অণুগল্প_ নিজস্ব_বৃত্তে

ঘোর কুয়াশায় ঢাকা সকাল। মনে হচ্ছে ভোর। আসলে সোয়া আটটা। ভার্সিটির নির্জন কাটাপাহাড়ের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছিলো হীরক আর তৃণা। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই একে অন্যের ছায়ার মত। দুই বন্ধু, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। দু’জন ভারী শীতের কাপড় আর ঘন কুয়াশার আড়ালে দুটো ছায়ার মত পাশাপাশি হাটছে। স্টেপগুলি ভারী। পা জমে আছে। হীরকের শুধু নাক আর মুখের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। তৃণার মুখ খোলা। তার গায়ের উলেন কার্ডিগানটা বেশ গরম, আরাম।

হীরকের সারা বছর ভোরে গোসলের অভ্যাস। ওর একটু বেশিই ঠান্ডা লাগছিল। সে তৃণার দিকে ফিরে হাসল, ‘একটু কাছে আয় তো… আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখ। দেখ, এখানে কি শীত। আমাকে তোর কার্ডিগানের ভিতরে নে। উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে রাখ।’

তৃণা হীরকের এই বেকায়দা কথাবার্তাগুলির সাথে পরিচয়ের শুরু থেকে পরিচিত। হীরককেও সে খুব ভালো চেনে। এখন যদি তৃণা এক পা- ও কাছে যায় হীরক গালি দিতে শুরু করবে, ‘বেহায়া, শয়তানের অস্ত্র তোরা!.. ‘ সে মৃদু হাসল। কিছু বলল না।
অবশ্য আজ হীরককে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। উদাস। কিছু ভাবছে। তৃণা হাঁটতে হাঁটতে তাকে এক পলক দেখে।

হীরক অন্যমনষ্কভাবে বলল, ‘আমি সবসময়েই তোর আশে পাশে আছি। আমি তোকে ভালোবাসি।’ একটু থেমে তৃণার দিকে তাকিয়ে আবার পথের দিকে চোখ ফিরাল। হিসাবের সুরে বলল, ‘ভালোবাসা কি আমি তোর কাছ থেকে শিখেছি? তোকে এতো অপমান করেছি, তারপরও তুই আমার। আবার তুই ও আমাকে অপমান করেছিস, তারপরও আমি তোর। আমিই একটু বেশী করেছি, তাই আমি তোকে একটু বেশী ভালোবাসি। তুই একটু কম বাসিস।’

কিছুক্ষণ দু’জন চুপচাপ হাটতে থাকল। সামান্য পথ। মাঝামাঝি চলে এসেছে। দুই পাশের পাহাড়ের অপরূপ নির্জনতার অপার্থিব সুখ তাজা ফুলের ঘ্রাণের মত নি:শ্বাসে বুক ভরে নিচ্ছিলো ওরা। পাখিরা ঘর ছাড়ছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে।

হীরক হঠাৎ কথা বলে উঠল, ‘ভালোবাসা আর ঘৃণা হাত ধরাধরি করে হাঁটে। ‘ একটু থেমে বলল,’আমার একটা স্বপ্ন- তোর হাত ধরে এই কাটাপাহাড়ের ভিতর দিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যাওয়া। হেঁটে যেতে যেতে বাতাসে তোর খোলা চুল উড়বে । দু’একটা চুল তোর চোখ ঢেকে দিবে। তোর শরীর থেকে বুনো ফুলের ঘ্রাণে আমি মাতোয়ারা হবো। আমি ঘাড় বেঁকিয়ে তোর দিকে ফিরে তোর নিঃশ্বাসের দূরত্বে চলে আসবো! ‘

হীরকের কথাগুলি যেন আর কোথাও থেকে ভেসে আসছিল! শব্দের উৎস গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল। তৃণা নি:শব্দে হীরকের অনুভুতিগুলি অণুসরণ করছিল। সে একটু একটু কাঁপছিল। মুখটা গরম হয়ে গেছে। সে একেবারেই চুপচাপ মাথা নিচু করে হাটতে থাকল।তার ভয় হচ্ছিল। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, যেন সে কিছুতেই তার বন্ধুর জীবনে পদস্খলনের কারণ না হয়। সমস্ত মন দিয়ে তৃণা হীরকের ইচ্ছেগুলো অনুভব করছিল। হীরক অস্পষ্ট গলায় একমনে বলে যাচ্ছিল, ‘এরপর…এরপর তোর চোখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলোকে আলতো করে সরিয়ে দেবো। যাতে তুই আমাকে দেখতে পারিস।’ হীরক তৃণার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,’ তুই কি আমাকে পুরোপুরি কখনো দেখেছিস?পুর্ণ দৃষ্টি দিয়ে? আমাকে তোর দেখতে ইচ্ছে করে না?’

তৃণা নি:শ্বাস গোপন করল। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সীমা মানবে। বিয়ের এক মূহুর্ত আগেও কেউ কারো দিকে আর কখনো হাত বাড়াবে না। হীরকের স্বর স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। অনেকটা গল্প বলার মত। হীরক বলছিল, ‘তোর ঠোটের উপরে ঘামে ভেজা ত্বক একটু একটু করে কাঁপছে…তুই অস্ফুটে আমায় কিছু বলতে চাইছিলি?

তৃণার ঠোঁটে একটু হাসির রেখা ফুটল। ঠান্ডায় গরমের দিনের কল্পনাতে সুখ খুঁজছে হীরক। সে বলল,’বলতে চেয়েছিলাম -“ভালো লাগছে তোর?” ‘

হীরক মুখ তুলে একবার আকাশ দেখল। বলল, ‘মুহুর্তটা একটা প্রচন্ড কামনার ভাব উদ্রেক করেছিল আমার… এই নির্জন পাহাড়ঘেরা জায়গায় শুধু তুই আর আমি… কত কিছুই তো হতে পারত… ক্ষণিকের পদস্খলন… কিন্তু একটা স্বর্গীয় অনুভূতি এসে আমাকে বদলে দিল। আমি শুধু তোর নাকের পাশের তিলটিকে আলতো ছুঁয়ে দিলাম….আবার তোর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম… একটা প্রশান্ত সবুজ উদ্যানের দিকে।’ জ্যাকেটের পকেটে রাখা হাতগুলির মুঠি খুলে দিল সে। বাইরে আনল না।

এক মূহুর্ত চুপ থেকে কিছু ভাবলো হীরক। একটু হাসল। বলল, ‘বন্ধুর হাত ধরাটাই আসল ব্যাপার। ওখানে সকল শান্তি… পরম নির্ভরতা।’

জ্যাকেটের দুই পকেটে দুই হাত গুঁজে স্বপ্নচোখে হীরক পথের শেষে তাকিয়ে আছে – দৃশ্যটা দেখে তৃণা পূর্ণশ্বাস ফেলে হাসল, ‘ হ্যা ‘..

শহীদ মিনারে চলে এসেছে ওরা।
হীরক একটু হেসে বলল, ‘আলহামদুলি’ল্লাহ! আমরা ফিরতে পারলাম!’

সে মুখ থেকে মাফলার সরিয়ে ফেলল। পিঠের হালকা ব্যাগের ফিতা ঠিক জায়গায় নিতে নিতে বলল, ‘আমি তোকে অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক… ভালোবাসি! তুই কি বুঝিস?’

তৃণা হাসল,’হ্যা ‘..সে হীরকের গল্পের শেষে পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছিল। হীরক বাস্তবে হাত কখনও বাড়ায়নি ঠিকই, অন্যদিন হীরকের বুনো সব চিন্তা আর ইচ্ছে তৃণাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ভোগ করত। আজ সে শান্তি পেয়েছে.. তার খুব ভালো লাগছিল।

হীরকের মুখে কিছুটা বিষাদের আভাস। সে বলল, ‘একটা জিনিস দেখ, অন্য বন্ধুরা যারা তোর আর আমার কথা জানে, ওরা মনে করে আমরা আর দশজনের মত। কিন্তু – ‘

কিন্তুটা তৃণা জানে। এই কিন্তুটার জন্যই সে হীরককে বেশি ভালোবাসে। সম্মান করে। সতেজ একটা হৃদয়। স্বচ্ছ বিবেক। অনেক কিছুই সে অন্যদের চেয়ে অন্যভাবে দেখে। এই যে এই ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন তা কেবল বাস্তবে না ছুঁয়ে থাকার জন্য। সে তার অনুভুতির স্বীকৃতি চায়, কিন্তু, পাপকে সে মেনে নিতে পারে না। সে কল্পনাতে জীবন কাটায়, কিন্তু মিথ্যা বলেনা। ঠকায় না। তাকে নিয়ে অন্য বন্ধুদের মত অন্যদের সাথে ফান করে না। এই নারকীয় উল্লাসের পৃথিবীতে মানুষটা ভিন্ন।

শুরুটা তাদের অন্যদের মতই দেখাচ্ছিল। অন্য দশটা সম্পর্কের মত পরিণতি তারা চায়নি। যা হবে ফেয়ার হোক। চারপাশের পৃথিবীর সমস্ত অনাচারে ব্যথিত মন দুটি স্বেচ্ছায় সব চেনা জানা কিছু থেকে, সমস্ত বাজে অভ্যাস থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে এনেছে। তাদের পৃথিবী স্বচ্ছ, সুন্দর।

‘আত্মাকে শুদ্ধ করার জন্য আমাদের যুদ্ধটা কি ওরা জানে? দেহ থেকে শুরু হয়ে আবার হৃদয়ে ফিরে আসাটা যে কতটা টাফ, সেটা ওরা কখনোই বুঝবে না।’

তৃণা বলল,’ওদেরকে কী দোষ দেবো? বাইরে থেকে আর ভিতর থেকে তো দেখতে এক হয় নারে ‘
হীরক জেদী গলায় প্রতিবাদ করল,’না! দোষ ওদের। ওরা ভালোটা ভাবতে পারে না। এজন্যই বীণা দল ছেড়ে চলে গেছে, তোর আমার ব্যাপার নিয়ে। শিহাব আমার সাথে আলগা। তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। মিনা ও দূরে। অবশ্য শুরুতে এরা কেউ ই আমার কাছে ছিল না।’

একই কষ্ট তৃণার ও মনে। সে বলল,’ আমি সবাইকে ভুলে গেছি। ‘
হীরক জিজ্ঞেস করল,’আমাকেও? আমার তোকে দরকার।”
তৃণা হাসল,’আছি ইনশাআল্লাহ। ‘
হীরক সুখী হাসি হাসল, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা, চল ক্লাসে যাই।’

ওরা মিনা, বীণা, শিহাব সবার সাথে একই ক্লাসে গিয়ে বসল। নিজেদের মত।

#নিজস্ব_বৃত্তে_অণুগল্প_৪৫৮

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

10 thoughts on “অণুগল্প_ নিজস্ব_বৃত্তে

    1. ধন্যবাদ রিয়া দিদি গল্পটি পড়ে আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. গল্পটি পড়ার শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা গ্রহন করুন প্রিয় কবিদা!

      https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  1. * সুন্দর একটি অনুগল্প পড়লাম… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif। শুভ কামনা সবসময়।

  2. ভালো লাগলো ! লেখককে ধন্যবাদ । সাথে শুভকামনা সারাক্ষণ ।

    1. আপনাকেও ধন্যবাদ গল্পটি পড়ে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।