সৌমিত্র চক্রবর্তী এর সকল পোস্ট

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

আগমনীর প্রারম্ভ মূহুর্তে

সেই কালো ছেলেটা দেখছিল।
এই সময়টায় এবং
শুধুমাত্র এই সময়টায় সে সময় পায়
তার রূপকথার পৃথিবীটা কেমন
আস্তে আস্তে মাথা তুলছে।

কালো অ্যাসফল্টের রাস্তার অর্দ্ধেক জুড়ে
ও পাশের একফালি ফাঁকা জায়গায়
কয়েকদিনের সমূহ ব্যস্ততা,
কত রকমারী জিনিসপত্র জোড়াতালি
কত মানুষের আনাগোনায়
কখনো রাজপ্রাসাদ, কখনো প্রেমের দূর্গ।

ছেলেটা এত শত বোঝেনাকো,
বোঝার কিম্বা ওগুলো ছোঁয়ার কোনো
মৌলিক অধিকারও নেই তার;
তাতে কিচ্ছুই যায় ও আসেনা
বিস্মিত দুই সরল চোখের,
আসলে সে এত জানেই না!

একবার সে একটা আস্ত সিনেমা দেখেছিল।
কারা যেন সারা বিকেলের সূর্যডোবা আলোয়
মাঠজুড়ে টাঙিয়েছিল অত্যাশ্চর্য এক কাপড়,
আর ঝুপ করে অন্ধকার লাফিয়ে পড়তেই
সে এক মায়াবী জগৎ তার মনে সেঁধিয়ে গেল।
মাঝেমাঝে ঘুমের অবকাশে সেও
হয়ে যায় সিনেমার সেই মায়াবী পুরুষ…
তারপরেই, খিদের অসভ্য খোঁচায় সব উধাও।

কিন্তু এখানে, চোখের সামনে
যে রোশনাই জুড়ে চারদিনের অলীক পৃথিবী
ওরা কিছু খেতে দেয়না কেন?
ওরা কিছু খুদ তুলে দিলে মা টাও
ফুটপাথে মরতো না ওষুধের অভাবে।
ছেলেটা তখন তাকিয়েছিল একদৃষ্টিতে,
সেই কালো হাড়জিরজিরে ছেলেটা।

গায়ে কোনো জামা ছাড়াই দাঁড়িয়েছিল
সূর্যাস্তের পরম আদরী আলোয়,
শতচ্ছিন্ন প্যান্ট অবহেলায় নেমে যাচ্ছিল নিচে,
কিন্তু আশ্চর্য, ছেলেটা উলঙ্গ হচ্ছিল না।
ছেলেটা দেখছিল আগমনীর তুমুল ব্যস্ততায়
সেই সুগন্ধী সুবেশ কর্ত্তাদের পরনেই
কোনো কাপড় নেই, চোখে কোনো পাতা নেই,
ওদের স্বচ্ছ অলিভ ত্বক কোথায় উধাও।

ছেলেটা ক্রমশই আকাশ ছাড়িয়ে উঠছিল।
সেই কালো শতচ্ছিন্ন ছেলেটা,
তার সমস্ত খিদের আগুন হাতের তালুতে নিয়ে
একদৃষ্টে তাকিয়েছিল
সেই সুন্দর মায়াবী জগতের দিকে, যেখানে
মা কোনোদিনই আসবে না।

28
.
(আসছে পুজো। আমার তিতলিঝোরা কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতা এসময়ের জন্য দিলাম এখানে)

স্বাধীনতা

সরকারি অকর্মণ্যতা আর রাজনৈতিক দলগুলোর উস্কানিতে ১৯৪৬-‘৪৭ সালে ঐ সরকারি হিসেব মতই পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
আমরা একবারের জন্যও সেই হতভাগ্যদের কথা স্মরণ করিনা।

স্বাধীনতা দিবস এল, চলে গেল ফের। আমরা মাংসভাত খেয়ে, শপিংমলে গিয়ে, আর ভুল সুরে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে একটা পতাকা তুলে একটা ছুটির দিন কাটালাম। অপদার্থ নেতাদের দোষ দিচ্ছি না, মুখে জয়হিন্দ, বন্দেমাতরম্ বললেও এর মানে মুষ্টিমেয় জানে।

ক্রমশঃ আমরা ইয়াংকি কালচারের অকর্মন্য নকলনবীশ হচ্ছি। ফাঁকিবাজ, অর্থলোলুপ, ঘুষখোর, চোর জাতি হচ্ছি আমরা। নিজের মুখের সামনে একটা জাতীয় পতাকার ছবি লাগালেই জাতীয়তাবাদী হওয়া যায় না। দেশ কে সত্যিকারের ভালোবাসতে হলে নিজের মন ও কাজ পরিষ্কার করতে হয়।

খেতু বাগদি ও গোপাল কাহার বেঁচে আছ! সেই যে পতাকা তোলা দেখতে গিয়ে হারিয়ে গেছিলে নির্বীজ জন অরণ্যে, তারপর দীর্ঘ ছিয়াত্তর বছর তোমাদের কথা উচ্চারিত হয় বছরের মাত্র দুটো দিনে। তোমার পরনের সেই ছেঁড়া ফাটা গামছাটা আজও জীবিত আছে খেতু? আর গোপালের তার একলৌতা জীবনের মতই আধময়লা ফ্যাকাশে ধুতি?

আমিও আর পতাকা তোলা দেখতে যাই না এখন। আমি এখন এলইডি বাহাত্তর ইঞ্চি জুড়ে ঘরজোড়া গমগমে হাততালির বুক চিরে সটান পৌঁছে যাই লালকেল্লার চওড়া পাঁচিলে। তোমাদের কথা আমাদের মনেও পড়ে না বিশেষ।

কতদিন যেন না খেয়ে সেদিন মানুষের জঙ্গলে গেছিলে তোমরা? আমরা এখন সকালে পাস্তা, দুপুরে ভুরুভুরে বাসমতী, সন্ধ্যেয় ব্ল্যাক ডগ আর রাতে বিরিয়ানি – রেশমি কাবাব। এখন আর কেউ না খেয়ে মরে না গো হাড়হাভাতে বোকা মানুষের ঝুন্ড।

পেটভর্তি হয়ে গেলে অবসর অবর সময় আমরা দেশ ভক্তির ভজন গাই। আমরা নিজেরাই নিজেকে দেশিকোত্তম উপাধি দিয়ে গলায় পরে নিই তেরঙা চাদর। সেই চাদরে এক এক রঙ এক এক সময়ে উজ্জ্বল হয়ে ছলকে উঠে রাজপথ, মাঠ আল, মাটির কুটির কিম্বা ঝকঝকে খিলান ওয়ালা বাড়ীর মেঝেতে লোহিত কণা আঁকে এন্তার। রাত গভীর হলে নেশার দমকে আমার গলা ভেঙে যায়। দুরকম গলায় চেঁচিয়ে উঠি – হর হর মহাদেও – আল্লাহু আকবর! আমার দুহাত আমার নিয়ন্ত্রণ ছুঁড়ে ফেলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে যায়। ওহে বুদ্ধু গোপাল – খেতু, আমরা এখন চাঁদে উপগ্রহ পাঠাই।

শুধু রাত্তির ঝুম হয়ে এলে নেশার প্রথম প্রহর জমে উঠলেই তোমাদের দুজনের কুৎসিত কাটা মুণ্ডু চোখের সামনে দোলে, ঠাঠা করে হাসে, আমাকে বিদ্রুপ করে।

গোপাল কাহার – খেতু বাগদি আজকাল আমি রাতে ঘুমোতে পারি না যে!

একদিন যাব

একদিন সত্যিই যাব
গলির সব খানাখন্দ, ভেঙে
পড়া ল্যাম্পপোস্ট এড়িয়ে
সেদিন আকাশ হাসবে
প্রতিবেশীর বাড়ির ফুল
হেসে উঠবে খিলখিল
গঙ্গার প্রত্যেক নৌকা তুরুতুর
তিরতির গল্প বলবে অবিশ্রান্ত
একদিন যাব, সত্যিই
সচকিত সিংহের প্রহরা সরিয়ে
দরজা খুলে রেখো।

স্মৃতিসৌধ

Un

ছায়াখেলা আলোবেলা
স্মৃতির কুহক কুহু ডাকে,
খেজুরের মোহপাতা
উঠানের তুলসী
যাযাবরী বিশ্রাম
নক্সী আসন পেতে রাখে।
কাঠকুটো সাধারণ
বালতি ও গামলায়
স্নেহছাপ ট্রেডমার্ক
সূর্যও চুমু খায় সোহাগে
মেটে অবগুণ্ঠিত
লজ্জারুণ তাকে;
আমি আছি, তুমি আছ
স্মৃতিময় স্বপ্নিল ফাঁকে।

ছোটগল্প “এ শহর প্রান্ত”

0-18

তক্তাপোষের ওপর এক হাঁটু মুড়ে অন্য পা টা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল রনি। আনমনে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের কোনের চামড়া খুঁটে খুঁটে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছিল, যদিও অত মোটা চামড়া একটু খোঁচা হয়ে উঠে আর ছাড়ছিল না। বেশি জোরে টানলে লাগছিল, আর তখনই চমকে হাত সরিয়ে আনছিল ও। কিন্তু আবার একটু পরেই হাতটা সেখানে চলে যাচ্ছিল অজান্তেই।

সামনে উঁচু একটা পড়ার টেবিলের ওপর রাখা টিভি তে ইস্টবেঙ্গলের খেলা হচ্ছে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর সঙ্গে। বেশ বেগ দিচ্ছে দলটা। রনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সাপোর্টার। সুযোগ পেলেই ক্লাবহাউসের টেন্টে ঢুকে পড়ে। ভাবও জমিয়ে নিয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে। এখন সবই তেলের যুগ। খিক খিক করে আপনমনেই হেসে উঠল ও।

পুরনো সাবেকী ঢঙের দোতলা বাড়ী। তৈরী করেছিল রনির ঠাকুরদা। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা চটে গিয়ে ইট দাঁত বার করেছে। কোথাও নোনার স্পষ্ট ছোপ। ছাদের বেশিরভাগ অংশই শ্যাওলার মোটা আস্তরণের দখলে। কতদিন যে রঙ হয়নি ঠিক মনেও করতে পারে না কেউ। কালিঘাটের এই অঞ্চলটা এখনো পড়ে আছে সেই মান্ধাতার আমলের ভাবনা চিন্তায়। ওপরে ওপরে বড় রাস্তার ধারে অনেক চকচকে দোকান, শোরুম, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট হলে কি হবে, গলির মধ্যে কিম্বা মন্দিরের সামনের জগতের মানুষগুলো এখনো সাবেক ঘি এর গন্ধ শুঁকেই দিন কাটায়। এখানে মার্জিত সুরে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনা। চিৎকার করে হামেশাই একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করা আর সেই কুৎসিত কোলাহল উঁকিঝুকি মেরে উপভোগ করা এখানকার স্বাভাবিক দস্তুর। এখানে সম্প্রতি যারা বাড়ী করেছে, তাদের এই পুরনো বাসিন্দারা বহিরাগত উপদ্রব মনে করে তাচ্ছিল্য করে।
রনি নিজেও ওই ভাবধারার শরিক। সেখানে সে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। নিজেরটুকু গুছিয়ে নিতে পারলেই হল। এত বড় বাড়ীর দেখভাল করার মত কেউই আর নেই। শরিকদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। পড়ে রয়েছে রনি আর তার জ্যাঠতুতো ভাই অনীক। সে এখনো বিয়ে থা করেনি। আর করবেও না মনে হয়। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই অনীক সল্টলেকে একটা সরকারী অফিসের কেরানি। বাড়ী বা সংসার সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহই নেই। সন্ধের অনেকপরে বাড়ী ফিরে সোজা একখানা বোতল খুলে বসে। সাথে অফিসফেরতা আনা টুকটাক খাবার আর একটা বই কিম্বা নতুন কেনা ট্যাব। এ বাড়ীর ঐতিহ্য যদিও সেরকম কিছুই নেই কিন্তু সেসম্পর্কে তৈরী করা কিছুটা টনটনে অহংকার তার মধ্যেও আছে।

গোওওল… যাহ! টালিগঞ্জ গোল দিয়ে দিল ইস্টবেঙ্গলকে। নড়েচড়ে বসল রনি। বিড়বিড় করে গাল দিল কাউকে। এই পুচকে দলগুলোর কাছে গোল খাওয়ার আগে এরা আত্মহত্যা করে না কেন? চোখদুটো ঈগলের মত তীক্ষ্ণ করে তক্তাপোষ থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকল সে। পারলে হয়তো টিভির মধ্যে ঢুকেই পড়ত।

উফ! অনেক দেরী হয়ে গেল। আরো জোরে পা চালাল সম্পাতি। এই কলকাতার ফুটপাতে তাড়াতাড়ি হাঁটাও যায়না। এখানে গর্ত, সেখানে নোংরা আর হকারের দৌরাত্য … ধুস শালা…এখানে কেউ থাকে! বিড়বিড় করল আপনমনেই। টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর মোড়ে এসে রাস্তা পেরোনোর জন্যে দাঁড়িয়ে গেল। হুশ হুশ করে গাড়িগুলো প্রায় গায়ের ওপর দিয়েই চলে যাচ্ছে। এই হতভাগা দেশে কোনো সিস্টেম তৈরী হলোনা এখনো। আর হবেও না কোনোদিন। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও কোনো ট্র্যাফিক পুলিশের চিহ্নও দেখতে পেলনা সে।

থেমেছে। চটপট পা চালিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এপাড়ে মেট্রোর সাইডে এল। ঘড়িটা দেখল একবার, বিকেল চারটে বাজে প্রায়। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরা যাবে কি? সামনে একটা বাস থেকে কন্ডাকটর চিৎকার করে যাচ্ছে- হাওড়া…হাওড়া…হাওড়া…! আর না ভেবে পাদানিতে পা রাখল ও, আর আশ্চর্য উঠেই সিট পেয়ে গেল। কলকাতার পুরনো আমলের এই বাসের সিটগুলোও একেবারেই পছন্দ নয় তার। সেই মান্ধাতার আমলের দুদিকে লম্বা লাইন করে বসার সিট। অন্যদেশের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, এই পশ্চিমবঙ্গের অন্য শহরে কিম্বা গ্রামাঞ্চলেও এই বাসগুলো আর দেখা যায়না। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে উঠলো সম্পাতির।

আসলে এখন যা দেখছে তাতেই বিরক্ত লাগছে। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমনো উচিৎই হয়নি তার। মোবাইলে একটা অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হত। সিগন্যালে আটকেছে বাসটা। অধৈর্য হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে দেখল সে। কাতারে কাতারে গাড়ি দাঁড়িয়ে সামনে।

কাল দেশপ্রিয় পার্কে অনেকক্ষণ বসেছিল শাখার সঙ্গে। সেই একই টুকটাক কথা হতে হতেই শাখা অনর্গল হয়ে গেল। নিজের কথা, ছেলেবেলার কথা, ওর বাবার কথা, মায়ের কথা, জেঠুমনি, পাশের বাড়ির তাতাই এর কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল। ঘটিগরমের ঠোঙা থেকে একটু একটু খেতে খেতে মন দিয়ে শুনছিল সম্পাতি। খুব মন দিয়ে কিছু শুনলেই তার চোখের সামনে ছবিগুলো পরিস্কার ফুটে ওঠে। সিনেমার মত সব ঘটে যাওয়া অতীত সরে সরে যায়, পিছলে যায়। একাত্ম হয়ে যায় তখন সে।

শাখার হাতের তালুটা বেশ শক্ত। ওর শ্বশুরবাড়ির প্রায় সব কাজই তাকে করতে হয়। আসলে ও বাড়িতে শাখার জায়গা কাজের লোকের প্যারালাল। ওর স্বামীটা একেবারেই অপদার্থ। মোটামুটি সবকিছুই শোনা হয়ে গেছে সম্পাতির।

হাত তুলে কুলফি ডাকলো ও। দুটো দিতে বলে একটা সিগারেট ধরালো। ঘাসের সামান্য রেখার ওপরে বসে আছে ওরা দুজন। পার্কের বাইরের রাস্তার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এদিক ওদিক গাড়ি চলে যাচ্ছে। আচ্ছা এখানে পাখি আছে?

এবারে মাত্র দুদিনের জন্যে এসেছিল সে। চাকরীসূত্রে সম্পাতি থাকে বীরভূমের রামপুরহাটে। লালমাটির দেশে প্রচুর খোলামেলা জায়গা, পাখপাখালি তাকে অভিভূত করে দেয়। আজন্ম এই কলকাতার মানুষ সে। পড়া কমপ্লিট করে প্রথম চাকরী পেয়ে বাইরে গেছিল, তাও প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। কিন্তু সেও কাঠখোট্টা গুজরাতের এক শহর, মেহসানা। বাংলার প্রাম যে একেবারেই দেখেনি তা নয়। দু একবার বন্ধুদের সঙ্গে আশেপাশের গ্রামের কোনো ট্যুরিস্টস্পটে গেছে পিকনিক করতে কিম্বা বেড়াতে।কিন্তু আপাদমস্তক গ্রাম কে এভাবে উপভোগ করা, শরীরে মনে মেখে নেওয়া আগে কখনো হয়নি।

রামপুরহাটে সে যেতেও চায়নি। কিন্তু নতুন এই চাকরীটা বেশ বড় কোম্পানীতে, আর অফারটাও বেশ শাঁসালো। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে শুনে কি হয় দেখি একবার গোছের মনোভাব নিয়েই গেছিল সে। আর গিয়েই জাস্ট প্রেমে পড়ে গেছে জায়গাটার।

শাখার সঙ্গে ওর আলাপ ফেসবুকে। সন্ধের পরে ওখানে বিশেষ কিছুই করার থাকেনা। ওখানে খুব একটা বন্ধুও নেই তার। কাজের সূত্রে যা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ। তার বেশি কখনোই এগোয়নি কোনো সম্পর্ক। তাই সময় কাটাতে সন্ধের পরে ফেসবুক খুলতে শুরু করেছিল সে। প্রথম প্রথম শুধু পড়ত, দেখত। তারপর গুড ইভনিং, গুড নাইট। আর এভাবেই কিভাবে কখন যেন আলাপ হয়ে গেল শাখার সঙ্গে এখন আর ঠিক মনেও করতে পারবে না সে। সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটে কেটে যেত। কখনো মেয়েদের সাথে সেভাবে না মেশার জন্যে ওদের মন, চাহিদা, কল্পনা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না সম্পাতির। কথায় কথায় জল গড়িয়ে সম্পর্ক কখন যেন গাঢ় হয়ে গেল। শাখার হাতের আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে সম্পাতি।

পঁয়তাল্লিশ ছুঁল সে এই লাস্ট জুনে। বাড়িতে দাদা আর বউদি। দাদার মেয়েরা বিয়ে হয়ে বিদেশে। এখানে আর ফিরে আসার চান্স খুবই কম। দাদাও রিটায়ারমেন্টের পরে ক্লাব নিয়েই মেতে থাকে। আগে আত্মীয়রা বিয়ের কথা বলত ওকে। ঠাট্টা তামাশাও করত। এখন ওরাও ফেডআপ হয়ে ছেড়ে দিয়েছে ওসব বলা। ধরেই নিয়েছে এরকমই অবিবাহিত হয়েই থেকে যাবে সম্পাতি। আসলে এতদিন মেয়েদের সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহ ছিল না ওর। মেয়ে মানেই বাধা এই ধারণাটা ওর বদ্ধমূল ছিল। আস্তে আস্তে শাখার সঙ্গে আলাপের পরে সব কেমন যেন পাল্টে গেল। সাদাকালো স্কেচের ওপরে রঙের আলতো টান লাগতে শুরু হল।

শাখার জীবনটা ওর খুব অদ্ভুত মনে হয়। ওর বাপের বাড়িও কেমন যেন উদাসীন। দুই বাড়িই প্রাচীন মানসিকতার কূপমন্ডুকতায় পড়ে আছে এখনো এই একুশ শতকেও। কলকাতা শহরটাকে সম্পাতির মাঝেমাঝে গ্রাম মনে হয়। যতই ঝাঁ চকচকে হোক ওপরটা, ভেতরে ভেতরে মানসিকতা পড়ে আছে সেই মধ্যযুগেই। শাখার বাপের বাড়িতে যেমন মনে করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আপদ নেমে যায় ঘাড় থেকে। তেমনি শ্বশুরবাড়িও মনে করে বাড়ির বউএর কদর কাজের লোকের বেশি নয়। আশ্চর্য, এদিকে লোকটা কিন্তু শাখার রোজগারেই বসে বসে খায়।

-“উঠবে না? অনেক রাত্রি হলো তো! না ফিরলে আবার চিৎকার …”
শাখার কথায় হুঁশ ফিরলো সম্পাতির।
-“হ্যাঁ চল”।
টেনিস কোরটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শাখার ডানহাতের তালুটা বাঁ হাত দিয়ে মুঠো করে ধরলো সে। শাখাও আঁকড়ে ধরলো ওর হাত। কালিঘাটের গলিতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে শাখাকে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি এখন, অথচ হিমের কোনো রেশ নেই এই মহানগরে।

একটা মানুষের আইডেনটিটি কি? একটা ভোটার আইডি? একটা আধার কার্ড কিম্বা প্যান কার্ড, পাসপোর্ট? কয়েকটা কাগজের টুকরো বা কয়েকজন সাক্ষী কি একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে? আইডির ফটো থেকে চেনা যায় মানুষটা কেমন?

সে বা তার বাবা, মা কেউই তো রনি কে চিনতে পারেনি কখনো। বিয়ের আগে প্রায় বছর তিনেক একটানা ওদের সিথির বাড়িতে যেত রনি। ভুরিভুরি মিথ্যে বলতো সেসময়। সে নাকি বিশাল আর্টিস্ট। প্রেসিডেন্সির ছাত্র, প্যারিসের ডিপ্লোমা আছে। বড় বড় এক্সিবিশন করে সে, যেগুলো উদ্বোধন করেন বিশাল মাপের বিশিষ্ট মানুষেরা। অবাক হয়ে সেসব শুনত ওদের বাড়ির সবাই। ওর বোন তো রীতিমত ফ্যান ছিল রনির। তারপর যেদিন রনি বিয়ের প্রস্তাব দিল ওদের বাড়ির সবাই যেন হাতে চাঁদ পেল। ও নিজেও বিভোর হয়ে গেছিল এক বিশাল আর্টিস্ট কে নিজের করে পাবে ভেবে। আগুপিছু কোনো খবর না নিয়েই এক অশুভক্ষণে বিয়েটা হয়ে গেল তার।

হ্যাঁ, তার বিয়েই বলবে সে। কারন রনি কোনোদিনই নিজেকে বিবাহিত ভাবেনি। বিয়ের কিছুদিন পরেই এটা বুঝতে পেরেছিল শাখা। আসলে রনির দরকার ছিল ওর মা কে দেখাশোনা করার জন্যে একটা বিনে মাইনের আয়া আর রান্নার, বাসন মাজার কাজের লোক। বিনেমাইনের, কারন রনির কোনো রোজগার ছিলনা। সব মিথ্যে কথা বলেছিল। সে আদৌ শিল্পী নয়, বলতে গেলে কিছুই নয়। পড়াশোনাও মাধ্যমিকের গন্ডীর এদিকে। আর রীতিমত দুশ্চরিত্র। প্রথম যেদিন একতাড়া চিঠি ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে হাতে পেল, সেদিন ছুটে গিয়ে রনিকে জবাবদিহি করেছিল স্ত্রীর অধিকারবোধ নিয়েই। কিন্তু রনি চিঠিগুলো হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যখন সপাটে গালে চড় মারলো, যেন বাজ পড়েছিল ওর মাথার কোষের মধ্যেই। রনির বাকী চিৎকার আর ওর মাথায় ঢোকেনি। পরে যতবারই ফোনে মা বাবাকে এসব কথা বলেছে, তাঁরা গম্ভীর হয়ে অ্যাডজাস্ট করতে বলেছেন ওকে।

কতভাবে অ্যাডজাস্ট করতে পারে একটা মেয়ে? রাত্রির এই নির্জন সময়ে একা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল শাখা। এই ছাদ আর এই রাত্রি ওর বন্ধু, ওর আশ্রয়। যখনই কোনো মানসিক বিচ্যুতি ঘটে ওর, পালিয়ে আসে এই ছাদে। এখনো পর্যন্ত কোনো ইস্যু হয়নি ওর। রনি ওকে যেমন আজ পর্যন্ত হাতে তুলে কোনো উপহার দেয়নি, তেমনি দিতে পারেনি স্বামী-স্ত্রীর সেরা উপহার। আসলে বহুগামিতায় নানারকম রোগের শিকার হয়ে পড়েছে সে। যে কয়েকবার সে রনির কামনার শিকার হয়েছে, লক্ষ্য করেছে তার আগে রনিকে ওষুধ খেতে হয়েছে। তবুও কখনোই শেষরক্ষা করতে পারেনি সে। নিজের কামনাটুকু চরিতার্থ কোনোরকমে করেই ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের তক্তাপোষের ওপরে। ওপরে সেই বিছানায় শোবার অধিকার ছিলনা শাখার। এখন অবশ্য সেই ঘর ছেড়ে দোতলায় একচিলতে চিলেকুঠুরিই তার জায়গা। ছোট্ট, তাহলেও অন্তত একা নিজের মুখোমুখি হতে পারে এখানে সে। আর খুব বিচলিত হলে, কিম্বা নির্ঘুম এইসব রাতে চলে আসে ছাদে। তাকিয়ে থাকে আকাশের তারাদের দিকে। কথা বলে ওদের সঙ্গে, নিজের সঙ্গেও। আজও গায়ে হাত তুলেছিল জানোয়ারটা। আঁকছিল শাখা। ছোট থেকেই আঁকার শখ তার। কিন্তু এখানে এসে সব জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। রনি তো কিছু রোজগার করেনা। অথচ তার চাহিদা আকাশ ছোঁয়া। প্রথম প্রথম বাবার কাছে হাত পাততে হত। কিন্তু তারপর বাবার বিমুখতা আঁচ করে এখন নিজেই টিউশন শুরু করেছে। পড়ানোর আর আঁকার। মোটামুটি চলে যায় এতেই। কিন্তু যা পায় তার বেশিরভাগটাই রনি কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যায়। কোনোরকমে কিছু বাঁচিয়ে সংসার চালাতে হয় তাকে। অথচ সেই আঁকাটাই সহ্য করতে পারেনা জন্তুটা। হয়তো তার নিজের বলা মিথ্যেগুলো মনে পড়ে যায়। আজ যখন একমনে আঁকছিল, কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল রনি, বুঝতে পারেনি। সাধারণত ওকে লুকিয়েই ছবি আঁকে সে। হঠাৎ কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে হাতে জোরে একটা ঘুষি মেরে বসলো রনি। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল সে। এখনো হাতের কব্জির ওপরটা ফুলে আছে। দুচোখ ভরে জল এল শাখার। ওপরে তাকিয়ে বলল, আর কত?

নিজের শৈশব, যৌবন সব যখন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছিল ঠিক সেই সময়েই সম্পাতির সঙ্গে ওর পরিচয়। আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষটার, ওর সঙ্গে কথা বললে সব ভুলে যায় সে। তার নিত্যকার ক্লেদ, গ্লানি, ক্ষোভ কিছুই লুকায়নি সে সম্পাতির কাছে। প্রায় একবছরে আস্তে আস্তে কখন যেন সে তার আশ্রয় হয়ে উঠেছে। রোজ ফোনে কথা হয় দুজনের। কিন্তু একটাই মুস্কিল বড় অবুঝ আর অভিমানী সম্পাতি। ওকে বোঝাতে হয় সবকিছু। আর এই বোঝানোতে এই এতদিন পরে তৃপ্তি পায় শাখা। এতদিনে সে পূর্ণ নারী হয়ে উঠছে।

ওয়ালেটটা খুলে দেখল রনি।মাত্র পঞ্চাশ টাকা পড়ে আছে। মাগীটা এখন কিছুতেই হাত উপুড় করতে চাইছে না। কি ব্যাপার কিছুই আঁচ করতে পারছে না সে। কোনো চক্কর চালাচ্ছে নাকি? কয়েকবার বন্ধ দরজায় আড়ি পেতে মনে হয়েছে কারো সাথে কথা বলছে ফোনে। এইসব বুদ্ধি নিশ্চয় সেই নাগরই দিচ্ছে। রাগে গা কিসকিস করে উঠলো রনির।

শালীকে বিয়ে করে আনার পরে বেশ বাধ্য ছিল। বাপরে! অনেক ভুজুং ভাজাং দিতে হয়েছে ওর বাপ মা দুটোকে। হেব্বি মালকড়ির টোপ দিয়ে তবে কাজ হাসিল হয়েছিল। মাগীটাকে প্রথম দেখেছিল ওদের পাড়ায় একটা ছবির একজিবিশনে। ওখানেই মাথায় বুদ্ধিটা আসে। তারপর আর্টিস্ট সাজতে ওর বেশিক্ষণ লাগেনি। আর টুপি পরানো ওর কাছে জলভাত। কিন্তু সেই বাধ্য মেয়েটা কি করে যে গত একবছরে পাল্টে যেতে শুরু করল, তার থই খুঁজে পায়না সে। যে মালটা এইসব বুদ্ধি দিচ্ছে হাতের কাছে পেলে সেটাকেও ঠ্যাঙাত সে। নিজের পিপের মত পেটটা সামনে বিছিয়ে ভাবতে বসলো রনি। কিভাবে এখন কিছু হাতানো যায়। সন্ধেয় মনিকার সঙ্গে মোলাকাতের টাইম দেওয়া আছে। খালি হাতে তো যাওয়া যায়না। অলরেডি যা গয়না ছিল চুরি করে ঝেড়ে দিয়েছে সে। আলমারীতে দামী শাড়ীগুলোরও একই অবস্থা। এখন…!

এখন চারদিকেই খারাপ সময় চলছে তার। ক্লাবে ওর ব্যাকিং সতুদাটা পট করে অ্যারেস্ট হয়ে গেল একটা কুকর্মতে ফেঁসে গিয়ে। মনিকাকে ইমপ্রেস করার জন্যে যে পঞ্চাশ কপি বই নিজের নামে ছাপিয়েছিল এর তার বই থেকে ঝেড়ে, সেই প্রেসের মালিক রন্তু আজ রীতিমত শাসিয়ে গেছে টাকা পেমেন্টের জন্যে। দুপুরে টাকা চাইতে গিয়ে দেখে ছোটোলোকের মেয়েটা আবার ছবি আঁকতে বসেছে। দেখেই ধাঁ করে মাথা গরম হয়ে গেছিল ওর। কতবার বলেছে, বারন করেছে সে, তবুও আবার! এই ছবি আঁকলেই মনে হয় মেয়েটা তাকে বিদ্রূপ করছে। ছবিটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল আর মেরে বসেছিল এক ঘুষি।

আফশোষে হাত কামড়াল রনি। ইস। তখন মাথা গরম না করে কোনোরকমে কাজ হাসিল করে নিলে এখন আর এই চিন্তায় থাকতে হত না তাকে। এতটা বোকামি তো কখনো করেনা সে। এখন কি করা যায়? পাড়ায় সবাই ওকে চেনে। সবাই মোটামুটি জেনে গেছে ওর কীর্তিকলাপ। এখন আর কেউই ধার দিতে চায় না ওকে। নানান অজুহাতে এড়িয়ে যায়। সতুদা থাকলে এইসময় কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু…
ডিওর ক্যান থেকে স্প্রে করল অকারণ। তারপর মেসেজ করল মনিকাকে, “শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ লাগছে। আজ যেতে পারব না। প্লিজ কিছু মনে কোরোনা সোনা”।

মাথা গরম হয়ে আছে। ট্রেনে আসতে আসতেই সব শুনেছে সে। আরো মাথা গরম হয়েছে দুপুরে মেরেছে জানোয়ারটা, হাত ফুলে আছে এখনো, কিন্তু শাখা ডাক্তার দেখায়নি শুনে। ফোনেই প্রচন্ড রাগারাগি করেছে সে। শাখা কথা দিয়েছে কাল সকালেই ডাক্তার দেখাবে।

আরেকটা কথা বলেছে সম্পাতি। একটা এফআইআর করতে থানাতে। প্রথমে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না শাখা। কিন্তু এভাবে মার খাওয়া বন্ধ করার যে আর অন্য কোনো রাস্তাই নেই সেটা বুঝিয়ে বলার পরে নিমরাজি হয়েছে, কিন্তু ড্রাফট টা এখন করে দিতে হবে সম্পাতিকে এই শর্তে।

মেসের ঠাকুর চন্দন খাবার দিয়ে গেল। প্লেট টা খুলে দেখল ও, রুটি, বেগুনের তরকারি আর একটা ওমলেট। খাওয়ার ব্যাপারে কোনো খুঁতখুঁতে ভাব নেই সম্পাতির। যা পায় তাই খায়। হাত ধুয়ে বসে পড়ল সে। এমনিতে জীবনে খুব বাস্তববাদী সে। কখনো আবেগের বশে কোনো কাজ করেনা। যোগ বিয়োগ গুন ভাগের চাকরী করতে করতে তার মধ্যে আসেনা কাশফুলের রোমান্টিকতা। সব আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কও একেবারে নিখুঁত দেনাপাওনার হিসেবমত। তাহলে শাখার মধ্যে কি এমন খুঁজে পেল সে, যাতে এত কাছাকাছি চলে গেল সে স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে? শাখার ক্ষেত্রেও ঠিক একই প্রশ্ন কাজ করে। স্বভাবগত ভাবেই শাখা খুব রোমান্টিক, ঠিক তার উলটো। সর্বদা একা থাকতে থাকতে নিজের সঙ্গেই কথা বলে মেয়েটা। ছবি আঁকে, কবিতাও লেখে। যদিও দু একটা ওর কবিতা শাখার ফেসবুকের ওয়ালে দেখেছে সম্পাতি, লাইকও করেছে, কিন্তু বোঝেনি কিছুই। আসলে ওসব কবিতা বা ছবি টবি বোঝার মত অত সূক্ষ্ম বোধ নেই তার। তার শুধু শাখাকে ভালো লাগে। সারাক্ষণ শাখাকে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, এটাই কি প্রেম? আপনমনেই মুচকি হাসলো সে। খাওয়া শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ল্যাপটপ টা খুলে বসল ও। ওয়ার্ডে লিখতে শুরু করল, “ টু দ্য অফিসার ইন চার্জ, কালিঘাট পোলিশ স্টেশন…”

জীবনে এই প্রথম নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। আজকের সকালটার রঙ অন্যদিনের থেকে একেবারেই আলাদা। দেওয়ালে, আশেপাশের আসবাবগুলোতে হাত বোলাচ্ছিল ও। কতদিন! কতদিন হলো এই পুরনো হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো, এই দাগ ধরা রঙ চটা দেওয়াল ওর সঙ্গী। প্রায় বারোটা বছর একটানা এদের সঙ্গেই কাটিয়ে দিল সে। নিজেই আশ্চর্য হয় শাখা। একযুগ! এতদিন সে এই অন্ধকূপে কাটিয়েছে!

আজ ঘুম থেকে ঊঠেই ছাদে গেছিল সে। কাল রাতে ভালো ঘুমও হয়নি। হাতের যন্ত্রণা তো ছিলই, আর ছিল দুশ্চিন্তা। কখনো একা বাড়ির বাইরে যায়নি সে। স্টুডেন্ট লাইফেও যখন ইউনিভার্সিটি তে যেত তখন সঙ্গে থাকত বোন। এখানে টুকটাক কোথাও বেরোতে হলে পাড়ার কোনো মেয়েকে ডেকে নেয় সে। অথচ সম্পাতির জেদে সকাল হলেই যেতে হবে থানায়। একটু একটু রাগও হচ্ছিল সম্পাতির ওপরে। একদিন থেকে যেতে পারত না সে? এরকম ভাবে তাকে বাঘের গুহায় ঠেলে দিয়ে উনি কোন চুলোয় বসে বসে পা নাচাচ্ছেন!

ওর খুব প্রিয় টবগুলোর গায়ে, টবে এতদিন যত্ন করে লাগানো ছোট্ট গাছ গুলোর গায়ে আলতো করে ভালোবাসার হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল সে। গাছেরা ভালোবাসা বুঝতে পারে। পরিস্কার বোঝে শাখা, সে আদর করলেই গাছেরা তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার হাতের আঙুলে ওরাও আদর করে। আজ ওদের আদর করতে করতে চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েকফোঁটা ঈষদুষ্ণ জল ঝরে পড়ল।

সকালে যখন বাড়ী থেকে বেরোল, রনি তখনো নাক ডাকছে। এই নাকডাকাও আগে একেবারেই সহ্য করতে পারত না সে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে মানুষকে কত কিছুই সহ্য করতে হয়। এই পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে সহ্য করা কাকে বলে, তা প্রতিদিনই একটু একটু করে জেনেছে ও। রোজ সকাল হলেই একটা ভয়ংকর আতঙ্ক চেপে ধরত তাকে। কোন দিক থেকে কি বিপদ আসবে তা আঁচ করার মত প্যাঁচালো বুদ্ধিবৃত্তি নেই তার। ছিলনা কোনোদিনই। একবার কথায় কথায় কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলে ফেলেছিল এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার কথা। শুনেই রেগে আগুন হয়ে বাবা বলেছিলেন, এ বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলে যেন সে গঙ্গায় ডুবে মরে। বাবার ঠুনকো আভিজাত্যের মোহ যে তার চেয়েও দামী এটা বুঝতে পেরে সেদিন থেকেই সে আরো কঠিন হয়ে গেছিল। বুঝে গেছিল সব সহ্য করতে হবে তাকে এভাবেই যতদিন না মৃত্যু এসে তাকে আদর করে নিয়ে যায়। হঠাৎই কোথা থেকে তার এই শপ্ত জীবনে টুপ করে ঝরে পড়ল সম্পাতি।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের চার্জে একটু আগেই পাড়ার সকলের চোখের সামনে রনি কে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে পুলিশ। ফাঁকা বাড়ির দরজায় তালা দিল শাখা, চাবিটা ওপাশে ঘুরে অনীকের হাতে দিয়ে এল। সে এখনো ঘুমের দেশেই ছিল। কাল রাতে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছিল। ঘুমঘুম চোখে কিছু না বুঝেই চাবি হাতে নিয়ে ফের বিছানায় লম্বা হল। বাড়ির এদিকটায় যে এতকিছু ঘটে গেল তার কিছুই জানেনা ও। জানতে পারলে হয়তো বাড়ির প্রেস্টিজ চলে গেল বলে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে নিত। এই অপদার্থ পরজীবীদের সম্মানবোধের আড়ম্বর যে কোন ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই বুঝে উঠল না সে এতদিনেও।

বুক ভরে একটা পূর্ণ শ্বাস টানল শাখা। স্যুটকেস টা হাতে তুলে নিল। আর এখানে নয়। জীবনটা এবার অন্যভাবে নতুনকরে শুরু করতে হবে।

বেঁচে থাকা

ভালো থেকো, বেঁচে থেকো / অমৃত ইচ্ছা তোমার বলয় / মাথায় রেখেও সর্বদা বাঁচা যায় না / আসলে বেঁচে আছি কী না / বুঝতেই কেটে যায় এক পূর্ণ জন্ম / পূণ্য যজ্ঞ থেকে জন্ম নিয়েও / যাজ্ঞসেনী বনবাসে যায় / কীচক ও দুর্যোধনের শ্লীলতাহানির হরিণ হয় / বেঁচে থাক বললেও / সর্বদা বেঁচে থাকা যায় না।

বসন্তবৌরির ডাক

uyiii

অনেকদিন পরে পাপড়ি খুলে গেল,
কেমন আছিস বসন্তবৌরি?

এখন বিকেল দেখিনা রঙীন
বিকেলগুলোয় ধার নেই আর
এখন সোজা কথা বলতেও
ভুলভাবে নেশাগ্রস্ত হই,
থাক যত বাজে কথা –
কেমন কাটালি ঐ বিহীনসময়?

শেষবার ঝগড়ায় ভুলেই ছিলাম
তোর অনাথ বাড়ির চলতি গল্পকথা
তোর অনর্থক বন্ধুত্বের অপছন্দ কাহিনীমালা।
থাক তেঁতো স্বাদ, আয় দাবদাহ কিম্বা
লেটেস্ট ফ্যাশন নিয়েই কথা শুরু হোক
কিম্বা তোর অহঙ্কারী বাবা বিষন্ন মা,
সেই হারানো বিকেলের মতোই।

আয় আবার শেষ পীত আলোর কণা
গায়ে মেখে ফুচকার জলের বিন্দু
চেটে নিই তোর আঙুলের গোলাপী আভায়।
এখনো মনখারাপী শুষ্ক আবহাওয়া ঘিরে
শ্বাসকষ্ট তোর কল্পবিলাসে!

এ নিস্পৃহ সময় কাটিয়েছি দুস্থ রামের গ্লাসে,
এই কবছর বসন্তবরণ ভিআরএসে ছিল
সারাটা সময় জুড়ে শুধু শীত শুধুই বরফপাত।

শুধুই বলার থাকে সারা দিনমান?
শুধুই কি কাজের কথায়
প্রত্যাশায়
নষ্ট করি এ প্রান্তসময়?
আজকাল সব কিছু থেকে যায়
অনুভবে
বুকের অদৃশ্য তানপুরায় কবে
যেন বেজেছিল সূক্ষ টোড়ির তান
জানিস না তুই!

আর আজ ফিরেই যদি এলি …

সত্যিই কি এসেছিস বসন্তবৌরি
যা চলে গেছে, ফেরে না কেন কিছুতেই…!

চলনবিল

সূর্য কি পোড়ে! সূর্য পোড়ায়
তুমিও পোড়াও তবু কেন যে পুড়ি না!
এ পোড়া দেশ শুধু গল্প শোনায়
আগুনের নদী ঘেরে সামুদ্র সময়।

আসলে সেই কথাগুলো বলা হয়ে ওঠে না, যে গুলো স্বপ্নের মধ্যেও অলিগলি সাঁতরায়। দিন ওঠে, দিন নামে। মানুষের হাতে পায়ে শাখা প্রশাখা। অহংকার কিম্বা নমনীয়তার বৃত্ত ছাড়িয়ে মাটির ভেতর থেকে ছলকায় বিগত গরমের ঘাম, রক্ত, কান্নার শহীদ ইতিহাস। চোখের আড়ালে জমা হয় আশ্চর্য এক হ্রদের গভীর তলদেশে। একসময়ে হ্রদের বহির্গন্ডী উপচে গেলে বাষ্প হয় প্রাচীন পুরাতত্ব।

আসলে কথাগুলো কথা থাকে না চিরকাল। না বলা কথাদের গায়ে জমে যায় অনড় সবুজ শ্যাওলা। রোদ্দুর আছড়ায়, বৃষ্টি অসময়ের নোনা গন্ধ ভাসিয়ে ভঙ্গুর করে দেয় কখনোই না জন্মানো ভ্রুণ শব্দদের। বিরল প্রজাতির ঈগল হয়ে যায় না বলা কথারা। পূর্বী সমুদ্রের ওপরে ঝুলে থাকা বাষ্পের ঝুন্ড আচমকা আকাশ বাইসন হয়ে আছড়ে পড়ে মুখ আর মুখোশের যান্ত্রিক সভ্যতার অ্যাসফল্টের রাস্তায়, মধ্যযুগীয় বাড়ির বদ্ধ উঠানে, মেকি রেস্তোরাঁর রোমান্টিক টেবল্ ল্যাম্পশেডে।

কোনো শুরু ছিল না, তাই শেষও হয় নি
বিকার ছিল না, তাই নির্বিকার হওয়ার প্রশ্নও তোলেনি কেউ;
নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কিম্বা ফুটফুটে আলো
মেরুর বরফজ্বলন শেষে ছিল না কোথাও,
এক অলীক ব্রহ্মের রূপক ঘিরে রেখেছিল আব্রহ্মস্তম্ব;
ছিল শুধু সুখ আর শোকের কল্পিত মন্ড।

নির্বিকল্প সমাধির গভীরে হারিয়ে যায় কোনো একলা মাঠকোঠা ঘর। সুখ আর সুখের বৃত্তান্তের ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় উঠে আসে অনিবার্য শৈশবের ফেলে আসা আঁচড়। আস্তে আস্তে সুখের স্মৃতিকণা জমতে জমতে জন্ম নেয় রাজৈশ্বর্যের আলো ঠিকরানো টাইটানিক। আলোর সঞ্চয় পূর্ণ হলে আচমকা মহা বিস্ফোরণ।

দু হাত একত্র করে মহাকাশ উচ্চারণ করে ওহম্! গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে উড়ে যায় শান্তির সাদা পতাকা –

প্রকৃতি রজঃস্বলা হয়…
প্রকৃতি শান্ত হয়…

ছন্ন ছড়া

সবার যখন মত্ত ছুটি
আমি তখন ঘাস্কাটায়,
সবার যখন ব্যস্ত কাজ
আমি তখন রাস্তা পা য়।

কারো পকেট ভর্তি হলেও
চোখ থেকে যায় টাঁকশালে,
দু টাকাতেই আমীর আমি
জলসা বসে জঙ্গলে।

একটুখানি নাম ছড়ালেই
প্রাসাদ গড়ে অহংকারী,
চালচুলোহীন বেবাক হাসি
এপার ওপার আমার বাড়ি।

এমনই থাক মেট্রোমানুষ
কিম্বা গঞ্জ ব্যবসাদার,
মাঠ ও গ্রামীণ আদিবাসী
সোজাসাপটা পগাড়পার।

কাব্য কিম্বা গান্ধীছাপে
ঝুঁকছে মানুষ দিন ও রাত,
এই আছি বেশ তোয়াক্কাহীন
মানুষ ছুঁয়ে হাতে হাত।

যেমন আছি

আমি কেমন আছি ভাবতে গেলেই
চারপাশ গুলিয়ে যায়
ছোট ছোট তারা চোখের সামনে
নাচতে নাচতে বুদবুদ হয়।

কাগজ কল থেকে ছাঁটাই হওয়া দাদু
কবেই মরে ভুত হয়েছে
ধুঁকতে ধুঁকতে মরে গেছে
জুট মিল থেকে ছাঁটাই জ্যাঠা।

বিএসসি পাশ দাদা এখন সাইকেলে
রোজ কয়লা পাচার করে, সন্ধ্যেয়
চুল্লুর ঠেকে কাটিয়ে রাস্তার ধারেই
শুয়ে পড়ে রাতের তারা গোনে।

দাদার প্রেম করা বউ
এক সময়ে খুব রূপসী ছিল, আজও
জেল্লার টানে দাদার বন্ধুরা আসে, তারাই
দেখে বৌদিকে, বিরিয়ানির গন্ধে ম ম করে ওদের আকাশ।

আমি চুল্লু খেতে পারিনা, সকাল বিকেল
হরিদার চায়ের দোকান, ধারে এক ভাঁড়
ভয়ঙ্কর মিষ্টি চা, কখনো শস্তার মোবাইলে
ফেসবুকের মায়া জগৎ, বছরে একবার টেট।

স্পঞ্জ আয়রন থেকে ছাঁটাই বাবা লক্ষ
টাকা চোখে দেখেনি কোনোদিন
আমি চাকরির পরীক্ষা দিই দিতে হবে বলে
লক্ষ্মীভাণ্ডারের পাঁচশ টাকা হাত পেতে নিই।

কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেই
গোল বৃত্তাকার ধূসর ঝালর নেমে আসে
আমার চারপাশে, আস্তে আস্তে ফেড হয়ে কালো
আমিও একসময় মিলিয়ে যাই কালোর অতলে।

দেয়ালা

কে ককন কিভাবে কার মাথায় কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে খাবে কিম্বা কার নখ বড় হলো, কার বউ অবলিক বর রোজকার একঘেয়ে ঘষা ছেড়ে তৃতীয় লিঙ্গের সঙ্গে লিঙ্গরাজ টেম্পল বেড়াতে গেল ফুরফুরে অফারের ডিও মেখে, এসব বিন্তিরিং সাবজেক্টে আমার এক্টুও দিলচসপি নেই। ফেস্বুকে যখন এসচিলুম তখন ছাতার মাতা এই সমাজ জালের গাঁটে গাঁটে কি চক্কর না জেনেই এসচি ওই যে ঠ্যালার নাম গঙ্গারাম পোবাদের ঘিজতাঘিজাং নাছোড় নাচের হুজুগে। এক্টু এক্টু করে শিকলুম হ্যানা সন্ধি ত্যানা বিচ্ছেদ। আর দেকলুম কি তুখোর সব কলমবাজ থুক্কু মাউস কিম্বা আঙুলবাজ! দেকতেই রহ্ গিয়া। জীবনে যাদের এক্কলম লেকা নাকউঁচু পত্রিকায় ছাপা হয়নি কিম্বা হবেও না, তাদের লেকা দেকলে মুক হাঁ হয়ে থাকতেই থাকবে, বন্ধ হবেনা। কি দারুণ লেকে গো! আত্মজীবনী লিকচে, তো নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেকচি, এত ফাস্টোকেলাস তরতরে ভাবনা কলকেতার এ ওয়ান ম্যাগাজিনেও পাব কিনা সন্দ।

গপ্পো লিকচে কয়েকজন বেশ ভালো। আর এন্তার কিলবিলে হিলহিলে কবিতা থেকে এক্কান ছাকনিতে ছেঁকে পড়, দেকবে বেশকিচু কবিতা অম্বুজা সিমেন্টের জোড়কেও টক্কর দেবে। তবে হ্যাঁ, তুমি যদি ভালোটুকু ছেড়ে হাবিজাবি হাতপাকানো গুলোকেই ফেস্বুকীয়ান লেকা বল, তাইলে রকবাজি স্টপ। দেক, যকন এত ভালো আচে, তাদের ছেড়ে ভ্যানতারাং ড্রেন তোলা মাল দেকতে পাল্লুম না। সময় আচে, সময়ের ফুটো আচে, আরাচে দুই সময়ের টেক্টনিক প্লেটে ইয়াব্বড় কিলবিলে ফাটল। ওই দুম্বো ফাঁকে পা ফাঁসলেই মুস্কিল। চ্যাটিংস্যাটিং আর দিন্রাত লাল লাল টমেটো মার্কা টিন হার্টের গুডিগুডি মর্ণিং নাইট ছেড়ে এবেলা কিচু পড়ে নাও দিকি! না পল্লেও ক্ষতি নেই কারো, কিন্তু ওই গুজব ছড়ানোর নাটমন্দিরি পিএনপিসি কোরোনা। কে ককন খ্যাঁক্কোরে কাম্রে দেবে বলা যায়!
এবার তা’লে বুজলে তো ভালো না’লে চলুক যেইসি আপকি মর্জি।

জুকুদা ঝিন্নাবাদ! ফেস্বুকদা অমর রহে!

নববর্ষ

images (1)

দেখতে দেখতে এ বছরও গড়িয়ে গেল
অর্জুন শালের অতিকায় শুকনো পাতা
গাছের মায়া ছেড়ে ভাসতে ভাসতে হাওয়ায়
লাল নীল সবুজ হলুদ গিরগিটি চোখের পাতায়
আলপনা দিল এবছর ভালো যাবে নিশ্চয়ই
ত্বক জ্বালিয়ে দেওয়া দাবদাহ লাইন দিল
খাসির মাংসখণ্ডের দোকানে

নতুন জামার অভাবে এক কুচি রুমালেও খুশি তিরতির
আড়াই হাজার কিলোমিটার দূর থেকে সমুদ্র ঢেউ
ফিসফিস বলে গেল ভালবাসি ভালবাসি

লাশের গন্ধ

কোনো কিছুই ব্যক্তিগত নয়
আহাম্মকের মাথায় ভর্তি একের পর এক
গুনতির বস্তা এখন রাষ্ট্রের সম্পত্তি,
সমস্ত দ্বৈত ও অদ্বৈত দ্বন্দ্ব
ক্রমশঃ বেড়ে যাওয়া ধর্ষকাম
অন্ত্র থেকে জরায়ুমুখে সূচের বিছানায়
ছটপট করতে থাকা নাদান কিশোরী
আর বন্ধ এটিএমের খাঁজে
কাকুতি লুকোনো বলিরেখা
একদিন যারা বাঁচতে চেয়েছিল।

আরেকটা নির্ঘুম রাত পেরিয়ে গেলে
নিজের অজান্তে রাতচরা পাখি হয়ে যাই,
তৃতীয় প্যাকেট সিগারেট শেষ হয়ে গেলে
অ্যাশট্রেতে তাকিয়ে থাকে অন্ধ আগুন:
সেদিনের বৃষ্টি ভেজা মাসুল
একশো দুই তিন গুনতে গুনতে বোবা
থার্মোমিটারের হার্ডল টপকায়
জ্বরতপ্ত ঠোঁট চেপে ধরে বালিশের
শেষ ঠান্ডাটুকু শুষে নিতে চাইলে রক্তচোখ
রাত্রি ধমকায় কাঠফাটা বিকট আওয়াজে।

মেয়েটার ব্যাথাক্লান্ত শরীর পড়ে থাকে
লোহার খাটের এক পাশে প্রাচীন মমি হয়ে,
কামুক হাতের সংখ্যা কেবলই
গুনতিতে বেড়ে ব্যঙ্গ করে নিখুঁত ভোগব্যবস্থাকে
চন্ডীদাসের রজকিনী শতভোগ্যা হয়ে উলঙ্গ জ্ঞানহীন
পড়ে থাকে পুকুরের আগাছা আড়ালে।

রাত্রি গড়িয়ে যে সকাল আসে
সেখানে সূর্য আসে না, শুধু জলবাস্পের উনকোটি
চৌষট্টি ভয়াল ছায়া উড়ে বেড়ায়
অন্ধকার আরও জম্পেশ শিকড় ছড়ায়;
প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে এঁটো বাসনা
পড়ে থাকে বন্ধ ভ্যাটের দুর্গন্ধী চৌহদ্দির বেড়ায়,
পার্লার ফেরত ফ্লুরোসেন্ট আলো অবজ্ঞায়
লাথি মেরে সরায় বিগত জন্মের
অকালে খুন হয়ে যাওয়া যাযাবরী প্রেম,
সূর্য ভয়ে পিছিয়ে যায়, রাত্রি জেঁকে বসে সকালের গায়ে।

কান্নার শেষ জলটুকু শুকিয়ে আসছে
চোখের কোল আর গাল বেয়ে
রেখে গেছে অন্তিম মিনতির রঙশূন্য দাগ
যুদ্ধের ক্ষতবিক্ষত উঠানে এক পাশ
ফিরে পড়ে আছে হার না মানা আন্তিগোনে
চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা অজস্র সহচরের
লাশের ঠোঁটে লেগে আছে না ফুরানো
একচিলতে বাদামী হাসির টুকরো
কান্নার শেষ অক্ষর দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে আন্তিগোনে
দ্রুত সেই জায়গার দখল নিচ্ছে ভিসুভিয়াসের রাগ

কোন দূরে টুই টুই ডেকে চলে একটানা
অলীক পাখিছানা নিবিড় একাত্মন্
মাঝরাতে প্যাঁচা, রাষ্ট্রনিয়ন্তা আর সুপ্ত বিবেক
ক্যাবিনেট মিটিংয়ে বসে, যুদ্ধ শুরুর আগে
খতিয়ে দেখে নেওয়ার অন্তিম চেষ্টা
মার্ডারার আর ভিকটিমের মধ্যে কার পাল্লা ভারী:
বুরবক পাখি দিন রাতের তফাৎ বোঝে না
জ্বর বাড়ে মৃত্যুর ফিতে ছোঁয়ার আকুল ইচ্ছেয়।

শেষের বেলা

A0041

হাতে তখন বাবার স্মৃতি পালক
পটভূমি পার্বত্য বন
বয়স যেন হারানো এক পাখি
সবুজ থেকে ধূসর হওয়া মন।

এপাশ ওপাশ বহতা এক নদী
ঢেউ দিয়ে যায় মৎসকন্যা ঝিলিক
কাচ হৃদয়ের টুকরো এদিক ওদিক
সময় বড় চঞ্চল এক শালিক।

শাদা কালোর সেলুলয়েড ফিতে
ত্রিভুজ ভাঁজে টাইম ট্র্যাভেল যন্ত্র
ফাগুন আগুন পলাশ ইশারায়
গুনগুনিয়ে মনখারাপি মন্ত্র।

রহস্যের দুহাতে জাগলিং
অনবধান শব্দ কলস ফাঁকি
নদীর দুপাশ ছড়ায় শ্মশান ভূমি
আর ক’টা দিন, আর ক’টা দিন বাকি।