মানুষ বাঁচতে চায় কেন? (পর্ব-৩)

মানুষের খুব সাধারণ একটা চাওয়া হলো সম্মান। সবাই সম্মান নিয়েই পৃথিবীতে বাঁচতে চায় পাশাপাশি সবাই সম্মানিত হতেও চায়। হতে চাওয়াটা দোষের নয় কিন্তু সম্মান খুঁয়ানোটা বড় দোষের। সম্মান যদি একবার হারিয়ে যায় তবে ফিরে পাওয়াটা খুব কঠিন। সম্মান হারিয়ে অনেকেই মৃত্যুর পথ বেছে নেয়। সম্মান মানুষের বিশাল সম্পদ। পৃথিবীতে এমন বহু বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান মানুষ আছেন – যারা তাদের ক্ষমতাবলে অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু তাদের সম্মান নেই। মানুষ তাদের সম্মান দেয় ভয়ে স্বইচ্ছায় নয়। আবার এমনও আছেন যারা কিনা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন, না আছে কোন ক্ষমতা না আছে কোন অর্থবিত্ত অথচ সমাজে তারা প্রভূত সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকেন। সম্মানিত হতে হলে কিংবা সম্মান পেতে হলে আপনাকে নিজের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য অনেক কিছুই করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলোঃ কাউকে কোন কথা দিলে সেই কথাটি রক্ষা করার চেষ্টা করা। মানুষের কাছে সম্মানিত হতে হলে বলা চলে এটা অন্যতম একটা শর্ত।
মানুষের জন্য এমন কিছু করা যা তাদের উপকারে বা কাজে লাগে। আপনার টাকা থাকলে মসজিদ-মন্দির, খেলার মাঠ – ঈদগাহ্ মাঠ করে দিতে পারেন, অভাবী-ঋণগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করতে পারেন। এগুলো করলে আত্মতৃপ্তি পাবেন। বেঁচে থাকার অভিপ্রায়টা আরও বেড়ে যাবে।

মানুষ কেন বাঁচতে চায়? ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিস্কার হবে। ধরুন আপনি চাকুরী করেন। সরকারী চাকুরী। বেসরকারী বলছি না একারণেই যে, বেসরকারী চাকুরীজীবীদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা খুব কমই ঘটে। কোন এক অফিসে দীর্ঘদিন চাকুরী করার পর হঠাৎ করে আপনার অফিসের বস আপনার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। বদলির চিঠি। আগামী দিন কয়েকের মধ্যেই আপনার পুরাতন কর্মস্থল ছেড়ে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে। ইস্! আরো যদি কিছুদিন এখানে থাকতে পারতাম। এই পরিচিত শহর, বাজার, দীর্গদিনের কলিগ, বন্ধু-বান্ধব সব ছেড়ে চলে যেতে সহসা মন চাইবে না। বাসার সব আসবাবপত্র, তল্পিতল্পা গুছাতে গিয়ে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে আপনার। মন কিছুতেই এই শহর, চিরচেনা কর্মস্থল ছেড়ে চলে যেতে সায় দিবে না। মনে হবে এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়েছেন। কিংবা দীর্ঘদিন পর যখন কেউ তার বাবা-মা স্বানিদ্ধ্যে আসে বা আত্মীয় স্বজনের কাছে আসে চলে যাওয়ার সময় তখনও সবার মন খারাপ হয়। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা সব চেয়ে বেশি হয়। বিয়ের পর চির চেনা পরিবেশ ছেড়ে যখন শ্বশুড় বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় তখন তো কান্নার রোল পড়ে যায়।
সবকিছু ছেড়ে না যাওয়ার জন্য এই যে একটা পিছুটান, এই পিছুটান এর কারণেও মানুষ বাঁচতে চায়। মানুষ যে পৃথিবী জন্মগ্রহন করে একদম বুদ্ধিহীন অবস্থায় সেখানে যখন সে বড় হতে থাকে, বুদ্ধি-বিবেচনা তৈরি হয়, বুকের ভেতর ভালোবাসার জন্ম হয় তখন গোটা পৃথিবী, সমাজ এবং তার পারিপার্শ্বিকতার একটা টান তৈরি হয়, অদৃশ্য ভালোবাসার একটা বন্ধন সৃষ্টি হয়। তাই হয়তো মৃত্যু চির সত্য জেনেও মানুষ আরও কিছুদিন এখানে থেকে যেতে চায়। বাঁচতে চায় আরও কিছুদিন।

মানুষের বেঁচে থাকার আর একটা কারণ হতে পারে পাপ। পাপের কারণেও অনেকেই মরতে ভয় পায়। মানুষ যখন তরতাজা থাকে, যখন রক্তে আগুন জ্বলে তখন সে পাপ করতে কোন দ্বিধা করে। খুন – ধর্ষণ – রাহাজানি – চুরি – ডাকাতি – ঘুষ – সুদ – ঝগড়া – গালমন্দ –পরনিন্দা – পরচর্চা হেন পাপ নেই যা সে করে নাই। পাপ করার একটা নির্দিষ্ট বয়সে গিয়ে তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। তখন সে বাঁচতে চায় যেন মৃত্যুর আগে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারে। আরও ভালো ভালো কাজ করতে চায় বলে সে আরও বেশিদিন বাঁচতে চায়। কিন্তু সত্যটা হলো মানুষ ভালো কাজের পরিবর্তে খারাপ কাজই বেশি করে এবং মরতেও ভয় পায়।

”মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”

মানুষ বাঁচতে চায় কেন? কবিগুরু লেখা এই দুটি চরণের মধ্যেই তার উত্তর নিহিত আছে। এই পৃথিবীটা বড়ই সুন্দর। মায়াময়! প্রেম আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। এই ভুবনে যার একবার আগমন ঘটে সে আর এর মায়া ত্যাগ করতে পারে না। তাই সে এমন সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চায় না। আবার অনেকেই চান তিনি তার সৃষ্টি দিয়ে মানুষের হৃদয়ে, ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকতে। তাই তারাও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চান। কিন্তু আমাদের জীবনটা খুব ছোট্ট, চাহিদা অসীম। কিন্তু এই সীমাহীন চাহিদা পুরণ করার মতো সম্পদের পরিমাণও সীমিত। ঠিক তেমনি মানুষের চাওয়ার যেমন কোন শেষ নেই, দেখারও শেষ নেই কিন্তু আয়ু তো সীমিত। একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছানোর পর আয়ু রেখার গতি আর উপরে উঠবে না। গতি থেমে যাবে। এটা সব মানুষই জানে। তারপরেও এই সীমিত আয়ু নিয়েও মানুষ চিরকাল বাঁচতে চায়।

মানুষ খুব সহজে মরে না। মানুষের কই মাছের প্রাণ। নানা রকম অখাদ্য – কুখাদ্য খেয়েও মানুষ দিব্যি বেঁচে থাকে। আবার অনেকেই বেঁচে থাকার মূল্যটাকে বোঝে। জীবনের মূল্য কারো কারো কাছে হয়তো বা অনেক বেশিই। তাই অধিকাংশ মানুষই আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথে পা বাড়ায় না। তারা বেঁচে থাকতে চায় আরও কিছু কাল।

শুধুমাত্র পৃথিবীতে জন্ম নিয়েই একজন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বরং জন্ম নেয়াটা তার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্যের সূচনা বলা যায়। সন্তান জন্ম নেয়ার পর বাবা-মা’র দায়িত্ব হলো সন্তানকে মানুষ করা। পড়ালেখা করানো। মানুষের মতো মানুষ করে বড় করে তোলা। এখানে ‘মানুষের মতো মানুষ’ বলতে শুধু বড় পদে চাকুরী বুঝাচ্ছে না, একজন মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ করে তোলা। যাতে করে সন্তানকে নিয়ে তার বাবা-মা গর্ব (অহংকার নয়) করতে পারেন। তারপর সন্তানকে বিয়েশাদি করানো। অতঃপর সংসারে নতুন অতিথি আসলে তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের খেলা করার স্বপ্ন। কার না থাকে এমন আশা। এই স্বপ্নগুলোর কারণেও মানুষ বাঁচতে চায়।
…………….চলবে

4 thoughts on “মানুষ বাঁচতে চায় কেন? (পর্ব-৩)

  1. কাউকে কোন কথা দিলে সেই কথাটি রক্ষা করার চেষ্টা করা। মানুষের কাছে সম্মানিত হতে হলে বলা চলে এটা অন্যতম একটা শর্ত। স্বপ্নগুলোর কারণেও মানুষ বাঁচতে চায়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণের আগের ক'টি পর্ব অফলাইনে পড়েছিলাম। আমার ভাল লেগেছে। নিয়মিত হোক।

  3. ভীষণ সুন্দর হয়েছে আলোচনাটি কবি মোকসেদুল ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।