(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে একটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ পঞ্চদশ পর্ব।)
ক্ষমতা দখলের মরীয়া প্রচেষ্টায় জামাত এবার অন্য চাল দিল। সেনাবাহিনীর উচ্চস্তরে তারা তাদের উগ্র ধর্মীয় মতবাদ ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করায় মন দিলো আর সফলও হলো। এই পর্বে জামাতের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্বঘোষিত উগ্র ধর্মগুরু মউদুদি। তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দাবার প্রথম চালেই তিনি মাত করে দিলেন মধ্যপন্থার ভুট্টোকে। ক্ষমতার নেশা ধরিয়ে নিজের দিকে টেনে আনতে সমর্থ হলেন সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তা জেনারেল মুহম্মদ জিয়া উল হক কে। তলে তলে সেনাবাহিনীর ধর্মীয়করন শুরু করে দিলেন জিয়া। ১৯৭৬ এর জুলাইয়ে সেনার এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জয়ীরা পুরস্কার পেলেন মউদুদির লেখা প্রচার পুস্তিকা তাফহিমু-ই-কুরান। শুধু তাই নয়, সেই অন্ধ প্রচার পুস্তিকা, যা কিনা কোরানের মহতী আদর্শ থেকে যোজন দূরে এবং শুধুমাত্র যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই লিখিত, সুপারিশ করা হলো সেনার ক্যাপ্টেন ও মেজর পদের প্রোমোশনের পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তক হিসাবে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে পাকসেনা পরিবর্তিত হতে থাকলো অন্ধ ধর্মীয় হানাদলে।
এবার চোখ ফেরানো যাক আরো একবার পূর্বে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেই বাংলাদেশের চেহারা ছিল ধর্ষিতা জননীর মতো। আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ বুলালে দেখতে পাই, Time Magazine USA 17-January -1972 : “In the aftermath of the Pakistani army’s rampage last March, a special team of inspectors from the World Bank observed that some cities looked “like the morning after a nuclear at tack.” Since then, the destruction has only been magnified. An estimated 6,000,000 homes have been destroyed, and nearly 1,400,000 farm families have been left without tools or animals to work their lands. Transportation and communications systems are totally disrupted. Roads are damaged, bridges out and inland waterways blocked.The rape of the country continued right up until the Pakistani army surrendered a month ago. In the last days of the war, West Pakistani-owned businesses—which included nearly every commercial enterprise in the country—remitted virtually all their funds to the West. Pakistan International Airlines left exactly 117 rupees ($16) in its account at the port city of Chittagong. The army also destroyed bank notes and coins, so that many areas now suffer from a severe shortage of ready cash. Private cars were picked up off the streets or confiscated from auto dealers and shipped to the West before the ports were closed.”
এই ছন্নছাড়া অবস্থা থেকে সুস্থ দেশ গড়ে তোলা ছিল সেই সময়কার নেতৃত্বের কাছে চ্যালেঞ্জ। দেশ চালানোর ভার হাতে পেয়েই তাঁরা প্রথম খাদ্য এবং চিকিৎসা এই দুই প্রাথমিক চাহিদার ওপরেই প্রাধান্য ন্যস্ত করলেন। কিন্তু ভাঁড়ার সম্পূর্ণ শূন্য। এ অবস্থায় সাহায্য চাওয়ার আর অন্য কোনো বিকল্পই সামনে খোলা ছিল না। স্বভাবতই সাহায্যের জন্য শেখ মুজিবর রহমান আবেদন জানালেন রাষ্ট্রসংঘ, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম সহ ইউরোপের ধনী দেশগুলির কাছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে গড়ে তুললেন সখ্য। প্রতিবেশী অন্য দেশগুলির সঙ্গেও সদ্ভাব বজায় রাখার নীতি গৃহীত হলো। পশ্চিম পাকিস্তানের এতদিনের ঔপনিবেশিক নীতি থেকে দেশ কে বার করে আনার জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলো।
জাতীয়তা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র এই চার স্তম্ভের ওপর গড়ে তোলা হলো নতুন সংবিধান, যা অন্য দেশে মুজিবিসম নামে খ্যাতি পেয়ে গেল। ১৯৭৩ সালে স্বাধীণতা পরবর্তী বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম সাধারণ নির্বাচন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করল আওয়ামি লীগ। প্রধানমন্ত্রী হলেন মুজিব। খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জল, বিদ্যুৎ, নিকাশী ব্যবস্থা, ১০ লক্ষ উদাস্তুর পুনর্বাসন লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য পদক্ষেপ নিল নতুন সরকার। প্রায় ৯০ শতাংশ দরিদ্র এবং দরিদ্রেতর মানুষের দেশ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারছিল না সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
তলেতলে দানা বাঁধল ষড়যন্ত্র। পরাজিত পাকিস্তানের বেশ কিছু এজেন্ট রয়ে গেছিল ছদ্মবেশে। এছাড়া ছিল পাকিস্তানপন্থী জামাত ই ইসলামীর মতো কট্টর মৌলবাদী দল। তাদের মদত দিল আমেরিকা। ১৫ই আগষ্ট, ১৯৭৫, আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টালিজেন্স এজেন্সি এবং পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ আর্থিক ও অন্যান্য মদতে এবং ঢাকাতে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বুস্টারের উপস্থিতিতে খোন্দকার মোস্তাক আহমেদের প্ররোচনা এবং নেতৃত্বে একদল ধর্মোন্মাদ তরুন মিলিটারী অফিসার ট্যাংক ও সবরকম অস্ত্র নিয়ে ঘিরে ফেললো ঢাকায় ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ী। মুজিব সহ তাঁর পরিবারের উপস্থিত সমস্ত সদস্য কে হত্যা করল উন্মাদের দল। বেঁচে গেলেন শুধু পশ্চিম জার্মানিতে প্রবাসী দুই কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও শেখ রেহানা। বাংলাদেশে তাঁদের ফেরা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে সামরিক অভ্যুথানের নায়ক পাকিস্তানপন্থী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ হলেন স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট অব বাংলাদেশ।
আশ্চর্য ইতিহাসের পরিহাস, একই সময়ে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে। পিছিয়ে পড়লো উন্নয়নের শুভ প্রচেষ্টা ও ইচ্ছা। খুন হল গণতন্ত্র তিন দেশেই।
(আবার আগামী কাল)
জাতীয়তা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র এই চার স্তম্ভের ওপর গড়ে তোলা হলো নতুন সংবিধান, যা মুজিবিসম নামে খ্যাতি পেয়ে গেল। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম সাধারণ নির্বাচন। প্রায় ৯০ শতাংশ দরিদ্র এবং দরিদ্রের মানুষের দেশ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারছিল না সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।