কবি তাড়াতাড়ি মরে যাক
এক.
হোয়্যারঅ্যাজ ইট অ্যাপিয়ারস যে কবিকে পঞ্চাশ বছর বয়েস হলেই মরে যেতে হবে। না মরুক, থেমে যাবে — তার মানেই তাই। সোজা কথা — কবিজনের মধ্যেকার কবি খতম হোক। এবং হোয়্যারঅ্যাজ ইট আবার অ্যাপিয়ারস: কবি যেন তিরিশ বছরের বেশি কাব্যচর্চা না করে (যে সময়সীমা আগে পার হচ্ছে, সেটাই বলবৎ)। নাহলে আনফিট কবি প্রচুর পাতলা লেখে আর রফা করে আর ভাটবাক্য বকে যায়।
লিখতে না পারার কারণ অসংখ্যবিধ। দৃষ্টি মোছে চোখ থেকে, মন নতুন দ্যাখে না, সবচেয়ে বেশি সরু হবে মন:সংযোগ। পুরনো প্যান্টের বোতামের মতো বিস্ময়বাটন খুলে পড়ে গেছে চেতনা থেকে — কাজেই কবিরই সর্বস্ব দ্যাখা যায় ফাঁক দিয়ে, কবিতা ছাড়া। ঘটনার পলেস্তারা খসিয়ে আইডিয়ার গাঁথুনিতে ব্রাশ ছোঁয়াতে পারবে না, শুধু ত্বক থেকে কথা বলা। নিজের পুরনো লেখা পড়ে আর ভাবে, শালা ফাটিয়ে দিয়েছিলুম।
[অ্যানেক্সচার ওয়ান: বাদ যাবে সেই সেই কবি যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।
কবিতার একটা মাথা-ঠেকে-যাওয়া, শ্যাওলাধরা চোরাদরজা আছে — পদ্য। পদ্যকে সিলেবল-এ ভেঙে দেখুন, পায়ুর সঙ্গে মিল পাবেন। কিন্তু পদ্যের পাছদরোজা গিয়ে থেমেছে কবিতার জাঙ্করুমে। ছানা নয়, গাদ থেকে তৈরি হল পদ্য এবং কোনও ট্যারিফ সিস্টেমেই চমচমকে আপনি রসগোল্লা বানাতে পারেন না! তবে এই টি-টোয়েন্টি সমাজব্যবস্থায় পদ্যের একটা ইয়াব্বড়ো ভূমিকা আছে, প্যারাসিটামলের মতো। যারা পদ্য লেখে তারা দীর্ঘজীবী হোক।
কবি মরে যাক।
দুই.
আপনার হার্ট আপনাকে অ্যাটাক করার আগে যেমন একদুবার শাসিয়ে দিয়েছে বুকের মাঝখানে ব্যথার চিউয়িংগাম লাগিয়ে, তেমনি নিজেই নিজের সেকেন্ড-হ্যান্ড হয়ে ওঠা কবিকুল প্রচুর গদ্য লিখতে শুরু করে, ছোটদের জন্যে গল্পছড়া, আর স্বপ্ন দ্যাখে উপন্যাস ছাড়ব বাজারে। ভাবে কিন্তু লেখার সাহস পায় না; ভালোরকম জানা আছে, কবিতা কাঁচি মেরে দেবে বাকি লাইফের মতো। আর লিখেই ফেললে উপন্যাস?
“আমার বিচার তুমি করো”।
[অ্যানেক্সচার টু-এ: আলোচনা থেকে বাদ যাচ্ছে সেই সেই কবি যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা মাল্টিপারপাস প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।
মুশকিল হল, পৃথিবীতে কাউকে এক্স-পোয়েট বলার চল নেই। একবার কেউ কবি, তো চিরকাল এক্সপ্লয়েট করবে তোমাকে।
কবি মরে যাওয়ার দ্বিতীয় লক্ষণ, সে পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকবে, নিজের প্রকাশনীও খুলে ফেলতে পারে। [অ্যানেক্সচার টু-বি: বাদ যাবে ওই ওই কবির নাম যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা সাংগঠনিক প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।
কবিদের তিনটে দশা আছে ব’লে আমার ধারণা। এক: শুধু কবিতা লেখা (সৃষ্টি)। দুই: কবিতা লেখা আর ছাপানো (স্থিতি)। তিন: শুধু ছাপানো (প্রলয়)।
এই প্রলয়কালের আগেই কবিকে রুখে দিতে হবে। সে তো মরা নক্ষত্র। আলো ছড়াচ্ছে মানে বেঁচে আছে ভাবলে এত চরম ভুল হবে, আপনি বিরাট কোহলির মতো সর্বোচ্চ পরিমাণ জিভ কেটে গোটা বাংলাদেশ খেপিয়ে দেবেন। ধরুন, কবি তিনটে কবিতার বই লিখে ফতুর হয়ে গেছে। কিন্তু সুবুদ্ধি করে থামে আর কে? ফুরিয়ে যাওয়ার সিকি শতাব্দী পরে তার প্রথম কবিতার বই নিয়ে নাড়াচাড়া। ওই মরা তারার আলো আসা শুরু হল। কবি উৎসাহিত হয়ে বাইশ নম্বর কাব্য প্রকাশ করে দিলেন, তাতে সবক’টা অপদার্থ কবিতা। জনমনস্তত্বের নিয়মে সেই কিতাব নিয়েও হইচই পড়ে যাবে। ইতিমধ্যে এতদিনে তার দু’নম্বর কবিতার বইও পাঠকদের মনে ধরতে লেগেছে। ব্যস, মরা তারার তেইশতম কাব্যগ্রন্থ পেয়ে গেল অ্যাকাডেমি/জ্ঞানপীঠ/নোবেল, যেকালে একটা পদের পদ্য লেখার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে বসে আছেন।
সার্ত বেনি লেভিকে বলেছিলেন, পুরস্কার কমিটি লেখকের সেই বইটা বেছে নেয় যেখানে লেখকের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তারপর সেটাকে পুরস্কার দিয়ে লেখকের কফিনে পুঁতে দেয় শেষ পেরেক।
প্রায় একশো বছর হয়ে গেল, সাহিত্য সমাজকে আর প্রভাবিত করতে পারে না। সফটঅয়্যার-বিনোদনের যুগে তার অবস্থা সুকিয়া স্ট্রিটের দোতলার লেটারপ্রেস। সাহিত্য-পুরস্কার কথাটারও তাই মানে হয় না কোনও। তবু আমি যদি “বউ নেই শ্বশুরবাড়ি যাই পূর্বের সম্বন্ধে”, তবে ওই বাচ্চা ছেলেটা-মেয়েটাকে তাদের প্রথম বা দ্বিতীয় বইয়ের জন্যে পুরস্কার দিই না কেন? দিয়ে দেখি গলার মালা নিয়ে আর কী গুলদস্তা সে তৈরি করতে পারে, নাকি মালাটি হয়ে ওঠে মালা-ডি? তা-নয়তো মরা বডিতে কোরামিন মারো, সাহিত্য অ্যাওয়ার্ড-এর নাম পালটে সাহিত্যগ্র্যাচুইটি রেখে দাও…
যত্তো ঝামেলি!
তিন.
কবি শুরুতে পয়-পরিষ্কার থাকে। কল্পনার অতিবারিশ, ফুলটু সাহস, মোবাইলে মেসেজ করতে করতে গাড়ির নিচে চলে আসার মতো লেখার আত্মবিনাশী ঘোর, ভাসানো আবেগ, ভাষাআরশির ঝকমকানি, সততা নামের সেরা জীবনবিমা, ছাঁচ ভাঙার মেজাজ — এসবই অল্প বয়েসি লিভার-কিডনির সম্পদ। টাকমাথা ফাটিয়ে দুব্বোঘাস গজাতে পারে, কবিতা কক্ষনো নয়। সবচেয়ে আশার কথা, তরুণ কবিদের কেউ পোঁছে না। নন-এনটিটি না হলে তুমি লিখবে কী করে!
আরও একটা অতিরিক্ত ভালো হচ্ছে, নতুন কবিরা নিজের বাইরে পাঠক খুঁজতে বেরোয়নি। তাই কবিতা-ব্যতিরেকী কিছু তাদের বিরক্ত করতেও পারবে না। হুঁ, জীবনবোধের অভাব আছে বটেক। কিন্তু শিল্প তো আশমানি দুনিয়ার কথা বলে, টাটকা ফ্রেশ এক মহল্লার ইজারা নেয় — পুরনো বই পুরনো হাড়ে যার ইশারা খচিত হয়ে নেই।
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল শক্তিকে আটকানো। শক্তি অনেকটা কাপুরের মতো, চান্স পেলেই চরণামৃতকে চুতিয়া বানিয়ে দেবে। এদিকে, শুধু বেঁচে থাকার অভ্যেসই ক্ষমতাবান করে তোলে আমাদের। সেই ক্ষমতাপাথর কিডনি থেকে নিয়মিত গলিয়ে বার করে দেওয়া রামশ্যাম কবির কম্মো না [অ্যানেক্সচার থ্রিঃ ইন্দ্রজিতের তালিকায় আছেন অল্প একমুঠো সু-খতরনাক, বেকায়দা প্রতিভাবান, আড়েবল্লে, আত্মডাক্তার কবি হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ ]।
রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ক্যাঙারু-থলিতে যে অনেক পুঁচকে রাষ্ট্র বসত করে, সাহিত্যরাষ্ট্র তাদেরই একজন। আবার সব সাহিত্যরাষ্ট্র মিলে এক আন্তর্জাতিক ইউনাইটেড স্টেটস অফ লিটারেচার। এইরকম বিভিন্ন ইউএসটিআর (ট্যাক্স রিসার্চ), ইউএসপি (শান্তি), ইউএসডিবি (ড্রাগ ব্যারনস), ইউএসবিএম (কালো টাকা) হয়ে থাকে। [দয়া করে ভাববেন না, কবিতালেখা আর সুপারিকিলিং বা শান্তিপ্রচেষ্টা ও নারীপাচারকে পাশাপাশি বসাতে চাইছি। আমি শুধু বিভিন্ন ছোট ক্যাঙারুর সাংগঠনিক জীবন নিয়ে কথা বলছিলাম]।
আমরা জানি, বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিড আর প্রতিষ্ঠা পাওয়ার খ্বাহিশ একই তালে বাড়বে, যেভাবে মানবশরীরের দুই প্রধান অঙ্গ জিভ আর লেজও লম্বায় সমান-সমান। তাছাড়া, জিভ যতখানি ভিজে ওঠে, লেজও নড়ে ততটা। কবির যদি শিয়ালজন্ম হয়, তবে তার গতি: শিয়াল থেকে কমার্শিয়াল, কবি থেকে সম্পাদক, লেখক থেকে নেতা, সংবর্ধনা থেকে সাহিত্যপুরস্কার, দেশ থেকে বিদেশ।
এভাবে পেছল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কেউ সাহিত্যরাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হড়কে যেতে পারে। তার মানে কবি থেকে কবি-প্রশাসক, যদিও কবি শব্দটা বিশেষ্য থেকে বিশেষণে গিয়ে আরেকটু প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ল।
এই ঘনচক্করে কবিতা গেল কোথায়! খোঁজ খোঁজ, এ-পকেট ও-পকেট ট্রলিব্যাগ রুকস্যাক… জিভছোলা ফেসক্রিম এমনকি সাবানমাখা খোসাটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে লিস্ট করে গোছানো, কিন্তু যাঃ ট্রেনের টিকিটই আনতে ভুলে গেলাম নাকি! এভাবে জংশন স্টেশনে কবি থেকে কবিতা আলাদা হয়ে যায়, খসে পড়ে — বৃষ্টিথামা মাঝরাতে পারদআলোয় অচেনা প্ল্যাটফর্মে গাছের পাতা থেকে যেভাবে ছিটকে হারায় জলের ফোঁটা।
বুড়ো কবি কিন্তু থানায় একটা ডায়েরিও লেখাতে পারছে না ফতুর-হয়েছি মর্মে, কেননা সে এখন সত্তায় পর্যবসিত এবং এনটিটি-র জীবানু তোমার ভোকালকর্ড নষ্ট করে দেয়। সেই “হোয়্যারঅ্যাজ ইট অ্যাপিয়ারস” কবিকুলকে কেউ বলে দিচ্ছে কি: বয়েস পঞ্চাশ হয়ে গেলে বা তিরিশ বছর ধরে লেখালিখি, হুইচএভার ইজ আরলিয়ার, কবিতা ছেড়ে দিতে হয়? বয়স্ক মুখগুলো দেখছে — নক্ষত্রের ছায়া অনেক দূরে যদিও, তারা নিজেরা পাদপ্রদীপের আলোয় ভাসমান। তখন সবাই এটাও কেন মনে করাতে ভুলে যাবে: পাদপ্রদীপ শব্দের দুটো অংশ খুব স্ববিরোধী, এবং পাদের হাওয়ায় প্রদীপ নিভে যায়!
আপনার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এবং তার শাব্দিক প্রকাশ নিঃসন্দেহে প্রশ্নাতীত। অভিনন্দন প্রিয় চন্দন দা। শুভ সকাল।
আপনার লিখায় শেখার অনেক উপকরণ থাকে চন্দন দা।
পুরোটা পড়েছি। দু দু বার।
অনেক হেসেছি। অনেক শিখেছি।
কবি মরে যাক, বেঁচে থাক কবিতা।
ধন্যবাদ জানবেন। ভাল থাকবেন।
অসাধারণ একটি শিরোনাম। আগে পড়েছিলাম চন্দন দা।