তুমি এখন কী কর! ঘাস কাটি। অর্থাৎ কিছু করি না। ‘ঘাস কাটা’কে যতই অকাজের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হোক না কেন; ঘাস কাটা সহজ নয়। আমি কিছুদিন গরুর জন্য ঘাস কেটেছি, ঘাস কাটতে গিয়ে দেখলাম বিষয়টা জটিল। একবার তো মাপের হেরফেরে হাত কেটে গিয়ে ডাক্তার পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে।
আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময় আমাদের পাড়া আরামবাগে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। আমাদের শহর মৌলভীবাজারে অনেক মাঠ ছিল, ফাঁকা জমিন ছিল। এখনকার মত “ইটের উপর ইট/মধ্যে মানুষ কীট” অবস্থা হয়নি। মৌলভীবাজার তখনো পুরোদস্তুর শহর হয়ে ওঠেনি। মানুষের মধ্যে কিছুটা গ্রাম্যতা তখনও বিদ্যমান। মানুষ তখনও গ্রামে বসবাসের অভ্যাস পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি।
পাকা কাঁঠাল খেতে হবে ভেবে আমরা তখনও গোঁফে তেল লাগানো শিখিনি। আমরা কব্জি ডুবিয়ে রসের পাতিল থেকে রসমালাই মুখে পুড়তাম। লুঙ্গি পাঞ্জাবি আমাদের পরিধেয় বস্ত্র ছিল। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট কিংবা টি শার্ট কী জিনিস তখনও জানি না।
আমার জন্ম শহরে। আমার বাবার জন্ম গ্রামে; যদিও দীর্ঘ দিন ধরে কাজের সুবাদে শহরে বসবাস করছেন। শহরে বসবাস করছেন ঠিকই কেন যেন পুরোপুরি শহুরে হতে পারছেন না। শহুরে হতে চাইলে গ্রাম তাঁর মনে এসে ভিড় করে। এমন না যে আমার আব্বা চাষী ছিলেন কিংবা তার আব্বা অর্থাৎ আমার দাদা।
চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি আমাদের ছিল কিন্তু দাদা কিংবা বাবা সে অর্থে চাষী ছিলেন না। দাদা ছিলেন স্কুল মাস্টার। বাবার ছিল সরকারি চাকুরী। বাবা মুনসেফ কোর্টের সেরেস্তাদার বা চিফ একাউন্টেন্ট ছিলেন।
আমার রক্তে যে অক্ষর খেলা করে তা কিছুটা উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া। দাদারও টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিল। তিনি গ্রাম বাংলার আদি শ্লোক ইংরেজিতে যাকে Verse কিংবা Couplet বলা হয় পদ্য ছন্দে খাতায় লিখে রাখতেন। বাবা আমাদের মত পুরোপুরি প্রবাসী না হলেও চাকুরীর কারণে নিজ জেলা শহর থেকে দূরে অন্যান্য শহরে থাকতেন। এক অর্থে তিনিও প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসীরা অত্যন্ত নস্টালজিক হয় স্মৃতি বেদনায় তড়পায়। বাবা বিরহকাতরও ছিলেন। নববধূকে ফেলে দূরের শহরে কাজ তাঁর জন্য বেশ কষ্টের ছিল। তিনি সেই কষ্ট কথা খাতায় লিখে রাখতেন। অনেক বছর পরে অমুদ্রিত খাতাগুলি আবিষ্কৃত হলে আমরা একজন রোমান্টিক কবি তথা রোমান্টিক পিতার দেখা পাই।
আমাদের বাড়ি বা গ্রাম শহর থেকে খুব দূরে নয়। তিন সাড়ে তিন মাইলের মত হবে কিন্তু যেতে হতো নদী পার হয়ে। আমি শহুরে হওয়ায় নদী পারি দেয়া আমার জন্য ভীতিকর ছিল। খেয়া নৌকায় উঠলে ভয়ে কাঁপতে থাকতাম। আব্বার হাত কিংবা পাঞ্জাবি শক্ত করে ধরে থাকতাম। আব্বাকে দেখতাম কি অবলীলায় খেয়া নৌকার এদিক থেকে ওদিকে হাঁটছেন। কখনো উবু হয়ে নদী থেকে আজলা পানি তুলে মুখ ধুচ্ছেন কুলি করছেন। নদীর পানি আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার মনে হত না আব্বা অবলীলায় সে পানি দিয়ে কুলি করতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি বলেছিলেন বহতা পানি সাধারণত অপরিষ্কার হয় না। তিনি নদী পাড়ের মানুষ নদীর সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছেন; সামান্য পানি তাকে কাবু করতে পারবে না।
আমাদের গ্রামের নাম ঢেউপাশা। নামকরণের ইতিহাস জানিনা কোন প্রবীণকে কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি। এখন গ্রামের কোন প্রবীণ অবশিষ্ট নেই জিজ্ঞেস করলেও সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। নদীর ঢেউ এর সাথে পাশা খেলার কোন সংযোগ আছে কিনা জানিনা। তবে পাশা এবং ঢেউ দুটোই অভিজাত শব্দ। দুটি শব্দই আমাদের গ্রামের সাথে মানানসই। গ্রামটি ঐতিহ্যবাহী। ধামাইল গানের একচ্ছত্র অধিপতি রাধারমন দত্ত কিছুদিন আমাদের গ্রামে ছিলেন। তাঁর গুরু গোস্বামীদের আদি নিবাস ঢেউপাশায়। এখানেই তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন।
শিক্ষাদীক্ষায় আমাদের গ্রাম আশপাশের দু-দশ গ্রামের চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রাশ শত বৎসর বয়সী স্কুল এখনও গ্রামে বিদ্যমান।
বলতে খারাপ লাগছে আমাদের ছোট বেলায় যে গ্রামকে দেখে এসেছিলাম সে গ্রাম এখন আর নাই। আমার বাবা শহরে থেকে গ্রাম্য থাকতে চেয়েছিলেন, যে গ্রামকে আঁকড়ে ধরেছিলেন সে গ্রাম এখন প্রায় শহরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। খেয়া পার কবেই উঠে গেছে। যে গ্রামে কখনও গরু গাড়ির দেখা মিলত না এখন দানব ট্রাকের চাকা সেই গ্রামের মাটিকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে। হাতে হাতে মোবাইল। বাড়িতে বাড়িতে স্যাটেলাইট।
প্রতিবার দেশে গেলে সময় করে বাড়ি ঘুরে আসি। বাড়ি বললাম ঠিকই কিন্তু জনমানব বিহীন ভিটা; দু-তিন কামরার একটা ঘর। আগে দেখাশোনার জন্য একজন ছিল; স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে থাকত। কয়েক বছর আগে তারা নিজের বাড়িতে চলে গেলে এখন ঘর ফাঁকা, তালাবন্ধ থাকে। এক সময়ের জমজমাট মাস্টার বাড়ি এখন খা-খা করছে। বাড়ির বাসিন্দারা এখন তিন মহাদেশের ছয়টি দেশে বসবাস করে।
প্রতিবার দেশে গেলে বাড়িতে যাই; কিসের টানে যাই ঠিক জানি না। খা-খা বাড়ি মানুষ নাই। পুকুরের অপর পাড়ে শুধু কয়েকটা কবর। দাদা দাদী এবং তাদের পূর্ব পুরুষেরা শুয়ে আছেন। কবরের টানে যাই বটে, তার চেয়েও বড় টান; একটা আম গাছ। বেহেস্তে হয়তো অত্যন্ত মজাদার ফল খেতে পারব কিন্তু সমস্ত মজাদার ফল একপাশে সরিয়ে আমি আল্লাহর কাছে শুধুমাত্র এই আমগাছ চাইবো। এর চেয়ে সুস্বাদু জীবনে আর কিছু খেতে চাই না।
প্রতিবার আমার লোভাতুর চোখ, লোভাতুর মন আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায় শুধু এই আম গাছের জন্য। গৃহস্থালীতে পরিপূর্ণ বাড়ি যেখানে আজ বিরাণ মাঠ সেখানে আম গাছ কী করে পাবো! আমি জানি কবেই আমগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমি জানি আমগাছ নির্দয় রাস্তার পিচের পেটে গেছে। আমি জানি স্যাটেলাইট ট্রাক ঘন ঘন উন্নয়নের বার্তা গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে। আমি জানি সরকারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে আমরা গ্রামকে শহর বানানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছি বাংলাদেশে গ্রাম অবশিষ্ট থাকবে না।
আমার শৈশবের আম গাছ দাদা দাদীর কবরের পাশে শুয়ে আছে। দাদা দাদীর প্রায় চল্লিশ জন উত্তরাধিকার বছরে একবার না একবার গ্রাম ঘুরে আসে। আম গাছ কোন উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেনি তার অনুপস্থিতি কারো মনে ব্যাঘাত ঘটায় না। তার জন্য কেউ ব্যথিত হয় না। শুধু আমি সৌখিনতা আক্রান্ত হয়ে আম গাছে কাব্য খুঁজতে যাই।
কথা শুরু হয়েছিল ঘাস কাটা নিয়ে। আমার বাবা শহরে বাস করে গ্রামকে ভুলতে পারেননি বিধায় গ্রামের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ সন্তানদের স্বাস্থ্য-চিন্তায় সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আমাদের বাসায় একটা গরুকে (গাভী) লালন পালন করতেন। শহরে গাভী পালন করা খুব সহজতর ছিল না কারণ পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। আগে যেভাবে বলেছি তখনও শহরে কিছু ফাঁকা জায়গা ছিল সেসব ফাঁকা জায়গায় ঘাস গজাতো। আমাদের বাসা তখনও বর্ধিত করা হয়নি উঠোনে ফাঁকা জায়গা ছিল গরুর জন্য আলাদা ঘর বানানো হয়েছিল।
আমাদের সাদা গাই (গাভী) আমাদের পাড়ার সবার কাছে পরিচিত ছিল। কখনও আমাদের অগোচরে অন্য বাসায় ঢুকে গেলে তারা অত্যন্ত মায়া করে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে যেত। ধীরে ধীরে এসব বদলে যেতে লাগলো। পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দারা একে একে প্রবাসী হতে থাকলে শূন্যস্থান পূরণে অন্যান্য জেলার বাসিন্দারা বসবাস করতে আসলো। স্থায়ী বাসিন্দাদের মত মহব্বত তাদের মনে ছিল না বিধায় আমাদের সাদা গাভী প্রায়ই খোঁয়াড় বন্দী হতে লাগলো।
মৌলভীবাজার পৌরসভার অধীনে একটা খোঁয়াড় ছিল শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ডের কাছে। হাফিজা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে। গরু কিংবা ছাগল মুক্ত করার ফি ছিল দুই টাকা। আমাদের প্রায়ই দুই টাকা দিয়ে সাদা গাভীকে মুক্ত করে আনতে হতো।
এই সাদা গাভী পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিল। আব্বা যেভাবে আমাদের খেয়াল রাখতেন ঠিক সেভাবে গাভীকেও খেয়াল রাখতেন। নিজের সন্তানের মত পালন করতেন। লালনের বিনিময়ে আমরা তাঁকে প্রতিদান দিতাম না, গাভী আমাদের মত অকৃতজ্ঞ ছিল না। সে প্রতিদিন বালতি ভর্তি করে দুধ দিত আমরা সেই দুধ পান করে পরিতৃপ্ত হতাম।
সারাদিন খোঁয়াড়ে থাকার জন্য কোন দিন গাভী প্রয়োজনীয় ঘাস খেতে পারত না তখন আব্বা আমাকে ঘাস কেটে আনতে বলতেন। আমি কাচি নিয়ে ঘাস কাটতে যেতাম, ঘাস কাটা সহজ ছিল না। যথেষ্ট ঘাস না হলেও যতটুকু পারতাম কেটে নিয়ে আসতাম।
আব্বা স্থানীয় চালের আড়ত থেকে গুড়া নিয়ে আসতেন। ভাতের ফ্যানের সাথে মিশিয়ে গাভীকে খেতে দিতেন। যেদিন ভাতের ফ্যান থাকতো না সেদিন বালতিতে ঠান্ডা পানি নিয়ে গুড়া ঢেলে মিশিয়ে নিতেন।
সাদা গাভী এবং আমি প্রায় একসাথে বড় হয়েছি কিংবা গাভী হয়তো আমার বয়সের চেয়ে সামান্য বড়। আমার ধারণা ছিল মানষই শুধু বৃদ্ধ হয় এবং তারা মরে যায়। গাভীও যে বৃদ্ধ হতে পারে চিন্তায় আসেনি। আমাদের সেবা করতে করতে সাদা গাভী একদিন বৃদ্ধ হয়ে গেল। সে আগের মত দুধ দিতে পারে না। মানুষের বাসায় ঢুকে শিম গাছে মুখ দিতে পারে না। ভালো করে দাঁড়াতে পারে না।
গাভীর সন্তানকে আমরা কাজে লাগাতে পারতাম কিন্তু সে এঁড়ে বাছুর এবং অত্যন্ত দুরন্ত। মাঠে প্রথাগত ঘাস খাওয়া তার ধাতে নেই। মানুষের বাসায় বাসায় মুখ মেরে ফিরে। তার মাকে হয়তো সপ্তাহে একদিন খোঁয়াড় থেকে আনতে হতো। তাকে আনতে হয় সপ্তাহে সাত দিন কোন কোন দিন একাধিকবার। তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে আব্বা গ্রামে চালান করে দিলেন।
আমাদের সাদা গাভী ধীরে ধীরে চলৎশক্তিহীন হয়ে গেল। সারাদিন বাসায় ঘুমিয়ে থাকে। ততদিনে পাড়ার ফাঁকা মাঠগুলো ভরাট হতে শুরু করেছে। ঘাস দিনে দিনে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।
একদিন দেখলাম একজন লোক আমাদের বাসায় এসেছে। তাকে কসাই হিসেবে চিনি। চৌমুহনায় মাংসের দোকান আছে।
কসাই যখন সাদা গাভী নিয়ে যায় আমার আব্বা সামনে যেতে পারেননি। কারণ তিনি কাঁদছিলেন। আমার চাচা গাভীকে কসাইয়ের হাতে সপে দিয়েছিলেন। গাভী বিক্রি করে আমরা ৫০০ টাকা পেয়েছিলাম। এই টাকা আব্বা কোনদিন খরচ করেননি কাউকে দান ও করেননি। গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজের ভিতরে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন। আমার আব্বা শহুরে হয়েছিলেন কিন্তু তার মন গ্রাম্য ছিল যেকোনো কিছুতেই তার চোখ আদ্র হয়ে উঠতো।