গল্প নভেল নিয়ে টুকটাক কিছু কথাঃ শেষ পর্ব (অণুগল্প)

অণুগল্প বিষয়ে আমি যা জানি বা যা বুঝি আজ সেটা নিয়ে কথা বলবো। তবে তার আগে আধুনিক গল্প নিয়ে একটু বলতে চাই।

আধুনিক গল্পের মূলকথা হলো, “how people respond to life”; অর্থাৎ জীবনের গল্পই আধুনিক গল্প (বড়গল্প, ছোটগল্প, অণুগল্প) যেখানে কোন ভূমিকা বা উপসংহার থাকেনা। কারণ জীবনের কোন ঘটনা ভূমিকা দিয়ে শুরু হয়না এবং তাতে উপসংহার সাধারণত অনুপস্থিত থাকে।

একটা উদাহরণ দেই। দুদিন আগে এক রিক্সাচালক এবং আরোহীর মধ্যের একটা ঘটনা সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে। ওটার অনুকরণে আবার অন্য কাহিনি বানিয়ে সেটা ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে। কাহিনিটা বলি।

“বেশ পথ ট্রাভেল করার পর কম বয়সী এক মহিলা আরোহী রিক্সাচালককে কুড়ি টাকার একটা নোট দেয় এবং দশটাকা ফেরত চায়। চালক বলে, ভাড়া কুড়ি টাকাই। এক পর্যায়ে মহিলাটি উত্তেজিত হয়ে চালকের গায়ে হাত তুলে। রাজধানীর ব্যস্ত এলাকায় দুপুরের দিকের কাহিনি। পথচারীদের কেউ পাশ দিয়ে যেতে যেতে; আবার কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখছিল কিন্তু কেউ কিছু বলছিলনা। একপর্যায়ে এক ফেরিওয়ালা এবং তার দেখাদেখি আরও একজন রিক্সাচালকের পক্ষে এগিয়ে আসে।”

ভাইরাল ঘটনা বা অনুকরণে বানানো ঘটনাটার কোন ভূমিকা বা উপসংহার ছিলনা এবং নাথাকাটাই বাস্তব। ওটা নিয়ে লেখা গল্পই আধুনিক ছোটগল্প হতে পারে। এই বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলি-

ক) ওটা একক ঘটনা ছিল এবং ঢাকা শহরের একটা রাস্তায় সীমিত সময়ব্যপি ঘটেছে
খ) তিন চারটা চরিত্র থাকলেও রিক্সার আরোহীই মূল চরিত্র যাকে কেন্দ্র করে মূলত ঘটনাটা আবর্তিত হয়েছে। মূল চরিত্র নায়োকিচিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই এবং এখানেও সেটাই হয়েছে। মূল চরিত্রটার বাইরে চালক ব্যতিত বাকি চরিত্রগুলি বৈশিষ্টপূর্ণ ছিলনা
গ) সুস্পষ্ট কনফ্লিক্ট (রিক্সার ভাড়া নিয়ে মতদ্বৈততা) আছে যা মূলত আরোহী এবং চালকের মধ্যে (অন্য ঘটনায় মূল চরিত্রের নিজের সাথে নিজের, মূল চরিত্রের সাথে সমাজের বা পরিবেশের সাথেও হতে পারে)
ঘ) ভাইরাল ঘটনাটা নানান জন নানান ভাবে ফেইসবুকে/ইউটিউবে উপস্থাপন করেছে এবং উপস্থাপক তার দর্শন বা ভাবনা (থিম) পাঠকদের মনোজগতে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে।

অতএব, একটা আধুনিক ছোট গল্প লিখার মতো সবগুলি মৌলিক উপাদান (চরিত্র, সেটিং, প্লট, কনফ্লিক্ট এবং থিম) কাহিনিটিতে রয়েছে।

ওপরের ঘটনাটা নিয়ে যে নভেল লেখা যাবেনা এটা যেকেউ মানবে। তবে ওটা আধুনিক ছোটগল্পের জন্য পারফেক্ট যা আগেই বলেছি।

অনেকেই হয়তো বলবে, ওটা অণুগল্পের জন্য সবচে বেশি উপযোগী ঘটনা। কেউ যদি তাই মনে করে আমি তার মতের ঠিক ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে অবস্থান নেব। কেন নেব তার একটা গ্রহণযোগ্য জবাব অণুগল্প নিয়ে আলোচনায় দেয়ার চেষ্টা করবো।

অণুগল্প নিয়ে আলোচনার শুরুতে এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার ইচ্ছে ছিল। একটা হল বহুস্বর; দ্বিতীয়টা অণুগল্পের না লিখা অংশ যা পাঠক লেখা অংশের চেয়ে বেশি দীর্ঘসময় ব্যপি পড়ে । দুটি উদাহরণই এই ব্লগে পোস্ট করা “মিডলাইফ ক্রাইসিস” অণুগল্প থেকে নেয়া। যাহোক, উদাহরণ দুটি এনেক্সে দিলাম।

এবার অণুগল্পের মূলকথাগুলি বলে লেখাটা শেষ করি।

বাংলা অভিধানে অণুর প্রতিশব্দ খুঁজলে অ্যাটম, কণা, ছোট ইত্যাদি পাওয়া যায়। এখান থেকে “ছোট” শব্দটা বেছে নিলে অণুগল্প এবং ছোটগল্পের অর্থ একই হয়ে যায়। আসলে অ্যাটম বা পরমাণুর “অণু”ই অণুগল্পের এই অণু। পাহাড় সমান পদার্থকেও ভেঙ্গে ভেঙ্গে সবশেষে যখন অণু (পরমাণু) পাওয়া যায় পদার্থটিকে তখন আর ভেঙ্গে ছোট করা যায়না। একইভাবে বিশাল বড় গল্পকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যখন আর কোন ভাবেই ছোট করা যায়না তখনই সেটা অণুগল্প হয়। এর মানে দাঁড়ালো, অণুগল্প আসলে বিশাল বড় গল্প যা গতরের সকল মেদ পুড়িয়ে স্বল্পায়তন পায়। আরেকভাবে বললে, গল্পটা অনেক বড় কিন্তু আয়তন খুব ছোট !

তবে অণুগল্প ঈশপের স্বল্পায়তন গল্পের (চূর্ণক) মতো সাধারণ কোন আখ্যান নয়। কারণ আদর্শ অণুগল্পের ক্ষেত্রে স্বল্পায়তন, মেদহীনতা এবং বহুস্বর মুখ্য উপাদান। এছাড়াও গল্প শুরুর চমকের সাথে গল্পজুড়ে রহস্যময়ীতা, মোচড়, বিস্ময়কর পরিণতি অণুগল্পের জন্য জরুরি বিষয়।

অণুগল্পের উপাদানগুলির লিস্ট দেয়ার আগে প্রাসঙ্গিকভাবে আসা একটা শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ছোট কোন কাহিনি নিয়ে লেখা গল্প কোনভাবেই অণুগল্প নয়। অণুগল্পের পরতে পরতে গল্প থাকে; লেখা অংশের চেয়ে লেখকের নালেখা অংশে পাঠক বেশি গল্প পায় এবং সেই নালেখা অংশটা মুগ্ধ পাঠক সুদীর্ঘ সময়ব্যপি পড়ে।

উপস্থাপনায় একমুখিতা বজায় রাখা অণুগল্পের জন্য খুব জরুরি। নদের মতো একমুখি যা ডান বাম থেকে ধার করে জল নেয়না; একমুখি প্রবাহের সময় ঢেউয়ে ঢেউয়ে জল সম্ভারের কথা জানান দিয়ে যায়। কথায় কথায় নানান ইঙ্গিত দিয়ে লেখক আদতে তার নালেখা গল্পই রেখে যায়।

প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু কথা বলিঃ
ক) আগেই বলেছি, ছোট কাহিনি নিয়ে লেখা গল্প অণুগল্প নয়
খ) মেদভরা গল্প অণুগল্প নয় অথবা সেটা লাইফ সাপোর্টে থাকা অণুগল্প
গ) সাধারণ কোন আখ্যান অণুগল্পের মর্যদা পায়না
ঘ) পড়া শেষে পাঠক যদি ক্ষণিক স্তব্ধ নাহয় তাইলে সেটা অতি দরিদ্র একটা অণুগল্প
ঙ) লেখা অংশের চেয়ে লেখকের নালেখা অংশে যদি কম গল্প থাকে তাইলে সেই অণুগল্প রক্ত স্বল্পতায় ভুগতে ভুগতে স্বল্পায়ু হয়ে যায়
চ) কাব্যিক উপস্থাপনা অণুগল্পের মর্যদা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়!

বিগ ব্যাঙ্গের আগে বিশ্বটা একটা গোলমরিচের সমান না হলেও তারচে খুব বেশি বড় ছিলনা। অণুগল্পও আসলে বিগ ব্যাঙ্গের আগের রুপ যার ভিতরে এই বিশ্বের সমান একটা গল্প থাকে।

বিশ্বের সমান বলে বোধকরি একটু বেশিই বলে ফেললাম। তবে খুববেশি “বেশি” বলিনাই।

——————-

এনেক্সঃ বহুস্বর এবং অণুগল্পের নালিখা গল্পের উদাহরণ

উদাহরণ একঃ
“-আমি স্কুলটার ওইখানে থাকমুনি; তুমি আইসো। আসবা তো সিতারা বেগম? মোত্তালেব মিয়া ফিস ফিস করে জানতে চায়।
-পুরা সাতশ টাকা লাগবো! ঠোঁটের কোণে হাসি মেখে সিতারা বেগম জবাব দেয়।

অল্প দূরে থাকা ছেলেগুলোর দলনেতা খুব নিচুস্বরে বলে,
-জানস তোরা ওই বেটি কেডা?
-তিন নাম্বার দাদি? ছেলেগুলির একজন উল্টা প্রশ্ন করে।
-ওই রকমই। আগের মরা দাদিটা লাল পরী হইয়া ফিরা আইছে। দাদারে আদরও করতে পারে; আবার ঘাড় মটকাইয়াও দিতে পারে।

দলনেতার শেষ মন্তব্যে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে এবং একসাথে উল্টা পথে দৌড় দেয়”।

ব্যাখ্যাঃ
মূলগল্পে মোত্তালেব মিয়াকে ছেলেগুলির দাদা হিসেবে দেখানো হয়েছে। দলনেতার নিচুস্বরের প্রশ্ন বহুস্বরের সূচনা করেছে। একপর্যায়ে দলনেতার কথায় ছেলেগুলির সবাই “হো হো করে হেসে ওঠে”। দলনেতা যা ভেবেছে দলের অন্যদের কেউ হয়তো সেটাই; আবার কেউ হয়তো ভিন্ন কিছু ভেবে হেসেছে। “জানস তোরা ওই বেটি কেডা?”এই জানাটার বহুমুখিতাই হলো বহুস্বর। যেমন- সম্ভাব্য তিন নাম্বার দাদি, মৃত প্রথম দাদির পরী হয়ে ফিরে আসা, নিষিদ্ধ নারী, অন্য যেকোন নারী যে ছেলেগুলির দাদার জন্য ভয়ংকর হতে জেনেও তাদের দাদা (মোত্তালেব)মহিলাটার কাছ ছাড়ছেনা। ভাবনার এইসব বহুমুখিতা এই গল্পের বালক চরিত্রগুলোর বহুস্বরের একটা উদাহরণ হতে পারে।

ওপরের উদাহরণটার একাংশ রিপিট করে আরো একটু বলি,
“-তিন নাম্বার দাদি? ছেলেগুলির একজন উল্টা প্রশ্ন করে।
-ওই রকমই। আগের মরা দাদিটা লাল পরী হইয়া ফিরা আইছে” ।

মিডলাইফে একজন মোত্তালেবের পরিবর্তিত মনোজগতের বড়সর একটা গল্পের ইঙ্গিত আছে দ্বিতীয় লাইনে। গল্পটা হলো, অভ্যস্ত নারীর (স্ত্রী) প্রতি অনাসক্তি এবং নিষিদ্ধ নারীকে লাল পরীর মত লাগার সাইকোলজি যা মিডলাইফ ক্রাইসিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ।

উদাহরণ দুইঃ
“সিতারা বেগম বেশ অনুভব করে, যতদিন শরীর আছে তার নিজের ভিতর হেমিলনের বাঁশিওলার একটা অস্তিত্ব আছে যা মোত্তালিব মিয়ার রক্তস্বল্পতায় ভোগা কিশোরী বউটার মধ্যেও নাই! তাই তার পেছনে শিমুলিয়া গ্রামের এই মধ্যবয়সী পুরুষটা দৌড়াচ্ছে আর হাঁফাচ্ছে; হাঁফাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে”!

ব্যাখ্যাঃ
গল্পের এই অংশটা নিয়ে নানান পাঠকের নানান কিছু ভাববার সুযোগ আছে। ঘরের কিশোরী স্ত্রী নয় বরং অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী এক নিষিদ্ধ নারীর হাতে মোত্তালেব মিয়া হেমিলনের যাদুর বাঁশীটা দেখে। কেন? উত্তর হয়তো অনেকগুলি; একেকজনের একেক রকমের ভাবনা। সেই ভাবনাগুলি এইরকমঃ এটা নয়, ঐটা; না ঠিক ঐটাও নয় ভিন্ন কোন কিছু। এই অণুগল্পে বিষয় ভিত্তিক বহুস্বরের একটা উদাহরণ হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা যেতে পারে।

এছাড়া শেষ লাইনেই মিডলাইফ ক্রাইসিসের কোটি মানুষের হাজারো গল্প আছে।

“দৌড়াচ্ছে আর হাঁফাচ্ছে”; কেন দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফাচ্ছে?
“হাঁফাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে”; কেন হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়াচ্ছে?
মোত্তালেব মিয়া তার অভ্যস্ত স্ত্রীতে ক্লান্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে? অভ্যস্ত স্ত্রী থেকে পালাতে পালাতে হাঁফাচ্ছে? যাইই হোকনা কেন এসবই নালেখা গল্পের ইঙ্গিত। কারণ এই ক্রাইসিসে যতো উপসর্গ হয় সেগুলো নিয়ে লেখা হাজারো গল্প ধারণ করতে পারে শেষ লাইনটা।

3 thoughts on “গল্প নভেল নিয়ে টুকটাক কিছু কথাঃ শেষ পর্ব (অণুগল্প)

  1. নিজের লিখার বেশ ভালো ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন দেখছি। নিজেরপি্রিয় অপ্রিয় লিখার সমআলোচনা খুব কম লিখকই মান্য করে। আপনি উল্টো। পাঠকের ধ্যান এবং ধারণাকে নিজের লিখার উদ্ধৃতি এনে পাঠক ভাবনাকে বরং সমৃদ্ধ করেছেন।  আপনার লিখায় বারবারই অনুরণন এবং জ্ঞানকোষ লক্ষ্য করি; আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

    গুড জব মি. মিড ডে ডেজারট। কীপ ইট আপ স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. চমৎকার একটি আলোচনা পড়লাম ডেজারট ভাই। তবে গল্প নভেল নিয়ে টুকটাক কিছু কথা'র প্রথম পর্ব (অণুগল্প) শিরোনামের লিখাটি পড়ে ধরে নিয়েছিলাম বেশ খানিকটা পথ হয়তো এগুবে। প্রথম পর্বের পর একটানে শেষ পর্ব কিভাবে সম্ভব !!  আরও কিছু পর্ব দাবি করছি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

  3. যে কোন কন্টেন্টে আপনার বিশ্লেষণ অসাধারণ লাগে আমার কাছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।