ঝিলমিলঃ গোটা থাকলে ওটা স্কুলের কি উপকারে লাগত?
অমায়িকঃ চুপ! আর কোন প্রশ্ন নয়, নো ফারদার সিলি কোশ্চেন—উত্তর চাই উত্তর। স্যার কি এখেনে ছেলেখেলা করতে এসেছে ? উত্তর না পেলে আমি সবাইকে জেলে পুরব, তাতে যদি উত্তর না পাই পুরে দেব হাজতে। মনে রাখবেন আমার নাম অমায়িক হলেও রেগে গেলে আমি রাক্ষস হয়ে যাই।
ঝিলমিলঃ আপনি আমাকে ধমকাবেন না। আমার সম্মানের ব্যাপারে আপনি রাক্ষসগিরি দেখাতে আসবেন না। আমি তাহলে মহিলা সুরক্ষা আইনে আপনার পেনসন চটকে দেব।
অমায়িকঃ তাই বল—তুমি চক্রান্ত করেই এটা করেছ। আমার বরাবর সন্দেহ হত তুমি যেন কি একটা ভাঙ্গবার চেষ্টা করছ। তবে সেটা যে ওইটা মানে—স্যার, ওটা কি যেন বললেন?
পরিদর্শকঃ এই শেষবারের মত বলছি—হরধনু। বুঝেছেন?
অমায়িকঃ ঊনষাট বছর ছ’মাসে যদি না বুঝি তবে কবে আর বুঝব স্যার?
পরিদর্শকঃ তাহলে বলুন কে ভেঙ্গেছে হরধনু?
অমায়িকঃ আমার এই হিংস্র ষড়যন্ত্রকারী অ্যাসিস্টেন্ট ভেঙ্গেছে স্যার। আপনি চট করে রিপোর্টটা লিখুন আমি ঝট করে দস্তখৎ দিয়ে দিই।
ঝিলমিলঃ (উত্তেজিত) মাইন্ড ইয়োর ওয়ার্ড! আপনি আমাকে যা তা বলছেন আবার মিথ্যা দোষ চাপাচ্ছেন। আমি কিন্তু এসব সহ্য করব না।
অমায়িকঃ আপনার যা বলার কোর্টে বলবেন। স্যার আমি ওর নামে কেস করতে চাই। আপনি কেসটা লিখে নিন।
পরিদর্শকঃ দ্যুৎ! আমি কেন কেস লিখব? আমি লিখি রিপোর্ট।
পরিদর্শকঃ তাহলে আপনার শেষ কথা হল আপনি জানেন না যে কে হরধনু ভেঙ্গেছে?
অমায়িকঃ জানব না কেন? ঐ ম্যাডাম—আরে উনি গেলেন কোথায়? এই যে এদিকে আসুন—এখন বই উলটে কি বিদ্যা জাহির করছেন? থানা থেকে পুলিশ আসছে তৈরী থাকুন।
ঝিলমিলঃ আপনি তৈরী থাকুন। আমি সময়মত রহস্য ফাঁস করে দেব।
পরিদর্শকঃ না, আর পারছি না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
বাবাঃ কি হয়েছে পরিষ্কার করে বলুন না।
অমায়িকঃ একটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল ভেঙ্গে ফেলেছে ভাই।
পরিদর্শকঃ দলিল?
বাবাঃ দলিল কখনও ভাঙ্গে?
অমায়িকঃ সময় খারাপ হলে ঐসব হয়ে যায়।
ঝিলমিলঃ দেখছেন কি রকম অর্থহীন কথা বলে। আবার হয়েছে হেড মাস্টার।
রাজিবুলঃ হয়ত এরও কোন গভীর অর্থ আছে।
ফতিমাঃ বাবা আমি বাড়ী যাব।
বাবাঃ তাহলে আপনি স্বীকার করছেন তো আমার মেয়ে ঐ দলিল ভাঙ্গেনি?
পরিদর্শকঃ উঃ! এবার হয়ত আমিই পাগল হয়ে যাবো। ওরে ভাই, ওটা দলিল নয়।
রাজিবুলঃ উনিও আপনার আসল ভাই নয়।
অমায়িকঃ সব নকল বাবা, সবই নকল। এইরকম পরিপাটি মেয়ের মনে যে এতকূট বিষ আছে তা কে ভাবতে পারে? বলুন না ভাঙ্গার পরে দলিলটা কোথায় সটকালেন?
বাবাঃ মা ফতিমা, এসব কি হচ্ছে বলতো?
কতিমাঃ কি জানি বাবা কি হচ্ছে! আমার খালি বাড়ীর কথা মনে পড়ছে।
বাবাঃ চল মা তোকে বাড়ীতেই নিয়ে যাই (উভয়ের প্রস্থান)
অমায়িকঃ দেখলেন! কি অভদ্র! অনুমতি না নিয়েই চলে গেল। ওদের দেখে না স্যার আমারও বাড়ীর কথা, নলেন গুড়ের কথা মনে ভেসে উঠছে।
পরিদর্শকঃ বাড়ীর কথা?সে তো আমারও মনে পড়ছে। কি কুক্ষণে যে এখানে এলুম!
অমায়িকঃ পুলিশ কেন এখনও আসছে না? ম্যাডাম, একটু দেখুন না ওরা কখন আসবে?
ঝিলমিলঃ আপনার কি লজ্জাও নেই? কি করে বলেন যে আপনি একজন শিক্ষক?
অমায়িকঃ দলিলটা বার করো না। জোড়া লাগাবার চেষ্টা করি সবাই মিলে।
পরিদর্শকঃ আবার বলে দলিল! হরধনু কি করে দলিল হয়?
অমায়িকঃ হরধনু? সে আবার কি?
রাজিবুলঃ হয়ত রামধনুর কাছাকাছি কিছু।
পরিদর্শকঃ কি বললে, কি বললে? রামধনু না কি যেন বললে?
ঝিলমিলঃ রাজিবুল তুমি প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছো। হরধনু হল মহাদেবের দেওয়া একটা ধনুক। যা তিনি দিয়েছিলেন সীতাদেবীর পিতা জনক রাজাকে।
অমায়িকঃ সেকি! জনক রাজা! মহাদেব!
পরিদর্শকঃ আশ্চর্য!
ঝিলমিলঃ তা ভাঙ্গা সাধারণের পক্ষে সম্ভবই নয়। রামচন্দ্র তা ভেঙ্গে সবাইকে অবাক করে দেন।
অমায়িকঃ তাই বলো, রামচন্দ্র ভেঙ্গেছেন। ওর ভাঙ্গা তো ভাঙ্গা নয় তা গড়ার চেয়ে বড়।
রাজিবুলঃ তার মানে? ভাঙ্গা তো ভাঙ্গাই, তার মানে গড়া নয়।
অমায়িকঃ চুপ! একদম চুপ! তুই কালকের ফচকে ছোঁড়া, তুই কি বুঝবি? তুই ভাঙ্গলে বুঝতে পারতিস কত ধানে কত চাল। (ঘুরে) ম্যাডাম, আপনাকে স্যালুট, অভিবাদন—আপনি আমার চিরকালের গর্ব!
ঝিলমিলঃ আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না।
পরিদর্শকঃ ওঃ! আপনি যে ব্যাপারটা জানতেন তা বুঝতে পারিনি।
ঝিলমিলঃ না। ভুলে গিয়েছিলাম। আগে প্রাইমারীতে ইতিহাসে ঐ গল্পটা ছিল। পরে আমার মনে পড়ল।
পরিদর্শকঃ শুনে আমারও প্রাণ জুড়িয়ে গেল। আমি ভেবেছিলুম আপনারা হয়ত উত্তরটা দিতে পারবেন না।
অমায়িকঃ কেন পারবে না? ও এম এ করেছে। আপনাকে বলিনি স্যার, ওর মত গুণী ভারতে কেন বাংলাদেশ বা পাকিস্থানেও আর একটি পাবেন না।
ঝিলমিলঃ সত্যি আপনি পালটি খেতে পারেন বটে!
পরিদর্শকঃ ঊনি আপনাকে কতই না ভুল বুঝেছিলেন।
অমায়িকঃ ভুল বুঝিনি স্যার। আমি ওর স্মৃতিকে উসকে দেবার জন্য –হেঃ হেঃ মানে ওকে দায়ী না করলে ও কি আর উত্তর খুঁজত?
পরিদর্শকঃ আমাকে বলতেই হবে যে এখানে একজন যোগ্য শিক্ষক আর বেশ কিছু ভাল ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।
অমায়িকঃ আর প্রধান শিক্ষক? তার কথা বলবেন না? চলুন, চলো হে সবাই—আমার বাড়ীতে–নলেন গুড়ের পায়েস খেয়ে তারপর বিচার করবে।
পরিদর্শকঃ কি বিচার?
অমায়িকঃ আমি আর পায়েস এর মধ্যে কোনটা বেশী মিষ্টি। (সমবেত অট্টহাসি)
সমাপ্ত
বাসু দেব এর সকল পোস্ট
হরধনু ভঙ্গ ২
পরিদর্শকঃ আপনি বোধহয় এই স্কুলের শিক্ষিকা অথবা কোন ছাত্রের—
ঝিলমিলঃ না, না কোন ছাত্রের নয় স্কুলের—
অমায়িকঃ অন্যতম শিক্ষিকা। বাংলায় বিএ, ভুগোলেও বিএ আবার কিসে যেন একটা এম এ। আমার এই একজন মাত্র হেল্পার স্যার, ভয়ে ভয়ে থাকি কখন ফুস করে চলে যায়।
পরিদর্শকঃ তা আপনার স্কুলে ছাত্র ছাত্রী কত?
অমায়িকঃ তা প্রায় ১২৫ হবে। সবাই ওদিকের ঘরগুলোতে বসে মুখস্থ করছে। আমি এই কয়েকজন উত্তম ছাত্র ছাত্রী নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।
পরিদর্শকঃ মাত্র দু-জন টীচার?
ঝিলমিলঃ ছ’মাস পরে হয়ে যাবে একজন।
অমায়িকঃ তখন আর তোমাকে কে পায়? তুমিই রাজা আবার তুমিইমন্ত্রী। রাজিবুল, একটু এদিকে এসো তো বাবা, ( রাজিবুল আসে) মানে স্যার আপনার আসার কথা শুনে আমার মেয়ে নলেন গুড়ের পায়েস করেছে ওটাই আনতে পাঠাচ্ছি।
পরিদর্শকঃ না, না তার কোন দরকার নেই, রাজিবুল তুমি বসো (রাজিবুল আবার বসে)
অমায়িকঃ হ্যাঁ, স্যার যা বলে তাই করো তবে জীবনে কখনও নখ দিয়ে দাঁত কাটবে না—মনে থাকবে?
ঝিলমিলঃ আপনি একটু খেয়াল করে কথা বার্তা বলুন।
অমায়িকঃ কেন? আ-আমি কি খেয়াল গায়ক যে খেয়াল করব? এটা গুরুচরণ প্রাথমিক বিদ্যালয় এখানে খেয়াল, ঠুংরির দরকার কি? বাই দ্য বাই—স্যার, আপনার এখানে আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো?
পরিদর্শকঃ না, সে এমন কিছু নয়। আচ্ছা অমায়িকবাবু, আমি কি আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারি?
অমায়িকঃ করুন না- করুন করুন। ম্যাডাম, সব ঠিক আছে তো?
ঝিলমিলঃ আছে আছে। (স্বগতঃ নিজের যে ঠিক নেই সেটা কে বলবে!)
পরিদর্শকঃ কি নাম তোমার?
ফতিমাঃ আমার নাম ফতিমা, আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার দেশের নাম ভারত। রাজধানীর নাম দিল্লী। রাজ্যের নাম পশ্চিনবঙ্গ রাজধানীর নাম কলকাতা। জেলার নাম দঃ ২৪ পরগণা আর মহাকুমার নাম ডায়মন্ডহারবার।
পরিদর্শকঃ ওকে, ওকে—তোমার নাম?
উৎপলঃ আমার নাম উৎপল ঘরামী, বাবার নাম বলরাম ঘরামী, গ্রামের নাম চাঁদপুর,পাড়ার নাম চৈতন্যখোলা সাত নম্বর।
পরিদর্শকঃ কেন সাত নম্বর কেন?
উৎপলঃ না –মানে—সবাই সাত নম্বর বলে। ছ নম্বর টা চৈতন্য পোলের ওদিকটায়। পাঁচ নম্বরে এই ইস্কুল।
ঝিলমিলঃ ইস্কুল নয়—স্কুল বল।
অমায়িকঃ বলবে আস্তে আস্তে সব বলবে—এইতো সবে শুরু গো মা!
ঝিলমিলঃ কি? কি যে সব বলে!
পরিদর্শকঃ যাকগে যাকগে—তোমার নাম কি?
হামিদাঃ (দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে) আমার নাম হামিদা। আমিও ক্লাস ফোর।
পরিদর্শকঃ আচ্ছা হামিদা, এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম করতে পারো যার নামের শেষে দা আছে?
হামিদাঃ আমি কি যে কোন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে দাদা বলে সম্বোধন করতে পারি স্যার?
অমায়িকঃ করোনা যতদূর পারবে চেষ্টা করো।
হামিদাঃ নেতাজী দা, ক্ষুদিরাম দা, —
পরিদর্শকঃ থাক, থাক, আর বলতে হবে না। মাষ্টারমশায়, আপনি কি বলতে পারবেন?
অমায়িকঃ আমি যা বলার পরে প্রাইভেটে বলব। এখন যা বলার আমার অ্যাসিস্টেন্ট বলবে।
ঝিলমিলঃ মাস্টার-দা। এ আর এমন কি শক্ত?
পরিদর্শকঃ হামিদা, ব-দ্বীপ কাকে বলে?
হামিদাঃ প্রদীপের মত কিছু একটাকে হয়ত বলে?
পরিদর্শকঃ না, মোটেই তা নয়—ব-দ্বীপ জ্বলে না।
রাজিবুলঃ তাহলে স্যার হয় সলতে নিভে গেছে নতুবা ওতে তেল নেই।
ঝিলমিলঃ এই চুপ! তোমাকে প্রশ্ন করা হয় নি।
রাজিবুলঃ আমাকে কি প্রশ্ন করা হবে না স্যার?
পরিদর্শকঃ (একমনে কাগজ দেখে—হ্যাঁ হবে, করা হবে) ইয়ে বলত প্রশ্ন কবিতা কার লেখা?
রাজিবুলঃ তালগাছ কবিতার কবির লেখা।
অমায়িকঃ হঠাৎ তালগাছ কেমন করে এল?
পরিদর্শকঃ ছেলেটি বুদ্ধিমান, কিন্তু হঠকারী। এবার আমি আসল প্রশ্নটি করব।
অমায়িকঃ তাই বলুন, এবার আসল—এতক্ষন যা হল সবই ওপরওয়ালার ছল।
পরিদর্শকঃ হরধনু কে ভেঙ্গেছে? (উত্তেজিত) বলুন কে ভেঙ্গেছে হরধনু?
অমায়িকঃ (অতি বিস্ময়ে ও আতংকে) অ্যাঁ? ভেঙ্গে দিয়েছে? বল বল কে এই সর্বনাশ করলি? (রাজিবুলের দিকে চেয়ে) তুই, তুই ভেঙ্গেছিস, তুই হচ্ছিস হঠকারী।
মনে রাখিস কথাটা আমি বলিনি স্যার বলেছে। আর ওপরওয়ালা যখন বলেছে তখন তুই হঠকারী না হলেও হঠকারী। বল বাবা, কেন তুই এই শেষ বয়েসে আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিলি?
ঝিলমিলঃ আপনি এত ভেঙ্গে পড়বেন না স্যর? লোকে কি ভাববে?
পরিদর্শকঃ দেখুন, আমাকে ফিরতে হবে। আমার সময় নষ্ট করবেন না। তাড়াতাড়ি জানান কে ভেঙ্গেছে?
রাজিবুলঃ আমি ভাঙ্গিনি স্যার। তবে কেউ না কেউ ভেঙ্গেছে নতুবা ওটা গোটাই থাকত।
(ক্রমশঃ)
হরধনু ভঙ্গ
[গুরুচরণ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে কয়েকজন পড়ুয়া এবং দুইজন শিক্ষক। শিক্ষকরা আলোচনারত।]
অমায়িক পাড়ুইঃ তাহলে বলছেন আমার ছাত্ররা পুরোপুরি প্রস্তুত। মানে আসন্ন সাক্ষাৎকারের মোকাবিলায় ওরা তৈরী।
ঝিলমিল মুখার্জীঃ বললাম তো যা বলার বলেছি এবং যা করার করেছি।
অমায়িকঃ না মানে যদি একটু জোর দিয়ে বলেন তাহলে আমার ভরসাটা জমাট হয়, অর্থাৎ কংক্রীট হয়। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনাকে কি আমি বলেছি আর ছ’মাস পরে আমার রিটায়ারমেন্ট?
ঝিলমিলঃ অসংখ্যবার বলেছেন। এইমাত্র আরো একবার বললেন। যদি কিছু মনে না করেন—শুনতে শুনতে আমি যেন হাঁফিয়ে উঠেছি।
অমায়িকঃ ও! আপনার বয়স কত?
ঝিলমিলঃ এটা আবার কি ধরণের প্রশ্ন? আমার বয়স ২৯।
অমায়িকঃ ঐ কারণে আপনি আমার ব্যাথা, বেদনা, উদ্বেগ, জ্বালা, আতংক কিছুই বুঝতে পারছেন না। আসলে উনত্রিশ বছরে কিছুই বোঝা যায় না। যখন আপনার বয়স হবে উনষাট বছর ছয়মাস তখন, কেবল তখনই আপনি সবকিছু গভীরভাবে। মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করতে পারবেন।
ঝিলমিলঃ ও! আচ্ছা! শুনে আস্বস্ত হলাম যে একদিন আমি পারব। কিন্তু আজ তাহলে কি করব?
( বাইরে থেকে—আসব স্যার?)
অমায়িকঃ হ্যাঁ,হ্যাঁ, এসো, এসো। ( রাজিবুল প্রবেশ করে)
রাজিবুলঃ বসব স্যার?
অমায়িকঃ হ্যাঁ, বসবে বৈকি। বেঞ্চির উপর অবনত হয়ে বস। আর তোমার ওই দাঁতগুলি গোপন করে, মুখটি বন্ধ করে একটু ইতিহাস ভূগোলের চিন্তা কর—এই ম্যাডাম আপনি একটু দেখুন তো ও সব পারে কিনা।
( আসব স্যার? এইবার ফতিমা উঁকি মারে)
ঝিলমিলঃ এসো। ওইখানে বসো কোন গোলমাল করবে না।
এইসময় চীৎকার করে উৎপল নামের এক ছাত্র –
উৎপলঃ দিদিমণি, হামিদা দাঁত নিয়ে নখ কাটছে।
ঝিলমিলঃ চুপ! বলেছি না চীৎকার করবে না? একি হামিদা, তুমি আবার দাঁত দিয়ে নখ কেটেছ?
হামিদাঃ না, ম্যাডাম। ও মিথ্যা করে নালিশ করছে।
অমায়িকঃ না, না, নখ দিয়ে কখনও দাঁত কাটবে না। এতে দাঁতের ময়লা নখে গিয়ে বুকের অসুখ করতে পারে।
ঝিলমিলঃ কি?!
অমায়িকঃ আচ্ছা হামিদা অসুখ কথার মানে কি?
হামিদাঃ ওর মানে জ্বর ডায়েরিয়া নয়ত সর্দি-কাশি, বাতের বেদনা।
ফতিমাঃ তার কোন মানে নেই—আচ্ছা স্যার, অসুখ মানে ব্রণ বা ফোঁড়াও হতে পারে?
অমায়িকঃ চুপ! মুর্খের দল! আমি তোমাদের কাছে কোন অসুখের নাম চাইনি, অসুখ মানে জিজ্ঞাসা করেছি। যে মানে জানে না, সে কিছুই জানে না—আশা করি আমি কি বলতে চাইছি তা তোমরা বুঝতে পারছ?
ফতিমাঃ হ্যাঁ, কিন্তু ফোঁড়া কেন অসুখ হবে না সেটা বুঝতে পারিনি।
রাজিবুলঃ কিন্তু স্যার এমন কি কোন অসুখ হতে পারে যার কোন নাম নেই? আর যার নাম নেই তার থাকা আর না থাকা সমান নয় কি?
ফতিমাঃ তুমি চুপ করো। অসুখ কোন অসুখের নাম নয়, আর ফোঁড়া থাকা আর না থাকা কখনও সমান নয়।
ঝিলমিলঃ তোমার কি হয়েছে ফতিমা? তুমি তখন থেকে ফোঁড়া ফোঁড়া করছ কেন?
রাজিবুলঃ হয়ত ওটাই ওর অসুখ।
ফতিমাঃ হ্যাঁ হয়েছে।সারা পৃথিবীতেই কারও না কারো ফোঁড়া হয়। এই স্কুলের সক্কলের কখনও না কখনও ফোঁড়া হবে। রাজিবুল দেখো তোমারও হবে।
অমায়িকঃ ঝিলমিল,
ঝিলমিলঃ বলুন—
অমায়িকঃ এরা কারা? এরা কি সব আইনস্টাইন না প্লেটো? এরা একটা সামান্য কথা নিয়ে এত মাঞ্জা দিচ্ছে কেন? এত প্যাঁচ কষছে কেন? ও! আমি পাগল হয়ে যাবো, এদিকে ছ’মাস পরেই আমার রিটায়ারমেন্ট—
( বাইরে থেকে এক ভদ্রলোক প্রবেশ করে)
পরিদর্শকঃ এটাই কি গুরুচরণ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়?
অমায়িকঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ এটা ঐ বিদ্যালয়। মানে বিদ্যালয় হিসেবে আদর্শ আর খাঁটি। আপনি নিশ্চয় বিদ্যালয় পরিদর্শক?
পরিদর্শকঃ ঠিক অনুমান করেছেন। আপনি?
ঝিলমিলঃ উনি এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমায়িক মান্না।
পরিদর্শকঃ নমস্কার।
অমায়িকঃ না, না, স্যার কি যে করেন? আমার এই ছমাস আর মাত্র চাকরি আছে –এখন আমি শুধু আপনাকে নমস্কার করতে চাই এক তরফা। আর দেখবেন স্যার রিপোর্টে যেন কিছু গোলমাল না হয়।
পরিদর্শকঃ মানে?
অমায়িকঃ সে আমি পরে বলব। এই তোমরা সব স্যারকে নমস্কার করো।
(সবাই তাই করে) (ক্রমশঃ)
কবি কাকাতুয়া ( একাংক নাটিকা)
একটি মধ্যম আলোকিত কক্ষ। একটি বড় ও একটি ছোট টেবিল। একপাশে ডাঁই করে রাখা কিছু প্লাষ্টিকের চেয়ার। পেছনে কাঠের তিনতাকে কিছু নূতন পুরানো বইপত্র। এক যুবতী চেয়ারে বসে একমনে কিছু পড়ছেন। উপরে একটি ব্যানারে লেখা ধ্রুবতারা কবিতা ক্লাব।
মনোঃ ভেতরে আসতে পারি আজ্ঞে?
যুবতীঃ আসুন।
মনোঃ নমস্কার।
যুবতীঃ নমস্কার।
মনোঃ ধ্রুবতারা ক্লাবের সম্পাদক কি আপনি?
যুবতীঃ তা বলতে পারেন। আমি সম্পাদক মন্ডলীর একজন।
মনোঃ আজ্ঞে! পুনরায় নমস্কার।
যুবতীঃ হুম! এত ঘন ঘন নমস্কার দিচ্ছেন কেন?
মনোঃ আজ্ঞে! একটা ভদ্রতা হিসেবে আর একটা ঐ মন্ডলীর সদস্য হিসেবে মোট দুটো দিলাম।
যুবতীঃ বুঝলাম। কিন্তু উদ্দ্যেশ্য কি সেটা বলুন।
মনোঃ আজ্ঞে! বলব বলেই এসেছি।
যুবতীঃ অত আজ্ঞে আজ্ঞে করছেন কেন বলুন তো?
মনোঃ আজ্ঞে! ওটি হল প্রাচীন বাংলার বাগধারা।
যুবতীঃ কিন্তু আমি তো প্রাচীন নই। তাই কি?
মনোঃ আজ্ঞে না। আপনি মনোহর। পীন পয়োধর।
যুবতীঃ কি! কি! বললেন আপনি?
মনোঃ আজ্ঞে আপনি ভেরোনিকা আর নয়ত মালবিকা।
যুবতীঃ নট দ্যাট! নট দ্যাট! তার আগে যেটা বললেন।
মনোঃ ( একটু চিন্তা করে) আজ্ঞে আগের কথা বড্ড ভুলে যাই। তবে ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নাই।
যুবতীঃ ওঃ! হোপলেস!( চীৎকার) আপনি এবার থামবেন?
মনোঃ আজ্ঞে আপনি বললে থামব নতুবা এগোব।
যুবতীঃ হোয়াট ননসেন্স! এগোবেন মানে?
মনোঃ আজ্ঞে! জীবনের লক্ষ্যের পানে এগিয়ে চলাই মানব ধর্ম।
যুবতীঃ (আশ্বস্ত হয়ে) তাই বলুন! আমি ভাবলাম আপনি আমার দিকে এগোতে চাইছেন।
মনোঃ আজ্ঞে! মধ্যিখানে টেবিল কি করে এগোই!
যুবতীঃ (উত্তেজিত হয়ে) তাই বলুন! টেবিল না থাকলে কি করতেন আপনি? (ড্রয়ার থেকে একটা আপেল কাটা ছুরি বার করে) বলুন কি করতেন?
মনোঃ (দু-পা পিছিয়ে) ম্যাডাম! আপনি কি পাগল?
যুবতীঃ আমি নয়, আপনি পাগল! আর আমি খুব ভাল করে জানি আপনার মত পাগলদের কি করে শায়েস্তা করতে হয়।
মনোঃ পাগল তো নয় ম্যাডাম। আমি একজন কবি।
যুবতীঃ (থমকে গিয়ে) কবি? কি নাম আপনার?
মনোঃ আজ্ঞে! আমার নাম মনোবর। বড় বড় কবিরা আমার বন্ধু।
যুবতীঃ কি নাম আপনার বড় বড় কবি বন্ধুদের? বলুন, চুপকরে থাকবেন না।
মনোঃ এলোমেলো টুম্পা, তারপর ঝুম্পা, তারপর বিক্রমাদিত্য প্রভৃতি।
যুবতীঃ না। কোন চেনা নাম পেলাম না। আপনার কথা একটুও বিশ্বাস করিনা।
মনোঃ আপনার নাম কি ম্যাডাম?
যুবতীঃ কেন? আমার নাম জেনে আপনি কি করবেন?
মনোঃ আজ্ঞে আপনার হাতে আমার রচনারাশি সমর্পন করব।
যুবতীঃ কি রচনা করেন আপনি?
মনোঃ আজ্ঞে! আমি যে কোন গদ্যকে পদ্যে রূপান্তর করতে পারি।
যুবতীঃ বটে! যে কোন গদ্যকে তাই না? বেশ যান ঐ চেয়ারে গিয়ে বসুন।
(আগন্তুক একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে।)
যুবতীঃ যে কোন গদ্যকে আপনি পদ্যতে রুপান্তর করতে পারেন। তাই তো? বেশ। ‘সে কাল এখানে এসেছিল’ এই বাক্যকে পদ্যে রূপান্তরিত করুন।
(আগন্তুক মাথা নীচু করে একটি কাগজে কলম দিয়ে কিছু লিখতে থাকে। এই সময় ফোন বাজে। যুবতী ফোনে কথা বলে)
যুবতীঃ আমি না তোমাদের ব্যাপারগুলো শুধু দেখি। তোমাদের রোজই কত যে কাজ থাকে। এখানে আবার এক উদ্ভট এসে হাজির হয়েছে। হাঃ হাঃ! মজার ব্যাপার। চলে এসো দেখতে পাবে। কতক্ষন? ও আচ্ছা! রাখছি। ( আগন্তুকের দিকে চেয়ে) কি হল আপনার কবিবর? কতক্ষণ লাগাবেন?
মনোঃ আজ্ঞে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শোনাব?
যুবতীঃ হুম! শোনান।
মনোঃ প্রথমে সাধারন রূপ শোনাই। গদ্যরূপ-সে এখানে এসেছিল। সাধারণ পদ্যরূপ হবেঃ ‘এসেছিল হেথা সে।’ গদ্য কবিতায় ওটা হবেঃ ‘তার পায়ের ধূলোয় এদেশ ছিল।’ আমার প্রিয় কবি এলোমেলো টুম্পা স্টাইলে লিখলে এটা হবেঃ ‘হতচ্ছাড়া সেই পা দুটো/ দুয়ার আমার টপকেছিল/ আমার শূন্য আকাশগুলি/ প্রশান্ত কাল মুচড়ে দিল।’ যদি জয় গোস্বামী স্টাইলে লিখি তাহলে ওটা হবেঃ ‘এই তো এইখানে থ্যাবড়ান পদছাপ তার/ তার মানে মুন্ডহীন ধড় একটা / কি যেন এক নামও ছিল।’
যুবতীঃ ( বিস্মিত হয়ে) হুম! পাস মার্কের মত হয়েছে। আচ্ছা কারো স্টাইল ফলো না করে আপনার নিজের স্টাইলে এই গদ্যটা পদ্যে অনুবাদ করুন তো।
মনোঃ আজ্ঞে! গদ্যটা বলুন।
যুবতীঃ ‘রাত ভোর বৃষ্টি হল’ এই হচ্ছে আপনার গদ্য।
মনোঃ ( আবার লেখে। তারপর মুখতুলে বলে) আঁধার চিরে আঁধার ফুড়ে / আকাশ ভেঙে রাত্রিভোর/ জলের চাদর সব ডোবাল/ রাস্তা-নালা এ ঘরদোর।
যুবতীঃ দেখুন আমার আক্রমণাত্মক ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। মানে আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে বাট ওটা এমন কিছু ব্যাপার নয়।
মনোঃ আজ্ঞে! ঐ ভুল বোঝাবুঝির একটা পদ্যরূপ দিয়ে দেব?
যুবতীঃ না, না, না, সেটা দেবার কোন দরকার নেই। প্লীজ! ওটা আপনি করতে যাবেন না। আসুন না আমরা অতীতটাকে টোট্যালি ব্ল্যাকআউট করে বর্তমান নিয়ে আপনাকে আমাকে নিয়ে, বাংলার কবিতা নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবি।
মনোঃ আজ্ঞে! যা বলেছেন! শুধু ঐ টেবিল আর ছুরিটা যদি না থাকত তবে কবিতা এক অন্যধারায় ঝরে পড়তে পারত! হাঃ! হাঃ! হাঃ!
অতঃপর উভয়ে হাসতে হাসতে পরস্পরের দিকে একটু আগিয়ে মঞ্চে স্থির হয়ে যায়।
সমাপ্ত
যেভাবে বহু হল
লেখা জিনিসটা খুব একটা সুবিধার কিছু নয় বলে মনে হচ্ছে। কেননা এতে গা জুড়োবার কোন ব্যাপার নেই। যত উত্তমই লেখো তা বেশীক্ষণ হাতে গরম থাকবে না। আর সর্বদা উত্তম তো সোনার পাথরবাটির মত অসম্ভব ব্যাপার। এ-সবই কিছুক্ষণের আমোদ প্রমোদের মত ব্যাপার।
প্রেমও ঠিক তাই। সবারই মনে হচ্ছে একটা অতি গভীর প্রেম হলেও হতে পারে। কিন্তু এমন মায়ের লাল দেখিনি যার হয়েছে বা হলেও ধরে রাখতে পেরেছে। দুর্দান্ত প্রেমিকদেরও যখন দেখি তাস আর চুল্লুতে সময় কাটাচ্ছে তখন যেন সক্রেটিসের আত্মা আমায় ভর করে–সক্রেটিসের বউ একদিন দেখে সক্রেটিস এক রোয়াকে বসে ছেলে ছোকরাদের জ্ঞান বিতরণ করছে। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বৌদি তখন হাতের কাছে পেল এক আখগাছ সেইটা উৎপাটন করে বসাল সক্রেটিসের পিঠে বেজায় এক ঘা।
ঘটনাক্রমে আখটা গেল তিনটুকরো হয়ে। সক্রেটিস, ঈশ্বর তাকে যেন দীর্ঘজীবী করেন, তখন ছোকরাদের বললেন চোখের সামনেই তোমরা দেখলে এক কিভাবে আন্দোলিত হয়ে বহুর রূপ ধারণ করে–।
ল্যাম্পপোষ্ট
ল্যাম্পপোষ্ট
কতকাল নির্বিকার দাঁড়িয়েই আছে।
কচুবন গেছে, নালাও বুঁজেছে।
গাছ পালা অনেক সাফ হবার পর
এখন ফ্ল্যাটের জানালাও তাকে চিহ্ণিত
বিপদ বলে ডাকে।
সে কি কারো ডাক বোঝে?
মান অপমান?
ইতিহাস-কথকতা, প্রেম?
সে কি শুধু আমাদেরই প্রয়োজন
নাকি সমাধিস্থ প্রজ্ঞা অথবা
আমাদের সকল প্রতীক্ষার
লম্বমান ছবি চিরায়ত!
কত কথা নড়ে গেল
প্রতিজ্ঞা ফানুস হয়ে উড়ে গেল
সরকার , গদী, নদী
আঁকাবাঁকা পথ বদলালো
শুধু ঐ রয়েগেল নির্বিকার।
আসা যাওয়ার পথে অর্থহীন
দেখা হচ্ছে তবু এই তো ব্যাপার।
সেই বাড়ীটা
ঐ স্কুল থেকে আবার ফোন এল। আমি বাড়ীতে আসতে বললাম। ভেবেছিলাম আসবে না। অনেকেই করব বলে করে না, আসবে বলে আসে না। কিন্তু ওরা এসেই পড়ল। আমি দিঘীর পাশে রাস্তা দিয়ে ওদের আসতে দেখলাম। আগেই দুটো চেয়ার পেতে রাখলাম। আমি কমলালেবু আর খেজুর খাচ্ছিলাম। খেজুর খেতে ভালো লাগে কিন্তু দাঁতে যেন জড়িয়ে যায়।
এ-কি তুমি বেলা দশটায় ফল খাচ্ছো?
এর আগে চিনি দিয়ে একটা পাঁউরুটি খেয়েছি।
পাঁউরুটি? বলে দু-জনেই হাসতে থাকে।
রান্নার মেয়েটার শরীর স্বাস্থ্য দিন দিন ভালো হচ্ছে, কিন্তু মেজাজ তিরিক্ষি হচ্ছে। প্রায়ই বলে সে কলকাতায় কাজে যাবে, সেখানে অনেক বেশী মাইনে। অথচ কয়েক মাস আগেই দুশো টাকা বাড়ালাম। অবশ্য যুবতী মেয়ের কাছে দু-শো টাকার দাম খুবই সামান্য। ওকে এখন আবার চা করতে বললেই খ্যাচ খ্যাচ করতে থাকবে।
তোমরা একটু চা বিস্কুট খাও।
ওরা নীরবে হাসে। তার মানে করতে হবে। নীচে নেমে দেখি হেনা রান্নায় ব্যস্ত। আমাকে দেখেই বলল, ঠিক আছে আজ করছি কিন্তু রোজ রোজ এমন করা যাবে না।
এই বয়সে যদি রোজ করতে ভয় পাও তাহলে কবে তুমি করবে? এই বলে আমি নকল বিরক্তি প্রকাশ করি। আমার ধারণা ও যতই হুমকি দিক সহজে কাজ ছাড়বে না।
ধুধ না লাল। বানান ভুল লিখিনি ভাই ও দুধ কে সর্বদা ধুধ বলে। আচ্ছা, ধুধই করো।
ওপরে ওরা বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। তোমাকে অফারটা ভেবে দেখতে বলছি—তুমি যা বলছ আমরা যা বলছি এর মাঝামাঝি একটা রফা করো।
চারিদিকে ফাঁকা মাঠ। মাঠের মধ্যে একটা কবেকার ভাঙ্গা বেড়ার ঘর। স্কুলের ছাদ থেকে ওই ঘরটা দেখা যায়। কাছেই একটা ডোবা। এই জায়গাটা এভাবেই পড়ে আছে দেখি। যদিও এই অঞ্চলের অনেক জায়গায় এখন প্রোমোটারদের থাবা পড়েছে। স্কুলে থাকার অসুবিধা হল। ছাত্রদের ঘরে বড় চেঁচামেচি। আমার একা থাকার অভ্যাস। ভোরে বা দুপূরে ওই জায়গাটা খুব ভালো লাগে। কিন্তু বিকেলের পরেই সব কেমন বিষন্ন হয়ে যায়। কাছাকাছি কোন দোকান পাট নেই। প্রায় দুশো মিটার দূরে পাকা রাস্তা। সেখান থেকে হুস হাস গাড়ি যায় কিন্তু কেউ থামতে চায় না।
এ-দিকে রোজগারের কথাও তো আমায় ভাবতে হবে। চাকরী বাকরীর চেয়ে এই ধরণের টেম্পোরারি কাজে বেশ বৈচিত্র আছে। ওরা আমাকে স্কুলের আবাসিক ইংরাজী শিক্ষক করতে চায়। এই আমার দুর্বল জায়গা। আমার ইংরাজী জ্ঞানের মর্যাদা যখন কেউ দেয় তখন আমি নরম হয়ে পড়ি।আবার ঐ স্কুলে ফেরার এই তো কারণ।
সময়টা নভেম্বরের ২৭ তারিখ হবে বোধহয়। পরীক্ষার পরে ছাত্রাবাস ফাঁকা হয়ে গেল।মনীর নামের এক রাজমিস্ত্রী স্কুলে থাকত। একটা খোলা বারান্দার এক কোণ ঘিরে একটা খাট পেতে তাতে মশারী টাঙ্গিয়ে শুতো। লোকটা রাতে মাল খেত। আমাকেও বোঝাতো যে মাঝে মধ্যে খেলে কোন দোষ নেই। এমন কী রোজ খেলেও শরীরের এবং মনের পক্ষে ভালো। এই তো সে খাচ্ছে তাতে কী তার কোন ক্ষতি হয়েছে? তবে মদ কথাটা শুনতে যেহেতু খারাপ, গাঁজা খাওয়া যেতে পারে। তার কাছে নিজের চাষ করা গাঁজা আছে—ভিটামিনে ভরপূর।
গাঁজা আমি খেয়ে দেখেছি। চিন্তা গভীর হয়, সময় আর দূরত্বজ্ঞানে কিছু গোলমাল হয়, আর ক্ষিদে পায়। সেদিন মনীর বলল ও একসের ভালো ঘন দুধ জ্বাল দিয়ে রেখেছে। আমি যদি গাঁজা খেতে রাজী থাকি যেন সন্ধ্যে সন্ধ্যেতে খেয়ে নি। সে হাফ দুধ আমাকে দেবে। অতবড় স্কুলে সেদিন আমরা দু-জন।
আকারে যত বড়ই হোক খাঁচা হচ্ছে খাঁচা। চারিদিকে গ্রীল কপাট দিয়ে ঘেরা এই স্কুল কেন সন্ধ্যেবেলা আমাদের আত্মা বন্দী করে রাখবে? ঘোৎ ঘোৎ করে মনীর ঘুমোচ্ছে দেখে ওর বালিশের তলা থেকে চাবি বার করে গেটটা খুলে দিলাম। শীত যে কোথায় খুঁজেই পেলাম না। নেশা হয়েছে বটে।কিন্তু মনীরের মত অতটা হয় নি। পুকুরের দিকে তাকিয়ে মনে হল জলের চেয়ে নরম আর সুন্দর কিছুই নেই।
এই ফুরফুরে মেজাজে এখন কি করা যায়?
একা একা স্কুলের ছাদে উঠলাম। মাঠের মধ্যে সেই ভাঙ্গাচোরা বাড়ীটার দিকে তাকিয়ে আমার অদ্ভূত লাগল। আরে! এই সময় কারা যাচ্ছে ওখানে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা বেশ বোঝা যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখলাম ওরা ভগ্নস্তূপের আড়ালে হারিয়ে গেল। মনীরকে ডাকা দরকার।
অনেক কষ্টে মনীরকে ব্যাপারটা বোঝানোর পরে ও আতংকের চোখে আমার দিকে চেয়ে ইঙ্গিতে বারণ করেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। গ্লাসে আর দুধ নেই। বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। যাই দেখি আবার ছাদে ব্যাপারটা কী হচ্ছে।
ঠিক দেখেছি। ওখানে বেশ কয়েকবার টর্চের আলো জ্বলেই আবার নিভে গেল। হঠাৎই আতংকের একটা স্রোত নেমে গেল আমার মেরুদন্ড দিয়ে। বাড়ীটার দিকে লক্ষ্য করতে করতে ছাদের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমি।এই সময় বাতাসের মধ্যে একটা তীব্র চীৎকার ভেসে এল, আরো একবার, আরো একবার। আর তারপর সব চুপ। এই চীৎকার এলো ঐ মাঠের ভাঙ্গাবাড়ী থেকে। ঠিক ওখান থেকেই ওটা এসেছে আমি নিশ্চিত হলাম।
গেটের সামনে ভয়ংকর মূর্তিতে মনীর দাঁড়িয়েছিল। ওর চোখ টকটকে লাল। কেন খুলেছো তুমি গেট? আমি বললাম মনীর ঐ ভাঙ্গাবাড়ীটায় কেউ বিপদে পড়েছে। চীৎকার শুনেছো তুমি? এক ধাক্কায় মনীর আমাকে পেছনে হটিয়ে গেট আটকে দাঁড়িয়ে রইল। খবর্দার! আগে চাবি মারো গেটে।
আরে বাবা! মারছি বলে চাবি বার করে গেটের দিকে গিয়েই আমি দৌড় মারলাম মাঠের দিকে। বাড়ীর কাছা কাছি পৌঁছতে বেশ হাঁফিয়ে গেলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে জায়গাটাকে বোঝার চেষ্টা করলাম। বুনো গাছপালার ঝোপের মধ্যে বেড়া সমেত মুখ থুবড়ে পড়েছিলো বাড়ীটা। তবু মেঝের জায়গাটা এখনও বেশ উঁচু আছে। আরে উঁচু কোথায়—গোটা বাড়ীটা ঠিকই আছে। টিনের দরজা। উপরে অ্যাসবেস্টস। তাহলে দূর থেকে এটাকে ভাঙ্গাবাড়ী মনে হয় কেন? বারান্দায় উঠে টিনের দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলতেই—আমি স্পষ্ট দেখেছি একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছিল ঘরে আর রক্তের মধ্যে ছাপা শাড়ী পরা একটা গলাকাটা মেয়ে গোঙ্গাচ্ছিলো। তারপরে কেউ পেছন থেকে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল—এই পর্যন্ত আমার মনে আছে। আর যতবার আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে এই ছবিগুলো দেখে আমি ঠিক ঠাক কথাই বললাম।
কিন্তু মনীর আর আমাকে দু-জনকেই বলা হল এসব ঘুণাক্ষরে কাউকে না বলতে। কেননা এসব কিছুই আসলে হয় নি সবই নেশার ভুল।
এর অনেক পরে মনীর আমাকে বলেছিল সে গিয়ে আমাকে উদ্ধার না করলে আমার গলাও কাটা হত। ব্যাপারটা ভুতুড়ে না মানবিক সেটা আমাকে একদিন না একদিন সমাধান করতে হবে।