একদিন এই মাঠে মেলা বসতো;
দূরদূরান্ত থেকে দোকানি পসরা সাজাত।
একদিন এই মাঠ কিশোরের পায়ের ভারে
দেবে যেত, কিশোরীর গোল্লাছুট
দৌড়ে নাগাল পেত না। একদিন এই
মাঠের পাশে দেখা যেত ফুল ফুটেছে।
একদিন সযত্ন মালি দূরে ফেলে দিত
অযাচিত আগাছা। একদিন এই মাঠে
হত ষাড়ের লড়াই। বিছাল যুদ্ধ দেখতে
লাখো মানুষ জড়ো হত, ধারালো শিঙের
ঘর্ষণে উত্তেজনা যখন চরমে; পরাজিত
ষাড়ের সাথে মানুষের অলিম্পিক দৌড়।
একদিন এই মাঠ বুকের কাছাকাছি ছিল,
আজ সে একা; অভিশাপগ্রস্ত মনে
নিঃসঙ্গতার হাহাকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একদিন এই পুকুর ভর্তি জল ছিল,
শৈশবের ডুবসাঁতার নিমিষেই ওপারে
ভেসে উঠতো। একদিন এই পুকুর মা মাসিদের
খোশ গল্পে সরব হত। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে
বিরহী প্রেমিক অনন্তকাল বসে থাকতো।
পুকুরের পাড় ঘেঁষে নির্লজ্জ নেবু গাছ
খিদে বাড়িয়ে দিলে দক্ষিনে দেখা
যেত প্রেমিকার মুখ। বিরহী কোকিলের কণ্ঠে
ধ্বনিত হতো বসন্তের আগমনী গান।
মা, মাসীদের আড্ডা পুকুর নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
বিলীন হয়েছে প্রতীক্ষার বাঁধানো ঘাট।
বিরহী বসন্তের গান শুনতে
প্রেমিক আর আসেনা পুকুরের ঘাটে।
এই বাড়ি একদিন একান্নবর্তী ছিল;
চাচাদের সাথে চাচিদের বিয়ে সম্পন্ন হলে
পাক ঘরের মেঝেতে থালার পরিধি
ব্যাপ্ত হত। একদিন এই বাড়ির উঠোনে
ধান মাড়াই হত, হুঁকোর নল মুখে নিয়ে
ক্লান্ত দাদা আরামে চোখ বুজে ফেলতেন।
একদিন এই বাড়ির ছেলের সুন্নতে খৎনায়
হাজার মানুষ দাওয়াত খেতে আসতো।
গ্রামের শালিসে, চেয়ারম্যানের ভোটে
এই বাড়ির উঠোন উন্মুক্ত ছিল। একদিন
এই বাড়ি দাদা দাদী মা বাবা চাচা চাচী
ফুফুতে মুখরিত ছিল, আজ শুনশান।
বাড়ির চারিদিকে আজ কবরের নিরবতা।
একদার সরব উঠোন নির্যাস মুছে যাওয়া
বিধবার মত একা দাঁড়িয়ে আছে।
এই বাজার একদিন জুলেখা বিবির
চায়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। আসতুম মোল্লার
পান, হরিপদ সান্যালের রসমালাই, নজু শেখের
পাতিল, উত্তম কর্মকারের জুতা-কর্মের জন্য
বিখ্যাত ছিল। গৌতম শীলের সেলুনে
দীর্ঘ অপেক্ষায় মানুষ বিরক্ত হত না।
তার রসসিক্ত আলাপে পাশের দোকানের
রমিজ উল্লার সেলাই কাজে ব্যাঘাত ঘটলে
ঝগড়া বাঁধার উপক্রম হত। হাটবারে
তাজা মাছ, সবজির সাথে পাওয়া যেত ছাতা,
নিষিদ্ধ বিড়ি, ছিকরমাটি। আব্দাল খানের
দোকানের পিছনে জমে উঠতো জুয়ার আড্ডা।
মাঝেমধ্যে পুলিশের সামান্য বিড়ম্বনা ছাড়া
প্রাণবন্ত ছিল এই বাজার। আজ জনশূন্য,
লাওয়ারিশ কুকুরে অতিষ্ঠ বাজারে
আজ কোন কুকুরেরও দেখা মেলে না।
একদিন এই পথ দিয়ে লোক চলাচল
করতো। হাজার হাজার পা ছাপ রেখে পৌঁছে
যেত নিজস্ব গন্তব্যে। প্রিয়জনের জন্য
অপেক্ষমাণ চোখে যখন অস্থির চিন্তা দানা
বাঁধছে পথের মোড়ে দেখা যেত বিশ্বস্ত চাঁদ।
বিপরীত মানুষকে নাক বরাবর হাঁটাতে এই
পথের জুড়ি ছিল না। কত শ্লোগানে, মিছিলে
উত্তপ্ত হয়েছে পথ। কত অভাগা পথের
চাকায় পিষ্ট হয়ে ছেড়ে গেছে ধরাধাম।
কত বেভুল পথিক নিরুদ্দেশ শেষে ফিরেছে।
সংসার ত্যাগী বৈরাগ্য ভুলে জপেছে আরোগ্য মন্ত্র।
অসংখ্য মানুষের পায়ের ছাপে মুখরিত
পথও আজ ধূলি বর্জিত। ভুলেও কেউ
এই পথ মাড়ায় না, একাকিত্বের বেদনা
নিয়ে এই পথ দাঁড়িয়ে রয়েছে একা, একা।
অনেক অনেক ভালো থাকুন এবং ভালো রাখুন প্রিয় কবি আবু মকসুদ ভাই।