এখান থেকে দেড়শ মাইলের মাথায় আমাদের উঠানে এখন পারদের মত থই থই করছে চাঁদের আলো। গাছগুলো এখন ভারী ঘুমে। চৈতি হাওয়া শিস দিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা কিছুক্ষণ পরপর বাড়ি যাব যাব বলে সংকল্প জানান দিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। বাড়ি যাওয়ার পথে একদল লোক বাঁশ বেঁধে দিয়ে একযোগে সেলফি তুলে। তারপর দোকানের মালামাল নিয়ে যাওয়ার পথে মুদিকে ওরা ঠ্যাঙায়। করোনার বিধ্বস্ত সময়ে এসব হয়। মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। পাখিরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ তখন আবার ঘুমায়। কেউ কেউ ভাবে এত ঘুমিয়ে কি হবে। খবরটা দেখি। তখন তারা খবর দেখে। খবরে লাশের হিসেব। আঙুলে গুনে গুনে দেখি খবর ঠিক আছে কিনা। তখন আমরা আবার ঘুমিয়ে পড়ি। গাছেরা শিস দেয়। তাদের নিচে বেজিরা লাফায়। বেজিদের লাফালাফিতে বিরক্ত হয় স্বেচ্ছাসেবীর দল। ত্রানের ছবিতে বেজি দেখা গেলে সেটা ভাল দেখায় না। বেজিরা এখন তবু নিশ্চিন্ত। দুপায়ের উপর ভর করে তারা নাচে। বাচ্চাদের কার্টুনের মত। বাচ্চাদের এখন আর কার্টুন ভাল লাগছে না। তারা বেজিদের দেখেও সন্তুষ্ট না। তারা বাইরে যেতে চায়। বাইরে করোনা ভাইরাস ডাংগুলি খেলছে রাজপথে। ভ্যাম্পায়ারের মত ওঁত পেতে আছে। রক্ত খাবে। রক্ত আরো অনেকে খায়। অনেকের রক্ত গরম হয়ে যায়। ত্রাণ নেয়ার সময় অভাবী লোকেরা ঠিকমত ছবি না তুলতে পারলে তখন আরো মেজাজ খারাপ হয়। তখন তাদেরকে কষে চড় দিলে তারা ঠিকমত ক্যামেরার দিকে তাকাতে পারে। তারা আঙুলে গুনে হিসাব মিলাতে পারে না বেশি ভয়ঙ্কর ভাইরাস নাকি ভাইরাসের সময়ের ত্রাতারা। তারা নিচের দিকে তাকিয়ে ত্রাণের বস্তা হাতে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। বাড়ি গিয়ে তারা আবার আঙুলে গুণে হিসেব করে। না লাশের সংখ্যা না, লকডাউনের। হিসেব করতে করতে তারা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠলে সকাল। সকালের ঘাসে শিশির জমে। অনেক জায়গায় এখন ঘাস। সমুদ্রে ডলফিন। রাস্তায় বানর। না খেয়ে আছে অনেক কুকুর। কুকুরদের খাবার দিচ্ছে পাকিস্তানে। সে ছবি বাংলাদেশের পত্রিকায়। পত্রিকা হাতে মানুষ ঘরে বসে বসে ঝিমায়। ঝিমানি শেষে তারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে বাতাসে কাপড় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা আনার জন্য নিচে যাবে কি না সে সিদ্ধান্ত নিতে নিতে তাদের দেরী হয়ে যায়। তখন মনে হয় বাজারে যাওয়া দরকার ছিল। বাজারে অনেক মানুষ। মাস্ক পরা। সবাই আজকাল মাস্ক পরে। নামাজীদের ছবি তোলার সময় সাংবাদিকরাও মাস্ক পরে। দশজন নামাজীর বিপরীতে কুড়িজন সাংবাদিকের ছবি যে তুলেছে সে মাস্ক পরেছে কিনা জানা যায় না। মাস্ক না পরলে করোনা ফুটে না। তবে স্বজনের লাশ রাস্তায় ফেলে দিলে সেটাতে করোনা ফুটে। স্বজনকে রেখে পালিয়ে গেলে কিংবা নিজেই পালিয়ে গেলে তাতেও করোনা ফুটে। মা যখন একা ১৪০০ কিলো পাড়ি দিয়ে সন্তানকে নিয়ে আসে তাতেও করোনা ফুটে। অনেক কিছুতেই করোনা ফুটে। চাল চুরিতে। হাহাকারে। মেম্বরীতে, চেয়ারম্যানীতে। কিন্তু ভারতীয় আর্মির বুলেট যখন ৩ বছরের দীবা আর ২ বছরের আইমানের বাবা আইজাজ আহমদকে মেরে ফেলে তাতে মোটেও করোনা থাকে না। যা থাকে তা করোনার চেয়ে ভয়াবহ। সেই ভয়াবহতার ভীড়ে তোমাকে থই থই করা চাঁদের আলোর খবরটা দিতে ভুলে যাই।
2 thoughts on “করোনাময় চৈতী দিন”
মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।
মানুষ মানুষের জন্য। জয় হবেই মানবতার l
এই ই হচ্ছে করোনাময় চৈতী দিনে আমাদের যাপিত জীবন। অসাধারণ লিখা।