চলন্ত রিক্সায় দুই যুবক। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওদের হ্যাণ্ডসেটে বেজে চলা বাপ্পী লাহিড়ীর গানের কলি ভাসে বাতাসে। কেমন স্মৃতিকাতরতায় আপনাতেই ভেসে যায় মন!
শীত তেমন জাকিয়ে বসেনি। এখন ক্লান্ত মধ্যদুপুর। শেষ হবো হবো করছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। মেঘবালিকাদের মন খারাপ। ক্যাম্পাসের লম্বা পিচঢালা রাস্তা দু’পাশে জারুল গাছের ছায়ায় নিজের কায়া বিসর্জন দিয়েছে। একা একজন মানুষ। উদ্দেশ্যহীন হেঁটে চলেছে। স্কুল ও কলেজের গেট অতিক্রম করতেই, চিকন সুপারি গাছগুলোর পিছনে কাকচক্ষু জল নিয়ে নীরবে নিজের অস্তিত্ব কে জানান দেয়া দীঘিটি দৃশ্যমান হলো।
সেদিকে তাকাতেই চিনচিনে ব্যথার এক গভীর গহবরে যেন প্রবেশ করলো রাহাত। ওপাড়েই ওই যে দেখা যায় শিমুল গাছটিকে! যখন ফুলে ফুলে গাছটি ছেয়ে থাকত, শিমুলে আগুন জ্বেলে ফাগুনের বয়ে যাওয়া মাতাল সমীর… সময়ের বুকে রেখে যাওয়া স্মৃতিদের ডানা ঝাপটানোর সেই আওয়াজ -এ সব-ই পড়ন্ত হেমন্তের এক বিকেল বেলায় রাহাতের সামনে মুহুর্তে এসে হাজির হয়।
ওইখানে একসময় ওর বাড়ি ছিল। প্রথমে একটি ঘর, এরপর রিতাকে নিয়ে সেই ঘরটিকে বাড়ি বানাতে কি আপ্রাণ চেষ্টাই না করেছিল সে। আইনের ফাঁকফোকর আর সংশ্লিষ্ঠ মানুষগুলোর ভিতরের বিদ্যমান লোভ, একদিন ওকে ওদের ‘বাড়ি’ থেকে উচ্ছেদ করে।
এরকমই এক শীতের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে নামবে মুহুর্তে- রিতার হাত ধরে বাচ্চাদেরকে নিয়ে, রাহাত কে চলে আসতে হয়েছিল। পিছনে কুয়াশাচ্ছন্ন এক পথ, যে পথে কখনোই হয়তোবা আর হাঁটা হবে না!
একটা কুকুর। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওর পিছু পিছু আসছে। একবার ফিরে তাকায় রাহাত। বিস্মৃতির আড়ালে আরেকটি কুকুর দৃশ্যমান হয় হঠাৎ। যখন ওর বাড়ি ছিল, সেই কুকুরটি রোজ আসত ওর বাড়ির সামনে। সকাল-বিকাল কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। কুকুরদের ও কি নিয়মের ভিতরে চলতে হয়? রাহাত জানে না। তাই ভাবনাটা সেদিকে যেতেও চায় না। তবে অন্য কিছু ভাবনা বয়ে চলে। কুকুরটিকে প্রতিদিন সে নিজের ভাড়া দেয়া মুদি দোকান থেকে একটা করে বনরুটি খাওয়াতো। সেই থেকে পশুটি ওর ন্যাওটা। ফজরের আজানের সময়ে মসজিদে যাবার সময়ে, পথের পাশে কুকুরটি ঘুমে থাকত। রাহাত অতি সন্তর্পনে শব্দ না করে ওকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করেও দেখেছে। কুকুরটি ওর শরীরের ঘ্রাণে কিভাবে যেন জেগে যেত! মসজিদ পর্যন্ত পিছু পিছু আসত।
সেই বিপর্যয়ের দিনে রাহাত আশেপাশে কাউকে পেলো না। কুকুরটি ঠিকই হাজির হয়েছিল। রাহাতের সকল মালামাল যখন রাস্তায় ফেলে দেয়া হচ্ছিল, একমাত্র কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করছিল আর ওর পাশে পাশে লেজ নেড়ে কুই কুই করছিল। সেদিন রাহাতের অন্য পরিচিত মানুষেরা তাঁদের লেজ দু’পায়ের মাঝে লুকিয়ে পালিয়েছিল। অথচ একই দোকান থেকে তাদের পেটেও বনরুটি প্রবেশ করেছে। তারা মনে রাখেনি, কুকুর মনে রেখেছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তবে কখনো কখনো কিভাবে যেন মানুষ নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়, সেদিন দেখেছিল রাহাত।
একবার এক পীরের কাছে বায়াত হয়েছিল। একজন পীর ভাই ছিল ওর। ওর বাসায় আসত যেত। পরিবারের সদস্যের মত ছিল সে। সেই দিন প্রভাবশালী এই ‘ভাই’টিকে ও পাশে পায়নি রাহাত।
এক শীতের রাতে এক আন্ডার কন্সট্রাকশন বাসায় বউ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাত কাটাতে হয়েছিল অভুক্ত অবস্থায়। সে রাতে কাছের আত্মীয়েরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হয়ত ভয়ে পালিয়েছিল। কুকুরটি সারা রাত দু’পা সামনের দিকে বিছিয়ে ওর মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল। অভুক্ত সন্তানদের ক্লিষ্ট চেহারা দেখে নীরবে জল গড়িয়েছিল রিতার চোখ বেয়ে।
সেদিন আরেক লোকের জায়গায় সাময়িক ভাবে রাহাতের মালামাল দখলকারীরা ফেলে দিচ্ছিল। সেই অতি পরিচিত লোকটিও তার জায়গা থেকে মালামাল দ্রুত সরিয়ে নিতে বলেছিল। তাঁর প্রাইভেট কার ঢুকতে পারবে না সেই চিন্তায় তিনি ব্যস্ত ছিলেন!
সেই সময় কেটে গেছে। নিজের অবস্থান বেশ সুদৃঢ় করেছে বিগত বছরগুলিতে। কয়েকদিন আগে সেই লোকের ছেলে একটা চাকরির জন্য এসেছিল রাহাতের কাছে। বিয়ে করে বউকে নিয়ে খুবই অসহায় অবস্থায় আছে সে। মা-বাবার অমতে বিয়ে। রাহাত পরিচিত এক জায়গায় বলে ক’য়ে ছেলেটির চাকরির ব্যবস্থা করেছে। এমন-ই রাহাত। বিবর্ণ সময়ের তিক্ত অনুভব নিজের মনে পুষে রাখলেও, তিক্ততার আস্বাদ অন্যদেরকে পেতে দেয় না সে।
বিকেলগুলো সব একই থাকে, বদলে যায় শুধু আমাদের দেখার ভঙ্গিটি। সময়ের বুকে বয়ে চলা পীড়িত অসময় কতটা দীর্ঘস্থায়ী? ওর রুক্ষ কর্কশ অনুভূতিতে প্রলেপ দেয়, এমন কিছু আদৌ আছে কি?
#উত্থান_পতন_অণুগল্প_৪৫৬
বিকেলগুলো সব একই থাকে, বদলে যায় শুধু আমাদের দেখার ভঙ্গিটি। … চমৎকার অণুগল্প উপহার দিয়েছেন মি. মামুন। ধন্যবাদ আপনাকে। এমনি করে পাশে থাকুন।
অণুগল্পটি পড়ে আপনার সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার শুভেচ্ছা গ্রহন করুন ভাইয়া।
স্বাগত আপনাকে।
পাশেই আছি ইনশা আল্লাহ।

অসাধারণ গল্প দা।
গল্পটি পড়ার শুভেচ্ছা রইলো রিয়াদি'
ধন্যবাদ।
অসাধারণ মহ. আল মামুন ভাই।
ধন্যবাদ প্রিয় কবিদা'