ইসিয়াক এর সকল পোস্ট

ইসিয়াক সম্পর্কে

আমি ইসিয়াক।

গল্পঃ নায়িকা সংবাদ

images

আমরা একে অপরকে যে ভালোবাসি একথা বলি নি কখনও আসলে তেমনভাবে বলার সুযোগ হয় নি আর কি। তবে আমি আর মিহির আমরা পরস্পর খুব ভালো বন্ধু ছিলাম এ ব্যপারে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।আমাদের সম্পর্কটা সেই ছোটবেলা থেকেই।

ওর সাথে, আমি আমার ছোট ছোট দুঃখ কষ্টগুলো খুব সহজে ভাগ করে নিতে পারতাম। গল্প করতে করতে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব কথা বলতে বলতে আমরা কপোতাক্ষকে সাক্ষী রেখে বহু দূর হেঁটে যেতাম। বহুদূর।

শেষ বিকেল গড়িয়ে যখন বকেরা ঝাঁক বেধে নীড়ে ফিরতো তখন আমরাও ফিরতি পথ ধরতাম। ও বরাবরই বেশ মনোযোগী শ্রোতা আর ভীষণ যত্নশীল ছিল আমার প্রতি। মিহিরের মা’ও ছিলেন খুব বেশি রকমের ভালো মনের মানুষ। আমার দুঃখ কষ্টগুলো তিনি খুব সহজে পড়তে পারতেন, আমাকে অনুভব করতেন অন্তর দিয়ে। তিনি আমাকে একনজর দেখে সবটা বুঝে নিতেন মুহুর্তেই, আমার হাসি আমার আনন্দ আমার কান্না। আমার অভুক্ত শুকনো মুখ দেখে কপট রাগ দেখিয়ে আমার উদর পুর্তির ব্যবস্থা করতেন। আমার কোন আপত্তি তখন ধোপে টিকতো না। তারপর কি জানি কি হলো খালাম্মা হঠাৎ করে অসুস্থ হলেন।

সামান্য উপসর্গ যে ক্যান্সারে রুপ নেবে তা কে ই বা জানতো? ক্যান্সার ধরা পড়ার অল্প কদিন পরে তেমন একটা চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই হুট করে তিনি চির বিদায় নিলেন। ঘটনা আকষ্মিকতায় মিহির কেমন যেন হকচকিয়ে গেল।এত চটপটে আর মেধাবী একটা ছেলের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখা দিলো। ওর এই অসহায়ত্ব ওকে আরও বেশি আমার কাছাকাছি নিয়ে এলো। দিন দিন আমার প্রতি ওর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকলো। আমিও ঋণ শোধ করার সুযোগ পেয়ে সাধ্য মত ওর পাশে থাকার চেষ্টা করলাম। এদিকে ওর বাবাও চাইতো আমি ওদের বাড়ি যাই। ওকে সংগ দেই স্বান্তনা দেই পাশে থাকি। এসব নিয়ে পাড়া প্রতিবেশি যখন আমার মাকে নানা রসালো কথা শোনাতে শুরু করলো তখন এক প্রকার বাধ্য হয়ে মা ওদের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ করে দিতে বললো।

কিন্তু আমি তবুও লুকিয়ে চুরিয়ে মিহিরদের বাসায় যাই ওদের খোঁজ খবর নেই। টুকটাক রান্না বান্না করে দিয়ে আসি সময় সুযোগ মত।
একদিন মিহির কি কাজে যেন শহরের বাইরে গেল তখন ওর বাবার ব্যবহারে ভীষণ আহত হলাম আমি। মানুষ এত জানোয়ার হয় কি করে? এই ব্যপারটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি বাঁধা দিয়ে ছিলাম সর্বশক্তি দিয়ে কিন্তু অসুরের কাছে আমি পরাস্ত হলাম। আসলে আত্মরক্ষার কৌশল আমার জানা ছিল না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আধাঘন্টা ধরে পাশবিক যন্ত্রণা সইলাম।

মানুষকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে কিছু মানুষ নোংরা সুখ পায়। আসলে এ ধরনের মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু থাকে না।

আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে
যখন আমার বাবা মারা গেল খুব ছোট তখন। আমি অত কিছু না বুঝলেও ক’দিনের মধ্যে এটুকু বুঝলাম আমাদের অবস্থান টলে গেছে বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে। আমার নানুরা আমার মাকে আবার বিয়ে দিলো কয়েক মাসের মাথায়। পরিবারটি যৌথ পরিবার ছিল।

বছর পাঁচেক পরের কথা এক ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমি আমার কৌমার্য হারালাম আমারই সৎ বাবার ছোট ভায়ের কাছে। এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এলেই সে সুযোগ নিতো, আমি ভয়ে লজ্জায় ঘৃণায় কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। তাছাড়া আমি তখন নিজের সম্মান দুটো ভাত আর সামাজিক নিরাপত্তার খাতিরে সব যন্ত্রণা সহ্য করতাম। অনেক পরে জানতে পারি….. থাক সে কথা আর না বলি। অবশেষে শয়তানটার রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর আমি ওর হাত থেকে বাঁচলাম।

মাকে একদিন বলতে শুনেছি হারামজাদা মরছে ভালো হইছে। কিন্তু আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল আমার জীবনে। অসহায় মেয়েদের কত কত বার যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।

সেদিনের পর আমি আর মিহিরদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। নিজেকে কুৎসিত জীব মনে হতে লাগলো। মনে হলো নিজের রূপ নিজেই পুড়িয়ে ছারখার করে দেই কিন্তু মিহির কষ্ট পাবে এই কথা ভেবে আমি পিছিয়ে এলাম। মা মনে হয় কিছু আঁচ করেছিলো সে হঠাৎ গলায় ফাঁস দিলো। মা কি আমার জন্য গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে কিন্তু পরে বুঝলাম ঘটনা অন্য ছিল। আমার বাবার মৃত সৎ ভাইয়ের মোবাইলে আমার নানারকম ভিডিও চিত্র তার মৃত্যুর কারণ। লোকে তখন আমায় বলতে লাগলো হারামজাদি তোর মরণ হয় না কেন? মরতে পারিস না। মৃত্যু না এলে আমি কি করে মরবো? আমি আত্মহত্যা করার মত মেয়ে নই। এদিকে আমার সৎ বাবা আমার মৃত মায়ের চল্লিশার আগেই নতুন একটি কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললো।

(২)
তমালদা আমায় খুব ভালোবাসার কথা বলতো, সুযোগ পেলেই ঘ্যান ঘ্যান। আমি সংগত কারণেই তাকে পাত্তা দিতাম না। এদিকে মিহির বাড়ি না যাওয়াতে মিহির আমার খোঁজে বাড়ি আসতে লাগলো। আমি ওকে লোক মারফত নানা বাহানায় ফিরিয়ে দিতে লাগলাম কিন্তু কত দিন? আমি আসলে মিহিরকে এই পাপ মুখ দেখাতে চাইছিলাম না। তাছাড়া আমার মা ছাড়া আমি এ বাড়িতে অবাঞ্ছিত। আমি আর পারছিলাম না। “মেয়ে মানুষের রূপ তার, সব চেয়ে বড় শত্রু” মা বলতো।

আমি এক ঝড় জলের রাতে তমালদার সাথে পালিয়ে গেলাম। তমালদা আমাকে কিছু দিন বিয়ের নামে ভোগদখল করে বর্ডার পার করে দিলো। যখন আমার জ্ঞান হলো আমি বুঝলাম আমার আর এ জনমে মুক্তি নেই আটকে গেছি বিশাল ফাঁদে কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ছিল বুঝি অন্য। এরপর….

(৩)
নতুন ছবির প্রচারে জেলা শহরে এসেছি ছবিটির নায়ক, পরিচালক আর আমি। ইদানীং আমার ভীষণ জনপ্রিয়তা। গত কয়েকবছর টপ নায়িকার ইঁদুর দৌড়ে আমিই সেরা। এ জীবনে যত অবহেলা পেয়েছি তা যেন সব পুষিয়ে নেবার সময় এখন। এত ভালোবাসা কোথায় ছিল মানুষের? আসল নাকি সত্যি সে বিবেচনায়, না আনি। নগদ গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের পরিচয়। মাঝে মাঝে ভাবি আর হাসি।
গাড়ি তে চড়ার মুহুর্তে ছোটখাটো ভীড় ঠেলে সানগ্লাস পরা এক মধ্যবয়সী যুবক এলো তার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি নাকি আমার ভীষণ ভক্ত। অটোগ্রাফ নিতে চায়।
আমি মেয়েটিকে বললাম
– কি নাম তোমার?
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল
– অঞ্জলি। আগে অবশ্য অন্য নাম ছিল।কিন্তু বাবা বদলে দিয়ে তোমার নামে নাম রেখেছে। তুমি কিন্তু বাবার ফেভারিট।
– বাহ!

আমি বাড়িয়ে ধরা খাতাটিতে অটোগ্রাফ দিলাম। দ্রুত ভীড় বাড়ছে খাতা ফেরত দিতে গিয়ে মধ্যবয়সী যুবকটির হাতে হাত স্পর্শ হতে বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে। এত চেনা স্পর্শ! আমি সানগ্লাস পরা যুবকটির চোখে চোখ রাখতেই অবাক হলাম আরে এতো. …..আমি মিহিরকে চিনতে পারলাম মুহুর্তেই। এ ক’বছরে অনেক বদলে গেছে সে মোটাসোটা থলথলে ভুড়িতে তাকে চিনতে যে কারও কষ্ট হবে। আচ্ছা মিহির কি আমাকে চিনে?
ভীড় বাড়ছে ক্রমশ। আমার সেক্রেটারী নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে ঠেলে গাড়িতে তুলে দিলো।

ভীড়ের চাপে মিহির দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। বুকে আমার অন্য রকম ব্যথা। আমি ডাকতে চাইলাম কিন্তু লোক সমাগমে বাড়তেই জনঅরণ্যে আমি আরেকবার মিহিরকে হারিয়ে ফেললাম। মিহিরকে বলা হলো না শুধু তার কাছাকাছি আসার জন্য আমার এই সংগ্রাম। শত কলঙ্ক মান অপমান সয়ে আমার এই ফিরে আসা। মিহির আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।

– ম্যাডাম। ইউনিভার্স মাল্টিমিডিয়া থেকে কল করেছে। আগামীকাল ওরা ছবির চুক্তিটা করে নিতে চায়। সামনের মাসের প্রথম দিকে মহরত।
– সুজানা তুমি ওদের বলে দাও আমি আপাতত আর কোন ছবি করতে চাই না।
– কেন ম্যাম! এই ছবিটা আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হবে আমি শিওর। বড় প্রডাকশন, গল্প ভালো,টানটান চিত্রনাট্য। ব্যানারটাও তো ভালো।
– আমি আসলে একটু একা থাকতে চাই। তুমি একটা ভালো দেখে রিসোর্টের খোঁজ নাও। যেখানে কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না এমন জায়গা। এত লোকের ভীড় আমার আর ভালো লাগছে না।

“কত যে কথা ছিল
কত যে ছিল গান
কত যে বেদনার না বলা অভিমান।
তোমায় ভেবে ভেবে আকাশ হলো সারা।…….”
লতা মঙ্গেশকরের এই গানটি সম্ভবত আমার কথা ভেবে লেখা। আজকাল আর কাঁদতে পারি না। কান্না সব শুকিয়ে গেছে কবে যেন। মাঝে মাঝে বিধাতাকে বলতে ইচ্ছে হয়। প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে হয় –
– কি ক্ষতি হতো আমাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দিলে? আমি তো এজীবন চাই নি। আমি চেয়েছি মিহির হাতে হাত রেখে লক্ষ কোটি দিন কাটাতে। মিহির ভালোবাসায় হারাতে। আর কিছু নয় ব্যস এটুকুই। এই চাওয়া কি খুব বেশি ছিল?

© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক।

বড় গল্পঃ বন্ধ দুয়ারের ওপাশে

2691

(১)
তাদের সে সময়টা ছিল আবেগ আর ভালোবাসায় ভরা। মিলা আর জাহিদ তারা দুজনেই একে অন্যের প্রতি ছিল দারুণ অনুরক্ত। একে অন্যকে এক মুহুর্ত না দেখে, কথা না বলে থাকতে পারতো না কিছুতেই। নব যৌবনকালের উতলা সে সময়। সর্বদাই একে অন্যের প্রতি চুম্বকের আকর্ষণ যেন অনুভবে। বুক আনচান অকারণ অস্থিরতা, কোন কাজে মন না বসা সহ ভিত্তিহীন নানা কাল্পনিক উদ্বেগের হাস্যকর ছটফটানি। তারপর দেখা হবার মুহুর্তে যেন পরম প্রাপ্তি পরম তৃপ্তি। এমন উথাল পাথাল প্রেম অথচ আশপাশের কেউ জানবে না বা কারো চোখে পড়বে না তা কি কখনও হয় না হয়েছে!!

জাহিদ ও মিলার প্রেমের কথা চারদিকে রাষ্ট্র হতে দেরি হয়নি। যেদিন প্রথম মিলার বাসায় নালিশ গেল সেদিন থেকে তার বাসায় শুরু হলো নানা অশান্তি। কৈফিয়তের পর কৈফিয়ত। মিলার চলাচল, জীবনযাপন, পড়াশোনায় নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো স্বাভাবিকভাবেই। এমনকি বিয়ের জন্য পাত্র দেখাদেখিও চলতে লাগলো। এর মুল কারণ তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট ও তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থান। অন্যদিকে মিলার পরিবারের দিক থেকে এতোটা কঠোর হবার কারণ মিলা ছিল নামকরা তথাকথিত উচ্চ বংশের অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে আর জাহিদ ছিল ভারত ফেরত শরনার্থী পরিবার। তাদের না ছিল চাল না ছিল চুলো। তার বাবা কাজ করতো একটা প্রাইভেট ব্যাংকে। থাকতো দুই কামরার ভাড়া বাড়িতে। সংসারে অশান্তি টানাটানি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে হ্যাঁ সাংসারিক নানা অভাব অনটন স্বত্ত্বেও লেখাপড়ায় ভালো হওয়াতে বাড়ি থেকে পড়াশোনার সাপোর্ট জাহিদ পেয়েছে বরাবরই আর সেই সাথে টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালাবার যোগ্যতা তার ছিল। স্বাভাবিকভাবে নানা কারণে তাকে নিয়ে অনেক আশা ছিল তার বাবা মায়ের। আর সে কারণে ছেলের প্রেম সংক্রান্ত গুঞ্জনে তারা বিরক্ত হলো যদি দুই পরিবারের অমতের কারণ ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। কিন্তু এক জায়গায় তারা একমত ছিল এ সম্পর্ক কখনও পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।

কিন্তু দুরন্ত কিশোর কিশোরী দুজন কোন বাঁধাই বাঁধা মনে করলো না। তারা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো সব প্রতিকুলতাকে তারা দুর করে তারা মিলিত হবে। এবং নব প্রত্যয়ে তারা এক নিশুতি রাতে বাড়ি ছাড়লো। তখন জাহিদ সবে অনার্স শেষ করেছে আর নিলা ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী স্থানীয় কলেজের। তারপরের জীবন কঠিন সংগ্রামের। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে জাহিদের পরিবার বিয়েটা মেনে নিলেও বলা যায় ছেলের জিদের কাছে পরাজিত হয়ে এই বিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হলেও মিলার পরিবার। মিথ্যা অহংবোধের বশবর্তী হয়ে মিলাকে মেনে নিলেও জাহিদকে তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। এ নিয়ে জাহিদের পরিবারের লোকজন স্বভাবতই মিলার প্রতি অসন্তুষ্ট রইলো যদিও মিলার এক্ষেত্রে কোন হাতই ছিল না। জাহিদ ততদিনে অনেক ভালো চাকরি পেয়ে গেছে এবং প্রতি বছর তার উত্তরোত্তর উন্নতিও ঈর্ষণীয়।

সব মিলিয়ে জাহিদ আর মিলা ভালো আছে। তারা চুটিয়ে ঘরসংসার সামলাচ্ছে। জাহিদের বাবা গত হওয়ার পর থেকে তার মায়ের মধ্যে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এলো একাকিত্ব আর বংশ রক্ষার তাগিদে সখিনা বেগম মাঝে মাঝে ফুট কাটলে লাগলো ছেলের কাছে ঘরে কোন সন্তান আজ অবধি হলো না বলে। তলে তলে তিনি ছেলেকে আর একটা বিয়ে করার জন্য প্রায় প্ররোচিত করতে লাগলেন। মিলার দৃষ্টিতে সবই পড়ে তবে মায়ের কথায় জাহিদ কোন পাত্তা দেয় না বলে সে আর এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। সত্যি বলতে কি তার স্বভাবে ঝগড়া ফ্যাসাদ রাগ বিরাগ তেমন একটা নেই। নিতান্ত ভালো মেয়ে বা বউ এর আর্দশ উদাহরণ বলা চলে তাকে।

(২)
এভাবে কেটে গেল সাত সাতটি বছর। দীর্ঘ সময়। আজ মিলার সারাটা দিন মহা ব্যস্ততা কাটলো তবে এই সব ব্যস্ততাকে তার একটুও ব্যস্ততা মনে হয়নি পুরো সময় যে কোথা থেকে কেটে গেছে সে টেরই পায়নি। জাহিদের পছন্দের সব রকমের খাবার নিজ হাতে যত্ন করে রান্না করেছে আজ। বেশি করে কিসমিস আর কাজুবাদাম দিয়ে প্লেন পোলাউ, মাংসের টিকিয়া, খাসির কষা মাংস, ইলিশ পাতুরি, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, মুগডাল আর কাতলা মাছ দিয়ে রান্না করেছে স্পেশাল মুড়ি ঘন্ট। সাথে একটু ঘন দুধের পায়েসও রেঁধেছে বেশি করে কিসমিস দিয়ে, এক হাতে সব করতে হয়েছে তাকে শ্বাশুড়ী গেছে ছোট মেয়ের বাড়ি,কাজের সাহায্যকারি মেয়েটিও আজ আসেনি। সব শেষে কেক বানাতে বানাতে বিকালটা পার হয়ে গেল কিভাবে কিভাবে। সন্ধ্যার আগে সেই কেক ওভেন থেকে বের করে চমৎকার ডেকোরেশন করলো মনোযোগ দিয়ে। কেকের পাশে সাজিয়ে রাখলো সাতটা মোমবাতি। আজ তাদের সপ্তম বিবাহ বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে জাহিদ এলে কেক কাটা হবে। কোনবারই জাহিদ বিবাহ বার্ষিক বা মিলার জন্ম দিনের কথা ভোলে না, এসব ব্যপারে বেশ কেয়ারিং সে। কিন্তু কেন কারণে এবার তার মনে নেই। সারাজীবন তো একরকম যায় না বয়স বাড়ছে তাই হয়তো আবেগও কমে আসছে মিলা ভাবলো। এতো আয়োজনের অবশ্য আরও একটা কারণ আছে…

এত বছরের বিবাহিত জীবনে টুকটাক খুনসুটি ছাড়া তাদের মধ্যে বড় ধরনের কোন ঝগড়া পর্যন্ত হয়নি। শুনলে অনেকেই অবাক হশ। শুধু একটাই আফসোস রয়ে গেছে এতদিনেও একটা সন্তান হলো না। রাত বেড়ে যাচ্ছে। মিলা ফ্রেশ হয়ে নিজেকে চমৎকার সাজে সাজিয়ে নিল। সে নিজেও চাইছে জাহিদ আজ একটু দেরিতে ফিরুক এই ফাঁকে সে একটু সাজগোছ করবে। বরাবরই সে সাজতে ও সাজাতে পছন্দ করে। আচ্ছা জাহিদের বাসায় ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন হঠাৎ মনে হলো তার। অফিসে কি আজ অনেক বেশি কাজ পড়েছে একবারও তো খোঁজ নিল না। এমনটাতো কোনদিন হয় না। কি আশ্চর্য কাজের ভীড়ে এতক্ষণ মাথায় আসেনি অন্য কথা ! বিপদ হয়নি তো কোন? জাহিদও একবার ফোন দেয়নি। সেও কাজের চাপে ফোন দিতে ভুলে গেছে। কি করে এমন ভুল হলো নিজের উপরই রাগ হলো মিলার। তারপর আয়নায় চোখ যেতে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হলো সে।

আচ্ছা জাহিদ কি তাকে দেখে চমকে যাবে যা বেহায়া পাগলামি নিশ্চয় করবে কিছু। মিলা লজ্জা পেল। বেশি রোমান্টিকতা হয়ে যাচ্ছে না হয় হোক সে তো আর বুড়ো হয়ে যায়নি। তারপরও জাহিদের খোঁজ নেই। না আর দেরি করা ঠিক হবে না। মোবাইলে দ্রুত কল দিল সে,তবে লাভ হলো না। সুইচ অফ বলছে। ঠিক সেই মুহুর্তে কলিং বেল বেজে উঠলে শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল তার। মিলা এক ছুটে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই অচেনা একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো সে, কে এই মেয়ে বিরক্ত নিয়ে প্রশ্ন করলো সে
– কাকে চাই
মেয়েটি কোন উত্তর দিল না একটু হাসবার চেষ্টা করলো।
সিড়িতে আবার একটা পদশব্দ…
মেয়েটির পেছন থেকে জাহিদ বেরিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল,
-অনিকা সম্পর্কে উনি তোমার বড় আপা হয়।উনাকে সালাম কর।
তারপর মিলির উদ্দেশ্যে বলল,
– মিলি, ও অনিকা। আজ থেকে আমাদের সাথে ও এই বাড়িতেই থাকবে! আমাদের বাড়ির নতুন সদস্য ও।
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো মিলা। জাহিদ বিয়ে করেছে !!! মেয়েটি জাহিদের বিয়ে করা বউ!!

জাহিদের কথা গুলো যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে, জাহিদ যেন আর তার সামনে নেই। মিলা যেন আস্তে আস্তে হঠাৎ কোন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। তার মাথা ঘুরছে, দুলছে পৃথিবী। অনেক আগেই কানাঘুষা শুনেছে সে। জাহিদ কোন একটা মেয়ের সাথে সময় কাটায় নানা হোটেল রেস্তোরাঁয়। বিশ্বাস করেনি সে, পাত্তাই দেয়নি কোন জাহিদের কাছে শোনা তো দুরের কথা। অন্ধ বিশ্বাসের এই পরিণতি হবে সে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি সে। নিঃসন্তান জীবনের একমাত্র সহায় জাহিদ অথচ.. বিশ্বাসের মূল্য এই্। অথচ সব চাওয়া পাওয়ার পূর্ণতার দ্বার প্রান্তে তাদের সম্পর্ক। কিন্তু আজ এ কেন সমীকরণে এসে দাঁড়ালো। এমন দিন তাকে দেখতে হবে সে কখনও ভাবতে পারেনি। সব বিশ্বাস ভেঙে গেছে তার। অনিকা নামের এই বাচ্চা মেয়েটি তার সতীন তবে কি শুধুমাত্র একটা সন্তান লাভের আকাঙ্খাই এত দিনের সম্পর্ককে ভেঙে গুড়িয়ে দিল এক নিমেষেই …
অথচ..।

(৩)
বহু বছর বাদে মিলার এই ফিরে আসাকে মিলার বাসার লোকজন কেউই সহজভাবে নিলো না। আসলে তাদের জীবনে মিলার আর কোন গুরুত্ব নেই। চরম অহংকারী পরিবারটির কাছে আজ মিলা মৃত। কেউ তার সাথে কথা বলে না, খেতে ডাকে না কোন প্রয়োজনীয় কথাও বলে না। যে বাবা তাকে এত ভালোবাসতো সেই বাবা একদিন কয়েকটা প্রশ্ন করার পর জানতে চাইলো সে ওই বাড়িতে কবে ফিরে যাচ্ছে।

মিলার মা মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে এবং তার বাবা আবার বিয়ে করেছে। স্বাভাবিকভাবে পরিবারের কোন কিছু মিলার অনুকূলে আর নেই। খুব তাড়াতাড়ি মিলা তার বাবার বাড়ির সাথে তার সম্পর্কের ফাটলটা স্পষ্টত বুঝতে পারলো। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে বাস করা যে অতি কষ্টকর। আবারও মিলা বাড়ি ছাড়া হলো। তবে এবার একা!
একদিন সকালে সবাই খেয়াল করলো মিলা বাসা ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। গুরুত্বহীন মানুষের বিদেয় হলে স্বার্থপরতার সংসারে সবাই দম ফেলে বাঁচে। মিলার ব্যপারে কোন খোঁজ নেবার প্রয়োজন টুকু বোধ করলো না কেউ।
অবহেলা অনাদর কখনও কখনও বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। মনে অনেক অনেক ব্যথা নিয়ে মিলা হারিয়ে গেল জন অরণ্যে।

(৪)
কোম্পানির মালিক রহমান সাহেবের অফিস কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে রেজওয়ান। ডাক পেয়ে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে সে এখানে এসেছে। কাজ পাগল রহমান সাহেব নিজের কাজ নিয়ে অতি ব্যস্ত রেজওয়ানের দিকে তার কোন খেয়াল নেই। ঢোকার মুখে শুধু একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন মাত্র। ব্যস ওইটুকুই। রেজওয়ান বুঝতে পারছে না তাকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। চেয়ার টেনে বসার সাহস তার নেই কারণ সে সামান্য কর্মচারী। পা ব্যথা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে চেয়ার টেনে বসলে কি খুব অন্যায় হয়ে যাবে হঠাৎ নিজের ল্যাপটপটা শাট ডাউন করে রহমান সাহেব রেজওয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন।
– কি আশ্চর্য এখনও দাড়িয়ে আছো কেন বসো! বসো!! আমার সাথে তোমার মনে হয় এই প্রথম সাক্ষাৎ আসলে আমি গত দু মাস বাইরে ছিলাম, নিজের ব্যক্তিগত কিছু কাজে। তারপর ফিরে অফিসের পেন্ডিং কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তোমার সাথে সাক্ষাৎ করার সময় হয়নি। তবে তোমার কাজের বেশ প্রশংসা শুনেছি। তো বলো নতুন চাকরি নতুন পরিবেশ কেমন লাগছে রেজওয়ান
– জ্বি স্যার ভালো লাগছে।
– কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো!
– জ্বি না স্যার।
– কোন কাজ না বুঝতে পারলে অয়নের কাছ থেকে বুঝে নেবে। ওকে তোমার কথা বলা আছে।
– জ্বি স্যার, আচ্ছা।
– ও হ্যাঁ বসো বসো, এখনও দাঁড়িয়ে কেন
রেজওয়ান চেয়ার টেনে বসলো।
– দুপুরের খাওয়া কি হয়ে গেছে
– জ্বি স্যার খেয়েছি।
– কি দিয়ে খেলে, মাইন্ড করো না আবার, আমার খাওয়া দাওয়ায় গল্প করতে বেশ ভালো লাগে। হে হে হে…

মনে হচ্ছে রহমান সাহেব বেশ দিল খোলা মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন শুনে রেজওয়ানের একটু অস্বস্তি লাগলো। সে যা খেয়েছে সেটা বলার মত কিছু নয়, মিথ্যা বলতে ইচ্ছে করছে না। অকারণ মিথ্যা বলা তার পছন্দও নয়। রহমান সাহেব রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে কি একটু ভাবলেন। তিনি লোক চরিয়ে খান ছেলেটাকে আপাতদৃষ্টিতে অন্য রকম মনে হচ্ছে। ভীষণ রকম চুপচাপ,শান্ত প্রকৃতির বোঝা যাচ্ছে। তাছাড়া তিনি খোঁজ খবর নিয়ে শুনেছেন কাজ ছাড়া বাড়তি কথা খুব একটা বলে না রেজওয়ান। এই বয়সের ছেলেরা স্বভাবে উচ্ছল চঞ্চল হয়। এই ছেলেটা বেশ ব্যতিক্রম। এর ভালো মন্দ দুটো দিক হতে পারে। সময়ই বলে দেবে।
– কথা বলছো না কেন রেজওয়ান, আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে। বললেন রহমান সাহেব।
-রুটি আর আলু ভর্তা।
রেজওয়ানের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন রহমান সাহেব, বুকের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো। ছেলেটির আর্থিক অবস্থা মনে হয় ভালো নয়। আহারে! না হলে দুপুরবেলা কেউ রুটি আলুভর্তা খায়!
– স্যার আমি কি এখন যেতে পারি
– তুমি কোথায় থাকো
– শ্যামলীতে।
– বাসায় তোমার কে কে আছেন
– আমি একা থাকি স্যার। এ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।
অদ্ভুত তো! কেমন যেন মায়া হলো তাঁর।
তিনি নিজেও এখনও দুপুরের খাওয়া খান নি। রেজওয়ানকে কি তিনি খেতে বলবেন বাসা থেকে খাবার পাঠিয়েছে। ভাত সাথে আট নয় পদের তরকারি। রহমান সাহেব ইতস্তত বোধ করলেন। ছেলেটি যদি বিব্রত হয়। কাউকে বিব্রত করার কোন অধিকার তার নেই অবশ্য। সে যেমনই অর্থনৈতিক অবস্থার অধিকারী হোক না কেন।
রহমান সাহেব বললেন
-আচ্ছা তুমি এখন যাও। পরে প্রয়োজনে তোমাকে ডেকে নেব।
রেজওয়ান নিঃশব্দে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।


ঘর খুলে বিথি দক্ষতার সাথে খুব দ্রুত হাতে ঘর গোছগাছ করলো। গোছগাছ করতে করতে মনে মনে ভাবলো এত অগোছালো কি করে হয় মানুষ! সাথে করে বেশ কিছু বাজার সদাইও এনেছে সে। ঘর গোছগাছের পরে প্রথমে মুরগী কেটে, কাটা মসলা দিয়ে রান্না বসালো সে। মুরগীর কষা ঝাল মাংস রান্না হবে এখন। এদিকে রেজওয়ান অফিস থেকে এখনও ফেরেনি। তাতে অবশ্য বীথীর ঘরে ঢুকতে কোন সমস্যা হয়নি। তার কাছে এই এক কামরার ডুবলিকেট চাবি সবসময়ই থাকে। রেজওয়ানের ফিরতে আজ দেরি হচ্ছে কেন কে জানে আজ দেরি হলে অবশ্য সমস্যা নেই বিথি বরং চাইছে রেজওয়ান দেরি করেই ফিরুক। এই ফাঁকে সে রান্না শেষ করবে। সে আজকের আইটেম মাংস, বেগুনভাজি চিংড়ি মাছের দোপেয়াজা, প্লেন পোলাও আর টক মিষ্টি দই।

অন্যের বাসায় এসে রান্না করার ব্যপক ঝামেলা। কোন জিনিস ঠিক মত পাওয়া যায় না। আর রেজওয়ান তো চুড়ান্ত অগোছালো। কোন জিনিস হাতের নাগালে নেই। এই রান্নার উদ্দেশ্য কি উদ্দেশ্য তো অবশ্যই আছে। আজ বিথি চাকরি জীবনে প্রথম বেতন পেয়েছে। বিথি যে চাকরি করছে সেটা সে রেজওয়ানকে জানানো হয়নি এ কদিনে। আজ জানাবে। ঘটা করেই জানাবে। সে জন্যই এই আয়োজন।
প্রথমে খাওয়া দাওয়া হবে তারপর রেজওয়ানের হাতে একটা মিষ্টি পান ধরিয়ে খুশির খবরটা দেবে বিথী। তারপর যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের আয়োজন নিয়ে আলোচনা হবে। দীর্ঘ প্রেমের সফল সমাপ্তি হবে। আহ! ভাবতেই শরীরের মধ্যে রোমাঞ্চ হচ্ছে।
তারপর আগামীকালের কেনাকাটা আর নতুন বাসা খোঁজাখুঁজির ব্যাপারে আলোচনা করবে। মদপ্য বাবার হাত থেকে মুক্তির আনন্দে বিথীর মন আজ ভীষণ চঞ্চল। মনের মধ্যে জমা কষ্টের মেঘগুলো কেটে যাচ্ছে। আহ! মুক্তি!!!
রেজওয়ান আর সে। তাদের দুজনের আয়ে ভালোভাবে সংসার চলে যাবে। সুখেই কাটবে দিন।

সমস্ত কাজ গুছিয়ে বিথি গোসল সেরে নিলো। গোসল করার আগে সে একটু দ্বিধা করছিল। এর আগে সে কোনদিন রেজওয়ানের বাসায় গোসল করেনি। বাড়িতে অশান্তি বলে রেজওয়ান তাকে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে রেখেছে। তার অবর্তমানে যেন সময় সুযোগ মত বিথি এসে এখানে বিশ্রাম নেয় তবে গোসল টোসল সে বরাবরই এড়িয়ে গেছে অন্য কোন কারণে। রাত বাড়ে বিথি অপেক্ষা করে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।রেজওয়ান ফেরে না। ফোনও ধরে না। বিথি এক বুক অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করে করে শেষ রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু কোথায় গেল রেজওয়ান!!

৫)
হঠাৎ কাকের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙলো বীথির। রাত এখনও পোহায়নি। রেজওয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেই জানে না। ঘুম ভেঙে প্রথমে সে মনেই করতে পারলো না ঠিক কোথায় আছে। তারপর আস্তে আস্তে সব মনে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। সে তো রেজওয়ানের বাসায় কিন্তু রেজওয়ান তো এখনও ফেরেনি। কোন বিপদ হয়নি তো গতরাতে অজস্রবার ফোন দিয়েও ফোন বন্ধ বলে কল ঢোকেনি। রেজওয়ানের ফোনের চার্জ ফুরিয়ে যেতে পারে এটাই ভেবেছে সে কিন্তু… । জসীমের ফোনে ফোন দিয়ে জানলো জসীম এখন গ্রামের বাড়িতে, তার মায়ের শরীর খারাপ। গত দুদিন রেজওয়ানের সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। জসীম রেজওয়ানের একমাত্র বন্ধু, জানতে চাইলো অনেক কিছু কিন্তু পরে কথা বলবে বলে এড়িয়ে গেল বিথী। তার ভীষণ খারাপ লাগছে, কেন জানি কান্না পাচ্ছে। অফিসে বা অফিসের কারো কাছে ফোন দিলে কেমন হয়। তবে এত সকালে খোঁজ নেওয়া যাবে না অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু অফিসের কারও ফোন নাম্বারও তো বিথীর কাছে নেই। রেজওয়ান বরাবরই ফোনের সংক্রান্ত ব্যাপারে বেশ উদাসীন। তার উপর ইদানীং ওর ফোনে ব্যাটারীটা ঝামেলা করছে। চার্জ দিলেও চার্জ দাঁড়াচ্ছে না। সেই কারণে হয়তো যোগাযোগ…. তাই বলে রাত ভোর হয়ে যাবে তবু বাসায় ফিরবে না। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিতে দিতে আযানের ধ্বনি কানে ভেসে এলো বিথীর। হাত মুখ মুছে মোবাইল চেক করে দেখলো বীথির বাবা ওসমান আলী ফোন দিয়েছে বেশ কয়েকবার। বিয়াল্লিশটা মিস কল। বীথি তাচ্ছিল্যের সাথে ঠোঁট উল্টালো, কল ব্যাক করার কোন ইচ্ছে আপাতত নেই তার। মদপ্য জুয়াড়ি বাপের প্রতি সে কোন টান অনুভব করে না। শুধুমাত্র জন্মদাতা পিতা বলে তার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করতে পারে না।

কল লিস্টে অন্য একটা আননোন নাম্বার থেকে পনেরটা মিসকল এসেছে ! বিথীর ভ্রু কুঁচকে এলো..
রেজওয়ান কি কিন্তু… কল ব্যাক করার আগে।
মেসেজ চেক করে দেখলো। নতুন মেসেজ এসেছে সেই আননোন নাম্বার থেকেই।
বীথি তুমি যত দ্রুত সম্ভব ইবনেসিনা হাসপাতালে চলে আসো।
~রেজওয়ান
মেসেজটা কিছুক্ষণ আগে সেন্ড করা হয়েছে। এর মানে কি…. হঠাৎ রেজওয়ান অসুস্থ হবে কেন। সারা রাত ও কোথায় ছিল হাজারটা প্রশ্ন। এটা কোন ফাঁদ নয় তো। কত কিছু তো আজকাল ঘটে এ শহরে………

৬)
রহমান সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, খুব খারাপ। তাঁর সামনে যে পড়ছে তার সাথেই তিনি খারাপ ব্যবহার করছেন। এই ধরনের আচরণ তার স্বভাবের সাথে যায় না। সবাই তাকে সদালাপী আর মিষ্টভাষী বলেই জানে আর তাই সকলেই কম বেশি যথেষ্ট বিস্মিত। অবশেষে কারণ জানা গেল, কারণ সামান্যই তবু তিনি এতটা অস্থির হয়ে আছেন। কি এমন কাহিনী সেটাই কেউ বুঝতে পারছে না।
রেজওয়ান হঠাৎই অনুপস্থিত তার হদিস ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ নিরুদ্দেশ বা লাপাত্তা যাকে বলে ঠিক তাই। এখনকার সময়ে জলজ্যান্ত মানুষ হুট করে উধাও হয়ে যাবে এটা কিভাবে সম্ভব। কোন না কোন ট্রেস তো থাকবে অথচ কোন রকমেই কোন ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। কি অদ্ভুত! কেন সে নিরুদ্দেশ কেন সে অফিসে আসছে না কেউ কিছুই বলতে পারছে না। রেজওয়ানের ফোন বন্ধ। বাসার ঠিকানাও কেউ জানে না। এটা কিভাবে সম্ভব।
অদ্ভুত!
অফিসে যে ঠিকানা দেয়া সেই ঠিকানায় গিয়ে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে নাকি বাসা বদলেছে কদিন আগে। তার মানে লোকটি সত্যি সত্যি নাই হয়ে গেছে। কিন্তু রহমান সাহেব সে-সব কিছু মানতেই চাইলেন না তার যে কোন মূল্যে রেজওয়ানকে চায়।
সময় গড়িয়ে আজ বারো দিন হলো সে অফিসে আসেনি। এই দুই মাসে এত ভালো,সহজ সরল একটা ছেলের সাথে কারোই ভালো সম্পর্ক হয়নি কি আশ্চর্য!
পনেরোতম দিনে রহমান সাহেব রেজওয়ানের বায়োডাটা আনতে বললেন অয়নকে। এবার তিনি স্থানীয় ঠিকানায় খোঁজ খবর নিবেন। যথা সময়ে স্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছে খোঁজ খবর নিয়েও স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। কে এই রেজওয়ান
————————
বিথী বসে আছে রহমান সাহেবের সামনে। এই কদিনে তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। তার চোখের নিচে কালি। সজল চোখ। চুলগুলোও সে ঠিক মত বাঁধেনি। পোষাকটাও মলিন। পুরো চোখে মুখে অসম্ভব এক কষ্টের ছাপ।
– তোমার নাম
– বিথী। কামরুন্নাহার বিথী।
– বলো কি বলতে চাও
– আসলে আমি এসেছি একটা খবর জানাতে।
– খবর কি খবর
– আপনার এখানে কাজ করতো। রেজওয়ান নাম ছিল।
– হু বল.. বল তারপর হ্যাঁ হ্যাঁ রেজওয়ান কোথায় ও কোথায় আছে এখন
– গত সপ্তাহে সন্ধ্যার সময় ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়। মারাত্মক এক্সিডেন্ট
– এক্সিডেন্ট!
– হ্যাঁ
-তারপর…..
– যমে মানুষে লড়াই চলল টানা বারো দিন। অবস্থা ক্রমশ খারাপ হলো এবং তেরোতম দিনে রেজওয়ান মারা গেল।
– তুমি আমাদের সাথে একটু যোগাযোগ করতে পারতে
– আসলে আমার কাছে ফোন নাম্বার ছিল না। আর সবে মাত্র জয়েন্ট করা একজন সাধারণ কর্মচারীর দায়ভার কোন কোম্পানি কি নেয় বলুন। আমি সেই ভাবনা থেকে
-তাই বলে অফিসের নাম তো জানতে নাকি অফিসে যোগাযোগ করবে না
– আমার মাথায় অত কিছু আসেনি স্যার। আমি আসলে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কোন সহায় পাচ্ছিলাম না। কি করবো কোথায় যাবো টাকা কেথায় পাবো… আমরা দরিদ্র শ্রেনির মানুষ কে করবে সাহায্য কেউ করেনি। গত পরশু ও মারা গেছে। বলেই হু হু করে কেঁদে উঠলো বিথী। রহমান সাহেবও কাঁদছেন।

– ওহ! রেজওয়ান। আমার রেজওয়ান! বলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।
বিথী কাঁদছিল হঠাৎ রহমান সাহেব আর্তনাদ শুনে সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সেই চোখে হাজার প্রশ্ন।
অনেকটা পরে ধাতস্থ হয়ে জাহিদুর রহমান বললেন,
– রেজওয়ান আমার ছেলে ছিল। ওর মা মিলা ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী। আমার ভুল আর গোয়ার্তুমির কারণে মিলা হারিয়ে গিয়েছিল। আমি রেজওয়ানের বায়োডাটা ঘেটে ওর স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে সব খোঁজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি। ব্যপারটা আমার জন্য কতটা আনন্দের ছিল সে শুধু আমিই জানি তার মধ্যে ও নিখোঁজ হল। আহ! নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস। জানো মেয়ে আমার স্ত্রী মিলা অনেক অভিমানী ছিল। ও আমাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতো, খুব ভালোবাসতো। আমারই ভুলে আমার একমাত্র বংশধর মায়ের মত এক বুক অভিমান নিয়ে চিরকালের মত হারিয়ে গেল। ওহ! আমার প্রাণ প্রিয় স্ত্রী মিলা। আমার প্রিয় রেজওয়ান চিরজনমের মত হারিয়ে গেল !!
বিথী অবাক হয়ে তখন তাকিয়ে আছে। কাঁদতেও ভুলে গেছে সে।এ কি করে সম্ভব …

”আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ
বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও
ধরা দেবে বলে আশা করে রই
তবু ধরা নাহি দাও
জানি না তোমার একি অকরুণ খেলা
তব প্রেমে কেন মিশে রয় অবহেলা
পাওয়ার বাহিরে চলে গিয়ে কেন আমারে কাঁদাতে চাও
বুঝি আমার মালায় মায়ার বাঁধন নাই
আপনজনেরে আপন করিয়া বাঁধিতে পারিনা তাই
আসে আর যায় কত চৈতালি বেলা
এ জীবনে শুধু মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা
কোন সে বিরহী কাঁদে মোর বুকে তুমি কি শুনিতে পাও
—————-
গীতিকারঃ প্রণব রায়
শিল্পী ও সুরকার – মান্না দে “
সমাপ্ত

© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক

মনময়ূরী

গোধূলীবেলায়,
ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে।
ঘরে ফেরার তাড়নায়,
পাখী সকলের জান কবুল করা সময়ে।
আবির রঙে হেসে ওঠে আকাশ।
হৃদয়ের দখিন কোন থেকে দোলা দেয় হাওয়া,
অতীব মনোরম ছন্দে।
সেই ক্ষনে আনমনে মনের বাতায়ন খুলে যায় সপাট।
কনে দেখা আলোয় হেসে ওঠে পদ্ম।
লুকোচুরি খেলা খেলে আকাশ আর পৃথিবী।
ঠিক তখনই,
তুমি এসে দাঁড়ালে তেতালার খোলা ছাদে,
আমি চেয়ে মুগ্ধ!
আকাশ মিতালীতে তোমায় দেখে।
অনুভব করি অপার্থিব ভালোবাসা হৃদয় কোনে।
তুমি কি আমায় ভালোবাসবে মনময়ূরী?

পাখির স্বাধীনতা


বাবা টিয়া গাইছে গান,
আমড়া গাছের ডালে।
ছানাগুলো আশ্রয়ে,
মায়ের বুকের তলে।

রীনা বসে বীনা বাজায়,
মীনা গায় গান।
দীনা বলে পুষবো পাখি,
একটা ধরে আন।

মা শুনে কয় বনের পাখি,
বনেতে মানায়।
বন্দী পাখি হয় যে দুঃখী,
উচিত কাজ নয়।

দীনা বলে ঠিক তবে তাই
বাঁচুক ওরা ওদের মত করে ।
মুক্ত স্বাধীন কাটাক জীবন,
এদেশ ওদেশ ঘুরে।

গল্পঃ বেলা অবেলা

024c145f

[১]
অনেকক্ষণ ধরে ডোরবেল একটানা বেজে চলেছে। বাথরুম থেকে তো জুলেখা ঠিকই শুনতে পাচ্ছেন আর কেউ শুনতে পারছে না নাকি! তুতুল কি করছে কে জানে? এই দুপুর বেলা পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে হয়তো। আর এ অসময়ে কে ই বা এলো।জুলেখার আরও কিছু কাজ বাকি ছিলো স্নানঘরে, খানিকটা বিরক্ত হয়ে সব কাজ ফেলে, গায়ে কোন রকম দু চার মগ হাপুস হুপুস পানি ঢালল বেলা গড়িয়েছে অনেকটা তারপর ভেজা শরীর কোন রকম আলতো করে মুছে, হুড়োহুড়ি করে কাপড় বদলিয়ে, জুলেখা বানু দরজা খুললেন একরাশ বিরক্তি নিয়ে।
দরজা খুলতেই জবাকে দেখে তার বিরক্তি আরও বেড়ে গেলো।
– তুই?
জবারও এমনিতে রাগে শরীর জ্বলছে। এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে? বাড়িতে কি সব মরে গেছে নাকি? সেই ধরে বেল দিচ্ছে তো দিচ্ছে কারো আসার নাম নেই।
তার উপর মায়ের অমন প্রশ্ন। কার না রাগ হয়? সেও ঝাঁঝিয়ে উঠল,
– কেন এ বাড়িতে আমার আসা বারণ নাকি?
– বারণ হবে কেন?
– তোমার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে । তা না হলে…… যাক সে যাক বলো মুখ অমন গোমড়া করে রেখেছো কেন?
– হাসাহাসির কি যথেষ্ট কারণ আর অবশিষ্ট আছে? খেটে খেটে মরে গেলাম কেউ খোঁজ নেবার নেই, আবার সবার ঝাড়ি ও খাচ্ছি সারাদিন, বড় কপাল করে এসেছিলাম তো পৃথিবীতে তাই এই দশা ।
– মা এত খোঁচা মারো কেন? খোঁচা খুঁচি আমার অসহ্য লাগে।
– আমার অবস্থায় পড়তিস তবে বুঝতি, কত ধানে কত চাল।সারা জীবন তো সবাই গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ালে, তা আর বুঝবে কি?
– আবার বুঝি ভাবির সাথে ঝগড়া করছো? তা দরজা থেকে সরবে ,না চলে যাবো।
জুলেখা একপাশে সরে দাড়ালেন তবে আবার বললেন,
-দাড়া আগে হ্যান্ড ওয়াশ আনি,আর মাস্ক পরিসনি কেন?
– ওসব মাস্ক টাস্ক আমার ভালো লাগে না। তুমি দেখি ঝগড়া করার মুডে আছো সরো তো সরো, সোজা ওয়াশরুমে যাচ্ছি। এমনিতে গোসল হয়নি। ভালো কথা তোমাদের ওয়াশরুমে তো সাবান শ্যাম্পু থাকে না। না থাকলে দিয়ে যাও।আর হ্যাঁ লেদার খুলে লাল রং এর ম্যাক্সি আছে একেবারে উপরে, ওটা দিয়ে যেও।
– শ্যাম্পু শেষ, সাবান আছে।
তারপর জুলেখা বানু লেদারের দিকে তাকিয়ে বেশ উষ্মা প্রকাশ করলেন,
-এত ভারি ব্যাগ বয়ে এনেছিস কি কারণে?
– থাকবো ক’দিন।
– কদিন থাকবি মানে? এই তো সাত দিন আগে গেলি।
– আচ্ছা মা আমাকে কি ও বাড়িতে বেঁচে দিয়েছো?
– ও কথা আসছে কেন? মানুষ কি বলে বাপের বাড়ি এত ঘন ঘন এলে?
– আমি আমার বাড়িতে এসেছি ব্যাস তাতে কে কি বলল না বলল শুনতে আমার বয়ে’ই গেছে।
-তুই কারো ধার না ধারলেও আমাদের সমাজ নিয়ে চলতে হয়।
– আরে রাখো তোমার সমাজ। এটা আধুনিক যুগ। আমার সিদ্ধান্ত আমার, ব্যস। আর জুবায়েরের সাথে আমার থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই চলে এলাম।
– এসব আবার কি বলছিস তুই? দুদিন অন্তর নাটক আমার ভালো লাগে না। তোরা কি একটু শান্তিতে থাকতে দিবি না আমাদের? কি বলবো আর।
আমার হয়েছে যত জ্বালা, সব কপালের লিখন,কোন পাপে যে এমন শাস্তি তিনিই জানেন।
সোমত্ত ছেলে স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছে,তার বউ রাত দিন হুমকি ধামকি দিচ্ছে, এখানে তার নাকি আর পোষাচ্ছে না।তার উপর তুই নিত্য নতুন অশান্তি। আমাদের বয়স হয়েছে জবা। আমরা আর পারছি না।
– মা দয়া করে তোমার বকবকানি থামাবে? এই একই ভাঙা রেকর্ড শুনে শুনে আর ভালো লাগে না।

[২]
জবা মায়ের কাছ থেকে সরে এসে গোসল সেরে ভাবির রুমে উঁকি মারলো। যেহেতু ভাইয়া অসুস্থ সেহেতু উঁকি মারতে দোষ নেই।
– ভাবি কি করো?
তুতুল চমকে ওঠে। চোখ বড় বড় করে তাকায়।যদিও সে একটুও চমকায়নি এসব তার ভান। সে বহু আগেই জবার আগমন টের পেয়েছে। জবা যখন গেটের মুখে জানালা দিয়ে তুতুল তাকে দেখতে পেয়েছে। মা মেয়ের গরম গরম বাক্য বান,তাকে নিয়ে আলাপ সবই তার কর্ণকুহরে যথাসময়ে প্রবেশ করেছে। সে এসব আর এখন পাত্তা দেয় না, গায়েও মাখে না।
জেনে শুনে ঢং করা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
– ওমা ননদিনী কখন এলে? কি কিউট লাগছে তোমাকে।
– এইতো কিছুক্ষণ। এসেই তো ঝগড়াঝাটি করলাম তুমি কোথায় ছিলে ,শোননি কিছু?
– আমার না কারো পারসোনাল ম্যাটারে ইন্টার ফেয়ার করা একদম পছন্দ না। তাই আমি ওসব কানে নেই না।
– তুমি না একদম আমার মতো, এজন্য তো তোমায় এত পছন্দ করি। সে যাক ভাবি কি রেঁধেছো আজ? আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে, কিন্তু মায়ের কাছে খাবার চাইলে হাজারটা কথা শোনাবে। তাই তোমার কাছে এলাম।
– তোমার পাগলামি আর যাবে না, এই অবেলায় কেউ না খেয়ে বের হয়?
– আর বলো না ,মা ছেলে দুজনার সাথে ঝগড়া করে খাওয়ার মুডটা নষ্ট হয়ে গেছিলো।
– কি নিয়ে আবার গোল বাঁধালে?
– আরে ভাইয়া সুস্থ হয়ে ওঠা অবধি ভাইয়ার মটর সাইকেলটা জুবায়ের দেখে শুনে রাখবে বলে নিয়ে গেল না। ওটা ও গতকাল বেঁচে দিয়েছে।
– কি? তুতুলের মুখ দিয়ে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো।
– বেঁচে দিয়েছে মানে কি জবা? ওটা তোমার ভায়ের অনেক শখের মোটরসাইকেল ছিলো।
– সে আমি জানি না বলছো? তাই নিয়ে তো ঝগড়া। মহা ঝগড়া।
– তো বেঁচে দিলো কেন?
– কে জানে? নেশাখোর হলে যা হয়।বেঁচে জুয়া খেলেছে নয়তো কি? ও তো বলছে ও নাকি মায়ের জন্য এক জোড়া ঝুমকো গড়াতে দিয়েছে। তুমি বলো বুড়ো বয়সে কেউ ঝুমকো পড়ে ,না তাকে মানায়। সবটা শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিলো। আমার বাপের বাড়ির জিনিস আর তোরা মা ছেলে ভাগ বাটোয়ারা করছিস। লজ্জা হওয়া উচিত , না কি বলো?
– ওই মোটরসাইকেল মোটেও তোমার বাপের বাড়ির জিনিসের মধ্যে গন্য হবে না, ওটা তোমার ভায়ের খুব শখের। ওটাতে আমার টাকাও দেয়া ছিলো। শুধু ব্যবহার করলে ভালো থাকবে বলে দেওয়া। এখন যদি তোমরা বেঁচে খাও। তোমার ভাই সুস্থ হলে আমি কি কৈফিয়ত দেবো?
– ভাইয়া সুস্থ হবে? তুমি এখনো আশা করছো? আমার তো মনে হয় না ভাইয়া কোনদিন সুস্থ হবে। তুতুল জবার কথায় পাত্তা দিলো না।ফয়সালের ভালো হওয়া মন্দ হওয়ায় এখন আর তার কিছু যায় আসে না। সে যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে ফেলেছে।
কথা ঘুরিয়ে তুতুল বলল,
– তুমি প্রেম করার জন্য আর ছেলে পাওনি ননদীনি।এ তোমাকে তোমার পরিবারকে সারাজীবন জ্বালাবে।
– আমি কি করবো, বিয়ের আগে তো ভালোই ছিলো। লেখাপড়ায় ভালো, বাবার বড় ব্যবসা। সে কারণে তো মা বাবার অমতে গিয়ে বিয়েটা করলাম। কত কান্ড করে তারপর সব মীমাংসা হলো।জানো তো সবই।
তুতুলের মনটা জবার কথা শুনে হঠাৎ করে বিগড়ে গেছে, এই সব দায়িত্বজ্ঞানহীন লোভী মানুষগুলো দেখলে তার রাগে গা জ্বলে। এবার সে নিজের কাজে মন দিলো। আজ বিজয়ের সাথে দেখা করতে হবে। এ বাড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

[৩]
রাকিব সাহেব অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। অবসরে গিয়েছেন তিন বছর হলো। সারা জীবন স্কুল আর টিউশনি করে তার দিন পার হয়েছে এ যাবৎকাল । দারিদ্রতার কারণে পুরোটা জীবনে অন্য কোন দিকে নজর দেবার ফুরসত খুব একটা পাননি তিনি।
যদিও এ নিয়ে আক্ষেপ বা অভিযোগ কোনটিই তার নেই। তিনি তার কাজ আর জীবন নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট।সবচেয়ে বড় কথা তিনি সৎ ভাবে জীবন যাপন করতে পারছেন এটা তার কাছে অনেক গর্বের বিষয়।
তার জীবনটাও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কেটে গেছে। একই ধারায় বয়ে গেছে, মেয়েটা যা একটু বেয়াড়া তা বাদে আর সব ঠিক ঠাক চলেছে বরাবরই যেমনটি তিনি চেয়েছেন । যদিও ছেলের পড়াশোনা বেশি দূর হয়নি।সবার দ্বারা সব কিছু হয় না তাও তিনি জানেন ,এনিয়ে তার কোন আফসোস নেই। তিনি ছেলেকে শর্ট একটা কোর্স করিয়ে ফার্মেসীতে বসিয়ে দিয়েছেন।
রায়হান এক্ষেত্রে বেশ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে, দ্রুত ব্যবসা দাঁড় করিয়ে সে নিজে উদ্যোগী হয়ে বাবার টিউশনি ছাড়িয়েছে। বাবাকে সে জান প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।বাবার কষ্ট সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।
তারপর আর কি, রাকিব সাহেবের কাজ বলতে বাজার করা আর নাতিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা।তার বাইরে অখণ্ড অবসর।
তার এত অবসর দেখে জুলেখা মাঝে মাঝে খোঁচা মারতে কম করেন না।
– নবাব সাহেব আপনার মতো ঝাড়া হাত পা হলে আমি একটু বাঁচতাম। কবে যে সংসারের ঝামেলা থেকে মুক্ত হবো আল্লাই জানেন!
রাকিব সাহেব স্বভাবে বেশ রাশভারি হলেও রোমান্টিকতায়ও তিনি কম যান না তৎক্ষনাৎ তিনি উত্তর দেন,
-এবার তাহলে চলো যেখানে যা আছে , ছেলে আর ছেলের বউকে সব বুঝিয়ে দিয়ে দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যাই।
-এই যে মাস্টার মশাই দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে না হয় গেলাম কিন্তু খাওয়া জুটবে কি হাওয়া থেকে? গেলে তুমি যাও আমার অত শখ নেই।
– সব শখ তাহলে মিটে গেছে বুঝি? আলহামদুলিল্লাহ।
– গলা অত চড়াচ্ছো কেন? আস্তে কথা বলো, ওরা সবাই শুনছে।
রাকিব সাহেব চুপ করেন বটে তবে ঠোঁট চেপে মিটমিটিয়ে হাসেন তাই দেখে জুলেখা ঝনঝনিয়ে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
-বুড়ো বয়সে যত সব ভীমরতি, দেখলে গাঁ পিত্তি জ্বলে যায়। বয়স বাড়ছে আর ফাজিল হচ্ছে। যাচ্ছেতাই লোক একটা।

[৪]
জীবন কখনো সাজানো ছকে চলে না, কখন যে কার জীবনে কি ঘটবে কেউ তা জানে না। দিন ভালোই কাটছিলো রাকিব সাহেব ও তাঁর পরিবারের এর মধ্যে হঠাৎ করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো মহামারী করোনা,অনেক মানুষের মতো করোনা রাকিব সাহেবর জীবনও লন্ড ভন্ড করে দিলো।
লকডাউনে রায়হানের ওষুধের দোকান খোলা থাকলেও বেচাবিক্রি সর্ব নিম্ন পর্যায়ে নেমে এলো,তবুও সংসার চালানোর দায় থেকে রায়হান ফার্মেসি খুলে বসে নিয়মিত।
এর মধ্যে একদিন প্রচন্ড গায়ে ব্যথা আর জ্বর নিয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে। দিন পার হতে না হতে তার অবস্থার ক্রমাবনতি হয়।বাড়ির সবাই ধারনা করেন রায়হানের করোনা হয়েছে কারণ করোনার প্রায় সব লক্ষ্মণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান, রাকিব সাহেব ঠিক করেন ছেলে সহ বাড়ির সকলের করোনা টেস্ট করাবেন। দেরি করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কিন্তু রায়হানের স্ত্রী তুতুল হঠাৎ বাঁধ সাধে তাঁর মায়ের পরামর্শে। সে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে যে, করোনা হোক বা না হোক ,টেস্ট করতে গেলে আশে পাশে পাড়া প্রতিবেশি সবার চোখে তারা নাকি ছোট হয়ে যাবে। আর যদি করোনা পজেটিভ হয় তাহলে তো ষোলকলা পূর্ণ, নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে সবাইকে । এক ঘরে হতে হবে, বাড়ি লকডাউন হবে,পাড়া প্রতিবেশি উঁকি ঝুকি মারবে, বাজে কথা বলবে। ইট পাটকেলও নিক্ষেপ করতে পারে। করোনা সেরে গেলেও তেমন একটা কেউ মিশতে চাইবে না। নানা কথার খোঁচায় জর্জরিক করবে।
তুতুল এই বিপথ থেকে উদ্ধারের বিকল্প পথও বাতলে দেয়। এলাকার এক কোয়াক ডাক্তার আছেন নাম তার ফুল ডাক্তার। তাকে দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে।
ফোনে ফুল ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলে তার ওষুধে রায়হান ঠিকই সেরে উঠবে। অনেকে নাকি এমন গোপন চিকিৎসায় ভালো হয়ে গেছে। এতে নিজেদের সামাজিক অবস্থানের কোন সমস্যা হবে না। বলা যায় সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।
রাকিব সাহেব বারবার অসম্মতি জানালে জবা আর তার মা ও তুতুলের পক্ষ নেয়। আসলে তুতুল তাদের আগে থেকে নানা রকম উল্টা পাল্টা বুঝিয়ে হাত করে রেখেছে।
এভাবে ফুল ডাক্তারের চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়
দিন দুই পরে রায়হানের শারীরিক অবস্থা মারাত্নক অবনতি হলে, হাসপাতালে নিতে সেখান থেকে তারা জানালো রুগি স্ট্রোক করেছে। রুগির ব্লাড প্রেশার মারাত্মক হাই। ডায়বেটিস ও আছে। অথচ রায়হানের পরিবারের লোকজন রায়হানের এ ধরনের শারিরীক সমস্যার কথা এত দিন জানতেন না।
কিভাবে কি হলো কে জানে?
নানান টেষ্টের পরে আশার কথা রায়হানের করোনা লক্ষ্মণ থাকলেও করোনা হয়নি। সিজেনাল জ্বর। কিন্তু ভুল চিকিৎসায় শারীরিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।
স্রোতের মত টাকা খরচ হলো।অমানুষিক ভোগান্তি তার বদলে রায়হানের শারীরিক উন্নতি হলো যৎ সামান্য। মাস খানিক পরে যখন রায়হান বাড়িতে এলো তখন সে কোন রকমে পা টেনে টেনে হাঁটতে পারে। আর অনেক ক্ষণের প্রচেষ্টায় আব্বা বলে ডাকতে পারে।
যেহেতু ফার্মেসী ব্যবসার কিছু বোঝেন না রাকিব সাহেব তাই ফার্মেসী বেঁচে দিলেন পানির দামে। এছাড়া কি আর করবেন?
সংসারই বা চলবে কি করে? রাকিব সাহেব আবার ফিরে গেলেন পুরানো পেশায়,টিউশনিতে।
প্রথমদিকে টিউশনি পাওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে গেলো। ফার্মেসি বেঁচা পয়সার হাত দিতে হলো বাধ্য হয়ে। জুলেখার গয়নাগুলো হাতছাড়া হয়ে গেলো।
পরবর্তীতেও পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আয়ের বেশির ভাগ খরচ হয়ে যেতে লাগলো রায়হানের চিকিৎসায়।
এর মধ্যে জবা আর তার জামাই নিয়ে হাজির হলো নতুন বায়না নিয়ে।

[৫]
সেদিন জবার জন্মদিন ছিলো। করোনা, রায়হানের অসুস্থতা সাথে বিবিধ পারিবারিক সমস্যার কারণে জুলেখার মনটা অস্থির থাকে সবসময়।
সন্ধ্যাবেলা জবা ফোন দেয় মাকে,
– মা কি করো।
– এই নামাজ পড়ে উঠলাম।
– আমার কথা এখন আর তুমি অতটা ভাবো না তাই না?
– ওমা তা কেন হবে। এই তো নামাজ শেষে তোর, জামাই আর কণার জন্য দোয়া করলাম।
জবা অভিযোগের সুরে বলল,
-তোমাদের চিন্তা ভাবনা এখন শুধুই ভাইয়াকে নিয়ে।আমাকে তো পর করে দিয়েছো।
– তোর ভাইটা অসুস্থ তাকে নিয়ে এত অভিযোগ করা কি ঠিক?
– অভিযোগ করলাম কোথায়? আমি কি তোমাদের ব্যাপারে কিছু বলার অধিকারও হারিয়েছি?
– কি ভুল ভাল বকছিস।এসবের জন্য ফোন করেছিস?
– জানি তোমরা এখন আর আমাকে ভালোবাসো না, আমাকে তোমরা পর করে দিয়েছো। এখন আমার সব কথা তোমাদের তিতা লাগে যাহোক যা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম, আজ আমার জন্মদিন তোমরা মনে রাখার প্রয়োজন বোধটুকুও করনি। ভালোই হলো আমি জানলাম আমার পরিবারের আমি অবাঞ্ছিত।
জুলেখা অস্বস্তিতে পড়লেন তার অন্তত এই বিষয়টি মনে রাখা উচিত ছিলো। নানা অশান্তিতে সব ভুল হয়ে যায় ইদানিং।
– মা রাখছি। আরো একরাশ অভিমান ঝরে পড়লো তার কন্ঠে।
জুলেখা বানু ফোনে ওদের নিমন্ত্রণ জানালো রাতে খাওয়ার। জবা আসলে জামাইকে নিয়ে এ বাড়িতে আসার বাহানা খুঁজছিলো। সেটা হয়ে গেলো।
– দেখি তোমার জামাইকে বলে ও যদি আসতে চায় তো একবার ঘুরে যেতে পারি তোমাদের ওখান থেকে। আমি পরে জানাচ্ছি।
জুলেখা জানেন জবা আসবে। তিনি রান্নাঘর ঘরে যান, আজ এমনিতে শুক্রবার ছিলো। মাংস আর ডিম ভূনা করা ছিলো। তুতুল তার মায়ের বাড়ি গেছে মেয়েকে নিয়ে। খাবার প্রায় সবটাই রয়ে গেছে। মাছ ভাজি আর সরষে ইলিশ সাথে প্লেইন পোলাও করে দিলে ভালোভাবে সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।
জুলেখা ফ্রিজ খুলে অবশিষ্ট ইলিশ মাছ বের করে আনলেন।
তুতুল আর কাজরী এখনো ফেরেনি। হয়তো ফিরবে না। আজকাল তুতুল বাপের বাড়িতে থাকতে বেশি পছন্দ করে অথচ রায়হানের এখন সবচেয়ে বেশি তাকে প্রয়োজন। জুলেখার কানে অনেক কথাই আসে তুতুল সম্পর্কে তিনি অনেকবার ভেবেছেন কিছু জিজ্ঞেস করবেন।তারপর কি জানি কি ভেবে আর জিজ্ঞেস করা হয় নি।
রায়হানের বাবা এখনো সম্ভবত এসব ব্যাপারে কিছু জানেন না বা শোনেন নি। পুরুষ মানুষ অত শত বোঝেনও না, তবে জানতে পারলে ভীষণ আঘাত পাবেন।
এ ক’মাসে তার উপর দিয়ে অকল্পনীয় ঝড় ঝঞ্ঝা গেছে তার উপর জবার জ্বালাতন। না আজকাল মনে হয় এসব দেখার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিলো। অন্তত এতো কষ্ট পেতে হতো না।।

(৬)
রাকিব সাহেবের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তিনি প্রচন্ড রেগে আছেন। এর কারণ আছে অবশ্য,আজকাল তিনি জবা আর জবার স্বামীকে সহ্যই করতে পারেন না। মেয়েটা দিনে দিনে এত লোভী হয়ে উঠছে কি কারণে কে জানে? তার সন্তান যে এমন হবে তা তার কল্পনার বাইরে ছিলো।
একে তো খাওয়ার টেবিল তার উপর জামাই বসে আছে। এই জামাইকে তিনি দুচোখে দেখতে পারেন না। একমাত্র জামাই হওয়া স্বত্ত্বেও এই ছেলেটিকে তিনি প্রচন্ড রকমের অপছন্দ করেন। কেন অপছন্দ করেন তারও বহুবিধ কারণ আছে । সবচেয়ে বড় কারণ ছেলেটি মারাত্মক রকমের লোভী। সে জবাকে লোভী বানিয়ে ফেলেছে নিজের স্বার্থে। কাজ হাসিলের উদ্দেশ্যে।
খাবার টেবিলে কিছুটা সময় চুপচাপ পার হবার পর জবা যখন বুঝলো যে পরিবেশটা ঠিক তার অনুকূলে নেই। তখন নিজেই উপযাচক হয়ে মায়ের সাথে এটা সেটা আলাপ শুরু করলো সে।জুলেখা বানুর ও আজ মন মেজাজ খারাপ। কথাবার্তা কিছুতেই জমছে না যে সেই প্রসঙ্গ ধরে জবা মূল প্রসঙ্গে আসবে।
অথচ জুবায়েরের কড়া হুশিয়ারি যে আজই যা করার করতে হবে।কিছুক্ষণের মধ্যে জবা আসল প্রসঙ্গে এলো,
– মা তোমার জামাই নতুন একটা ব্যবসা শুরু করবে বলে ভাবছে।
– ভালো তো।
– শুধু ভালো সাথে আরো কিছু বলো, একটু সৌজন্য তো আশা করতে পারি নাকি?
জুলেখার গা জ্বলে, সে জানে এরপর কি হবে, টাকা পয়সার কথা উঠবে। মেয়েটা এমন কেন।ও কি পাগল নাকি বোকা?
মেয়েটা একটু দুরন্ত ও জেদি ছিলো ছোটবেলা থেকেই, কন্ট্রোলে আনা যায়নি, বর্তমানে দিন দিন তা আরো বেশিমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।বেশি আদর দেওয়ার ফল এখন হাতে হাতে পাওয়া যাচ্ছে। আদরে একেবারে বাঁদর যাকে বলে।
অপমানটুকু সয়ে জুলেখা জানতে চাইলেন,
– তা কিসের ব্যবসা। কোথায় করবে? আগেও তো কয়েকটি করেছে। যদিও সফল হতে পারেনি। এবার নিশ্চয়ই পারবে আশা করি।
– হ্যাঁ মা, বাবা তোমরা দোয়া করো। সেজন্য তো তোমাদের এখানে আসা। দোয়া নিতে।
রাকিব সাহেব সগোক্তি করলেন
– দোয়া নিতে এলে? তোমার মা’তো বলল জন্মদিন তাই বায়না করে এসেছো। কেউ তোমার খোঁজ নেয় না নাকি?
– অমন করে ঠেস দিয়ে বলছো কেন বাবা? দোয়া নিতে তো আসছি জন্মদিন তো উপলক্ষ, একটু অন্য কথাও ছিল অবশ্য। মা বাবা দুজনেই আছো যখন, বলছিলাম কি? ভাইয়ার এই অবস্থা তোমরাও আর কদিন। এই বাড়িটা শেষ পর্যন্ত তো আমরা দুই ভাই বোনই পাবো , নাকি?
যাহোক আসল কথায় আসি তোমরা যদি বাড়িটা বেঁচে আমার মানে আমাদের অংশটা বুঝিয়ে দিতে তাহলে আমরা জীবনটাকে নিজের মত করে গুছিয়ে নিতে পারতাম। এভাবে আর কতদিন?
আর ভাইয়ার অংশের টাকা দিয়ে ভাইয়ার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেতাহলে ভাইয়াও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। টাকা পয়সাই তো মূল সমস্যা তাই না?
রাকিব সাহেব মেয়ের স্পর্ধায় যারপর নাই অবাক হলেন,তাঁর ভ্রু কুচকে উঠলো। সমস্ত শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। মাখা ভাত রেখে তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেসিনে হাত ধুতে গেলেন।
আর কোন কথা হলো না বাকি সবাই খাওয়া শেষ করে যার যার মতো টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো।
হঠাৎ করে পুরো বাড়িটা জুড়ে মধ্য রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন।
তেমন সুবিধা করতে না পেরে রাত বাড়লে জবা জানায় তারা এখন চলে যাবে, আর এ বাড়িতে আসা হবে কিনা সে ব্যাপারে তাকে ভাবতে হবে ,ইত্যাদি ইত্যাদি।
– এত রাগ কেন তোর?
-এতে আবার রাগের কি দেখলে মা।আমি চাই না আমার জন্য জুবায়ের তোমাদের বাড়িতে এসে অপমানিত হোক।
– ওকে কে অপমান করলে? কি যা তা বকছিস।
-ন্যাকামি রাখো তো, আর হ্যাঁ ভাইয়ার অসুখের সময় যে কুড়ি হাজার টাকা নিয়েছিলে ওটা কি দিতে পারবে?
-তোর বাবার কাছে শুনি?
-না পারলে সমস্যা নেই, ভাইয়ার তো একটা মোটর সাইকেল ছিলো। ওটা তো পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যাবে। চাইলে ওটা ধার দিতে পারো। ভাইয়া সুস্থ হলে না হয় তখন ফেরত দিয়ে যাবো। ভাইয়ার শখের জিনিস ভেবো না ,যত্নে থাকবে।
জুলেখা মেয়ে বিচার বুদ্ধি স্বার্থপরতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে তুতুল ফোন দিলো জুলেখা বানুকে।
– মা জবা নাকি কাল খুলনায় যাবে? কি একটা জরুরি কাজে?
– আমি জানি না। তো কি হয়েছে?
-রায়হানের বাইকটা একটু নিতে চাচ্ছিলো। পরে ফেরত দিয়ে যাবে।
– কিন্তু………….
ওকে চাবিটা দিয়ে দিন মা। আমি আপনার সাথে এ ব্যাপারে পরে কথা বলছি। একটু ব্যস্ত আছি।
কলকাঠি কোথেকে নড়েছে জুলেখার বুঝতে একটুও দেরি হলো না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।তাদের মৃত্যুর পর এতো সাধের সংসার তছনচ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না এটা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।
কারো কাছে কিছু শুনলেন না আর ,আর শুনাশুনি করে অশান্তি বাড়িয়েও লাভ নেই বুঝতে পেরে ,জুলেখা বানু মটর সাইকেলটার চাবিটা জবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। শুধু বললেন,
– তোর এত লোভ? এত লোভ ভালো না’রে জবা।
জবা ও জুবায়ের দুজনেই সমান বেহায়া। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে মটর সাইকেলটা নিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় হলো।

(৭)
দিন কয়েক পরে…..
আছরের নামাজ পড়ে জায়নামাজ গুছিয়ে তসবি হাতে জুলেখা বানু তুতুলের ঘরে ঢুকলেন।
আজ তাকে কয়েকটি কথা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে হবে তুতুলকে। সমস্যা জটিলতর হবার আগে সমস্যার সমাধান করতে হয়।
ইদানিং তুতুলের মতিগতি জুলেখার একটুও ভালো লাগছে না। প্রায় প্রতিদিনই অনেক কথাই কানে আসছে তার, এমনিতে রায়হানের বাবার শরীরটা আজ কদিন খুব বেশি ভালো না। বুকে চাপ চাপ ব্যাথা বলছে। এই বয়সে এত পরিশ্রম তার পক্ষে সবকিছু একা হাতে সামলানো বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু করারও কিছু নেই।ডক্তিারের পরামর্শ দরকার এখন মাসের শেষ হাত একেবারে খালি।
তাই মাসের প্রথমে ছাড়া ডাক্তারের কাছে যাওয়া হবে না।এই নিয়ে জুলেখা বানু বেশ চিন্তায় আছেন কারণ মাস পুরতে এখনো বেশ কদিন বাকি,লোকটার কিছু হলে পুরো পরিবারটা ভেসে যাবে। এতোদিন তুতুলের ব্যাপারটা তিনি তাই ইচ্ছে করে রাকিব সাহেবের কানে তুলেন নি। বেচারা জানতে পারলে প্রচন্ড কষ্ট পাবেন। এমনিতে চারপাশ ঘিরে আসছে ঘোর অন্ধকারে।
অন্যদিকে তুতুলের ব্যপারটা নিয়ে জুলেখা বানু নিজেও কি কম কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু কিছুই করার নেই যেন।
প্রথম প্রথম তিনি ব্যাপারটা ততটা আমলে নেননি।তারপর বহুমুখে শুনে আর অবিশ্বাস করবেন কি করে।
তুতুল এক মনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজগোজে ব্যস্ত। খুব সুন্দর লাগছে তাকে।যার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্থ পঙ্গু তার এত সাজগোজ অন্য কারণ নির্দেশ করে।
তুতুল বরাবরই সুন্দরী তবে সে যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন এত ভালো তাকে দেখাতো না ইদানীং যেন রূপ তার কাছে মোহময়ী হয়ে ধরা দিয়েছে।
-তুমি কি এখন কোথাও বের হচ্ছো মা?
– হ্যাঁ একটু কাজ আছে বাইরে। ফিরতে রাত হতে পারে।রায়হানের সব চেঞ্জ করে দিয়েছি,তেমন কোন অসুবিধা আর হবে না হয়তো। হলে আপনারা তো আছেনই,দেখবেন। ওষুধ গুলো সব বাইরে রেখেছি। বাবা এলে খাইয়ে দিতে বলবেন ।
– কাজরীও যাচ্ছে?
– ওকে কার কাছে রেখে যাবো মা?
– ওর পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে।
– সে আপনাকে না ভাবলেও চলবে মা,আমি তো আছি নাকি?
– তুমি ওর মা,আসলে সবচেয়ে তুমি ভালো বুঝবে কিসে ওর ভালো কিসে মন্দ। যা হোক তোমার সাথে একটু কথা ছিল।
– আমার দেরি হয়ে যাবে, এমনিতে দেরি হয়ে গেছে তারপর কি ভেবে বলল,
– ঠিক আছে কি বলবেন বলুন।
– তুমি এই যে প্রতিদিন অসুস্থ স্বামীকে রেখে চলে যাও কোনদিন বাড়ি ফেরো আবার কোনদিন ফেরো না এতে নানা জনে নানা কথা বলে।
– মানে? আপনার সাথে আবার কে কি বলল।আর কে কি বলল না বলল আমার তাতে কিছু যায় আসে না মা।
– তোমার মেয়ে বড় হচ্ছে?সমাজে আমাদেরএকটা সামাজিক অবস্থান।
– আমি আগেও বলেছি আপনারা আপনাদের অর্থব ছেলেকে নিয়ে ভাবুন।আমাকে আর আমার মেয়েকে নিয়ে নয়। আর আমি ঠিক করেছি ওকে হোস্টেলে দিয়ে দিবো।
-এইটুকু বাচ্চা মেয়েকে তুমি হোস্টেলে দেবে? কেন?আমরা তো এখনো বেঁচে বর্তে আছি।
– আর আপনাদের আমি জ্বালাতন করতে চাই না।মা অনেকদিন বলবো বলবো ভাবছি বলা হয়ে উঠছে না,যেহেতু আপনি কথা তুললেন সেহেতু ভালো হলো।আসলে আমিও তো রক্ত মাংসের মানুষ, আমার নিজের একটা জীবন আছে। এভাবে আর ক’দিন? আপনাদের এখানে আমার মনে হয় খুব বেশি দিন থাকা হবে না।
– থাকা হবে না মানে? এসব তুমি কি বলছো? থাকা হবে না মানেটা কি? আমাদের কথা না হয় বাদ দিলাম তুমি এই সংসার ছেড়ে স্বামী সন্তান ছেড়ে কোথায় যাবে? কেন যাবে?
– মা আমি না এইসন ন্যাকামি একদম সহ্য করতে পারি না। আপনি দিব্যি সবাইকে নিয়ে চুটিয়ে সংসার করছেন। আমার অবস্থা বয়স এসব নিয়ে কি একবারও ভেবেছেন? নিজের মেয়ে হলে ভাবতেন।
কিসে আমার দিন রাত কাটে একবারও খোঁজ নিয়েছেন? নেননি।
জুলেখা বানু থমকে গেলেন রূঢ় বাস্তবতার কাছে,
তিনি কোন রকমে বললেন,
– তোমার একটা সন্তান আছে মা। ওর ভবিষ্যৎ আছে।
-আর আমার ভবিষ্যত?
-সব ঠিক হয়ে যাবে মা একটু সময় লাগবে হয়তো।
-আমি জানি, কিছুই ঠিক হবে না।
-তোমার মেয়েটার কথা একটু ভাবো।
– ভেবেছি, ওটাই তো পথের কাঁটা না হলে কবেই পথ দেখতাম।আমার পক্ষে দীর্ঘ দিন এই পঙ্গু অসুস্থ স্বামীর ঘর করা সম্ভব না।

(৮)
রাকিব সাহেবের এক বন্ধু ক’দিন আগে জানিয়েছিলেন, নবী নগরে নাকি একজন কবিরাজ আছে। তার দেওয়া তেল পড়া প্যারালাইসিস রুগীর শরীরে মালিশ করলে, রুগী খুব দ্রুত সেরে ওঠে। বিপদের সময় মানুষের সব বিশ্বাসের ভিত্তি দূর্বল হয়ে যায়। রাকিব সাহেব কখনোই এই সব তেল পড়া পানি পড়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু ওই বলে বিপদ মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি মূলে আঘাত করে।
সেই কবিরাজের বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে রাকিব সাহেব সাভার থেকে ফিরছিলেন।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, বাসের মাঝামাঝি ছিটে বসে আছেন তিনি। জ্যামে পড়ার কারণে অনেক যাত্রী নেমে গেছে। বাস প্রায় ফাঁকা।
পথ চলতে নিজের সাইড ব্যাগে সবসময় বই রাখেন তিনি,এটা তার অনেক দিনের পুরানে অভ্যাস। সময় কাটানোর জন্য এখন তিনি বাসের মৃদু আলোয় বই পড়ার চেষ্টা করছেন। জ্যামে পড়া সময়টা কাজে লাগানো তার পুরান অভ্যাস। গাড়ি এগুচ্ছে ধীর গতিতে। মাঝে মাঝে কিছু যাত্রী উঠছে, আবার গন্তব্য এলে নেমে যাচ্ছে কেউ কেউ। রাকিব সাহেব ডুবে আছেন বইয়ের মাঝে।
হঠাৎ সামনের সিটে নারীর কন্ঠটি তার চেনা মনে হলো।একটু খেয়াল করে কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন এটা তুতুলে গলা। তিনি কিছু বলার উদ্যোগ নিতেই কয়েকটি কথা তার কানে এলো, তিনি বরফের মত জমে গেলেন। একি বলছে তুতুল…… সঙ্গের লোকটিই বা কে? মেয়েটি তাদের প্রতি এতটা ঘৃণা পুষে রেখেছে অথচ তারা….
ছেলেটি বলল,
– তারপর কি ফাইনাল করলে?
– কতবার বলবো।বললাম তো সামনের মাসে বিয়ে করছি আমরা।
– তোমার মেয়েটাকে কি করবে?
– বোডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেবো।
– সেই ভালো নির্ঝঞ্ঝাট থাকা যাবে।
-আর ওই পঙ্গুটাকে?
-ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দেবো দু একদিনের মধ্যে।
আমি আর পারছি না, অভিনয় করে করে ক্লান্ত জানো তো।
-আসলেই।
-বুড়ো বুড়িকে কি করে ম্যানেজ করবে?
-আরে রাখো তো,ওরা আমার কিছু করতে পারবে না। আর আমার ওত মায়া টায়া নেই। বরং সারাদিন ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বাঁচা যাবে। আমাকে নীতি নৈতিকতা শেখাতে আসে, যত সব বিরক্তিকর লোকজন। রায়হান সুস্থ থাকলে এতদিনে ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দিতাম ঠিক। কপাল ভালো বুড়ো বুড়ীর। ওদের মেয়েও তো চায় ওরা ওল্ড হোমে যাক। করোনা এসে সব প্লান ভন্ডুল হয়ে গেলো।
– করোনা এসে ভালো হয়নি বলছো?
তুতুল এবার হো হো হো করে হেসে ছেলেটির গায়ে গড়িয়ে পড়লো।
– একেবারে যে খাবাপ হয়েছে তা বলা যাচ্ছে কোথায়? করোনা না এলে তো তোমার কাছে আসা হয়ে উঠতো না। তোমাকে নিজের করে পাওয়া হতো না। ঝামেলাটা মিটিয়ে নেই তারপর দুজনে চুটিয়ে সংসার করবো।

(৯)
দরজা খুলে রাকি সাহেবের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলেন জুলেখা,
– কি হয়েছে তোমার?এমন দেখাচ্ছে কেন?
– শরীরটা ভালো লাগছে না।মাথা ঘুরছে জুলেখা।
-বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ফ্যানের নিচে বসো ফ্যান ছেড়ে দিচ্ছি। পানি খাবে? পানি দেবো?
রাকিব সাহেব অস্ফুট স্বরে বললেন
-দাও।
-ঠিক আছে হাত মুখ ধুতে হবে না,গোসল করবে তো।আগে ফ্যানের নিচে বসো বিশ্রাম নাও,তারপর গোসল করো। গোসল করলে নিশ্চয় ভালো লাগবে।
– আর বিশ্রাম আর ভালো লাগা,আমাদের সব আশা শেষ হয়ে গেছে জুলেখা সব আশা শেষ হয়ে গেছে।
পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে জুলেখা প্রশ্ন করেন
-কোথাও কোন ঝামেলা হয়েছে? কোন সমস্যা। আশা সব শেষ হয়ে যাবে কেন? আমরা এত সহজে হার মানবো না। কি হয়েছে কি?
মুখে প্রায় এসে গেছিলো কিন্তু রুচিবোধ এসে বাধা হয়ে দাড়ালো। কি করে তিনি ছেলের বউ দিকে আঙ্গুল তুলবেন?
রাকিব সাহেব মাথা নাড়ালেন, মুখ খুলতে দ্বিধাগ্রস্থ তিনি। যদি মুখ ফসকে কোন অসংলগ্ন কথা বের হয়ে যায়।
বুকের ব্যাথাটা আবার ফিরে আসছে সেই সাথে মাথা ব্যথা ।হয়তো গ্যাসের ব্যথা। জুলেখা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-ডাক্তার ডাকবো?
-না ঠিক হয়ে যাবে।এখন একটু ভালো বোধ হচ্ছে।
-এ মাসের টাকা পেলে একটা ভালো ডাক্তারের কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। আর আমি বলি কি এবার ভ্যাকসিনের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করে ফেলো। ভ্যাকসিনটা নিয়ে নাও। এর পর নাকি সরকার আর ফ্রী দেবে না। কিনতে হবে।
-তুমি দেবে না ভ্যাকসিন।
-আমি তো বাড়িতে থাকি।তোমার নেয়াটা বেশি জরুরি। আর ডাক্তার দেখানোটাও।
সে রাতে তুতুল বাড়ি ফিরলো না।রাত বাড়ার সাথে সাথে রাকিব সাহেবের বুকের ব্যথা বাড়তে লাগলো।জুলেখা জবার কাছে ফোন দিলো সে জানালো তারা সবাই নাকি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছে। এখন আসতে পারবে না। তুতুলের ফোনও বন্ধ পাওয়া গেলো।
রাকিব সাহেব বললেন
– আমার সমস্যা হচ্ছে না তুৃমি খামোখা অস্থির হচ্ছো আগামীকাল ডাক্তারের কাছে যাবোভাবছি,তুমিও সাথে যেও কিন্তু খোকার কাছে কে থাকবে?
জুলেখাবানুর চোখ ভারি হয়ে এলো।তিনি কান্না লুকাতে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

(১০)
শেষ রাতে ব্যথাটা একটু কমলে রাকিব সাহেব ও জুলেখা বানু দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন।হঠাৎ কারো বিভৎস গোঙানির আওয়াজে জুলেখা বানুর ঘুম ভেঙে গেলো, ঘুম ভাঙতেই দেখলেন অনেক বেলা হয়ে গেছে।পাশের ঘর থেকে রায়হান চেঁচাচ্ছে ,গোঙানির আওয়াজটা তার, রায়হানের সারা শরীর মল মূত্রে একাকার।
জুলেখা তাড়াহুড়োয় উঠতে গিয়ে রাকিব সাহেবের গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে চমকে উঠলেন,
-একি রায়েহানের বাবার শরীর এত ঠান্ডা কেন?
কিছুক্ষণ পরে জুলেখা লজ থেকে গগন বিদারী চিৎকার ভেসে এলো
– ওরে রায়হান রে এসে দেখে যা বাপজান কি সর্বনাশ হলো রে।তোর আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে।ওরে আমাদের কি হবে রে। কে দেখবে রে। আল্লাহ তুমি এতো নিষ্ঠুর কি করে হলে। আল্লাহ আল্লাহ……

শেষ।

গল্পঃ চরিত্রহীনা

148227861_7430_n

মহুয়া খুব গুছিয়ে ঠোঁটের রংটা ঘষে নিলো। চোখের কাজল,কপালের টিপ,মুখের রং আগেই মাখা হয়ে গেছে। ঠোঁট যেহেতু আগেই আঁকা ছিলো তাই শুধু রংটা লাগিয়ে নিলো। ব্যাস। আজ আর খোঁপা করেনি সে। সাধারণ বেনি করেছে। লাল হলুদ শাড়িতে আজ তাকে কনে বউ কনে বউ লাগছে। নিজের রূপে নিজেই খানিক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়নাতে নিজেকে বার কয়েক দেখে নিলো সে।

কালামের মা বলে, ভাঙা আয়নায় নাকি মুখ দেখতে নেই, অমঙ্গল হয়। কিন্তু মহুয়ার কপালটাই তো ভাঙা, তাতে করে ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলেই কি আর না দেখলেই কি। অমঙ্গল যা কিছু ঘটার তার সবটাই ঘটে চলেছে তার জীবনজুড়ে।
আয়না দেখে শেষ ফিনিসিং সেরে বুকের আঁচল সরিয়ে ব্লাউজটা ঠিক ঠাক সেট করে নিলো সে। এই ব্লাউজটা গত বছর বানানে। আগে ঠিক ঠাক ছিলো এখন ঢলঢলে হয়ে গেছে খানিকটা। গতর শুকিয়ে যাচ্ছে নাকি? গতর শুকালে তো বিপদ। না খেয়ে মরতে হবে যে। মহুয়ার মুখে খানিকটা চিন্তার রেখা দেখা দিলো,তবে তা কিছুটা সময়ের জন্য। হঠাৎ করে তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে সব ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায় সে। এবার তাকে বেরোতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে ভালো করে জানে ভাবনা চিন্তা করে কোন লাভ নেই, খামোখা শরীর খারাপ করবে। তার চেয়ে নিজের কাজে মন দেয়া ভালো। যা হবে তখন দেখা যাবে।

[২]
এতোক্ষণ জহির ড্যাবডেবিয়ে লোভী দৃষ্টিতে মহুয়ার সাজ পোশাক দেখছিলো।তার বউটা দিন দিন লাউ ডগার মতো থকথকে হয়ে উঠছে। দেখলে মাথা ঠিক রাখা কষ্ট। কিন্তু সেই সাথে মাগীর দেমাগও বেড়ে গেছে খুব। কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দেয় না আজকাল। মাঝেমধ্যে মনে হয় ছুটে গিয়ে জোড়া পায়ের লাথি কষে দেয় কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয়। তার তো পা ই নাই তো লাথি মারবেটা কি দিয়ে?
সুযোগ বুঝে মহুয়ার শরীর স্পর্শ করতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে।
– এখন বিরক্ত করো না তো।সাজ পোশাক নষ্ট হলে খদ্দের দাড়াবে?
জহির একবুক অভিমান নিয়ে বলল,
– আমার জন্য কি কিছুই নাই? সব ওই তোর খদ্দেরের জন্য?
– অসুস্থ মানুষের অত লোভ ভালো নয়। পারো কিছু? জানা আছে মুরোদ। দু মিনিটেই শেষ। খামোখা উঠা আর নামা।
সত্যি মিথ্যা যাই হোক জহিরের মাথা হঠাৎ গরম হয়ে ওঠে,
– ছেনাল মাগী, গতর খাকি,বারো ভাতারি।
মহুয়াও কম যায় না। সেও খেঁকিয়ে ওঠে।
– দেখ, বেশি গলা বাজি করবি না।সোজা ভাত বন্ধ করে দেবো। খাস তো বউ এর কামাই অত কথা আসে কোথেকে? ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোঁসাই। গতর বেচে খাওয়াচ্ছি আবার বাবুর লম্বা লম্বা কথা।আমার কি দায় পড়েছে তোকে পোষা। নিতান্ত তুই এককালে ভালোবেসেছিলি, তোর হাত ধরে ভিটে ছেড়েছিলাম বলে টানটা এখনো রয়ে গেছে। অন্য কোন মাগী হলে এতোদিনে আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলে দিতো।এই আমি বলে দিলাম।

হঠাৎ করেই জহির চুপসে যায়। পা দুখানা ট্রেনে কাটা পড়ার সাথে সাথে তার দুনিয়া ওলোট পালোট হয়ে গেছে। পালটে গেছে জীবনের সব হিসাব নিকাশ। চিল্লিয়ে লাভ হবে না। সাবধানী হতে হবে। মহুয়া দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে যে কোন সময় ছেড়ে চলে যেতে পারে।তখন বিপদ বাড়বে বই কমবে না। জহির শুনেছে মহুয়া নাকি কাজের নাম করে কার না কার সাথে বাদাম ফুচকা খেয়ে বেড়ায়। ফোনে হেসে হেসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে। মকবুল নাম তার, কাস্টমার নয় খোঁজ নিয়েছে সে, অনেকদিন ভেবেছে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু অশান্তির ভয়ে আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না তার। মহুয়া আর আগের মহুয়া নেই অনেক বদলে গেছে।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ এতোটা বদলে যায় কিভাবে?

জহির নিজেও নিজেকে প্রশ্ন করে সেও কি আগের মতো আছে? মনে হয় না, সে এতোটা বদমেজাজি কোন কালেই ছিলো না, মহুয়ার গায়ে হাত তোলার কথা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি, কিন্তু এখন…
মাঝে মাঝে এখন নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হয়। এখন তার চারপাশটা শুধু হতাশায় ঘেরা। অন্ধকার আর অন্ধকার। আলোর দিশার খোঁজে সে মরিয়া কিন্তু কোথায় আলো? তার মতো অসহায় মানুষের এ দুনিয়ায় কেউ নাই কিছু নাই। ব্যাটা ছেলেদের কাঁদতে নেই। তবুও তার কেবলি কান্না পায় আজকাল। জহির মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সে মহুয়াকে তার চোখের জল দেখাতে চায় না।

[৩]
মহুয়া জহিরের দিকে একবার তাকিয়ে বুঝতে পারলো অপরপক্ষ রণে ভঙ্গ দিয়েছে। এখন সে এক বুক অভিমান নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। জিতে গেছে মহুয়া, তবে এ জেতায় তৃপ্তি নাই, মনের মধ্যে কেমন যেন অতৃপ্তির ছায়া, তিক্ততার কাটা খচখচ করে বিঁধতে লাগলো তার। আসলে প্রতিপক্ষ যদি জোরালো না হয় তবে কোন কিছুতেই সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না। তবে মানুষটার জন্য এখনও তার মনে মায়ার টান রয়ে গেছে।

সে হাজার চেষ্টা করলেও তা অস্বীকার করতে পারছে না। অথচ মকবুল নামে একজন তার জীবনে প্রবেশ করেছে, তার সাথে সময় কাটাতে, গল্প করতে খুনসুটি করতে তার খুব ভালো লাগে।
একে ভালোবাসা বলে কিনা তা তার জানা নেই। তবে অন্য রকম একটা টান সে অনুভব করে।

ভালোবাসা! ভালোবাসা তো উবে গেছে সেই সে দিন যেদিন ট্রেনে জহিরের দু খানা পা কাটা পড়লো। অভাব অভিযোগের ঘরে ভালোবাসা থাকে না। থাকে ঝগড়া, ফ্যাসাদ, অবিশ্বাস। রসিক বাবুরা অবশ্য ভালোবাসা বলতে বিছানায় যাওয়াটাকেই বোঝে। মহুয়া সেই ভালোবাসার সওদাগরি ধান্দায় থাকে কি কায়দায় বড় অঙ্কের টাকা খসিয়ে নেওয়া যায়। তবে দালাল, মাস্তান আর কমিশনারের লোকদের উৎপাতে অস্থির অবস্থা। তাদের ম্যানেজ করতে করতে জান পেরেশান।এত কষ্টের রোজগারের সিংহভাগ চলে যায় তাদের পকেটে। মহুয়া অবশ্য চালাকি করে কারো কারো বিছানায় গিয়ে সমস্যাটা মিটিয়ে আসে।

তবে কমিশনারের ভাইটা বদমাশের বদমাশ। মহুয়া তাকে খুব ভয়ও পায়। পিশাচের পিশাচ বলা যায় তাকে। তার ডাক আসলে মহুয়ার আত্মা শুকিয়ে যায়। না জানি কত রকমের অত্যাচার সহ্য করতে হবে তাকে। বুড়ো বেটার শরীরের শক্তি নাই কিন্তু খায়েশ আছে ষোলআনা। কি সব যন্ত্র পাতি জোগাড় করে আনে কোথেকে কে জানে! খচ্চরের খচ্চর একটা। ওর কাছে গেলে ব্যাথায় গতর চার থেকে পাঁচদিন টনটন করে। কাজে বসতে পারে না ঠিক মতো। গত বছর তো রাহেলা ওর অত্যাচারেই মরলো। রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো সারা ঘরের মেঝে। কি বীভৎস! ভাবতেই এখনো গা শিউরে ওঠে। পুলিশ এলো লাশ নিয়ে গেলো। নিরীহ কিছু লোক হেনস্তা হলো তারপর যে কে সেই। সব আবার আগের মতো। মাঝে মধ্যে মনে হয় এই সব জঞ্জাল গুলোকে ধারালো ব্লেড দিয়ে এফোড় ওফোড় করে দিলে তবে শান্তি পাওয়া যাবে। তবে এও জানে শেষ পর্যন্ত সে টিকতে পারবে না।

[৪]
দিন এগিয়ে যায়, মহুয়া প্রতিদিনকার মতো আজও কাজে বেরিয়েছে। এখন বেলা বেশ খানিকটা পড়ে এসেছে। নিয়নবাতিগুলো জ্বলে উঠবে আরো কিছুটা পরে। মহুয়া হাঁটতে থাকে। এই সময়টা মকবুল আসে ঘন্টা খানিক কাটিয়ে যায়। খুব হিসেবি সে। মহুয়া যদিও আরও কিছুটা সময় থাকতে বলে কিন্তু টিউশনির অজুহাতে সে চলে যায়। আজও যথারীতি সে খুব সুন্দর করে সেজেছে। খোঁপায় বেলীফুলের মালা পড়েছে। গায়ে চমৎকার সৌরভের সুগন্ধী।
পরনের শাড়িটি টকটকে লাল। এটি তার বিয়ের শাড়ী।
সেই গাড়াগঞ্জ থেকে কেনা।খুব বেশিদিন আগের কথা নয়।
সে আর জহির বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথমে গাড়াগঞ্জ বাজারে উঠেছিল।
সেখান থেকেই বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটা করা হয়েছিলো । জহির তখন গ্রামে ট্রাক্টর চালাতো।হাতে কাঁচা পয়সার অগাধ আমদানি। পরবর্তীতে ঢাকা শহরে এসে সে অবশ্য সি এন জি চালাতো। দিন ছিলো সে সব। তখন পৃথিবীটাকে মনে হতো রঙিন আর মধুময়। তারপর যেদিন জহিরের পা দুখানা ট্রেনে কাটা পড়লো সেদিন থেকে শুরু হলো নরকময় জীবন। জমে মানুষের টানাটানিতে জহির সে যাত্রায় রক্ষা পেলে ও মহুয়ার হাত হয়ে গেলো শূন্য। ঘরের ঘটিবাটি থেকে যা কিছুর মূল্য ছিলো সব এক এক করে হাতছাড়া হয়ে গেলো। মোটামুটি স্বচ্ছল থেকে ভিখারি হয়ে পথে দাঁড়ালো তারা।

ভিখারি তবে সুস্থ সবল ভিখারিকে ভিক্ষা দেবে কে? জামিলার পরামর্শে বাসার কাজে ঢুকলো একরকম বাধ্য হয়ে। কয়েকদিন যেতে না যেতে ফাঁকা বাড়িতে গৃহকর্তা দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলো সে। শহরের শিক্ষিত জ্ঞানী গুণী মানুষ যে এতো নোংরা হতে পারে তা তার কাছে অজানা ছিলো। ফুলমতি সব শুনে জানালো ওই সব কাপুরুষদের সুখ দিয়ে লাভ নাই। মনে রাখবে না অথচ সুযোগ পেলে খাবলে খাবে। অসহায় মেয়ে মানুষের গতর হলো আসল শত্রু। তারচেয়ে এই গতর কাজে লাগিয়ে দু পয়সা ইনকাম করলে তাতে অন্তত কদিন ভালো মতো খেয়ে পড়ে বাঁচা যাবে। বুদ্ধিটা পছন্দ হলো তার। উপায়ও ছিলো না কোন।

সেই থেকে শুরু, ভালো মন্দ পাপ পূন্য জানে না মহুয়া। দুটো ভাত জুটছে এতেই সে খুশি। ভাতের জ্বালা বড় জ্বালা। হঠাৎ করে আবার জহিরের কথা মনে হতেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজও বড্ড বেশি বাজে ব্যবহার করেছে সে। অত বেশি করে না বললেও পারতো। ইদানীং জহির কিছু বললেই সে প্রতি উত্তরে বেশি করে কথা শোনায় এটা যে ঠিক না সেও বোঝে কিন্তু মাথা কারণে অকারণে সবসময় গরম হয়ে থাকে কি করবে সে। সুখের দিনগুলো কোথায় যে হারালো কে জানে। আর আসবে না ফিরে সে সব দিন। সম্পর্কও আর হয়তো কখনো ঠিক হবে না।
ফোন বেজে উঠতে মহুয়ার মন খুশি ঝিলিক মেরে ওঠে। মকবুলের ফোন। মহুয়া ফোন রিসিভ করে।
– হ্যালো জানটু কোথায় তুমি?
– তোমার পিছনে?
মহুয়া পেছন ফিরে অবাক হয়ে যায়,মকবুল এক গুচ্ছ গোলাপ হাতে দাড়িয়ে আছে।
সে ছুটে যায় মকবুলের দিকে তৃৃষিত চাতকের মতো।

[৫]
সময়ের সাথে সাথে মানুষ কত বদলে যায়,বদলে যায় তার ইচ্ছেগুলো,বদলে যায় তার জীবনযাপন বদলে যায় তার পৃথিবী। জীবন জীবিকার তাগিদে কোনদিন মহুয়া স্বপ্নেও ভাবেনি দুটো ভাতের জন্য তাকে রাস্তায় নামতে হবে। প্রতিদিন তাকে একটু একটু করে মরতে হবে। দেখতে দেখতে আরো একটা বছর চলে গেলো, এর মধ্যে কত শত মানুষের সাথে দেখা হলো, কাজে বসা হলো। বেশির ভাগই কামুক শ্রেণির, তার মধ্যে যে ভালো মনের অধিকারী লোক একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়।

এই যে মকবুল। পড়াশোনা শেষে ছোট খাটো একটা চাকরি করে, ভালোবাসে গল্প কবিতা লিখতে। সাত বছরের প্রেমিকার সাথে যেদিন সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলো এক তরফা ভাবে, কি যে অসহায় হয়ে বসেছিল পার্কে। দেখে খুব মায়া হয়েছিল মহুয়ার। প্রথমে ভেবেছিলো খদ্দের তারপর…….. সারা রাত বেচারার সাথে পার্কে বসে ছিলো সে। তার খুব মায়া করছিল ছেলেটার জন্য, মকবুলও জানিয়ে হালকা হয়েছিলো মনের যতো কষ্টের কথা বলে, কারো সাথে সে কাজে বসেনি সেরাতে। সেই থেকে শুরু, এরপর থেকে যেদিন মকবুল আসে মহুয়া নিয়ম করে কাজে বসে না আর। মকবুলের সাথেই তার সময় কাটাতে ভালো লাগে।কত হাসি কত গান ঠাট্টা মজা। কেটে যায় সময় চোখের পলকে।

মানুষ এত মজার এত ভালো এতো সাদাসিধা কি করে হয়! এমন করে সময় কাটাতে কাটাতে কবে কবে যেন দুজন দুজনের প্রতি আরো অনুরক্ত হয়ে পড়ে তারা। মকবুল আর মহুয়া ঠিক করে তারা বিয়ে করবে, সংসার বসাবে, চলে যাবে দুর শহরে, আবার বাঁচবে নতুন করে। জহিরের কথা সে জোর করেই মন থেকে মুছে ফেলবে বলে ঠিক করে। কিন্তু সব সম্পর্ক কি চাইলেই মুছে ফেলা যায়? আজ সেই দিন। মকবুল মনে হয় এতোক্ষণে চলে এসেছে। পার্কের পিছনে বুনো খেজুর গাছটার নিচে দাঁড়াবে বলেছিলো। মহুয়া ধীরে ধীরে হাঁটছে। মনটা খুশি খুশি হবারই কথা কিন্তু কিছুতেই সে খুশির কোনকিছু উপলব্ধিতে আনতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে তার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠছে। কিসের এতো পিছুটান….. তার চোখ জ্বালা করছে।

যত পথ সে হেঁটে এগোচ্ছে ততই বিষণ্নতা অস্থিরতা বেড়ে চলেছে বুকের মধ্যে। এমন কেন হচ্ছে। তবে কি জহির কে সে এখনও ভালোবাসে? সব ভালোবাসা তবে ফুরিয়ে যায়নি? ঘুরে ফিরে জহিরের অসহায় মুখটাই ভেসে উঠছে বার বার। কিন্তু মকবুল? তার জীবনে মকবুলের স্থান কোথায়? এমন জটিল পরিস্থিতিতে সে কোনদিন পড়েনি। আসার সময় জহির কে কিছু বলে আসা হয়নি তার। বলা যায় একরকম সে পালিয়ে চলে এসেছে। আসলে সে আজ জহিরের মুখোমুখি হবার সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি। কি করে অসহায় মানুষটিকে সে বলবে আমি আর তোমার সাথে থাকতে চাই না। তোমাকে আমার আর ভালো লাগে না।

আমি নতুন করে ঘর বাঁধতে চাই। আমি একটু সুখের মুখ দেখতে চাই। আমি হেসে খেলে পাখির মতে উড়তে চাই। আমি আর এই পাপের জীবনের বোঝা টানতে পারছি না। প্রতিদিন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে আসতে আসতে আমি ক্লান্ত। আমি এই বেশ্যার জীবন চাই না। আমি আর প্রতি দিন তিলে তিলে মরতে চাই না। অনেক কথা বলার ছিলো, বলা হয়নি। বলতে গিয়ে দ্বিধা এসে ভর করেছে।

আচ্ছা সে যদি আজ বাড়ি না ফেরে তবে কি জহির তাকে নিয়ে ভাববে? চিন্তিত হবে? তাকে ছাড়া তো লোকটা এক পাও চলতে পারে না সে চলে গেলে কি হবে তার? হঠাৎ করে মহুয়ার মনের ভিতর এসব কি হচ্ছে? লোকটা তো তাকে ইদানিং বেশির ভাগ সময় দূর ছাই করে, সময়ে অসময়ে মারধোর করে সুযোগ পেলে যদিও আগে এমনটা কখনো করতো না। জহিরের ইদানিংকার আচরণে সে প্রচন্ড বিরক্ত। ঘরে জ্বালা বাইরে জ্বালা কাহাতক সহ্য হয়। তাই তো সে জহিরের সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। মকবুলকে সে কথা দিয়েছে। তার সাথে মহুয়া থাকবে। মকবুল বলেছে তাকে আর গতর বেচতে হবে না। মহুয়ারও এখন আর গতর বেচতে আর ভালো লাগে না। এ লাইনে সব পুরুষগুলোই জানোয়ার। সুযোগ পেলে খুবলে খুবলে খাওয়ার ধান্দা। তার যে কত কষ্ট হয় সেই কথাটা একটুও ভাবে না কেউ। বেশ্যাও যে রক্ত মাংসের মানুষ এ কথাটা কে বোঝাবে কাকে?

ইদানীং বেশির ভাগ খরিদ্দারই ওষুধ খেয়ে আসে। কাজ শেষেও ছাড়তে চায় না। ব্যাথা করে, তীব্র যন্ত্রণায় চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসে তবুও খরিদ্দারের খায়েশ মেটে না। কখনো কখনো এক জনের কথা বলে পাঁচজন এসে হাজির হয়। সে রাতগুলো যেন দোজখের আজাব নেমে আসে। মকবুলের সাথে সম্পর্কে মহুয়া নতুন করে আশার আলো দেখতে পেয়েছে। আহ এবার বুঝি মুক্তি মিলবে,এই নরক যন্ত্রণার। কিন্তু মহুয়ার ভাবনায় হঠাৎ ছেদ পড়ে, একটু বসতে পারলে ভালো হতো। হঠাৎ করে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করে। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তার কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। মকবুল মানে তো নতুন জীবন, নতুন করে বাঁচা তাহলে নতুন করে কেন এই সিদ্ধান্তহীনতা ।আর জহিরের সাথে থাকা মানে অপমান অপদস্তের জীবন।

[৬]
তার যোগ্যতা সীমিত। তার উপরে চরিত্রে দাগ লেগে গেছে। অন্য কাজের চেষ্টা সে অনেকবারই করেছে।বারবনিতাকে কেউ কাজ দিতে চায় না। এ লাইনে ঢোকা যত সহজ বের হওয়া তত কঠিন। মকবুলের সাথে সে অন্য শহরে গিয়ে থাকবে নতুন করে ভালোভাবে বাঁচবে বলে সে জহিরের হাত ছেড়ে দিয়ে এসেছে, মানুষ সমাজ তাকে স্বার্থপর, হৃদয়হীনা বলে বলুক। লোক নিন্দার ভয় সে আর করে না।

বেশ্যার আবার মন থাকে নাকি? কিন্তু হঠাৎ করে তার এমন লাগছে কেন? কিসের দ্বিধা এসে ভর করছে তার মনের মধ্যে? এমন কেন হচ্ছে তার সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। সে কি ফিরিয়ে দেবে মকবুলকে? এদিকে মকবুলের ও খোঁজ নেই, রাত বাড়ে, ফোন দিলে ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। তবে কি মকবুল মত বদলেছে? নাকি কোন বিপদে পড়েছে?

তাকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে সে কি কোন চাপের মুখোমুখি। মহুয়া যে চরিত্রহীনা বেশ্যা সে তো মকবুল ভালো করেই জানে। তবে তার পরিবার পরিজন জানে কি? ধীরে ধীরে রাত আরো বাড়ে, তার বুকেও কষ্ট বাড়ে, অভিমান জমা হয়, অন্য রকম একটা শূন্যতা এসে ভর করে।চোখের কাজল কান্নায় ভেসে যায়। এতোকক্ষণে সে বুঝে গেছে সব মিছে সব ফাঁকি মকবুল আসবে না। এই তার নিয়তি,চরিত্রহীনা বেশ্যার কথা স্বয়ং ইশ্বর ও ভাবে না। শেষ রাতে মহুয়া বাড়ির পথ ধরে, মকবুল অজানা কারণে আজ আর আসেনি। আজ বিশেষ দিন ছিলো,মকবুল পর্ব হয়তো এখানেই শেষ।

এমনই তো হয়। নিজেকে বোঝায় সে, যাক নিজের স্বার্থে অমানবিক হলে চলবে না। সে চলে গেলে কে দেখবে জহিরকে, একসাথে বাঁচবে বলে শপথ করেছিলো একদিন তারা। আজ নিজের স্বার্থে সে শপথ কি ভাঙা ঠিক হবে? যদি একই ঘটনা উলটো হয়ে ঘটতো তার জীবনে? তখন জহির হয়তো তাকে ছেড়ে যেতো। সে যেতে চাইলে যেতো। সে সব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। জহির তার প্রথম ভালোবাসা সে শেষ ভালোবাসাই হয়ে থাক। কেউ তাকে ভালো না বাসলেও জহির একদিন তাকে ঠিকই ভালো বেসেছিলো। এক সাথে অনেকটা পথ হেঁটেছিলো, আজও সেই চলা শেষ হয়নি যদিও ভালোবাসা টুকু আর অবশিষ্ট নেই তবুও এক জীবনে এটুকুই তার স্বার্থকতা।বাকি সব মিছে। সরে গিয়ে দূরে গিয়ে ভালো থাকুক মকবুল। জহিরই তার অবলম্বন হয়ে থাকুক, হোক সে অথর্ব, অকর্মণ্য।

শেষ।

গল্পঃ ভূত দর্শন

unnamed

[১]
ফয়সাল এর আগে কখনো একা একা শহরে আসেনি। যদিও শহরটা তার গ্রামের কাছাকাছি তবুও বিভিন্ন কারণে আসা হয়নি তার। ফয়সালের বয়স আঠারো বছর তিন মাস বারো দিন, সবচেয়ে অবাক ব্যাপার এতটা বয়সে বাবা মাকে ছেড়ে সে একা একা থাকেনি কোথাও কোনদিন।
ভীষণ রকম মা বাবা নির্ভরশীল ছেলে সে। একমাত্র ছেলে হবার কারণে সম্ভবত এমনটা। জহির ও সাবেরার চোখের মণি যাকে বলে, একটু সময় ছেলেকে না দেখলে কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠেন তারা।
এইচ এস সি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত খোঁজ খবর নিতে চাচাতো ভাই রবিনের সাথে এক বিকালে সে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।স্বাভাবিক ভাবে জহির সাবেরা দম্পতির বিষন্ন মনে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে ছেলেকে বিদায় দেন।
পথে তেমন সমস্যা না হলেও হঠাৎ করে গাড়ির ইঞ্জিণ বিকল জনিত সমস্যার কারণে তারা শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যায়।
মফস্বল শহর, সেই কারণে হয়তো রাস্তায় লোক চলাচল কম।রিক্সা না পাওয়াতে তারা দু’ভাই কিছুটা হেটে গন্তব্যে পৌছে গেলো অল্প সময়ের মধ্যে। একটু দ্রুত হেটে তারা পথটুকু অতিক্রম করলো কারণ আকাশ জুড়ে তখন ঘণ কালো মেঘ।যখন তখন বৃষ্টি চলে আসতে পারে।
গলির ভিতরে ছোটখাটো দোতলা বাড়ি । এখনো নির্মাণাধীন।রবিন মোটামুটি ফ্রিতে এখানে থাকে। বাড়িওয়ালা তার মামার বন্ধু হবার সুবাদে বাড়ির কাজ দেখাশোনার বিনিময়ে সে এই বাড়িতে থাকে আর কি। কেয়ারটেকারের কাজটা তাকে দিয়ে দিব্যি চলে যায়।
যাহোক বাড়ি দেখে ফয়সালের বেশ পছন্দই হলো। পাড়াটিও নিরিবিলি বলে মনে হলো। যদিও এতো রাতে ভিতরের দিকে রাস্তায় লোকজন না থাকাটা স্বাভাবিক।
তালা খুলে বাসায় ঢুকে আলো জ্বালতেই রবিন একটা জরুরি কল পেয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করে। যাওয়ার আগে বলে গেলো আমি এক্ষুনি আসছি। একটা জরুরী কাজ আছে, ফ্রিজে খাবার রয়েছে তুই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গ্যাসে খাবার গরম করে খেয়ে নে।আমি এক্ষুনি আসছি ।
ফয়সালের যদিও একটু ভয় ভয় করছিলো।তবে সেটা সে প্রকাশ করলো না।পাছে রবিন হাসাহাসি করে । এমনিতে সে মায়ের আঁচলে থাকে বলে তাকে নিয়ে আত্নীয় স্বজনের সবাই হাসা হাসি করে। নানা রকম টিকা টিপ্পনী কাটে সবসময়।
সে ঢোক গিলে শুধু বলল,
-ভাইয়া তুমি দেরি করোনা।
– আরে না ভয় কি ? পুরো বাড়ি ফাকা কেউ নেই তুই নিশ্চিন্তে থাক আমি যাবো আর আসবো।
বাসাটা বেশ বড় বলে মনে হচ্ছে। মেঝেটা অমসৃণ ।দেয়ালগুলোতে রঙের প্রলেপ পড়েনি এখনও। প্রথমে ফয়সাল চারদিকে এক নজর
চোখ বুলিয়ে নিলো ,তারপর জামা কাপড় পালটে ওয়াশ রুমে ঢুকলো।
ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে হতে একবার মনে হলো গোসল করতে পারলে ভালো হতো। আজ বেশ গরম পড়েছে। কিছুক্ষণ পরে তোয়ালে নেবার উদ্দেশ্য দরজা খুলতেই খেয়াল করলো মিষ্টি একটা গন্ধে ঘরটা ভরে গেছে।
ফয়সাল অবাক হলো? পারফিউমের গন্ধ এটা নিশ্চিত। পরিচিত কোন ফুলের এমন সুবাস নেই।বাসায় তো অন্য কেউ নেই। তাহলে? যাহোক সে গোসল সেরে বুঝতে পারলো যে তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
সাত পাঁচ না ভেবে সে খাবার গরম করতে রান্নাঘরে ঢুকলো।বাসায় থাকতে সে মায়ের রান্নাবান্নায় অনেক সাহায্য করে দিতো সেহেতু অভ্যাস থাকার কারণে চুলা জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে তার খুব একটা অসুবিধা হলো না।
খেতে বসেছে হঠাৎ তার মনে হলো ঘরের ভিতরে কেউ একজন নূপুর পায়ে দিয়ে হাটছে। সে পিছন ফিরে এদিক ওদিক চাইলো।
না কেউ নেই। সে কি ভুল শুনছে? এখন অবশ্য আওয়াজটা আর নেই। আশ্চর্য! নূপুরের আওয়াজ কোথেকে আসবে?
কিছুক্ষণ কান খাড়া করে নিজেকে নিজেই বোকা ভেবে বকা দিলো তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলো সে।
তখন খাওয়া প্রায় শেষ। বেসিনে যাবে হাত ধুতে। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। এরকম মনে হচ্ছে কেন? কি হচ্ছে কি তার সাথে?
এরকম হবার তো কথা নয়? সেতো দরজা লক করে ছিটকিনি তুলে দিয়েছে।তাহলে?
যাহোক সে খাওয়া শেষে আবোল তাবোল চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যাগ খুলে একটা গল্পের বই বের করলো । তবে কিছুতেই বইয়ে মন বসাতে পারলো না।মনের মধ্যে কেমন যেন অশান্তি অশান্তি লাগছে।
কষ্ট করে বইয়ের ক’পাতা পড়েছে সবে হঠাৎ তার কানে মেয়ে কণ্ঠের গুণ গুনিয়ে গান গাওয়ার আওয়াজ ভেসে এলো। ভারি মিষ্টি গলা তো!কিন্তু এখানে গান গাইবে কে?
নাকি সে ভুল শুনছে?
এবার কিন্তু সত্যি সত্যি তার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। অনেক গুলো ঘটনা ঘটে গেছে যার কোন ব্যাখ্যা সে পাইনি।এমন হবার কারণ কি?
ঘরে কি কেউ আছে?
এসব ভাবতে ভাবতে বলা নেই কওয়া নেই দুম বিদ্যুৎ চলে গেল।
[২]
এবং কাছাকাছি সময়ে ঝড় উঠলো তারপর শুরু হলো বৃষ্টি।
বৃষ্টি দমকা হাওয়া সাথে করে ঘর অবধি এসে পৌছাচ্ছে ,জানালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো জানালা খুলল কে? নাকি খোলা ছিলো।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফয়সাল দেখলো কেউ একজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো এবং দ্রুত গতিতে জানালার কপাট বন্ধ করতে লাগলো আর সেই সাথে একটু আগের পারফিউমের গন্ধটাও নাকে এসে লাগলো। কি আশ্চর্য নূপুরের আওয়াজটাও ফিরে এসেছে।
কে ? কে ওখানে ?
ফয়সাল চেষ্টা করলো কথাগুলো বলতে কিন্তু কে যেন তার গলা চেপে ধরেছে মনে হলো । ক্রমশ তার গলার ভিতরটা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। ভয়ে আতঙ্কে সে খুব দ্রুত জ্ঞান হারালো।
তারপর যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো তখন প্রথমে সে চোখ মেলে দেখলো তার চাচাতো ভাইয়ের উদ্বিগ্ন মুখ।সে বেচারাও খুবই চিন্তিত তা বোঝা যাচ্ছে তার চোখে মুখ দেখে।
চোখ মেলতেই সে প্রথমে জানতে চাইলো,
-কি রে ফয়সাল এখন কেমন লাগছে? ভালো বোধ করছিস তো? ডাক্তার ডাকবো?
ডাক্তারের কথা শুণে ফয়সাল সব ঝেড়েঝুড়ে ধড়মড়িয়ে ঠেলে উঠলো্ ডাক্তারকে তার দারুণ ভয় কারণ ছোটবেলাতে একবার ইনজেকশান পুশ করা নিয়ে হুলুস্থুলুস কান্ড ঘটে ছিলো।
ঘরের মধ্যে সে রবিন ভাইয়া আর অচেনা একজন স্ত্রীলোক। এই মেয়েটি সেই মেয়েটি কি? যাকে দেখে সে ভয় পেয়েছিলো?
রবিন আবার জানতে চাইলো
-আর ভয় লাগছে?
ফয়সাল মাথানোয়ালো । এখন তার ভীষণ লজ্জা লাগছে তবে অচেনা মেয়েটি কে জানতেও ইচ্ছে করছে।
রবিন মনে হয় ফয়সালের মনের ভাব বুঝতে পারলো।একে চিনেছিস?
ফয়সাল মাথা নাড়ালো। রবিন হো হো করে হেসে উঠলো তাই তো তাইতো চিনবি কি করে পরিচয়ই তো করে দেইনি।
যাহোক এবার আসল কথায় আসা যাক, বৃষ্টি তখনো পড়লেও বিদ্যুৎ চলে এসেছে , ফয়সালও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।পূর্ববর্তী ঘটনা এরকম।
রবিন মায়ার কাছ থেকে ফোন পেয়ে সেই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে বাড়িতে খুব দ্রুত চলে এসেছিলো। মায়া হচ্ছে সেই অজানা অচেনা নারী মূর্তি।
আসলে সে ভূত বা প্রেত কোনটাই নয়। সে রবিনের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী । এই বউয়ের কথা বাড়িতে তো নয় এমন কি ফয়সালকেও জানাইনি রবিন, মায়াকে সে মাত্র কিছুদিন হলো বিয়ে করেছে।
বিয়েতে মায়ার পরিবারের পূর্ণ সম্মতি ছিলো সে কারণে রবিনকে তেমন একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি তবে সমস্যা একটা আছে তা হলো মায়ার পরিবার তথাকথিত নিচু বংশ যা রবিনের বাবা বেঁচে থাকাকালীন এই বিয়ে মেনে নেবে কিনা সন্দেহ।রবিন আধুনিক ছেলে সে এই বংশ জাত পাতের ধার ধারে না।কিন্তু তার বাবা এবং পরিবার সমাজ নিয়ে চলেন।তাই সাহস করে রবিন আর বাড়িতে এই মেয়ে বা তাকে বিয়ের কথা তুলতে পারেনি।
যদিও রবিনের বাড়ি পর্যন্ত কানাঘুষো পৌঁছে গেছে রবিন নাকি শহরে কোন এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। বিয়ের কথাটা অবশ্য কেউ জানে না।
তো রবিন বাড়িতে যাবার আগে বৌকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।কারণ মায়ার খালি বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না ভেবে।আর মায়াও কদিন ধরে বাবার বাড়ি যাবে বলে বায়না করছিলো।
মায়া আজ বিকালে রবিন আসছে বলে বাড়িতে ফিরে আসে রবিনকে চমকে দেবে বলে । এখানে এসে গোসল খাওয়া দাওয়া শেষে একটু ঘুমিয়ে পড়ে।
আর এদিকে কমন চাবি দিয়ে ডোর লক খুলে রবিন ও ফয়সাল ঘরে ঢোকে এবং তৎক্ষনাৎ রবিন সাম্যের জরুরি কল পেয়ে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশে। সাম্য রবিনের ছোটবেলার বন্ধু।
ফায়সাল যখন ওয়াশ রুমে তখন বাড়িতে কে এলো দেখার কৌতূহলে মায়া ডাইনিং রুমে ঢুকে। সেই মুহূর্তে রবিন ফোন দেয় মায়াকে, মায়া জানায় সে বাড়িতে ফিরে এসেছে। তখন রবিন জানায় যে তোমার এখন ফায়সালের সামনে যাওয়ার দরকার নাই। আমি বাসায় ফিরে সব ম্যানেজ করবো। তুমি নিজের ঘরে থাকো। না হলে ফয়সাল এমনিতে লাজুক মুখচোরা ছেলে ও তোমাকে হঠাঃ দেখলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে।আর সে কারণে পাশের ঘর থেকে মায়া আর বাইরে আসেনি। তবে ঘরের ভিতরে হাঁটা চলার আওয়াজে পায়ের নূপুর বেজেছে। আর স্বভাব সুলভ কারণে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠেছে নিজের অজান্তে যা শুণে ফয়সাল বিভ্রান্ত হয়েছে।
আর সব শেষে
বিদ্যুৎ চলে যাবার পর ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে জানালা বন্ধ করতে মায়া এঘরে ঢুকলে ফয়সাল মায়াকে ভুত ভেবে অজ্ঞান হয়ে যায়।
সবশুনে ফয়সাল সত্যি সত্যি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো। আর ভাবতে লাগলো সে এতো বোকা কেন?
সমাপ্ত
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক

All of my love about you

5605b15b

‘Is that you!
Why did you become so strange!
Is that me!
Why would I give you so much pain!
How did you become as unknown as this?
How did I become so change like this?
Let us remove all the heartaches;
Why don’t you realize that I am nothing without you?
All my love about you;
Forgive me, how much sin I have with you Many nights I had been crying with deep agony And I had been sunk in the hollow;
Please take me back to your heart;
Why don’t you understand that I am nothing without you?
All my love about you;
Forgive me, how much sin I have with you you always come to mind;
While I thought I would forget you I can’t forget those days I left behind;
Why don’t you understand that I am nothing without you?
All of my love about you; Forgive me, how much sin I have with you…

.
#Rafiqul_Islam

গল্পঃ স্বার্থের পৃথিবী

unnamed

প্রথম পর্ব
জয়তুনের আজ শেষ কর্মদিবস ছিলো। শেষ কর্মদিবসে সাধারণ চাকরিজীবিদের মন খারাপ হলেও কিছু না কিছু দেনা পাওনার ব্যাপার থাকে। ভবিষ্যৎ বলতে একেবারে সব শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু জয়তুনদের মতো গৃহকর্মীদের কোন পাওনা থাকে না বরং দেনার দায় থাকে। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কালো মেঘ এসে জড়ো হয় ভাবনার আকাশে।

জয়তুনের মনের আকাশেও আজ কালো মেঘের ঘনঘটা। স্বাভাবিকভাবেই জয়তুনের মনটা ভীষণ রকমের খারাপ।চিন্তায় তার মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। বর্তমান সময়ের আগে পিছে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই তার চোখে পড়ছে না আজ। সে যেনো এক দিকভ্রান্ত পথিক। পথ চলছে দিশেহারা অসহায় নাবিকের মতো।

এবার কি হবে তার? কে দেখবে তাকে? কে তাকে আশ্রয় দেবে।সে জানে সে প্রথমে বাস্তুুচ্যূত হবে। তারপর হয়তো ভিক্ষাই তার শেষ পরিণতি। এগুলো তার অভিজ্ঞতা থেকেই উপলব্ধি করতে পারে। পুরোটা জীবন টিকে থাকার জন্য সামান্য দুমুঠো ভাতের জন্য লড়াই করে করে আজ সেই জীবনের কাছে তাকে অসহায় আত্নসমর্পন করতে হচ্ছে। কত জনের কত কাজে লেগেছে সে। আজ তাকে কেউ মনে রাখেনি। না সংসারে না কর্মক্ষেত্রে।

বয়সের ভারে কাজে ধীরগতির কারণে একে একে সবগুলো বাড়ির ঠিকে কাজগুলো অপেক্ষাকৃত তরুণ গৃহকর্মীদের হাতে চলে যাচ্ছিলো বছরখানিক ধরেই, সেও বুঝতে পারছিলো এবার তাকে ফিরতে হবে, পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছাই তার নেই কোনকালে।

বয়স হবার কারণে সাথে পুষ্টিকর খাবারের অভাবে এমনিতে শরীর ভাঙছিলো দ্রুত। তার কাজের গতি কমতে শুরু করার সাথে সাথে তার চাহিদাও কমে আসছিলো। এটাই দুনিয়ার নিয়ম দুনিয়া চলে আপন স্বার্থে। এছাড়া অসুখ বিসুখও ইদানীং বেশি রকম জ্বালাচ্ছে জয়তুনকে। কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না যেন।

সিকদার বাড়ির কাজটা সে অনেক কষ্টে টিকিয়ে রেখেছিল।যদিও নতুন বৌমা তাকে কেন জানি একটুও পছন্দ করেনা। শাশুড়ির পুরানো লোক বলেই হয়তো অপছন্দের মূল কারণ।বৌ শ্বাশুড়ীর দ্বন্দে সে হলো বলি। গরীবের কপালই এমন।

গতকাল খবরটা জানার পর থেকে তার চোখে অশ্রু জলে বান ডেকেছে। কিছুতেই সে জল সে সামলাতে পারছে না।বুকের মধ্যে জ্বলে জ্বলে উঠছে। সে কত কাকুতি মিনতি করলো। যে ফারহান শিকদারকে সে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে নিজের ছেলের মতো মনে করেছে। আজ তার বিয়ে করা বউ এসেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পথ দেখিয়ে দিলো কত অবলীলায়। নোংরা অপরিষ্কার ধীর আরো কত অপবাদ। অথচ কত আপন ভেবেছিলো এই পরিবারটিকে।আসলে এই দুনিয়ায় কেউ তার আপন নয়। কেউ তার কথা ভাবে না। হায়রে স্বার্থের দুনিয়ােএমন দুনিয়ায় না জন্মানোই ভালো ছিলো।

জীবনের বাকি কটা দিন তার কেমন করে কাটবে এই ভাবনায় তার পৃথিবী আজ ওলোট পালোট হয়ে গেছে। অতীত যেন ফিরে ফিরে আসছে বারবার। বড় কষ্টের জীবন তার। সাত বছর বয়সে বাবা তাদের ছেড়ে যাবার পর মায়ের কাছে মানুষ সে। মায়ের সংসারে স্বচ্ছলতা ছিলো না কোন কালেই। মা ছিলো তার মতোই গৃহকর্মী। টেনেটুনে চলতো সংসার।

তারপর নানা চরাই উৎরাই পেরিয়ে মালেকের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধা। মালেক বড় ভালো মানুষ ছিলো। খুব খেয়াল রাখতো তার। নিজেও খুব ছিমসাম থাকা পছন্দ করতো। তারা একই বস্তিতে থাকতো। সেখান থেকে চেনাজানা পরিচয় তারপর বিয়ে।

অভাবের কারণে যদিও মালেকের লেখাপড়া তেমন এগোয়নি তবু লেখাপড়ার প্রতি তার ভালোবাসাটা ছিলো অকৃত্রিম। সে স্কুলের সেকেন্ড বয় ছিলো। পড়াশোনার প্রতি খুব আগ্রহ ছিলো সেজন্য হয়তো পড়াশোনার মূল্যটা বুঝতো।

সংসার বড় ছিলো যদিও তারপরেও চার ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্ট হলেও ভালো স্কুলে পড়াতো তাদের।
বেবিট্যাক্সি চালাতো মালেক। দিনকাল ভালোই কাটছিলো। কপাল খারাপ হলে যা হয়। হঠাৎ করেই মৃত্যু হলো তার, বালির ট্রাকের সাথে বেবিট্যাক্সির মুখোমুখি সংঘর্ষ, হাসপাতালে নেয়ার ঘন্টা পাঁচেক পরে তার মৃত্যু। মুহুর্তেই তছনচ হয়ে গেলো সব।

চোখে সরষে ফুল দেখা যাকে বলে সেই রকম অবস্থা হলো জয়তুনের। একে একে তিন মেয়েকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে হলো অভাবের দায়ে। নিজে ফিরে গেলো মায়ের পেশায়। মালেকের সাথে বিয়ে হবার আগে যদিও টুকটাক করতো। মালেকের মৃত্যুর পরে তা হয়ে গেলো তার স্থায়ী পেশা। ছেলে লেখাপড়ার ভালো না হলেও মালেকের কাছে দেওয়া কথা মোতাবেক ছেলেকে কষ্টে সৃষ্টে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ালেন। এক সাহেবকে ধরে চাকরিও হয়ে গেলো তার।

বড় মেয়ে ফুলিকে গ্রামের দিকে গৃহস্থ পরিবারে বিয়ে দিলেন। মেজো মেয়ে জুলিকেও শহরে কর্মঠ একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিলেন কিন্তু তার জীবনের ঘটনাই যেন পুনরাবৃত্তি হয়ে ফিরে এলো মেঝো মেয়ের জীবনে। অল্প বয়সে বিধবা হলো মেয়েটি, কোলে তার জমজ সন্তান। বোঝা আরো বেড়ে গেলো। কেত ঝামেলা কাজের লোক ন্খেই শুধু খাওয়ার লোক বেড়ে গেলো। বোঝা টানতে হলো সব জয়তুনকে। এখন সে অবশ্য আবার বিয়ে করেছে নিজের পছন্দে, লোকটা দুই নম্বরি। জয়তুন তাকে পছন্দ করে না একটুও।জুলির সে সংসার বড় অশান্তির সংসার।

ছোট মেয়েটা এরই মধ্যে এক লাফাঙ্গা ছেলের পাল্লায় পড়ে না বলে না কয়ে ঘর ছাড়লো। তার খোঁজ খবর পাওয়া গেলো না কোনদিন। হয়তো পাচার হয়ে গেছে, সবাই তাই বলে, কে জানে। আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না সে কেমন আছে কোথায় আছে। জয়তুনের মনটা চায় যেখানেই সে থাকুক ভালো থাকুক।

তার মধ্যে এগিয়ে চলে জীবন, জীবনের নিয়মে। এভাবেই একে একে কেটে গেলো জীবনের বাষট্টিটি বছর।
এর মধ্যে ছেলে বিয়ে করলো। টুকটাক ঝামেলা হতে নিজেই সরে এলো সে। জয়তুন বরাবরই ঝামেলা এড়িয়ে চলা মানুষ।যেহেতু সে রোজগেরে সেহেতু লোকের কথা শুণনে ভাত সে মুখে তুলতে পারবেনা কিছুতেই।

ছেলে মাসে দুমাসে দেখা করে যায়। বউমা তাকে কেন জানি দুচোখ পেড়ে দেখতে পায় না। অথচ জয়তুন তাদের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে কিছু একটা করতে। ছেলেটা একটু মাটি কিনতে চায়। জয়তুন মাসের শেষে যে টাকা জমে দুই ঈদে যা যাকাত ফিতরা পায় সবটাই সে ছেলের হাতে তুলে দেয়। তাপেরেও তাদের কাছে সে ভালো না।
জয়তুন চোখ মোছে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে না আসতেই সে অটো রিক্সার ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যায় পার্শ্ববর্তী ড্রেনে। প্রচন্ড ঝাঁঝালো রোদের, সীমাহীন গরমের দুপুরে গলির রাস্তায় লোকজন কম হওয়াতে সুযোগ বুঝে দোষী ড্রাইভার কেটে পড়ে দ্রুত আর জয়তুনের দুর্বল শরীরটা আকষ্মিক আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে অনেকটা সময় ড্রেনের পাশে।

দ্বিতীয় পর্ব

কে যেন মিহি সুরে ডাকছে,
-জয়তুন, জয়তুনরে ও জয়তুন, ওঠ উঠে পড়। উঠোস না ক্যান? ও জয়তুন।
কে ডাকছে কে জানে? কন্ঠটা চেনা চেনা লাগছে কিন্তু ধরতে পারছে না কিছুতেই। জয়তুনের দুচোখে যেন রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। আবারো সেই ডাক।
হ্যাঁ, এবার সে চিনতে পেরেছে, এতো তার মায়ের গলার সেই চির চেনা ডাক। মা আসছে নাকি!
-মা!
কতদিন পরে মায়ের ডাক, চোখ তাকে মেলতেই হবে ঘুম তাকে তাড়াতেই হবে। সে অনেকক্ষণের প্রচেষ্টায় কোন রকমে চোখ মেলল।
কিন্তু একি! এরা কারা? এদের কে তো সে চেনে না! তার মা কোথায়? সে অবাক চোখে মাকে খুঁজতে লাগলো।

তার চারপাশে অনেকগুলো মুখ। বেশ উৎকণ্ঠিত। আস্তে আস্তে মুখগুলো তার চেনাচেনা লাগছে। কিন্তু কেন জানি চিনতে পারছে না।

হঠাৎ বুঝতে পারলো মাথার পেছনটা বড় বেশি ব্যাথা করছে।কোমরেও সেই রকম ব্যাথা। এক ফাঁকে কে একজন তাকে একটু গরম দুধ খাইয়ে দিলো। এমনিতেই জয়তুনের খুব খিদে পেয়েছিলো। দুধটুকু খেয়ে যেন শরীর সাড়া দিলো। কিন্তু তার শরীরে এতো ব্যাথা কেন? কি হয়েছে তার? কিছুই তার মনে পড়ছেনা।
তার চারপাশের এই অচেনা লোকগুলোই বা কে? সে কোন কিছু মনে করতে পারছেনা কেন? এটা কার ঘর?
-ও জয়তুন এখন কেমন লাগতাছে? আর কিছু খাবি? খিদা লাগছে?
জয়তুন অপরিচিত মুখখানির দিকে অবাক চোখে চেয়ে জানতে চাইলো
-তুমি কেডা?
-আমারে তুমি চিনবার পারতাছো না জয়তুন। আমি তুলির মা।
জয়তুন অবশ্য মনে করতে পারলো না। তবুও জানতে চাইলো।
-তুলির মা আমার কি হইছে। আমি এই খানে কেন?

তুলির মা অবাক হলো জয়তুন নিজের ঘর চিনতে পারছে না।মাথার চোটের কারণে এমনটি কিনা কে জানে?

জয়তুনের কোমরেও বেশ চোট পেয়েছে। ড্রেনের ধারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলো সে। লোকজন প্রথমে তো মনে করেছিলো মরেই গেছে। মাথায়, কোমরে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে, প্রাথমিকভাবে বস্তির এক হাতুড়ে ডাক্তার দেখে গেছে, হাসপাতালে নিতে বলেছে। কিন্তু এ দ্বায়িত্ব সে একা সামলাবে কি করে? টাকা পয়সার ব্যপার আছে, টাকা পয়সা কে দেবে?

তুলির মায়ের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিলো।

তুলির মা আর জয়তুন আধাআধি ভাগে এই বস্তির ঘরটাতে থাকে। অনেকদিনের সুখ দুঃখের সঙ্গী তারা, জয়তুনের জন্য তারও প্রাণ কাঁদে।
তুলির মা জয়তুনের মেয়ে জুলির কাছে ফোন দিয়েছে। জুলি জানিয়েছে সে এখন আসতে পারবেনা। তার ছেলের ধুম জ্বর। সে আরো রাগ দেখিয়ে বলেছে ভাইরে খবর দাও। মা তো ভাইকে বেশি ভালোবাসে তারেই তো সব টাকা পয়সা দেয়। সে কেন খামাখা এখন দায়িত্ব নিয়ে তার সংসারে অশান্তি ডেকে আনবে। যার জন্য করতো সে এখন করুক গে। আমার কি দায়।

তুলির মা ছেলেকে ফোন দেয় সেই ফোন কেউ ধরে না। তার কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিলো। জয়তুনকে নিয়ে এখন সে কি করবে। আজ তার কাজ কামাই হয়ে গেছে।
কাল কামাই হলে কাজ হারাতে হবে নিশ্চিত। জয়তুনের বড় মেয়ের ফোন নামাম্বর নেই তার কাছে। থাকলে যোগাযোগ করা যেতো। জয়তুনের ছেলে মেয়েরা এড়িয়ে যাচ্ছে কেন সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। রাত বাড়ার সাথে সাথে সবাই যে যার ঝুপড়িতে চলে গেছে। জয়তুন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। তুলির মা জয়তুনের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে আর ভাবছে তার জন্যও হয়তো এমন দিন অপেক্ষা করছে……কঠিন দিন।

জবা সেই থেকে মুখ ভার করে বসে আছে। সারা মুখে তার আষাঢ়ের মেঘ।
শাহিন বারবার বলেই চলেছে,
_কি করবো বলো, মা কে তো ফেলে দিতে পারিনা। তুমি কি পারতে তোমার মা হলে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে। মা তো এতোদিন নিজের মতোই ছিলো। এখন অসুস্থ হয়ে…
-তোমার বোনেরা তো পেরেছে।তোমার এতো কিসের দায়? মা কি তোমার একা। তারা তো গা ঢাকা দিয়েছে।
_তুমি কটা দিন একটু সহ্য করো। আমি সব সামলে নেবো।
_তোমার মা তুমি যা করার করবে আমি পারবো না, সাফ সাফ বলে দিলাম।

জয়তুন পাশের ঘর থেকে সবই শুনতে পায়। মনে ভীষণ কষ্ট পেলেও আজ তার চোখে জল নেই। আবেগকে সামলেছে অনেক কষ্টে। এসব কেঁদে কেটে ঝগড়াঝাঁটি করে কোন লাভ নেই সেটা সে অনেক আগেই বুঝে গেছে। তাছাড়া তার স্মৃতি ইদানীং মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করে। বড্ড ভুলো মন হয়েছে তার।ঝগড়া করার পরিস্থিতিতে এখন আর সে নেই।
তুলির মায়ের সেবা যত্নে আর কদিনের হালকা পাতলা হাতুড়ে চিকিৎসার পরে যদিও এখন সে খানিকটা ভালো আছে।তবে মাথার ফোলাটা কমলেও কোমরের ব্যাথা কিছুতেই কমছে না। তার উপরে আজকাল অনেক কিছু তার মনে থাকে না বা মনে পড়ে না বলে মেজাজটা খুব চড়ে থাকে, কেমন যেন আউলা ঝাউলা হয়ে যায় সব কিছু। কথার পিঠে কথাও গুছিয়ে বলতে পারে না।

আজ কদিন হলো শাহিন তাকে নিয়ে এসেছে শাহিনের ভাড়া বাড়িতে। তার আগে বস্তিতেই তার চিকিৎসা চলছিলো কোন রকমে। জবা তাকে কোনদিনও যায়নি দেখতে শাহিন নিয়ম করে দেখে আসতো, খোঁজ খবর নিতো।

কারো প্রতি জয়তুনের আর কোন অভিমান নেই। দুনিয়ার প্রতি তার কেমন যেন বিতৃষ্ণা এসে গেছে। মেঝো মেয়ে তো একবার চোখের দেখা দেখতেও এলো না। বড় মেয়ে জানে কিনা কে জানে? মেয়েদের আর দোষ কি তাদের সংসার নিয়ে তারা ব্যস্ত অথবা স্বামীরা তাদের হয়তো আসতে দেয়নি দায়িত্ব নেবার ভয়ে।

তার পরেও কিছু অভিমান তো বুকে জমেই, অন্তত একটা ফোন তো তারা করতে পারতো! যাক গে সে ঠিক করেছে সে আর কোন কিছু নিয়ে ভাববে না।

এ ক’দিন তুলির মায়ের জীবনের উপর দিয়ে গিয়েছে।
দিন কারো জন্য অপেক্ষা করে না। গড়িয়ে চলে নিজের গতিতে। শাহিনের বাড়িতে জয়তুন আসার মাস পূর্তির আগেই জবা অস্থির হয়ে উঠলো। জয়তুনকে কেন্দ্র করে শাহীন আর জবার মধ্যে তুমুল অশান্তি শুরু হলো। সমস্যা এতটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌছল যে সংসার টেকা দায় হয়ে পড়লো। জবার অনিহার কারণে সে বেশ বিপদে পড়লো।একে তো শাহিনের বোনেদের সাথে সম্পর্ক ভালো না। যাওয়া আসা তো দুরের কথা ফোনেও আলাপ চলে না।

তারপর একদিন জবার সাথে আপোষ হলো এই বলে যে মাকে সে সময় সুযোগ বুঝে ঢাকাগামী বাস স্ট্যান্ডে ছেড়ে আসবে। সেখান থেকে মা যেখানে পারে চলে যাক।

জয়তুন কোমরে ব্যাথায় বিছানা থেকে উঠঠে না পারলে কি হবে, তার কান এখনও সজাগ। সে সবই শুনতে পায়। সে শুধু নির্বাক চেয়ে রয়।
তারপর একদিন সুযোগ বুঝে জবা আর শাহিন মিলে জয়তুনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বন্ধু রায়হানের সহযোগীতায় ছেড়ে আসে মনিহার বাস স্ট্যান্ডে রাতের আধারে। সেখানে জয়তুনের জায়গা হয় ফুটপাতের বেওয়ারিশ কুকুরের পাশে।

তৃতীয় পর্ব

একটা অসহায় বৃদ্ধ মানুষ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বেলা এখন সাড়ে বারোটা। তাকে ঘিরে বসে আছে সম্পূর্ন অজানা অচেনা আরো দু তিনটি মানুষ। অচেনা মানুষ হলেও তারা কিছুটা উৎকন্ঠিত। অচেনা অজানা মানুষটি আর কেউ নয় জয়তুন।
জয়তুনের ঘুম ভাঙে বেলা দেড়টার কিছু পরে। সে প্রথমে বেশ ঘাবড়ে গেলো। এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো বারবার। কেউ এক জন এসে প্রশ্ন করলো,
-ও বুড়ি মা তোমার বাড়ি কোথায়?
জয়তুনের চোখ ছল ছল করে উঠলো। বাড়ি! মনের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো। সে সবই বুঝতে পারলো আস্তে আস্তে। কারণ সে তো সব পরিকল্পনাই শুনেছে আগে। কিন্তু কখনো মন থেকে বিশ্বাস করেনি যে তাকে তার কোলের সন্তানেরা এমনভাবে পরিত্যাগ করতে পারবে।জয়তুন শুধু নির্বাক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকলো। এছাড়া আর সে কিই বা করবে? কি করতে পারে সে।

অনেকেই এলো কত জনে কত প্রশ্ন করলো সে কোন উত্তরই দিতে পারলো না। আসলে সে উত্তর দিতে চাইনি। নিজের সন্তানের বদনাম সে কি করে করবে? এই লজ্জা রাখবে কোথায়।
সে লজ্জায় কোন কথাই বলল না,শুধু জানালো তার কিছু মনে পড়ছে না। কিছুই মনে করতে পারছেনা সে।

শেষ

হোক প্রতিবাদ

অস্থির সময়ের পাজর ছুঁয়ে
নেমে এসেছে নিঃস্তব্ধ নিকষ কালো বিত্রস্ত অন্ধকার।
মশান গ্রাস করেছে সুশোভিত চন্দ্রকে।

অতল আঁধারের স্নেহাশিসে সুযোগ সন্ধানীরা জন্ম দিচ্ছে যত পাপাচার।
ক্রমাগত দিয়েই চলেছে এক একেকটি পাপের জন্ম।
নতুন মোড়কে নতুন নামে।

যেন এটাই চিরন্তন এবং কাঙ্ক্ষিত।

হায় বিধাতা!
আর কত পাপ হলে পাপের কলস হবে পূর্ণ।
না হোক পূর্ণ পাপের ঘড়া,
আর নয় নিয়তির উপর দায়ভার চাপাবার খেলা।
অনেক তো হলো
আর অন্যায় সইবার সময় বা সুযোগ কোথায়?
এবার তবে হোক প্রতিবাদ।

হে দলিত,
তোমায় আজ অনুরোধ নয় আদেশ করছি।
হও প্রতিবাদী,
হও রণরঙ্গিনী দূর্বার।
হও দুরন্ত,উত্তাল ।
অন্যায় গোপন করার অভ্যাস করো পরিত্যাগ।
আর নয় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি।
আর নয় মায়ামমতা প্রদর্শন পূর্বক দয়া ভিক্ষা।

পচনশীল সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে হতে
তীব্র উচ্চারণে উচ্চারিত হোক তোমাদের সুতীব্র প্রতিবাদ।
প্রতিধ্বনিত হোক সেই আওয়াজ
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া অবধি গগনবিদারী ধ্বনিতে।
অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের পতাকাতলে।

এখন গ্রহণকাল।
ঠুনকো অজুহাতে তোমায় ছোবল মারতে পারে
নিষ্ঠুর হায়েনার দল।
ছলে বলে নানা কূট কৌশলে।
তাই বলে ভয় পেলে চলবেনা কিছুতেই।

জেনে রেখো,
যদি লক্ষ্য থাকে অটুট তবে দেখা হবে বিজয়ে।
দুষ্টের দুর্জনের ছলনার অভাব হয় না।
তারা বহুরূপী।

মনে রেখো,
তারা রৌদ্রজ্জ্বল পবিত্র আলোকিকত দিনেও
অস্থির রকমের নির্লজ্জ বেহায়া অসংযত ।
অপরিনামদর্শী।
তারা ধর্মান্ধ, তারা কুসংস্কারচ্ছন্ন।
তারা ক্ষমতার দম্ভে দাম্ভিক ,
তারা কু রিপুর তাড়নায় বিকারগ্রস্ত।
তারা নিষ্ঠুরতার, নির্মমতার একনিষ্ঠ পূজারী।
তারা একেকজন সাক্ষাৎ রাবনের প্রেতাত্মা।
মানুষরূপী এইসব অবাঞ্ছিত কীটের তান্ডব নৃত্য,
আজ চতুর্পাশে।

পথ ঘাট মাঠ প্রান্তর লোকালয় স্কুল, পার্ক খেলার মাঠ।
কোথায় নেই তাদের অশুভ বিচরণ?
সমাজে প্রতিটি কোন আজ বিষাক্ত নর্দমার কীটে পরিপূর্ণ।

তারা লালায়িত, তারা লোভাতুর, তারা কামার্ত
তারা নৃশংস এবং তারা নির্মম।
তাদের বিষ নিঃশ্বাসে আজ আকাশ বাতাস সর্বত্র পরিপূর্ণ।
এই সমাজ আজ অসহায় নিশ্চল ।

দায়িত্বের অবহেলা জনিত কারণে
আজ সর্বত্র নানা বেশে নানা রূপে বহুমুখী অসুরের উত্থান।
ওই অসুরদের।
ওই নরকের কীটদের।
ওই নরপিশাচদের।
কোন মা নেই _
কোন বোন নেই_
তাই বুঝি
নারী মাত্র তাদের দৃষ্টিতে শুধু দমন পীড়নের সামগ্রী।
কাম লালসার পান পাত্র।

ওরা জন্মায়নি কোন মায়ের জঠরে।
ওরা যে ইবলিশের হাতে গড়া জারজ আত্মা।
আর কত বার দেয়ালে ঠেকলে পিঠ
ঘুম ভাঙবে?
জাগো জাগো মাগো
জাগো বোনেরা।

এসো সামিল হও প্রতিবাদ মিছিলে।
তৈরি হও বিবেকবোধ,মূল্যবোধহীন সমাজের
সমস্ত অব্যবস্হাপনা গুলোকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার যুদ্ধের জন্য।
এসো পুরানো নিয়ম জাল ছিড়ে, নতুনের প্রয়োজনে।
এই সব ইবলিশের প্রেতাত্মা নিধনে।

© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
ফুটনোট – বিত্রস্ত -অতিশয় ভীত।
মশান-অপরাধীদের বধ্যভূমি।

গল্পঃ আঁধারের কথকতা

[১]
কোন কোন মানুষের জীবনটা শুরু হয় ভুল দিয়ে। অল্প বয়সে সহপাঠীর মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে শরীরের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে জবা। মা বাবার উদাসীনতা এ ক্ষেত্রে তাকে আরো সাহসী করে তোলে। সমাজের চাপে পড়ে যখন শাসনের বেড়াজালে তাকে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা শুরু হয় ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সুযোগ বুঝে বাড়ি থেকে পালায় জবা। এ ঘাট ও ঘাট ঘুরে এখন সে মেহেরজানের আয়ত্ত্বে। এতো দিনে সে তিনবার বিক্রি হয়েছে,হয়েছে অজস্রবার ধর্ষিতা। এখন তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে। কিন্তু পথ যে বন্ধ সে তা ভালো করেই জানে, ফিরবার আর কোন আর রাস্তাই নেই, সে যেন বন্দিনী এক অদৃশ্য জালে।এ জাল ভেদ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

সে এটাও জানে সে ফিরে গেলে সমাজ তাকে আর ফিরিয়ে নেবে না। এখন সে বুঝতে পারে কত বড় ভুল সে এ জীবনে করেছে। আজ মেহেরজানের সকাল সকাল মেজাজ তুঙ্গে। নানা চিন্তায় মাথা খারাপ হবার জোগাড়। ইদানিং দৈনিক আয় রোজগারের অবস্থা মারাত্মক খারাপ। এরকম চলতে থাকলে দল ভেঙে ফেলতে হবে। কিন্তু দল ভেঙে ফেললেও কি নিস্তার আছে নাকি? মাসিক হিস্যা যেখানে যা দেবার ঠিকই নিয়মিত দিয়ে যেতে হবে। এ জাল এমনই জাল একবার ঢোকা যায় কিন্তু মুক্তি মিলবেনা মৃত্যু ছাড়া।
মেহেরজান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তার বয়স হয়েছে, পুরানো দিনের মত তেজও নেই আর ক্ষমতাও নেই সেইভাবে। কাজেও উৎসাহ পায় না আর আগের মতো। কিছুদিন আগেও এ লাইনে সম্মান ছিলো বড় ছোট মানামানি ছিল। সবকিছুতে একটা অদৃশ্য নিয়ম ছিলো। ইনকামও ছিলো প্রচুর। এখন এমন পরিস্থিতি যে ব্যবসা চালানো তো দূরের কথা, মান সম্মান রক্ষা করাই মুশকিল হয়েছে। কেউ কাউকে মানে না, রোজগারের কথা না হয় বাদই গেলো।
মেহেরজান হাঁক দেয়,
-জবা ও জবা?
জবা পাশের রান্না ঘরেই আছে, কিন্তু সে উত্তর করে না। তার উত্তর করতে ইচ্ছা করছে না। সে গুনগুন করে গান গাচ্ছে। বন্ধু তিনদিন তোর বাইত গেলাম দেখা পাইলাম না।
মেহেরজান আবার গগন বিদারী হাঁক দেয়,
-কানে কথা যায় না নাকি, ও *নকি মা*?কখন ধরে ডাকি।কানের কি মাথা খাইছোস।
জবাও গগনবিদারী আওয়াজ তোলে
-এতো চেঁচাও কেন?
-তোর কথার ঝাঁঝ বাড়ছে কিন্তু কইলাম।
-কি কইবা কও। কাম আছে। সারাদিন শুধু ফেগর ফেগর।
-তোরে কিন্তু আমি এই মেহেরজান না থাকলে শেয়াল শকুনে ছিড়ইড়া খাইতো। খাইতো কিনা ক?
-এক ভাঙা রেকর্ড আর কতবার বাজাইবা। কি হইসে ঝাইড়া কাশো। শেয়াল শকুনে খাইতে আর বাকি আছে নাকি! ওই ভয় দেখাইয়ো না।
-তোর নাকি কাম কাইজে মন নাই। উড়াল দেওনের ধান্দা নাকি? পালাইলে বাঁচতে পারবি?
-কেডায় কইছে?
-সেইডা তোর জাননের কাম নাই। কাজ কাম ঠিক কইরা কর, তোরে কিন্তু লাস্ট ওর্য়ানিং দিতাছি, তেড়িবেড়ি করলে এমন জায়গায় বেইচা দিমু দিনে হাজার বার পানি তুইল্যা কুল করতে পারবি না।
জবা কিছু বলে না, জানে কিছু বলে লাভ নাই। এইসব তার নিয়তিতে আছে, সে মেনেই নিয়েছে।
-গত সপ্তাহের পোলাডার খবর কি? কি যেন নাম, মালেক না খালেক।
-দশ হাজার দিছে। আর মাসিক সিস্টেম কইরা নিছি।
-আর আলম সাহেবের মাইয়ার খবর কি?
-হাতে পায়ে ধরে।
-মায়া দেখাইলে কিন্তু ফাইস্যা যাবি।
জবা আত্নবিশ্বাসের সাথে বলে,
-খাইয়া কাম নাই, আজ টাকা দেওনের দিন, না দিলে পিকচার দেখামু, যাইবো কোই হালির পো হালি?
মেহেরজান আয়েশে চোখ বোজে। বিড়ি খেতে ইচ্ছা করতেছে, কিন্তু সকাল সকাল সে বাসি মুখে বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগে। চোখ বুজে বুজে সে ভাবতে থাকে তাড়াতাড়ি ব্যবসার ধরণ পাল্টানো লাগবে। তারপর কি জানি কি ভেবে সে হঠাৎ চোখ মেলে হাঁক দেয়,
-আজ সন্ধ্যায় মিটিং ডাকিস তো। জরুরী কথা আছে। কামাল আর বাবলু কই গেলি, ওই শু*রের বাচ্চারা ……সব কি বয়রা হইলি নাকি?

[২]
-ভাইজান ফুল নিবেন? টাটকা ফুল আছে, দাম কিন্তু সস্তা।
ছেলেটি আড় চোখে তাকায় তারপর দামী মোবাইলটায় সময় দেখে, রুম্পা এখনো এলো না,আধাঘন্টা লেট। অপেক্ষার প্রহরগুলো প্রচন্ড বিরক্তিকর। আজ রুম্পার জন্মদিন। ফুল নেয়া যেতেই পারে কিন্তু কেন জানি ইচ্ছা করছে না। সে কি রুম্পার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। নাকি রুম্পা সুক্ষভাবে তাকে নিরুৎসাহিত করতে চাচ্ছে। ইদানিং রুম্পার আচরণ তার কাছে খানিকটা সন্দেহজনক লাগছে।
-ভাইজান একটা ফুল লন,পানির দামে দিমুনি।
-কত করে তোমার ফুল?
-বিশ টাকা প্রতি পিস।
-ঠিক আছে দুটো দাও।
-তিনটা নেন।একটা ফ্রী দিমুনে।
-দাও
মেয়েটি চারটি ফুল দেয়। ছেলেটি টাকা দেয়। মেয়েটি টাকা নিয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসে, শিকার নিয়ে খেলতে তার ভালোই লাগে। সে তার সাথে থাকা ছোট ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে। তারপর শুরু করে তার খেলা,
-ভাইজান কম দেন ক্যান।
-কই ষাট টাকাই তো দিছি।
-দিবেন তো আশি টাকা।
– কি বলো? একটা ফ্রী বললে না।
– ফ্রী তে খুব ঝোঁক দেখি? মেয়েটি একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করে।চোখে মুখে তার গাঢ় প্রগলভতা।
-যাওতো এখান থেকে।ব্যস্ত আছি।
-কই যামু। টাকা মেটান চইলা যাই। কাম আছে। আপনের কাছে বইয়া থাকলে আমার চলবো না।
-ফুল বেচছো আমি কিনছি। টাকা পাইছো। এখন বিদেয় হও। এতো কথা কও কেন?
-আর বিশ টাকা।
-খামাখা ক্যাচাল করো কেন?
মেয়েটি এবার চিল্লাতে থাকে,
– আমি ক্যাচাল করি? আমি ক্যাঁচাল বাজ। আমি খারাপ মাইয়া? হায় আল্লাহ কয় কি? ফুল বেইচ্যা খাই তাই বইল্যা কি আমার মান সম্মান নাই। ফুল বেচি শরীর না, আপনে কেন গায়ে হাত দিলেন। মেয়েটির সাথে আসা ছোট ছেলেটি তৎপর হয় সেও এবার সুযোগ বুঝে চেঁচিয়ে ওঠে।
-ওই মিয়া আমাগো ফুলের টাকা দেন। আমরা যাই গা। আপনে আমার বইনের গায়ে হাত দিছেন ক্যান? আপনে আমার বইনের গায়ে হাত দিছেন ক্যান?
এর মধ্যে কিছু লোক জড়ো হয়ে যায়। আসলে তারা সবাই এই চক্রের সদস্য। তার মধ্য থেকে একজন জানতে চায় কি হয়েছে? ফুলওয়ালী মেয়েটি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে ঘটনা বর্ণনা করে। তার পাতানো ভাইটি সাক্ষী দেয়। ছেলেটির ভয়ে মুখ শুকনো হয়ে আসে। এসব কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

[৩]
এই পার্কের এই অংশটা অতি মাত্রায় নিরিবিলি। তমালের কাজের জন্য বেশ আরামদায়ক। এই পরিবেশে খুব তাড়াতাড়ি তার ভাব আসে। পাখীর ডাক, বাতাসের শুনশান আওয়াজ বেশ মিষ্টি একটা পরিবেশ, আহ! কবিতা লেখার জন্য এর থেকে ভালো পরিবেশ ঢাকা শহরে কোথাও পাওয়া যাবে না। অল্প কয়েকজন চা ওয়ালা, বাদামওয়ালাআর একজন ফুলওয়ালী ছাড়া হকারদের বিরক্তিকর জ্বালাতনও নেই। দূরে দূরে কিছু প্রেমিক প্রেমিকা খোশ গল্পে মত্ত। তাতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই বরং কবিতার প্লট সাজাতে বেশ সহায়ক।
তমাল প্রতিদিন ফুলওয়ালী মেয়েটিকে গভীরভাবে খেয়াল করে। এই মেয়েটিকে নিয়েও একটা কবিতা লেখা যায়। মেয়েটির হাঁটাচলা ঘোরাফেরা কথা বলাতে কেমন একটা চেনাচেনা ব্যাপার রয়েছে। কিছুতেই সে এই মেয়ের আকর্ষণ অগ্রাহ্য করতে পারছেনা। সে কি তাকে আর কোথাও দেখেছে? তার তো মনে পড়ছে না।
মেয়েটির বাহ্যিক পোষাক যা একটু অমলিন তাছাড়া অন্য সবখানে তার ভিন্ন মাত্রার জৌলুষ ছড়ানো। যা সত্যি দূর্লভ তার বর্তমান পরিবেশের সাথে। তমালের কেবলি মনে হয় মেয়েটি এই পরিবেশের সাথে যায় না। এর অন্য কোন পরিচয় আছে। তাকে জানতে হবে।

বিশেষ করে মেয়েটির মুখটি এতোটাই মায়াকাড়া যে চোখে চোখ পড়লে তমাল চোখ ফেরাতে পারে না কিছুতেই। যেন তার সাথে তার সাত জনমের সম্পর্ক। এ কিসের টান? সে জানে না। কয়েকদিনের চেষ্টায় সে মেয়েটি নাম জেনেছে, মেয়েটির নাম জবা কুসুম। পেশায় ফুল, বাদাম, পানি বিক্রেতা, অমিত অবশ্য অন্য আরেকটি তথ্য দিয়েছে। তথ্যগুলো ভয়ানক। তমালের তাতে কিছু যায় আসে না, সে ওসব বিশ্বাস করে না।
জবা মেয়ে হলে কি হবে? তার ভিতরে মেয়েলী ব্যাপারগুলো, রমনীসূলভ আচার আচরণগুলো সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে । সাহসেও সে দূরন্ত হয়ে উঠেছে দিনে দিনে।
জবা নিজেও বেশ কদিন ধরে খেয়াল করে দেখেছে ছেলেটি তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।কি এতো দেখে সে? কে জানে?সে পুরুষ চেনে।পুরুষের কাম ক্ষুধা তৃষ্ণ লোভ শয়তানি সমস্ত বিষয় তার নখদর্পনে এসব সে জীবন থেকে শিখেছে।
এ ছেলেটি যে খারাপ প্রকৃতির না সেটা সে ভালোই বুঝতে পারে।উঠতি যুবক।উঠতি যুবকদের ফাঁদে ফেলা খুব সহজ। পুরুষ মানুষকে ফাঁদে ফেলাই জবার আসল ব্যবসা।
একদিনে সামান্য বেচাকেনার সৌজন্যমূলক কথাতে ছেলেটিকে আটকে ফেলেছে সে।কিন্তু এই ছেলেটিকে কেন জানি তার শিকার বানাতে ইচ্ছা করছে না। কামালের দৃষ্টি শকুনের দৃষ্টি। তার দৃষ্টিতেও ধরা পড়েছে জবার গাফিলতি।সে ঠিক মেহেরজানের কাছে গিয়ে কুটনামি করেছে তার নামে।
জবা কি যেন ভাবে। সে কি একে সাবধান করবে? সরে যেতে বলবে? কিন্তু শিকার হাত ছাড়া হয়ে গেলে তো তার কপালে দুঃখ আছে।
সে একটু বাজিয়ে নেবার জন্য তমালের দিকে আজ দ্বিতীয়বারের মতো এগিয়ে আসে।হাতে তার এক গুচ্ছ ফুল। সে তমালের সামনে দাড়িয়ে সরাসরি আক্রমণ চালায়।
-আ্যই মিয়া এই, হাঁ কইরা কি দেহেন?
-চমকে ওঠে তমাল,সে যেন কোন ভাবনায় ডুবে গেছিলো।অচেনা মেয়েটি তার সামনে দাড়িয়ে।মেয়েটি এভাবে সামনে এসে দাড়াবে সে সেটা ভাবতে পারেনি অবশ্য।
মাজায় হাত ঠেসে ধরে চোখ মুখ পাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে কি যেন বলে চলেছে দ্রুত তালে।
তমাল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
-আমায় কিছু বলছো?
-হ আপনেরে ছাড়া তো আর কাউরে দেহি না।দেইখ্যা শুইনা তো ভদ্র ঘরের পোলা মনে হয়।চোখের নজর এতো খারাপ কেন?
-আমি কি খারাপ কিছু করেছি?
– না করেন নাই,কিন্তু করবেন।আপনের সব ভালো হইতে পারে কিন্তু নজর খারাপ।
তমাল উঠে দাড়াতে যায়।সে বিব্রত বোধ করে।
মেয়েটি আবার বলে
-ভালো চান তো চুপচাপ এইখান থাইক্যা ফুটেন।এর মধ্যে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে।তমালের কেমন যেন ভয় ভয় করে।
লোকগুলোর মধ্যে ষন্ডা মতো একজন বলে, কি হইছে রে জবা?কি সমস্যা?
– ভাই কোন সমস্যা নাই। তোরা ফোট। আমার দেশি ভাই।একটু গাও গেরামের খবর লই আর কি।
তমাল কিছু বুঝতে পারে না সে শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
-দেশি ভাই মানে কি?আর তাকে চলে যেতে হবে কেন?
লোকজন সরে গেলেও কামাল ঠিকই দুর থেকে তাকে শকুনের দৃষ্টিতে দেখছে ,জবা পিচ্চিটাকে কৌশলে সরিয়ে দিয়ে,জবা নিচু স্বরে বলে।
-কি নাম আপনের?
-তমাল,
নাম শুনে কি যেন ভাবে মেয়েটি,কি একটু চিন্তা করে।সে যা অনুমান করেছিলো ঠিক তাই, এতোকাল সে যা করেনি আজ তাই করে,বেশ কিছু প্রশ্ন করে বসে সে।তার শরীর ঝিমঝিম করছে,চোখে পানি চলে আসতে চাচ্ছে,সে কোন রকমে নিজেকে সামলে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,
-ভাইরে এই পার্কে বইয়া কি করেন?
তমাল লজ্জা পায়।
-না মানে।একটু এ পাশটা নিরিবিলি তাই এদিকে বসি।কবিতা লিখি তো।এখানকার নিরিবিলি পরিবেশটা ভালো কবিতা লেখার জন্য।
-আপনে তো আমার ব্যবসা লাটে তুলবেন মিয়া।
-কেন?
-জায়গাটা ভালো না এটা কি আপনি জানেন?
-আমার কাছে তো খারাপ মনে হয়নি,বেশ শান্ত নিরিবিলি,ঝামেলাবিহীন।
-আপনে কিন্তু বিপদে পড়বেন।
-মানে?
-এখানে আর আইসেন না।
-বুঝলাম না।
-বেশি বুঝনের কাম নাই,আপনে সোজা হাইট্যা বাড়িত যান।আপনে খুব সরল সোজা ।জায়গাডা ভালা না।একা একা ঘুরঘুর কইরেন না।
-কেন?
-প্রশ্ন করেন ক্যান? নিজের বেআব্রু ছবি দেহনের সাধ হইছে।জবা জানে ভাষা খারাপ না দিলে কাজ হবে না।সহজসরল মানুষদের নিয়ে এই এক বিপদ।
তমাল কিছু বোঝে না তবে হঠাৎ করে তার অমিতের সতর্ক বানী মনে পড়ে।তারপর মনে পড়ে রবিনে কথা ।
রবিন কোন এক জায়গায় নাকি এ রকম মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলো।
হঠাৎ করে তার দিগম্বর ছবি ফোনে ফোনে ছড়িয়ে পড়ে। সে বেচারা শেষে কোথায় যেন পালিয়ে বাঁচে।আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।বন্ধু বান্ধবী মহলে তাকে নিজে কত মজা?সবাই মজা নেয়। পৃথিবীটা এমনই।এতো কাছের বন্ধু বান্ধব অথচ ওই ঘটনার পরে তার কথা উঠলেই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে তার স্পর্শকাতর অঙ্গ।
সে নিজেকে লুকাতে চায় অনবরত,বদলাতে চায় যে কোন মূল্যে নিজের সকলকিছু।বেশভূষা নিজের অবয়ব সবকিছু পরিবর্তনের সেকী দূরন্ত চেষ্টা তার সে সময়গুলোতে।তাতেও তার রক্ষা নেই যেন।অনেক পরে জানা গেছে মধ্যে প্রাচ্যের দেশে কামলা দেয়ার নাম করে পালিয়ে বাঁচে সে।
জবা শেষ বারের মতো বলে আপনারে যেন আর কোনদিন এইখানে না দেখি,দেখলে কিন্তু আমার চাইতে কেউ খারাপ হইবো না।
হঠাৎ কামাল এসে হাজির হয়।জবা তুই কাষ্টমার ভাগাইয়া দিতাছস কেন?
জবা ঝাঝিয়ে ওঠে,
-সেই কৈফিয়ত আমি তোরে দিমু না।
কামাল ফিক করে হাসে।বুঝবার পারছি তোর পাখনা ছাটনের টাইম হইছে।
জবা একটা বিড়ি ধরায়।তার চোখমুখের ভাব দেখে কামাল সরে যায়।
[৪]
আজ ভবিষ্যত কর্মসূচী নিয়ে মিটিং হবার কথা ছিলো। কিন্তু তার আগে জবাকে নিয়ে ওঠা অভিযোগের সুরাহা করতে হবে।মেহেরজানের মেজাজ এখন দারুণ অশান্ত। জবাকে আজ বেশ উদ্ধত লাগছে সে মনে হয় কিছুটা বেপরোয়াও।
মেহেরজান বাঁজখাই গলায় হাঁক দেয়,
-তুই কি বুঝবার পারছোস যে তুই আমাগো লগে বেইমানি করছোস।হারামজাদি *নকি *গি।
-মুখ খারাপ কইরো না যা কইবার আমারে কও। বাপ মায়েরে টানো কেন?
-ওই ছেমড়ি চান্দি গরম করাইস না কইলাম।তোরে কিন্তু কুকুর শিয়াল দিয়া খওয়াইবার পারি।
-জানি।জানি। জানি।
-দুই দুই বার সুযোগ পাইয়াও পোলাডারে তুই ছাইড়া দিছস।উত্তর দে,তোর মতি গতি কি ক, আমারে তাড়াতাড়ি ক’
জবা চুপ করে থাকে সে কোন উত্তর দেয় না আসলে তার কাছে………..
-কথা কস না কেন?
কেন জানি জবার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না, তারপর কি ভেবে বলে ওঠে,
-আপনে কি আপনের আপনজনের লগে আকাম কুকাম করবার পারবেন ?
-জবা!!!!!!!
-চিল্লায়েন না।
-ওই ছেমড়ার লগে তোর কি সম্পর্ক। পিরিত করছোস? নাগর বানাইছোস,রসের নাগর?
-মুখ সামলাও কইলাম।
-সামলামুনা মুখ, কি করবি? মারবি? কেডায় তোরে এতো পাওয়ার দিছে? ক আমারে ?কেডায় তোরে এতো পাওয়ার দিছে?
– শুনবেন ওই পোলা আমার কি লাগে?
-হ শুনমু ক, কি লাগে তোর? কেন তুই আমার লগে বেইমানি করছোস ওই পোলার লাইগা?
-ওই পোলা আমার ভাই লাগে,ভাই।
-কেমুন ভাই?
জবা আর্তনাদ করে চিল্লায়ে ওঠে,
-আমার মায়ের পেটের আপন ভাই লাগে আপন ভাই।
-এতো খবর দিলো কে তোরে?তুই ওই পোলারে চিনলি কেমনে?
জবা চুপ।
-জবা চুপ থাকিস না।আমার চান্দি রম করাই না।কথা ক।
জবা কোন উত্তর দেয় না।সে তো তমালকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। ডান হাতের ছয় আঙ্গুল দেখে তার
প্রথম সন্দেহ হয়।বাম হাতের জন্মদাগ দেখে সে আরো নিশ্চিত হয়।
জবা কোন কথা বলে না।সে ঠিক করেছে সে আর কিছুই বলবেনা তার যা হয় হোক। এ জীবন তার আর ভালো লাগে না। নিতান্ত আত্ন হত্যা করার মতো সাহস তার নেই। না হলে কবেই সে এই পাপের জীবন শেষ করে দিতো।
মেহের জানের গলার আওয়াজ দ্বিগুন হয়,
-কামাল বাবলু জবারে ভিতরে ল।ওর খাওন একবেলা। দরজায় তালা দিয়া চাবি আমারে দে।
কামাল আর বাবলু এগিয়ে আসে।জবাকে তার দুজন দুদিক থেকে ধরে।তাদের মুখে খুশির ঝিলিক।অনেকদিন পরে আজ তাদের খায়েশ পূরণ হবে।জবার অনেক ক্ষমতা ছিলো। মেহেরজানের খাস লোক ছিলো সে। আজ জবার কোন ক্ষমতা নেই। এই তো সুযোগ…..
জবাকে ঘরে তালা বদ্ধ করা হয়।জবা জানে মেহেরজান তাকে দিয়ে আর কাজ করাবে না।হাত বদল হতে চলেছে সে ,সেটাও সে ভালো করে জানে।এ লাইনে বেইমানির কোন ক্ষমা নাই।
কামাল আর বাবলু চলে যেতে
সে বিশেষ জায়গায় লুকিয়ে রাখা ধারালো ছুরিটা বের করে।শকুনের পাল আজ সুযোগ নেবেই।কাজে লাগবে ছুরিটা……….।

©রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক

জানা অজানা-১[ভিস্তিওয়ালা]

মুঘল সম্রাট বাবরের ছেলে হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধে শের শাহের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক খরস্রোতা নদীতে। জলের প্রচণ্ড স্রোতে যখন হুমায়ুনের প্রাণ ওষ্ঠাগত, এক ভিস্তিওয়ালা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। হুমায়ুন তাঁকে কথা দিয়েছিলেন, যদি কখনও তিনি দিল্লির তখতে বসতে পারেন, ওই ভিস্তিওয়ালা যা উপহার চাইবেন, তাই দেবেন। পরে যখন হুমায়ুন সম্রাট হলেন, আর সেই ভিস্তিওয়ালা তাঁর কাছে চেয়ে বসলেন সম্রাটের সিংহাসন। বাদশাহ হুমায়ুন নিজের মুকুট পরিয়ে দিলেন ভিস্তিওয়ালার মাথায়, তাঁকে বসালেন নিজের সিংহাসনে। তখন ভিস্তিওয়ালা সম্রাটকে আলিঙ্গন করে ফিরিয়ে দিলেন তাঁর মুকুট আর সিংহাসন।

উল্লেখ্য যে সেই ভিস্তিওয়ালার নাম ছিলো “ভিস্তিওয়ালা নাজিম”।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে ছিল সুপেয় পানীর বেশ অভাব। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হত খাল, নদী বা কুয়ার উপর৷ একই পদ্ধতি ছিল কলকাতা শহরেও৷ নিরাপদ পানির জন্য তাই শহর অধিবাসীদের অনেক দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতে হত৷ ঢাকার নাগরিকদের নিরাপদ পানির জন্য সাধারণত শীতলক্ষা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানির উপর নির্ভর করতে হত। শহরে যেসব কুয়া ছিল তাতেও ছিল সুপেয় পানীর অভাব। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী লোকেরা তাই এক বিশেষ পেশাজীবি শ্রেণীর লোকদের মাধ্যমে নিজেদের পানি সংগ্রহ করতেন। তাঁদের কাঁধে ঝুলানো থাকত ছাগলের চামড়ার এক মশক। এই মশক দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করত। এদেরকে বলা হত ভিস্তি বা সুক্কা। ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ হাঁক দিয়ে প্রতি বাড়ি গিয়ে তাঁরা পানি দিয়ে আসত।

ভিস্তিওয়ালাদের ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ হাঁকে এক সময় শুধু ঢাকা নয় কলকাতা কিংবা দিল্লির রাস্তা মুখরিত থাকত। সময়ের পরিক্রমায় সেই হাঁক আর শোনা যায় না। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই পেশা এবং ভিস্তিওয়ালারা। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে- গত শতাব্দির বিশের দশকের মাঝামাঝি ঢাকার রাস্তাতেও ভিস্তিওয়ালার আনাগোনা ছিল।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায় –
ভিস্তি অর্থ পানি বয়ে নিয়ে যাবার জন্য ব্যবহৃত চামড়ার থলি। শব্দটি এসেছে পার্সি ‘ভেস্ত’ বা ‘বেহস্ত’ থেকে; যার অর্থ স্বর্গ। কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধের মধ্যে পানি বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হোসেন (রা.) তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে স্বর্গলাভ করেন। সেই ঘটনা থেকেই এমন নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। কালো চামড়ার বালিশের মতো ‘মশক’ ভরে যারা পানি দিয়ে যেত তাদের বলা হতো ভিস্তি। অনেকে ভিস্তিওয়ালাও বলতেন।

আবার অন্য সূত্রে জানা যায়, এক সময় যখন শহরগুলোতে পাইপলাইন দিয়ে জল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না, তখন ভিস্তিওয়ালাদের ওপরই নির্ভর করতে হত শহুরে মানুষকে। ছাগলের চামড়ায় তৈরি একধরনের ব্যাগে তাঁরা জল ভর্তি করে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দিতেন। এই বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগকে বলা হত ‘মশক’। ভিস্তিওয়ালাদের মশকে জল থাকত ঠান্ডা। ‘বেহেশত’ একটি ফার্সি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘স্বর্গ’। এই ‘বেহেশত’ থেকে ‘ভিস্তি’ কথাটি এসেছে। পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী মনে করা হয়, স্বর্গে রয়েছে প্রচুর নদী, খাল আর বাগান।একটা সময় মানুষের বিশ্বাস ছিল, ভিস্তিওয়ালারা জল নিয়ে আসেন স্বর্গ থেকে। স্বর্গের জল তাঁরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন বলে স্বর্গের দূতও বলা হত তাঁদের।

আগেকার দিনে যুদ্ধের সময় জল রাখতে ভিস্তিওয়ালার মসক ব্যবহার করা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে দুর্গগুলোতে জলের সরবরাহ করা হত মশক থেকে।
জলভর্তি মশক থাকত ঢাকার টমটম গাড়িতে। কলকাতার সঙ্গে ভিস্তিওয়ালাদের সম্পর্ক খুব পুরোনো। কাঁধে মশক নিয়ে ভোরবেলা থেকেই মহানগরীর পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন তাঁরা। রান্না আর স্নানের কাজে লাগত তাঁদের সরবরাহ করা জল। ১৯৪০-৫০ সাল পর্যন্ত কলকাতার কয়েকটি রাস্তা ধোয়ার কাজেও ভিস্তিওয়ালাদের জল কাজে লাগত। কলকাতা আর ঢাকাতে ছিল আলাদা ভিস্তিপল্লি।

এখন অবশ্য পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। কর্পোরেশনের জল মোটর পাম্পের সাহায্যে পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতার বাড়িতে বাড়িতে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিস্তিওয়ালাদেরও বেছে নিতে হচ্ছে অন্য পেশা। দ্য লাস্ট ওয়াটারম্যান’ হিসেবে ভিস্তিওয়ালারা ইতিহাসখ্যাত। এদের ফারসিতে বলা হতো ‘সাক্কা’। পুরান ঢাকার সিক্কাটুলীতে ছিল তাদের বাস। সাক্কা থেকেই যে সিক্কাটুলী বুঝতে অসুবিধা হয় না। দিল্লিতেও এই পেশাজীবীরা ছিলেন। সেখানেও রয়েছে সাক্কেওয়ালী গলি। থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি ও মিশমিশে কালো চাপ দাড়িওয়ালা ভিস্তির সন্ধান সাহিত্যেও পাওয়া যায়।

শামসুর রাহমানের ‘স্মৃতির শহরে’ তাদের উল্লেখ রয়েছে। রবীন্দ্র ও সুকুমার সাহিত্যেও রয়েছে তাদের উপস্থিতি। পুরনো ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের বেশ প্রভাব ছিল। আলাদা পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় তারা থাকতেন। পঞ্চায়েত প্রধানকে বলা হতো ‘নবাব ভিস্তি’। জিন্দাবাহার চৌধুরী বাড়ির জমিদারকন্যা আমেতুল খালেক বেগম ভিস্তিওয়ালাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন: ‘সকাল বেলা ভিস্তি আসত বিরাট মশকে ভরে পানি কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে।… ভিস্তির সেই বিকট গলা। মশকের মুখটা খুলে চেপে ধরে কলসিতে পানি ঢেলে রাখত। বিরাট সেসব কলসি, মাটির মটকায়ও পানি রাখা হতো।… ভিস্তিওয়ালাদের ব্যাগগুলো ছিল চামড়ার। ব্যাগগুলো তৈরি হয় মূলত ছাগলের চামড়া দিয়ে।’

‘কোম্পানী আমলে ঢাকা গ্রন্থ’ থেকে জানা যায়, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস তাঁর ১৮৩০ সালের আদমশুমারি ‘সেনসাস অব দ্য সিটি অব ঢাকা’য় মুসলমানদের যে পেশাভিত্তিক তালিকা তৈরি করেছিলেন, তাতে ১০টি ভিস্তি গৃহের উল্লেখ রয়েছে। ভিস্তিরা ছিলেন সুন্নি ধর্মাবলম্বী। সুন্নি হওয়া সত্ত্বেও সেকালে মহররমের মিছিলে রাস্তার দুই পাশে প্রতীক্ষারত ও রৌদ্রক্লান্ত দর্শকদের মধ্যে পানি বিতরণ করতেন ভিস্তিরা।
ঢাকাকেন্দ্রের পরিচালক আজিম বক্শ ভিস্তিদের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল-দুপুর তারা পিঠে পানিভর্তি চামড়ার ঢাউশ ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় পানি ছিটাত, যাতে ধুলা না ওড়ে। তাদের কাঁধে ঝুলানো থাকত ছাগলের চামড়ার মশক। এই মশক দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করত। ষাটের দশক পর্যন্ত ছিল তাদের কর্মকাণ্ড। তারপর হারিয়ে যায়।’

পরে ঢাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ পানির অপ্রতুলতার প্রতি খেয়াল রেখে নবাব খাজা আবদুল গণি ১৮৭৪ সালে চাঁদনীঘাটে ওয়াটার ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠার জন্য দুই লক্ষ টাকা চাঁদা প্রদান করেন। তাঁর এই বদান্যতায় ১৮৭৮ সালে ঢাকা পৌরসভায় গড়ে ওঠে ঘরে ঘরে পানি সরবরাহের আধুনিক সুবিধা। আরো পরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলে নগরবাসীর নিরাপদ পানির চিন্তা দূরীভূত হয়। এর সঙ্গে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় ভিস্তিদের পেশাদারী জীবন। আবেদন কমতে থাকে ভিস্তিওয়ালাদের। তারাও বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় নিজেদের জড়িয়ে নেন।
তবে কলকাতায় আজো ভিস্তিওয়ালাদের চোখে পড়ে।
ঢাকার দিন বদলেছে। তবে আধুনিক ঢাকায় এখন আছে আধুনিক ভিস্তিওয়ালা। তারা পাইপলাইনে বাড়ি বাড়ি পানি দেন কিংবা পানি সরবরাহ করেন। এখন ভিস্তির ব্যবহার নেই, তবে পানি সরবরাহের কাজটি কিন্তু ঠিকই আছে। সদরঘাট, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলীর লোকজন পানি সরবরাহকারীদের ‘ভারওয়ালা’ বলেন। তারা পানি ভর্তি টিনের জার ভারে বহন করেন। ওয়াইজঘাটের বুলবুল ললিতকলা একাডেমির (বাফা) পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি কল। এখান থেকে ভারওয়ালারা পানি নিয়ে পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, সদরঘাটের দোকানগুলোতে সরবরাহ করেন।

পাত্র ভেদে ভারওয়ালারা পানির দাম পান। আবার মাসিক চুক্তিতেও তারা পানি সরবরাহ করেন। সূত্রাপুরের হেমেন্দ্র দাস রোডের একটি পানির কলে দেখা গেল সারি ধরে কলস রাখা হয়েছে। অথচ আশপাশে কেউ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সরবরাহ নলে পানি আসে দুপুর ১২টার পর। সে সময় একটা একটা করে কলস ভরা হয়। সেগুলো পৌঁছে দেয়ার কাজ করেন কলসওয়ালারা। আবার নগরের বাজারগুলোয় রয়েছে পানি সরবরাহের হাঁড়িওয়ালা। তাদের কাজ বাজারের মাছ আর সবজি বিক্রেতাদের কাছে পানি সরবরাহ করা। টিনের পাত্রে ভার দিয়ে পানি সরবরাহ করেন এ পেশার লোকেরা। প্রতি টিন পানির দাম ৫ টাকা।
এদিকে এখনও কিছু ভিস্তিওয়ালা নিয়মিত জল সরবরাহ করেন মধ্য কলকাতার কয়েকটি গৃহস্থ বাড়ি আর দোকানে।

কলকাতার জনা চল্লিশেক ভিস্তিওয়ালা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের পারিবারিক পেশা। তাঁদের বেশিরভাগই আদতে বাস করেন বিহারের কাটিয়ারে। মধ্য কলকাতায় ঘর ভাড়া করে থাকেন তাঁরা। প্রত্যেক ঘরে অন্তত দশজন করে মানিয়ে গুছিয়ে থেকে যান। মহম্মদ আনসার, মহম্মদ জারিফুল, মহম্মদ রেজাউলের মতো ভিস্তিওয়ালাদের থেকে এখনও জল কিনে খান কিছু লোক। হোটেলেও যায় এঁদের জল। সকাল-বিকেল তাঁরা পুরসভার ট্যাপ কল আর টিউবওয়েলের জল মসকে ভরে ঝড়-বৃষ্টি-রোদ উপেক্ষা করে জল পৌঁছে দেন। একটি মশকে জল ধরে ৩০ লিটারের কাছাকাছি। রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড, বৃন্দাবন দাস লেন, মারকুইস স্ট্রিট, ইলিয়ট রোড, মার্কুইস স্ট্রিটের বাড়ি এবং দোকান মিলিয়ে একেকজন ভিস্তিওয়ালা দিনে দুবেলা মোটামুটি ৩০টি বাড়িতে জল পৌঁছে দেন। এর জন্য মাসে চারশো টাকার মতো খরচ হয় একেকটি পরিবারে।

বাংলা সাহিত্যে ভিস্তিওয়ালা
বাংলা সাহিত্যে ভিস্তিদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদের রচনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিস্কার কবিতায় ভিস্তিওয়ালাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক, একুশ লাখ ভিস্তি পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
সুকুমার রায় তার ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়? ছড়ায় ভিস্তিদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন এভাবে লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে? ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার? এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা ঢিপ্ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার।

শামসুর রাহমান তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ভিস্তিদের চিত্রায়িত করেছেন এভাবে, ‘রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। কালো মোষের পেটের মতো ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসীর ভেতর। মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা।
বাদশাহ নামদার উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ তুলে এনেছেন সম্রাট হুমায়ূনের বিপদে এক ভিস্তিওয়ালার সহযোগিতার গল্প।

তথ্য সূত্রঃ
https://www.bongodorshon.com
http://itibritto.com
http://www.kholakagojbd.com
https://www.risingbd.com ও অন্যান্য।

শেখ রাসেল প্রিয় ভাই আমার

কতোটা বিবেক বুদ্ধিহীন না হলে,
মানুষ নিজেকে এমন পৈশাচিক রুপে রুপান্তরিত করে।
ধিক তাদের !
আমি ধিক্কার জানাই
সেইসব নরপশুদের প্রতি!!
রাসেল,প্রিয় ভাই আমার।
নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে
যারা তোর বুকের রক্ত দিয়ে হোলি খেলতে একটুও দ্বিধা করেনি।
ধিক! ধিক!!ধিক!!! সেই নরকের কীটদের।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা তোর জীবনের।
তোর সুন্দর শৈশব,কৈশর,যৌবনের।
প্রিয় ভাই
না জানি কতটা কষ্ট দিয়ে তোকে ওরা আশার ছলনে ভুলিয়ে
অবশেষে তোর রক্ত শুষে,
পৈশাচিক নৃত্যে মেতেছিলো ওরা।
আমি দেখিনি,তোর কষ্টগুলো।
আমি দেখিনি তোর কান্না।
আমি দেখিনি,
থরে থরে পড়ে থাকা ছিন্ন ভিন্ন প্রিয় আপন লাশের মাঝে
বিভৎস বিকৃত অবয়বসমূহ।
তবুও অনুভব করি অন্তর থেকে,
প্রিয় বাবা, মা ,চাচা ,ভাই ভাবীসহ আরো অনেকের লাশ দেখে,
তোর সীমাহীন কষ্টের অনুভূতি কি হয়েছিলো।
আমি যেটুকু শুনেছি,
যা জেনেছি।
সেটুকুতেই আমার গায়ের লোম আজো দাড়িয়ে যায়,
নিদারুণ ভয়ে আর আতঙ্কে।
হে সাহসী ছোট্ট বালক
তোর ছোট্ট প্রাণে কি করে ধরেছিলি এতোগুলো কষ্ট?
আমি এখনও শুনতে পাই তোর চিৎকার,
সকরুণ আর্তনাদ
’আমি মায়ের কাছে যাবো!
’আমি মায়ের কাছে যাবো!
আমি চোখ বুঝলে বুঝি,
এখনো দেখতে পাই
তোর ঝলসে যাওয়া পা,
তোর মস্তকবিহীন দেহটা।
উফ! ওরা কি মানুষ!
ওরা তো পশুর চাইতে অধম।
ওরা তো জাতীয় বেইমান।
জাতির লজ্জা।
নয়তো এগারো বছরের ছেলের সাথে কি নিয়ে থাকতে পারে তাদের শত্রুতা?
আমি ক্ষমা চাই।
আমি করজোড়ে ক্ষমা চাই তোর কাছে ।
আমি বাঙালি জাতির হয়ে ক্ষমা চাই তোর কাছে প্রিয় ভাইটি।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা তোর জীবনের।
তোর সুন্দর শৈশব,কৈশর,যৌবনের।
প্রার্থনায় রাখি তোকে সর্বদা,
ওপারে ভালো থাকিস ভাই আমার।
ভালো থাকিস সর্বদা।
© মোঃ রফিকুল ইসলাম

গল্পঃ হায়েনা

গল্পঃ হায়েনা
************
প্রচন্ড গরমে চুলগুলো উচু করে ঝুঁটি বেঁধে মাথার ঘোমটাটা ফেলে দিয়ে মহুয়া এক মনে ডাটার শাকগুলো বাঁচছে। ডাটা আর আলু দিয়ে তেলাপিয়া মাছ রান্না হবে আজ। আর শাকগুলো হবে ভাজি ।ওপর থেকে বোঝা যায়নি যে ভিতরের শাকগুলো খুব একটা ভালো না। দোকানদারের মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি তার। মিলির শাক খুব পছন্দ। সে শুধু শাক দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আজ শাকের পরিমান নিতান্তই কম। মহুয়া মনে মনে দোকানদারকে একটা গালি দেয়।

মিলি বেচারা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনে রাতেই একবার রান্না করা হয়। গার্মেন্টসে চাকরি করলে মানুষের জীবন আর জীবন থাকে না। যদিও কষ্ট হয় তবু মহুয়া মিলিকে আগুনের কাছে যেতে দেয় না। তার কি জানি কেন যেন ভয় ভয় করে। একা একা মেয়েটা পুড়ে ধরে মরে না থাকে।

প্রতিদিন মিলি এই সময়টাতে ঘুমিয়ে নেয়। রাত দশটার দিকে এক ডাকেই সে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এটা তার নিত্য দিনের অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া শেষে সে রাত জেগে পড়ে। মহুয়া তার পাশে বসে বসে ঝিমায় আর চোখ মেলে দেখে মাঝে মাঝে, সব ঠিক ঠাক আছে দেখে আবার একটু ঝিমায়। আজ কাজের চাপ একটু বেশি ছিলো, ফিরতি পথে বাজার করে ফিরতে ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গেছিলো। দেরি হলে আজকাল মহুয়ার খুব চিন্তা হয় মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। ঘরে একা থাকে। পাশে যে পাঁচ/সাত ঘর লোক থাকে সবাই একই গার্মেন্টসে কাজ করে। বাড়ি থাকে ফাঁকা। দুনিয়ায় খারাপ লোকের অভাব নাই। চিন্তা সেজন্যই। খাওয়ার পর মিলি বই নিয়ে পড়ে আর মহুয়া ঘুমায়। ঘুমায় বলা ভুল।ঝিমুনি বলা চলে একে।
-কত রাত হলো রে মা।
-রাত একটা বাজে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো মা। আমার দেরি হবে একটু। একটা অঙ্ক কিছুতেই মিলছে না।
-এখন ঘুমা কাল সকালে চেষ্টা করিস।
-ঠিক আছে, মা তুমি এবার কিন্তু আমারে আজিজ স্যারের কাছে প্রাইভেট দিবা। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি না। না হলে কিন্তু রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে।
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আসলে সে আর পেরে উঠছে না, লেখা পড়ার যা খরচ! এতো টাকা সে কোথায় পাবে? দুবেলা ভাত জোটানোই যেখানে মুশকিল। লেখাপড়াটাকে আজকাল তার কাছে গরীবের ঘোড়া রোগ মনে হয়।

আজ প্রচন্ড গরম পড়েছে। অন্যদিন জানালা দেওয়া থাকে, আজ একটু বাতাসের আশায় জানালা খোলা। আশেপাশের সব ঘরে শুনশান নিরবতা নেমে এসেছে। সবাই এখন গভীর ঘুমে, তাদের ঘরটা অবশ্য বেশ একটু দূরে। তবুও বোঝা যায় কেউ জেগে নেই।
মহুয়া বলল,
-জানালাটা লাগিয়ে দে মা। খোলা রাখিস না।
মিলি জানালার কাছে পৌছতেই একটা মুখ ভেসে ওঠে। এত রাতে জানালায় মুখ! চেনা অচেনা বড় কথা নয়। ভয় লাগারই কথা। মিলি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে,
-কি চাই। কে আপনি?
-কেমন আছো ? আমি গো আমি, ভয় পাও কেন?
পাশের বাসার মান্নান চাচা!
চাচাকে সে ভালো মতো চেনে আর জানে, মায়ের সাথে ভালো সম্পর্ক, বিপদে আপদে সাহায্য করতে বলার আগেই দৌড়ে আসে। এই লোকটাকে তার মতলববাজ বলে মনে হয় না। তবে এতো রাতে লোকটা এখানে কি চায়? এর আগে তো কোনদিন রাত বিরেতে একে এদিকে আসতে দেখেনি।
মিলির ইচ্ছা না হলেও বলে,
-ভালো আছি চাচা। আপনে ঘুমান নাই?
মহুয়া এতক্ষণ ঘুম ঘোরেই ছিলো। সে হঠাৎ অন্য মানুষের গলার আওয়াজে সতর্ক হয়ে গলা চড়ায়,
-এই কে ?এতো রাতে কে কথা বলে?
-আমি মান্নান !
-এতো রাইতে কি? বাড়িত যান, মাইনসে দেখলে খারাপ কইবো।
-কেউ দেখবো না। সব ঘুমে। মহুয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মেয়ের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। কি একটা ভাবে। কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার সময় চলে এসেছে মনে হয়। কিছু একটা করতে হবে না হলে এই হায়েনার হাত থেকে সে মিলিকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না।

মানুষের জীবনে অনেক অজানা দিক থাকে যা সযতনে লুকানো। কোন কোন ঘটনা লুকিয়ে রাখতে হয় সামাজিক মর্যাদা হারাবার ভয়ে। আবার কখনো অনেকটা বাধ্য হয়ে। মহুয়ার জীবনে এরকম লুকানো গল্প আছে। সেই প্রবঞ্চনার গল্প কেউ জানে না। সে অতি গোপনে সেই গল্প লুকিয়ে এসেছে সযতনে। এছাড়া তার কি বা করার ছিলো।
তখন মিলি পাঁচ বছর বয়স। সদ্য বিধবা হয়েছে সে। আত্নীয় বলতে এই পোড়া শহরে কেউ নেই। গার্মেন্টসের চাকরিটা আগেই ছিলো বলে মিলির বাপটা মারা যাওয়ার পরে সে এই শহরে টিকে গিয়েছিলো। আর যাওয়ার জায়গাও তো ছিলো না তার। সব জায়গায় যেমন শিকারী পশু থাকে মহুয়ার আশেপাশে তেমন একটা পশু ঘুরে বেড়াতে লাগলো সবার অলক্ষে। সন্তপর্ণে।
একে তো বিধবা একা এক নারী। কৌশলে ফাঁদ পাতে আপাত দৃষ্টিতে নম্র ভদ্র হায়েনারূপী মান্নান। সবাই তাকে অল্পবয়সী সাধাসিধা যুবক হিসাবে খুব ভালো জানে। বাইরে সাধাসিধা হলে কি হবে ভিতরে ভিতরে কামার্ত এক ভয়ঙ্কর পুরুষ সে। খালি চোখে এই এলাকার সবাই তাকে নম্র ভদ্র জানলেও মহুয়া জানে কতটা নরপিশাচ এই মান্নান।
বস্তির বারোয়ারি সাধারণ খোলামেলা গোসলখানার সুযোগ নিয়ে মহুয়ার গোসল দৃশ্য মান্নান মোবাইলে ভিডিও করে অতি গোপনে। তারপর সুকৌশলে সে মহুয়াকে কবজা করে খুব সহজে। অসহায় হরিণীর মতো বাধ্য হয় মহুয়া মান্নানের পাতা ফাঁদে পা দিতে। প্রত্যেক সপ্তাহান্তে সে ধর্ষণের শিকার হয় মান্নানের দ্বারা। অনেকবার ঘর পাল্টাতে চাইলেও মান্নানের নীরব হুমকির কাছে সে আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
মহুয়ার মন আজ রাতে অন্য আশঙ্কায় উদ্ধিগ্ন হয়ে ওঠে। এক ঝলক দেখে সে বুঝতে পারে মান্নানের চোখ মুখ আজ অন্য কথা বলছে। তার চাওয়াগুলো বদলে গেছে ইদানিং। এর আগে সে ইশারায় দাবিও জানিয়ে এসেছে। তার সাথে যা হয়েছে মহুয়া চায় না মিলির সাথে তা হোক। সে মিলিকে জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখবে।
মান্নান আবদারের সুরে বলে,
-দরজা খুলবা না ভাবী।
-রাত হইছে আপনে বাড়িত যান।
-বাড়ি তো যামু তয় তোমার লগে একটু কথা আছিল। প্রাইভেট কথা। জরুরী।
-এতো রাইতে কোন কথা নাই।
-আহ ভাবী তুমি বড় বেশি অবুঝ হইয়া উঠতাছো।
-আপনে বাড়ি যান।
-যদি না যাই। মান্নান ঘাড় বাঁকায়।
মহুয়া বুঝতে পারে আজ একটা ফায়সালা করতেই হবে। একে এতোদিন প্রশ্রয় দেওয়াটাই হয়েছে চরম ভুল। আগেই একটা হেস্তনেস্ত করা উচিত ছিলো। কথা বাড়ালে লোকজন জেগে যাবে। একে আজ একটা শিক্ষা দিতেই হবে।
মহুয়া দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।
মান্নান আহ্লাদী করলো।
-ঘরে ডাকবা না।
-না।
-কেন?
-মাইয়ার সামনে আমি….
-আমিতো আজ তোর লগে বইতে আহি নাই। মান্নান দাঁতে দাঁত চাপে।
মহুয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই শয়তানের লোভ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
-অন্য দিন হইবো। আজ মিলির শরীর খারাপ।
-আমি কিছু করমুনা, একটু দেখইখ্যা তারপর যামুগা। এই আবদারটুকু রাখবা না।
মিলিরে রাজি করানো লাগবো, চিল্লা চিল্লি হইলে আপনের বদনাম হইবো।
-আমি জানি। আমি সব বুঝি। তুমি কি মনে কর আমি তোমাগো কথা একটুও ভাবি না? তুমি রাজি কিনা কও?
মহুয়া কি যেন ভাবে তারপর মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,
-আপনে খাড়ান আমি মিলিরে রাজি করাইয়া আহি।
মান্নান খুশিতে আকাশের তারা গুনতে থাকে। যাক এতোদিনের প্রচেষ্টা সফল তাহলে।

মহুয়ার মাথায় দ্রুত চিন্তারা ঘুরপাক খায়। সে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এছাড়া যে আর কোন উপায় নাই। তার জান থাকতে সে মিলিকে এই নরপশুর হাতে কিছুতেই তুলে দেবে না। প্রথমে মিলিকে সে রান্না ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে। মিলি প্রশ্ন করলে সে ইশারা করে। চুপ থাকতে বলে। মিলির ভয় করলেও সে চুপচাপ মায়ের কথা মেনে নেয়। কি করে যেন সে মোটামুটি একটা ধারনা পেয়ে গেছে। কি হতে চলেছে।
এরপর মহুয়া ভেতর ঘর থেকে ধারালো বঠি সযতনে লুকিয়ে এনে মান্নানকে আহ্বান করে ঘরে আসার জন্য। মান্নান ঘরের চৌকাঠ পেরুতেই অসুরিক শক্তি দিয়ে মান্নানের মাথা বরাবর ধারালো বঠি চালিয়ে দেয়ার আগ মুহুর্তে মিলি এসে তার মায়ের পা চেপে ধরে।
মহুয়া প্রচন্ড অবাক হয়ে বলে,
-সরে যা মা, এই পাপীর বিচার না করলে আমার পাপ হবে।
-মা তুমি উনারে ছাইড়া দাও।
-না, মহুয়ার স্বরে যেন আগুন ঝরে।
-মা আমি উনারে ভালোবাসি। তুমি উনারে কিছু কইয়ো না। তুমি ছাইড়া দাও। যা কওনের তুমি আমারে কও।
ধূর্ত মান্নান সুযোগ বুঝে তার হাত থেকে বঠিটা কেড়ে নেয়।
হঠাৎ দমকা হাওয়ায় মহুয়ার পৃথিবী উল্টা পাল্টা হয়ে যায়। দুলে ওঠে তার চারপাশ। এ কি করে সম্ভব? এটা কি করে সম্ভব?
মহুয়া খুব ঠান্ডা গলায় বলে,
-মা’রে পাপের প্রায়শ্চিত্ত আরো আগে করলে আমার এমন দিন দেখতে হইতো না। অন্যায়ের প্রশ্রয় দেওয়া মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল। আমি আগে জানলে এই ভুল কোনদিনই করতাম না।
মিলি তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে। আশেপাশের ঝুপড়ির লোকেরা জেগে উঠেছে। কেউ কেউ এদিকে এগিয়ে আসছে। পরম নিশ্চিন্তে মান্নান বিড়ি ধরালো। সে জানে মিলি আজ তার পক্ষে আছে। তার কোন ভয় নেই। মা মেয়ে দুজনেই আজ তার হাতের মুঠোয়।
মিলি একটানা কেঁদে চলেছে,
-মা তুমি আমারে মাফ কইরা দাও। মা তুমি আমারে মাফ কইরা দাও।
মহুয়ার কাছে আজ এই পৃথিবীটাকে অর্থহীন মনে হয়। লোকজনের ভীড় বাড়তে থাকে। মহুয়া অথর্বের মত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

হিংসুটি প্রেমিকা

হৃদয়ে ব্যালকনিতে ফুটেছিলো এক গোলাপ।
সে আবদার করেছিলো, প্রেমিকার সাথে করবে আলাপ।
আমি বলেছিলাম, প্রিয়তমা যদি রাগ করে তখন কি উপায়?
বলল গোলাপ, ফুলকে বাসেনা ভালো এমন মানুষ কি হয়?
গোলাপের কথাতে তো আমি হেসেই মরি।
কতটা জ্ঞানী দেখো আমার গোলাপ সুন্দরী।
সব শুনে প্রিয়ার হলো ভীষণ মুখ ভার।
গাল ফুলে অভিমানে মারাত্মক আকার।
বললাম,
কি হলো কি বলেছি প্রিয়তমা তোমায়?
দোষ যদি করে থাকি প্রায়শ্চিত্তের উপায়?
প্রিয়া বলল,
গোলাপ হলো সুন্দরী, আমি বুঝি অসুন্দর?
থাকো তুমি গোলাপ নিয়ে কাঁটার ভিতর।
মনের কষ্ট মনে নিয়ে গোলাপ গেলো শুকিয়ে।
সীমাহীন দুঃখ নিয়ে আমি রইলাম তাকিয়ে।
এতো কেন হিংসুটে মেয়েগুলো হয়।
আমি বুঝি শুধুই তার আর কারো নয়?

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।