কলির ঠাকুর অনুকূল ধর্মমূলক সামাজিক নাটক

কলির ঠাকুর অনুকূল
ধর্মমূলক সামাজিক নাটক

পরিবেশনায়- নতুন দিল্লি নাট্য সমাজ
সংগ্রহ, সম্পাদনা, নির্দেশনা
ও অভিনয়ে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী,
প্রযোজনা-শঙ্খ বিশ্বাস,
সুর- প্রশান্তকুমার,
সুর ও আবহ: কাঞ্চন নস্কর।
মঞ্চসজ্জা- ইন্দ্রনীল চ্যাটার্জী
সামাজিক নাটক- কলির ঠাকুর অনুকূল

নাট্যকারের নিবেদন

শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সনাতন ধর্মের একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ। বাংলা ১২৯৫ সনের ৩০ শে ভাদ্র পাবনা জেলার অদূরে পদ্মানদীর তীরে হিমাইতপুরে তিনি আবির্ভূত হন। অনুকূলচন্দ্রের পিতা শিবচন্দ্র ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণ। তার জননী মনোমোহিনী দেবী ছিলেন একজন স্বতীসাধ্বী রমনী।

তিনি উত্তর ভারতের যোগীপুরুষ শ্রী শ্রী হুজুর মহারাজের শিষ্য। বাল্যকালে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র মায়ের কাছেই দীক্ষা গ্রহন করেন। পদ্মানদীর তীরে হিমাইতপুর গ্রমেই অনুকূলচন্দ্রের শৈশব, বাল্য ও কৈশর অতিক্রান্ত হল। পিতা-মাতার প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা।

একবার পিতার অসুখের সময় সংসারে খুব অর্থকষ্ট দেখা দেয়। বালক অনুকূলচন্দ্র এগিয়ে এলেন সংসারের হাল ধরতে। তিনি প্রতিদিন আড়াইমাইল হেটে গিয়ে শহরে মুড়ি বিক্রি করে সে অর্থ দিয়ে পিতার জন্য ঔষধ আনতেন, পথ্য আনতেন। মায়ের প্রতিও ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি। মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাতে সকল কষ্টিতিনি অকাতরে সইতে পারতেন। হিমাইতপুরে পাঠশালায় পাঠ সমাপ্ত হলে তিনি পাবনা ইনস্টিটিউট এ ভর্তি হন।

সহপাঠীদের কাছে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ছিলেন প্রিয়পাত্র। কেউ তাকে বলতেন ‘প্রভু’ আবার কেউ একধাপ এগিয়ে বলতেন অনুকূল আমাদের রাজা ভাই। পাবনা থেকে নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এলেন অনুকূলচন্দ্র। এখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি মনোনীত হন। কিন্তু সে পরীক্ষা দেওয়া আর তার ভাগ্যে ঘটেনী। এক দরিদ্র সহপাঠীর পরীক্ষার ফিসের টাকা যোগাড় করতে পারেনী দেখে ব্যথিত ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নিজের টাকাটা তাকে দিয়ে দেন। মায়ের ইচ্ছা পূরনের জন্য এরপর তিনি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। পিতা অসুস্থ, সংসারে দারিদ্রের কালো ছায়া।

তাই কলকাতায় শিক্ষা জীবন ছিল ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবন সংগ্রামের সময়। টাকার অভাবে ঠিকমত খাওয়া পর্যন্ত জুটত না। কখনও রাস্তার ধারের কল থেকে জল খেয়ে কাটাতে হত। আর্থিক কষ্ট থাকলেও অনুকূলের ছিল মধুর অমায়িক ব্যবহার। তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে প্রতিবেশী ডাক্তার হেমন্তকুমার চাটুজ্জে ঔষধসহ একটি ডাক্তারী বাক্স তাকে উপহার দেন। অনুকূলচন্দ্র ঐ ঔষধ দিয়েই শুরু করেন কুলিমজুরদের সেবা। সেবার আনন্দের সাথে সাথে যে সামান্য কিছু অর্থ আয় হত তাতেই ক্রমে ক্রমে তার অর্থকষ্টের অবসান হয়।

কলকাতা থাকা অবস্থায় অনুকুলচন্দ্র মাঝে মাঝে গঙ্গার ধারে বসে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। হিমাইতপুতে চিকিৎসক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এতে তার অভূতপুর্ব সাফল্য আসে। তবে তিনি শুধু দেহের চিকিৎসাই করেন না, মনের চিকিৎসাও করেন। তিনি উপলব্দি করলেন, মানুষের দুঃখের স্থায়ী নিবারণ করতে হলে শারীরিক মানসিক ও আত্মিক এই তিন রকম রোগেরই চিকিৎসা দরকার। তিনি মানসিক ব্যাধীর চিকিৎসা শুরু করলেন। অসহায় যারা অবহেলিত যারা অনুকূল তাদের হলেন প্রাণের বন্ধু। তাদের তিনি নাম মহাত্ম্য শুনিয়ে কীর্তনের দল গড়ে তুললেন। কিন্তু কিছু কিছু শিক্ষিত তরুণও এই সময় তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এদের নিয়ে কীর্তন আনন্দে মেতে উঠলেন অনুকূলচন্দ্র।

তখন থেকে সমাগত ব্যক্তিগণ তাকে ডাক্তার না বলে ঠাকুর বলে সম্মোধন করতে থাকেন। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের এই মহিমার কথা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তবে কীর্তনের ব্যাপারটা নিয়ে ঠাকুর গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, কীর্ত্তন মানুষের মনকে উপরের স্তরে নিয়ে যায় বটে, কিন্তু সে অবস্থা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। মনের স্থায়ী উন্নতি ঘটাতে হলে চাই সৎনাম স্মরণ ও মননের সাহায্যে ব্রহ্মার উপলব্ধি। আর তার জন্য দীক্ষা একান্ত আবশ্যক।

শুরুহল সৎ নাম প্রচারের মহিম্মানিত অধ্যায়। তাঁর ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। সৎসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ঠাকুর শ্রী অনুকূলচন্দ্র। প্রতিষ্ঠান্টির নামের তাৎপর্য ব্যখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সৎ ও সংযুক্তির সহিত তদগতিসম্পন্ন যাঁরা তাঁরাই সৎসঙ্গী, আর তাদের মিলনক্ষেত্রি হল সৎসঙ্গ। শুরু হল মানুষ তৈরির আবাদ। কর্মের মাধ্যমে যোগ্যতর মানুষ গড়াই হল এর লক্ষ্য।

অন্যদিকে হিমাইতপুরে গড়ে উঠল ধর্ম কর্মের অপূর্ব সমন্ব্যে সৎসঙ্গ আশ্রম। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প সুবিবাহ আস্তিকের এই চার স্তম্ভের অভিব্যক্তি। এই আশ্রমে বিভিন্নমুখী কর্ম প্রতিষ্ঠানের বিদ্যায়তন গড়ে উঠল, প্রাচীন ঋষিদের তপবনের নবতর সংস্করণ যেন।

ব্রহ্মচর্যা, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস সনাতন আর্য জীবনের এই চারটি স্তরই সৎসঙ্গ আশ্রমভূমিতে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ যুগোপযোগী রুপ লাভা করে। ঠাকুর অনুকূলচন্দের আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উদদ্ভু হয়ে দলে দলে মানুষ এসে তাঁ শিষ্যত্ব গ্রহন করে। ঠাকুর অনুকুল চন্দের প্রতিষ্টিত হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রম নামে উপমাহাদেশে সুপরিচিতি লাভা করে। মহাত্মা গান্ধী এই সৎসঙ্গের কর্মকান্ড দর্শন করে ভূয়শী প্রশ্নংসা করেন।

এটি একটি ধর্মমূলক সামাজিক যাত্রাপালা। গ্রামে গঞ্জে, শহরে এ পালাটির বহুল প্রচার হলে ও যুগের ঠাকুর যুগপুরুষোত্তমের প্রদর্শিত পথে সকলেই অগ্রসর হলে আমার প্রয়াস সফল হবে।

বিনীত নাট্যকার
নতুন দিল্লি- ১১০০২৮

কুশীলবগণ

অনুকূলচন্দ্র- যুগ পুরুষোত্তম [নাম ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেছেন কবিপূত্র সূর্যশেখর ভাণ্ডারী]
শিবচন্দ্র- অনুকূলচন্দ্রের পিতা [ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেছেন কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী]
মনমোহিনী- অনুকূলচন্দ্রের মাতা [ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেছেন কবিপত্নী শেফালী ভাণ্ডারী]
দুর্বৃত্তপ্রধান- [দুরৃত্তের ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেছেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র (পল) অমিত বারিক]
দুর্বৃত্তগণ-গ্রামবাসীগণ- গ্রামের মাতব্ররগণ ইত্যাদি।

(সুত্রধর মাইকে ঘোষণা করবে)

হিমাইতপুর ছোট্ট গ্রামে পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মাতা মনমোহিনী দেবীর গর্ভে বিশ্বমানবের পরম কল্যাণস্বরূপ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন পরম প্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র। তিনি মায়ের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেই শুরু করে দেন নতুন কাজ, নতুন জীবন। তিনি নবউদ্যম নিয়ে উৎফুল্ল মনে উঠেপড়ে লেগে যান মানুষের চরিত্র গঠনের কাজে। তিনি পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে কলূষমুক্ত করার জন্য এতো অপমান, এতো গঞ্জনা সহ্য করে চলেছিলেন তাঁর আপন গতিপথে। যেথায়ই দেখেছেন অসৎ প্রকৃতির লোকেরা শাসন পীড়নের মাধ্যমে সঠিক পথে আনা যাচ্ছে না, তখনই তিনি দেবদূত হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর প্রেম ভালবাসা নিয়ে। তাঁরই অংশ বিশেষ সংলাপ আকারে তুলে ধরছি :

(মঞ্চে আলো জ্বলে ওঠে। বেজে ওঠে নহবতের সুর। )

প্রথম দৃশ্য
(শিবচন্দ্রের বাড়ির অভ্যন্তর)

অনুকূলচন্দ্র : মানুষের দেহের রোগ সাময়িক, অল্প দিনেই সেরে যায়। কিন্তু দেহের ভিতরের রোগটা কীভাবে সারিয়ে তোলা যায় তাঁর একটা উপায় করতে হবে মা।

মনমোহিনী দেবী : খোকা তুই কি বলছিস! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রে বাপ।

অনুকূলচন্দ্র : তুমি না বুঝলে কে বুঝতে পারবে মা, তুমি যে বিশ্বজননী। জগতের ভাল মন্দের চিন্তা করা তোমার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি।

মনমোহিনী : এবার বলতো বুড়ো বাপ আমার, তুমি কি করতে চাও?

অনুকূলচন্দ্র : মা-মানুষের দেহের ভিতরে অবস্থিত মন-মন্দিরই সর্বসিদ্ধ আত্মিক তথা আধ্যাত্মিক জীবনের মূল আধার। মানুষ আজীবন কষ্ট পায় মনের এই রোগ নিয়েই এবং অপরকেও কষ্ট দেয়। তাই আমি ভেবে দেখছি আমার সর্বশক্তি, প্রেম ভালবাসা দিয়ে মানুষের মনের সুস্থতা ফিরিয়ে আনবো।

মনমোহিনী : বাবা-অনুকূল, ঐ অঞ্চলে মূঢ় নীতিজ্ঞানহীন অসৎ লোকের অভাব নেই। সর্বত্রই তাদের অবাধ বিচরণ। তাঁরা না পারে এমন কোনো হীন কাজ নেই। অবলীলাক্রমে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা, অগ্নিকান্ড, লুটতরাজ, নারীদের ওপর অত্যাচার চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি করে চলছে। যারা তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেছে তাদেরকেই প্রাণে বাঁচতে দেয়নি।

অনুকূল চন্দ্র : তাই বলে আমিও হাল ছেড়ে বসে থাকতে পারিনা। তুমি শুধু আশীর্বাদ করো তাতেই সফল হতে পারবো। আর এই কাজটা ভেবে চিন্তেই করবো। তা নিয়ে কোনো চিন্তা করো না মা।

(ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র মনে মনে ভাবলেন হুট করেই তাদেরকে বাধা দিতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের আসুরিক মনোবৃত্তি যাতে ক্ষুন্ন হয় সেদিক বিবেচনা করে ধীরে ধীরে কাজ করে যেতে হবে)
(দৃশ্যান্তর)

দ্বিতীয় দৃশ্য
(গ্রাম্য পথ)

অনুকূলচন্দ্র : বন্ধুগণ তোমাদের জন্য মিষ্টি এনেছি। নাও তোমরা সবাই মিলে আনন্দ করে খাও।

দুর্বৃত্তগণ : সেকি ডাক্তার! তুমি আমাদের এতো খাতির করছ যে বড়। কোনো সভ্য ঘরের সন্তান আমাদের বন্ধু হতে পারে? তাতে যে তোমার দুর্নাম হবে গো। নাকি কোনো ছল করছো?

অনুকূল চন্দ্র : আরে বন্ধুগণ-আমি দুর্নামকে ভয় পাই না। কোনো ছলও করছি না। শুধু আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই, বন্ধু হতে চাই। তোমাদের আলোচনায় থাকতে চাই। এবার বিশ্বাস হলো তো?

দুর্বৃত্তদের প্রধান : ডাক্তার অনুকূলচন্দ্র, আমাদের একজন পরম হিতাকাঙ্খী। আমার মনে হচ্ছে। তোরা ভুল বুঝিস না। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি সঙ্গে থাকলে ভালই হয়।

দুর্বৃত্তগণ : ওস্তাদ আপনার কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু ডাক্তারকেও বলে রাখবেন সে যেন আমাদের সঙ্গে কোনো প্রতারণা না করে।

অনুকূলচন্দ্র : কি বলছ বন্ধুগণ! প্রকৃত বন্ধু যে, সে কি তাঁর বন্ধুদের ক্ষতি চায়, নাকি করতে পারে?
(দৃশ্যান্তর)

তৃতীয় দৃশ্য
শিবচন্দ্রের বাড়ি

(কয়েকজন গ্রামবাসী সহ মুরুব্বি লোকেরা প্রবেশ করে)

গ্রামের মুরব্বি লোকেরা : কি যুগ পড়ছে রে বাবা-লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হয়ে শিবচন্দ্রের ছেলে অনুকূল একেবারে গোল্লায় গেছে। ডাক্তারি করতেছিল ভালই ছিল। কিন্তু সেসব ছেড়ে দুর্বৃত্তদের সঙ্গ নিচ্ছে। সবাই চলো তো, তাঁর বাবা মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করি।

(ডাক্তার অনুকূলচন্দ্র তথাকথিত মান-সম্মানের ভয় না করে বিষাক্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে সুস্থ ও রোগমুক্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন কেন, কেউ বুঝবার চেষ্টাও করে নি। হয়তো এটাকেই বলে মোহ-মায়াজালে অন্ধ)

মুরব্বিগণ : শিবচন্দ্র বাড়ী আছ?

শিবচন্দ্র : আপনারা! কি সৌভাগ্য আমার। আসুন, আসুন, বসুন।

মুরব্বিগণ : আমরা বসতে আসিনি বাপু। জানতাম ভদ্রলোকের ঘরে ভদ্র সন্তান হয়। কিন্তু-

শিবচন্দ্র : কিন্তু কি?

মুরব্বিগণ : দেখ শিবচন্দ্র, তোমার ছেলে যে দুর্বৃত্তদের সাথে মিশে আড্ডা দেয় তা কি তোমার চোখে পড়েনি? এবার তোমাকে জানিয়ে গেলাম যা ভাল বুঝ তাই করবে।
(গ্রামবাসীগণ সহ মুরুব্বিগণের প্রস্থান)

শিবচন্দ্র : হায় ভগবান! এই ছেলেকে নিয়ে আর পারছিনা। মনো, ওরা কি বলে গেল তা তো তুমি নিজের কানেই শুনলে।

মনমোহিনী : ওরা ওদের কথা বলে গেছে তাতে কি হয়েছে? আমরা তো জানি, আমাদের ছেলে কেমন। অনুকূল এমন কোনো কাজ করতেই পারে না যাতে করে সমাজের অকল্যাণ হয়। তাছাড়া সে তো বাড়ি ফিরবে।

(অনুকূলচন্দ্রের প্রবেশ)

অনুকূলচন্দ্র : মা-আমাকে নিয়ে কি কথা হচ্ছে গো?

মনমোহিনী : আর কি হবে? তুমি দুর্বৃত্তদের পাল্লায় পড়ে দুর্বৃত্ত হয়ে গেছ এই এই …..

অনুকূলচন্দ্র : জান মা পারিপার্শ্বিক অবস্থা দূষিত হলে সবার গায়েই তাঁর আঁচ লাগবে। তাই পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে তা নেভানোই সর্বপ্রথম কর্তব্য। তাঁর নীতিবাক্যই বলে দেয় সমাজে প্রত্যেকেরই প্রয়োজন। কারণ পাপকে ঘৃণা করলেও পাপীকে ঘৃণা করা উচিত নয়। এবার হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, খ্রিস্টান হোক বা বৌদ্ধই হোক, সবাই একই পিতার সন্তান। এখন তুমি বলো, কেন ওদের সঙ্গ নিচ্ছি?

মনমোহিনী : তাই বুঝি নীলকণ্ঠের মতো গরল পান করে প্রত্যেককে পথ দেখাতে চাইছিস?

অনুকূলচন্দ্র : হ্যাঁ, মা। তাঁরা আমার অকৃত্রিম সেবা-ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে অকপটে তাঁদের মনের গোপন কথা বলছে। আর যদি আমি তাঁদের সাথে মেলামেশা না করতাম তাহলে কি তাঁরা বলতে চাইতো?

মনমোহিনী : সত্যি তোর এই কৌশল দেখে আমিও মুগ্ধ হচ্ছি। তুইই পারবে বাবা, ওদেরকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনতে।
(দৃশ্যান্তর)

চতুর্থ দৃশ্য

দুর্বৃত্ত প্রধান : তোরা ভাল করে কান পেতে শোন-আজই ঐ গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে-ছেলেকে অপহরণ করবো। সে কি ডাক্তার! এই সময়ে তুমি?

অনুকূলচন্দ্র : তোমরা কোথাও যাচ্ছ বুঝি? আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবো।

দুর্বৃত্তগণ : না-না। এটা কিছুতেই সম্ভব না। তোমার দ্বারা এসব কাজ হবে না।

অনুকূলচন্দ্র : তোমাদেরকে বুঝিয়ে বলছি-আমি সঙ্গে থাকলে তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং তোমাদের লাভই হবে।

দুর্বৃত্তগণ : কি নাছোর বান্দা রে বাবা। কি আর করা যাবে। ডাক্তার চল। কিন্তু মাথায় রেখো তোমার দ্বারা যেন কোন অনর্থ না ঘটে।

(সুত্রধর মাইকে ঘোষণা করবে)

(তাদের সঙ্গে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রও গেলেন। কিন্তু দুর্বৃত্তরা গৃহস্ত বাড়ির আস্তাকুড়ের পাশেই লুকিয়ে রইল। কখন এই গৃহস্ত বাড়ির মেয়েরা বাইরে আসবে আর সঙ্গে সঙ্গে অপহরণ করবে। কিন্তু ঠাকুর ঐ আস্তাকুড়ের দুর্গন্ধ ও সাথে প্রচন্ড মশার কামড় সহ্য করতে পারেননি। তাই জোরে জোরে ইচ্ছে করেই চাপড় মেরে মশা মারতে লাগলেন)।

দুর্বৃত্তগণ : ঐ যে ডাক্তার, আগেই বলেছিলাম না তুমি এসব কাজ পারবে না। আবারও সাবধান করে দিচ্ছি শব্দ যেন না করো।

অনুকূলচন্দ্র : দূর হো শালার মশা-

দুর্বৃত্তগণ : সে কি! ডাক্তার জোরে চপেটাঘাত করতে করতে মাঠের উদ্দেশ্যে ভীমবেগে দৌড়াতে লাগল কেন? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। চলতো আমরাও তাঁর পিছু পিছু যাই ……

অনুকূলচন্দ্র : আর পারছি না বাপু, একটু জিরিয়ে নিই।

দুর্বৃত্তগণ : ডাক্তার তুমি এমনভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠে এলে কেন?

অনুকূলচন্দ্র : কি আর করবো-শালার মশার কামড় খেয়ে মরতে গিয়েছিলাম এই ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে আমার কি প্রাণের মমতা নেই? জীবনটা কি এতই তুচ্ছ।

দুর্বৃত্তগণ : ডাক্তার তুমি বজ্রকণ্ঠে কিসব বলছ?

অনুকূলচন্দ্র : কেন তোমরা বুঝতে পারনি? তুচ্ছ মেয়ে মানুষের পাছে ছুটে লাভ কি? আমরা কি পুরুষ নই যে পরস্ত্রী হরণের চেষ্টা করবো? আমাদের কি লজ্জা বলতে কিছুই নেই? আমরা কি এতই নিচ যে আত্ম মর্যাদা বিসর্জন দেব? আমাদের শৌর্য-বীর্য, রূপ-গুণ দেখে নারীরাই ছুটে আসবে আমাদের পেছনে তবেই তো …..

দুর্বৃত্তগণ : হে ডাক্তার, হে প্রাণের ঠাকুর! আমরা সৃষ্টিকর্তাকে চোখে দেখিনি কিন্তু তুমি আমাদের নতুন জীবন সৃষ্টি করেছো, তাই তুমি আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তোমার এই বজ্র-গম্ভীর বাণী আমাদের আত্মসম্মানে প্রচন্ডভাবে ঘা দিয়েছে। আমাদের অন্তর অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তুমি দয়া করে তোমার পদতলে স্থান দিয়ে আশীর্বাদের হাত আমাদের মাথায় রেখ।

অনুকূলচন্দ্র : বন্ধুগণ! আমার পা ছাড়। আর কেঁদো না। তোমরা কাঁদলে আমার প্রাণেও ব্যথা লাগে। তাই আল্লাহই বলো, ভগবানই বলো, গডই বলো যে যাই বলো না কেন তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো। দেখবে দুঃখ ক্লেশ সব দূর হয়ে গেছে। তোমরা তোমাদের ভুল বুঝতে পারছ তাতেই আমি প্রীত হয়েছি আর আমি কিছু চাই না।

যবনিকা

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

12 thoughts on “কলির ঠাকুর অনুকূল ধর্মমূলক সামাজিক নাটক

  1. একজন লেখকের সার্থকতা তখনই, যখন পাঠক সেটিকে সানন্দে গ্রহণ করেন। আমি আপনার পোস্ট পড়লাম কবি। ধন্যবাদ। :)

    1. আপনার সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।
      আসুন, আমরা সকলেই শ্রী শ্রী ঠাকুরের নির্দেশিত চলার পথে অগ্রসর হই।
      আর আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি মনুষ্যত্বের মহান আদর্শে।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

  2. একই লিখকের একাধিক পোস্ট একদিনে এমনিতেই বিরক্তির একটি কারণ হয়ে উঠতে পারে। পাঠক কেমন সাড়া দিচ্ছে সেটা খেয়াল করার সনির্বন্ধ অনুরোধ করলাম। শুভেচ্ছা। :)

    1. সু পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। শ্রদ্ধা রেখে গেলাম। সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন।
      আসুন, আমরা সকলেই শ্রী শ্রী ঠাকুরের নির্দেশিত চলার পথে অগ্রসর হই।
      আর আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি মনুষ্যত্বের মহান আদর্শে।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

  3. ধন্যবাদ কবি। সারাদিনের ব্যস্ততার পর এতো বড় পোস্ট পড়ার ধৈর্য্য থাকেনা। সরি।

    1. আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। বড়ো পোস্ট না দেওয়াই ভালো।
      কথাটা স্মৃতিতে থাকলো। সুপরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।

      আসুন, আমরা সকলেই শ্রী শ্রী ঠাকুরের নির্দেশিত চলার পথে অগ্রসর হই।
      আর আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি মনুষ্যত্বের মহান আদর্শে।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

  4. ১৯৫১ শব্দ। না ভাণ্ডারী দা। এই ক্লান্তিতে এতো বড় পোস্ট পড়তে পারবো না। :(

    1. আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। বড়ো পোস্ট না দেওয়াই ভালো।
      কথাটা স্মৃতিতে থাকলো। সুপরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।

      আসুন, আমরা সকলেই শ্রী শ্রী ঠাকুরের নির্দেশিত চলার পথে অগ্রসর হই।
      আর আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি মনুষ্যত্বের মহান আদর্শে।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

    1. আসুন, আমরা সকলেই শ্রী শ্রী ঠাকুরের নির্দেশিত চলার পথে অগ্রসর হই।
      আর আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি মনুষ্যত্বের মহান আদর্শে।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

  5. "আল্লাহই বলো, ভগবানই বলো, গডই বলো যে যাই বলো না কেন তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো। দেখবে দুঃখ ক্লেশ সব দূর হয়ে গেছে।"

     

    এর চেয়ে অধিক সত্য আর কি আছে । শুভকামনা দাদা       

  6. আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

    আসুন, আমরা সকলেই শ্রী শ্রী ঠাকুরের নির্দেশিত চলার পথে অগ্রসর হই।
    আর আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি মনুষ্যত্বের মহান আদর্শে।
    সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
    জয়গুরু!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।