কফিনের গায়ে উৎসবের ঢেউ // রুকসানা হক

খুব অযত্নে রাখা কাঠের পুরনো বাক্সটি খুলতেই বেখেয়ালি আঙুলে সুঁইয়ের খোঁচা লাগলো,
লালনীল সুতোয় পেঁচানো জংধরা সুইগুলো ওখানে আত্মবিশ্বাসহীন পড়ে আছে।
রুমালের সাদা কাপড়খানির ভাঁজ খুলতেই
দেখলাম আমার কৈশোরের কিছু নীরব কান্না,
ধবধবে রুমালটিতে এখন ছোপ ছোপ অন্ধকার বাসা বেঁধেছে
লাল সুতোয় বোনা গোলাপের ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতির বিমর্ষতা কেবল।

দেখলাম ভিন্ন ভিন্ন আকারের বোতামগুলেতে থৈথৈ তৃষ্ণা,
কোনটা ছিল বাবার শার্টের কোনটা ভাইদের,
হুট করে মনে পড়ে গেলো
একবার শার্টের বোতাম সেলাইতে গিয়ে বাবার বুকে সুঁইয়ের খোঁচা লেগেছিল,
আমার ভীষণ অপ্রস্তুত কপালে বাবা আদর এঁকেছিলেন,
বাবার বুকে আঁকা সে কষ্ট কোনদিনই মুছতে পারিনি আমি,
তাঁর স্নেহের পরশ আজীবন আমার ব্যথাগুলো মুছতেই ব্যস্ত ছিল।

পুতুল খেলার বড় সখ ছিল আমার
দর্জিবাড়ি থেকে কুড়িয়ে আনা টুকরো কাপড় দিয়ে বোনা পুরোনো পুতুলগুলোর চোখে দেখলাম
খসেপড়া জোনাকির জল,
আমার টিপের বিবর্ণ পাতায় ঝিঁঝিদের ক্ষয়ে যাওয়া নিঃশ্বাস,
ছাতাপড়া আধভাঙা লিপস্টিকে লুকিয়ে আছে যৌবনের সমস্ত রঙ
নেলপলিশের বোতলে ছিপিআঁটা অনেকগুলো বসন্তকাল।

গুটিকয়েক চৌকোনা পিতলরঙা পাঁচপয়সার মূদ্রায় ক্ষরণের দীর্ঘস্রোত,
অগণিত ডাকটিকেটের সাথে ওরা অন্তহীন বেদনায় জড়ো হয়ে আছে পুরোনো বাক্সের কোণে।
মনে পড়ে সেই মেঘাল সন্ধ্যায় জার্মানি থেকে পাঠানো ভাইয়ের চিঠির খামে দেশবিদেশের সেসব স্ট্যাম্পের কথা,
আজ ভাইবোনের সেই কঠিন সুতোটিও অনেকটা ঢিলেঢালা।

ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া বিবর্ণ চিঠিখানি খুলতেই দপ করে জ্বলে উঠলো
বিশুদ্ধ সুন্দরের গলেপড়া সুখ,
অস্পষ্ট অক্ষরের ভিড়ে পালতোলা নাগরিক প্রেম।

আমার বিষন্ন ভালবাসা ভরা কাঠের বাক্সটি এখন জীবন্ত কফিন,
আর বাবার শার্টের বোতামটা যেনো কফিনের গায়ে দলা দলা উৎসবের ঢেউ।

24 thoughts on “কফিনের গায়ে উৎসবের ঢেউ // রুকসানা হক

  1. যাপিত জীবনের কথা মালা। আমাদের জীবনটাই কাব্য তাই না কবি দি !!

    1. জীবনের নামই তো কবিতা। সেখানে শতবর্ষের অনুভবগাঁথা শিল্প হয়ে উঠে ।ধন্যবাদ তোমাকে দিদি।      

  2. ধবধবে রুমালটিতে এখন ছোপ ছোপ অন্ধকার বাসা বেঁধেছে
    লাল সুতোয় বোনা গোলাপের ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতির বিমর্ষতা কেবল। জীবন।

    1. ভালবাসা অফুরান আপু । ভালো থাকুন সবসময় ।   

  3. আমার বিষন্ন ভালোবাসা ভরা কাঠের বাক্সটি এখন জীবন্ত কফিন। হৃদয় ছুঁয়ে গেল । শুভকামনা ।

    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন।       

  4. শিরোনাম আর কবিতার কন্টেন্ট অসাধারণ কবিবোন রুকশানা হক।

    1. আপনার চমৎকার অভিমতেে ধন্য হলাম দাদা। ভালো থাকুন।       

  5. লাল সুতোয় বোনা গোলাপের ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতির বিমর্ষতা।

  6. আমার বিষন্ন ভালবাসা ভরা কাঠের বাক্সটি এখন জীবন্ত কফিন,
    আর বাবার শার্টের বোতামটা যেনো কফিনের গায়ে দলা দলা উৎসবের ঢেউ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. মন্তব্যেে অনুপ্রানিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।      

  7. সুখদুঃখ নিয়েই আমানুষের জীবন। জীবনের সাথি সুখের ওজনটা কম! দুখের ওজনটা খুবই ভারি বলে মনে হয়, শ্রদ্ধেয় কবি দিদি। 

    শুভকামনা রইল। 

    1. অনেক সুন্দর করে অনুভূতি বিশ্লেষণ করলেন দাদা । ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সবসময়।            

  8. লাল সুতোয় বোনা গোলাপের ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতির বিমর্ষতা কেবল। চমৎকার শব্দ চয়ন।এই লাইনটা পুরো কবিতাটিকে অন‍্য রকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

    অনেক অনেক শুভেচ্ছা কবি আপু।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু । অনেক অনেক ভালবাসা।        

  9. একবার শার্টের বোতাম সেলাইতে গিয়ে বাবার বুকে সুঁইয়ের খোঁচা লেগেছিল,
    আমার ভীষণ অপ্রস্তুত কপালে বাবা আদর এঁকেছিলেন,
    বাবার বুকে আঁকা সে কষ্ট কোনদিনই মুছতে পারিনি আমি,
    তাঁর স্নেহের পরশ আজীবন আমার ব্যথাগুলো মুছতেই ব্যস্ত ছিল।

    কথাগুলো হৃদয়ে দাগ কেটে গেলো।  

    যাপিত জীবন কাহিনী মন ছুঁয়ে গেলো, ।    

     

    শুভেচ্ছা জানবেন শ্রদ্ধেয়  

    1. চমৎকার অনুভূতি প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে । মন্তব্যে  উৎসাহিত হলাম ।  শুভেচ্ছা সতত ।  

  10. "পিতার শার্টের বোতামে" সন্তানের অন্যরকম আবেগ মেশানো থাকে সাহিত্যে যার আবেদন অসীম।

    পরিণত জীবনে এসে হঠাৎ একদিন কেউ তাঁর কৈশরের কাঠের বাক্স খুঁজে পেল। বাক্সটা খুলে সে তাঁর "কুড়িয়ে আনা টুকরো কাপড় দিয়ে বোনা পুরোনো পুতুল", "আধভাঙা লিপস্টিক", "ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া বিবর্ণ চিঠি" পেয়ে গেল! দৃশ্যটা আমি চোখে ভাসালাম। তখন কাঠের বাক্সটাকে আর "কাঠ দিয়ে বানানো" নিছক একটা বাক্স দেখলামনা। পিতার শার্টের বোতামগুলি তারা হয়ে বাক্সের গা জুড়ে বসে ওটাকে আকাশ করেছে ! সেখানে মেঘ আছে; তারাদের আলোর মেলা আছে!

    আবেদনে ভরা এমন কবিতা অনেকদিন পড়িনাই!

    1. সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।  শৈশব ও কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো ফিরে পেয়েছি এই কাঠের বাক্সটি পেয়ে । 

      এমন চমৎকার বিশ্লেষণ এবং তীক্ষ্ণ অনুধাবন বরাবরই আমাকে উৎসাহিত করে । শুভেচ্ছা ।     

                

  11. কাব্যপাঠে বেশ অনুপ্রারণা পেলাম কবি আপু

    অনেক শুভেচ্ছা রইল———-

    1. ধন্যবাদ ভাই । মন্তব্যেে অনুপ্রানিত হলাম।    

  12. উৎকৃষ্ট রচনা। ভরপুর শুভেচ্ছা রাখছি শ্রদ্ধেয়া আপু। আরও লিখুন। আপনার মতো একজন শক্তিশালী লেখিকার উপস্থিতি আমার জন্যে অন্তত বিরাট প্রেরণাদায়ক। 

     

    অনেক শ্রদ্ধা ও শুভকামনা জানাচ্ছি। সদা ফল্গুধারায় ভরে থাক জীবন।     

  13. প্রেরণাদায়ক মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম ভাই। শুভেচ্ছা অফুরান।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।