বারো
মাঠের নাম রঘুনাথ। রেল কোম্পানির জমি, রঘুনাথ নামের ঝাড়েবংশে একা এক বিহারি গ্যাংম্যান তার কোণে ঝুপড়ি তুলেছিল। সকালে উঠে লোটা হাতে চলে যেত বাতিল কেবিনের কাছে গরুভাগাড়ের দিকে। তারপর প্রান্তরের পাশের ডোবায় ডুবকি লাগিয়ে স্টেশান-লাগোয়া হোটেলে রুটিতরকারি খেয়ে ডিউটিতে। রাতে তার তাঁবুর হারিকেন-আলো অন্ধকারের সমুদ্রে কম্পাসের মতো দেখা যেত কলোনি থেকে। এভাবে চলতে চলতে একদিন সকালে ঝুপড়ির ঝাঁপ ঠেলে আর বেরলো না রঘুনাথ। গরীব মানুষ ঠিক বেড়ালের মতো, মৃত্যুর সমীপবর্তিতা কাউকে টের পেতে দেয় না। অথবা গরীবকে সবাই বেড়াল ভাবে ব’লে তার ক্রমপতন চোখ এড়িয়ে যায়। যাই হোক, গ্রামের মানুষ এক স্থায়ী উত্তরের ঠিকানা হারিয়ে রেলের মাঠটাই লিখে দিয়েছিল বিহারির নামে।
আজ প্রচুর ভিড় জমেছে রঘুনাথে — পাঁচ দিন ব্যাপী অবিরাম সাইকেল চালনা এইমাত্র শুরু হল। এখন থেকে গুনে গুনে একশো কুড়ি ঘন্টা বাবলু গিরি নামে ওই কালো প্যাত্পেতে ছেলেটার মাটির সঙ্গে আড়ি, হাগু-হিসু বন্ধ, দুচোখের পাতা এক করবে না, মাডগার্ডহীন সাইকেলে ব’সেই স্নান সেরে মায়ের হাতে দুটো খেয়ে আবার গোলচক্কর কাটবে ঘাসের ওপর। হ্যাঁ, সেই চন্দ্রকোণা মেদিনীপুর থেকে মা এসেছে ছেলের সঙ্গে। রঘুনাথের এক কোণে ত্রিপল খাটিয়ে পাশেই মাটি খুঁড়ে উনুন সাজিয়েছে।
বাবলুর জামায় পোষা পাখির মতো দুটো এক টাকার নোট গাঁথা। বিকেলে ব্যালান্সের খেলা দেখাবে যখন, পালিত কবুতরের টানে অনেক শালিক-চড়াই-ময়না ওর শরীরে ব’সে ডানা ঝাপটাবে। আর মাইকে মুহুর্মুহু ঘোষণা : কলোনির শ্রী সবুজ বিশ্বাস এইমাত্র বাবলু গিরির খেলা দেখিয়া…, মান্নাপাড়া নিবাসী শ্রীমতি বিলাসী দেবী বাবলু গিরিকে আশীর্বাদ স্বরূপ…, কাশিমপুরের শ্রী অনাদি বসু বাবলু গিরির সাহসিকতায় মুগ্ধ হইয়া…।
খবর না দিয়ে যেমন হঠাৎ ক’রে বাড়িতে অতিথি চলে আসে, বিনোদনও গ্রামের নিরুপায় মেহমান। অঘ্রানের এক ভোরে উঠে শোনা গেল গ্রামে রামযাত্রা এসেছে, আবার মাঘের এক দুপুরে সে সহসা গায়েব। ততদিন অধিকারীসমেত রাম, সীতা, মন্দোদরী, লক্ষণ, শূর্পনখা…নানা ডিজাইনের আটন’টা ছেলেকে ক্লাবঘরের দরজাহীন প্রবেশপথে রঙিন শাড়ি টাঙিয়ে ‘প্রতি বছরের ন্যায়’ রাখার ব্যবস্থা। প্রথম এক মাস তারা দুতিনটে গ্রুপে ভাগ হয়ে গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি অন্নসেবা করবে, খাতির পাবে ফিল্মস্টারের মতো। তখন রাতে অভিনয় হচ্ছে রামায়ণের ছোট ছোট টুকরো, মালা-ডাকে পয়সাও মন্দ না।
কিন্তু যত দিন যায়, গরীব ফতুয়ার পকেটে টান পড়ে, বেস প্রাইস লজ্জাজনক ভাবে নামিয়ে আনলেও জানকীকন্যার স্পঞ্জলাঞ্ছিত বুকে ঘসটানিখাওয়া মালা ডেকে নিতে কোনও আধাবুড়ো উঠে দাঁড়ায় না! আস্তে আস্তে অতিথিসেবা বন্ধ হয়ে ক্লাবঘরেই শিল্পীদের স্বপাক আহার চালু। এই অবস্থায় রামায়ণ ইউএসপি ধরে রাখতে পারছে না বুঝে অধিকারী সামাজিক পালায় সরে আসে। নিমতিতার মতোই কোনও গ্রামের গল্প, পাড়ার দুটো ছেলেমেয়ে ভালোবাসা করেছে — শিবনাথ (ডাকনাম শিবে, ভূমিকায় রাম) আর পার্বতী (অভিনয়ে সীতা)।
ততদিনে শীতের খোলা আকাশের নিচে নেহা-কুয়াশা লেগে অভিনেতাদের নাকে পুরোদস্তুর গোদরেজের তালা। কাজেই, রামযাত্রার দল গ্রাম ছাড়ার পর পাড়ার দাদাবৌদিরা রগুড়ে সন্তুকে পেলেই ধ’রে বসে, সেই সিনটা কর না, মনা। সন্তু কানু মালাকারের নিষ্কর্মা ছেলে, শিস দিয়ে গান, নাটক-থিয়েটার দেখা আর মাঝেমাঝে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া তার সাধারণ গুণাবলী।
— কোন সিন?
সেই যে শিবনাথ পার্বতীকে কানে কানে কী একটা প্রস্তাব দিল, শোনামাত্র নায়িকা উত্তেজনায় থরো-থরো।
সন্তু ওমনি ঘাড় একদিকে বেঁকিয়ে কাঁধে ঝটকা দেয় :
(পার্বতী) : টা টা টা, আমি পাপোটা, আমি পাআপোটা। তুমি আমায় অপোন কথা পোলপে না, শিপেটা! তুমি যডি অপোন করো, আমি সপাইকে পোলে টেপো।
(শিবনাথ) : (গলায় হাসিমাখা প্রশ্রয়) কী পোলপি?
(পার্বতী) : আমি পোলপো, আমি পোলপোও… (সন্তু দুহাতে মুখ ঢেকে পেছন ঘুরে যায়) টাআআ, আমার লট্টা করে!
হা হা ক’রে হাসতে হাসতে নির্মলকে এসে সেই খবর দিচ্ছিল সুধা।
— মামনিদের বাড়িতি ব’সে সন্তুমামা রামযাত্রার নকোল কোত্তিছে। না-না-নারে বলতিছে টা-টা-টা। শোনবা?
মায়া চেঁচায় : ওরে দামড়ি মেয়ে, জ্যাঠারে এসব কোতি হয় নাকি!
নির্মল মজা পায় খুব।
— শোন, আমি যখন খুলনার দৌলতপুর স্কুলে মাস্টেরি করতাম, আমাদের এক বাংলা টিচার ছিল, কমলেশবাবু নাম। খুব নস্যি নিত নাকে, কিন্তু সবাইরে সাবধান করত, খবরদার এই নেশা ক’রো না। কারণটা কী?
“লিয়মিত লাকে লস্য লইলে দোলতোল ল-গুলি ল-বৎ উচ্চারল হয়। যেমল, অরুলববরুলকিরলমালা পরিলত হয় অরুলবরুলকিরলমালা-য়। যদি জিজ্ঞাসা করো, আপোলার ক্যালো এরূপ হয় লা? আমি বলিব, ইহা অভ্যাসের গুল!”
খিলখিল খলখল হাসির ওপর দিয়ে দুটো কুড়ির বনগাঁ লোকাল পাস ক’রে গেল। মায়া জানে, সাত কথার এক উত্তর দেওয়া ভটচাজমশাই আসলে একটি মিচকে শয়তান। স্কুল থেকে ফিরে কাল সে সঞ্জুকে ইংরাজি পড়াতে বসেছিল। মায়ার কানে এল বাবা ছেলেকে বলছে, আমি যে তোমারে এত বোঝাই, তা যে তুমি বোঝ না, তা যে আমি বুঝি, তা কি তুমি বোঝ!
এসব মস্করার মধ্যে ট্রেন থেকে নামা লোকজন আমতলাবাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। তাদের পেছনে এক পরিবার হেঁটে আসে আস্তে, দোনোমনা পায়ে — বৌ আগে, সঙ্গে বছর বারোর ছেলে, কিছু পেছনে তার স্বামী, হাতে ধরা পাঁচ-ছ’বছরের বাচ্চাটা হাঁটছে না, লাফাচ্ছে। সেদিকে চোখ পড়তে মায়া কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে গাঢ় চাপা স্বরে বলে উঠল, সারিছে!
ননীবালাও দেখেছে যা দেখার।
— আজ দু’দিন আমার বাঁ-চোখ নাচা বন্ধ হোতিছে না। তখনই ভাবিছি…।
মায়া একটা হালকা গর্জন ছাড়ল মায়ের দিকে।
— একদম মুখি তালা মেরে থাকো। তোমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কুটুম।
তারপর হাঁক পাড়ল শিউলিকে।
— যা তো মা, বলরামকাকার বাড়িত্থে শিগ্গির এক খুচি চাল নিয়ে আয়। বলবি, সামনের সপ্তায় ফেরত দেব।
তেরো
প্রত্যেক পাড়ায় একটা পাগল, একটা মদখোর থাকে; আর আজন্ম মুখ-খারাপ একজন। এদের অস্পৃশ্যজ্ঞানে এক হাত দূরে রাখবে বাকিরা, কিন্তু সমাজ থেকে সরাতে তো পারবে না। আজ অবিরাম সাইকেলচালনার প্রথম বিকেলে কানাই তফাদারকে দেখা গেল রঘুনাথে। কানাইবুড়োর বয়েস আশি-পঁচাশি, বারাসাত কোর্টে মুহুরির কাজ করত, ভিড়ের মধ্যে কখন সে চাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
— দাদু, তুমি শোনলাম ইশকুলি ভোত্তি হইছ? আ-কার ই-কার শিখিছ নাকি?
— হ্যাঁ
— তালি বলো দেহি, ক-য় আ-কার ল কী হয়?
— কাল
— বেশ। ত-য় আ-কার ল?
— তাল
— এবার কও, ব-য় আ-কার ল কী?
এপাশ-ওপাশ থেকে লোকে খ্যা-খ্যা ক’রে হাসে। চাঁদ থমকে যায়।
— ব-য় আ-কার ল হল তালশাঁস, বুঝিছ? বাড়ি যেয়ে দিদিমারে ক’বা, কানাইদাদু শিকোয় দেছে।
বাসু এসে চাঁদের হাত ধ’রে টেনে নিয়ে যেতে যেতে রাগি গলায় বলে, দাদু, তুমি কিন্তু আমার ভাইটারে খারাপ ক’রে দেচ্ছো।
— বন্নোপরিচয়ে যে শব্দডা নেই, পড়ায় দিলাম। তোদের দেহি ‘ভালো কোল্লি মোন্দো হয় কলিকালের ফলে’!
চোদ্দ
তখন মাইকে ‘অজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে’ বাজছিল, বাবলু আকাশে টুপি ছুঁড়ে দিয়ে সাইকেলে এক পাক ঘুরে নিলে উড়ন্ত টুপি বাজপাখির মতো নেমে আসছে মাথায়। সিটে উপুড় শুয়ে দুহাতে প্যাডেল করছে, যেন চাকার প্রতিটা স্পোক তার কথা শোনে। এবার সুতোয় বাঁধা কুড়িটা ব্লেড গিলে ফেলছে বাবলু, এই দৃশ্যে তার মা প্যাঁচা-সাদা মুখ ঘুরিয়ে আছে উল্টোদিকে। পাঁচ দিন সাইকেল চালাতে চালাতে অর্ধেক হয়ে যাবে ছেলেটা, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যে পায়ের টো-ও মাটি ছোঁবে না, কথা ইজ কথা! ধুঁকে ধুঁকে একশো উনিশ ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট শেষ করার পর হঠাৎ বুনো ঘোড়া হয়ে যাবে সে, হঠাৎ হেলিকপ্টার। শাঁই শাঁই করে দশ-পনেরো পাক দিতে দিতে চোঙামাইকে যেই সময় সমাপ্তির ঘোষণা, মাটিতে নেমেই দড়াম ক’রে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। তখন ছেলেরা জোরসে হাততালি আর মেয়েরা মুখে আঁচল-চাপা। মাইকের গানও পালটে গেছে — সও সাল প্যাহলে, মুঝে তুমসে প্যার থা।
এমনটাই নিয়ম; আগের বছর মছলন্দপুর থেকে বিজু মল্লিক এসেছিল, তার আগের বার গাইঘাটার বিশ্বজিৎ পরামানিক, সবাই লাস্টে জ্ঞান হারায়। এর পরেও দম থাকলে মাঠের এক পাশে যে কবর খোঁড়া হয়েছে, বস্তায় শরীর পুরে তার মধ্যে ঢুকে যায় অবিরাম সাইকেলচালক। চার ঘন্টা মাটিচাপা থাকার পরে যখন তোলা হল, দর্শকেরা মোটামুটি নিশ্চিত — টেঁসে গেছে। পাখার বাতাস, হাতপায়ের তেলো ঘষা এবং ‘সংঘের পক্ষ হইতে একুশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা’র পর সে চোখ খোলে।
সন্ধে হয়ে আসছে, খেলা ভেঙে আবার একঘেয়ে চক্রগতিতে ফিরে গেছে কাঙাল জাদুকর। মাঠে ঘাসের তরোয়ালে শিশিরমুন্ডু বিঁধিয়ে আস্ফালন করছে শীতঋতু। ছড়িয়ে পড়া ভিড়ের মধ্যে টিপুদাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরে শিউলি।
— তারপরে নন্দরাক্ষসের কী হল বললে না তো?
— বলবানে। এখন দোকান খুলতি হবে, বুন্ডি।
— জানো, নন্দু সুন্দরবনেত্থে পালায় একা-একা বাড়ি আসতিছে। আমি স্বপ্নে দ্যাখলাম।
(আরও আছে)
ধারাবাহিক কয়েকটি পর্বই আমি নিয়মিত পড়েছি। আমার কাছে অসামান্য লাগছে।