শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

এক
নিবাধুইয়ের সবজি বাজারটা কেমন যেন কম-রোশনি, চোখ-বোজা, মরা-মরা। ইঁটের দাঁত বের করা পিলারের ওপর টালির চাল, নীচে কাঁচা এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে একটা চটের বস্তা পেতে ব’সে দুতিনটে বস্তার ওপর আনাজের ডাঁই তুলেছে দোকানদাররা, বিক্রির টাকাপয়সা চালান করছে হাঁটুর নীচে চাপা অন্য একটা দুভাঁজ করা বস্তায়।

আলু-পেঁয়াজের লাটের সামনে উবু হয়ে সওদা বাছছে লোকজন, তার মধ্যে লং ক্লথের সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতির ওই যে নির্মলচন্দ্র। জাহাজের মতো একজন খদ্দের হেলেদুলে এসে হাতের ডিবে থেকে চুন খুবলে লাল জিভে মাখিয়ে নিয়ে জিগেস করল, আলু ক’পহা? দোকানদার ব্যস্ত হয়ে হাতবোমা সাইজের আলুগুলো বেছে চুপড়িতে তুলতে তুলতে জবাব দিল, ক’কেজি লাগবে বলুন, মুখুজ্জেদা। হুগলি হাটের পাল্লা-দরে দিয়ে দোবো।

ওমনি পেছনে একটা ধাবমান আওয়াজ শোনা গেল, আলু ক’পহা? তোর বাপের পহা? ঢলঢলে ধুলোমাখা শার্টপ্যান্ট পরা, কোমরে নারকোল-দড়ির বেল্ট, হাতে কঞ্চির লাঠি — সীতাপাগলি হুশ করে বেরিয়ে গেল। বাজারের ও-মাথায় পৌঁছে কুচকাওয়াজরত সৈন্যের মতো মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসতে লাগল, মুখে সেই মন্ত্র, তোর বাপের পয়সা?

এই বাজারপাড়াতেই উন্মাদিনীর বিচরণ; বর কলেরায় ফৌত হওয়ার পরে ছেলেকে নিয়ে থাকত; কিশোরপুত্র রাস্তায় লরিচাপা পড়ায় সীতা রাতারাতি পাগল হয়ে যায়। তবে নির্মল দেখেছে, অনেক সময় গ্রামের গরীব মানুষেরা মাথাখারাপ হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। টিফিনে রুটিটা-মুড়িটা কি দুপুরে দুটো ভাত যেভাবে হোক নসিব হচ্ছে তাদের। ফলে কোনও কোনও খ্যাপা আপনা থেকে সুস্থ হয়ে গেলেও খ্যাপামির ভেক ছাড়তে চায় না। নির্মল দেখে বুঝতে পারে, অভিনয়ের ফাঁকে কখন তারা ব্রেক নেয় অথবা কখন পাগল ফাঁকি দিচ্ছে পাগলামিতে।

আলুর দোকান থেকে দু’নয়া ভিক্ষে পেয়ে সীতা চলে গেছে পারিজাত টকিজের দিকে, নির্মল ঢুকল মাছবাজারে। শোল, চ্যাং, কই, কাঁকড়া, কচ্ছপ আর প্রচুর পুঁটি-মৌরলার ঢেউ পার হয়ে তবে মাটির হাঁড়ি নিয়ে বসা মেছুনি। মেয়েটা তিতিলের সরা তুলতেই গোল্লা পাকানো চারটে গাঢ় বাদামি সর্পপ্রতিম কুচে মাছ; তা থেকে সবচে’ প্রশস্তটি নির্মল কিনে নিল থোক দামে। কুচেমাছ খেলে গায়ে রক্ত হয়, তাকে গরম মশলা দিয়ে মাংসের মতো রাঁধতে হবে। তার আগে কুচের গলা বরাবর গোল ক’রে পোঁচ দিয়ে গোটা চামড়াটা লেজের দিক দিয়ে টেনে ছাড়িয়ে ফেলাই হল আসল ক্যাপাকাইটি! আঁশ-নিরামিষ যাতে ঠেকে না যায়, দুই হাতে দুই ব্যাগ ঝুলিয়ে নির্মল বাজার থেকে বেরোতে যাবে — “আ রে, পণ্ডিতমসাই, পাঁটার মাংস কিনেছেন ভালো কতা, আমরা তো আর আব্‌নার বাড়ি যাচ্ছিনে নেমন্তন্ন খেতে। তাড়া কীসের?”

সুধাময়… ট্রেনে তারা এক বগিতে বারাসাত যাতায়াত করে। ব্লক-অফিসে-চাকরি সুধা ভাবতে পারবে না মাসের এগারো তারিখেও নির্মলের বেতন হয়নি। আজ ঘর-কুড়িয়ে টাকাক’টা হাতে দেওয়ার সময় মায়া জানিয়ে দিয়েছে, আগামি কাল থেকে মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত বাজার বন্ধ।

সুধাময় তার অসন্তুষ্ট হাসিটা হাসে :
— সান্তিপ্‌পিয়ো মানুস, এক মনে সঙ্‌সার কোচ্ছে। আজকের নিউজপেপার পড়েছ?

রবিবারের খবরের কাগজ নির্মল পরের দিন স্কুলে গিয়ে পড়তে পায়। তাদের বাড়িতে রেডিয়ো নেই।

—তাসখন্দো চুক্তি সই হয়ে গেল জানো নাকো! রাসিয়ার পেসিডেন্ট তো ভারতের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়েছে। দুই দেসের সোন্নোদেরকে নিজের এরিয়ার ফিরে যেতে হবে বলো।
— ভালোই তো হয়েছে।
— কী বলছ, মাস্টার? আজাত কাস্‌মির দখলের এত বড় চান্স হাতছাড়া হয়ে গেল! পাকিস্তানও সাওস পেয়ে গেল।

সুধাময় যে কীসে খুশি বোঝা মুশকিল। যুদ্ধ যখন বাধে সেই অগাস্ট মাসে, বলেছিল মানুষ এবার না-খেতে পেয়ে মরবে। আবার এখন থামাতে চাইছে না। হাঁটতে হাঁটতে তারা সিনেমাহলের উল্টোদিকে বিজু খোঁড়ার চা-দোকানে হাজির হয়েছে। পায়ের-পাতাহীন কাঠের পা-টা পাশে খুলে রেখে বিজু তোবড়া মুখে জমিদারের মতো বিড়ি টানে, আর তার বেঁটে-বামন বউ শান্তি চা বানিয়ে একটা অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে গেলাসগুলো বসিয়ে ছুটছে দোকানে দোকানে — মেহবুব রেডিয়ো-সারাই, পাশে সেলাই-মেশিন নিয়ে বসা চিরকেলে কথার খেলাপি হারাধন দর্জি, তারপর গমকলের সাধুখাঁ, আদ্যাশক্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পারিজাত হলের লাইটম্যান মোটরম্যান, এইসব।

বিশ্‌কুটের যুদ্দো… চায়ের যুদ্দো… ফুলুরির যুদ্দো…সন্নেসের যুদ্দো — কখন সীতাপাগলি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতের এস-বিস্কুটখানা তাকে সঁপে দিয়ে বিজুর বউকে আর একটা চা দিতে বলে নির্মল। শান্তি গেলাসে চামচ নাড়তে নাড়তে টাকরায় চটাস আওয়াজ করে : নামেতেই মেয়েটাকে খেয়ে নিল, বুয়েচেন? সীতা নামে ওবিসাপ নেগে আচে।

এসবে ভ্রূক্ষেপহীন সুধাময় বকবক করেই যায় :
— আমাদের উচিত ছিল লাহোর এয়ারপোর্ট কেড়ে নোয়া। পাকিস্তান যদি জম্মুর আকনুরের দখল পেতো, তাহলে আমেরিকা রাসিয়া কারও কথাতেই ভারত ছাড়ত না — আমি তোমাকে লিকে দিচ্ছি, মাস্টার।

বাড়ির গেটে বুগেনভিলিয়ার ডালের মতো একটা সামনে ঝোঁকা লোক দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। সে বলল, আয়ুব খান বলেছেল হিঁদুরা জ্যাগামতো দুএকটা শক্ত ঘা খেলিই ভেঙে পড়বে। ব্যাটা কচি-র হাতের খেলনা পেয়েচে!

সুধাময় জবাব দিল, খেলনা নয় তো কী? মনে নেই, গত সালের এপ্পিল মাসে কচ্চের রানে অ্যাটাক করেছিল পাকিস্তান? বলে, কচ্চের সাড়ে তিন হাজার মাইল এলাকা নাকি ওদের। তাই নিয়ে ইংল্যান কমিসান বসিয়ে দিয়েছে। দ্যাকো, সেকানে আবার কী হয়!

বুগেনভিলিয়া বলে, সাদিনতা হয়ে গেচে বিস বচোর, এখনও সীমানা নিয়ে বিবাদ কীসের? আইন মোতাবেক ধোল্লে এটা বেআইনি।
— আইন মোতাবেক মানে জানো? আইনকে মুতিয়ে ছাড়বে। ওর নাম পাকিস্তান। হা হা ক’রে হাসে সুধাময়।

এই শব্দখেলা কথা বলতে উৎসাহ দেয় নির্মলকে।
— খবরের কাগজে দেখবা, ভারত বলিছে আমরা যুদ্ধে পাকিস্তানের দু’হাজার বর্গ কিলোমিটার জমি দখল করিছিলাম, আর ওরা মোটে সাড়ে পাঁশ্‌শো। আবার পাকিস্তান বলে, আমরা ষোলোশো বর্গ কিলোমিটারের দখল নিছিলাম, ভারত সে তুলোনায় কিছুই না। গড়ে দেখতে পাবা, দু’দেশেরই সমান-সমান ক্ষতি। আমরা মারামারি বাধালিউ বড় দেশ এসে থামায় দেবে। মাঝখান দিয়ে নিজেদের কয় হাজার সেনা মরল, গোলাবারুদ নষ্ট হল, বাজারে চালির দাম বাড়ে গেল।

এমন মন্তব্য জনপ্রিয় হয় না, উলটে শীত-সকালের চা জুড়িয়ে দেয়। কিন্তু সুধাময়ের মন হল তিনচোখো মাছের বুড়বুড়ি কাটা ডোবা। মেহবুব রেডিয়োর কাউন্টারে বসা দাড়িওলা জামালভাইয়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে সে বলল,
— ঠান্ডাটা যাক, পাকিস্তান আবার অ্যাটাক কোরবে, তুমি কাস্‌মির আগলে রাকতে পারবে নাকো।

দুই
বাজার নিয়ে ফিরতে ফিরতে পছন্দসই চেনা একাকিত্বের মধ্যে আবার ঢুকে পড়ছিল সে। শীতের রোদ কৈশোর পার হচ্ছে; উঠোনে উঠোনে এত গাঁদাফুল… বাচ্চারা তাদের ফেদার বানিয়ে পিচবোর্ড দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার পর পাপড়ির থ্যাঁতলানো গন্ধে বাতাস বাঘবন্দী। মুখে নরম হাসি নিয়ে একটা লোক সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। যার সঙ্গে আলাপ ক’রে ফিরছে, সে নিশ্চয় এই সুহাস উপহার দিয়েছে তাকে। এভাবে প্রত্যেক মানুষ অন্যের অনুভূতির জলছাপ বয়ে বেড়ায় বুকের ভেতর। যেমন সুধাময় তার মনে ঘুগনির শালপাতায় চানাচুরের মতো সন্দেহ ছড়িয়ে দিয়ে গেল।

চৌবাড়ি ময়দানের অশ্বত্থগাছে দল বেঁধে অনেক পাখি ডাকছে, উলের লেচিতে জট পাকিয়ে গেলে যা হয়। সে সাবধানে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল — শালিখ, টিয়া, ছাতারে, ফিঙে, বউ কথা কও…। পাখি শুনতে শুনতে দেশভাগ পেছনে চলে যায়, টানাটানির সংসারও যেন পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া পালক। তারপর কাঁসর শোনা গেল মান্নাপাড়া কালীবাড়ির, নির্মলের মনও শিস থেকে ভেসে গিয়ে নোঙর করল সংগীতে। তিন বার টং-এর পরে একটা মাত্রা চুপ, তারপরে আবার টং টং টং। নির্মল কাঁসরঘন্টাকে ত্রিতাল বানিয়ে ওই লয়ে গুনগুন ক’রে বোলকারি গড়তে লাগল। কাব্যতীর্থ পাশ দেওয়ার পরপরই তার নড়াল-এর জমিদারবাড়িতে গৃহশিক্ষকের চাকরি জুটে যায়। মাস-মাইনে করা গোয়ালিয়র ঘরানার ওস্তাদজি থাকতেন পাশের ঘরে। সন্ধেবেলার মজলিশে সে মাঝেমধ্যে মৃদঙ্গ নিয়ে বসেছে।

একটু এগিয়ে নির্মল দেখল কলোনির একটা বাচ্চা, চাকা চালাতে চালাতে এতদূর এসে পড়েছে। লতপত ক’রে পাক-খাওয়া বাতিল সাইকেলের টায়ার সামান্য লাঠি দিয়ে পাকা ড্রাইভারের মতো সামলাচ্ছে সে; এই শীতে গায়ে কোনও রকম একটা ছিটের জামা, প্যান্টের বোতাম নেই ব’লে বাঁহাতের ছোট্ট মুঠোয় ঢাকা তার সংক্ষিপ্ত লজ্জাশরম, পা খালি আর ধারাবাহিক শিকনি নাক দিয়ে। বিষণ্ণতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় আবার মোর হয়ে গেল নির্মল। সে জানে এই শিশু বিপর্যয়ের মায়াহীন প্রতীক যার সারা গায়ে উল্কি ক’রে লেখা আছে চারটে অক্ষর — শরণার্থী।

(চলবে)

2 thoughts on “শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

  1. আপনি গল্পও ভালো লিখেন। তবে কিছু আঞ্চলিক শব্দের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করছি।

  2. আপনার হাতের এমন স্বতন্ত্র ঘরানার লিখা বরাবরই আমার ভীষণ পছন্দ। চলুক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।