শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

সাত
— দাঁড়ায় জল খায় না, দিদি। বিষম লাগবেনে।
শিউলি খাটের ওপর খ’সে প’ড়ে গেলাসে চুমুক দিল।
দিদিমাবুড়িরা একটু বকর-বকর করেই থাকে :
— জীবনে আর তিন্‌ডে জিনিস মনে রাইখো। কেউ পান খাওয়াতি চালি খুলে দেখে মুখি দেবা। পাইখানা ক’রে মাটিতি হাত ঘষতি ভোলবা না। আর কোনও দিন ষোলোগুটি খেলার ধারেকাছে গেছো কি মোরিছো।

দু’একটা ক’রে হাবাগোবা মানুষ বাংলার প্রত্যেক গ্রামে পাওয়া যাবে, বুঝি কে বা কারা তাদের পানের রঙিন মশলায় শেকড়-বাকড় বেটে খাইয়ে দিয়েছিল। আর পায়খানা থেকে বেরিয়ে শ্যাওলাপেছল মাটিতে ভালো ক’রে ঘ’ষে নিলে বাঁহাত শুদ্ধ হয়ে যায়। ঘষতে ঘষতে কাঁকর-বালি উঠে চিনেবাদাম-রঙ মাটি বেরিয়ে পড়ে, ধরা যায় কোন হাতের মাপ বাড়ির কোন সদস্যের। বাকি থাকল ষোলোগুটি। পূর্ববঙ্গে এক দিবানা লোক সন্ন্যাস নেবে ব’লে মাঝসংসারে বউ-ছেলেমেয়ে ফেলে গেরুয়া প’রে পিঠটান দিয়েছিল। তিন দিন তিন রাত জলেজঙ্গলে হেঁটে এক গ্রামে পৌঁছে পাকুড়তলায় জিরোতে বসেছে, বৈরাগী ভেবে কোনও গোয়ালা সদ্য দুয়ে আনা এক লোটা দুধ দিয়েছে তাকে। দুধে চুমুক দিতে দিতে, এই যেমন চাঁদভাই খাচ্ছিল আজ, দ্যাখে গাছতলায় ষোলোগুটি-র ছক কাটা। “কী হে, এক-হাত হবে নাকি” বলে সে কোনও পথচারীকে ডেকে বসাল। সেই যে বিবাগী মাতল খেলায়, না হল তার গ্রাম ছেড়ে এগোনো, না সন্নিসি হওয়া। পথিক আসে, পথিক যায়, আর লোকটা মাথা নীচু ক’রে খেলতে খেলতে জিতে গেলে জোকার দেয় বিশ্বেশ্বরের নামে, হারলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার ইঁটের ঢেলা দিয়ে কোট সাজায়। দেখতে দেখতে তার দাড়ি বুক পর্যন্ত, মাথার চুলে জট, খাওয়া বলতে ওই লোটায় ক’রে কাঁচা দুধ… গ্রামের মানুষ নাম দিয়েছে ঢেলামহারাজ। আশপাশের যোক্তা লোকজন এসে বলল, চলো গঙ্গাসাগর যাই, গেল না। ছ’মাস পরে খোঁজতলাশ করে তার বৌ-ছেলে এল, চিনতে পারল না তাদের। লোকটা পাকুড়তলাকে ‘ষোলোগুটির থান’ বানিয়ে ঢেলামহারাজ নামে কাটিয়ে দিল বাকি জীবন।

বেঁচে থাকা এমনই বিচিত্র কারসাজি, এক দেববিস্ময় মহাজনি কেতা। এইমাত্তর সে মৎস্যচক্ষু বোঝাটানা জীবন, আবার মুহূর্ত পরেই হেঁয়ালি-শিহরনে জম্‌জমা। শ্রীরামপুরের গঙ্গা যেন — কোথাও শ্মশানঘাটে পচা গাঁদাফুল আটকে প’ড়ে আছে তো আছেই; কোথাও কোলের শিশু খসামাত্র তলিয়ে যাবে, হদিশ করতে পারবে না।

এই যে পাড়ায় রামযাত্রা এল, যখন তের্‌পল গুটিয়ে হ্যাজাক নিভিয়ে চলে যাবে, দেখা যাবে তক্ষুনি গ্রামের দু’একটা মেয়েও গায়েব-লোপাট-অনুপস্থিত। প্রতিদিন ভিড় হতো, প্রতিদিন সংলাপমুগ্ধ যুবতীরা মঞ্চের সামনে ব’সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত রামের গভীর নাভিকুণ্ডলী, সীতার গলাভর্তি গয়নার দিকে…। তারপর কোন ফাঁকে বাতিল রেল কোয়ার্টার্সের পাশে জানকীবল্লভের অসভ্য ইয়ারকি শুনে ফেলল তারা, সীতার বুকের ঘন লোম তাদের ঝটকা দিয়ে দিল। তারা ডুবে গেল চুঁচড়ো বা অগ্রদীপ বা ধুলিয়ানের গঙ্গার ঘূর্ণিজলে।

আট
ঘরের ছাঁচতলায় গাঁদার চারা লাগিয়েছিল মায়া, তাতে খুব ফুল এসেছে। নির্মল অনেক দিন পরে রুলটানা, তিন ফুটো ক’রে সবুজ সুতোয় সেলাই — তার বাংলা, ইংরাজি আর সংস্কৃতে কবিতা লেখার খাতাটি বের করল বইয়ের তাক থেকে। তখন পাশের ঘরে মায়ার গলা :
— বাহ, বই মুখি দিয়ে সব খাটে শুয়ে পড়িছেন! গ্যাঁট হয়ে ব’সে পড়তি পারিস না? সাধে কী আর বলে, শোয়া-পণ্ডিতির বংশ?
— শোয়া-পণ্ডিত কী, মা?
— এই কাহিনিডা আমার চেয়ে তোমার বাবা অনেক ভালো কোতি পারবে।
মা’র চোখের ইশারা পেয়ে চাঁদ মরা গলায় ডাকে :
— বাবা, ও বাবা, শোয়া-পণ্ডিতির গল্পোটা বলেন না!

ফাউন্টেন পেনের নিব খসখস করছে, নির্ঘাৎ সঞ্জু বা বাসু লুকিয়ে বাবার কলমে হাত দিয়েছিল। নির্মল ধ’রে ধ’রে লিখল :
শুষ্ক স্বর্ণ জিনিয়া বর্ণ,
সুষমার সার রূপ অতুল —
গাঁদাফুল!
তারপর অসমাপ্ত কবিতার জিম্মায় শীতের দুপুরকে রেখে এ-ঘরে এসে দ্যাখে সন্তানদের মুখে একরাশ লাবণ্য। গরীব ভালো থাকে যদি সে ভবিষ্যৎচিন্তা ভুলে যায়। তবে সে-কাজ মহাপুরুষদেরও অনায়াসসাধ্য নয়। তাই ঈশ্বর অসহায়কে আরও একটু সমস্যার মধ্যে ফেলে তারপর সেই অসুবিধেটি মোচন ক’রে দেন। কোনঠাসা লোক আবার পুরনো ঝুটঝামেলার জীবনে এসে পড়ে। কিন্তু খানিকটা নেমে আগের জায়গায় পুনর্স্থাপিত হওয়ায় সে নিজেকে জয়ী এবং সুখী ভাবতে থাকে। চাঁদের অসুখ থেকে ওঠা-ও বাড়িতে তেমনই এক ক্ষণবসন্তের জন্ম দিয়ে গেছে।

নয়
— আমার ঠাকুর্দা ছিলেন স্বর্গীয় শ্রীধর তর্কালংকার, স্বর্গীয় অমূল্যচরণ তর্কালংকার আমার প্রপিতামহ।
— আমিও বিয়ে হয়ে ইস্তক শুনিছি, শ্বশুরবাড়ির বংশে অনেক কাঁচালংকা শুকনো লংকা ছিল। ফোড়ন কাটে মায়া, মুখে আঁচল চাপা দেয়, তারপর বাচ্চাদের দিকে ফিরে : প্রপিতামহ মানে ঠাকুদ্দার বাবা, বুঝতি পারিছো?
নির্মল বাবু হয়ে ব’সে গোপার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে যায় :
— মহা-মহা পণ্ডিত ছিলেন তাঁরা। তবে পাড়ার বয়স্করা এ-বাড়ির ছেলেমেয়েদের চিনত ‘শোয়া-পণ্ডিতের বংশ’ ব’লে। সেনহাটির সিদ্ধান্তপাড়ায় বিষ্ণুমন্দিরের মুখোমুখি স্কুলবাড়ির মতো লম্বা দোচালা। টানা বারান্দায় সার দিয়ে তক্তপোশ, ঘরের মধ্যে উঁকি দিলেও ওই খাটিয়া-সাইজ খাটই। তাতে আগাগোড়া বই ডাঁই করা রয়েছে। মাঝখানে খোঁদল ক’রে এক একজন শুয়ে। শুয়ে, ঘুমিয়ে নেই কিন্তু। বই পড়ছে।
এটা ন্যায়শাস্ত্রের খাট, পরেরটা স্মৃতির — দুই জ্যাঠাতো ভাইয়ের সংসার। ভেতরের ঘরে সুশ্রুত খাটে কবিরাজ ছোটকাকা, আবার গীতাভাগবতের পুরনো খট্টাঙ্গটি খোদ বাড়ির বড়কর্তার। দেখলে দূর থেকে বেশ মনে হবে জেলা হাসপাতাল।

যে কাহিনি বলতে যাচ্ছি, ছোট্‌ঠাকুরদার লেখা তালপাতার পুথি থেকে উদ্ধার করেছিলেন আমার বড়দা। চৈতন্যের আবির্ভাবের দুশো বছর পরে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন মধুসূদন, তার মতো ন্যায়-বৈশেষিক শাস্ত্রজ্ঞ ও তার্কিক তখন গোটা বঙ্গদেশে নেই। সেবার বেনারস থেকে এসেছেন দিগ্বিজয়ী দশরথ মিশ্র, জাঁহাবাজ লড়ুয়ে, যাকে তর্কে হেরে যাবে ভয়ে লোকে সম্ভাষণ করতেই ভয় পায়। দশরথের বজরা গঙ্গা বেয়ে ভাটপাড়া কাটোয়ায় নোঙর রেখে শেষে বিজয়পতাকা উড়িয়ে পদ্মা বেয়ে কপোতাক্ষ হয়ে ভৈরবের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে ব’সে রইল। সে বজরার এ-মাথা ও-মাথা করছে বাদশাহের মতো আর ছোট-বড় কথা বলছে বাঙালির জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে। তখন সাতক্ষীরা খুলনার মাতব্বরেরা এসে ধরল — মহাশয়, আপনি রুখে না দাঁড়ালে তো বাংলার মান বাঁচে না। রাজি হতেই হল মধুসূদনকে।

বিতর্কের দিন মেহেরপুরের মাঠে বিরাট শামিয়ানার নীচে দুই পণ্ডিতের বসার ব্যবস্থা। চারপাশে গোল হয়ে এলাকার মান্যিগন্যিরা আসীন, পেছনে উৎসুক জনতা। এসে তো বসলেন, কিন্তু মধু পণ্ডিত একটু যেন উশখুশ করছেন মনে হচ্ছে? দশরথ শুরুর প্রশ্ন একটু হালকা চালে ছেড়েছেন :

— ধর্ম কয় রূপ?
মধুসূদন চুপ!

শুনতে পাননি। মেলা গোল ক’রো না, ওহে লোকজন। রিপিট করা হল প্রশ্ন। মধু এবারও নির্বিকার। দশরথের পাতলা লাল ঠোঁটে হাসি বঙ্কিম হল।

— নির্গুণ আত্মজ্ঞান কার আবিষ্কার?
মধুসূদনের পন্ডিতি ভেঙে ছারখার।

—- ও বাবা, কী বোলতিছেন, মানে বুঝি না তো!
যেন শিউলির গলায় নির্মলের সম্বিত। সে তালকাটা হয়ে তাকায় মায়া, তার অনুবাদিকার দিকে।

(চলছে)

1 thought on “শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

  1. যেন শিউলির গলায় নির্মলের সম্বিত।
    সে তালকাটা হয়ে তাকায় মায়া, তার অনুবাদিকার দিকে।

    ___ চলতি পর্বের ফিনিশিং অসাধারণ হয়েছে প্রিয় কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।