জোড়া অণুগল্প

জোড়া অণুগল্প
**
আমি যেখানে বসা আছি, সেখান থেকে একদিন নিজেকে দেখার চেষ্টা করি এক নিরব প্ল্যাটফরমে, ওয়েটিং পিলারের সাথে হেলান দিয়ে বসে।

একটা অপেক্ষমাণ ট্রেন আর আমার ছায়া নিয়ে আমি এক উল্টাপাল্টা জীবনের অধিবাসী হয়ে বসে আছি, নিজেকে দেখবার ব্যাকুলতা মনে।

থার্ড ক্লাস সিটিজেনের ছায়ারও কায়া থাকে, আমার কায়া কোথায়.. সবাই আমার যে ছায়া দেখে ওটাই কি আমি?

এই দেশে আমি নাগরিকদের কোনো শ্রেণিতেই পড়ি না।

#শ্রেণিহীন_অণুগল্প_৪৮৮

**
মেইন রোডের সাথে অফিসের মোড়ে এসে প্রচন্ড জ্যামের কারণে ইমরুলকে নিয়ে আসা মাইক্রোবাসটি অনেক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আরো অনেক অফিসগামী মাইক্রোবাস, মালামাল ও যাত্রী নিয়ে ট্রাক-বাস-টেম্পু আর ম্যাক্সির ভিড়ে, ইমরুলের অফিসের নীল মাইক্রোটিকে আলাদা করা যাচ্ছে না। সাথের অন্য কলিগেরা প্রায় সবাই-ই ঘুমে। দু’একজনের নাক ডাকছে। স্মিত হেসে ভাবে ইমরুল, রাতের বেলাটা এরা বাসায় কি করে? ঘুমায় না নাকি?

জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। লাইন ধরে পথের ভাঙ্গাচুরা অংশ দিয়ে যার যার কর্মক্ষেত্রে চলে যাচ্ছে সেলাই দিদিমনিরা। সেলাই বন্ধুরা। কত রঙ বে রঙ এর পোশাক পরণে তাদের। কিন্তু জীবনটা কি ওদের পরিধানের পরিচ্ছদের মত-ই বর্ণীল?

হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি পড়ছিল। মোবাইলে পিডিএফ ফাইলগুলি অফিসে আসা-যাওয়ার সময়গুলোতে ইমরুলের বিশ্বস্ত সঙ্গী। কোনাবাড়ি থেকে অফিস শেষে ঢাকায় নিজের বাসায় পৌঁছাতে, দুর্বিষহ বেশ কয়েকটি জ্যামের কবলে পড়তে হয়। নাগরিক বিড়ম্বনা। সেই সময়গুলিতে পিডিএফ গুলোতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে।

সামনের মাইক্রোটির টেইল লাইট জ্বলে উঠতেই ইমরুলদের গাড়ির ড্রাইভার বাসেত তৎপর হয়। কে কার আগে যাবে তার-ই এক দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমরুল। কেউ-ই আইন মেনে চলতে চায় না।

মোড় ঘুরে মেইন রোড থেকে শাখা রোডে ঢুকতেই ওদের কারখানাটিকে দেখতে পায় সে। চকিতে একটু আগে পড়া গোর্কির লাইনটা মনে পড়ে-‘কারখানার উঁচু উঁচু পাথুরে খুপরিগুলো ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার আত্মপ্রত্যয়ে।’

হ্যা! যদিও দুই দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্নতায় আবহাওয়া উপযোগী ইমারত নির্মাণের কারণে, ইমরুলের কাছে নিজেদের কারখানাটি উপন্যাসে বর্ণিত হুবহু অনুভব আনে না; কিন্তু সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এই বিশাল কংক্রিট- কাঠামো যে ওদেরকে গিলে খেতেই অপেক্ষায় রয়েছে, সেটা ভেবেই নিজের অজান্তে মনটা একটু দমে যায়। দীর্ঘশ্বাসগুলোও কেন জানি মহানগরের ভিতরের ছোট্ট এই নগরের প্রাচীরে বাঁধা পেয়ে ফিরে ফিরে আসে।

ওখানে দীর্ঘশ্বাসগুলির জন্ম হয় বলেই কি?

#একদিন_প্রতিদিন_অণুগল্প_৪৮৯

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

8 thoughts on “জোড়া অণুগল্প

  1. জোড়া অণুগল্প অসাধারণ লাগলো মি. মামুন। রিয়েলি আপনি একজন জিনিয়াস। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. এই দেশে আমি বা আমরা নাগরিকদের কোনো শ্রেণিতেই পড়ি না। কথা সত্য। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।