মামুন এর সকল পোস্ট

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

অণুগল্পঃ মায়াবী কোমল আদর

নিজের টাইমলাইন একান্ত নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফরম। কিন্তু গল্প লিখতে লিখতে নিজের কথাই বলা হয়ে ওঠে না।

আমি মিস করি আমার ছোট ভাইকে। ‘ইমিডিয়েট’ ছোট ভাই। আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ওর সাথে কেটেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে একসাথে স্কুলে যাওয়া, এক সাথে বেড়ে উঠা, কলেজ-ভার্সিটির সময়গুলোতেও কাছাকাছি ছিলাম। মুসা ভাই চবিতে যখন গুলিবিদ্ধ হলেন, আমি তখন সেই দোকানটির সামনে বসে চা পান করছিলাম। হঠাৎ সিনেমা স্টাইলে ক্রলিং করে ফায়ারিং শুরু হলো। দেখছিলাম সব চুপচাপ। দৌঁড়াতে বা পালাতে তখন লজ্জা লাগতো। আমার সাথের সবাই হাওয়া। ভাই ছিল পাশে তখনো। পাশে ফিরে ছোট ভাইকে দেখে এবং আমাকে ছেড়ে তার না যাওয়াটা দেখে বড্ড ভালো লেগেছিল সেদিন।

এরকম অনেক ভালোলাগা রয়েছে আমার চিন্তার গোপন আলমিরায় এই ভাইটিকে ঘিরে।

সে আমার দেখা দুর্দান্ত মটরবাইক চালক। আমাদের আব্বাও ছিলেন তাই। আমার ভাই আর আমি চট্টগ্রাম থেকে মটরবাইকে করে খুলনায় নিজেদের বাড়িতে এসেছিলাম একবার। ওর সাথে এবং আরো কয়েকজন ভাই-বন্ধুদের সাথে বাইক বহর নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি যশোহর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা, পটুয়াখালী।

নিজেকে একজন রাজপুত্র মনে হতো তখন। আব্বার সাথে ছিলাম যে তখন!

এখন কি মনে হয় নিজেকে?
কিছুই না।
‘নাথিং এট অল।’

জীবনের খারাপ এবং ভালো সময়গুলো আমরা দুই ভাই আরো ভাইদেরকে নিয়ে একত্রে কাটিয়েছি। যদিও তৃপ্ত সময়গুলো কিছু অতৃপ্তিও বুকে নিয়ে চলেছিল তখন।

সারা রাত জার্ণি করে ঢাকা থেকে ফজরের আজানের একটু আগে বাড়ি পৌঁছে মেইন গেটের সামনে একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি আমাকে। চাবি হাতে ভাইকে দাঁড়ানো পেয়েছি! যতবার গেছি ঠিক ততোবারই এভাবেই পেয়েছি। বউয়েরা সবাই তখন ঘুমে বিভোর।

আর ঘুরে ঢুকে পেয়েছি আম্মাকে। সোজা তাঁর বিছানায় আমার জন্য রাখা খালি জায়গাটায় গিয়ে শুয়ে পড়েছি। মা আরো অনেকক্ষণ জেগে থাকতেন। আমি তখন ঘুমে বিভোর।

সেই শুণ্য জায়গাটি আজো শুণ্য আছে। কেবল আমি নেই। মায়ের আঁচলের আদর এখনো শীতের নরম রোদের মত বড্ড মায়াবী কোমল! কিন্তু অনুভব করার জন্য সেখানে আমি নেই। আমি আছি এই কংক্রিট নগরে। ইউনিটে আবদ্ধ বাসা পরিবারে।

আমার মাটি নেই। মাটি মায়ের কাছে। মা নেই এই কংক্রিট নগরে।

ভাই মায়ের কাছে। আমার আদরের অংশটুকু বড্ড যত্ন করে পাহারা দিচ্ছে।

সব পাখি একসময় নীড়ে ফিরে। মানুষ ও বাড়ি ফেরে। কিন্তু আমি বাড়ি ফিরবো কখন?

হে ক্ষণিকের অতিথি … পর্ব: ১

324

আমি যখন অনুভব করা শিখলাম, তখন থেকেই ওকে ভালো লাগতো। এই ভালো লাগা অন্যসব ভালো লাগার থেকে আলাদা। বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের জন্য যে ভালো লাগা সেরকম না। লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয়কূলদের জন্যও তো আলাদা এক ‘ফিলিংস’ থাকে, তেমনও না। আবার ওই ভালো লাগাকে ভালোবাসা ও বলা যাবে না।

তাহলে ওর প্রতি আমার ভালো লাগাটা কেমন ছিলো?
ওটা যেন গন্তব্যহীন কোনো পথের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘ল্যান্ডমার্ক’ এর দেখা পাওয়ার উদগ্র বাসনায় তাড়িত হওয়া। অন্ধকার টানেলে দিকভ্রান্ত ছুটে চলে এক কোটি বছর পর বহুদূরে শেষ মাথায় আলোর আভাস পাওয়া। কিংবা পাতা ঝড়ার দিনে- দুইপাশে সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে কালো পিচের পথ ধরে পাগলা হাওয়ায় নিঃশব্দে হেঁটে চলা। অথবা শীতের দুপুরে ভরপেট ঘুম চোখে প্রিয় কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ ঝাপসা করে দেয়া বিস্মৃতির অতল গভীরে ডুব দেওয়ার আগ মুহুর্ত!

ওকে যেদিন প্রথম দেখি, জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শনের চেয়ে সেটা কোনো অংশে কম ছিলো না। কিংবা প্রথম বিমান ভ্রমণ। অথবা মায়ের আঁচল ছেড়ে প্রথম একা বান্ধবীদের সাথে বাইরে যাওয়া। অক্ষরে সেই অনুভব প্রকাশ করা দায়।

ওর ঘামে ভেজা লেপ্টানো কোঁকড়া চুল যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায়, আমি তখন আর জন্মে বাতাস হতে চাই! ওর কপালে জমে থাকা মুক্তোর মত শ্বেদবিন্দু শীতের নরম রোদে যখন চকচক করে, পরের জন্মে আমার নরম রোদ হতে ইচ্ছে করে। ও যে পথ ধরে বন্ধুদের আড্ডায় যায়, সেই পথে ওর শরীরের ঘ্রাণ পেতে আমি পৌণঃপুণিক হেঁটে চলি!

বাবা মারা গেলেন। মায়ের আবার বিয়ে হলো। ওদের বাড়িতে আশ্রিতা হলাম। বাবার বড় বোনের ছেলে সে। সে দিক থেকে সম্পর্কে আমরা ভাই-বোন। কিন্তু আমি চাইলাম- যতবার জন্মাবো, আমি ওর হবো! এভাবেই বেড়ে উঠলাম আমরা। আনন্দ-হাসি-কান্নার মাঝে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর ছাড়িয়ে আলগোছে একদিন হৃদয়বতী হয়ে উঠলাম।

যখন হৃদয়বতী হলাম, ভালো লাগা প্রেমের আগুনে পুড়ে পুড়ে ভালোবাসায় রুপ নিলো। আমি পুইঁয়ের লতার মতো আমার হৃদয়বানকে ঘিরে নেতিয়ে পড়লাম। মোমের মতো গলে গেলাম। আবার ধীরে ধীরে শক্ত মোম হলাম। কিন্তু ওকে ভালোবাসি তা কী বুঝাতে পারলাম?

এক ভরা সাঁঝে সে চলে গেলো। ওর আর আমার গল্পের শুরুটা এখান থেকেই।

#হে_ক্ষণিকের_অতিথি_পর্ব_১

(ক্রমশঃ)

মামুনের ছোটগল্প: সন্ধ্যা নেমে এলো

2888

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।
রংধনুর রঙ এর লুকোচুরি দেখতে দেখতে পথ হাঁটছি। সোনালী বিকেলটাকে আবার এতো তাড়াতাড়ি যে ফিরে পাবো ভাবিনি। কিছুক্ষণ আগেই নীলচে কালো মেঘেরা সব গুড়ুম গুড়ুম করে আকাশটাকে দখল করে নিলো। টিউশন শেষ করে মেসে ফেরার তাড়া ছিল না। তাই উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি আর ঠোঁট না নাড়িয়ে গুনগুন,
‘কত যে কথা ছিল, কত যে বেদনা…’।

ঠোঁট না নেড়ে কখনো গুনগুন করেছ? এটা নাকের বাঁশী ও কন্ঠনালী ব্যবহার করে করতে হয়। গানের কলি শুনলে মনে হচ্ছে যে কতটা দুঃখ হৃদয়ে নিয়ে হেঁটে চলেছি। আসলে তা নয়। তবে একেবারেই যে দুঃখ নেই তাও না। সুখও নেই, দুঃখও নেই। এটাকে এক কথায় প্রকাশ করলে কি যেন হয়?

পকেটে একটা টাকাও নেই। রিক্সার দশ টাকার পথ হেঁটে মেয়েটিকে পড়াতে যেতে হচ্ছে আজ তিনদিন ধরে। মাসের ছাব্বিশ তারিখ। এই মাস আবার একত্রিশে । কেন, সব মাসগুলো ত্রিশ দিনে হলে কি হয়? আরো পাঁচ দিন এভাবে যেতে হবে। অন্যরা সপ্তাহে তিন কি বেশী হলে চার দিন পড়ায়। আর আমার বেলায় একদিন বন্ধ রেখে প্রতিদিন। আমার চেহারায় কিছু একটা আছে হয়তো। অভিভাবকেরা প্রথম দেখায়ই বুঝে যায়, কলুর বলদ একটাকে পাওয়া গেছে। অবশ্য আমি বলদ হলেও পড়াই ভালো। যাদের রেফারেন্সে টিউশন দিতে আসি, তাঁরা আমার সম্পর্কে ভালোই বলে। অন্তত আমার একাডেমিক রেকর্ডও সে কথাই বলে।

আজ দেড় বছর এই টিউশন এর ওপরই বেঁচে আছি। এটা বললে মোল্লারা আবার ক্ষেপে যাবে না তো? ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা…’ বলে শাপলা চত্বরে আমার বিরুদ্ধে আমরণ অনশনে না বসে যায়।

কি করব বলো। চাকরি পাই না। প্রথমদিকে অনেক ইন্টারভিয়্যু দিয়েছি। একটা হ্যান্ডবুকই লিখে ফেলতে পারতাম মনে হয়। ‘দ্য হ্যাণ্ডবুক অফ আনএমপ্লয়েড ভ্যাগাবন্ড’ নামটি কেমন হয়? আসলে চাকরির জন্য যে যোগ্যতা লাগে তা আমার নেই। এখন যদি তোমরা কেউ জিজ্ঞেস করো, কি ‘যোগ্যতা’ লাগে, আমার অনেক সময় নষ্ট হবে। এমনিতেই আমার সময় নেই। এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পৌনে ছ’টায় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আমাকে থাকতে হবে।

একজন অপেক্ষা করবে।

আজ ক’দিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কোনোভাবেই আজ পালানো যাবে না। তাহলে আমাকে রাত কাটাতে হবে কোনো পার্কে বা স্কুলের বারান্দায়। কারণ সে সোজা আমার মেসে চলে আসবে। আমি জানি। এবং ওকে আমার থেকেও বেশী জানি। কলি এ ধরনেরই মেয়ে!

একটা বিড়ি খাইতে পারলে মন্দ হতো না। বিড়ি শুনে আবার নাক কুঁচকে ফেলো না যেন। সিগ্রেটকে আমি বিড়িই বলি। বিড়ি হোক আর সিগ্রেট হোক, জ্বালিয়ে ছারখার করবে তো সেই আমাকেই। এই জীবনের মত!

একটু পা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করি। সামনে এক ভদ্রলোক (নাহ! তাঁকে ভদ্রলোক বলা যাবে না। সে প্রকাশ্যে ধুমপান করছে, আইন ভাঙছে। ভদ্রলোকেরা আইন মেনে চলবে।) তিনি ধুমপান করতে করতে হাঁটছেন। ওনার সিগ্রেটটা ফেলে দিলে না হয় দু’তিন টান দিতে পারবো। এভাবে অনেক কুড়িয়ে ফেলে দেওয়া সিগ্রেট টেনেছি আমি। কোথাও কোথাও এইগুলিকে ‘মোতা’বলে।

অভদ্রলোকটির ফেলে যাওয়া সিগ্রেটের শেষাংশে কষে তিনটি টান দিতে পারলাম। নিকোটিনের বিষে ফুসফুসকে ভরিয়ে দিতে কি যে আনন্দ! এই একই আনন্দ পাই যখন কলির পাশে বসে বসে ওর বকা শুনি,
‘এটা পারো না.. কেন এমন হল.. এত দেরী কেন… এই, তুমি আবার সিগ্রেট খেয়েছ’ ইত্যকার হাজার রকমের কেন শুনে শুনে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন আর না শুনলে ভালো লাগে না। কলি আমার ভ্যাগাবন্ড জীবনের অন্যতম নেশা!

আজ কলিকে আমার নিজের একটি অনুভুতির কথা বলতে হবে। আরে, অন্য কিছু ভেবে বস না আবার। সেদিন হেলাল হাফিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। কলি চুপচাপ আমার আবৃত্তি শুনল। আমার শেষ হলে বলল,
‘ আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী’ এই লাইন আমাকে বুঝিয়ে দিবে। এখানে প্রথমবার স্পর্শ দিয়েও কি তাঁর অনুভুতি হয়নি, আবার নিবিঢ় স্পর্শ কথাটি কেন বললেন?’

কি বিপদে পড়লাম দেখ দেখি। ওকে খুশী করার জন্য রাত জেগে জেগে কবিতা মুখস্ত করি। আমার একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর আগে এর ছিটেফোঁটাও যদি করতাম, হয়তো আরো.. বেটার কিছু হতো।

কে যেন পিছন থেকে বলল, ‘বালটা হইত… তুই ব্যাটা এখনো যা আছিস, তখনো তাই-ই থাকতিস… এখন হাঁটার উপরে থাক।’ চারপাশে তাকাই। কিন্তু কাউকে দেখি না। সকালে স্টিকে টান দিয়েছিলাম বলে তো মনে পড়ছে না।

যখন কলির কাছে পৌঁছলাম, অলরেডি দশ মিনিট লেট হয়ে গেছে। বসের সামনে দাঁড়ানোর মতো কাঁচুমাচু হয়ে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম দেরীর কারন জানতে চাইল না সে। বলল,
– তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম, করেছ?
‘কোন কাজটা যেন?’

এমন ভাবে সে আমার দিকে তাকালো, আমার তাতেই হয়ে গেল। বললাম,
‘না, মানে এতো ব্যস্ত থাকি যে সব কিছু কেমন আউলা হয়ে যায়। একটু মনে করে দিলে ভালো হয় ডার্লিং!’

– দেখ, আমার সাথে তুমি ফাজলামো করবে না। তুমি হেঁটে আসার পথে এইগুলো নিয়েই ভাবছিলে। কি, মিথ্যে বলেছি?

আমি ভেবে পেলাম না, ও কীভাবে জানল আমি কি ভাবতে ভাবতে এসেছি ! বললাম,
‘ডার্লিং, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি ঐ কবিতার লাইনটির অর্থ নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। কিন্তু…’
– কিন্তু কি?
‘আমার মাথায় একটা গান ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই গতকাল থেকে। কোনোভাবেই বের হচ্ছে না…’
– কোন গানটা?
‘দুশমনি করো না প্রিয়তমা’ এইটা। মাথায় বাজতে বাজতে শেষে ‘দুষ্টুমি করো না প্রিয়তমা’ হয়ে যাচ্ছে।’

দাঁড়ানো অবস্থা থেকে কলি বসে পড়ল। ওর মুখ থমথমে। নাকের নিচের জায়গাটায় হাল্কা ঘাম জমেছে। বড়ই ভালো লাগছে! আমার বুকের ভিতরে কিসে যেন টান মারল। আমি ভাবলাম, কেন ওর সাথে এরকম করছি? ও যা চায়, সেটা করলে ক্ষতি কি? পরক্ষণেই ভাবি, নাহ, আমার মত ভ্যাগাবন্ডের সাথে ওকে মানায় না। আমি ওকে কোনো সুখই দিতে পারব না। তবে কেন ওর সাথে মায়ায় জড়ানো?

আমাকে সে ওর পাশে বসতে বলল। আমি বসলাম। ওর শরীর থেকে খুব সুন্দর হাল্কা অচেনা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলাম। ওকে আরো বেশী করে একজন নারী মনে হল। খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু একটু আগের নিজের অনুভুতির কথা ভেবে এখনকার অনুভুতির গলা টিপে ধরলাম। সে আমার একটা হাত ধরল। কেঁপে উঠলাম আমি! আমাকে বলল,

– আর আমার মাথায় জগজিৎ বসে আছে। ভাবোতো রেইল লাইন ধরে হাঁটছি, খুব চেনা পথটি ধরে। আর জগজিৎ কানে কানে বলছে, ‘মুঝে তুম সে মোহাব্বাত হো গ্যায়ি হ্যায়.. ইয়ে দুনিয়া খুবসুরৎ হো গ্যায়ি হ্যায়.. উফ! কখন যে সন্ধ্যা হবে!
আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম কলি পাগল-টাগল হয়ে গেলো না তো! ওর হাত ধরা অবস্থায় ওর শরীরও তেমন গরম অনুভব করলাম না। নিশ্চিন্ত হলাম। সে ও মনে হয় আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। বললাম,
‘সন্ধ্যা হলে কি তুমি খুশী হও?’
– হ্যা! কেন তুমি হও না?
‘নাহ, সন্ধ্যা হলেই আমার সেই মেসের জীবন শুরু হবে। তুমি তো তোমার বাসায় চলে যাবে। আমার একলা জীবন। একেবারে সেই পরেরদিন তোমার সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত।’
– একলা জীবন মানে মেসের জীবন কি খুব কষ্টের?

আমি হাসলাম। কলি একটু বিব্রত হল। ওকে বললাম,
‘সন্ধ্যা নামতেই যখন চারিদিকে আঁধার হয়ে যাবে, আমার মেসের দরজা আমার জন্য উন্মুক্ত হবে। রাত আমার কাছে কোনো আনন্দই আনে না। কাঠের চৌকি আর অন্ধকারের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ছারপোকারা আমাকে কুরে কুরে খাবে। ইঁদুর দৌড়ে যাবে রাতের অন্ধকারে। আমি ওদের গাঁয়ের ঘ্রাণ পাবো। রুম মেটের নাক ডাকার শব্দে আমার বিনিদ্র রজনি কেটে যাবে।

দিনের বেলায় আবার আমি সেই সবার চির পরিচিত আমি। হাসবো.. হাসাবো.. কিন্তু কাঁদব একা একা! ভাবতে পারো? একজন মানুষ কতটা রূপ নিতে পারে? আমি আমার জীবনের বিভিন্ন ধাপে অনেকগুলো ফেইক আইডি বানিয়ে এক একজনের চরিত্রকে আমার নিজের ভিতরে ধারণ করতে চেয়েছিলাম। কখনো আমি নর, কখনো নারী- কিংবা বয়ষ্ক প্রেমিক পুরুষ অথবা নাবালিকা শিশু।

সব রুপেই আমি আমাকে চিনতে চেয়েছি। মানুষকে উপলব্ধি করতে চেয়েছি, কিন্তু বারে বারে ফিরে পেয়েছি এই আমাকে।

কলি আমার হাত ধরে বসে আছে। ওর দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে। ধীরে ধীরে সে আমার কাছে আসে! এতোটা কাছে যে আমাদের দু’জনের নাকে নাক লেগে যায়। জীবনে এই প্রথম সে আমার ঠোঁটে তাঁর ঠোঁট ছোঁয়ায়..আমি ও সাড়া দিতে বাধ্য হই। নিজেকে মনে হচ্ছিল একজন শিক্ষানবিস। যে তাঁর টিচারের কাছ থেকে ‘ডিপ কিস’ এর লেসন নিচ্ছে।

ভালোভাবে লেসন নেয়া হয়ে গেলে কলির চোখে চোখ রেখে বললাম,
‘তোমার কবিতার উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে গেছ?’
– কিভাবে?

বললাম, ‘আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী – এখানে তুমি প্রথমে আমার হাত ধরে ছিলে নিজের অজান্তে। সেটিই ছিল আমাকে স্পর্শ করা। একজন নারীর সাধারণ স্পর্শ। আর চোখের জ্বলে সিক্ত হয়ে পরবর্তীতে যে স্পর্শ করলে, সেটি ছিল আমার প্রতি প্রগাঢ় মমতায় তোমার স্বেচ্ছায় কাছে আসা। এই স্পর্শকেই কবি নিবিঢ় স্পর্শ বুঝিয়েছেন।’

-বাহ! এতো সুন্দর করে বুঝালে!
‘আমি কোথায় বুঝালাম? সবতো তুমি ই…’।

সন্ধ্যা নেমে এলো। বলাকাদের মতো আমরা দু’জনেও ফিরে যাচ্ছি.. যে যার ডেরায়। আমার এখন আর মেসের পরিবেশকে অসহনীয় মনে হচ্ছে না। ছারপোকা এবং ইঁদুরদেরকেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে। মায়া লাগছে.. মায়ার এক অফুরন্ত জগতের ভিতর নিজেকে জড়িয়েছি যে!

#সন্ধ্যা_নেমে_এলো_মামুনের_ছোটগল্প

জলে ভাসা পদ্ম আমি

246710

সামিয়া রেখার সেই স্কুল জীবন থেকে সব সুখ দু:খের অংশীদার। এবার সে বেশ অনেকদিন পর এসেছে।
ছুটির দিনের সকালটা নানা রকম রান্নায় ব্যস্ত থাকল রেখা। সামিয়া কাজে হাত লাগাল। দুপুর দুটোর মধ্যে টেবিল ভরে গেল নানান রং, সুগন্ধ আর স্বাদে। আজ মিনার মাহমুদ কোন এক সংবর্ধনায় গেছেন। বান্ধবীকে পেয়ে রেখা বাসায় থেকে গেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় আধশোয়া হয়ে পাশাপাশি বসে অলস আলাপে মন দিলো দুই বান্ধবী।

গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বান্ধবীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল সামিয়া। একটু দ্বিধা নিয়ে শেষে এক সময় বলল, ‘কয়েকদিন আগে এক মহিলা আমার কাছে এসেছিল একটা নতুন বাচ্চা নিয়ে। বাচ্চাটা ওর দরজায় কে যেন রেখে গেছে। ফুটফুটে মেয়েটা। একটু দুর্বল। চোখগুলি বড় বড়। অনেক পাপড়ি। ফর্সা। আমার কাছে আছে। সপ্তাহখানেক হল। আমার ছেলেরা ওকে পেয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।’

রেখার মুখটা সাদাটে হয়ে গেল। চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর আস্তে বলল, ‘মিনার যদি কষ্ট পায়?’

সামিয়া বান্ধবীকে একটু সময় দিল। তারপর সমস্যার ভিতরটা দেখাল বান্ধবীকে।

‘এভাবে থাকলে খারাপ লাগাটা সারাক্ষণ থেকে যাবে। উনার স্বাস্থ্য দেখলাম অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তোকেও দুর্বল দেখাচ্ছে। একবার ফেইস করে ফেল। নেহায়েত রিয়্যাক্ট করলে জোর করার কিছু নাই। আমার তো মেয়ে নাই। আমি রেখে দেব।’

সেই রাতটা রেখা ঘুমাতে পারল না। স্বামীকেও কিছু বলতে পারল না।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়ার আগে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল। জানালা দিয়ে আসা আলো ফ্লোরে পড়ে সারা ঘর আলো হয়ে আছে। মানুষটার ফর্সা মুখটা বাচ্চা ছেলের মুখের মত মায়াভরা। সে অপলক তাকিয়ে রইল।

নিষ্পাপ মুখটার চোখের নিচে কালি দেখে রেখার মনে আবেগ ভরা নদীর বান জাগাল। যে কোন অবস্থায় সে তার স্বামীর সাথে থাকতে চায়। তাকে সুখী দেখতে চায়। আর কাউকে সে তার মানুষের ভাগ দিতে পারবে না। কিছুতেই তাকে ফেলে যেতেও পারবে না। আর কারো সাথে জীবন কাটানোর চিন্তাও সে করতে পারে না।

এত বছরের সঙ্গী! পরম মমতায় দুই হাতে স্বামীর মুখটা বুকে নিয়ে বসে থাকে। সকালের আলোয় রেখার মুখ উজ্জ্বল। সে সিদ্ধান্ত নেয়, বাচ্চাটার কথা স্বামীকে বলবে। ঘুম ভেঙ্গে রেখার আদরটুকু লেখককে বিয়ের সেই প্রথম সময়টাতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়..।

নাশতার টেবিলে স্ত্রীর মুখে বাচ্চাটার কথা শুনে মিনার মাহমুদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সকালটা মনে পড়ল। ব্যথা আর শান্তি একসাথে অনুভব করলেন।

মন দিয়ে অনুভব করলেন স্ত্রীর মনে সন্তান না পাওয়ার গভীর বেদনা। আবিষ্কার করলেন, সন্তানের জন্য প্রকৃতি তার স্ত্রীর মনে যে অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছে তা অবলম্বন না পেয়ে লেখককেই আঁকড়ে লতিয়ে উঠেছে!

নতুন বাচ্চাটা এলে তার সেই আদর ভাগাভাগি হবে জেনেও তিনি সস্নেহে স্ত্রীর ইচ্ছায় সম্মতি দিলেন।
অলক্ষ্যে লতার মুখটা কি লেখকের মনে ভেসে উঠল? চিনচিনে একটা ব্যথা?

নাশতা শেষে লেখক ঘর থেকে বের হবার আগে স্ত্রীর মুখ ছুঁয়ে আদর করে হাসলেন, ‘নতুন মানুষ পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে নাতো?’

মামুনের অণুগল্পঃ নষ্ট কষ্ট

28456a

নিউমার্কেটের চারটি প্রবেশদ্বার। পূর্বপাশের পার্কিং এরিয়ায় বসা অবস্থায়ই বাইক স্ট্যান্ড করায় শিহাব। চাবি খুলে নিয়ে ঘাড় লক করে। নামে না, আকাশের দিকে তাকায় একপলক। গুমোট হয়ে আছে। ঘোমটার আড়ালে মেঘবালিকাদের ভ্রু কুঁচকে আছে, স্পষ্ট অনুভব করে।

স্মরণকালের ভয়াবহ তাপদাহ। ঝুলফির দু’পাশ দিয়ে ঘামের ধারা বয়ে চলেছে। বুক ভেসে যাচ্ছে। ভেজা অস্বস্তিকর অনুভব। উফফ! যদি একটু বৃষ্টি হতো।

আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত উঁচু করে ইশ্বরের কাছে অভিযোগ জানাতে উদ্যত হতেই, আচমকা ফ্রিজ হয়ে যায় সে।

হ্যা!
পারু!
পারুই তো!
একটি তুলতুলে বাবু পারুর হাত ধরে নিউ মার্কেটের গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে। এখনো দেখতে একই রকম আছে ও!

কোথায়ও কি কিছু পুড়ছে?
গন্ধ পায় শিহাব। মুহুর্তে আঠারো বসন্ত পিছনে গিয়ে, সেই পারু দৃষ্টিগোচর হয়। অনুভবে.. কল্লনায়!

শিহাবের হৃদয় একটু কি জ্বলে ওঠে? অদৃশ্য পর্দা ভেদ করে আবার সেই মেয়েটির উপস্থিতিতে একটু কি বেসামাল হয়?

ভাবনার অবসরে ওরা কেউ কাউকে দেখতে পায় না। ইজি বাইকে পারু মেয়েকে নিয়ে হারিয়ে যায়। মোড়ের ওপাশের তিন রাস্তার যে কোনো একটি দিয়ে ভিড়ের মাঝে গন্তব্য খুঁজে নেয় পারুকে বহন করা যান্ত্রিক বাহনটি।

আবারো হারালো পারু?

এমন ভাবনা আসায় সম্বিৎ ফিরতেই
ডান পায়ের জোরালো কিক স্টার্টারে। পারুকে অবচেতনে নিয়ে, গলির মোড়ের দিকে ধাবমান শিহাব। রাস্তা জুড়ে চলে যাওয়া পারুর শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করতে চেষ্টা করে সে। সেই আগের মতো- ঠিক যেভাবে পারুর হেঁটে চলা রাস্তা ধরে ধরে.. আরও পরে পারুর বুকের উপত্যকায় নিজেকে ডুবিয়ে ভালোবাসার ঘ্রাণ পাওয়ার জন্য যেভাবে .. ঠিক আঠারো বছর আগে যেভাবে.. আজও সেভাবেই!

মোড়ে এসে আবারো থেমে যায় শিহাব। কেন জানি হারানো মেয়েটির শরীরের সেই হারানো সুরে একটুও উদ্দীপ্ত হয়না। অনুভব করে, পুরো রাস্তা জুড়ে এখন কেবলি শিহাবের বউয়ের ঘ্রাণ! শিহাবের অনুভবের গভীরতর প্রদেশ এখন কেবলি বউময়।

শিহাবের শরীর জুড়েও এখন কেবল বউয়েরই ঘ্রাণ! বাইক ঘুরিয়ে ফিরে চলে সে। বউ অপেক্ষা করছে। হাসে নিজের মনে শিহাব।

হ্যা!
শিহাবের জীবন এখন কেবল বউময়!
থাকুক হারোনো মেয়েটি তার নিজের মতো যা সে চেয়েছিলো।

তারপরও.. শিহাবের কি একটু একটু কষ্ট হয়?

#মামুনের_অণুগল্প

এখনো ভুলিনি তোমায়

147976_1

সমুদ্র আকাশের অশ্রুজল
সমুদ্র কি আমার চেনা পৃথিবীর শেষ প্রান্ত ও নয়?
যদি এমন হয়
আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি-
উপরে নির্ভার নীলাকাশ নিচে আমি
আরো একবার ভিজতে চাইবো আমি সেই অশ্রুজলে।
হৃদয়ের পরতে পরতে জমে থাকা আমার দুঃখগুলি
সেই জলে ধুয়ে ধুয়ে সুখ হতে থাকবে।

পাহাড় পৃথিবীর পেরেক কিংবা ভারসাম্য রক্ষাকারী
পাহাড় কি আমার চেনা ভূ-খন্ডের সর্বোচ্চ স্থান ও নয়?
যদি এমন হয়
আমি পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় দাঁড়ানো-
অনেক নিচে নীলসাগর আর উপরে দুরন্ত মেঘমালা
মেঘমালাদের দুরন্তপনায় মাথার চুল আমার এলোমেলো!
অবশিষ্ট দু:খগুলো এখানে এসে হারিয়ে যাক অবশেষে
কষ্টেরা হারাক আকাশের নীলে বাতাসে ভেসে ভেসে।

নদীর কাছে গেলে আমার নারীর কথা মনে হয়
দু’জনেই আজন্ম মেঘবতী আর নতজানু জল থেকে জলে..
আসলেই কি তারা তা নয়?
যদি এমন হয়
কোনো এক মধ্যরাতে মাঝ নদীতে ভেসে যাচ্ছি আমি জোছনায় ভিজে ভিজে-
চাঁদেরকণায় ছুঁয়ে যাওয়া রুপালী স্রোত
আমার অণুকষ্টগুলিকে নিঃশেষ করে টেনে চলে মোহনার পানে ধেয়ে।

আমি যখন আমার সব দুঃখ-কষ্টগুলি
সমুদ্র পাহাড় আর নদীর কাছে বিলিয়ে দিয়ে নি:স্ব হয়ে ফিরে আসি
তখন আমার তোমার কথা মনে পড়ে!
ছুটে আসি আমি তোমার কাছে
দু:খ শূণ্য হৃদয় নিয়ে অনুভূতিহীন নির্বাক
তাই বলা ও হয়না আমার মনের কথা তোমাকে।
‘জানো কি মেয়ে? অনেক অনেক ভালবাসি তোমায়!’
তুমি তখন আমার পানে চেয়ে
বললে হেসে আরেকটু পাশ ঘেষে
‘এত সুখ ভাল লাগছে না আর আমার
পারোতো কষ্টগুলোকে ফিরিয়ে আনো আবার।’

আবারো সেই ক্লান্তিকর পদযাত্রা আমার
নদীর জলে ভেসে ভেসে আবারো পাহাড়চূড়ায় আরোহন
আরো একবার সেই সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের যুবক হওয়া!
কুহকী প্রহর জুড়ে থাকা শূন্যতায় ডুবে ডুবে যাই আমি
আকাশের নীল থেকে আমার কষ্টগুলিকে ফিরিয়ে আনতে আরো একবার হই মেঘবালক!

প্রথম দফায় ব্যর্থ হই আমি..

কষ্টগুলি একবার হারালে কেন জানি ফিরতে চায় না আর
ঠিক তোমারই মতন!
অবশেষে হেসে হেসে
দু:খ-কষ্টের পাহাড় নিয়ে আমি ফিরে আসি যখন লোকালয়ে
শুনি তখন আর তুমি নেই আমার
অন্য কারও হাত ধরে নাকি সুখ খুঁজতে বেরিয়েছ!

এমন কেন তুমি!?

এখনো আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্তের যুবক হই
এখনো পাহাড়চূড়ার দুরন্ত মেঘমালারা আমার চুলকে এলোমেলো করে যায় পরম মমতায়-
মধ্যরাতের নদীর শব্দে ভেসে যায় আমার হৃদয়ের হাহাকার।
এখনো প্রতিটি জায়গায় গিয়ে আমি তোমাকেই খুঁজি মেয়ে
চীৎকার করে করে বলি, ‘ভালোবাসি! ভালোবাসি এখনো অনেক তোমায়!’

মেয়ে! তুমি কি শুনতে পাও?

উল্লাসমূখর আরো একটি সন্ধ্যা তোমার সাথে কাটাবো বলেই
এখনো ঘুরে বেড়াই পাহাড় সমুদ্র আর নদীর মাঝে..

সমুদ্র পাহাড় আর নদী
এখনো আমাকে তোমার কথাই মনে করিয়ে দেয় মেয়ে।।

এই নগরজীবন থেকে কবে যে মুক্তি পাবো

2775

দিন যেতে যেতে বহু দিন চলে গেছে
কখন অলখে বিকাল নেমে এসেছে!
শীতের নরম রোদের আলোয় দৃষ্টি ফেলে রাখি
একটা মানুষ – আজীবন একাকী!

অফিস ফেরত লোকের মিছিলে পথে
একজন লোক মধ্যবয়সী পথ পার হতে হতে
ভাবছেন এলোমেলো
পাশ থেকে তার খাঁচায় দোলানো পাখি নিয়ে
এক পাখিওয়ালা চলে গেলো।

খাঁচায় পাখিটা অস্থির দোলে এত ঝাপটায় পাখা
তবু দুই পায়ে লাঠিটার ওপর কিছুতে যায়না ভারসাম্য রাখা
জীবন যেন জীবনের আয়না!
প্রৌঢ় লোকটা খাঁচা থেকে ওই পাখির দু’চোখে পৃথিবীকে দেখে মাতাল টালমাটাল
ভাবেন, ‘পাখিটা মানুষ জাতকে দিচ্ছে না গালাগাল?’

বনের পাখিকে খাঁচাটাতে ভরে পথে পথে হেঁটে হেঁটে
পাখিটাকে নিয়ে সারাদিন তার পথেই গিয়েছে কেটে
পাখিওয়ালা তবু কখনো দেখেনি সরু লাঠিটার জন্য
পাখিটার দুটি পায়ের নখেরা কত বেপরোয়া বন্য
একটু কেবল সুস্থির হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায়
‘পাখিকে মানুষ ভালোবেসেইতো খাঁচাটাতে পেতে চায়
কেন তবে তার কষ্ট বোঝে না – স্বস্তি বোঝে না?’
পাখি শুধু ভেবে যায়।

খাঁচা হাতে যেতে পাখিওয়ালা ভাবে
কত দানাপানি পাখি খাবে
আর পাখি বেঁচে সে নিজে কত টাকা পাবে?
মাঝবয়সের মানুষটা দেখে পাখিওয়ালাটাকে
দেখে পাখিটাকে, দেখে এ ব্যস্ত শহুরে জীবন নিষ্ঠুর করেছে যাকে।

আরো দেখে জালজোচ্চুরি, জীবিকার তাড়া
প্রয়োজন আর লোভের লোহার শিকে
মানুষেরই হাতে বানানো শহর খাঁচা হয়ে তাতে
বন্দী করেছে স্বাধীন মানুষটিকে!
যতই সে পাখা ঝাপ্টায় তবু কিছুতে দাঁড়াতে পারে না
জীবন হয়তো ছাড়ে পাখিটিকে, খাঁচা তবু ছাড়ে না!

#মুক্তি_কাব্যগ্রন্থ_শেষ_তৈলচিত্র

মামুনের অণুগল্পঃ কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭

27615

★ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আমি এই কন্ডেম সেলে! মৃত্যুর অপেক্ষায়।

সাড়ে পাঁচ বছর ঠায় কারো বা কিছুর জন্য অপেক্ষা করা তোমার কাছে কেমন মনে হয়? মরছিলাম আমি প্রতি পলে পলে। মুহুর্তে। ঘন্টায়। প্রতিটি সূর্যোদয়ে এবং সূর্যাস্তে!

দুর্ভাগ্য আমার। একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে আমি আয়েশ করে, একটা সুর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখতে পারিনি বিগত বছরগুলোতে।

নিজের সেলে একাকী। দুপুরের খাবার শেষ করে একটু ঝিমানি মত এসেছিল কেবল। ভাত ঘুমে ঢলে পড়া কোনো ক্লান্ত প্রহর কল্পনায় আনতে চাইছিলাম বোধহয়।

এমন সময় ওনারা এলেন। সমন নিয়ে। সময় হয়েছে। অবসান হয়েছে অপেক্ষার। আমি হাসলাম তাদের মুখের ওপর। স্বস্তির হাসি 🙂

একজন ডাক্তার এলেন। অনেক কিছু পরীক্ষা করে কেন জানি আমার বাম হাতের বৃদ্ধ আংগুলটিতে বেশী সময় লাগালেন। আমাকে কি যেন পড়ে শোনালেন। আমি শুনলাম। ঘোরের ভিতর। আমার তখন ঘোর লাগা ঘোর! কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭ এর ঘোর।

আসলে আমি তখন আমার ভিতরের পাহাড়, নদী আর সাগরকে বিদায় জানাতে মগ্ন ছিলাম।

সময় বয়ে চলে একসময় সন্ধ্যা পেরিয়ে মধ্যরাতকে সাথে নিয়ে এলো।

আমি নিজে শুদ্ধ হলাম।
একজন কিছু পাঠ করেছিলেন। আমি নির্নিমেষ চেয়েছিলাম তার ঠোঁটের দিকে।
মুগ্ধ হয়েছিলাম কিনা?
পাগল নাকি!
মুগ্ধ হবার ওটা যথার্থ সময় ছিল কি? এই শেষ সময়েও আমার মেজাজ বিগড়ে দিও না তো।

আমাকে আমার শেষ ইচ্ছের কথা জানাতে বললেন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন। ডেপুটি জেলার হবেন হয়তো। কারণ জেলার সাহেবকে চিনি আমি। তিনি আসেন নাই।

কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা জানতে চাওয়া হলেও নিশ্চুপ ছিলাম আমি। তারপরও কিছু একটা হাতে করে এনেছিল এক রক্ষী। আমি ফিরেও চাইলাম না সেদিকে।

সবশেষে প্রার্থনা করার সুযোগ দিতে চাইলে প্রশ্নকর্তার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কাছে করব?’ তিনি নিশ্চুপ রইলেন।

একসময় জল্লাদরা এলো। আমার হাত পেছনে ভদ্রভাবে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো। বলল, ‘চলুন স্যার!’ আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেও, তারা ছিল নিষ্প্রাণ। পাথরের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে। জল্লাদদের চোখ পাথরের-ই হতে হয়।

আমাকে যম টুপি পরাতে চাইলে, প্রথমবারের মত আমি সরব হলাম। বললাম,
– আমার এত বছরের থাকার পরিচিত জায়গাটুকু আমি খোলা চোখে যেতে চাই। আমাকে বধ্যভূমির প্রবেশদ্বারের আগে পরিয়ে দিও।

আইনে নেই। তাই পরতেই হল। আমার দু’পাশে দু’জন জল্লাদ আমাকে শক্ত করে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। আমার আপন আঁধার ঘোর অন্ধকারের দিকে আমাকে টেনে নিয়ে চলল!

আমি হেঁটে যেতে যেতে, পাহাড়-নদী-ঝর্ণাদের মনে মনে ডাকলাম, ওরা দূর থেকে আবছা প্রচ্ছায়ার মত নিশ্চুপ রইলো। কাছে এলোনা।

তখন আমি কাছের মানুষদেরকে মনের চোখে দেখার চেষ্টা করলাম। বরাবরের মত আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তারা আরো দূরে সরে গেলেন আমাকে দেখে। এই জগৎ এর একমাত্র অচ্ছুৎ মানুষটি যেন আমি।

সহকারী জল্লাদরা আমাকে সাথে নিয়ে, অল্প ক’টি ধাপ পার হয়ে, আমাকে প্রধান জল্লাদের হাতে ‘হ্যান্ডওভার’ করল।

মনে মনে আমার কাছের মানুষদেরকে শেষবারের মত দেখতে চাইলাম। ‘আমি যাদের যাদের এই জীবনে সবচেয়ে বেশী ভালবেসেছি, সবচেয়ে বেশী আঘাত আমাকে তারাই দিয়েছে’, আমার গলায় ফাঁসির নট যথাস্থানে বাধার সময়ে এই কথাই মনে পড়ল।

সব চুপচাপ। সময় থেমে আছে। নির্দিষ্ট ক্ষণের অপেক্ষা করছে সময়কে ঘিরে অন্যরা।

‘কেবলমাত্র তোমাদের ঘৃণা অবহেলায়ই আজ ঝুলে যেতে হলো আমায়!’- পতনের নিম্নগতির প্রথম অণুমুহুর্তে এই ছিল কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭ এর অণুভাবনা।।

.
#কয়েদি_নাম্বার_৪৪০৮৮৭_মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্পঃ ফিরতি পথে

27610

★ – এতো রাতে ফোন করলি কেন? তোর হাজবেন্ড কোথায়? তারিকের আওয়াজে বিরক্তির ঝাঁঝ।
– আনহ্যাপি মহিলারাই এত রাতে এইভাবে ফোন করে।

মিলার মুখ গাল কান থেকে গরম ভাপ উঠতে লাগলো, কঠিন গলায় বললো,
– রাত সাড়ে দশটা, তুই তখন বললি বলেই ফোন করলাম। যাকে তাকে রাত্রে ফোন করি না আমি। রিসিভ ও করি না।

তারিকের মেজাজ একই রকম খারাপ,
– তাতে কী? ঘুম ভেঙ্গে দিলি কেন? এখন আমি কি করবো?

মিলা অপ্রস্তুত,
– sorry , ঘুমা। রাখি।
তারিক ধমক লাগালো,
– রাখবি না। সারা রাত কথা বলবি।
– sorry

গম্ভীর হয়ে ফোন কেটে দিলো মিলা।
অনেকগুলো খারাপ অনুভুতি একসাথে হচ্ছে ওর। বিশ্রী লাগছে। সত্যি সত্যি ও বাসায় একা। ঘুম আসছে না। কী বললো তারিক? মিলা কি এই জন্য তারিককে ফোন করেছে?

মনটা খারাপ হয়ে গেলো মিলার।
টিভির, বই এর নেশা ও ছুটে গেছে অনেক বছর আগে। ভালো লাগে না। অনেক বছর ধরে নির্ঘুম রাত, নি:সঙ্গ দিন, কারণে অকারণে লোকজনের খারাপ ব্যবহারকে স্বাভাবিক বলে বুঝে নিয়েছে ও। তবু তারিকের ব্যবহারে খুব অপমান লাগলো।

আবার এক রকম মমতাও যেন টের পাচ্ছিলো। বেচারার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একা মানুষ। আর হয়তো সহজে ঘুমটা আসবেও না।

অপরাধী মনে হতে লাগলো নিজেকে মিলার। মাথা নিচু করে বাগানের চেয়ারটাতে বসে ভাবতে লাগলো ও।
অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
‘সমস্যা আছে।’

তার মন ওয়ার্নিং দিলো।
সতর্ক মিলা মনে মনে তারিককে দুটো প্রশ্ন করলো,
‘এত কিছু থাকতে কেন তোর মনে হলো আমি আনহ্যাপি? কেমন আছিস তুই?’

ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। চাইলেও টিভি দেখে বা বই পড়ে সময় কাটাতে পারে। হয়তো তাইই করা উচিত। নিজের এলাকার বাইরে পা ফেলাটা বোকামি। তারিকের কথাগুলো মনে পড়লেই নিজের উপর নিজের রাগ লাগতে থাকলো মিলার। তার একা থাকারই অভ্যাস। এক এক সময় এক এক কাজের ভুতে পায় ওকে। তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

বন্ধু বলতে শেয়ারিং কেয়ারিং এর ইনফর্মাল যা ইচ্ছা তাই বলার কেউ মিলার কোনদিন ছিলো না। অনেক বন্ধু নিয়ে একটা কাজ চিন্তায় আসার পর সে ফর্মাল বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেছিলো।

মোটামুটি একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেলেই আইডিয়াটা বলা যাবে ভেবে সে সবার সাথে বেশ নিয়মিত কথাবার্তা বলতে লাগলো।

এই রকম একটা অবস্থায় সে তারিককে পেলো বন্ধুদের আড্ডায়। ভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কমন দুই এক জন বন্ধুর আড্ডায় দেখা হয়েছে দুই একবার। সৌজন্যই। ঠিক বন্ধুত্ব নয়। ক্লাসমেট।

আঠারো বিশ বছর পর যোগাযোগে নিজেদের পুরনো দিনের জন্য ভালোবাসাটাই নিজেদের অজান্তে একে অন্যের সাথে শেয়ার করতে শুরু করলো। মধ্যবয়সের সয়ে যাওয়া নি:সঙ্গতা হঠাৎ অসহনীয় হয়ে উঠলো।
তারুণ্য নয়, মন চাইলো প্রথম কৈশোর ফিরে পেতে।

যে যার নিজের অতীতে ফিরে গেলো। হৈ হল্লা, ঝগড়াঝাঁটি, অভিযোগের গোলমালে তাদের আসল বয়সটা কখন হারিয়ে গেলো কেউ খেয়ালই করতে পারলো না। সময়ের সাথে সত্যি সত্যি বুদ্ধি শুদ্ধিও চলে গেলো। যার চিন্তায় যা প্ল্যান ছিলো সমস্তই ভেসে গেলো। দু’জন ব্যস্ত রইলো কথা কাটাকাটি, ঝগড়ায়।
কোন কথাটা বলার, কোনটা নয় খেয়াল ও রইলো না কারো। অবশেষে যখন হুঁশ হলো, তখন দু’জনই সত্যিকার সমস্যায় পড়ে গেলো।

তবে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। পথ তো থাকেই। তারা কানাগলির শেষ থেকে আবার বড় রাস্তায় ফিরে চললো।

তারিকের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল।
সাধারণত ঘুম ভেঙ্গে গেলে, সহজে আর ঘুমাতে পারে না। এজন্যই মিলার ফোনে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এতটা চটেছিল। আর রাগটা আরো বেড়ে গেলো কথা শেষ না করেই হুট করে ফোনটা কেটে দেয়াতে।

বছর যদি ৩৬৫ দিনে ধরা হয়, তবে তারিক ২৮৭ দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একজন ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ রুপে দিন কাটায়। প্রাইভেট কোম্পানির গোলামি বলে কথা। দেশের ভিতরে থেকেই বিদেশে চাকরি করার অনুভূতি! কেমন এক বিশাল প্রাপ্তি মনে হয় তারিকের কাছে। ভিসাবিহীন, খরচাবিহীন মুফতে অনুভূতি লাভ!

নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে এক জেলায় রেখে, নিজে অন্য এক জেলায় থাকে। একা। একটি ১৩০ বর্গফুটের ছোট্ট রুমের ভিতরে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কাটাতে হয়। এরপর রুমে ঢুকেই কোনোমতে খেয়ে নিয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়া। ছোট্ট একটা টিভি নিজের মত চলতে থাকে। বিনোদনের ব্যবস্থা এই টিভি আর মোবাইল ফোন। প্রায় রাতই টিভি চলতে থাকে, তারিক ঘুমিয়ে পড়ে। মোবাইলে কথা বলার থেকে নেট ব্যবহারই করে বেশী।

আজও নেট ব্যবহার করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল.. মিলার কলটা যখন আসলো, রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গতেই মোবাইলটা পিঠের নিচে আবিষ্কার করে।

ডিসপ্লেতে মিলার নামটা দেখে প্রচন্ড একটা সুপ্ত ক্রোধের ধীরে ধীরে জেগে ওঠাটা টের পায়। বুকের গভীরে একটা আগ্নেয়গিরির গভীর তলদেশ থেকে প্রচন্ড জমাট বাঁধা কিছু নির্বাক অভিব্যক্তি খুব দ্রুত কিছু শীতল অনুভূতিকে সাথে নিয়ে ক্রমেই উপরে উঠতে থাকে। আর উত্তরোত্তর উত্তপ্ত হতে থাকে।

কেন এই রাগ? মিলার সাথে ওর সম্পর্কটা কেমন? দু’জনের ভিতরের এই সম্পর্ককে তারিক কিভাবে দেখছে? নিজের মনে এতোগুলো প্রশ্ন শুধু যে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এখনই উঠেছে, তা নয়। কাজের ভিতরে কি কাজের অবসরে, এই প্রশ্নগুলো বহুবার ওর মনে উঠেছে। কিন্তু কখনোই সদুত্তর পায়নি।

পায়নি নাকি পেয়েও উপলব্ধি করাতে চায় না?
নিজের বউ বাচ্চা রয়েছে। মিলার স্বামী সন্তান। এসব কিছুকে অতিক্রম করে কেমন এক দুর্বোধ্য সম্পর্কের মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে ক্রমশঃ আরো গভীরে নেমে যাচ্ছে সে।

এই বয়সে কী সে মিলাকে ভালোবেসে ফেলেছে?
জীবনের অনেকটা পথ অন্য কারো হাত ধরে হেঁটে হেঁটে এই বিষন্ন বেলাভূমে নতুন অন্য কাউকে নিয়ে একটি অচেনা ফিরতি পথ ধরে এক আনন্দময় ট্রেইলের কল্পনা করাটা কি ঠিক হচ্ছে? শোভন হচ্ছে?

তবে এই ভাবনায় যে কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে, বিছানায় উঠে বসে ভিতরে ভিতরে কাঁপতে থাকা অবস্থায় তারিক অনুধাবন করে। ওর এই মুহুর্তের চিন্তাধারায় ‘বিষন্ন বেলাভূমি’ এবং ‘অচেনা ফিরতি পথ’ ধরে ‘এক আনন্দময় ট্রেইলের’ কল্পনা করা হয়েছে। বিষন্ন বেলাভূমি কখনো আনন্দময় ট্রেইলের উৎপত্তি ঘটাতে পারে না। আর ফিরতি পথ অচেনা হয় কিভাবে? যে পথে সামনে আগানো হয়েছে, আবার সেই পথে ফিরে যাওয়া হয় বলেই না সেটাকে ফিরতি পথ বলে।

কিন্তু নিজেই নিজের ভাবনাগুলোর উত্তর দেয়। ফিরতি পথ অবশ্যই অচেনা হতে পারে। যখন অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে হাত ধরে নিজের চিরচেনা পথে ফিরে আসা হয়, তখন পরিচিত পথটিও অচেনা হয়ে উঠে।

তবে কি মিলা ওর অপরিচিত? যাকে নিয়ে সে জীবনের বাকি পথটুকু এক আনন্দময় ভ্রমনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চায়!

কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে তারিকের।
একটা ঘোরের ভিতরে চলে যায় সে। ওর এই রুমের বাথরুমের শাওয়ারটির নিচে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে সে এই অনুভূতি পেয়ে থাকে। প্রচন্ড পানির গতি, উপর থেকে সারা শরীরে আছড়ে পড়ার অদ্ভু্ত মাদকতার পরশ বুলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি! বেশ আগে ছেলেবেলায় এক বৃষ্টির দিনে প্রচন্ড স্রোতের ভিতরে খালে নেমেছিল সে। অল্প অল্প সাঁতার শিখেছিল। হঠাৎ স্রোতের টানে খালের পানির ঘূর্ণিতে তলিয়ে যেতে যেতে চোখে ভাসছিল পানির ভিতর থেকে গজিয়ে উঠা হোগলা গাছের লম্বা ফুলের হলুদাভ অবয়ব। বৃষ্টির পানির ঠান্ডা অনুভূতিকে ছাপিয়ে কেমন উষ্ণ আরামদায়ক অনুভূতি এনে দিচ্ছিল খালের পানি। আর ডুবে যেতে যেতে নাকে মুখে পানি প্রবেশের সময়ের সেই প্রচন্ড সাইনাস পেইনের অনুভূতিও মুহুর্তে অনুভব করে।

সেবার অবশ্য নিয়তিই ওকে তীরে এনে ফেলেছিল। ওহ! পায়ে যখন মাটির স্পর্শ পেয়েছিল, আর বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকণার শীতল ছুঁয়ে দেয়ার মাঝে ঝাপসা চোখে কালো আকাশকে দেখেও যে অসাধারণ ভালোলাগার অনুভূতি জেগেছিল!
আজ মিলাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময়েও কি এই সবগুলো অনুভূতি ক্রমান্বয়ে তারিককে ঘিরে ধরছিল?

মিলা!
মিলাকে নিয়ে অচেনা ফিরতি পথ ধরে আনন্দময় ট্রেইলের সন্ধান লাভের চিন্তাটা শাওয়ারের প্রচন্ড গতিতে শরীরে পানির স্পর্শের সুখানুভূতি কি এনে দেয় না? আর চলমান বাস্তবতা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বৃষ্টির শীতল ফোটার সাথে খালের স্রোতে তলিয়ে গিয়ে খাবি খাওয়ার অনুভূতিই কি নয়? আর এসব কিছুকে ছাপিয়ে জীবনের পিছনের ট্রেইল মুছে দিয়ে, এতোদিনের সম্পর্কগুলোকে নষ্ট করে, মিলার হাত ধরে অচেনা ফিরতি পথে চলার মত মনোবলের অভাব সেই তীব্র সাইনাস পেইন হিসেবে কাজ করে।

একটা ১৩০ বর্গফুটের রুমের ভিতরে তারিক নামের এক মধ্যবয়সী নিজের জীবনের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ যেন দিক হারিয়ে ফেলে। অনুভূতিতে একজন সম্পর্কহীনা সকল সম্পর্কের মূল উৎস হতে চেয়েও কেন জানি হতে পারে না। শুধুমাত্র হৃদয়ের অনুভূতি দিয়েতো আর জীবন যেখানে অন্তরীণ, সেই ক্ষেত্রকে অতিক্রম করা যায় না। তাই তারিকও জীবনের বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

বহু যত্নে হৃদয়ে লালিত একটি ফিরতি পথ ধরে অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে পথচলা আর হয়তো ওর হয়ে উঠবে না।।

.

#ফিরতি_পথে_মামুনের_অণুগল্প
মামুনের ৫০টি অণুগল্প // গল্প নং-৮

মামুনের অণুগল্পঃ তৃতীয় জনম

27599 ★ রাত শেষ হতে না হতেই জিসান বেশ তাড়াহুড়া করে বিছানা ছাড়লো। মা ভালোই বুঝলেন, কোথাও দৌড় লাগাবে। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল, আজ কনসার্ট দেখতে যাবার কথা। সে তো শুরু হবে দুপুর তিনটায়!

একের পর এক আলমিরার প্রায় সব কাপড়ই বিছানার উপর ঝাঁপ দিয়ে একটার উপর আরেকটা পড়ে এক রংগীন পাহাড় হয়ে গেল। এরপর সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে একটা ছোটখাটো নানা রং এর সমুদ্র হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত ব্যালকনির কাপড় শুকানোর স্টিলের আলনা থেকে সাদা গেঞ্জি আর গাঢ় নীল জিন্সটাই হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো অস্থির ছেলেটা।

পিছনে যা কিছুই সে এলোমেলো করে রেখেছে, তার জন্য তাকে এ পর্যন্ত কখনোই ভাবতে হয়নি। কাজেই এলোমেলো সে প্রাণ খুলেই করে। বাসায় ফিরে আবার গুছানো দেখার তৃপ্তিটাও বেশ উপভোগের ব্যাপার।
যাদু!

ভবিষ্যতের ব্যাপারে দুর্ভাবনার কিছু এখনো হয়নি। ওর স্বপ্ন, ধ্যান, জ্ঞান একটাই- ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়া বন্ধুর দল।
আর সব?
আছে নিশ্চয়, এত খেয়াল কি দরকার?

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখেন। ঠিক এখানটায় দাঁড়িয়ে, এক যুগ আগে অন্য আর একজনের চলে যাওয়া দেখেছিলেন। সামনে পিছনে সে ও ছেলের মতই দেখতে ছিল। ছেলের ফিরে আসার নিশ্চয়তাটুকু থাকলেও, সেই মানুষটির ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই জেনেও বহুদিন অপেক্ষা করেছিলেন।

এখন ও কি করেন না?

বৈধব্যের কি নির্দিষ্ট কোনো রং আছে?
একজন মানুষের চলে যাওয়াতেই কেন জীবনের রং বদলে যায়। এক নারী সাথীহারা হলে কি আর নারী থাকে না?
আকাশের বিস্তৃত নীলের মাঝে হারিয়ে এক মা তার দুঃখগুলোকে অনুভব করতে চান। দুঃখগুলো হারিয়ে যাক আকাশের নীলে! এক মায়ের আড়ালে বাস করা এক নারী তার সুখগুলোকে অনুভব করতে চায়, কিন্তু দু:খগুলো যে দেহধারী এই মায়ের চারপাশে ছড়ানো রয়েছে। তাই সুখগুলো আর অনুভব করা হয় না।

দু:খ জীবনের তরফ থেকে মায়ের জন্য উপহার।

মায়ের আড়ালে যে নারী বিদ্যমান- একজন বাবার চলে যাওয়ায়, সেই নারী যে কিভাবে নিষ্প্রভ হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যান, আমরা কি কখনো অনুভব করি?

মায়ের কাছে এক পলকের জন্য মনে হয়-
‘নারীর জীবনে পুরুষ কোনো না কোনো ভাবে থেকেই যায়। জিসানের বাবার চলে যাবার পর, সে এখন তার বাবার প্রচ্ছায়া হয়ে আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এক যুবতী নারী এক মায়ে পরিণত হন।

জিসানের মা। তিনিও হয়েছেন।
সামনের সময়গুলিতে হয়ত ছেলের কাছে এক মা ও বিস্মৃত হবেন!’

ভোরের স্নিগ্ধ বেলা শুরুর ক্ষণে, এক দেহের দুই নারী, তার তৃতীয় জনমের অপেক্ষায় প্রহর গোনেন।

বৈধব্য এক বিবর্ণ আঁধার।
সাদার প্রলেপে একে যতই দৃশ্যমান করার চেষ্টা করা হোক না কেন, জীবন নিজের থেকে কখনোই একে একটুও রং দেয় না। এর ভেতরের অন্ধকার থেকেই যায়।

এক নারী তার দ্বিতীয় জনমে এক মায়ে পরিণত হন। তৃতীয় জনমে তবে একজন মা কি হন?

.
#তৃতীয়_জনম_মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্প: নীল কাব্য

276025

★ এক শীতের সকালে বড্ড উষ্ণ হয়ে আছেন তারিক মোহাম্মদ। ভোরেই খালের পানিতে স্নান সেরেছেন। অনুভূতির গভীর থেকে ক্রমাগত উষ্ণতর এক প্রস্রবণে ভেসে বেড়ানোর রহস্য কি ওই স্নানের সাথে জড়িত?

সাড়ে আটটা বাজে। স্কুল ঘরের কাছে আসতেই প্রশ্নটি আবারো মনে এলো। তার এই বয়সে এসে মানুষ শীতল এবং শান্তিপ্রদ এক অনুভবে বিলীন হতে চায়। সেখানে তিনি কেন এক ‘জ্বালাধরা’ অথচ বড্ড কাম্য এবং অনুভূতিতে রস্য, এমন কিছু গোপন ইচ্ছেপালকের ছোঁয়ায় থেকে থেকে তাড়িত হচ্ছেন?

তারিক মোহাম্মদ। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। এক সাধারণ মানুষ। আজ অনেকগুলো বছর এক অজ পাড়াগাঁয় জীবনের অণুগল্পগুলি লিখে চলেছেন।

গ্রামের এক স্কুল ও কলেজের সিনিয়র শিক্ষক। তবে মিলির কাছে তিনি ছিলেন শুধুই তারেক।
ছিলেন? এখন কি নেই? মিলি কোথায়? তিনি সেখানে নেই কেন?

ফারজানা মিলি।
একই বিশ্ববিদালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী মিলি। যেন পাশের বাড়ির মেয়েটি! বড্ড কাছের মানুষ ছিল তারিকের। আচ্ছা, কাছের মানুষ দূরে কেন চলে যায়? পাশাপাশি এবং কাছাকাছি থাকার মুহুর্তগুলো নিজেরাও কি বড্ড একঘেয়েমির শিকার?

টিচারস রুমে।
নিজের চেয়ারে বসে এলোমেলো ভাবছেন তারিক। বড্ড বর্ণাঢ্য জীবন তার! এইতো বেশ আছি। আমরা মনে মনে যা ভাবি, চেতন-অবচেতনের আরো গভীরেও কি সেই একই ভাবনা বয়ে চলে? তারিক কি আসলেই বেশ আছেন!

নিজের ডেস্ক। হাবিজাবি অনেক কিছুর সাথে অবহেলায় পড়ে আছে এক নীল খাম। অবহেলা না ইচ্ছেকৃত অবহেলার অপব্যবহার? জগতের ভিতর অন্য এক জগত। এক নীল খাম মিলি নামের এক তরুনীর চামড়ার হৃদয়ের সাথে মিশে থাকা সময়ের ঘ্রাণে মিলেমিশে,পরম আরাধ্য এবং চরম অসহ্যকর এক প্রগাঢ় অনুভবে তারিককে বিলীন করে চলে।

কোন্ সময়ের ঘ্রাণ? এই সময় না সেই সময়? কতগুলো সময় পার করলে কাউকে পাওয়া হয়ে ওঠে? তারিক কি সময়ের সাথে চলতে পেরেছিলেন?

শীতের এক বেলা শুরুর সময়, একজন তারিক মোহাম্মদ, বিগত এক দু:সময়ের নীরব পীড়নে একটু একটু কেঁপে উঠেন। দৃশ্যমান চিন্তাজগতে তার মনে হয় শীতের কারণে এমনটি হচ্ছে বুঝি। তবে তার অদৃশ্য চিন্তাজগতে অন্য কিছু মনে হয়। নিজের মস্তিষ্কে এক ‘প্যারালাল অণুচিন্তায়’ আক্রান্ত তারিক, এই মুহুর্তে তার মনের আসল সত্যটি বড় তীব্রভাবে অনুভব করেন। নীল খাম থেকে কিছু কালো হরফ বের হয়ে তাকে আরো নাড়িয়ে দিয়ে হেলিয়ে দিতে চায়। গুটি গুটি কালো অক্ষরগুলো হৃদয়ের তীব্র রক্তক্ষরণে সিক্ত হয়েছিল বুঝি। তাই এমন রক্তলাল অনুভব! প্রখর অনুভবে কষ্টের নিলীমায় ডুবে যেতে যেতে তীব্র ‘সাইনাস পেইনের’ অনুভূতি এনে দেয়।

কষ্টগুলো এতোটা কষ্টময় কেন?
“স্যরি।
অনেক ভাবলাম। তুমি যে জীবন চাইছ, আমি তা মেনে নিতে পারছি না। তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হবে। অনেক অনেক কষ্ট! কতটা তুমি কি বুঝ? বুঝার মাঝেও কিছু কি বাকী রয়ে যায় এখনো তোমার!


তবুও আমাকে যেতে হচ্ছে…।”
মিলির লেখা শেষ চিঠি। আজো সব মনে আছে তারিকের।

ডেস্কের তালা খোলেন। হাতের ছোয়া লাগে নীল খামে। সময়ের ঘ্রাণে তিনি উদ্দীপ্ত হন। এক বিশেষ সময়ে ফিরে যান। এই খামটি মিলি নিজের কালো ব্লাউজের ভেতর থেকে বড্ড নির্বিকার ভাবেই বের করে তাকে দিয়েছিল। ঠিক ওর হৃদয়ের ওপরে মনের বড্ড কাছাকাছি ছিল খামটি। বেশ কিছু সময়।

সে একটি নীল খামও হতে পারল না!!
প্রচন্ড এক আক্ষেপ মহাজাগতিক রশ্মির লেজ ধরে কোন্ সুদূর থেকে হৃদয় পানে ধেয়ে আসে! তারিক কষ্টের সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবেন, মিলির হৃদয়ের কাছে, মনের গোপন দরজাটির কাছাকাছি, কত থাকতে চেয়েছে মন! তবে মিলি বরাবরই কাছে-দূরের মানুষের মত আচরণ করেছে। নারীর স্বভাবজাত রহস্যময়ী আচরণ ছিল কি?

তারিক আজ এতোগুলো বছর পর, দৃশ্যের ওপারের দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করেন। মনের ভেতরের মনকে দেখা কিংবা মনের অতল তলে অবগাহনের চেষ্টা কি এতটাই সহজ?

‘মিলির জীবনে আমি একটি নীল খাম হয়েও কিছুক্ষণ থাকতে পারলাম না!’

তারিকের অদৃশ্য চিন্তাজগত এই অনুভূতিতেই পাক খেতে থাকে। তার ‘প্যারালাল চিন্তাজগতের’ অন্যপাশে এক কবির উদয় হয়। একই মানুষের দুই ভূবনের অনুভূতির তীব্রতায় তারিক মোহাম্মদ এবং মিলির তারেক কেঁপে কেঁপে ওঠেন। গ্রামের এক স্কুল ঘরের টিচারস রুমে.. এক শীতের সকালে.. একা একা।

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অক্ষরে রুপ নেয় বড্ড নির্মমতায়। অন্য এক তারিক মোহাম্মদ নীল খামে বেদনার নীল কাব্য লিখে চলেন জীবন ক্যানভাসের পাতায় পাতায়!

‘একটি নীল খাম
আর বিবর্ণ এক চিঠি,
অনেক বসন্তব্যাপী কিছু সুপ্ত অনুভূতির লুপ্ত চেতনায়
বদ্ধ দেরাজে এখনো বিরাজমান।
যদিও ওর বুকে লাঙ্গল চষা যরীন হরফগুলো
এখন লুপ্তপ্রায়।

কবে কোন হৃদয় পুড়েছিল বলে-
ধোঁয়াটে ঘ্রাণে মিশে থাকা
সময়ের ঘ্রাণে আপ্লুত এক নীল চিঠি
এই পড়ন্ত বেলায় এসে এখনো
বুকের গভীরে জ্বালা ধরায়।

নীল খামে নীল অনুভূতি প্রেরণকারিণী,
এখন যদিও বিস্মৃতির অন্তরালে। তবুও
স্মৃতিরা জাবর কাটে দুঃস্বপ্নের রাতকে ঘিরে।
আর বদ্ধ দেরাজে মৃত স্বপ্নরা
আশা জাগানিয়া খেলা খেলে।
নীল খাম নীল কাব্য হয়ে
বেদনার অণুগল্প লিখে চলে।’

স্মৃতির মিনারে দাঁড়িয়ে এক প্রেমিক পুরুষ, এক নীল খামে জীবনের হারানো সুরকে খুঁজে পেতে চান। খুঁজে পাবেন কি?

#নীল_কাব্য_মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্প : সেতু

2757

★ অনেক দিন পরে ওরা দু’জন একসাথে টিভি দেখছে। কণা আর শিহাব। এখন তো ভারতীয় চ্যানেলগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য। আর শিহাবের পরিবারে বউ আর ছেলেমেয়ের। এদের ভিড়ে কদাচিৎ নিজের দেশীয় চ্যানেলগুলোতে পাঁচ দশ মিনিট একটু ঢু’ মারতে পারলেও নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান ভাবে শিহাব।

স্টার প্লাস নামের একটি চ্যানেলে সিরিয়াল চলছে। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে কেন্দ্র করে তাঁর স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের বাকী সদস্যদের বউটির প্রতি তাদের কর্মকাণ্ড দেখাচ্ছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ কণা বলে,
– আমার ভাগ্যে এমন আন্তরিকতা জুটলো না । দু’বার মা হলাম, সময়গুলো এমনি এমনিই চলে গেলো। অবহেলায় আর অনাদরে।

কণা কি বুঝাতে চাইছে শিহাব ভালোভাবেই উপলব্ধি করে। অন্য সব বিষয়ের মতো যে কোনো প্রসঙ্গে শিহাবের মৃত বাবা-মা কে টেনে না আনলে কণার দিন কেনো জানি ভালো যায় না। এক সাথে থাকলে কোন্ পরিবারে একটু আধটু টক্কর কিংবা মনের অমিল হয় না? কিন্তু সেগুলোকে সামনে এনে বার বার কাউকে আঘাত করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? শিহাব ভাবে। আজ কেনো জানি ওর মাথার তাঁর ছিড়ে যায়। প্রচন্ড এক ক্রোধ ওকে পেয়ে বসে। আজ কিছু একটা ঘটেই যেতো। ঠিক ঐ মুহুর্তে যদি ছোট মেয়ে রুপা বাবার কাছে না আসতো।

মেয়ে হুবহু মায়ের কপি। উপরের ঠোঁটের ডান পাশের তিলটিও কণার মত। মেয়েকে দেখে ধীরে ধীরে শান্ত হয় শিহাব। মেয়ে বাবার পাশে বসে। বাবার পাতলা হয়ে আসা চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কেমন ঘুম ঘুম অনুভবে একটু আগের ক্রোধের শেষ অংশটুকুও জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। কণার দিকে ফিরে তাকায়। তিল সমৃদ্ধ ওর তিলোত্তমার প্রতি কেন জানি প্রচন্ড এক ভালোবাসা জেগে ওঠে। টিভি পর্দার দিকে নিবিষ্ট কণার ঝগড়াটে মুখচ্ছবিও শিহাবের আরো ভালো লাগে। অথচ একটু আগেই কল্পনায় ওকে মেরে ধরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো।

ভাগ্যিস রুপা এসেছিল। সংসারে স্থিতি অবস্থা বজায় রাখতে কাউকে না কাউকে তো নিরব হতেই হয়। শিহাব সব সময়ে নিরবতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কতক্ষণ এবং কতবার? তবে যখনই সীমা পার হয়ে এপার ওপার কিছু একটা করার ভাবনায় পেয়ে বসে, তখন মেয়েদের অস্তিত্ব টনিকের মতো কাজ করে। শান্ত করার এক আশ্চর্য নিদ্রাকুসুম তেলের মতো। ওদের দু’জনের মাঝে মেয়ে দু’জন সেতুবন্ধনের কাজ করে।

মামুনের ৫০টি অণুগল্প // গল্প নং-৫

আবৃত্তি_মামুনের_অণুগল্প

275208

★ জীবনের এক বিষম সময়ে পারুর সাথে আমার পরিচয়। বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন। জীবন এক দুর্বিসহ দূর্ণিবার রুপে আমার সামনে উপস্থিত। শব্দে সেই রুপ আমি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এমনই সময় ছিলো।

টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। এভাবে লিখতে গিয়ে লেখকদের এক গ্রুপের সদস্য হয়েছিলাম। আড্ডাবাজি আর লেখালেখির সমালোচনামুখর সময় কাটতো ওখানে। অনেকেই আসতো। সবার সাথে সেভাবে পরিচয় না হলেও, অনেককে মুখ চেনা চিনতাম। তাদের ভিতরে পারুও ছিলো!

তখনো মুঠোফোন যন্ত্রটি এদেশে আসে নাই। অ্যানালগ টেলিফোন দূরালাপনী যন্ত্র হিসেবে একমাত্র বিলাসিতা কিছু কিছু অবস্থাপন্ন মানুষের ঘরে। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে এই যন্ত্রটি ছিলো। মেস ম্যানেজারের কৃপা দৃষ্টি ছিলো আমার প্রতি। কেন তা জানি না। কখনো জানতেও চেষ্টা করিনি আমি।

একদিন রাতে- ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিলো সেটা। বিদ্যুত ছিলো না। তখন হারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় মেসরুম গুলোর বাসিন্দারা নিজেদের যৎসামান্য কাজ চালাতো। আর মোমবাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার আমাদের কাছে ছিলো বিলাসিতা। যাই হোক মেস ম্যানেজার সেই রাতে আমাকে নিচে তলব করলেন। গেলাম।

কালো টেলিফোনের রিসিভারটি অবহেলায় ওনার সামনের নড়বড়ে চারপায়ার ওপরে পড়ে আছে। দাঁত খিলাল করতে করতে সেটার দিকে বাম হাতের অঙ্গুলিহেলন করে আমাকে বললেন,
– তোমার ফোন।

অবাক হলাম। কারণ এই শহরে আমাকে ফোন করার মতো কেউ থাকতে পারে, আমার কল্পনায়ও ছিলো না। বিস্ময়াভিভূত হৃদয়ে রিসিভার কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ঝড়-বৃষ্টির কোলাহলকে ছাপিয়ে মিষ্টি একটা কন্ঠ আমার কানে মধু ঢেলে দিলো!

টেলিফোনের ওপাশের মানূষটির সাথে আলাপ শুরু করতে প্রথমেই নাকি ‘হ্যালো’ বলতে হয়। আমিও ঐ বিজাতীয় শব্দটা উচ্চারণ করলাম। ওপাশ থেকে জলতরঙ্গের মতো দু’টি শব্দ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন?

সেই-ই পারুর সাথে আমার প্রথম আলাপ। বিনা তারে এক অদৃশ্য সংযোগের সেই-ই প্রথম সূত্রপাত।

পারু যে ওর নাম সেটা কীভাবে জানলাম? সে-ই বলেছিলো আমায়। এরপর অনেক জল গড়ালো আমার সেই মফঃস্বল শহরটিকে ঘিরে বয়ে চলা একমাত্র নদীটির বুকের ওপর দিয়ে। দিনের পর দিন, অনেকগুলি রাত আমাকে মেস ম্যানেজার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার বিরক্তিভরা ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করার মত মানসিক শক্তি আমাকে দিয়েছিলো কালো রিসিভারের ওপাশের পারু নামের অচেনা একটি মেয়ে। নারী বললাম না; কারণ মেয়ে শব্দটি আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। নারী বললে সবসময় এক পূর্ণ যৌবনা সম্পন্ন কাউকে মনে হতো আমার।

তবে পারু টেলিফোনে কথা বললেও কখনো ওর আসল পরিচয় তখনো আমাকে জানায় নাই। আমার লেখা কবিতা ওর নাকি খুব ভালো লাগতো! সে আমাকে টেলিফোনে দু’একটা আবৃত্তি করেও শুনিয়েছিলো।

এরপর ওর লেখা চিঠি আমার মেসের ঠিকানায় আসা শুরু হলো। অসাধারণ হস্তাক্ষর! চিঠিগুলোর কাগজে কেমন ভালোবাসার ঘ্রাণ জড়িয়ে ছিলো! হাসছেন? হাসুন। ভালোবাসারও নির্দিষ্ট ঘ্রাণ আছে। আপনারা যারা কখনো ভালোবেসেছেন, সহজেই অনুভব করতে পারবেন আমার সেই ঘ্রাণের অনুভূতিটুকু।

আমিও নতুন উদ্যমে পারুকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লেখা শুরু করলাম। একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনতে চান? শুনুন তবে,

“প্রিয়দর্শিনী পারু! তুই কেমন আছিস?
তোর বুকের ওম মাখা প্রহরগুলি
এখন আমার শীতল ঘরের ফায়ারপ্লেস!
সেখানে আমি ইচ্ছেমতো পুড়ি-শীতল হই…
তুই কি বুঝিস?”

প্রথম প্রেমের পাগলাটে কিছু অনুভব! তবে আমার মনে ঐ সময় একটাই ইচ্ছে ছিলো। আমার শহরকে আগলে রাখা সেই ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে, এক তারা জ্বলা রাতে, ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে, পারুকে নিয়ে আমার লেখা কবিতা ওর নিজের মুখে আবৃত্তি শোনার!

সেই কথাটি পারুকে লিখে জানালাম। ওর সাথে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষায় ওর দেবদাস অধীর ভাবে অপেক্ষমাণ। চিঠি চালাচালির সেই সময়ে টেলিফোনে কথা বলাটা কমে গিয়েছিলো। কারণ আমাদের দু”জনের এমন অনেক কথা ছিলো, যেগুলো আমাকে পছন্দ করা সেই মেস ম্যানেজারের সামনেও বলা যেতো না! এমনই সব কথাবার্তা। বুঝতেই পারছেন।

একদিন চিঠিতে পারু জানালো, সে দেখা করবে! সেই অনুভূতি শব্দে কীভাবে প্রকাশ করি বলুন তো? ইঁদুরের শরীরের গন্ধে ভরপুর আমার মেস রুমকে মনে হচ্ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌসের সবুজ গালিচাময় স্থান! আমি ভেসে যাচ্ছিলাম.. কি করবো, কখন সন্ধ্যা হবে সেই অপেক্ষায় সময়ই যেন কাটছিলো না।

হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন। আগেই বলেছিলাম, নদীর তীরের সবুজ ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে ওর আবৃত্তি শুনবো।

নির্দিষ্ট সময়ে আমি নির্দিষ্ট স্থানটিতে পৌঁছলাম। দূর থেজে দেখলাম, ওখানে আগেই পারু বসে আছে। কম্পিত হৃদয়ে গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে হাজির হলাম। প্রথম প্রেমের প্রথম অভিসার! আমার পারু চুপচাপ বসে আছে। আকাশের তারাগুলোর ধার করা আলোয় চারপাশটা দেখার মতো উজ্জ্বলতায় ভরপুর। আমি পারুর পাশে বসলাম। ওর শরীর ছাপিয়ে কি এক অজানা সুগন্ধি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো। আমি ডুবে যাচ্ছিলাম.. ক্রমশঃ এক বিহ্বলতার গভীর থেকে আরো গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করছিলাম! একি ভালো লাগা! একি ভালোবাসা! এমনই অ-অনুভবেয় এক অনুভূতি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো।

আমি পারুকে নিয়ে লেখা আমার সেই ঐতিহাসিক কবিতাটি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা পারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
– চোখ তোলো! চেয়ে দেখো আমায়।

পারু তাকালো আমার দিকে! নিঃ শ্বাসরুদ্ধ এক মুহূর্তে আমার ভিতরের অন্তর্চক্ষু দিয়ে আমি ওর চোখের আলোয় জ্বলে উঠলাম। বললাম,
– নাও, আবৃত্তি করো।

মুহূর্তে দু’টি কম্পমান ঠোঁটের মৃদু নড়াচড়ার সাথে তারা জ্বলা আকাশ থেকে বর্ষণ শুরু হলো। আমার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা দু’টি নীল চোখ মুহুর্তে রঙ পালটে কালো হয়ে গেলো দেখলাম। সেখান থেকে বারিধারা টুপ টুপ করে পড়ছে। অবাক বিস্ময়ে আমি কম্পমান পারুর হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিলাম। গুটি গুটি অক্ষরের আমাকে লেখা পারুর শেষ চিঠিতে ছিলো,

– টেলিফোনে তোমার সাথে আমার বান্ধবী কথা বলেছে। আমিই তোমার আসল পারু। আমি কথা বলতে পারি না। আমার ৪ বছর বয়সে গলায় কী যেন হয়েছিল। সেই থেকে আমি বোবা হয়ে গেছি। আমায় ক্ষমা করো গো! আমি আবৃত্তি করে তোমায় শোনাতে পারলাম না!

ভালোবাসার মানুষটির পাশে আমি চুপচাপ স্থানুর মতো বসে রইলাম। সে ও নিশ্চুপ। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে রাতের নিঃশব্দতাকে আরো নৈঃশব্দের গভীরে নিয়ে চলেছিলো জলের বয়ে চলার শব্দ। আমার হৃদয়ে ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে বইছিলো পারু! আমার পারু! তীব্র ‘ইলেট্রিক ব্লু’ আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে বিশ্বচরাচর। সেই রাতের নীলচে আলোয় পারু এবং আমাকে, হৃদয়ের অধিপতি আমাদের ঈশ্বর – সস্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ !!

অণুগল্প: চোর ১৩৮

প্রতিদিনের মতো অফিস ফেরত একজন বাবার ভূমিকায় শিহাব। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে নিজের বেডরুমে। কণা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে। স্বাভাবিক নি:শ্বাস পতনের শব্দ এবং কিছু অংগের উত্থানপতনে বুঝা যায় সে গভীর ঘুমে।

ঘুমের ভান নয়।
ভান শব্দটা এজন্যই শিহাবের মনে এসেছিলো রুমে প্রবেশের মুখে। কণা প্রায়ই এমন দুষ্টুমি করে ওদের ছোট বাবুটাকে সাথে নিয়ে। হঠাৎ করে নৈশব্দের নিঝুম নিমগ্ন ক্ষণে, একাকী বিচরণরত শিহাবকে চমকে দেয় কণা। কখনো ছোট বাবুটা। এভাবেই চলে নাগরিক জীবনে বেমানান কিছু বাবাদের সংসার সংসার খেলার মাঝে, কিছু আনন্দঘণ মুহুর্ত! কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া। রিফ্রেশমেন্ট?
কণা ইচ্ছাকৃত করে?

সম্পর্কগুলি নিত্য নতুন টানাপোড়ণে ভোগে। দগ্ধ হয়। ক্ষয় হয়। তাই অনবরত এর পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। কণা বুঝে? তাই সহজ করতে এমন করে? বিবাহিত জীবনের কুড়ি বছর পার করে এসে ও কি সেই প্রথম দিকের অনুভবকে জাগিয়ে তুলতে চায়?

শিহাব কি বুঝে?
কখনো কি নিজে কণার মতো সম্পর্কগুলির ক্ষতের মলম হতে চেয়েছে? সম্পর্কের মাঝের ক্ষয় রোধে তুমি নিজে কি ভূমিকা নিয়েছো? আদৌ নিয়েছো কি?

নিজের কাছ থেকে এমন প্রশ্নে বিব্রত শিহাব হাসে। নি:শব্দে। এটা নিজের মনে হাসা। ইদানিং এভাবেই হাসে অনেকে। নিজের থেকে লুকোতেই অনেক বাবারা ও এমন করেন।

ছোট্ট বাবুটা ঘুমন্ত মায়ের পাশে বসে হোমওয়ার্ক করছে। শিহাব নিরবে পাশে বসে। একটু দেখে। এটা মেয়ে বাবু। তবে পুরোদস্তুর ছেলেদের পোশাক পরে আছে। কান টুপি ও পরেছে একটা। দুষ্ট এক ছেলের পোশাকে দুষ্টু মেয়েটি স্কুলের কাজে মগ্ন। তার ভিতরেও বাবার পাশে বসাটা অনুভব করে। সে ও বাবার দিকে না তাকিয়ে নিজের মনে হাসে। ওর হাসি নিজের থেকে নিজেকে লুকোতে নয়। নিজেকে জাহির করতে। বাবার অনুপ্রবেশ তার ব্যস্ততার ভিতরেও অনুভবের ‘নোটিফিকেশনে এক্সিকিউট’ হয়েছে, ধরা দিয়েছে ঐ নিরব হাসির দ্বারা।

শিহাব মোবাইলে পাওয়ার ব্যাংকের সংযোগ দিতে দিতে স্বগতোক্তি করে,
– তরকারি চুরি করে খেয়ে এলাম।
বাবুটা এবার বাবার দিকে তাকায়। তবে তার হাত কাজ করে চলে। ইরেজার দিয়ে পেন্সিলের লেখা মুছছে। সে প্রশ্ন করে,
– তুমি তো এমনিতেই খেতে পারো। চুরি করা লাগে কেনো?

মোবাইলে চোখ, কী’র উপর আংগুল, শিহাব প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– আমার চুরি করে খেতেই ভালো লাগে। আমার ভিতরের চোরটা এই কাজ করে।

পাশের রুমে বড় কন্যাকে হাউস টিউটর পড়াচ্ছে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ছোট বাবুটা হেসে হেসে অল্প আওয়াজে বাবাকে বলে,
– আস্তে বলো পাপা, স্যার শুনবে।
– শুনুক। সবার ভিতরেই একটা করে চোর থাকে।
– সবার ভিতরে? স্যারের ভিতরে ও চোর আছে?

ছোট বাবুটার প্রশ্নের উত্তরে শিহাব একটু থামে। ভাবে? শেষে উত্তর দেয়,
– হ্যা। আছে।
– সে কি চুরি করে?
– ধরো, সে নিজের পাপাকে ফোন করে বললো যে বই কিনতে হবে, হাজারখানিক টাকা পাঠাও। তার বাবা টাকা পাঠিয়ে দিবে। সে আড়াইশো টাকা বইয়ের পিছনে খরচ করলে বাকী সাড়ে সাতশো’ টাকা বন্ধুদের কে নিয়ে বিড়ি ফুঁকে শেষ করবে। এটা তার ভিতরের চোরটা করে।
– এটা তো স্যারের বাবাকে মিথ্যে বলা হলো, তাই না পাপা? এই চোরটা তোমার চোরের চেয়েও খারাপ।
– হ্যা বাবা।

বাবুটার পরবর্তী প্রশ্নে শিহাব বিব্রত হয়,
– পাপা, তুমি কি কখনো দাদা ভাইয়ের সাথে এমন করেছো?
কি উত্তর দেবে ভাবতে সময় নেয় শিহাব। তবে বাবুটাই ওকে উদ্ধার করে। সে হোমওয়ার্ক করা অবস্থায় লজ্জিত হেসে বলে,
– আমার ভিতরেও একটা চোর আছে পাপা! 🙂

– হ্যা আছে। 🙂 তোমার চোরটা কি করে?
– আমার চোরটা অনেক কিছু করে। তুমি ঘুমিয়ে গেলে তোমার মোবাইল দিয়ে গেমস ডাউনলোড করে। আপুর ভিতরের চোরটা ও আম্মুর মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে ঘুরে ফিরে আবার তার একাউন্ট ডি-এক্টিভেট করে রাখে। ও মাই গড! আমি তো অনেকের ভিতরের চোরকে দেখতে পাচ্ছি পাপা! জান্নাতি, আমেনা, মিতু- ওদের ভিতরের চোরগুলি ক্লাসে কি করে আমি এখন জানি পাপা 🙂
শিহাব ছোট বাবুটার উচ্ছ্বাসিত অনুভবে ধীরে ধীরে ভালোলাগায় কোমল হতে থাকে। সময় বয়ে চলে। নিরুদ্বেগ সময়। আবারো প্রশ্ন বাবুটার,
– পাপা, সব চেয়ে বড় চোর কাদের ভিতরে থাকে?

উত্তর দিতে গিয়ে থামতে হয়। বাবাদের কখনো কখনো ভেবে চিন্তেও উত্তর দিতে হয়। শিহাবও দেয়,
– যারা একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে, কথা দিয়ে কথা রাখে না-তাদের ভিতরের চোরগুলি সবচেয়ে বড়।
– তারা কারা? আমি কি চিনি তাদের?

ছোট্ট বাবুটার মাথার চুল নেড়ে আদর করে শিহাব। মুখে বলে,
– আরেকটু বড় হলে তুমি নিজেই তাদেরকে চিনে নেবে। এটা মনে করো তোমার একটা এসাইনমেন্ট।

শিহাবের মন তখন নিরবে ভাবে, ওর বসবাসের ভূ-খন্ডে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে, নির্দিষ্ট কিছু মানুষ, একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে, সময় হলে কথা দিয়ে কথা রাখে না। এখন এটা একটা ‘ট্রেন্ডে’ পরিণত হয়েছে। এই নির্দিষ্ট মানুষগুলিকে ‘রাণী মৌমাছি’র মতো ঘিরে আমজনতার প্রদক্ষিণ, এই ‘ট্রেন্ড’কে ‘সিস্টেমে’ পরিণত করেছে।

সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে নিত্য নতুন বড় চোরেরা শূণ্য জায়গাগুলি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ভেবে ব্যথিত হন একজন বাবা। উত্তরপুরুষের জন্য এমন চোরসমৃদ্ধ একটি ভূ-খন্ড রেখে যেতে হচ্ছে!

আচ্ছা, সিস্টেম পাল্টানো যায় না? শুরুর শুরুটা তো অন্ততো করে যাই আসুন..

#চোর_অণুগল্প_১৩৮

ছোটগল্পঃ ও কেনো এতো সুন্দরী হলো?

20595_n

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর করে বাবা-মার সাথে ছিলাম। দেশের অন্যতম এক সমৃদ্ধ বিভাগীয় শহরে পরিপূর্ণ জীবন আমলা বাবার নিয়ন্ত্রণে বেশ আনন্দময়। ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই বাবার হাতে থাকলেও যথেচ্ছা উড়াবার স্বাধীনতা ছিল আমার। উড়াচ্ছিলাম। বাউরি বাতাসে নিজেও ভেসে যাচ্ছিলাম।

এ অবস্থায় বর্ডার সংলগ্ন একটি স্কুল ও কলেজের দায়িত্ব চাপলো আমার ঘাড়ে। দায়িত্ব নিলাম। সুন্দরভাবে পালন করলাম। উপভোগও করলাম সেই সময়টুকু।

পরিবারের বড় ছেলে। লেখাপড়া শেষ। সুন্দর চাকরি। বিয়ের জন্য আদর্শ বয়স। বাবা-মা বিয়ের জন্য অত্যন্ত তৎপর। বাবা সরকারি চাকুরীজীবি হবার কারণে, আমাদের বেড়ে ওঠা এবং মেলামেশা ছিল বাবার কলিগ পরিবারগুলোর সাথেই। সবার ভিতরে থেকেও, এই বিশেষ সার্কেলটি ছিল ক্ষমতার দম্ভে পরিপূর্ণ প্রাচুর্যের অধিকারী এক আলাদা শ্রেণি। যেখানে অন্য শ্রেণির সাথে শ্রেণি সংঘাত ওভাবে না থাকলেও এক আলাদা সমীহ জাগানিয়া অনুভবে তাড়িত হত অন্যরা।

যাইহোক, মা-বাবা থেকে আলাদা আরেক শহরে চাকুরির কল্যাণে নির্বাসিত একাকি জীবন কাটাই সপ্তাহের ছয় দিন। আর আর্কের টুলুর গান শুনি, ‘এই একেলা জীবন, ভালো লাগে না আমার…’। নিজের ভিতরেও একজন প্রিয়দর্শিনীর অভাব অনুভব করছিলাম।

একদিন মায়ের ফোন। তখন গ্রামীন ফোনের পোষ্ট পেইড যুগ। আমার বর্ডার সংলগ্ন কলেজের আবাসিক ভবনে আ্যান্টেনা দিয়ে কোনমতে নেটওয়ার্ক পাই। মা আমাকে শহরের বাসায় চলে আসতে বললেন। খুবই নাকি ‘আর্জেন্ট’।

বাসায় পৌঁছাতেই আমাকে বলা হলো, ‘আমরা মেয়ে পছন্দ করেছি, আজ অমুক আংকেলের বাসায় তোমাকে দেখবেন মেয়ে পক্ষ।’ আমাকে স্রেফ জানানো হলো। এক মুহুর্তে নিজেকে কোরবানির পশুর মত মনে হলো। একটু গাইগুঁই করার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না। বাবার সামনে ‘না’ বলার মত সক্ষমতা তখনও অর্জন করিনি।

খুব কাছের ক’জন বন্ধু ছিল আমার। মনের কষ্টটা ওদেরকে শেয়ার করতে চাইলাম। আমাদের আবাসিক এলাকা থেকে একটু দূরে অন্য আরেক এলাকায় থাকতো তারা। এটাও এক সরকারি কলোনি। বাবার কলিগদের বাসস্থান।

এক ভরা দুপুরে গেলাম ওদের কাছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ায় নিজেদেরকে ঝাঁপসা করে দিয়ে আমার টেনশনের কথাটা উপস্থাপন করলাম। বাবা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। এখন মেয়েপক্ষ আমাকে পছন্দ করলেই গেছি।
বন্ধুরা আমাকে টিপ্পনি কাটার পাশাপাশি হইহই করে আমাকে নিয়ে পড়লো। আমার অবস্থা কেন জানি ওদের আনন্দের খোরাক হলো। হয়ত এমনই হয় বন্ধুর বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে।

আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম ডি-টাইপের বিল্ডিং এর সামনের এক চিলতে সবুজের ওপর বসে। এল-টাইপের পিচের রাস্তা মাঠটাকে আবাসিক ভবনগুলির থেকে আলাদা করেছে। ফাগুনের পাতা ঝরার দিন। রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন বৃক্ষগুলি এলোমেলো বাতাসে নিরবচ্ছিন্ন পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাকে দেখলাম!

ছেলেবেলা থেকেই সুন্দরের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ। নারীর সুন্দর মুখশ্রী এবং রঙ তাদের ফিগারকে উহ্য রেখেই আমার অনুভবে দোলা দিয়ে যেত। ‘দুধে আলতা গাত্রবর্ণ ‘ কিংবা টোকা দিলে যেসব নারীর শরীরে রক্ত জমে যায়, এমন লাল-সাদা বর্ণ আমার ভিতরে আলাদা আবেদন জাগাতো (আমাকে বর্ণবিদ্বেষী ভাবাটাও কিন্তু ভুল হবে)। আমার ভিতরের ভালোলাগাটা ওভাবেই প্রকৃতিগতভাবে জন্মেছে, সেখানে আমার দায় কোথায়?
ডি-টাইপের এক তলা থেকে যখন সে বের হলো, প্রথম দর্শণেই আমার ভিতরের আমি নিজেকে জানালাম, ‘আমার পাঁজরের হাড় থেকেই একে বানানো হয়েছে! ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ন।’

পিচের রাস্তা দিয়ে গ্রীবা উঁচু করে উদ্ধত এবং নমনীয়’র মাঝামাঝি এক ভংগীতে সে হেঁটে যাচ্ছিলো। রাস্তার অপর পাশ দিয়ে আমাদের পাশ কাটানোর সময় সে আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। ওর দৃষ্টিতে কি ছিল জানি না, আমি লুটপাট হয়ে গেলাম!

আমার ভিতরে কোথায় যেন বেজে চলছিল, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’!

বাবার পছন্দের মেয়েকে দেখতে যেতে হবে, সে কেমন হবে, আমার তাকে কতটুকু ভালো লাগবে, তাদের আমাকে পছন্দ হবে কিনা ইত্যকার ভাবনা-চিন্তায় বিব্রত মন আমার। মনের আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। ঝড় না উঠেও বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে। ঠিক এমন এলোমেলো সময়ে আঁচল উড়িয়ে সে খোলা চুলে আমার সামনে এলো! আমি মুগ্ধ হলাম। ভালোলাগা ভালোবাসার আগুনে পুড়ে প্রেমে পরিণত হলো!

আমার ভাবনার চোয়াল শক্ত হতে থাকলো। জীবনে এই প্রথম ‘পছন্দের মেয়ে দেখা’ বিষয়ে বাবাকে ‘না’ বলার মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

সেদিন। আসরের নামাজের পর। আমাদের পুরা পরিবার সেই ‘অমুক’ আংকেল’ এর বাসায়। বাবাকে না বলা হয়নি আমার। যেতেই হলো।

বসার ঘর। ভাইদের সহ বাবা-মা ভিতরে সবে আসন গ্রহন করেছেন। দরজার মুখে দাঁড়ানো আমি। নিজেকে নিয়ে প্রবেশ করব। ভিতরে একবার অলস দৃষ্টি বোলালাম। আবারও মুগ্ধতা!

তবে এবার আমি অবাক হলাম! দুপুরের বাউরি বাতাসে আমাকে লুটপাট করা হেঁটে যাওয়া এলোকেশী সেই মেয়েটি মাথায় সবুজ একটি ব্যান্ড পরে বসে আছে। আমাদের চার চোখের মিলন হলো ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’!

মুহুর্তে প্রাণে আমার মন জেগে ওঠে। এতদিনের পরিচিত পৃথিবীটা একটুখানি বদলে যায় ‘ওকে’ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ সামনে পেয়ে। অপুর হৈমন্তিকে ‘পাবার’ মত আমিও ‘পাইলাম’ অনুভবে তাড়িত হলাম!

এরপর.. অনেকগুলি বসন্ত কেটে গেলো পাওয়া-না পাওয়ার গোলকধাঁধার ধোঁয়াশা ভূবনে। তবে ভালোবাসা আর প্রেম আমাদের ছেড়ে যায়নি কখনো। আমরা মানে আমি আর আমার লাল বউ, জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে, স্রেফ ভালোবাসায় মেখে মেখে- হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ তন্নতন্ন করে সুখ খুঁজেছি। কখনও হতাশ হইনি। সে আমাকে আগলে রেখেছে। মায়ায়, ভালোলাগায় আর মুগ্ধতায় যে নিরন্তর প্রেমময় আবহ তৈরী করে রেখেছে সে, যার বাইরে আমার কখনোই যাবার প্রয়োজন পড়েনি। অচল আমার থেকে সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে আমাকে আরো কাছে টেনে ওর বুকে ছোট্ট চড়ুই বাবুর মত আগলে রেখেছে।

এখনো সে আমার ভালোলাগার প্রথম প্রহর! এখনও সে শীতের নরম রোদের মত মায়াবী কোমল! সে উষ্ণতায় চোখ মুদে যাওয়া এক শীতের সকালে রোদ আর সাদা মেঘের ভিতরের মৃদু খুনসুটি। এরকম আরও অনেক অনেক বহু অনেক কিছুই সে!’

‘ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ ‘- হাসপাতালটির সামনে বাস থেকে নামার সময় ভাবে শিহাব। ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ধীর পায়ে এলোমেলো শিহাব কখন যে বিশেষায়িত এই হাসপাতালের দেড় তলার ‘টেস্ট রিপোর্ট ‘ নেবার কিউতে দাঁড়িয়েছে.. ধীরে ধীরে পেছন থেকে কিউতে সবার সামনে এসেছে, বলতে পারবে না। সময় ছিল স্থির.. মনের ভিতর ঝড় উঠেছে। গভীর সমুদ্রে ডুবে যাবার প্রচন্ড ‘সাইনাস পেইন’ অনুভবের প্রখর সীমায়। কিন্তু খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার মত কিছুই নেই। অন্য সব কিছুর মত শিহাবের লাল বউ-ই ওর জন্য আঁকড়ে ধরার একমাত্র খড়কুটো। সে-ই যখন ডুবে যাচ্ছে, কাকে আঁকড়ে ধরবে শিহাব?

বায়োপ্সি রিপোর্ট হাতে ভাঙ্গাচুরা একজন শিহাব হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে নিজের ইশ্বরের কাছে মিনতি জানায়, ‘ওকে ছাড়া আমি একমুহুর্তও থাকতে পারব না, আমাকে একা করো না!’

এক বিশেষায়িত হাসপাতালের দেড় তলা একটি কক্ষে ইশ্বর নিজের আলো এবং আঁধার দিয়ে একজন শিহাবকে জড়িয়ে রাখে। বাইরে সুর্য ডুবন্ত প্রায়। চলে আলো-আঁধারের মাঝে নিরন্তর দখল নেবার অন্তহীন খেলা।।

.
#মামুনের_ছোটগল্প