নতুন একটা সত্যগল্প

অফিসে কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। খেয়াল ছিল না। নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে সবার মাথায় আগুন ধরে আছে। কাল সকালের মধ্যে রিপোর্ট জমা না দিলে, প্রজেক্ট মিস হয়ে যেতে পারে, এমন জরুরী অবস্থা। কোম্পানীর টাকায় নিজেদের ডাল ভাতের ব্যবস্থা হয়; তাই সবাই জান দিয়ে খাটছে যেন প্রজেক্ট কোন ভাবেই মিস না হয়। কাজ শেষ করে দেখি দশটা ওভার। বাসা থেকে ফোন এসেছে কমছে কম পনের বার। আজ যে কপালে কি আছে সেটা চিন্তা ভাবনা না করেই ফোন দিয়ে বললাম, বের হচ্ছি। ওপাশে উদ্বেগ উৎকন্ঠা অভিমান রাগ প্রভৃতি একসাথ ঝরে পড়ছিল। বললাম, বাসায় আসি, সব শুনব, সব বলব। এখন তাড়াতাড়ি বের হই।

বের হয়েই দেখি গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা জনমানব হীন। অফিসের সামনের এই রাস্তা এমনিতেই সুবিধাজনক না। সন্ধ্যার পরে এটা পার হতেই হয় জানমালের রিক্স নিয়া। ট্যাক্সিতে ফোন দিলাম। বলল, পাঁচমিনেটের মধ্যেই আসছি। রাস্তা ফাঁকা আছে। সুতরাং পাঁচ মিনিটেই চলে এল। গাড়িতে উঠেই মনে হল বউকে বলছি সন্দেশ নিয়ে যাব। এমনিতেই কপালে আজ শনি আছি। সন্দেশ নিয়ে গেলে শনির দশা কিছুটা উপশম হয়। ড্রাইভারকে বললাম, প্রিমিয়ামের সামনে দিয়ে যাবে। শনি কপালের পিছে লেগেই আছে। প্রিমিয়াম বন্ধ। মাথার খুলির নিচে নরম মগজে তখন প্রজেক্ট, সন্দেশ, শনি এইসব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বুদবুদের মত করে সেগুলো ঠেলে বের হতে গিয়ে ঠোকর খাচ্ছে। তালগোল পাকাতে পাকাতে কাওরান বাজার এসে সিগনালে আটকা পড়লাম। এই সিগনাল দিনের বেলায় আধা ঘন্টার আগে ছাড়ে না। এত রাতে সারা ঢাকা শহরে গাড়ি ঘোড়া না থাকলেও এখানে কোন অভাব নাই। মিনিমাম পনের মিনিটের ধাক্কা। জ্যামে বসে থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ভাঙচুর করে এগিয়ে যাই। কিন্তু আসে পাশের গাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নাই।

আচমকা ড্রাইভিং সিটে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভার নাই। গাড়ির আশে পাশে তাকিয়ে দেখি কোথাও নাই। মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। এই মুহুর্তে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে নামবে কেন। এখন সিগনাল যদি ছেড়ে দেয়? এবং সিগনাল ছেড়ে দিল। প্যাঁ-ফোঁ করে লালবাতি জ্বালিয়ে গাড়ি গুলো নড়তে শুরু করেছে। আমি ড্রাইভারকে দেখি না। আমাদের গাড়িও দেখি নড়তে শুরু করে। ড্রাইভার ছাড়াই গাড়ি চলছে। ডাইনে বাঁয়ে কেটে, লাইট মেরে, সিগনাল দিয়ে, ব্রেক মেরে মেরে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার ছাড়াও গাড়ি চলে। আজকাল শুনছি নানান দেশে চালক ছাড়া গাড়ি চলে। গুগলের অফিসে নাকি এরকম গাড়ি আছে। এও তো দেখি সেই রকম। কিন্তু ড্রাইভার গেল কই।

ড্রাইভার যে গেল আর ফেরার নাম নাই। গাড়ি চলছে গাড়ির মত করে। ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। কাদের পাল্লায় পড়েছি। হরর কি সাইন্স ফিকশনের কাহিনীর মত আমাকে রিমোট কন্ট্রোলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে নাকি? পান্থপথে এসে সিগনালে পড়লে ভাবলাম নেমে যাই। ও খোদা, দরজা লক করা। আসলেই তো রিমোট কনট্রোল। ভাবলাম শেষ চেষ্টা করা যাক। লাফিয়ে উঠে সামনে ড্রাইভিং সিটে বসতে গেলাম। কে যেন পেছন থেকে টান দিয়ে বসিয়ে দিল। অটো সিট বেল্ট এসে আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। আমার কান্না কাটি করা ছাড়া কোন উপায় রইল না। আমি যে কোন অত্যাধুনিক চক্রের হাতে পড়েছি, সন্দেহ নাই। সম্ভব অসম্ভব সব সম্ভাবনা খতিয়েও কোন কূল কিনারা করতে পারলাম না। এলিয়েনের পাল্লায় পড়েছি না অফিসের প্রজেক্টের রাইভালরা না স্মার্ট কিডন্যাপার না অন্য কিছু – আমার মাথা একেবারে পাগল হয়ে যাবার অবস্থা। মাথার গিলু ফুটে ফুটে ঘাম ঝরতে লাগল। আমাকে কেন কিডন্যাপ করবে, আমার মত ছা-পোষা কেরানীকে কিডন্যাপ করে কার কি লাভ? ফোন হাতে নিয়ে কাকে ফোন দেব ভাবছি। ফোনে কাকে বলা যায়, কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে বলা যায়। আবার ভয় হচ্ছিল, মুখে চড় মেরে আবার ফোন টা না নিয়ে যায়। কিন্তু না, শান্তি মতোই কাঁদ কাঁদতে বউকে বলতে পারলাম। বউ ধমক দিয়ে বলল, আমার এখন রঙবাজির টাইম নাই। বাসায় এস তোমার রঙবাজি দেখাচ্ছি। শেষে মরিয়া হয়ে বললাম, আল্লাহর দোহাই লাগে, আমার কথা শুন, তুমি ফোন রাইখ না। ধরে থাক। প্লিজ। বউয়ের গলা নরম হয়ে এলে বললাম, আজ বাসায় না ফিরলে, আমার বাচ্চাটাকে দেখো। এবার দেখি বউও ফোঁপাতে শুরু করেছে।

সিগনাল ছেড়ে দিলে দূর্বার গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলছে। রাস্তার পাশে এক রিকসাওয়ালা রিকশা দাঁড় করিয়ে চা খাচ্ছিল, রিসকাটাকে ইচ্ছে করেই এমন একটা ধাক্কা দিল রিসকা গিয়ে উলটে পড়ে রইল। রিকসাওয়ালা বুঝে উঠে একটা গালি দেয়ার আগেই গাড়ি পরের সিগনালে। এখানে এসে সিগনালও শুনল না। একটা মাইক্রোকে ধাক্কা দিয়ে ওর ছাল তুলে দিল, আরেকটা প্রাডোর লুকিং গ্লাস ভেঙে বাম্পার ফেলে দিয়ে সে এগিয়ে চলল। টালমাটাল মাতালের কি বদ্ধ উন্মাদের কাজ কারবার।

কিন্তু গাড়ি ঠিকঠাক রাস্তায় যাচ্ছে। আমার বাসার দিকেই। বউকে সে কথা বললাম। সে কিছুটা আশ্বস্ত হল। সে এক টানা দোয়া দরূদ সূরা কালাম সব পড়েই যাচ্ছে। ঘামে আমার সারা শরীর ভিজে গেছে, হাত পায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। গাড়ি কিন্তু ঠিক ঠিক আমার বাসাতেই এল। দারোয়ান গেট খুলতে গিয়ে কি করবে না করবে বুঝতে উঠতে পারছিল না। আমি ইশারা করলাম তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিতে । বাসায় ঢুকলে সিটবেল্ট ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে আমাকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দিল।

আমি গাড়ি থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই গাড়িটা বাতাসে মিলিয়ে গেল। বেচারা দারোয়ানের খুলির নিচে নরম মাথা ঘটনাটা হজম করতে না পেরে ঘুরে পড়ে গেল।

19 thoughts on “নতুন একটা সত্যগল্প

    1. অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা প্রিয় মোকসেদ ভাই।

      মজা পেলে ভাবব গল্পের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. হ্যাঁ মজার জন্যই লিখা।
      আপনারা মজা পেলেই লিখা সার্থক।

  1. রহস্যময় গল্প সবসময়ই আমার কাছে উপভোগের মন্ত্র! এখানেও পেলাম আপনার আঙুলের জাদু!

    শুভেচ্ছা সেই সাথে অনেক ভালবাসা আনু ভাই।

    1. আপনার সুন্দর মন্তব্যে আমিও অনেক আনন্দ পেলাম।

      আপনাকেও শুভেচ্ছা ও ভালবাসা জানাই।

    1. হ্যাঁ স্যার, ঘটনার রহস্য তো আমিও উদ্ঘাটন করতে পারিনি।
      তাই সকলের সাথে শেয়ার করা। সবাই মিলে যদি কোন কূল কিনার করা যায়। কিন্তু দেখি কেউ কিছু বলতে পারছে না।

  2. দীলখুশ মিঞার পক্ষ থেকে লাল গোলাপের শুভেচ্ছা গ্রহন করুন।
    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    হাই হ্যালো।

    আপনি সত্যি করে বলেনতো এটি সত্যি ঘটনা কিনা! মিথ্যা বলুন আমি কীবোর্ড ঠিকমড ছাপতে পাড়চি না

    আপনার ভালো হোক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. আপনাকে জানাই নীল গোলাপের শুভেচ্ছা।
      এই টা আপনে কইতে পারলেন?

      ঘটনা পুরাই সত্য। কোন দুই নম্বরী গল্পের কারবার আমার কাছে নাই। যা কই সত্য কই।

      বিশ্বাস নাই হইলে দেখেন আমি কিন্তু গাড়ীত খালি স্টীয়ারিং এর ছবি তুইলা রাখছি। এর পরও যদি বিশ্বাস না করেন তাইলে আরো ছবি আছে সেগুলোও দেব।

  3. কি ভয়ংকর ব্যাপার স্যাপার! ভৌতিক সব কিছু থেকেই দূরে থাকি, ভীতু টাইপের মানুষ আমি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Shy.gif.gif

    1. সাবধানে থাকবেন সবসময়। যেকোন সময় কিন্তু এই গাড়ী আপনাকেও পাকড়াও করতে পারে।

  4. ঘটনা পুরাই সত্য ! এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই । আনু আনোয়ার ভাই এর ট্যাগ লাইন এ পরিবর্তন আমার চোখ এড়ায় নাই । কিন্তু আমি নিজে এই একই ঘটনার শিকার । তবে আমার সাথে ড্রাইভার এর কথা হয়েছিল । তিনি একজন বিজ্ঞানি । Kepler 22B থেকে এসেছিলেন এক সপ্তাহের জন্য গবেষণা করতে তার গাড়ি সহ । সে এক অদ্ভুত অনুভুতি ।

    1. আপনি আমারে বাঁচাইলেন। অন্তত একজন সাক্ষী তো আছে। kepler 22B এর ব্যপারটা তো আমি জানি। কিন্তু পাব্লিকতো মনে করব আমি গুল ছাড়তাছি। আপনারে সাক্ষী পাইয় ভরসা হইল
      ড্রাইভারের একটা ছবিও পাইছি

  5. চারদিক অন্ধকার হয়ে কাল বৈশাখী তার সাথে বৃষ্টির মাঝে অফিস ফেরত আমি গাড়িতে ঘরে ফিরতে ফিরতে আপনার গল্পটা পড়ছিলাম। পড়া শেষে চমকে সামনে তাকিয়ে দেখে নিলাম আমার গাড়ির ড্রাইভার আছে তো!
    দূর্দান্ত অনুভূতি দিয়েছেন। সত্য গল্পের সিরিজ চাই

    1. আপনার মন্তব্য দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করল আমাকে।
      আর হ্যাঁ গাড়িতে উঠলে ড্রাইভারকে চোখে চোখে রাখবে। বলা যায় না, কখন আবার কি হয়ে যায়!

    1. ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা, স্যার।

      আমার তো জান লিয়া টানাটানি, ভাড়া দিমু কেমনে। আর গাড়ি তো কোন ভাড়া চায় নাই। ভাড়া না চাইয়া নিজেই ভ্যানিস হয়ে গেল।

      পুরা বাংলাদেশ ব্যাংকই দিয়া দিলাম, ইচ্ছামত টাকা ছাপায় নিব।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।