আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

বুকের ধ্রুপদী দাগ

আমাদের বাসার সামনে দিয়ে যে সরু রাস্তা
সবুজ পরিধান করি তুমি রোজ যাও;

তুমি বোধহয় নবম শ্রেণী,
আমিও। তোমাদের স্কুলের বিপরীতে
শ্যাওলা পরা যে দালান ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু
হচ্ছে; তার কোন এক ক্লাসে
এলজেব্রা কষতে গিয়ে আটকে যাচ্ছি।

অমনোযোগী ছাত্রের প্রতি
বিপিন পালের কোন দয়ামায়া নাই।

এলজেব্রা কষতে গিয়ে
আমি সবুজ কষি, কষি তোমার নাকফুল।

অমনোযোগের শাস্তি বেঞ্চে দাঁড়ানো,
তবে মন্দ লাগছে না।

জানালার বাইরে তোমাদের স্কুলের
চকচকে নতুন বিল্ডিং
অসংখ্য সবুজের সমারোহ।

কোন এক সবুজে তুমিও আছো
উৎসুক চোখ বাইরে তাকিয়ে আছে।

চোখের দূরবীন তোমাকে খুঁজছে
বুকে চিনচিনে ব্যাথা;
মেয়ে তুমি কী জানো
তুমিই বুকের ধ্রুপদী দাগ।

সমগ্র আকাশ

mok

আমাদের জমানায় মুজিব ছিলেন না। যখন বড় হচ্ছি সানগ্লাস মেজরের রমরমা অবস্থা, চারদিকে প্রচুর খাল খনন কুমির আনা হচ্ছে। ঘোষক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে, প্রথম বাংলাদেশ শেষ বাংলাদেশে পরিণত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তিরোহিত; তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ তাঁকে খুঁজছে না।

খাল কাটা বিপ্লবীর করুণ অন্তের পরে বিশ্ব বেহায়ার আগমন, এসেই পূর্বমুখী সেজদা করা শুরু করে দিয়েছে। স্যাটেলাইট মেজর উল্টো পথে হাঁটার যে প্রথা শুরু করেছিল; লেজোহোমো সে পথে রকেট গতি লাগিয়ে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু উচ্চারিত হন না, তিনি ছিলেন বলে মনে হয় না।

বঙ্গবন্ধু ঘাতকের হাতে নিহতের সময় আমার বয়স পাঁচ, আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতা আরোহণের সময় ২৬। বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে আমরা বড় হয়েছি, বঙ্গবন্ধু ছাড়া বড় হয়েছি।

আমরা খালকাটার অনুসারী হতে পারতাম; অথবা বিশ্ব বেহায়ার, অনেকেই হয়েছে। বিষয়টা সহজ ছিল, রাবণের সহযাত্রী হওয়া সহজ কিন্তু সূর্যকে সবাই ধারণ করতে পারে না, পারে না বলে অন্ধকারের সহযাত্রী হয়।

কিন্তু আমরা সূর্যের অস্তিত্ব জানতাম, তাই কোন অন্ধকার আমাদের প্রভাবিত করতে পারেনি। কৃষ্ণ অন্ধকার কালে আমাদের বুকে বঙ্গবন্ধু সূর্য আলো দিয়েছিল। আমরা সেই আলোক ধারণ করেছি, করে আছি, থাকবো।

আমরা নিজেদের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজেছিলাম, নিজেদের চিনবো বলে তাঁর ঠিক ঠিকানার প্রয়োজন ছিল। যখন তাঁকে পেয়ে গেলাম দেখলাম আমাদের আত্মায় তার ঠিকানা, তিনি ছেয়ে আছেন আমাদের মন-মগজ।

অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু চিনেছিলাম। তখন তিনি আকাশের তারা হয়ে ছিলেন, এখন তিনি সমগ্র আকাশ হয়ে আছেন।

লজ্জাবতী ফুল

abu

আমার প্রিয় ফুলের নাম লজ্জাবতী ফুল। অন্য অনেক ফুল থাকতে লজ্জাবতী কেন প্রিয় বন্ধুরা প্রায়ই এমন প্রশ্ন করে থাকে। কোন ফুল কার প্রিয় হবে তার কোন ব্যাখ্যা থাকে না, যুক্তিও থাকে না।

লজ্জাবতী প্রিয় হওয়ার কারণ হচ্ছে আমার গভীর বিপদের সময় সে তার ডানা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি তিপান্ন পেরিয়েছি। তিপান্ন থেকে পঞ্চাশ বিয়োগ করলে যা অবশিষ্ট থাকে তাও আমি পেরুতে পারতাম না যদি লজ্জাবতী দেবদূত হয়ে আমাকে উদ্ধার করতে না আসতো।

বাসায় উঠানের শেষে পুকুর। আমি উঠানে ফুটবল চর্চা করি ভবিষ্যতের সালাহউদ্দিন কিংবা পেলে। ফুটবলের সাথে পানির সখ্যতা এত বেশি কেন এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি। আমি যতই পুকুর এড়িয়ে যেতে চাই ফুটবল ততই পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে।

ফুটবল পুকুরে পড়ে গেলে আমি চিৎকার করি; চিৎকার শুনে ঘর থেকে কেউ না কেউ এসে ফুটবল উদ্ধার করে দিয়ে যায়। একদিন বাসায় কেউ নেই। আম্মা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। একা আমি উঠোনে গোল প্রাকটিস করছি। পুকুরের উল্টো দিকে গোলপোস্ট। তবু কিক মারার সাথে সাথে বেয়াদব ফুটবল ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে পুকুরে লাফিয়ে পড়ে। পুকুরের পানিতে ফুটবল পড়ে গেছে কয়েকবার চিৎকার করে দেখলাম কেউ সাড়া দেয় না।

নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে ভেবে ফুটবল উঠাতে পুকুরের পাড়ে গেছি; দেখলাম পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। পুকুরের পাড় থেকে পানিতে কিভাবে এলাম বুঝতে পারলাম না।

বয়স তিন সাড়ে তিন তবু আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। হয়তো পাড় থেকে খুব বেশি দূরে যাইনি তাই রক্ষা পেলাম। পুকুরের চারপাশ ঘেঁষে অসংখ্য লজ্জাবতী। তাদের ডানা পুকুরের পানি পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঁচার জন্য মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। আমি আঁকড়ে ধরলাম লজ্জাবতী।

লজ্জাবতী আঁকড়ে ধরে উপরে উঠে এলাম। পুকুরের চারপাশে অসংখ্য লজ্জাবতী লতা কোনদিন তাদের দিকে গভীর মনোযোগে তাকানো হয়নি, এবার তাকালাম। দেখলাম ছোট ছোট অসংখ্য গোলাপি ফুল ফুটে আছে। লজ্জাবতীর গায়ে হাত ছোঁয়ালাম লজ্জায় তারা গুটিয়ে গেল কিন্তু ফুলগুলি ঠিকই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যেন বন্ধুত্বের আহ্বান জানাচ্ছে। আমি সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে লজ্জাবতী ফুল দেখতে থাকলাম। মনে হলো জগতে এর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু নাই। মনে হলো ঈশ্বর লজ্জাবতীর গায়ে ফুল হয়ে ফুটে আছেন।

লজ্জাবতী ফুল আমার প্রিয় ফুল। তাদের দিকে তাকালেই ঈশ্বরের প্রতিরূপ দেখি।

গ্রাম্যতা কিংবা সাদা গাভী

তুমি এখন কী কর! ঘাস কাটি। অর্থাৎ কিছু করি না। ‘ঘাস কাটা’কে যতই অকাজের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হোক না কেন; ঘাস কাটা সহজ নয়। আমি কিছুদিন গরুর জন্য ঘাস কেটেছি, ঘাস কাটতে গিয়ে দেখলাম বিষয়টা জটিল। একবার তো মাপের হেরফেরে হাত কেটে গিয়ে ডাক্তার পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে।

আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময় আমাদের পাড়া আরামবাগে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। আমাদের শহর মৌলভীবাজারে অনেক মাঠ ছিল, ফাঁকা জমিন ছিল। এখনকার মত “ইটের উপর ইট/মধ্যে মানুষ কীট” অবস্থা হয়নি। মৌলভীবাজার তখনো পুরোদস্তুর শহর হয়ে ওঠেনি। মানুষের মধ্যে কিছুটা গ্রাম্যতা তখনও বিদ্যমান। মানুষ তখনও গ্রামে বসবাসের অভ্যাস পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি।

পাকা কাঁঠাল খেতে হবে ভেবে আমরা তখনও গোঁফে তেল লাগানো শিখিনি। আমরা কব্জি ডুবিয়ে রসের পাতিল থেকে রসমালাই মুখে পুড়তাম। লুঙ্গি পাঞ্জাবি আমাদের পরিধেয় বস্ত্র ছিল। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট কিংবা টি শার্ট কী জিনিস তখনও জানি না।

আমার জন্ম শহরে। আমার বাবার জন্ম গ্রামে; যদিও দীর্ঘ দিন ধরে কাজের সুবাদে শহরে বসবাস করছেন। শহরে বসবাস করছেন ঠিকই কেন যেন পুরোপুরি শহুরে হতে পারছেন না। শহুরে হতে চাইলে গ্রাম তাঁর মনে এসে ভিড় করে। এমন না যে আমার আব্বা চাষী ছিলেন কিংবা তার আব্বা অর্থাৎ আমার দাদা।

চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি আমাদের ছিল কিন্তু দাদা কিংবা বাবা সে অর্থে চাষী ছিলেন না। দাদা ছিলেন স্কুল মাস্টার। বাবার ছিল সরকারি চাকুরী। বাবা মুনসেফ কোর্টের সেরেস্তাদার বা চিফ একাউন্টেন্ট ছিলেন।

আমার রক্তে যে অক্ষর খেলা করে তা কিছুটা উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া। দাদারও টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিল। তিনি গ্রাম বাংলার আদি শ্লোক ইংরেজিতে যাকে Verse কিংবা Couplet বলা হয় পদ্য ছন্দে খাতায় লিখে রাখতেন। বাবা আমাদের মত পুরোপুরি প্রবাসী না হলেও চাকুরীর কারণে নিজ জেলা শহর থেকে দূরে অন্যান্য শহরে থাকতেন। এক অর্থে তিনিও প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসীরা অত্যন্ত নস্টালজিক হয় স্মৃতি বেদনায় তড়পায়। বাবা বিরহকাতরও ছিলেন। নববধূকে ফেলে দূরের শহরে কাজ তাঁর জন্য বেশ কষ্টের ছিল। তিনি সেই কষ্ট কথা খাতায় লিখে রাখতেন। অনেক বছর পরে অমুদ্রিত খাতাগুলি আবিষ্কৃত হলে আমরা একজন রোমান্টিক কবি তথা রোমান্টিক পিতার দেখা পাই।

আমাদের বাড়ি বা গ্রাম শহর থেকে খুব দূরে নয়। তিন সাড়ে তিন মাইলের মত হবে কিন্তু যেতে হতো নদী পার হয়ে। আমি শহুরে হওয়ায় নদী পারি দেয়া আমার জন্য ভীতিকর ছিল। খেয়া নৌকায় উঠলে ভয়ে কাঁপতে থাকতাম। আব্বার হাত কিংবা পাঞ্জাবি শক্ত করে ধরে থাকতাম। আব্বাকে দেখতাম কি অবলীলায় খেয়া নৌকার এদিক থেকে ওদিকে হাঁটছেন। কখনো উবু হয়ে নদী থেকে আজলা পানি তুলে মুখ ধুচ্ছেন কুলি করছেন। নদীর পানি আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার মনে হত না আব্বা অবলীলায় সে পানি দিয়ে কুলি করতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি বলেছিলেন বহতা পানি সাধারণত অপরিষ্কার হয় না। তিনি নদী পাড়ের মানুষ নদীর সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছেন; সামান্য পানি তাকে কাবু করতে পারবে না।

আমাদের গ্রামের নাম ঢেউপাশা। নামকরণের ইতিহাস জানিনা কোন প্রবীণকে কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি। এখন গ্রামের কোন প্রবীণ অবশিষ্ট নেই জিজ্ঞেস করলেও সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। নদীর ঢেউ এর সাথে পাশা খেলার কোন সংযোগ আছে কিনা জানিনা। তবে পাশা এবং ঢেউ দুটোই অভিজাত শব্দ। দুটি শব্দই আমাদের গ্রামের সাথে মানানসই। গ্রামটি ঐতিহ্যবাহী। ধামাইল গানের একচ্ছত্র অধিপতি রাধারমন দত্ত কিছুদিন আমাদের গ্রামে ছিলেন। তাঁর গুরু গোস্বামীদের আদি নিবাস ঢেউপাশায়। এখানেই তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন।

শিক্ষাদীক্ষায় আমাদের গ্রাম আশপাশের দু-দশ গ্রামের চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রাশ শত বৎসর বয়সী স্কুল এখনও গ্রামে বিদ্যমান।

বলতে খারাপ লাগছে আমাদের ছোট বেলায় যে গ্রামকে দেখে এসেছিলাম সে গ্রাম এখন আর নাই। আমার বাবা শহরে থেকে গ্রাম্য থাকতে চেয়েছিলেন, যে গ্রামকে আঁকড়ে ধরেছিলেন সে গ্রাম এখন প্রায় শহরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। খেয়া পার কবেই উঠে গেছে। যে গ্রামে কখনও গরু গাড়ির দেখা মিলত না এখন দানব ট্রাকের চাকা সেই গ্রামের মাটিকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে। হাতে হাতে মোবাইল। বাড়িতে বাড়িতে স্যাটেলাইট।

প্রতিবার দেশে গেলে সময় করে বাড়ি ঘুরে আসি। বাড়ি বললাম ঠিকই কিন্তু জনমানব বিহীন ভিটা; দু-তিন কামরার একটা ঘর। আগে দেখাশোনার জন্য একজন ছিল; স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে থাকত। কয়েক বছর আগে তারা নিজের বাড়িতে চলে গেলে এখন ঘর ফাঁকা, তালাবন্ধ থাকে। এক সময়ের জমজমাট মাস্টার বাড়ি এখন খা-খা করছে। বাড়ির বাসিন্দারা এখন তিন মহাদেশের ছয়টি দেশে বসবাস করে।

প্রতিবার দেশে গেলে বাড়িতে যাই; কিসের টানে যাই ঠিক জানি না। খা-খা বাড়ি মানুষ নাই। পুকুরের অপর পাড়ে শুধু কয়েকটা কবর। দাদা দাদী এবং তাদের পূর্ব পুরুষেরা শুয়ে আছেন। কবরের টানে যাই বটে, তার চেয়েও বড় টান; একটা আম গাছ। বেহেস্তে হয়তো অত্যন্ত মজাদার ফল খেতে পারব কিন্তু সমস্ত মজাদার ফল একপাশে সরিয়ে আমি আল্লাহর কাছে শুধুমাত্র এই আমগাছ চাইবো। এর চেয়ে সুস্বাদু জীবনে আর কিছু খেতে চাই না।

প্রতিবার আমার লোভাতুর চোখ, লোভাতুর মন আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায় শুধু এই আম গাছের জন্য। গৃহস্থালীতে পরিপূর্ণ বাড়ি যেখানে আজ বিরাণ মাঠ সেখানে আম গাছ কী করে পাবো! আমি জানি কবেই আমগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমি জানি আমগাছ নির্দয় রাস্তার পিচের পেটে গেছে। আমি জানি স্যাটেলাইট ট্রাক ঘন ঘন উন্নয়নের বার্তা গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে। আমি জানি সরকারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে আমরা গ্রামকে শহর বানানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছি বাংলাদেশে গ্রাম অবশিষ্ট থাকবে না।

আমার শৈশবের আম গাছ দাদা দাদীর কবরের পাশে শুয়ে আছে। দাদা দাদীর প্রায় চল্লিশ জন উত্তরাধিকার বছরে একবার না একবার গ্রাম ঘুরে আসে। আম গাছ কোন উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেনি তার অনুপস্থিতি কারো মনে ব্যাঘাত ঘটায় না। তার জন্য কেউ ব্যথিত হয় না। শুধু আমি সৌখিনতা আক্রান্ত হয়ে আম গাছে কাব্য খুঁজতে যাই।

কথা শুরু হয়েছিল ঘাস কাটা নিয়ে। আমার বাবা শহরে বাস করে গ্রামকে ভুলতে পারেননি বিধায় গ্রামের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ সন্তানদের স্বাস্থ্য-চিন্তায় সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আমাদের বাসায় একটা গরুকে (গাভী) লালন পালন করতেন। শহরে গাভী পালন করা খুব সহজতর ছিল না কারণ পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। আগে যেভাবে বলেছি তখনও শহরে কিছু ফাঁকা জায়গা ছিল সেসব ফাঁকা জায়গায় ঘাস গজাতো। আমাদের বাসা তখনও বর্ধিত করা হয়নি উঠোনে ফাঁকা জায়গা ছিল গরুর জন্য আলাদা ঘর বানানো হয়েছিল।

আমাদের সাদা গাই (গাভী) আমাদের পাড়ার সবার কাছে পরিচিত ছিল। কখনও আমাদের অগোচরে অন্য বাসায় ঢুকে গেলে তারা অত্যন্ত মায়া করে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে যেত। ধীরে ধীরে এসব বদলে যেতে লাগলো। পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দারা একে একে প্রবাসী হতে থাকলে শূন্যস্থান পূরণে অন্যান্য জেলার বাসিন্দারা বসবাস করতে আসলো। স্থায়ী বাসিন্দাদের মত মহব্বত তাদের মনে ছিল না বিধায় আমাদের সাদা গাভী প্রায়ই খোঁয়াড় বন্দী হতে লাগলো।

মৌলভীবাজার পৌরসভার অধীনে একটা খোঁয়াড় ছিল শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ডের কাছে। হাফিজা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে। গরু কিংবা ছাগল মুক্ত করার ফি ছিল দুই টাকা। আমাদের প্রায়ই দুই টাকা দিয়ে সাদা গাভীকে মুক্ত করে আনতে হতো।

এই সাদা গাভী পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিল। আব্বা যেভাবে আমাদের খেয়াল রাখতেন ঠিক সেভাবে গাভীকেও খেয়াল রাখতেন। নিজের সন্তানের মত পালন করতেন। লালনের বিনিময়ে আমরা তাঁকে প্রতিদান দিতাম না, গাভী আমাদের মত অকৃতজ্ঞ ছিল না। সে প্রতিদিন বালতি ভর্তি করে দুধ দিত আমরা সেই দুধ পান করে পরিতৃপ্ত হতাম।

সারাদিন খোঁয়াড়ে থাকার জন্য কোন দিন গাভী প্রয়োজনীয় ঘাস খেতে পারত না তখন আব্বা আমাকে ঘাস কেটে আনতে বলতেন। আমি কাচি নিয়ে ঘাস কাটতে যেতাম, ঘাস কাটা সহজ ছিল না। যথেষ্ট ঘাস না হলেও যতটুকু পারতাম কেটে নিয়ে আসতাম।

আব্বা স্থানীয় চালের আড়ত থেকে গুড়া নিয়ে আসতেন। ভাতের ফ্যানের সাথে মিশিয়ে গাভীকে খেতে দিতেন। যেদিন ভাতের ফ্যান থাকতো না সেদিন বালতিতে ঠান্ডা পানি নিয়ে গুড়া ঢেলে মিশিয়ে নিতেন।

সাদা গাভী এবং আমি প্রায় একসাথে বড় হয়েছি কিংবা গাভী হয়তো আমার বয়সের চেয়ে সামান্য বড়। আমার ধারণা ছিল মানষই শুধু বৃদ্ধ হয় এবং তারা মরে যায়। গাভীও যে বৃদ্ধ হতে পারে চিন্তায় আসেনি। আমাদের সেবা করতে করতে সাদা গাভী একদিন বৃদ্ধ হয়ে গেল। সে আগের মত দুধ দিতে পারে না। মানুষের বাসায় ঢুকে শিম গাছে মুখ দিতে পারে না। ভালো করে দাঁড়াতে পারে না।

গাভীর সন্তানকে আমরা কাজে লাগাতে পারতাম কিন্তু সে এঁড়ে বাছুর এবং অত্যন্ত দুরন্ত। মাঠে প্রথাগত ঘাস খাওয়া তার ধাতে নেই। মানুষের বাসায় বাসায় মুখ মেরে ফিরে। তার মাকে হয়তো সপ্তাহে একদিন খোঁয়াড় থেকে আনতে হতো। তাকে আনতে হয় সপ্তাহে সাত দিন কোন কোন দিন একাধিকবার। তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে আব্বা গ্রামে চালান করে দিলেন।

আমাদের সাদা গাভী ধীরে ধীরে চলৎশক্তিহীন হয়ে গেল। সারাদিন বাসায় ঘুমিয়ে থাকে। ততদিনে পাড়ার ফাঁকা মাঠগুলো ভরাট হতে শুরু করেছে। ঘাস দিনে দিনে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।

একদিন দেখলাম একজন লোক আমাদের বাসায় এসেছে। তাকে কসাই হিসেবে চিনি। চৌমুহনায় মাংসের দোকান আছে।

কসাই যখন সাদা গাভী নিয়ে যায় আমার আব্বা সামনে যেতে পারেননি। কারণ তিনি কাঁদছিলেন। আমার চাচা গাভীকে কসাইয়ের হাতে সপে দিয়েছিলেন। গাভী বিক্রি করে আমরা ৫০০ টাকা পেয়েছিলাম। এই টাকা আব্বা কোনদিন খরচ করেননি কাউকে দান ও করেননি। গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজের ভিতরে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন। আমার আব্বা শহুরে হয়েছিলেন কিন্তু তার মন গ্রাম্য ছিল যেকোনো কিছুতেই তার চোখ আদ্র হয়ে উঠতো।

শিখার প্রেম

গাছে গাছে ফোটে আছে হরেক রকম ফুল
হরেক রকম ফুল
শিখা রানী খুলল ফেলে খোপায় বাধা চুল
খোপায় বাধা চুল।

খোপায় কেন চুল বাঁধলো যায় না কারণ জানা
যায় না কারণ জানা
জানলে তবু যায় না বলা বলায় আছে মানা
বলায় আছে মানা।

তবু বলি শুনো সখা শুনো আমার সই
গোপন কথা কই
শিখা রানী পড়তেছিল প্রেম কাননের বই
গোপন কথা কই।

বইয়ের পাতায় গোপন চিঠি গুলাপি এক খামে
গুলাপি এক খামে
প্রেমের পদ্য কেউ লিখেছে শিখা রানীর নামে
গোলাপি এক খামে।

সেই পদ্য শিখার মনে গানের তালে নাচে
গানের তালে নাচে
জানল শিখা তার জন্য কেউ কোথাও আছে
গানের তালে নাচে।

প্রেম আবেগে থরথরো ফেলল বেধে চুল
মনে হুলস্থুল
সই সখীরা বলল শিখা চুল তো এবার খোল
তুই চুল তো এবার খোল।

প্রেমাবেগে সখীর কথায় খুলল মাথার খোপা
খুলল মাথার খোপা
বলল সখি আমার মাথায় কোদাল দিয়ে কোপা
তোরা কোদাল দিয়ে কোপা।

এমন সুখে মরি যদি সুখের মরণ হবে
সুখের মরণ হবে
প্রেমে পরায় এত সুখ কে জেনেছিস কবে
প্রেমের মরণ হবে।

শিখা রানীর প্রেম হয়েছে প্রেমিক বসে ঘাটে
প্রেমিক বসে ঘাটে
প্রেমের নদী পেরিয়ে তারা সুখ সায়রে হাটে
জীবন সুখেই কাটে।

শিখা রানী চুল বাধে কিংবা রাখে খোলা
প্রেমের পাঠে তাহার এখন আড়াই জোড়া পোলা।

টুকটাক রমযান … শেষ পর্ব

প্রথমেই আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে এক মাসের সিয়ামের শেষে ঈদ উদযাপনের সুযোগ দিয়েছেন। করুণাময় আল্লাহ তাঁর করুণাতে জগৎবাসীকে সিক্ত করেছেন। সৃষ্টির প্রতি দয়া দেখিয়েছেন। তাঁর দয়ায় আমরা পরিশুদ্ধতা লাভে সক্ষম হয়েছি। যাবতীয় এবাদত তাঁর উদ্দেশ্যে। আল্লাহ আমাদের এবাদত কবুল করুন। আমিন।

এবারের রোজা খুবই আনন্দে কেটেছে। সিয়ামের প্রচেষ্টাকে আল্লাহ অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছেন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা তেমনভাবে অনুভূত হয়নি। দিনগুলি মৃদু ছিল। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে কাজের পরিবেশ। পুরো একমাসই কাজে কেটেছে কিন্তু কাজের চাপ কোন ভাবেই অনুভূত হয়নি। সহকর্মী যারা ছিল খুবই আন্তরিক ছিল, মানবিক প্রাণে আমাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে।

আমি যে শিফটে কাজ করি; আমাদের ম্যানেজার, শিফট ম্যানেজার, সেকশন ম্যানেজার, সুপারভাইজার, লাইন ম্যানেজার, টিম লিডার প্রত্যেকে আমাদের দিকে বাড়তি নজর দিয়েছে। রোযা পালনে কোনভাবে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সে ব্যাপারে সচেষ্ট থেকেছে। বারবার আমাদের সুবিধা, অসুবিধার খবর নিয়েছে। পর্যাপ্ত বিরতি নিতে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি।

এই প্রথম রমযান মাসে বিধর্মীদের সাথে কাজ করেছি কিন্তু মনে হয়নি আমি কোন বিজাতীয় পরিবেশে কাজ করছি। মনে হয়েছে সম ধর্মের, সম প্রাণের মানুষ একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও আমি মুসলমান ধর্মাবলম্বী; তবে অন্যান্য ধর্মের মানবিক আচরণ আমার মন ছুঁয়ে গেছে। মনে হয়েছে আমরা প্রত্যেকে এক মানব ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। আমরা ধর্মে, গোত্রে বিভক্ত হলেও মানবতার প্রশ্নে আমরা এক। মহামানবের সাগর তীরে আর্য, অনার্য, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সবাই এক। এক স্রষ্টার সৃষ্টি। মানবতা আমাদের একমাত্র ধর্ম।

আজ ঈদ। এমন আনন্দের ঈদ দীর্ঘদিন উদযাপন করিনি। আজ সত্যিই মনের ভিতরে আনন্দের উদগীরণ হচ্ছে। সত্যিই মনে হচ্ছে মানব জন্ম খুব আনন্দের।

আমি আমার ঈদানন্দ প্রত্যেক সহকর্মী, প্রত্যেক ম্যানেজমেন্ট সদস্যদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দীর্ঘ একমাস তাঁরা যেভাবে মানবিক হাত, মানবিক হৃদয়ের পরিচয় দেখিয়েছে আমার মনে তা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রাখবে। তাঁদের এই আচরণ মানুষকে নতুন করে চেনার সুযোগ দিয়েছে।

জগতের আলো-অন্ধকারে আমরা প্রত্যেকে ভুল করি, ভুল ভাবি। ভালোভাবেই কোন কিছু জানার পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই। এবারের রোজা আমাকে কিছু মাত্রায় হলেও মানবিক পুনঃপাঠের সুযোগ দিয়েছে, এই পাঠ পরবর্তী জীবনে অনেক কিছু ভাবতে সাহায্য করবে বলে আশাবাদী।

আমি আজকের ঈদে প্রত্যেকের প্রতি মানবিকতা দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছি। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান এক স্রষ্টার সৃষ্টি। আমাদের মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই। ধর্মবিশ্বাসে ভিন্নতা থাকলেও মানবিকতায় আমরা এক সারিতে থাকি। রক্তের রঙে যেখানে ভিন্নতা থাকে না মানবিকতার রঙেও আমরা কোন ভিন্নতা রাখবো না। ঈদ মোবারক।

পবিত্র রাতের প্রার্থনা

আজ সেই মহামান্বিত রাত হতে পারে। লাইলাতুল কদর। কুরআনের বর্ণনা অনুসারে এই রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, অর্থাৎ এক রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের সমতুল্য হবে।

প্রিয় ভাই, বন্ধু আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণের এই সুযোগ কিছুতেই হারাবেন না। পরিশুদ্ধ মনে আল্লাহর সামনে হাজির হন আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে কবুল করবেন।

আমি অতি নাদান এক বান্দা। জুতোয় লেগে থাকা ধূলিকণার চেয়েও নগণ্য। আল্লাহর করুণা ভিক্ষার যোগ্যতাও হারিয়েছি, তবু তাঁর কাছে ভিক্ষার হাত উঠিয়েছি। আল্লাহ চাইলে পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ মাফ করে দিতে পারেন। আল্লাহ বলেছেন কোন বান্দা যেন তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছে মনে না করে। যে খাস দিলে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে আল্লাহ তাকে কোনভাবেই বঞ্চিত করেন না। আমি আল্লাহর রহমতে বিশ্বাসী, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দাকে করুণা করবেন।

পবিত্র রাতের উসিলায় নতুন করে শুরু করার সুযোগ দিবেন। হে আল্লাহ ঘোর পাপী এক বান্দা তোমার কাছে ফিরবার আকুলতা দেখাচ্ছে, তুমি তাকে কবুল কর।

ভাই, বন্ধু আমার জীবন হচ্ছে পাপের খনি। আপনাদের ভাই বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা আমার কোনদিন ছিল না। কাঁধের ফেরেশতারা কোনদিন ভালো কিছু লিখেছে বলে মনে হয় না। জীবনের চলাফেরায় আপনাদের অনেকের সাথেই ভুল বুঝাবুঝি মন কষাকষি হয়েছে। আপনাদের অনেকের সাথেই জেনে না জেনে অন্যায় করেছি। সম্মুখে সদালাপ আড়ালে গীবত করেছি।

আল্লাহ বলেছেন গীবত হচ্ছে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ, আমার কৃত সর্বপ্রকার অন্যায় থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারাও আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহর হক চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন কিন্তু বান্দার হক বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করতে রাজি হন না। আমি অনেক সময় জেনে না জেনে বুঝে না বুঝে অহেতুক নাক গলিয়েছি। যে বিষয় আমি সংশ্লিষ্ট নয় সে বিষয়েও পান্ডিত্য দেখানোর চেষ্টা করেছি। জ্ঞাতে, অজ্ঞাতে অনেকের মনে কষ্ট দিয়েছি, নিজেকে বড় করে দেখাতে গিয়ে অন্যকে ছোট করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছি।

অনুশোচনার আগুনে মানুষই পরিশুদ্ধ হয়। আমি আজ অনুতপ্ত। আল্লাহর দোহাই আমার প্রতি কোন রাগ, বিরাগ রাখবেন না। আপনাদের মহত্ব দিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমি জুতোয় লেগে থাকা ধূলিকণা, আপনাদের ক্ষমায় আমার মুক্তি লাভ ঘটতে পারে। আল্লাহ আমার আপনার সবার প্রতি উদার হোন। আপনাদের মনে আমার জন্য সামান্য করুণা জাগ্রুক করুন। আপনারা আমাকে ক্ষমা করতে সক্ষম হোন।

পবিত্র রাত্রির দোহাই গীবতের ভয়াবহ পাপ থেকে আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।

টুকটাক রমযান ৪

আজ ২৪ রমযান। আগামী সপ্তাহে আজকের দিনে হয়তো ঈদ পালন করব। দুর্বার গতিতে রোযা চলে গেল ভালো করে ধরতে পারলাম না। জানি না এবারের রোযায় আল্লাহর আদেশ কতটুকু পালিত হয়েছে। জানি না আন্তরিক মনে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পেরেছি কিনা, আল্লাহ ভালো জানেন।

গতকাল বাংলা বছরের প্রথম দিন ছিল। আজ থেকে অনেক বছর আগে বাংলা ১৩৮৯ সালে বছরের প্রথম দিনে ‘বৈশাখী’ নামে ক্ষুদ্র এক সংকলন সম্পাদনা করেছিলাম। তখন আমার বয়স ১৩। এই সংকলনের কোন অস্তিত্ব এখন অবশিষ্ট নেই। ১৩৯০ অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় মৌলভীবাজার শহর তলিয়ে গেলে অনেক কিছুর সাথে ‘বৈশাখী’ও তলিয়ে যায়।

৮৪ বন্যার পরে ‘বৈশাখী’ না করতে পারলেও ‘ষড়ঋতু’ নামে আরেকটা ছড়া সংকলন সম্পাদনা করতাম। ‘ষড়ঋতু’ বেশ কয়েক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম। ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ, এই সংকলনে বিভিন্ন ঋতুকে চিহ্নিত করে ছড়া ছাপা হতো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কিশোর ছড়াকাররা লিখতেন। পত্র যোগাযোগে সারাদেশের ছড়াকারদের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এখন কুড়িগ্রাম হাতের মুঠোয় থাকলেও তখনকার সময়ে কুড়িগ্রামের ছড়াকারের কাছে পৌঁছাতে কমপক্ষে এক মাস লেগে যেত। তবু চেষ্টার কমতি না দিয়ে আমরা পৌঁছাতাম। ষড়ঋতু সেই সময় বেশ জনপ্রিয় ছড়া সংকলন ছিল। ‘ষড়ঋতু’র দুই এক কপি এখনো অবশিষ্ট আছে।

আমাদের কৈশোরে পাড়ায় পাড়ায় সাহিত্য সাংস্কৃতিক কিংবা ক্রীড়া সংগঠন ছিল। আমরা ছিলাম এসব সংগঠনের নিবেদিত প্রাণ কর্মী। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। দিনের গাম্ভীর্য বজায় রেখে নিজেদের মত আনন্দ ফুর্তি করতাম। আমরা প্রতিবছর দিবস ভিত্তিক সংকলন করতাম, স্থানীয় লেখকদের সাথে অন্যান্য জেলা কিংবা রাজধানীর লেখকদের লেখা ছাপতাম। একটা সংকলন কিংবা একটা অনুষ্ঠানের জন্য সেই বয়সে যে দৌড়ঝাঁপ করতাম এখন এসব স্বপ্নের মত মনে হয়। সেই বয়সে অফুরন্ত শক্তি ছিল, প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর সেই কৈশোর আর ফিরে আসবে না। নতুন একটা দেশকে নিজেদের মতো সাজাবো বলে আমরা কষ্ট করতাম, কিন্তু কষ্ট কি কোনদিন কষ্ট মনে করতাম না।

এখনকার কী অবস্থা বলতে পারবো না। এখনকার কিশোর আমাদের মত রাত জেগে প্রেসে বসে থাকে কিনা জানি না। শহীদ দিবসের ভোরে নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারের দিকে হেঁটে যাওয়ার ব্যাকুলতা তার আছে কিনা জানিনা।

কৈশোরে আমরা স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। ঘুম থেকে জেগেও স্বপ্নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। দেশ স্বপ্নে নয় বাস্তবে পেয়েছি, দেশকে নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করাই আমাদের ব্রত ছিল।
গতকাল ছিল বাংলা বছরের প্রথম দিন। প্রথম দিনকে ধরব বলে সেহরি খেয়ে বিছানায় যেতে ইচ্ছে হলো না। ভোরের আলোর সাথে সাথে পড়লাম…

নমো নমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ-সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি|
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি-
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি|
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ-
স্তব্ধ অতল দিঘি-কালো জল নিশীথ শীতলস্নেহ
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে-
মা বলিতে প্রান করে আনচান, চোখে আসে জল ভর।

দেখলাম আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, চেষ্টা করেও কান্না চেপে রাখতে পারছি না। হায় প্রবাস জীবন…

মৃতের বিবৃতি

আমাকে ইন্দ্র মোহন রাজবংশী
করে যদি পাঠাতে

অন্তত একদিনের জন্য
সম্মানের পুনরুজ্জীবন পেতাম।

এই যে মরে গিয়ে চিহ্ন হীন এক কবরে
শুয়ে আছি। এই যে কবরের ফাঁক গলে
শেয়াল প্রতিদিন হিসু করে।

বলো খোদা এটা কি ন্যায় বিচার!

জীবিত আমি তুচ্ছ ছিলাম
অনেকের জুতোর শুকতলা
জিহ্বা দিয়ে চেটেছি।

তারা কুকুরের মতো দূর দূর করে
তাড়িয়ে দিয়েছে।

রাস্তার ট্রাক দানব যখন থেতলে দিল;
আঞ্জুমানে মফিদুল
দয়াপরবশ সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে
নিয়ে এলো এই রুগ্ন কবরে।

আঞ্জুমানের কাছে কৃতজ্ঞ
শেষ মুহূর্তে এক টুকরো
কাপড় অঙ্গে দিয়েছে।

তবুও মনে খেদ; রাজবংশী
মরেও মরেনি, আর আমি
জীবিত থাকতে ছিলাম মৃতের মত
মরে; রুগ্ন কবরে প্রতিদিন
শেয়ালের হিসুতে জর্জরিত হই।

টুকটাক রমযান ৩

রমযানের সাড়ে পনেরো দিন অতিবাহিত হয়েছে। বাকী আছে চৌদ্দ দিনের মত। এবারের রমযান চোখের পলকে চলে যাচ্ছে। রমযান না বছরই চোখের পলকে চলে যাচ্ছে। ভাবা যায় চারদিন আগে মাত্র নতুন বছরের ফানুস উড়ালাম, এর মধ্যে তিনমাস পাঁচ দিন চলে গেছে। সময় কত দ্রুত যায় বুঝা যায় না। কেন যেন মনে হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর আহ্নিকগতি বেড়ে গেছে। এই কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সময়কে দৌড়াতে হচ্ছে, তাই মানুষ সময়কে ধরতে পারছে না।

এ পর্যন্ত রমযান ভাল কেটেছে। নির্ঝঞ্ঝাট। বিলেতের আবহাওয়া এখনো গরমমুখী হয়নি। যদিও মার্চের শেষ রবিবার থেকে গরমের মৌসুম আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছে তবু এখনো পর্যন্ত গরম মহাশয় দেখা দেননি। ঠাণ্ডা চাচা এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। রমাযানের শেষ পর্যন্ত যদি তিনি বিরাজ করেন তাহলে উত্তপ্ততার দোয়াই দিয়ে রমযানকে হালকা করতে হবে না। গরমের রমযানে খিদের কষ্ট না হলেও পানির কষ্ট কিছুটা অনুভূত হয়। ঠাণ্ডার দাপটের কারণে এবার জলের তেষ্টা পাচ্ছে না।

এবারের রমযানের অধিকাংশ সময় কাজে ব্যয়িত হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যস্ততায় যাচ্ছে তাই ইফতারের অপেক্ষায় কাতর হতে হচ্ছে না। আমার কাজের জায়গায় বিরতির সময় হচ্ছে সাড়ে ছ’টা, কিন্তু কতৃপক্ষ মুসলমান কর্মচারীদের জন্য ইফতারের সময় বিরতি নেয়ার সুযোগ দিয়েছে। সাড়ে সাত পোনে আটে ইফতার। আমার বেশ ভাল লাগছে। বিভিন্ন দেশের মুসলমান ভাই বোন একসাথে ইফতার করছি। বিচিত্র খাবার একে অন্যের সাথে শেয়ার করছি, বেশ একটা উৎসবের আমেজ।

ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু বইয়ের অক্ষরে সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তবেও দেয়া যায় এর প্রমাণ আজকের ইফতার। সোমালিয়ার এক ভাই ইফতার নিয়ে আসেনি, ঠিক কী কারণে জানিনা। সে ভেবেছিল ভেণ্ডিং মেশিন থেকে কিছু একটা কিনে ইফতার সেরে ফেলবে কিন্তু ভেণ্ডিং মেশিন কাজ করছে না। সে পানি পান করে যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওমনি দেখা গেল ক্যান্টিনের সবাই (অন্তত বিশ জন) খাবার হাতে নিয়ে তার সামনে হাজির।

তার সামনে যে খাবার জড়ো হল অন্তত পক্ষে পাঁচজন খেয়েও শেষ করতে পারবে না। সে একা বসে খেতে চেয়েছিল কিন্তু সবাই তাকে ঘিরে বসল, হাসি আনন্দের মধ্য দিয়ে ইফতার খাওয়া হল।

সে সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিল কিন্তু অন্য এক সোমালিয়ান ভাই বলল, আমাদের নয় তোমাকে ধন্যবাদ তোমার কারণে আমাদের খাতায়ও কিছু পুণ্য জমা হল। রমাযানে ছোটখাটো সৎকর্ম পুণ্যের খাতায় অনেক বড় হয়ে জমা হয় হয়। হাদিসে উল্লেখ আছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমযানের পরিপূর্ণ ফযিলত নসীব করুন। আমিন।

অসমঝদার আড্ডায় গেলে কী হয়

এক আড্ডায় গেছি বন্ধুর সাথে, সব অপরিচিত মুখ; কারো সাথে দেখা সাক্ষাত হয়েছে বলে মনে হল না। বন্ধু আমাকে কবি বলে পরিচয় দিল। কবি বলার সাথে সাথে সমীহ বেড়ে গেল। ভিআইপি খাতিরে আড্ডার মধ্যমণি করে সবচেয়ে আরামদায়ক চেয়ারে বসানো হল। আড্ডা আড্ডার মত চলতে থাকল। চুটকি, গসিপ, রঙ-তামাশা চলছে সমানতালে। আমি খুব উপভোগ করছি। কিন্তু কবি হিসাবে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে বসানো হল সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আমার কাছে কিছু শুনতে চাওয়া হল না। কিছুটা মন খারাপ, আমার মুখের দিয়ে চেয়ে হয়তো কারো দয়া হল। হঠাৎ একজন সবাইকে থামিয়ে বলল এবার কবি সাহেব বলুন ‘তার কাছ থেকে বাংলা কবিতার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে জানি’। আমার বন্ধু বলতে চেয়েছিল বাদ দেন; অন্য কোনদিন বলবে। কিন্তু সবাই অনুরোধ করলে আমি বললাম এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে কবিতা পদবাচ্য নামে যা হয়েছে শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। কবিতাকে নতুন করে লিখতে হবে, নতুন সময় এসে গেছে, নতুন কবি এসে গেছে, নতুন কবিতা এসে গেছে। বলে নিজের পকেট থেকে সদ্য লেখা কবিতা পড়ে শোনাতে শুরু করলাম…

আমার কবিতা শুনে আড্ডার সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। আড্ডার যে উত্তেজনা ছিল নিমিষেই চুপসে গেল। সবার মুখ হয়ে গেল পেঁচার মতন। তখন পিছনের চেয়ারে বসা একজন হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলল ‘ভাইজানের কী গ্যাস হয়েছে? লেখা থেকে বদ গন্ধ বেরুচ্ছে; ঘরে গিয়ে বাথরুম সেরে এন্টাসিড খান’। আমার বন্ধু তড়িঘড়ি করে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমি বললাম ‘এরা এমন করল কেন?’ বন্ধু বলল ‘এরা সাহিত্য সমঝদার নয় তোর কবিতা বুঝতে পারেনি, মন খারাপ করিস না…’

.
#সত্য_ঘটনার_গল্পরূপ

জীবন চক্র

জয়ত্রী জয়ের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে। জয় শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারেনি। জয়ত্রীর ধারণা পরাজিতরা সারা জীবন পরাজিত থেকে যায়। অকেজো কেউ ঘাড়ে চাপলে তাকে কেজো বানানো প্রায় অসম্ভব। জয়ত্রী দ্রুততর মানবী; দৌড়ে তাকে এখন পর্যন্ত কেউ হারাতে পারেনি। তার চাই দ্রুত বাহন; যে নিমিষেই দিগন্ত পার করিয়ে দেবে। জয়ের মধ্যে সেই স্পৃহা দেখতে পাচ্ছে না। কলেজের সামান্য দৌড়; এখানেই কোয়ালিফাইড হতে পারল না।

পনের বছর পরের কথা। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। জয়তীকে রাস্তা পেরুতে হবে কিন্তু স্ক্রাচে ভর দিয়ে রাস্তা পেরানো অসম্ভবই মনে হচ্ছে। এগিয়ে এলো জয়। তার হাতের ইশারায় থেমে গেল দুপাশের সমস্ত চলাচল। জয়ত্রী নির্বিঘ্নে রাস্তা পেরুলো। অপর পারে পৌঁছে কিছুক্ষণ জয়ের কথা ভাবলো। বুকে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হচ্ছে বুঝতে পারল।

স্বপ্ন শেফিল্ডে শহীদ মিনার

33

মনে পড়ে ছেলেবেলার একুশের ভোর। সারারাত জেগে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে, ভিক্ষা করে, চুরি-চামারি করে যে ফুল সংগ্রহ করতাম তা-ই সুন্দর করে সাজিয়ে অঞ্জলি দিতাম শহীদ বেদীতে। দীর্ঘদিন নগ্ন পায়ে হাঁটা হয় না দীর্ঘদিন প্রাণ খুলে গাওয়া হয় না ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। অমর এ গান অনেকবার চোখ ভিজিয়েছে। শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে অনেকবার হাউমাউ কেঁদে উঠেছি। সালাম রফিক বরকত জব্বার আমার কাছে শুধু একেকটি নাম নয়; এক একটি অগ্নি গোলক। তারা পুড়েছে; পুড়িয়েছে বলেই আমরা মন খুলে কথা বলতে পারি, নিজের ভাষায় চিৎকার করতে পারি। ছেলেবেলায় তাঁদের জন্য বুকের ভিতরে যে ভালবাসা জন্মেছিল দীর্ঘ প্রবাস বাসের কারণে সে ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এখনো একটি অক্ষরের অনুপস্থিতি বুক-কে খালি করে দেয়।

গত কয়েক বছর ধরে যে শহরে থাকি; প্রায় হাজার দশেক বাঙালির বাস। বলতে ভালো লাগছে না; তবু সত্য হচ্ছে শহরের অধিকাংশ বাঙ্গালী বাংলা থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের বুকে বাংলার শ্যামল রূপ আর দোলা দেয় না। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে তারা ভাবিত নয়।

বাঙ্গালীদের জাতীয় দিবস পালনের আগ্রহ এ শহরের বাঙ্গালীদের মাঝে দেখা যায় না। তৃতীয় প্রজন্মের কথা নয়, দ্বিতীয় প্রজন্ম যারা দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছে তারাও দেশ একেবারে ভুলে গেছে। প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে দেশ কিছু দূরে সরে যায় এটা অস্বীকার করার উপায় নেই কিন্তু কোন বাঙ্গালী অবসরে দেশ স্মরণ না করে কীভাবে থাকতে পারে! দুঃখ বেদনা আনন্দ খুশিতে দেশ হানা দেয় না এটা ভাবতে অবাক লাগে।

বাঙ্গালীর জাতীয় দিবস গুলি আসে যায়। কিন্তু এক নদী রক্তের বিনিময়ে ভাষা, এক সাগরে রক্তের বিনিময়ে দেশ পেয়েও আমরা দেশ স্মরণ করিনা; সেই আত্মত্যাগী মানুষদের সামান্য কৃতজ্ঞতা দেখাই না। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলি দিবসের নামে ব্যানার লাগিয়ে ফটো সেশন করে, সেখানে সাধারণ মানুষের দেখা পাওয়া যায় না।

এ শহরের বাঙ্গালীদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের সাথে এ বিষয়ে অনেকবার কথা বলে দেখেছি কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি কিংবা দেশ নিয়ে তাদের আগ্রহী করতে পারিনি। তারা দেশের শিল্প, সাহিত্য নিয়ে বলতে আগ্রহী নয় কিন্তু দেশের অবক্ষয়ে, যুব সমাজের অবক্ষয়ে বিদ্রোহী। হাজারবার বলেও তাদের বুঝাতে পারিনি শিল্প সাহিত্যের অনুপস্থিতিতে যে কোন দেশ যেকোনো সমাজ মূঢ় হতে বাধ্য।

একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু শহীদ দিবস নয় এখন এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। আমার মনে ইচ্ছে ছিল এই শহরে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করার। ১০ হাজার বাঙ্গালী অধিষ্ঠিত একটা শহরের জন্য এটা খুব বড় বিষয় নয়। প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং একতা। দল-মত নির্বিশেষে সবাই শহীদ মিনারের জন্য একমত হতে পারে। কোন রাজনৈতিক, ধর্মীয় মতদ্বৈততা এখানে বাধা হতে পারে না।

আমি খুব ক্ষুদ্র মানুষ; যারা নিজেদের বড় মানুষ বলে দাবি করেন তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও শহীদ মিনারের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন আদায় করতে পারিনি। আমাদের তৃতীয় প্রজন্ম এমনিতেই দেশ বিমুখ, দেশের রাজনৈতিক ঝগড়া তারা নিতে পারে না।

তবু পিতৃভূমির জন্য তাদের মনে কিছুটা দুর্বলতা আছে টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সাফল্যের কথা শুনে তাদের চোখ যেভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাতে বুঝা যায় মনে মননে কিছু পরিমাণ হলেও বাঙ্গালীত্ব আছে। বিশ্বব্যাংকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের পয়সায় যখন পদ্মা সেতু বানাতে দেখে তখন তাদেরও বুক ফুলে যায়। তাদেরকে দেশের প্রতি আরো আগ্রহী করতে শহীদ মিনার বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। শহীদ মিনারই একমাত্র দল এবং রাজনীতি নিরপেক্ষ। শহীদ মিনারের ইতিহাস জানার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারবে, পিতৃভূমির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী হতে পারবে।

একটা শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন খুব বড় স্বপ্ন নয়। চাইলেই বাস্তব করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন দেশের প্রতি ভালোবাসা। শুধু প্রয়োজন আত্মত্যাগী মানুষের প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতা দেখানো। আমরা যে মাকে মা ডাকি, তাদের রক্তের বিনিময়ে এ ডাক। মা ডাকের সাথে থাকে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার। তাদের আমরা কোনভাবেই ভুলতে পারি না।

শহীদ মিনার হতে পারে কৃতজ্ঞতার স্মারক। শহীদ মিনার হতে পারে বিদেশের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ …

ভালোবাসা হচ্ছে শরমের ব্যাপার

বহুব্রীহি নাটকে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন ‘ভালোবাসা হচ্ছে শরমের ব্যাপার’! আমার কাছে ব্যাপারটা শরম ছাপিয়ে আরো জটিল পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

আমাদের পাড়ায় ভাড়াটিয়া হিসেবে আকমল হুজুর এসেছেন। অভিভাবকেরা ঠিক করেছেন তাঁর কাছে আমরা আরবি পড়ব। পাড়ার নাবালক শিশু কিশোর নিয়মিত পড়তে শুরু করলাম। হুজুর তার বৈঠকখানায় আমাদের পড়ান। আমি যেখানে বসি তার উল্টা দিকে হুজুরের শোবার ঘর। হুজুর দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসেন। আরবি খুব আদবের সাথে পড়তে হয়। ভুল পাঠে কঠিন গুনাহ। প্রতিদিন মনোযোগের সাথেই পড়ি ভুল যাতে না হতে পারে। কিন্তু শয়তান তার ওয়াসওয়াসা নিয়ে সর্বত্র হাজির থাকে। কুরআনের মাহফিলও বাদ পড়ে না।

একদিন গভীর মনোযোগে তালিম নিচ্ছি হঠাৎ কিভাবে যেন শয়তানের ধোকায় হুজুরের শোবার ঘরে চোখ চলে গেল। দরজায় এক কিশোরীর মুখ দেখে চমকে উঠলাম। শ্যামলা রঙ; চোখ দুটো যেন চকিত হরিণী। আরবি গেল গোল্লায় । হরিণ চোখ হৃদয় তোলপাড় করে দিল। বয়স সবেমাত্র টিন-এজ এ পৌঁছাচ্ছে। এই বয়স যে ভীষণ খতরনাক হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সেদিন পড়া হল না; হুজুরের শোবার ঘরে কিশোরীর মুখ দর্শন হলো।

পরের দিন আমার নির্ধারিত জায়গায় অন্যজনকে বসা দেখলাম, হুজুর তখনো এসে পৌঁছাননি। তাকে জায়গা থেকে উঠে অন্য কোথাও বসতে বললাম সে রাজি না। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েও যখন রাজি করানো যাচ্ছে না তখন ঝগড়া বাধার উপক্রম। জায়গা নিয়ে হুজুরের সামনে ঝগড়া করা যাবে না বিধায় তাকে ঘুষ অফার করা হলো। টিফিনের জন্য বরাদ্দ টাকা আগামী একমাস তাকে দিয়ে দিব এই শর্তে সে স্থান ছাড়তে রাজি হল।

যে গভীর মনোযোগ নিয়ে তালিম শুরু করেছিলাম সে মনোযোগ আর রক্ষা করা গেল না। কারণ মন এবং চোখ বারবার শোবার ঘরের দরজায় উঁকি মারে। কয়েকবার সেই কিশোরীর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। অপর তরফেও যে আগ্রহ আছে বেশ বুঝতে পারলাম। হুজুর আমার অমনোযোগিতা লক্ষ্য করলেন। আরবি পাঠে মন না দিয়ে তার শোবার ঘরের দরজায় বার বার তাকাচ্ছি বুঝতে পারলেন।

কিশোরীটি হয়তো হুজুরের মেয়ে। হুজুরের মেয়ে হলেও তাকে পর্দা করতে দেখা গেল না। হয়তো ঘরে পর্দা করার নিয়ম নেই। আমি পর্দা বেপর্দা নিয়ে ভাবিত হলাম না। চোখাচোখির পরে কিভাবে এগোনো চিন্তা করতে লাগলাম।

পরের দিন আরবি পড়তে গিয়ে পুরোপুরি দমে গেলাম। বৈঠকখানা এবং শোবার ঘরের দরজায় নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে। বুঝা গেল আমার আর কিশোরীর মাঝে কিছু একটা হচ্ছে বুঝতে পেরে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা। এত সাবধানতার পরেও চোখ পর্দা মানল না। আমি পর্দায় চোখ রাখি আর পর্দা সরিয়ে কিশোরী।

চোখাচোখির দ্বিতীয় পর্বে চিঠি চালাচালি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। আর জানা গেল কিশোরী আসলে হুজুরের তৃতীয় তরফ। হুজুরনীর সাথে ভালবাসাবাসির শাস্তি হিসেবে বড় ভাই আমাকে একশবার কান ধরে উঠবস করালেন।

আমার কাছে ভালবাসা মানে কান ধরে একশবার উঠবস করা…

এফ ওয়ার্ড চ বর্গীও

(১৮+)
রেস্টুরেন্টে যারা খেতে আসে, তারা নানান কথাই বলে কিন্তু একটা শব্দ বারবার রিপিট করে। সেটা এফ ওয়ার্ড; F*ck। কখনো এই শব্দের সাথে ing লাগায়। আমি নতুন দেশ থেকে এসেছি, ইংরেজি জ্ঞান শূন্য বললেই চলে। ইয়েস নো ভেরি গুড পর্যন্ত আমার দৌড় এর বেশি কিছু হলে বুঝতে পারিনা।

দেশ থেকে আসার সময় ইংরেজি টু বাংলা একটা ডিকশনারি নিয়ে এসেছিলাম, প্রয়োজনে কাজে লাগবে ভেবে। কিন্তু ব্রিটিশদের ইংরেজির মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারি না। এরা যেন পরিষ্কার কোন শব্দ উচ্চারণ করে না, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে। ডিকশনারি কোন কাজে লাগে না। কিন্তু F*ck শব্দ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। ডিকশনারি উল্টিয়ে এই শব্দের অর্থ খুঁজতে থাকি কিন্তু খুঁজে পাই না। তখন google জমানো ছিল না, চাইলেই দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞান হাতের মুঠোয় চলে আসতো না।

রেস্টুরেন্টের খরিদ্দারদের মধ্যে এই শব্দ এত জনপ্রিয় কেন ভাবতে থাকি। প্রতিটি বাক্যে বারবার ঘুরেফিরে এই শব্দই কেন আসে ভাবতে ভাবতেও আমার বুঝে আসে না।

আমার সাথে কাজ করেন আমার চাচা এবং চাচার বয়সি আরেকজন। একবার ভাবি তাদের কাছ থেকে অর্থ জেনে নেই, কিন্তু কোথায় যেন দ্বিধা কাজ করে। সিক্সথ সেন্স বলতে কিছু যে আছে এটা হচ্ছে সেই প্রমাণ। যদি তাদেরকে এই শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করতাম তারা যেমন বিব্রত, লজ্জিত হতেন আমিও লজ্জায় মুখ তুলতে পারতাম না।

রেস্টুরেন্টের কিচেনে আমার বয়সী আরো দুজন কাজ করত। তাদের সাথে কিছু পরিমাণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়, একদিন দ্বিধা ঝেড়ে তাদের কাছে এই শব্দের অর্থ জানতে চাই। আমার প্রশ্ন শুনে তারা হাসতে হাসতে শেষ কিন্তু উত্তর দিতে রাজি হয় না।

কিচেনে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক কাজ করতেন তার বয়স সত্তরের উপরে সবাই থাকে দাদু বলে ডাকে। ভদ্রলোক প্রায় পঞ্চাশের অধিক কাল ধরে ব্রিটেনে থাকেন, তার স্ত্রী পুত্র কন্যা সবাই সাদা চামড়ার। আমার বন্ধুরা বলল দাদুকে জিজ্ঞেস করতে।

দাদুও বন্ধু ভাবাপণ্য; সবার সাথে বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন। গুরুগম্ভীর নন বেশ হাসিখুশি ধরনের মানুষ। তাছাড়া তিনি প্রায় ব্রিটিশ, অর্থাৎ জন্ম বাংলাদেশে হলেও তাঁর বেড়ে উঠা এবং কর্ম সবকিছু ব্রিটেনে। তিনি যেভাবে ইংরেজি বলেন অনেক ইংলিশও সেভাবে বলতে পারে না। যদিও আমাদের সাথে আলাপে তার ইংরেজি দক্ষতার তেমন আভাস পাওয়া যায় না, আমাদের সাথে বাংলায় কথা বলেন।

মুরব্বি হলেও তিনি হাফ ইংরেজ, তাঁর সাথে হাসিঠাট্টার সম্পর্ক আছে; তাই ভাবলাম তাকে জিজ্ঞেস করে অর্থ জেনে নেওয়া যাক। একদিন দুপুরে কিচেনে চা খাচ্ছি দাদু কি একটা কাজে ব্যস্ত, বললাম ‘দাদু F*ck অর্থ কী’? দাদু যেন ভালো করে শুনতে পায় নি আমার দিকে চেয়ে বলল ‘কিসের অর্থ’! আমি বললাম ‘F*ck দাদু’ আমাদের কাস্টমাররা প্রায় এই শব্দ ব্যবহার করে, কিন্তু আমি এর অর্থ জানিনা’।

– দাদু আমাকে বলল তোমার তো বিয়ের বয়স হয়নি; বাজারে গেছ কোনদিন?
– যাব না কেন অনেকবার গেছি, যখনই চাল, ডাল, তেল নুনের প্রয়োজন পড়েছে, খরিদ করে এনেছি।
– আরে চাল ডালের বাজার না, মেয়েদের বাজার।
– মেয়েদের বাজার মানে?
– মেয়েদের বাজার চেন না, পতিতালয়ের নাম শুনোনি
– নাম শুনেছি, যাওয়া হয়নি কোনদিন।
– ওখানে পুরুষ কিসের জন্য যায়?

আমার বয়স সতেরো, সহপাঠিনীদের দিকেই ভাল করে তাকানো হয়নি, আর পতিতালয়ে যাওয়া! আমি কিচ্ছু বলছি না দেখে, দাদু আমাকে F*ck শব্দের চ-বর্গীয় অর্থ বলে দিল।

আমার যে সংস্কার তাতে উত্তর জেনে আমি আশ্চর্য হলাম। আমি যে দেশ থেকে এসেছি সেই দেশের সমাজে এই শব্দ উচ্চারণ করলে আপনি পতিত হতে বাধ্য, সমাজচ্যুত হতে বাধ্য। কিন্তু ব্রিটেনের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই অহরহ এই শব্দ উচ্চারণ করে।

আমি দেখেছি স্যুট টাই পরিহিত ভদ্র জন যাকে আমরা বাবু কিংবা সাহেব হিসাবে অভিহিত করতে পারি বন্ধুদের সাথে আলাপে ক্রমাগত এই শব্দ ব্যবহার করে যাচ্ছে। আমি দেখেছি হিপ্পি তরুণ যার নাকে কানে ঠোঁটে অসংখ্য ছিদ্র সেও বান্ধবীর সাথে কথোপকথনে বারবার এই শব্দ উচ্চারণ করছে। আমি দেখেছি পরিবার নিয়ে খেতে এসেছে, সাথে ছোট ছোট বাচ্চা আছে কিন্তু স্ত্রীর সাথে কথা বলছে আর এই শব্দ উচ্চারণ করছে বাচ্চারাও শুনছে কিন্তু তারা নির্বিকার, যেন এটা একটা স্বাভাবিক উচ্চারণ যেন এই শব্দে দোষের কিছু নেই।

এই শব্দের অর্থ না জানলে হয়তো ভালো হতো, কারণ অর্থ জানার পর থেকে যেই আমার সামনে এই শব্দ উচ্চারণ করতো তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকাতাম, কোন কোন সময় করুণার চোখে। এদের আমার খুব নিম্নস্তরের মানুষ মনে হত।

বলাবাহুল্য সময়ের সাথে সাথে আমিও এই শব্দে অভ্যস্ত হয়ে যাই অর্থাৎ প্রথম প্রথম এই শব্দ শুনে যেভাবে আশ্চর্য হতাম; যেভাবে নাক কুঁচকে আসতো এখন আর সেরকম প্রতিক্রিয়া হয় না। ব্রিটেনের সমাজে এই শব্দ খুবই সহজলভ্য…

জীবন মানুষকে প্রতিনিয়ত F*ck করছে, জীবনের অবিচারের প্রতিবাদে মানুষ মুখে শুধু উচ্চারণ করছে F*CK, এতে দোষের কিছু নেই…