আজ সকালে হাসান সাহেবের সাথে চামেলির বেশ এক চোট ঝগড়া হয়ে গেলো। ঝগড়ার কারণ আর কিছু না উপলক্ষ হলো করোনা, দেশে ক্রমবর্ধমান সাধারণ ছুটি চলছে। হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো। প্রাইভেট স্কুল ,ছাত্র ছাত্রীদের বেতনে উপর শিক্ষকদের বেতন নির্ভর করে। যদিও বেতন খুব সামান্য। তবুও মাস গেলে যা পাওয়া যায় সেটাই বা কে দেয়। আজ প্রায় দু মাস হতে চলল বেতন কড়ি কিছুই দেয়নি স্কুল তবু ও এই দুমাস কোন রকম করে চামেলী সংসারটাকে টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু আজ সকালে সরাসরি জানালো এভাবে চললে তার পক্ষে আর সংসার চালানো সম্ভব না। পাঁচজনের সংসারে সে আর খাদ্যের জোগান দিতে পারবে না।
হাসান সাহেবের যে কয়টা টিউশনি ছিলো তাও এই করোনার দূর্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। কি করবেন কি বলবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। চিন্তায় চিন্তায় তার মাথা ধরে গেছে। সারা সকাল সে গোজ হয়ে বসে আছে। ছেলেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি করছে অন্য সময় হলে তিনি শাসন করতেন কিন্তু এখন কাউকে ই আর কিছু বলতে ভালো লাগছে না। যে যা পারে করুক। পৃথিবীটাকে মনে হচ্ছে নরক কুন্ড।
অরুন, বরুণ আর কিরণ। তিনজনই বেশ দুরন্ত। কাছাকাছি বয়সের বলে তাদের মারামারি আদর ভালোবাসা দুরন্তপনা সবই সমান্তরাল ভাবে চলে। অনেক সময় তো সামলানোই দায় হয়ে যায়। ছোট কিরণকে বেশ কিছু ক্ষণ ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতে দুপুরে পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। মনটা বিক্ষিপ্ত, জমানো যা টাকা ছিলো বড় ছেলের টনসিল অপারেশন করতে গিয়ে প্রায় সবটাই শেষ। কার কাছে হাত পাতবে আর কে ই বা দেবে টাকা এই দুঃসময়ে।
চামেলি এতোক্ষণ বাথরুমে ঘরের বিছানার চাদর কাচাকাচি করছিলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আগে ই সে কিরনের খোঁজ নিলো।
– অরুন বরুণ, কিরণ কই রে?
-জানি না মা বাইরে গেছে মনে হয়।
-তোরা মানা করিস নি।
-করলাম তো শুনলো না।
-আর তোদের হাতির মতো বাপটাই বা কি করছিলো? কোন একটা কাজ যদি লোকটাকে দিয়ে হয়।
হাসান সাহেব প্রতিবাদ করলেন,
-আমি আবার কি করলাম? তোমাকে কি আজ ঝগড়া রোগে পেয়েছে?
-কোন কাজাট তোমার দ্বারা হয় শুনি। ছেলেটা বাইরে বেরিয়ে গেলো তুমি আটকাবে না। এখন কি স্বাভাবিক সময়। এমনিতে করোনা ভাইরাসের ভয়ে সবাই অস্থির আর ওনার হুশ নাই। রোগ বাধায়ে আনলে গুষ্টি শুদ্ধ মরতে হবে এই বলে রাখলাম।
হাসান সাহেব অনেক কষ্টে একটা দীর্ঘ শ্বাস চাপলেন। একরকম তো ভালোই চলে যাচ্ছিলো দিন কাল। কি দিন এলো কে জানে। এর সমাধান ই বা কি। ঘরের পোশাকেই তিনি বাইরে চলে এলেন একটা চটি পায়ে গলিয়ে। গলির ভিতর হয়তো খেলছে ছেলেটা। এদিক ওদিক খোঁজা খুঁজি করলেন অনেকক্ষণ ধরে। কিরণের কোনই খোঁজ নেই। এই দুরন্ত ছেলেটাকে নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। এতো অশান্ত আজ বাড়ি এরে আচ্ছা করে বকবেন। খানিক এদিক ওদিক ঘুরে ভাবলেন এবার বাড়ি ফিরে যাবেন কিন্তু মোড়ের মাথায় ঘুরতেই তিনি কিরণকে দেখতে পেলেন। কিরণকে দেখে বুকের ভিতরটা হঠাৎ করে শান্তি শান্তি ভাব এলো। যাক ছেলেটা ফিরেছে। কিন্তু ওর হাতে প্যাকেট দেখে তিনি একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। প্যাকেটটা যে কিসের তা তিনি সহজে অনুমান করে ফেললেন। কিরণ ও বাবাকে দেখে এক ছুটে দৌড়ে এলো।
-বাবা এই দেখো মোড়ের মাথায় গাড়ি থেকে চাল দিচ্ছিলো আমি ও পেয়েছি।
হাসান সাহেব মনে মনে একটু খুশি হলেও সেটা তিনি মুখে প্রকাশ করলেন না। চকিতে অন্য ভাবনায় হঠাৎ করে চরম গ্লানিতে তার মুখটা কালো হয়ে গেলো। কিরন ছোট হলেও এই পরিবর্তন তার চোখ এড়ালো না।
কি হলে বাবা? আমি কি কিছু ভুল করেছি? তুমি খুশি হও নি?
-আমাদের এসব নিতে নেই বাবা। এগুলো দরিদ্রদের জন্য।
-আমরাও তো দরিদ্র। মা যে বলছিলো ঘরে আর এক ফোটা চাল নেই। ঘরে চাল না থাকাকে কি বড়লোক বলে। হাসান সাহেব কোন উত্তর দিলেন না। তারা দুজনেই জোরে হাঁটতে শুরু করলেন যাতে ব্যপারটা কারো চোখে না পড়ে। কিন্তু বিধি বাম। পথের মাঝে দেখা হয়ে গেলো সহকর্মী বিনোদ বাবুর সাথে । তিনিও হাসান সাহেবের সাথে একই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনিও আজ দুমাস বেতন পাননি? হাসান সাহেব হঠাৎ করে মাথা নিচু করে ফেললেন। কিন্তু বিনোদ বাবুও মনে হলো নিরুপায় তিনি দ্রুত এগিয়ে এসে বললেন,
হাসান ভাই চাল কোথায় দিচ্ছে? আমি গেলে কি পাবো?
হাসান সাহেব অসহায় চোখে তাকালেন। চোখে মুখে তার অসহায়ত্ব লজ্জা আর অপমানের জ্বালা। তিনি মাথা নিচু করে কোন রকমে বললেন,
-আমি কিছু জানি না, কিরণ যেনো কোথা থেকে আনলো।
কিরণ হঠাৎ বলল বাবা কাকুকে অর্ধেকটা দেবো। শ্রেয়ান ও মনে হয় আমাদের মতো না খেয়ে আছে তাই না কাকু?
হাসান সাহেব অস্ফুট স্বরে বললেন …
-দাও। দুর্যোগের সময় সবাই মিলে মিশে ভাগ করে খেতে হয়।
বিনোদবাবু চরম কৃতজ্ঞতায় কিরনের মাথায় হাত বুলিয়ে আর্শীবাদ করতে লাগলেন।
গল্পটি হৃদয় ছোঁয়া। প্রাপ্তি এবং ভালোবাসা বেটে নিলে তৃপ্তির রেখা কমেনা বরং বাড়ে। শুভ বাংলা নববর্ষ মি. ইসিয়াক। বিশ্বাস আর সমৃদ্ধির সূর্য একদিন উঠবেই ইনশাল্লাহ।