যুদ্ধ ৫

274572

আজ শুরু করার আগে প্রথমেই ইউক্রেনে যে দুজন ভারতীয় ছাত্র যুদ্ধের শিকার হয়ে মারা গেলেন তাঁদের স্মৃতিতে শোক ও শ্রদ্ধা জানাই। আমার এই লেখা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আমজনতার ইচ্ছার প্রতিফলন। আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ আমাদের কোনো উপকার করে না। যুদ্ধ শুধুমাত্র বৃহৎ ব্যবসাদারদের মুনাফার রাস্তা সরল করার সাধণ। আর কে না জানে আজকের পৃথিবী ব্যবসাদারদের অঙ্গুলিসঞ্চালনে চলে। এটা পরিস্কার মনে রাখতে হবে আজকের আমেরিকা আব্রাহাম লিংকনের জনকল্যাণের রাষ্ট্র নয়, আজকের রাশিয়া ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের সমাজকল্যাণমূলক সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। দুটি পরস্পর বিবাদমান দেশই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রিত। দুটি দেশেই বৃহৎ পুঁজিপতিরা আছে। তাদের এই বিবাদ পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্য দেশের উপরে কর্তৃত্ব নিয়ে। আমরা, পাকিস্তান বাদে ভারতীয় উপমহাদেশের বাকি রাষ্ট্রের মানুষেরা পুরোনো নীতিতে জোটনিরপেক্ষ থেকেও যুদ্ধের বিরোধিতা করব। এটা সাম্রাজ্যবাদের অপছন্দ হলেও আমাদের কিছু করার নেই। সুতরাং ফেসবুক কর্তৃক টানা বাহাত্তর ঘন্টা ব্লক থাকার পরেও ফের এই লেখা লিখতে বসেছি এবং লিখব। শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বিখ্যাত উক্তি লাইটহাউস হোক – “তোমরা আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না”।

আগেও বলেছি আবারও বলছি যুদ্ধ কখনো সাধারণ মানুষের জন্য সদর্থক কোনো বার্তা দেয় না। সবচেয়ে অবস্থা খারাপ হয় সাধারণ মানুষের। অথচ যে মুষ্টিমেয় নীলরক্তের ঝাঁকের স্বার্থে যুদ্ধ হয়, যারা যুদ্ধের ফলে মুনাফায় ফুলেফেঁপে ওঠে, তারা নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য মানুষ বা জীবদের ভয়াবহ অবস্থার অবণতির কথা মাথায় রাখে না। ১৯৪৫ এ শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরও বহু যুদ্ধ এই গ্রহে সংঘটিত হয়ে গেছে। ৩০শে ডিসেম্বর ১৯২২ থেকে ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯১ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল। এই সময়ে কোনো বড় আকারের যুদ্ধ হতে পারে নি, কারণ বড় আকারে যুদ্ধ শুরু করার মত পরিবেশ তৈরী হলেই সেই দেশটি সর্বক্ষেত্রে ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধ আটকে দিত। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে। পৃথিবী হয়ে গেল শক্তির এক মেরু বিশিষ্ট গ্রহ। এই পর্যায়ে সুপার পাওয়ার হলো আমেরিকা। তার অজস্র অনুগামী দেশ।

এই পর্যায়ে অত্যন্ত শক্তিধর দেশগুলি বলতে গেলে এক প্রকার খোলা লুঠ চালিয়েছে পৃথিবী জুড়ে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মধ্য এশিয়ার দেশগুলি। প্রাকৃতিক পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসে সমৃদ্ধ দেশগুলিতে নিজেদের ইচ্ছামতো শাসক বসিয়ে সেখানকার সম্পদ জোর করে তুলে নিয়েছে শক্তিশালী দেশগুলির জোট। যখনই কোনো দেশের কোনো শাসক এই লুটপাটের বিরোধিতা করেছে, তখনই যুদ্ধের নামে সেই শাসককে হত্যা করা হয়েছে, সেই দেশে নিজেদের পুতুল শাসক বসিয়ে ফের জারি থেকেছে লুঠ। অথচ দেখা গেছে সেইসব দেশে অশান্তি ছড়িয়ে দেশ, শাসক, সাধারণ নাগরিক ও বাকি পৃথিবীর নজর ঘুরিয়ে রাখার জন্য যে সব ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের তৈরী করা হয়েছিল তারাই পরে নিজেদের স্রষ্টার বিরোধিতা করে অবশেষে তাদের হাতেই মারা যায়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ওসামা বিন লাদেন, সাদ্দাম হোসেন বা আইএসআইএস দল ও আফগান তালিবান দল। আরও বহু আছে, কিন্তু সে সব বিস্তৃত উদাহরণে আপাতত যাচ্ছি না।

১৯৪৫ এর পরে যে বড় আকারের যুদ্ধগুলির আওয়াজ পৃথিবীকে আশংকিত করেছিল তার মধ্যে প্রধান আমেরিকা – ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েত – তালিবান যুদ্ধ ও পরে আমেরিকা – তালিবান যুদ্ধ এবং NATO বনাম ইরান ও NATO বনাম ইরাক যুদ্ধ। এর মধ্যে দুটি যুদ্ধ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য, কারণ সেই যুদ্ধগুলিতে সুপার পাওয়ারকে পরাজিত করেছিল দুর্বল প্রতিপক্ষ। প্রথম উদাহরণ সোভিয়েত – তালিবান যুদ্ধ। এখানে সমগ্র আফগানিস্তান রাষ্ট্র সেই যুদ্ধে জড়িত ছিল না। বস্তুতঃ আফগানিস্তান দখল করে সেই দেশকে NATO র করিডর তৈরী করতে চাওয়া তালিবানকে দখলচ্যুত করার উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ করে বিফল হয়। এর মূলতঃ দুটি কারণ, প্রথম – সেই সময়ে তারা পাকিস্তানের মাধ্যমে আমেরিকার সর্বাত্মক সাহায্য পেয়েছিল। দ্বিতীয় – হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বত বেষ্টিত সেই দেশে বিগত ছয়শত বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধের কাছে কখনো কোনো শক্তি জিততে পারে নি। যদিও পরবর্তীতে সেই তালিবানদের তাদের স্রষ্টারা কখনো যুদ্ধে দমিয়েছে আবার কখনো ফের ক্ষমতায় বসিয়েছে, যেমন এখন হয়েছে গত বছরে।

গত শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোর মধ্যে ছিল আমেরিকা – ভিয়েতনাম যুদ্ধ। বিশাল শক্তিধর আমেরিকা আক্রমণ করে বসল এক‌টি মাইক্রোস্কোপিক দেশ ভিয়েতনামকে। পৃথিবী ভেবেছিল কয়েক দিনের মধ্যে ধ্বস্ত হয়ে যাবে ভিয়েতনাম। আরেকটু বিশদে গেলে জানতে হবে প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৫ – ১৯৭৫ পর্যন্ত কুড়ি বছর ব্যাপী চলা সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। সেই সময়ে অন্য ছোট দুর্বল দেশের মত ভিয়েতনামও ছিল প্রবল শক্তিশালী দেশ ফ্রান্সের উপনিবেশ। প্রধানত দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছিল ফ্রান্সের দখলে। আর ফ্রান্সের মদতদাতা ছিল NATO তথা আমেরিকা। উত্তর ভিয়েতনাম যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাহায্য নিয়ে দক্ষিণকে ঔপনিবেশিক দখল মুক্ত করতে চাইল তখনই শুরু হয়ে গেল বিংশ শতাব্দীর আরেক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। কুড়ি বছর স্থায়ী হওয়া এই যুদ্ধে প্রতি ইঞ্চিতে বোমা ফেলে ধ্বংস করেছিল আমেরিকা। ব্যবহার করেছিল ভয়ঙ্কর ধ্বংসকারী নাপাম বোমা সহ সব ধরনের আধুনিক অস্ত্র। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ভিয়েতনামীদের গেরিলাযুদ্ধের কাছে নতি স্বীকার করে নিজেদের ভয়াবহ ক্ষতি স্বীকার করে তাদের পরাজয় মেনে নিয়ে ফিরে যেতে হয়।

“The United States in the Vietnam War began shortly after the end of World War II in an extremely limited capacity and over a period of 20-years escalated peaking in April 1969 with 543,000 American combat troops stationed in Vietnam. By the conclusion of the United States’s involvement in Vietnam, over 3.1 million Americans had been stationed in Vietnam. At home this involvement played a key role in sparking the Civil Rights Movement, hippie culture and wide ranging changes in popular culture.

American Paratroopers of the 173rd Airborne Brigade on patrol in March 1966. The U.S. involvement in South Vietnam stemmed from a combination of factors: Joseph Stalin and Mao Zedong’s pledge in 1950 to support Ho Chi Minh and the Viet Minh’s guerrilla forces against France’s colonial occupation, the U.S. war with Japan in the Pacific, and domestic pressure to act against communism after the loss of mainland China and indecisive conclusion of the Korean War. The U.S. was initially adamantly against providing any aid to France that would prop up France’s struggle to maintain its pre-WWII colonial empire. However, Stalin and Mao’s offering their support to the Viet Minh in 1950, changed the battlefield dynamic and geopolitical character of the conflict from a struggle for independence from a colonial power to one of a global conflict against communist expansionism. It was at the time, in September 1950, that French forces began to be moderately backed by America.

As of 2020, records reported that the conflict resulted in 58,279 U.S. fatalities before the official end of combat operations in 1973. As of 2019 it was estimated that approximately 610,000 Vietnam Veterans are still alive, making them the second largest group of Veterans behind those of the Global War on Terror. The war’s lasting impact can be seen in the thousands of movies, books, and video games centered on the conflict.”

একটা ছোট্ট অংশের অনুভবী মানুষ যুদ্ধ চায় না। তারা কিন্তু কাউকে চোখ রাঙিয়ে অযৌক্তিক কথা বলে না। অথচ বড় অংশের মানুষেরা যারা যুদ্ধ সমর্থন করে তারাই ছোট অংশকে চোখ রাঙায়, গালাগালি দেয়, দেশদ্রোহী বলে। দুপক্ষের সমাধানের মত ও পথ আলাদা। এরা জানে না একটা যুদ্ধ শুধু হত্যাই করে না, দুর্বল জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

(চলবে)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

1 thought on “যুদ্ধ ৫

  1. শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বিখ্যাত উক্তি লাইটহাউস হোক –

    “তোমরা আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না”। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।