এদেশ ওদেশ ৩

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ তৃতীয় পর্ব।)

পুরাকালে ভারতবর্ষের পরিধি ছিল আফগানিস্তানের কাবুল (গান্ধার প্রদেশ) থেকে নাগপ্রদেশ (বর্তমানের অরুনাচল)। এখনকার মায়ানমার ছিল অন্য দেশ, আর উত্তরে ছিল ইলাবৃতবর্ষ (বর্তমানে তিব্বত)। এই বিশাল এলাকা ভারতবর্ষের অন্তর্গত হলেও বিভিন্ন স্বাধীন শাসকের শাসনে থাকত। এই এলাকা থেকে মুঘল আমলে বিচ্ছিন্ন হয়ে গান্ধার প্রদেশ হয়ে গেল পাঠান ভূমি। ইংরেজ আমলে ক্রমাগত বিদ্রোহে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হয়ে গেল তরাই অঞ্চল।

রাজনীতির কান্ডারীরা যাই করুন না কেন, এই বিশাল ভূমিখন্ডের সাধারণ মানুষ কিন্তু এসবে মাথা ঘামাত না, সত্যি কথা বলতে তারা এত বিভেদের বৃত্তান্ত জানতোও না। রুটি রুজির জোগাড়ে সীমান্ত অতিক্রম করা তখন অন্যায় ছিল না।

৪৭ পরবর্তী দেশগুলোতে শাসকেরা ছিল উচ্চবর্ণের এবং রীতিমতো ধনী সম্প্রদায়ভূক্ত। এরা প্রায় সকলেই ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষিত। আমজনতার শিকড়ের সমস্যা সম্পর্কে এরা কেউই খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিল না। রাজতন্ত্র নামেই বিদায় নিয়েছিল। রাজা মন্ত্রী নবাব উজির নাজিরের দল ক্ষমতা ভোগ করছিল নিজেদের মধ্যে গোপণ আঁতাত এবং প্রকাশ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানোর কূট খেলা খেলে।

ভারতে নেহরু আর পাকিস্তানে জিন্নাহ্ র নরম নীতির কাল ফুরিয়ে এল খুব দ্রুত। পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব মুখে আলোচনায় বসার কথা বললেও কার্যত উগ্র আক্রমণ করে স্ব স্ব দেশে নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রাখা বা বাড়িয়ে মূলতঃ ভোট বৈতরণী পেরনোর চেষ্টা করতে শুরু করেছিল।

এই সহজ রাস্তার সন্ধান তারা পেয়েছিল ৪৬ – ৪৭ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েই। নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এতে ইন্ধন যুগিয়ে ছিল অপসৃয়মান ইংরেজ শাসক।

এদিকে দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের ছায়ায় থাকতে থাকতে ঔপনিবেশিক শাসকের সমস্ত খারাপ ধ্যানধারণা মজ্জায় মজ্জায় ঢুকেছিল ওই উঁচুতলার শাসকদের মধ্যেও।

দুই স্বতন্ত্র দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের আলাদা বৃত্ত গড়ে নিল। অথচ একটু চেষ্টা করলেই বিভাজনের কষ্ট ভুলে সৌহার্দ্য বাড়ানো যেত অনায়াসে।

ভারতে বাড়ছিল হিন্দু মৌলবাদ। আর পাকিস্তানকে ততদিনে গ্রাস করতে শুরু করেছে অন্ধ মৌলবাদ। প্রাদেশিকতায় আচ্ছন্ন পাকিস্তানের উচ্চসম্প্রদায় ভারত থেকে আসা উদবাস্তুদের গায়ে ছাপ মেরে তাদের করে দিল স্বতন্ত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মোহাজির। সিন্ধপ্রদেশের বালুচিস্তান অবহেলিত রয়ে গেল। আর পূর্ব পাকিস্তান হল উপনিবেশ। ভারতেও সর্বাধিক গুরুত্ব পেল উত্তর ও পশ্চিমের প্রদেশগুলো। উত্তর পূর্বের প্রদেশগুলোর জন্য বরাদ্দ হল চরম অবহেলা।

বঞ্চনা আনলো চরম দারিদ্র্য, দারিদ্র্য আনলো ক্ষোভ। ক্ষুব্ধ প্রজন্ম আবেদন নিবেদনের রাস্তা ছেড়ে হাতে তুলে নিল অস্ত্র। অশিক্ষিত এইসব বিদ্রোহীরা খুব সহজেই ধর্মের নামে মিথ্যা প্রচার করা ক্ষমতালোভীদের খপ্পরে পড়ে গেল।

(আবার আগামীকাল)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “এদেশ ওদেশ ৩

  1. সত্যি কথা বলতে তারা এত বিভেদের বৃত্তান্ত জানতোও না। রুটি রুজির জোগাড়ে সীমান্ত অতিক্রম করা তখন অন্যায় ছিল না।

    দুই স্বতন্ত্র দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের আলাদা বৃত্ত গড়ে নিল। অথচ একটু চেষ্টা করলেই বিভাজনের কষ্ট ভুলে সৌহার্দ্য বাড়ানো যেত অনায়াসে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।