রক্তপাতের কথা ও কাহিনী

Scre

মেয়েটা বলছিল
আমি শুনছিলাম…
ফোনের ওপারে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ভয়ঙ্কর তান্ডব
বলতে বলতেই মেয়েটার গলা বুজে আসছিল
বলতে বলতেই মেয়েটা কাঁদছিল অনর্গল
মাত্র দশে বাবার কথা শোনেনি বলে দুটো ছোট্ট ছোট্ট পা
বেঁধে তাকে হেটমুন্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল পাক্কা এক ঘন্টা
তাকে ঝুলিয়ে রেখেছিল তারই ব্যক্তিত্ববান মধ্যযুগীয় বাবা
না, তার বাবা কোনোদিনই পুলিশ ছিল না
তার বাবা এক ডাক্তার
তার বাবা এক উকিল
তার বাবা এক শিক্ষক
মেয়েটা সেদিন একটুও কাঁদেনি
একবার সার্বজনীন খেতে বসে রোগাভোগা মেয়েটার
জামায় পড়েছিল এক টুকরো ভাত, তারস্বরে চিৎকার করে
পাড়ার সব্বাইকে জানিয়ে এই ম্লেচ্ছ মেয়ের বিচার চেয়েছিল
সেই ছোট্ট ফরসা রোগা মেয়েটার আশিবছরিয়া ঠাকুমা
খাবার থালায় লাথি মেরে বেড়ালছানার মতো ঘাড় ধরে
তুলে নিয়ে ছড়ানো অপর্যাপ্ত উঠোনে তাকে চোরের দাওয়াই
দিয়ে সিধে করতে চেয়েছিল বিদ্বজ্জন বাবা, তার বাবা উচ্চশিক্ষিত
সমাজকল্যাণ হয়েছিল সেদিন
সমাজ বেঁচেছিল অবক্ষয় থেকে
আশ্চর্য মেয়েটা, সেই ছোট্ট মেয়েটা
সেদিনও একটুও কাঁদেনি
আর সেই যে দুপুরে চোর পুলিশ খেলায় সামান্য আওয়াজে
দিবানিদ্রার চটকা ভেঙে গেছিল বলে তেরর সদ্য মেয়ে থেকে
মেয়েমানুষ হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণের দ্বিতীয় দিনে সদ্য কেটে আনা
কঞ্চির দাগ পিঠ কেটে পা কেটে কচি দুটো হাত কেটে ঝরঝর
রক্ত ঝরিয়েছিল তবুও ক্ষান্তি দেয়নি যে শিরোমণি, সে তারই বাবা
হতবুদ্ধি মেয়েটা
বোকা মেয়েটা
সেদিনও একটুও কাঁদেনি, অবেলায়
আজ ফোনের ওপারে থমকে থাকা প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে
একমাত্র জীবন্ত গ্রহ, মাথার ওপরে মেঘ জমছে গাঢ়
বৃষ্টি নামবে অনেকদিন হাপিত্যেশ বসে থাকা গৃহস্থালীর শেষ উঠোনে
আজ মেয়েটা কাঁদছে তার বরের নির্বিকল্প মারে
ফোনের ওপারে মেয়েটা কাঁদছে
ফোনের এপারে কাঁদছে পৃথিবী
হতভাগা গ্রহটার বুক থেকে ঝরছে রক্ত
মেয়েটা এখন অ্যাসাইলামে আছে।

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

8 thoughts on “রক্তপাতের কথা ও কাহিনী

  1. এই চিত্র আমাদের অনেকের যাপিত জীবনে খুব একটি অপরিচিত নয়। মনে হয় খুব চেনা। ভালো থাকুক সবাই। শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী। শুভ সকাল। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।