মাগো,
সালাম নিও। খুব জানতে করে তুমি কেমন আছ? কতদিন গেছে, কত রাত যাচ্ছে… একের পর এক সূর্য পূব আকাশে উঠছে আর পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছে। এ বিশ্বচরাচরের সবকিছু কোনো না কোনোভাবে চলছে…. চলে যাচ্ছে। কোনোকিছুই থেমে থাকছে না, কেবল থেমে আছে আমি। তোমাকে দেখতে যেতে না পারার অসহ্য কষ্ট আর যন্ত্রণা বুকে জড়িয়ে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, দেহে তবুও আমি রোজ রাতে ঘুমাই। ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়ার আগে কেবলই তোমার মুখ চেয়ে থাকি। মনে মনে তোমার মুখোমুখি বসি। তোমার কোলে আধশোয়া হই। আমার চোখে, মুখে, চুলে তোমার কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করি।
জানো মা, এই প্রবাস জীবনে আমি যতবার খেতে বসেছি, একবারও তৃপ্তি সহকারে খেতে পারিনি। কীভাবে তৃপ্তি পাব মা, তোমার হাতের রান্না যে একবার খেয়েছে… সেকি তা কোনোদিন ভুলতে পারবে? পারবে না। আমিও পারিনি। থানকুনি পাতার সাথে শিং মাছের ঝুল, মলা, ঢেলার চর্চরি, মিষ্টি কুমড়ার ফুলের বড়া, সজনে পাতার ফ্রাই, কলমি শাক… এসবের কথা মনে হলে এখনো আমার জিবে জল চলে আসে। ইচ্ছেঘোড়াটা লাগাম ছিঁড়ে তোমার কাছে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু পারে না।
জানো মা, এখানে এই মরুভুমির জীবন আমার মোটেই ভালো লাগে না। আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই। যতদুর চোখ যায় কেবল বালুকারাশি। মাঝে মাঝে খেজুর গাছ। থোকা থোকা খেজুর ঝুলছে। খাওয়ার কেউ নেই। মাঝে মাঝে সরকারি গাড়ি আসে, খেজুর নিয়ে যায়। এই নিঃশব্দ মরুভূমিতে আমরা ক’জন বাঙালি প্রবাসি একসাথে থাকি মা। মরুভূমির জাহাজ নামে বিখ্যাত উট চড়াই। তুমি শোনে খুশি হবে, আমরা একজন আরেকজনের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করি। একজন হাসলে সবাই হাসি, একজন কাঁদলে সবাই কাঁদি!
তুমি বলো মা… এমনটা কি হওয়ার কথা ছিলো? তুমি আর বাবা শরীরের রক্ত পানি আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করেছিলে। আমাকে ঘিরে তোমাদের চোখে কত রঙিন স্বপ্ন ছিল। আমি সরকারি চাকুরি করব, মাস শেষে মোটা মাইনে পাব… আমাদের সংসারে আর কোনো দুঃখ থাকবে না। অথচ অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! অসংখ্য চাকুরির পরীক্ষায় প্রথম হয়েও স্বদেশে আমার ভাগ্যে চাকুরী জুটলো না। দালানের খপ্পরে পড়ে সেই আমি এখন সৌদি আরবের মরুভূমিতে উটের রাখাল।
জানি মা, আমার বকবক শোনতে শোনতে এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোমার কান্না পাচ্ছে। তোমার পায়ে পড়ি মা, দুঃখ করো না। এতো কষ্টের মাঝেও আমি আল্লাহর রহমতে, তোমাদের দোয়ায় এই ভেবে ভালো আছি যে, প্রতি মাসে দেশের জন্য সামান্য হলেও কিছু রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছি। আমার জন্য দোয়া করো। কদমবুসি নিও।
ইতি
তোমার সৌদি প্রবাসী আদরের সন্তান
অচল ওরফে জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
থানকুনি পাতার সাথে শিং মাছের ঝুল, মলা, ঢেলার চর্চরি, মিষ্টি কুমড়ার ফুলের বড়া, সজনে পাতার ফ্রাই, কলমি শাক… এসবের কথা মনে হলে এখনো আমার জিবে জল চলে আসে। ইচ্ছেঘোড়াটা লাগাম ছিঁড়ে তোমার কাছে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু পারে না।