রুকশানা হক এর সকল পোস্ট

বিদীর্ণ সময় // রুকসানা হক

শৈশবে হারানো মার্বেলের মতোই বিদগ্ধ কষ্টে
এ শীতেই অধিকার হারালাম।
তাই গেলো রাতের গভীর অন্ধকারটুকু ভিক্ষায় পেয়ে
রিপু করা দুঃখগুলো বিছিয়ে রেখেছিলাম দক্ষিণের জানালায়।

কুয়াশায় ভেজা কাঁচের গায়ে বোলতার বিষ পুঁতে
শহরের এই বিষাক্ত রাতকে পুষেছি খুব মমতায়,
জানি দলছুট কান্নাগুলোর কোন স্বর্গ, নরক থাকে না,
কেবলই কিছু মরণযন্ত্রনার কামড় থাকে কলিজা বরাবর।

যে পাখিটার ডানার গভীরে তুমি নদী এঁকেছিলে,
আমি সে নদী হবার আকাঙ্খায় মেঘ চুমুকে ধূসর হয়েছি,
পূণ্যতার অন্তর্জালিকায় গাঁথা চোখের কোণে নুনের স্তরকে গাঢ়তর করেছি,
অসংখ্য প্রাকগল্পের নির্জলা সত্যটুকু তুলে ধরার প্রয়াসে বিবেকের কাছে বারবার হেরে গেছি।
তবুও আমার বিনিদ্র রাতকে মুড়িয়ে রেখেছি জলের প্রবাহে।

তোমাকে বুঝতে দেইনি কিছুই।
আমি জানতাম আমার ঠুনকো অধিকারের কাঁচখানি বোলতার বিষে নীল হবে,
মার্বেল হারানো দুঃখগুলো আবার ঝলসে উঠবে এমনি এক বিদীর্ণ সময়ে।

শূন্য হাঁড়ির বন্য ব্যথা // রুকসানা হক

নেবো নাকি না নেবোনা ,
সব কিছুই তো ছেড়ে দিলাম
জমিজিরেত নাকের নোলক ভাতের হাড়ি
ঘরের মানুষ কোন কিছুর নেই দাবি আর ।

নিতে গেলেই জমি ফেটে দু’ভাগ যে হয়
ভাতের হাঁড়ি পুড়তে থাকে কাঠ উনুনে
নাকের নোলক ভাসতে থাকে
জল দীঘিতে স্নানের শেষে ।
আমার কি আর মনের মানুষ থাকতে আছে
উঠোন জুড়ে ঝরা পালক মৃত আশা ।

নেবো নাকি মনটা শুধু নিতেই যে চায়
দাবি ছাড়ার দুঃখ যে কি আমিই বুঝি
জমির বুকে জলবিরানী কষ্ট কেবল
ধ্বংস দেখি,আগুন দেখি ।

শোবার ঘরে ভারী পায়ের শব্দ যখন
মাথার ভেতর ঘুরে বেড়ায়
কেমন করে নিতে পারি
ভেজা মাটির গন্ধটুকু কিংবা প্রিয় মায়াদেহ
সব দাবিই তো ছেড়ে দিলাম দুঃখ বিনা
মনের মানুষ মন ছাড়ে না
জমির আলে সুখ থাকেনা
নাকের নোলক ভিজে থাকে চোখের জলে
শূন্য হাঁড়ি বন্য ব্যথায় কেঁদে মরে
দাবি ছাড়ার দুঃখ যে কি আমি বুঝি ।

ইচ্ছেগুলো নিভতে থাকে চিকন রেখায়
জমির বুকে দহন নেভার
একটুখানি জল মিলেনা — ইচ্ছে নেভে ,
মায়ার নোলক পড়ে থাকে প্রিয়জনের পায়ের নিচে
ভাতের দাবী আর তুলি না
কন্ঠ চেপে ধরে আছে সাত শকুনি ।

না নেবো না কথা দিলাম
সবকিছু আজ ছেড়ে দিলাম দাবি ছেড়ে
মনের মানুষ মন ছেড়ে দাও
নোলক থেকে হাতটা সরাও
ভাতের হাঁড়ি শূন্য থাকুক
জমি জিরেত যাক পুড়ে যাক ছেড়ে দিলাম।

লাবণ্যময় পথচলা

একটা রাতের মতো তার লাবন্যময় পথচলা
যেন মেঘহীন নীলিমায় জ্বলজ্বলে তারাদের শতকলা
আলো আঁধারের কী দারুণ কারুকাজে ভরা
কাজলের চোখদুটো তার স্বপ্ন আলোক ঝরা,
সে প্রসন্ন উজ্জ্বলতায় পূর্ণতা খুঁজে পায়
অস্বীকৃত অপ্রিয় দিন স্বর্গোদ্যান ছেড়ে যায় ।

এক অভূতপূর্ব আলোককুসুম ছোট্ট রশ্মি দিয়ে
আধেকটা বিলীন হয়েছে যে তার অধরা লাবন্য নিয়ে ।
মেঘ চুলে তার ঢেউ খেলে যায় কতো না পরমানন্দে
ঝলকে উঠে আলোকমালা মুখে তার ঝরণাছন্দে ।
ভাবনা সেখানে ফুটে ওঠে এক সুমিষ্ট নির্মলে
কতো যে মিহি কারুকাজ সেই অমূল্য অঞ্চলে ।

তার কুমুদ কপোলে ও জোড়া ভুরু তলে
কোমল পেলব শান্ত সুধা অপরুপ হয়ে দোলে ,
অপরাজেয় সেই হাসি আর দীপ্ত মুখের আভা
যাপিত দিনের শেষে এসে প্রকাশিত হয় প্রভা
একটি নিটোল হৃদয়মাঝে নমিত সে সবার চেয়ে
ভালবাসার বাঁধনে জড়ায় প্রিয়সুখ মেখে গায়ে ।

মূল কবিতা ঃ

She Walks in Beauty

BY LORD BYRON (GEORGE GORDON)

She walks in beauty, like the night
Of cloudless climes and starry skies;
And all that’s best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes;
Thus mellowed to that tender light
Which heaven to gaudy day denies.

One shade the more, one ray the less,
Had half impaired the nameless grace
Which waves in every raven tress,
Or softly lightens o’er her face;
Where thoughts serenely sweet express,
How pure, how dear their dwelling-place.

And on that cheek, and o’er that brow,
So soft, so calm, yet eloquent,
The smiles that win, the tints that glow,
But tell of days in goodness spent,
A mind at peace with all below,
A heart whose love is innocent!

পেঁয়াজ রঙ্গ // রুকসানা হক

বিশটাকা একহালি
খুব বেশি দাম নয়
একহালি কিনলেই
বেশ ভালো নাম হয়।

বাজারের থলেতে
পেঁয়াজটা না রেখে
হাত ব্যাগটায় রাখি
কেউ যেন না দেখে।

চায় যদি আধখানা
কিকরে যে দেই তারে
তার চেয়ে এই ভালো
থাকুক না চুপিসারে।

সোনাদানা ফেলে রেখে
পেঁয়াজের সঞ্চয়
বাড়াতেই করছি যে
পায়চারি ঘরময়।

চিন্তায় আর ভাবনায়
ঘুম নেই সারারাত
সিন্দুকে রেখে ভাবি
কেউ বুঝি দিলো হাত।

বারবার খুলে দেখি
আছে নাকি গোটাচার
যেই সেই কারিতে
পেঁয়াজ কি লুটাবার ?

ধুয়ে মুছে খোসাটারে
জ্বাল দেই হাঁড়িতে
লাল জলে স্যুপ খেতে
গেস্ট আসে বাড়িতে।

চেটেপুটে খেয়ে সবে
জোরে তোলে ঢেঁকুরও
ওপাড়ার ভাবী শুনে
গান ধরে বেসুরো।

পেঁয়াজের খোঁজে তাই
বাড়ি আসে ওবেলা
সিকিভাগ চেয়ে বসে
খোদার ওযে কি খেলা।

লজ্জার মাথা খেয়ে
বলি ভাই মাফ চাই
পেঁয়াজের খোসাটাও
এখন আর বাকি নাই।

গোটাচার আছে নাকি
খুলে দেখি সিন্দুক
এই ফাঁকে কি করে যে
দেখে ফেলে নিন্দুক।

পাড়াময় দুর্নাম
রটে গেলো নিমেষেই
আড়চোখে ভাবীগণ
খোঁচা মারে কি হেসেই !!

অনাদায়ী // রুকসানা হক

দেনার দায়ে রোদ বিকোলাম,
মেঘ বিকোলাম, সমুদ্দুর আর পাহাড়টাও,
ঘরের খুঁটি চরের মাটি, মাথার উপর আকাশটাও,
দেনা তো আর শোধ হয়না শোধ হয়না
জন্মদাগের ভুলটুকু এই কপালটাও আর সয়না ।

রঙে রঙে ভেসে যাওয়া সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত বিকিয়ে দিয়ে
খড়ির আগুন দরদাম হীন কিনতে গেলাম,
কিনতে গেলাম চড়াদামে জলকলসী,
শূণ্য হাড়ির শুকনো তলায় বিপন্ন মেঘ সর্বনাশী
পুড়তে থাকে,
পুড়তে থাকে দেনার দায়ে
দেনা তো আর শোধ হয়না, শোধ হয়না,
বুকের গোপন বিলাপ শুচি বদ্ধ বুকে আর রয়না ।

অনাবৃত মধ্যরাতে শরীর জুড়ে মন্ত্র পোড়াই,
স্বদেশ আঁকি রাত বিকিয়ে,
গোরস্তানের সমান্তরাল নিশির মাঠে আয়ু বেচি
দেনা শোধের আশায় আশায় ঋতুর চোখে বিন্দু বিন্দু শ্রাবণ নামাই
দেনা তো আর শোধ হয়না শোধ হয়না
নিরন্ন ঠোঁট শ্লোগানমুখর কেনো যেনো আর হয়না।

কি করে শোধ হবে বলো
এখন কি আর একশত পাপ ভরা নায়ের জলডুবি হয় ?
জলডুবি হয় পূণ্যশ্লোকের অনুরাগী শুদ্ধ মেঘের, কেউ জানেনা।
জানবে কেনো, পাহাড় নদী সমুদ্দুরটা বেচতে গিয়ে এই আমাকে বিকিয়ে দিলাম,
তবুও দেনা শোধ হলোনা শোধ হলোনা।

নিংড়ানো তেতো // রুকসানা হক

তুমি আমাকে আড়াল করেছিলে
শিল নোড়ায় অন্ধকার বেঁটে বেঁটে
আমি তোমাকে মুছে দিয়েছি অস্তমিত নবমীর চাঁদের মতো।
তুমি তো জানো নক্ষত্রে আগুন লাগলে সমুদ্র বিবস্ত্র হয়
অতীত আড়াল হলে সাদা পৃষ্ঠাগুলো নিরুদ্দিষ্ট হয় জীবন থেকে,
সেখানে আর নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়না।

বিশ্বাসের সুতোয় বাঁধা ছিল আমার নদী,
তোমার মূর্খতার বিস্ময় নদীটির গলা চেপে ধরে
অস্তিত্বের উপহাস গ্রাস করে আমার বৃষ্টিসমগ্র,
আমার ক্রোধ ও ঘৃণায় বাকরুদ্ধ আমি
হয়তো আর কোনদিনই মন থেকে হাসতে পারবো না,
গহনের বাক্যবন্ধগুলি উপচে পড়বে তোমারও চোখ ধারাজলে।

ভাঙনের মাটির তলায় চাপা পড়ে অবিশ্বস্ত সূর্যালোক
বুকের সীমানাজুড়ে অঙ্কুরিত রাত বাড়ে।
এই ত্রস্ত রাতের মুঠোয় আর যাই হোক
হেমন্তের ধানীভোর কোনদিনই খুঁজে পাবেনা তুমি।
কালক্ষয়ে থেমে যাবে তোমার আঁটকুড়ে জীবন
অন্তর্গত যন্ত্রণায় তুমিও আমার মতো হবে ক্লিনিক্যাল ডেড।

তোমার সামান্য ভুলেই ঝরে গেছে
ঝরে গেছে নিভৃতের শিমুল
ক্ষমা নেই, কোন ক্ষমা নেই
ক্ষমা যদি চাও আবার জন্ম নিয়ো
তখন অবিশ্বাসী তোমায় যেন চিনতে না পারি আমি
;
;
;
চিনতে না পারি আমি।

বাস্তুহীন ফিনিশীয় কবর // রুকসানা হক

ভোরের সানকিতে ভাঁপ ওঠা সরলতার ছোঁয়া
এখন আর কিছুতেই খুঁজে পাইনা
কি যেন হারায় প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে ;
পাড়ভাঙা মাটির তলপেটে হারায় অঙ্কুরিত সরল কবিতার ঘ্রাণ,
নিঃশব্দের আকাশ, শিশিরের ছদ্মনাম, আলজিভের ত্রস্ত পিপাসা
সবই যেন শুধু হারিয়েই যায়।

মধ্যবিত্ত সময়ের ভাঁজে দেখি আঁটকুড়ে নদীর গর্ভপাত
বিবস্ত্র বাক্যের প্রতিকৃতি
স্বরচিত জন্মকথায় গেঁথে দেয় জটিল ক্ষুধা,
হারাতে থাকি হাড়ের মজ্জায় বাস করা অবচেতনের শুকপাখি।

কত কি হারাই প্রতিদিন প্রতিক্ষণে
কোথায় যে হারিয়ে যায় আত্মমগ্নতার প্রত্নতাত্ত্বিক সুখানুভূতি !
বহু ব্যস্ততায় আমি থাকি আমার আড়ালে,
আমার ছায়ার ভেতর।
ক্ষুধিত চরের রক্তপিপাসায়
চোখের শব্দগুলো ঢেকে রাখি চোখেরই পাতায়,
ঝুলে থাকা নক্ষত্রের গায়ে লিখে দেই প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছেগুলো
ওরা ও হারিয়ে গেলে কালক্ষয়ে রাত বাড়ে,
আমার শিথানে রাত বাড়ে,
শুধু কালরাত বাড়ে।

আঁধারে চুপিচুপি খুদকুঁড়ো খুঁটি
ধানফুল ঝরে গিয়ে অভিশাপ নেমে এলে
হারিয়ে ফেলি মোহরের গন্ধবাস,
কুপির মৃদু আলো থেকে সরে যায় লালনীল সুতো, সুই, রুমালের সাদা রং
সব হারিয়ে আমি নিতান্তই এক নিরন্ন বাস্তুহীন ফিনিশীয় কবর।

বৃষ্টি আমার শহর কিনেছে // রুকশানা হক

আমার শহরে বৃষ্টি নেমেছে পথঘাট ডুবে একাকার
তেতলার ছাদ ভিজছে সাথে সৌখিন পাতাবাহার।
সুনসান পথ রিকশা দু’চারেক ভেজা বৃষ্টি মানুষ
হুডের ভেতরে চকচকে সুখ গানে ভেজা ‘বেলাবোস’,
দু-চোখে কতোনা স্বপ্ন খেলে গিটারের মৃদু সুর
চাকরীর কথা থাকনা এখন সবকিছু থাক দূর।

বৃষ্টি আমার শহর কিনেছে বেচে দিয়ে মেঘচোখ
ভিজছে নদী, উথাল-পাতাল ভিজছে কামিনী বুক।
রাস্তার পাশে গুটিসুটি মেরে কুকুরও ভিজছে কেমন
ল্যাম্পপোস্টের তার বেয়ে জল নামছে কেনো যে এমন।
জানালার পাশে একলা মানুষ বৃষ্টির ছাটে বন্দী
আমার শহরে বৃষ্টি এবং আকাশ করেছে সন্ধি।

কার্নিশে বসা জোড়া শালিকের প্রেমটাও সে গুনছে
অন্তরে কার ঝড় বয়ে যায় কান পেতে বুঝি শুনছে।
শহুরে বৃষ্টি শহর মানুষ থৈ থৈ জলে ছুটে যায়
একটু সময় নেই কারো হাতে এমন দিনেও হায়,
বৃষ্টি দিনে রবী ঠাকুরের কবিতা পড়েনা কেউ
নাগরিক মন নগরজীবন নেই আবেগের ঢেউ।

সাহিত্যে মৌলিকত্ব // রুকশানা হক

সাহিত্যে মৌলিকত্ব বিষয়টি সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের মান বিবেচনায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য সাধনা করতে হয় গবেষণাধর্মী মন নিয়ে। সেখানে একজন বড় লেখকের লেখাকে অনুকরণ নয় বরং তার বাইরে এসে আত্মপ্রকাশ করতে হয়, সাহিত্যে নতুনত্ব আনতে হয়। আর নতুন ধারা উদ্ভাবন একজন সাহিত্যিকের মৌলিকত্ব নিশ্চিত করে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথাকথিত কিছু সাহিত্যিকের নির্লজ্জ অনুকরণপ্রিয়তা খুবই দৃষ্টিকটু। এখানে এর চর্চা হয়ে থাকে নির্ভয়ে। কারণ এ মাধ্যমে যাতায়াতকারীদের অধিকাংশই সাহিত্যবিমুখ বলে বড় লেখকদের লেখা সম্বন্ধে একেবারেই অনভিজ্ঞ। তাই অনুকরণকারীকে সৎ পরামর্শ দেবার লোকের বড় অভাব। কেউ যদিও বা বুঝতে পারে সেও চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যায়। এটা আমাদের চরম দীনতা।

সাহিত্য, সংস্কৃতির মৌলিকত্ব হচ্ছে বিশ্বজুড়ে ঐ সাহিত্য কতটুকু নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। সব দেশের সাহিত‌্যিক তাই তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তথ্য প্রবাহের অবাধ প্রেক্ষাপটে অনুকরণপ্রিয়তার কারণে এই স্বকীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কবি সাহিত‌্যিকদের লেখায় নতুনত্ব, অভিনবত্ব সৃষ্টি করা অসম্ভব রকম চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্য। তাই বলে আরেকজনের লেখাকে দু’চার শব্দ পাল্টে দিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দেয়া? এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে? যার লেখার ক্ষমতা রয়েছে তাকে কেনো এমন দীনতা পেয়ে বসে আমার বোধগম্য হয়না।

অনেকেই বলে থাকেন এডগার এ্যালেন পোর “টু হেলেনের” কথা, যে কবিতা জীবনানন্দকে “বনলতা সেন” লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখানে জীবনানন্দ স্বকীয়তা বিসর্জন দেননি। তিনি ভারতীয় নারী চরিত্রের সকল আয়োজন ঘটিয়েছিলেন তাঁর বনলতায়। অতএব কবির কাছে টু হেলেন ছিল প্রেরণা, অনুকরণ নয়।

বাংলাদেশের বড় লেখকদের কিছু বিখ্যাত কবিতা ও গল্প রয়েছে যেগুলি তাঁদের যত্নে গড়া এক একটি মহীরুহের মতো। এসব কবিতাকে যখন সাহিত্যিক (?) নামধারীগণ শব্দ রদবদল করে কবিতা বা গল্পের আকার দিয়ে ফেলেন তখন করুণা করা ছাড়া কিছুই করার থাকেনা। কবি সাহিত্যিকের তো আপন মনের কিছু ভাবনা থাকেই, তাকে কেনো অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় আমার বোধে আসেনা।

আসুন আমাদের সাহিত্যকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করে তুৃলি নিজেদের স্বকীয়তার মাধ্যমে। অন্যের ভাবনাকে নিজের বলে চালিয়ে দেয়া লজ্জাজনক। এভাবে নিজেকেই অসম্মান করা হয়।

জীবন্ত মায়ের শেষকৃত্য

এটা কোন কবিতা নয়
এটা লাশের কফিনে জমে থাকা বিষাক্ত আর্তনাদ ,
মৃত্যুতে চুবানো নক্ষত্রের না জন্মানো দুধশ্বাস।
এটা কোন কবিতা নয়,
খুন হয়ে যাওয়া বেওয়ারিশ রাতের ক্লান্ত স্থাপত্য এটা,
জঠর ছিঁড়ে বিকৃত করা
এক রক্তাক্ত মায়ের জীবন্ত শেষকৃত্যের ছবি।

এগুলো কখনো কবিতা হয়না,
চালচুলোহীন এক কবির কাতর আর্তচিৎকার হয়,
হয় অভিমানী চিত্রকরের নষ্ট আঙুলের গলগল রক্তস্রোত।

কবিতার ভ্রমে কেউ যেন একে মৃত নক্ষত্রের তৃষ্ণা ভাবে না কখনো,
কেউ কি জানেনা
নিকষ কালো অন্ধকারে
চিতাগ্নিতে ভস্ম মায়ের চোখজলে তৃষ্ণা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে,
পুড়ে গেছে এ মাটির উদ্ভ্রান্ত পঙক্তির কালসিটে ছায়াগুলো !

প্রভু, এতো বীভৎস গদ্যময় চিৎকারে
তুমি কেনো নামছো না আকাশের মোহঘোর থেকে?
একবার দেখে যাও
নক্ষত্রের দুধশ্বাস কি করে রুদ্ধ করেছে পিশাচের নখর,
প্রভু, একবার ফেটে পড়ো অগ্ম্যুৎপাতের মতো,
ভস্ম করে দাও সমস্ত শ্যাওলার ঘৃণ্য চিবুক।
এভাবে জীবন্ত মায়ের শেষকৃত্য নির্বিকার বসে দেখোনা আর।

রক্তপিপাসু ময়ালের জিভে একবার নরক স্পর্শ করাও প্রভু,
অন্তত একটু স্বস্তিতে
ছিঁড়ে যাওয়া নক্ষত্র বিষন্ন আকাশটা জাগিয়ে রাখুক,
জাগিয়ে রাখুক আরোগ্যবিহীন বিপন্ন এ চাঁদটাও।

ছায়াপথের রক্তাক্ত স্খলনে আজ ছত্রভঙ্গ সকল প্রত্যয়,
ক্ষয়িষ্ণু বিবেক রাতের জঠরে পুড়ে ছাই,
প্রভু তুমি আর চুপ থেকো না,
বজ্রের অঙ্গারে গুড়িয়ে দাও পৃথিবীর বিধ্বস্ত কঙ্কাল
আর কবিতারা পালিয়ে বাঁচুক সম্ভ্রমহীন এ গ্রহের নির্লজ্জতা থেকে,
আজ থেকে কবিতা লিখা বন্ধ হোক,
কাতারে কাতার কীটেরা চেপে ধরেছে কবিতার শব্দশ্বাস,
এটা কোন কবিতা নয় প্রভু,
;
;
;
;
এটা কোন কবিতা নয়…..।

ফার্স্ট ক্লাশ সিটিজেন // রুকসানা হক

কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যারে পাস তারে ছোঁ,
কানামাছি বল নারে পার্থের দোষ কি,
গণপিটুনির মতো মজাদার ঘুষ কি?

জল পড়ে পাতা নড়ে
পার্থকে মনে পড়ে,
গণপিটুনিতে মরে তসলিমা সস্তা
পড়শীর ছাদে হাসে পার্থের বস্তা।

বাক বাকুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা,
এডিসের তান্ডবে দিশেহারা দেশবাসী,
জনগণ ছিঁড়ছে নিজেদের কেশ রাশি।

আগডুম বাগডুম
ঘোড়াডুম সাজে
ভিআইপি সচিবেরই
ঢাক ঢোল বাজে,
বাজে না তো ঢাক কভু শোষিতের কান্নায়,
শোষকেরা ঘুম দেয় তেল ঘষে নাকটায়।
পথঘাট আটকিয়ে চামচারা রাখে আর
মুমূর্ষু রোগী মরে জ্যামে পড়ে পাপে কার?
অবৈধ লেনদেনে কোটিপতি সেবকেরা
ফার্স্ট ক্লাশ সিটিজেন তারাই তো দেশসেরা।

মানুষের অগ্নিতাপে গলছে শহর // রুকসানা হক

একটা শহরে এতো মানুষ থাকতে পারেনা,
শহরের সাদা রেলিং জুড়ে ছিপছিপে ঘূর্ণির মতোন মানুষ
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটন্ত মানুষের পায়ে ও কপালে যেন দীর্ঘ সুনামিগন্ধ
মানুষের তুফান গিলে খাচ্ছে শহরের সবগুলো ঋতু, মাটি ও হৃদপিণ্ড।

এতো মানুষ, কেবল মানুষ
মানুষের পিঠে মানুষ
মানুষের পায়ে ও ত্বকে মানুষ,
দলে দলে স্নায়ুতন্ত্রের লাল ট্র্যাফিক সিগন্যালে
একটা শহর তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে
ছোটবড় পিচরাস্তায় জ্বলন্ত মোমবাতির মতো চুইয়ে পড়ছে ঘামক্লান্তি।
মানুষের অগ্নিতাপে গলছে শহরের যাবতীয় ফ্লাইওভার।

এই শহর মানুষের ভারে ন্যুব্জ,
এই শহর মানুষের ঘামে ভারসাম্যহীন প্রতিবন্ধী,
এখানে হেলাফেলায় হুটহাট ঢুকে পড়েছে ঘটিবাটিহীন প্রত্যাখ্যাত,
ওরা ধুমধাম গিলছে লতানো পাতার নতমুখ।

শহরের একপাশে প্রত্নজ ক্ষিধে,
দীর্ঘ জ্যামের ভেতরে হাতপেতে গিলছে প্রচন্ড সূর্যের আলরেখা,
অন্যপাশে চিলিচিকেনের উচ্ছ্বসিত টুংটাং
একফালি চাঁদজড়ানো নৈশশিশিরের তুমুল হর্ষ,
পালতোলা নরনারীর অলৌকিক হিরকদ্যুতির শব্দবিকেল।

একটা শহর গিলছে মানুষ
মানুষের শ্বাসযন্ত্রে মানুষ
মানুষের রক্তে মানুষ,
মানুষের ভারে তলিয়ে যাচ্ছে এ শহর
ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে মহেঞ্জোদারোর মতো…..…।

আধুলি // রুকসানা হক

আধুলিটা আকাশের দিকে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছে, ক্রমাগত ছুটছেই। বিশাল বিশাল বৃক্ষ পল্লবের মাথা ছাড়িয়ে, বাতাসকে পাশ কাটিয়ে ছুটেই চলেছে। ফিরে আসার নামটিও নেই।

নোলক স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, কোঁকড়ানো যন্ত্রণা পরবাসী অস্তিত্বে জমা রেখে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে, পাণ্ডুবর্ণ বিষণ্ন তার মুখ। আপন মনেই কথা বলে
ঃ তোমাকে আর ফিরিয়ে আনবো না। আধুলি তুমি মুক্ত।

আধুলিটা মেঘের উপরে উঠে গেছে, কোন এক মহাকর্ষ শক্তিবলে সে আকাশের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। বিশাল নীলেই যেন তার অবমুক্তি। নোলক চেয়ে আছে, মিটি মিটি হাসছে। মুক্তির অদ্ভুত স্বাদ দু’চোখের অক্ষিগোলকে জমা রেখে হৃদয় মন দিয়ে চেটে পুটে পান করছে তা।

সে তো আর বাসন্তী রঙ শাড়ি নিংড়ে নদীপাড়ে কাশবনে ছুটে চলতে পারে না। তার পায়ে বাঁধা বিরাট শেকল। অকস্মাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে সে। নিজের পায়ের দিকে তাকায়। তার হাসিটা পোড়ো জমির ফাটলের বুকে ভারী চাকার ক্লিষ্ট শব্দের মত মনে হচ্ছিল।

সে পশু হয়ে জন্মায়নি, ভীষণ রকম এক সৌভাগ্য তাকে মানবজন্মের খ্যাতিতে পূর্ণ করে রেখেছে। পশু হলে তো শেকলটা গলায় বাঁধা থাকতো। পশুর হাত অচল বলেই গলাই তার উপযুক্ত বাঁধনের স্থান। কিন্তু নোলকের তো আবার হাত চলে। পায়ে শেকল পরানোটাই নিরাপদ। দশ গজ লম্বা লোহার শেকলের একপ্রান্ত নোলকের পায়ে আর অন্য প্রান্ত পাকা খুঁটির সাথে বাঁধা।

আধুলি ছুটছে।
অস্পষ্ট ধোঁয়াশায় মোড়া এক উদ্ভিন্ন গোধূলির ভাষায় একা একা কথা বলে নোলক। নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকে। কেনো যে মাথায় মাঝে মাঝে খুন চেপে যায়। সেদিন কেনোই বা বুয়াকে ওভাবে কষ্ট দিল ? আবারো খিলখিল করে হেসে ওঠে। ঊর্ধ্বপানে আধুলির দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকে।

খুব মধুর স্বরে বুয়াকে ডাকতে ইচ্ছে হয়েছিল তার
ঃ বুয়া একটু আমার কাছে এসো না। পিঠ চুলকাচ্ছে। হাত দিয়ে নাগাল পাচ্ছি না। আমার পিঠটা চুলকে দাও না ?
ঃ না আপা আপনি আমাকে মারবেন। আমি পারবো না।
ঃ না না কি বলো বুয়া ? আমি মারবো কেনো ? আমার মাথা এখন পুরোপুরি ঠাণ্ডা।

অনুনয় বিনয় করে বুয়াকে ডেকে এনেছিল কেনো যে, সে নিজেও বুঝতে পারে না। বুয়া সরল মনে কাছে আসতেই বুয়ার শাড়ি দিয়েই গলা পেঁচিয়ে ধরলো নোলক। একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে এমন কাজে। বুয়া র জিহ্বাটা যখন বাইরে বের হয়ে আসছিল কেমন যেন একটা স্নিগ্ধ পুলক অনুভব করেছিল সে। কিন্তু শেষ মেশ কিছুই হলো না। বুয়া গগনবিদারী চিৎকার দিলো —– “ও মাগো আমাকে মেরে ফেললো গো”
সাথে সাথেই দৌড়ে এলো ঘরের ছোটবড় সবাই। তুমুল ধ্বস্তাধস্তি করে বুয়াকে ছাড়িয়ে নিলো।

বসে বসে এখন ভাবছে নোলক, এসব কি না করলে হতো না ? সবাই তাকে পাগল ভাবছে। শেকল পরিয়ে রেখেছে। কিন্তু মানুষের গ্রীবা খুব আকর্ষণীয় মনে হয় নোলকের কাছে। কাছে পেলেই খপ করে ধরে ফেলতে ইচ্ছে করে।

আধুলির ছুটে চলাটাও খুব ভালো লাগছে। আধুলি আকাশের বুকে গিয়ে থামবে, একটা নতুন নক্ষত্রের মতই আকাশের গায়ে চকচক করবে। পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ যেমন হ্যালির নামে ধুমকেতুকে চিহ্নিত করে ঠিক তেমনি এই নক্ষত্রের নাম চিহ্নিত করবে নোলকের নামে। নাম হবে নোলকের নক্ষত্র।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। বাড়ির সবাই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা হয়তো ভাবছে মাথাটা আরো গরম হয়ে গেলো কিনা ? এমনিতেই একটা অলিখিত সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ রয়েছে তার চারপাশ জুড়ে, কাছে এলে বিপদ অথবা একশ’ হাত দূরে থাকুন এ জাতীয় কথা দিয়ে।

মণিকে দেখলেই খুব আদর করতে ইচ্ছে করে নোলকের।
মনি কিছুতেই বোঝে না এ ছন্নছাড়া ফুপিটির অন্তঃস্থিত শিশিরের প্রহ্লাদ। একমাত্র ভাইয়ের ছেলে দশ বছরের মনির জীবনের বড় অংশ কেটেছে নোলকের স্নেহে।

চারমাসের শিশু মনিকে ফেলে রেখে মনির মা রাগ করে সেই যে বাপের বাড়ি গেলো, আর ফিরে এলো না। মনির লালন পালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়লো নোলক আর তার মায়ের উপর। মা মেয়ে মিলে মনিকে কোলেপিঠে করে বড় করলেন। মনির জন্য কতরাত যে নোলককে জেগে থাকতে হয়েছিল তার হিসেব নেই। অথচ সেই মনি এখন তার কাছে আসে না। একটা ভয়ংকর ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এ ছোট শিশুটির মনে।
মনি বল নিয়ে খেলছিল।
প্রাণপণে ডাকলো নোলক
ঃ মনি একটু কাছে আয় বাবা।

ডাক শুনেই ভয়ার্ত চোখে তাকালো শিশুটি। বলটা হাতে নিয়ে দিলো ভোঁ দৌড়। আহত হলো নোলক। আধুলির ছুটে চলাটা দেখানোর বড় ইচ্ছে ছিল তার। একদিন সে থাকবে না এ পৃথিবীতে। আকাশের গায়ে সেঁটে থাকা আধুলি অনন্তকাল ধরে বলে যাবে বেদনার তুমুল বর্ষণে গৃহবন্দী এক যুবতীর কথা। সে কথাটাই বলতে চেয়েছিল মনিকে।

আজকাল মাকেও মনে পড়ে খুব।
নোলকের জীবনের ভয়ংকর সে রাতের কাহিনী না জেনেই মা পাড়ি দিলেন না ফেরার দেশে। সে বলেনি কাউকে। বললেই বা কি হতো ? হয়তো অনেক হইচই হতো। মঈনুল কে মারধোর করা হতো, বড় জোর তাড়িয়ে দেয়া হতো বাড়ি থেকে। তাতে কি নোলক তার সম্ভ্রম ফিরে পেতো ? যে ক্ষতিটা তার হয়েছিল তা কি পোষানো যেতো ?

হঠাত চোখ বেয়ে গলগল করে অশ্রুর প্লাবন নেমে এলো তার। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। সবাই ভাবলো আবার শুরু হয়েছে এই হাসি এই কান্না। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বড় বোন নীলম আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলো
ঃ কি রে শরীর খারাপ লাগছে ?
মাথা নেড়ে জবাব দিলো নোলক —
ঃ না
ঃ তবে কাঁদছিস কেনো ? এই না হাসতে হাসতে মরে গেলি।
ঃ আমি মরে গ্যাছি ? কই ? বলেই একটা খামচি দিলো নিজের হাতে, চুলে সজোরে টান দিল
ঃ না মরি নি তো আপা ? ব্যথা পাচ্ছি তো। মড়ারা কখনো ব্যথা পায় ?

নীলম চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।
নোলক ভাবে আধুলিটা যদি মঈনুলের কপালে গিয়ে সজোরে আঘাত করতো ? না তা করবে কি করে ? মঈনুল হারামজাদা তো গাড়ির নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গ্যাছে। আকাশের কোথাও যদি কদর্য কিছু হয়ে লটকে থাকে এই দুরাত্মা, তবে হয়তো সেখানে গিয়ে আঘাত হানতে পারে আধুলি। কিন্তু আধুলিটা চিনবে কি করে এই শয়তানকে ?

মঈনুলের কথা মনে হতেই একটা কষ্ট শিরদাঁড়া বেয়ে মাথার সূক্ষ্ম ছিদ্রে এসে থামল। অভিশপ্ত সময়ের পলাতক কান্নার ধ্বনি ছড়িয়ে পড়লো ঘুটঘুটে অন্ধকার সে রাত্রির চিৎকারে।

সে বীভৎস রাতে নিজের রুমে দরোজা ভেজিয়ে ঘুমিয়েছিল নোলক। তখন মাত্র ক্লাশ টেনে ছিল সে। সুযোগ বুঝে পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মঈনুল। কিছুতেই ছাড়াতে পারেনি নিজেকে। শিয়রে জমে থাকা বীভৎসতার প্রগলভ উচ্চারণে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সজোরে টান ও দিয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুকে ছুঁতে পারেনি সে। এক দীর্ঘমেয়াদী স্তব্ধতার ভেতর আটকানো যেন তার উত্তরের বাতাস। সেখানে মৃত্যুর অস্তিত্ব ক্ষীণ।

একদিন খবর এলো মঈনুল ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছে। নোলক চিৎকার করে উঠেছিল, সে চিৎকারের ভেতরে নিহিত ছিল প্রচন্ড ক্ষোভ আর ঘৃণা। প্রতিমুহূর্তে ওর মৃত্যু কামনা করলেও এতো সহজ মৃত্যু সে চায়নি কিছুতেই।

মঈনুল নামটা উচ্চারন করেই হো হো হাসিতে ফেটে পড়লো নোলক। তখন সর্বস্ব হারিয়ে কয়েকদিন উদ্ভ্রান্তের মত ছিল। কতবার মাকে বলতে চেয়েছে কিন্তু কিছুই বলা হয় নি তার। ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেছে, অথচ কেউ বুঝতেও পারেনি নোলকের হিমের কাফনে জড়ানো গ্লাণির ভাষা।

মঈনুলদের মতো দুরাত্মারা মরে না, ওরা শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকে।

মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হতো। বীভৎস সে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে ঘৃণায় নিজের শরীরে থু থু ছিটোতো। চামড়া খামচে খামচে রক্তাক্ত করতো। প্রতিদিন আট থেকে দশবার গোসল করেও মনে হতো নিজেকে অপবিত্র।

তার এই অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল সবাই। পরামর্শ চলছিল দিনের পর দিন। ঠিক এমনি এক সময় হঠাৎ দু’দিনের ডাইরিয়ায় মা মারা গেলেন। সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে গেলো নোলক। সে শোক আর সইতে পারেনি সে।

ঘরের জিনিসপত্র তার কাছে ভয়ংকর শত্রুর মত মনে হতো। আছড়ে আছড়ে ভাঙত সব কিছু। কারো গলা দেখলে ভীষণ ইচ্ছে করতো চেপে ধরতে। এভাবে কয়েকজনকে ধরার পরই তার পায়ে শেকল পরান হলো।

আধুলিটা মেঘের স্তর পার হয়ে গ্যাছে। উল্কার গতিতে ছুটে চলেছে। সেই ছুটে চলা মুহূর্তগুলোর আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করছে নোলক। খিল খিল করে হাসছে। অন্তত এই আধুলিটা মঈনুলের কদর্যতা খুঁজে বের করবে।

এই আধুলি কোথায় পেয়েছিল মনে করতে পারেনা নোলক। তবে ঝাড়ফুঁকের একটা অংশ যে এ আধুলি তা বুঝতে দেরি হয়নি তার। তাইতো একে ছুঁড়ে একবারে আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

তার এখন একটাই লক্ষ্য, কুৎসিত মঈনুলকে খুঁজে বের করা। সে চেয়েছিল মঈনুলকে নিজহাতে শাস্তি দেবে। কিন্তু কুলাঙ্গারটা ভোরের আলো ফোটার আগেই পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন।

এখন এ শক্তিমান আধুলি পশুটাকে খুঁজে বের করুক। ওর মৃত কপালে আঘাত করুক।

নোলকের মামাতো ভাই লিটন ইংল্যান্ডে থাকে। ওখানে স্থায়ী বসবাস তার। কিছুদিনের জন্য দেশে বেড়াতে আসে সে। দেশে ফিরেই নোলককে দেখতে আসে। শেকল বাঁধা মেয়েটাকে দেখে কষ্টে মুষড়ে পড়ে। বড় আপাকে অনুরোধ করে –
ঃ আপা ওকে খুলে দাও।
ঃ ও খুব ভায়োলেন্ট হয়ে যায় রে
ঃ কিচ্ছু করবে না। আমি দেখবো।
ঃ না তুই সামলাতে পারবি না

বড় আপা খুলে না দিলেও লিটন নোলকের শেকলটা খুলে দিয়ে ওকে মুক্ত করে। নোলক যেখানে বসা ছিল সেখানেই বসে থাকে। লিটন কাছে গিয়ে বলে
ঃ তুমি এখন মুক্ত নোলক। এসো আমরা বাইরে যাই।

নোলক হাসে। এমন মুক্তি যেন সে চায়নি কোনকালে। দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে
ঃ কেনো খুলে দিয়েছো শেকল?
ঃ তোমাকে বাঁধা দেখতে আমার ভালো লাগে না তাই।
ভ্রু কুঁচকে লিটনের দিকে তাকায় নোলক।
মুহূর্তেই মঈনুলের কুৎসিত অবয়ব যেন দেখতে পায় লিটনের মাঝে। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে খাটের কোণায় জড়সড় বসে থাকে। ভয়ে থরথর কাঁপছে মেয়েটা।

লিটন অবাক হয়।
ঃ কি হয়েছে নোলক, এমন করছো কেনো?
ঃ আমার আধুলিটা? আধুলিটা কোথায়?
হন্যে হয়ে আধুলি খুঁজতে থাকে। আধুলিটা ছুঁড়ে মারতে চায়। কিন্তু অনেক আগেই ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সে।

উপরে তাকায়, আকাশ খুঁজে, যেন আকাশেই আধুলিটা সেঁটে আছে।

কিসের আধুলি কি আধুলি লিটন কিছুই বুঝতে পারে না। তবে এটা বুঝে মেয়েটাকে যেকোন ভাবেই সুস্থ করে তুলতে হবে।

সে জানে নোলককে সুস্থ করে তোলা খুব সহজসাধ্য নয়। পরিবেশ পরিস্থিতি কোনভাবেই নিজের অনুকূলে থাকবে না। লিটনের ভাবনার আকাশ জুড়ে যে নোলক তার সামান্যতম স্থান যে এ সুস্থ সমাজে নেই, এ ক’দিনে হাড়ে হাড়ে তা বুঝতে পেরেছে সে।

ধীরে ধীরে নোলক যেন কোন এক বিশ্বাসের আকাশ খুঁজে পাচ্ছে, যেখানে মঈনুলরা থাকেনা, থাকেনা তাদের কদর্য নোংরা হাত। তার আধুলির গতিপথে ছোট ছোট অনুভূতি জড়ো হতে থাকে। যে অনুভূতিগুলো সেই নোংরা রাতের বীভৎসতায় পচেগলে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

এখন আর বিছানার কোণে নিজেকে জড়োসড়ো করে লুকোতে চায় না নোলক। এখন সে উন্মোচিত হতে চায়।

রক্তের মেয়েকণা // রুকসানা হক

যখন মেয়েদের বুকের ভেতরে তৃষ্ণার কঠিন অনুবাদ,
জলরঙ জলাশয়ে নামে একদল জোনাকির গন্ধ ,
হা পিত্যেশের শহরে
কোন চাঁদচিঠি মেয়েদের ঘুমের মসৃণে পৌঁছায় না ,
শুধু বুকের গভীরে শিষ দেয় গতবসন্তের অলীক চাহনী ।

এখনো আকাশে মেয়েদের পালক ফোটেনি ,
এখনো মেঘের কাছে মেয়েদের চোখজল ফর্সা হয়নি ,
মেয়েদের বুকে নামে চাপাতির নৃশংস পিয়াস
মোমরঙ চিঠি ঘুম হয়ে নামে না তাদের চোখে ।

অনেকগুলো গানের অন্তরা ছুঁয়ে
মেয়েগানে কেবলই কান্না বাজে ,
অনেকগুলো রক্তের কণায় মেয়েকণা তৃষ্ণার্ত থাকে ,
অনেক অনেক নিঃশ্বাসের অরণ্যে
মেয়েশ্বাসেরা দমচাপা থাকে ,
দু’মুঠো সুবাতাস চেয়ে মেয়েপাখির ডানা এখনো
মেঘ ছুঁতে পারে না ।

সাত আকাশ ভরা ঐশ্বর্যভাষায় মেয়েদের স্তুতি শোনা যায় ,
সাতনদীর মোহনায় মায়াবী মেয়ের হাতছানি কবিতা হয় ।
অথচ রক্তের মেয়েকণা ঘাসের সবুজ শুষে নিতে থাকে ,
মেয়েস্তুতি আর হাতছানি কবিতারা লজ্জিত হয় না তবু ।

নিভৃতের দুঃখ// রুকসানা হক

কেউ তো জানেনা…..
বিছানার পাশে কাঁচের জানালা খোলা
তার ওপাশে আকাশ ছিল যে নীল,
ইটের দম্ভ ধূসর মাটিকে ছুঁয়ে
আকাশের বুকে এঁটে দিলো যেই খিল;
সুপারীর সিঁথি ঢাকলো দুখের পালকে
বর্ষাতি রঙ রামধনু এঁকে দিলোনা,
ইট পাথরের কর্কশ ধ্বনিগুলো
ঘাসফড়িংএর উল্লাস মেখে নিলোনা।

২)

কেউ তো জানে না……
সেদিনই আমার ঘুঘুর সুরটা হারায়,
জোনাকির চোখ নিলামের ডাকে পালায়।
উঠোন পেরুলে ছিল তো সবুজ জমি,
এমন রূপটা জীবনে দেখেছি কমই।
শীতের সকালে সোনালী ধানের সাথে
দু’চোখ আমার ভিজতো সুখে যে তাতে।
এপাশে দালান আকাশ সমান হলেও
ওপাশে কিষাণী সুখে থাকে নানা ছলেও।