেখেছে, মানুষটার কাশির সাথে রক্ত যায়। যাহোক, আজ হয়তো মহিলাটা ভালো নেই; তাই আসেনি। আসতে একটু সময়ও লাগতে পারে। কম করে হলেও তো দুই কিলো পথ। কুমার পাড়ায় বাড়ি।

এক কুড়ির বেশি লোক এখানে ইট ভাঙ্গার কাজ করে। কিন্তু সনোজ সবদিনই সবচেয়ে কম মাইনা পায়। কেমনেই বা বেশী পাবে? গায়ে শক্তি নাই; বেশি ইট তো ভাঙ্গতে পারেনা। ইটের খোয়ার মাপেই না মাইনার মাপ হয়। মাঝে মধ্যে কিছু টাকা বা এটা সেটা সনোজকে কিনে দিতে তনির খুব ইচ্ছে হয়। কেন এমন ইচ্ছে হয় সেই কথাটা তার গোপন সিন্দুকে যত্ন করে রাখা আছে। রাজা রাণীদের যেমন মজবুত গোপন সিন্দুক থাকে; ফকির মিসকিনদেরও তেমনি। আসলে সবারই। অন্যকেউ সেটার চাবির খোঁজ জানেনা। তনিরটাও না!

তনি আবার সূর্যের দিকে তাকালো। সে ভাবলো, এতো বেলা না খেয়ে সনোজ দা ভালো থাকবেনা। রেখে দেয়া দেড়খানা রুটি নিয়ে সে সনোজের জন্য ওঠবে ওঠবে করছিলো, তখনই দূরে তার সনোজবৌদির মতোই কেউ একজন আসছে দেখলো। একটু পর নিশ্চিত হলো, তাইই। হাতে সেই চেনা কাপড়ে বাঁধা থালা।

এক ঢোক জল খেয়ে তনি চোখ বন্ধ করে রইলো। তার ভালো লাগছেনা। কিছুক্ষণ পর ইট ভাঙ্গার হাতুরিটা সে আবার হাতে নিলো। অদূরে সনোজের স্ত্রী আঁচল ভিজিয়ে স্বামীর মুখ মুছতে মুছতে আফসোস করছে, “মুখটা কেমন শুকাইয়া গেছে”!

তনির মন আরও ভার হলো। চোখের সামনেই কিছু কাক তার দেড়খানা রুটি ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলো। অথচ সে তা খেয়াল করলোনা!

হাতুরি হাতে তনিমা বালা মনোযোগ দিয়ে জীবন ভেঙ্গে চলছে।

16 thoughts on “অণুগল্পঃ দেড়খানা রুটি

  1.  

    হাতুরি হাতে তনিমা বালা মনোযোগ দিয়ে জীবন ভেঙ্গে চলছে।   চমৎকার 

  2. তনিমা বালা এবং বাকি দুটি চরিত্র। স্বল্প কথায় অপরূপ চিত্রায়ণ। বিশেষ করে কাকের দৃশ্য। তনি'র জন্য মায়া হলো। ধন্যবাদ মি. মিড ডে ডেজারট। শুভ সন্ধ্যা।

    1. দারুণ মন্তব্য মিঃ মুরুব্বী। মুগ্ধ হয়েছি।

      আপনার দিন ভালো কাটুক !

  3. কিছুক্ষণ পর ইট ভাঙ্গার হাতুরিটা সে আবার হাতে নিলো। অদূরে সনোজের স্ত্রী আঁচল ভিজিয়ে স্বামীর মুখ মুছতে মুছতে আফসোস করছে, “মুখটা কেমন শুকাইয়া গেছে”! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  4. মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠলো মিড দা। তবে সুন্দর অণুগল্প এটা স্বীকার করি।

    1. সুন্দর করে অনুভূতি প্রকাশের জন্য কৃতজ্ঞতা দিদি।

      অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে !

    1. যারা পড়েন তারা যদি গল্পে বহুস্বর/বহু ভাবনা খুঁজে পান তাইলে যিনি লিখেন তিনি তৃপ্তি পান।

      আপনার মন্তব্যে সেটার ইঙ্গিত পেয়ে ভীষণ আনন্দিত। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে! 

  5. হাতুরি হাতে তনিমা বালা মনোযোগ দিয়ে জীবন ভেঙ্গে চলছে।

     

    * বরাবরের মতই শিল্পসফল উপস্থাপনা…

    শুভ কামনা নিরন্ত।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।