অণুগল্প : অভিমানী

প্রতিবারই দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের ভিতরের মেঠো পথটাতে ঢোকার সময় একটু থামি। পা দুটো কেন জানি থেমে যায়।আমার গ্রাম… আমার ভিতরের আমি এই মাটির গুণে আজকের আমিতে পরিণত হয়েছে। কেমন মায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছি এখান থেকেই।

যেখানটায় কিছু পাকা ধান বাতাসের ঝাপ্টায় মাটির সাথে মিশে আছে, তার অদুরেই তিনটি গরু। সাদাটা হলুদটার সাথে শিং দিয়ে শক্তি পরীক্ষা করছে। কালোটা বিরক্ত হয়ে পাকা ধান খাচ্ছে। দু’জন ধান কাটার কামলা মাথায় কাটা ধান নিয়ে যাবার পথে, ধান খেয়ে যাওয়া গরুটার কাজ দেখে পাশের খালি মাথার জনকে কিছু বলে। সে এক চিৎকার দেয়। কালোটা ধান খাওয়া বাদ দিয়ে একটু সরে যায়।

পিছনের সারি বাধা গাছ-পালার মাথার উপরে নীল আকাশ। সাদা তুলার মেঘের সাথে কিছু কালো মেঘ যেন গ্রামটাকে ভালোবেসে ছায়া দিয়ে রাখছে। বড় সহজ-সরল যে এই মাটির মানুষগুলি!

অদূরে একটা বাড়ী। একজন লোক লাঠির দু’পাশে বাঁধা ধানের আটি নিয়ে কিছুটা বাঁকা হয়ে হাঁটছে। বিড়ি ফুঁকছে আর কাশছে। কাশির দমকে দমকে ব্যাথায় নীল হয়ে যাচ্ছে সে। তারপর ও কষে একটান মারছে বিড়িতে।

কাঁধের ব্যাগটাকে আরো একটু রিল্যাক্স করে নিলাম। সামনেই আমার বাড়ি! মা ওখানে। মায়ের কাছে ছাড়া আর রিল্যাক্স কোথায়?

উঠানে ঢুকতেই ছেলে-মেয়েদের জটলা চোখে পড়ে। নিজেদের অলস সময় পার করছে ওরা। আনন্দ-উল্লাসে। কাটছে প্রহর নিঝুম নিমগ্ন সুখে! একটু দাঁড়াই। ওদের উচ্ছলতায় ভেসে ভেসে ফিরে যাই আমার সময়ে।

খেলার ছলে হয়ত কেউ একজন আরেকজনকে ব্যথা দিয়েছে। গাল ফুলিয়েছে অভিমানী বাবুটার মন! একটু দূরে সরে গেছে সে। প্রথমটায় কেউ খেয়াল করে না। শেষে অভিমানী বাবুর অপরিহার্যতা অনুভব করতেই, একজন কাছে আছে। একটু ছুঁয়ে দিতে চায় তাঁকে। সরে যেতে চায় সে। সে যতই সরে, ক্ষমাপ্রার্থী বাবুটা আরও কাছ ঘেঁষে। একসময় দু’জন পাশাপাশি। কিছুক্ষণ। শেষে হাসিতে মুক্তা ঝরে অভিমানীর! আবার জটলায় ফিরে সে। সবার মন আনন্দে উদ্ভাসিত। ভুলে যায় সবাই।

একটু খচ করে উঠে মনের কোথায় ও। পিছনে ফেলে আসা আর এক অভিমানীর কথা মনে পড়ে। ওর ক্ষুদ্ধ দু’চোখের তারায় তারায় অভিমানের জমাট কান্না। সেগুলো বর্ষণের অপেক্ষায় রেখে এসেছে সে। ঝরেছে কি সেই জমাট ধারা? জানতে ইচ্ছে হয়.. বড্ড।

কি করলে অভিমান ভাঙ্গবে বন্ধুর! জানি না আমি। বাবুদের জীবন কত সহজ। সরল। মুহুর্তেই চলে মান-অভিমান পর্ব। আবার মুহুর্তেই মান ভাঙ্গানোর পালা। বড় বাবুরা কেন এত সহজে গলে না? ওদের অভিমানের জমাট লাভাস্তর পার হওয়াটা কি অনেক কঠিন?

হয়ত। হয়ত না।
অপেক্ষা করছি অভিমানী! ভুল করে করেই মানুষ ‘মানুষ’ হয়ে উঠে। তাই ভুলকে অপরাধ ভাবলে, মানুষ হওয়াটা আর হয়ে উঠে না।

দরজা খুলে মা বের হন। একজন মায়ের মুখ আর অভিমানী কারও বিস্মৃত মুখ একাকার হয়ে যায়। নিজের ভেতরের জমাট লাভাস্তর গলে গলে যায়। দু’দন্ড শান্তি পেতেই মায়ের কাছে আসা। পিছনে রেখে আসা এক বনলতার নিরব চোখের তারায়, জমাট অভিমানী ভালবাসা- আমার ভুলগুলো গলিয়ে দেয়.. নদী হয়ে বয়ে যায় সেই হৃদয় অবধি!

অঝোর ধারায় ভিজে চলি আমি… :(

#অভিমানী_অণুগল্প_৪৫৪

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

6 thoughts on “অণুগল্প : অভিমানী

  1. 'বাবুদের জীবন কত সহজ। সরল। মুহুর্তেই চলে মান-অভিমান পর্ব। আবার মুহুর্তেই মান ভাঙ্গানোর পালা। বড় বাবুরা কেন এত সহজে গলে না? ওদের অভিমানের জমাট লাভাস্তর পার হওয়াটা কি অনেক কঠিন?' ___ ইহাই জীবন।

  2. অসাধারণ মামুন ভাই। অণুগল্পটাই আমি আজও ভালো মতো লিখতে শিখতে পারলাম না। :) অভিনন্দন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. ধন্যবাদ কবিদা।

      আপনি সবই পারেন। এক কাপ চায়ে এক চামচ ইয়ার্কি – লাইনটা আপনার এক অসাধারণ লেখা! মনে পড়ে আপনার?

      আর আপনি সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনন্য, এটা আমরা অনুভব করি।

      শুভেচ্ছা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. ধন্যবাদ রিয়াদি।

      এক বাসায় বেড়াতে গেলাম, তাদের দেয়ালে গল্পের সাথের ছবিটি ছিলো। ওটা দেখেই ওখানে বসে লিখেছি এটা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।