মামুনের অণুগল্পঃ তৃতীয় জনম

27599 ★ রাত শেষ হতে না হতেই জিসান বেশ তাড়াহুড়া করে বিছানা ছাড়লো। মা ভালোই বুঝলেন, কোথাও দৌড় লাগাবে। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল, আজ কনসার্ট দেখতে যাবার কথা। সে তো শুরু হবে দুপুর তিনটায়!

একের পর এক আলমিরার প্রায় সব কাপড়ই বিছানার উপর ঝাঁপ দিয়ে একটার উপর আরেকটা পড়ে এক রংগীন পাহাড় হয়ে গেল। এরপর সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে একটা ছোটখাটো নানা রং এর সমুদ্র হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত ব্যালকনির কাপড় শুকানোর স্টিলের আলনা থেকে সাদা গেঞ্জি আর গাঢ় নীল জিন্সটাই হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো অস্থির ছেলেটা।

পিছনে যা কিছুই সে এলোমেলো করে রেখেছে, তার জন্য তাকে এ পর্যন্ত কখনোই ভাবতে হয়নি। কাজেই এলোমেলো সে প্রাণ খুলেই করে। বাসায় ফিরে আবার গুছানো দেখার তৃপ্তিটাও বেশ উপভোগের ব্যাপার।
যাদু!

ভবিষ্যতের ব্যাপারে দুর্ভাবনার কিছু এখনো হয়নি। ওর স্বপ্ন, ধ্যান, জ্ঞান একটাই- ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়া বন্ধুর দল।
আর সব?
আছে নিশ্চয়, এত খেয়াল কি দরকার?

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখেন। ঠিক এখানটায় দাঁড়িয়ে, এক যুগ আগে অন্য আর একজনের চলে যাওয়া দেখেছিলেন। সামনে পিছনে সে ও ছেলের মতই দেখতে ছিল। ছেলের ফিরে আসার নিশ্চয়তাটুকু থাকলেও, সেই মানুষটির ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই জেনেও বহুদিন অপেক্ষা করেছিলেন।

এখন ও কি করেন না?

বৈধব্যের কি নির্দিষ্ট কোনো রং আছে?
একজন মানুষের চলে যাওয়াতেই কেন জীবনের রং বদলে যায়। এক নারী সাথীহারা হলে কি আর নারী থাকে না?
আকাশের বিস্তৃত নীলের মাঝে হারিয়ে এক মা তার দুঃখগুলোকে অনুভব করতে চান। দুঃখগুলো হারিয়ে যাক আকাশের নীলে! এক মায়ের আড়ালে বাস করা এক নারী তার সুখগুলোকে অনুভব করতে চায়, কিন্তু দু:খগুলো যে দেহধারী এই মায়ের চারপাশে ছড়ানো রয়েছে। তাই সুখগুলো আর অনুভব করা হয় না।

দু:খ জীবনের তরফ থেকে মায়ের জন্য উপহার।

মায়ের আড়ালে যে নারী বিদ্যমান- একজন বাবার চলে যাওয়ায়, সেই নারী যে কিভাবে নিষ্প্রভ হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যান, আমরা কি কখনো অনুভব করি?

মায়ের কাছে এক পলকের জন্য মনে হয়-
‘নারীর জীবনে পুরুষ কোনো না কোনো ভাবে থেকেই যায়। জিসানের বাবার চলে যাবার পর, সে এখন তার বাবার প্রচ্ছায়া হয়ে আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এক যুবতী নারী এক মায়ে পরিণত হন।

জিসানের মা। তিনিও হয়েছেন।
সামনের সময়গুলিতে হয়ত ছেলের কাছে এক মা ও বিস্মৃত হবেন!’

ভোরের স্নিগ্ধ বেলা শুরুর ক্ষণে, এক দেহের দুই নারী, তার তৃতীয় জনমের অপেক্ষায় প্রহর গোনেন।

বৈধব্য এক বিবর্ণ আঁধার।
সাদার প্রলেপে একে যতই দৃশ্যমান করার চেষ্টা করা হোক না কেন, জীবন নিজের থেকে কখনোই একে একটুও রং দেয় না। এর ভেতরের অন্ধকার থেকেই যায়।

এক নারী তার দ্বিতীয় জনমে এক মায়ে পরিণত হন। তৃতীয় জনমে তবে একজন মা কি হন?

.
#তৃতীয়_জনম_মামুনের_অণুগল্প

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

2 thoughts on “মামুনের অণুগল্পঃ তৃতীয় জনম

  1. অণুগল্পটি পড়ে আবারও মুগ্ধ হলাম মি. মামুন। ভালো থাকবেন এই প্রত্যাশা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।