খলিল মাহ্‌মুদ এর সকল পোস্ট

খলিল মাহ্‌মুদ সম্পর্কে

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

স্বপ্নরচিত গল্পনাটক

গত কয়েকদিন ইউটিউবে প্রচুর নাটক দেখেছি। বেশিরভাগই কমেডি ড্রামা, অল্প কিছু ছিল সামাজিক নাটক। নাটক দেখার পর মন জুড়ে আনন্দের রেশ জেগে থাকতো। সেই রেশ এভাবে স্বপ্নেও স্থান করে নিবে, এটা মনে হয় নি কখনো। ইউটিউবের সিকোয়েন্স হিসাবেই হয়ত স্বপ্নের ভিতরে নাটক ঢুকে পড়লো গতরাতে। তবে স্বপ্নের ভিতর রোমান্টিসিজমের পরিবর্তে একটা বেদনাঘন আবহের সৃষ্টি হলো। স্বপ্নের সেই ঘটনাই বলছি এখন।

স্বপ্নের ভিতর দুটো নাটক কিংবা নাটকের গল্প দেখেছি। আমরা জানি, স্বপ্নের স্থায়িত্ব খুব কম। সেই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যেই আমার নাটক দুটো দেখা হয়, অথচ নাটক দুটোর প্রভাব খুব দীর্ঘস্থায়ী এবং মনের মধ্যে তা গভীর ছাপও ফেলেছে।

প্রথম নাটকটা প্রকৃত অর্থে নাটক কিনা তা স্পষ্ট না। একটা গ্রামীণ পরিবেশ; একটা রাস্তার পাশে বাঁশঝাড়ের ছায়া পড়েছে, বাঁশপাতার ফাঁক দিয়ে বিকেলে হালকা আলোর ছিটা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে মধ্যবয়স্ক একজন লোক বসে আছেন- একবার মনে হলো আমার অশীতিপর চাচা, পরক্ষণেই দেখা গেল চাচা নন, অপরিচিত তৃতীয় কোনো ব্যক্তি। আমার চাচা যেভাবে একটা পিঁড়িতে বসে বাঁশের ফলা চাঁছতেন, ঐ লোকটাও ওভাবে বসে হাতে একটা দা কিংবা অন্যকোনো বস্তু নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ওখানে ওভাবে বসে থেকেই আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ বা সিকোয়েলের কাহিনি বর্ণনা করলেন, তারপর পরের দৃশ্যগুলো উন্মুক্ত করে দিলেন, কিংবা গল্পগুলো ব্যাখ্যা করলেন। গল্পটা আমার কিছুই মনে নেই, শুধু এটুকু অনুভব করা যাচ্ছিল- গল্পের শুরুটা খুব অদ্ভুত ও জটিল ছিল। কিন্তু স্বপ্নের ভিতরেই আগের সিকোয়েলগুলোর সাথে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চমৎকার সমাপ্তি টানার অনবদ্য শৈল্পিকতায় আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে গেলাম। এ মুহূর্তে মনে হলো, গল্পের শেষে একজন বেদনাবিধূর দুঃখিনী নারী কোনো এক জনমানবহীন, মরুভূমিপ্রায় প্রান্তরের মাঝখানে ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসে পড়ে গুমরে কাঁদতে থাকবেন। ঘটনার পরিণতি এতই করুণ যে, আমি তৎক্ষণাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। এ নাটক বা গল্পের এভাবেই যবনিকাপাত হয়; কিংবা এরপর হয়ত কিছু ঘটেছিল, কিন্তু আমার স্বপ্নকোষ তা ধরে রাখতে পারে নি। ঘুমের ভিতরে স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে, অথচ আমার ঘুমন্ত মন তখনো বারবারই চমৎকৃত হচ্ছিল লেখকের সুনিপুণ দক্ষতা ও কৌশলে – তিনি যেভাবে গল্প শুরু করে সুন্দর সমাপ্তি টেনেছেন তার জন্য।

পরের নাটক বা গল্পটা আগের নাটকের পরবর্তী সিকোয়েল ছিল না; কিংবা এমনটাও আমি নিশ্চিত না যে, এ নাটকটা আগের নাটক শেষ হবার পর পরই দেখেছি; কিংবা একটার সাথে অন্য নাটকটা ওভারল্যাপ করেছে, ব্যাপারটা তেমনও না। কিন্তু, এ নাটকটার প্রায় পুরোটাই আমার চোখের সামনে ঘটেছে; আবার, কিছু কিছু ঘটনা আমি স্বপ্নের ভিতরেই অনুভব করে পূরণ করে নিয়েছি, অর্থাৎ, কোনো ঘটনার আগের বা পরের অংশ উহ্য থাকলে সেটা আমি নিপাতনে বুঝে নিয়েছি। ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বলি – প্রথম নাটকটা কিংবা এটা, স্বপ্নের ভিতরে আমি কোনো ইউটিউব কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলে দেখি নি। ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে, পাত্রপাত্রীরা স্বপ্নের ভিতরে জীবনযাপন করেছেন, যা আমার কাছে গল্প কিংবা নাটকের মতো মনে হচ্ছে। এমনও হতে পারে, আমি কিছু পাত্রপাত্রীর জীবনপ্রবাহ দেখেছি, যা আমার কাছে গল্প বলে ভ্রম হচ্ছে।

কলেজ অ্যাডমিশনের সময়ে সিনিয়র ভাইয়েরা কলেজের বিভিন্ন ক্লাসরুমের সামনে অ্যাডমিশন টেস্টের সাজেশন পেপার বিক্রি করতেন, যেগুলো ছিল ফটোকপি করা লুজশিট, যা ছিল হাতে লেখা বা স্টেনসিল্ড। আমি নীলক্ষেত থেকে ছাপানো গাইডবই কিনেছিলাম। অ্যাডমিশন টেস্টের ফর্ম ফিল আপ করে জমা দেয়ার পর আমাকে-শহর-চেনানো ইউনুস ভাইকে সাথে নিয়ে সেই সময়ের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কলেজ, অত্যাশ্চর্য প্রতিভাদের কলেজ, ঢাকা কলেজের অলিগলি-করিডোর, বিভিন্ন গ্যালারি (ক্লাসরুম) ও অডিটোরিয়াম ঘুরে দেখছিলাম। সিনিয়র ভাইয়েরা সবাই তাদের নিজ নিজ সাজেশন বিক্রি করার জন্য অস্থির ছিলেন। না কিনলেই পস্তাবো, কারণ, প্রশ্ন কমন না পড়লেই মনে হবে, ইশ্‌শিরে, বড়ো ভাইদের সাজেশন পেপারেই সব কমন প্রশ্ন ছিল! তাই অনেকগুলো সাজেশন পেপার কেনার ইচ্ছে থাকলেও টাকার অভাবে অল্প কয়েকটা কিনেছিলাম।

আমার বড়ো ছেলে যখন বিবিএ, অনার্স থার্ড ইয়ারে, তখন তাকে একদিন বললাম, ‘তোমার রেজাল্টটা ভালো করার চেষ্টা করো, শুধু গানবাজনা কইরা ভার্সিটি পার করলে তো রেজাল্ট খারাপ হবে, বিসিএস দিতে পারবা না।’ ছেলে এ কথা শুনে মুখ ম্লান করে বললো, ‘আমি তো আপনাকে অন্য বাবাদের চাইতে আলাদা ভাবছিলাম।’ আমি অবাক হয়ে এমন কমেন্টের কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে বললো, ‘সবার বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে বিসিএস দেয়ার জন্য অ্যাডভাইস দিয়া দিয়া পাগল করে ফেলে। আপনি কোনোদিন দেন নাই বলে প্রাইড নিতাম। আজ তো আপনিও দিলেন।’ সবাই কি তাহলে ‘স্বতন্ত্রতা’ই পছন্দ করে? আমি অন্য বাবাদের চাইতে ‘স্বতন্ত্র’ হতে পারি নি বলে কিছুটা হলেও বুকে ব্যথা অনুভব করেছিলাম; এবং তার পর থেকে আর কোনোদিন ছেলেকে বিসিএস অফিসার হবার জন্য কোনো প্রেষণা কিংবা অনুপ্রেরণা দিই নি। তার ভবিষ্যত সে নিজে গড়ে নিবে। প্রত্যেকের ভবিষ্যত তার নিজের ‘ভাগ্যরেখা’য় অঙ্কিত, যেটি তাকে নিজ হাতেই কেটে নিতে হয়।

বাজারে ডিফেন্স অ্যাডমিশন গাইড, কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ বা ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন গাইডের মতো বিসিএস পরীক্ষার গাইডও হয়ত থাকবে। ‘হয়ত’ বলছি এ কারণে যে, বিসিএস গাইড আমি কখনো দেখি নি, অথচ গতরাতের শেষ বা দ্বিতীয় স্বপ্নটা ছিল বিসিএস গাইড নিয়ে।

এ স্বপ্নটার পটভূমিও একটা গ্রামীণ জনপদ।
একটা রাস্তার মোড়। দুপুর গড়িয়েছে। গাছগাছালিতে রাস্তার একটা দিক ছাওয়া, অন্যদিকে সূর্যের মৃদু হলুদাভ রোদ বাঁকা হয়ে নেমে আসছে। এখানে অল্প কিছু লোকের জটলা- বাদামওয়ালা, আচারওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালা – এমন ধরনের কিছু দোকানওয়ালা এখানে বেচাকিনি করছেন। আমি এসব দেখছি, কিন্তু কোথায় আমার অবস্থিতি তা জানি না। আমরা টেলিভিশন কিংবা সিনেমা যখন দেখি, পর্দায় গল্প বা ঘটনা চলমান থাকে, আমরা সেই গল্পের ভিতরে থাকি না, আমরা পর্দার বাইরে দর্শক হিসাবে থাকি। স্বপ্নের এ নাটকেও আমার উপস্থিতি এরকম- মানুষের জীবনযাত্রা, চলাচল দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার অবস্থান কোথায় তা দেখতে পাচ্ছি না আমি।

আমার উল্টোদিক থেকে এমন সময় এক জীর্ণশীর্ণ, হালকা গড়নের, সামনে সামান্য কুঁজো হওয়া, সাদা ও ময়লা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, গরীব ধরনের লোক বেশ হকার ছেলেদের মতো হেঁটে আসতে থাকলেন, যার হাতে একগোছা বিসিএস ভর্তি সহায়িকা বই – যদিও বইগুলোর নাম দেখা গেল না, কেউ আমাকে বলেও দেয় নি, তবুও স্বপ্নসুলভ নিয়মে আমি জানলাম, এগুলো বিসিএস ভর্তি পরীক্ষার গাইড। এবং এমন সময়ে আমি বুঝতে পারলাম, আমি একজন শিক্ষিতা ও উচ্চমার্গীয় ভদ্রমহিলার পাশে বায়বীয় অবস্থায় উপস্থিত রয়েছি। যুগপৎ দেখতে পাচ্ছি, আমার দৃষ্টির ডানদিকে তীর্যক কোণ বরাবর খুব নিকটে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন; তার বাদামি রঙের অভিজাত শাড়িটা আমার চোখে দৃশ্যত হচ্ছে। পরের মুহূর্তেই গাইডওয়ালা লোকটি এ মহিলার হাতে একখানা ভর্তিগাইড তুলে দিলেন। মহিলা বইটি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা খুলে তাতে কী যেন লিখতে থাকলেন। আমি আড়চোখে কিংবা অন্তরের চোখে দেখতে পাচ্ছি – তার ঠোঁটে এক রহস্যময় নিষ্ঠুর ক্রূর হাসির অস্ফুট চিকন রেখা ভেসে উঠছে; হ্যাঁ, ঠোঁটখানি একটুখানি বাঁকাও করলেন তিনি। গাইডওয়ালার প্রতি কিছুটা ক্ষোভও হয়ত তার মনে ফুটে উঠছে। তার হাতে গাইডবই তুলে দেয়ায় তিনি আহত বা অপমানিত বোধ করছেন। এসব বইয়ের তার কোনো প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে করলে তিনি নিজেই এখন সেরা বিসিএস গাইড রচনা করতে পারেন। এখানে এই বিপনিচত্বরে এসে দাঁড়ানো মানেই কি বিসিএস গাইড কেনা? কেন তার হাতে মানুষ এসব আবর্জনা তুলে দেয়? তাকে দেখে কি কিছুই বোঝা যায় না? ভদ্রমহিলার অন্তরে অহঙ্কারগুলো আক্রোশে নীরবে ফুঁসতে থাকে। মানুষের কীভাবে এত আস্পর্ধা হয়? কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই মানুষের- গাইডওয়ালার বোঝা উচিত ছিল, তিনি বিসিএস পরীক্ষার্থী নন, বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ বিসিএস অফিসার একজন, যিনি নিজেই অগণিত বিসিএস অফিসারের সুপিরিয়র তত্ত্বাবধায়ক। শুরুতে তিনি গাইডবইয়ের ভিতরের পাতায় কী যেন লিখেছিলেন মনে হয়েছিল; কিন্তু স্বপ্নপট বদলে গেছে; এখন দেখা যাচ্ছে তিনি একটা ফুল’স ক্যাপ সাইজ সাদা কাগজে কবিতার মতো ইংরেজিতে দুটো প্যারাগ্রাফ লিখেছেন- চমৎকার হাতের লেখা, সাদা কাগজের উপরে নীল কালির অক্ষরগুলো শিল্প হয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি কাগজটি কিংবা বিসিএস গাইডটি লোকটার হাতে ফেরত দিলেন। লোকটার গাইড বইটি বিক্রি হলো না; বিমর্ষ মুখে ওটি ফেরত নিয়ে চলে যেতে থাকলেন গাইডওয়ালা। একটু দূরে গিয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। ভদ্রমহিলার দিকে তাকাচ্ছেন তিনি, তার কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ে, চোখদুটো একটু সরু হতে থাকে, সেখানে জমে উঠতে থাকে একগাঁদা জিজ্ঞাসা ও বিস্ময়। কোথায় যেন ভদ্র মহিলাকে দেখেছেন তিনি। হয়ত চিনতে পারবেন তাকে। চেষ্টা করলেই চিনতে পারবেন। তিনি খুব করে তাকে চিনতে চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, তার মনে পড়ছে। এখানে দ্রুত, খুব দ্রুত একটা ফ্ল্যাশব্যাক ঘটতে থাকে।

এই ভদ্রমহিলা তার পরিচিতা। অনেকদিন আগে একবার তাদের দেখা হয়েছিল, ঠিক এখানেই। তারা একসাথে এই জায়গা থেকে বিসিএস ভর্তি গাইড কিনেছিলেন। বিসিএস ভর্তি নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ আলোচনাও হয়েছিল। একদিনের দেখায় কার কতটুকুই বা মনে থাকে? গাইডওয়ালা সেদিনের কথা ভোলেন নি।
লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার ঠোঁটে পান খাওয়ার চিহ্ন। তার গরীব চোখদুটো কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি সম্ভবত মুখ ফুটে বলতে চাইছেন- ‘আরে আরে, আপনি সেই বিসিএস পরীক্ষার্থী মেয়েটা না? আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? সেই যে একবার আমাদের দেখা হয়েছিল?’ তিনি কথাটা বলতে চাইছেন, হয়ত এখনই বলবেন… কিন্তু, শেষ মুহূর্তে তিনি কথাটা আর জিজ্ঞাসা করলেন না। আমার তখনো ঘুম ভাঙে নি, কিন্তু গল্পটা ওখানে ঐ অবস্থায়ই শেষ হয়ে যায়, কিংবা দৃশ্য ওখানে ‘ফ্রিজ’ বা স্থির হয়ে যায়। আমি ঘুমের ভিতর কিংবা স্বপ্নের ভিতরেই বলতে থাকি- অসাধারণ একটা প্লট তো! একজোড়া যুবক-যুবতী, যারা জীবনের কোনো এক পর্যায়ে একসাথে বিসিএস ভর্তি গাইড কিনে, একসাথে স্টাডি করে। মেয়েটা বিসিএস পাশ করে ডাকসাইটে অফিসার হয়ে যায়। উচ্চপদ আর আভিজাত্যের চাপে তার অতীতের দৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, বলা যায়, তার কোনো অতীত থাকে না, পুরোটাই সুবর্ণ বর্তমান। ছেলেটার বিসিএস পরীক্ষার বয়স পেরিয়ে যায়, ভাগ্যচক্রে সে নিঃস্ব হয়ে পড়ে, একসময় নিজেই বিসিএস ভর্তি গাইড ফেরি করে বিক্রি শুরু করে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আমি স্বপ্নের ভিতরই আফসোস করতে থাকি- হায়, এ নাটকটা যদি না থাকতো, এটা নিয়ে কত সুন্দর একটা গল্প লিখতে পারতাম!

ঘুম ভাঙবার পর আমি এ ভেবে অবাক হলাম যে, স্বপ্নে দেখা নাটক বা গল্পটা আদতেই অভিনব। আমি এ যাবত যত নাটক দেখেছি বা গল্প পড়েছি, তা থেকে এর থিম সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউটিউব বা টিভি চ্যানেলে নাটক দেখার প্রতিফলন হিসাবেই হয়ত স্বপ্নের ভিতরেও নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে; তবে স্বপ্নের থিমের সাথে আমার বাস্তব চালচিত্রের কোনো মিল আছে কিনা তা নিয়ে আমি নিজেই সন্দিহান। বিসিএস নিয়ে বড়ো ছেলের সাথে সেই যে বহুদিন আগে একবার আলোচনা হয়েছিল, তারপর আর কোনোদিন সেই আলোচনা আমাদের টেবিলে স্থান পায় নি। ছেলের ভবিষ্যত যথারীতি ছেলের হাতেই ন্যস্ত, সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য। ইতোমধ্যে আমার শেষ গল্পটা লেখার পর মাঝখানে বড়ো একটা বিরতি চলে গেছে। মাথার ভিতর জড়ো হয়েছে আরো অসংখ্য প্লট। গত সন্ধ্যায় নতুন আরেকটা প্লটের কথা ভাবছিলাম, যেটি মনে মনে গুছিয়েও ফেলেছি। আজ আমার সেই গল্পটিই লেখার কথা ছিল। ‘লিরিক’ নামক একটা গল্প লেখা পেন্ডিং রয়েছে অনেকদিন ধরে, যেটি লিখবো বলে ডুলুকে কথা দিয়েছিলাম। গত সন্ধ্যায় যে প্লটটা গুছিয়ে ফেলেছি, ওটা আসলে সেই ‘লিরিক’ গল্পের প্লট। ডুলুকে দেয়া কথা রাখার জন্য হলেও ঐ গল্পটা লেখা হবে, কিন্তু, স্বপ্নের এই অসাধারণ থিমটা যদি ধরে না রাখি, তাহলে অন্য অনেক ব্রিলিয়ান্ট থিমের মতো এটাও একসময় হারিয়ে যেত, তাই স্বপ্নটাকে ধরে রাখার জন্যই স্বপ্নে পাওয়া নাটকের গল্পটা লিখে ফেললাম।

২১ ডিসেম্বর ২০২০

বোঝের কথা

খেয়াল করে শোনো তবে
সেই কথাটা বোঝাই
সেই কথাটা কঠিন না খুব
পানির মতো সোজাই

সেই কথাটা বুঝবে তুমি
বোঝের মানুষ হলে
বোঝের মানুষ সবখানেই
বোঝের কথাই বলে

সেই কথা না বুঝলে তুমি
অন্যকে কী বোঝাবে?
বোঝাবুঝির ঝগড়া হলে
বোঝের কথায় খোঁচাবে

সেই কথাটা বুঝতে হবে
না বুঝলে তা বুঝবে না
বোঝার পরই বুঝবে কেন
বোঝের কথায় দুষবে না

সেই কথাটা বোঝার পরে
বুঝবে তুমি সবকিছু
বোঝের বিষয় বুঝতে মানুষ
ঘুরবে তোমার পিছু পিছু

সেই কথাটা বুঝতে যে চাও
বোঝার মতো জ্ঞান কি আছে?
জ্ঞানের কথা না শিখেই
বুঝতে কী চাও আমার কাছে?

এই কথা নয় যেমন তেমন
সবাই এটা বোঝে না
এই কথাটার মূল্য কত
মূর্খরা তা খোঁজে না

বোঝের কথা বোঝেন যিনি
তিনিই বিরাট বোঝের লোক
অ-বোঝ মানব বোঝের কথায়
গেলেন খালি শুকনা ঢোক

সেই কথাটা বুঝবে কিনা
ব্যাপারটা ঠিক বুঝছি না
বুঝবে না যা, বোঝা তাহা
ঠিক না; বলো – ঠিক কিনা?

সত্যি যদি এই কথাটা
আমার কাছেই বুঝতে চাও
এই কথাটা হাটবাজারে
ঢোল পিটিয়ে ছড়িয়ে দাও

এতক্ষণে বুঝে গেছ
কোন কথাটা বোঝাতে চাই
যা বোঝো তা বলতে যেয়ে
কথার বোঝা আর না বাড়াই

২০ নভেম্বর ২০২০

শামা

শামার সাথে আমি একই কলেজে পড়তাম। এইচএসসি পাশের পর শামা ঢাকা শহরের একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ভাইয়ের বাসায় থাকতে লাগলো, আর আমি ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে গ্রামের কলেজেই রয়ে গেলাম।
শামার গায়ের রঙ জারুল কিংবা মহিমার মতো ফরসা না হলেও ওর চেহারা মিষ্টি ও আকর্ষণীয় ছিল। অন্যদের চাইতে আলাদা এবং স্মার্ট ছিল শামা।
কলেজ লাইফে আমার সাথে শামার আচরণ ছিল স্রেফ ক্লাসমেট বা বন্ধুর মতোই। তবে, আমার দিক থেকে এর চাইতে একটু বেশিই ছিল। ওকে আমার ভালো লাগতো। মাঝে মাঝে ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কয়েকজন ক্লাসমেট ওদের বাসায় যেতাম। ওদের বাড়িতে আমগাছ আর নারকেল গাছ ছিল। শামা আমাকে বলতো গাছ থেকে ডাব পেড়ে দিতে, আমি বাকিদের চেয়ে লম্বা এবং বলিষ্ঠ ছিলাম বলে। আমি ডাব পাড়তাম। অন্য কেউ ডাবের মুখ কেটে দিলে শামা সবার হাতে সেগুলো পৌঁছে দিত; আমার হাতে ডাবটি তুলে দেয়ার সময় ও একটুখানি হাসতো, যেমন করে সবার চোখের দিকে তাকিয়েই হাসতো। আমি মনে মনে চাইতাম, শামা আমার দিকে একটু অন্যভাবে হাসুক, আমার সাথে কথা বলার সময় ওর ভুরুটা একটা সরু হোক, কিংবা চোখদুটো একটু নেচে উঠুক। এসব কখনো হতো না। তবে, ডাব তুলে দেয়ার সময় ওর হাতের আঙুলে আলতো করে একটা ছোঁয়া লাগলে আমি গোপনে, সবার অলক্ষে মৃদু শিহরিত হতাম। এভাবে প্রতিদিনই আমার শিহরিত হতে সাধ হতো।
আমের দিনে আমাকেই গাছ হতে আম পাড়তে বলতো শামা। শামা কাঁচা আম পাটায় ছেঁচে সামান্য চিনি ও ধনেপাতা দিয়ে মাখাতো। খুব ভালো লাগতো। আমরা মজা করে গল্প করতাম আর কাঁচা আমবাঁটা খেতাম। শামা চেয়ারের হাতলে বসে পা দোলাতো, খাটিয়ার কোনায় বসে পায়ের উপর পা তুলে নাচাতো। থুতনিতে আঙুলের ডগা রেখে কথা বলার সময় ও সবচাইতে বেশি আকর্ষণীয়া হয়ে উঠতো। ওর এসব দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। মেয়েদের হাঁটার ভঙ্গি, ঘাড় দোলানো, চুল ওড়ানো, হাত নেড়ে কথা বলা- সবকিছুতেই মাধুর্য মাখানো। এগুলো হলো মেয়েদের কলা বা শিল্প, যাকে আর্ট বলা হয়। এগুলো কোনো মেয়েকে অর্জন করতে হয় না, এগুলো তাদের জন্মজাত প্রাপ্তি। মেয়েদের সব কলাই ছেলেদের ভালো লাগে। যুবকেরা মেয়েদের এসব দেখেই আকৃষ্ট হয় এবং প্রেমে পড়ে। শামা একটা কলাবতী মেয়ে, যার প্রতিটি কলায়ই শিল্পের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ বিদ্যমান।

শামা খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতো। কলেজের ফাংশনে ওর আবৃত্তি শুনে সবাই মুগ্ধ হতো। ওদের বাসায় গেলে ও আবৃত্তি করতো আর অভিনয় করতো সেই সাথে। মাঝে মাঝে ঘাড় কাত করে, কখনো আঙুলে মুদ্রা তুলে সে শব্দগুলো উচ্চারণ করতো; অঙ্গ দুলিয়ে আবৃত্তি করার সময় ওর অঙ্গগুলোতে যেন শব্দগুলো জীবন্ত হয়ে কথা বলে উঠতো।

কলেজে চলে যাওয়ার পর এসব স্মৃতি আমার মনে পড়তো এবং খারাপ লাগতো। আমার খারাপ লাগার আরো কারণ ছিল। গ্রামে থাকা কালে শামার সাথে আলাদা করে ‘বিশেষ কিছু’ নিয়ে কোনো কথা হয় নি কোনোদিন। শহরে যাওয়ার পর সেই শামার সাথে আর কীইবা কথা হতে পারে? কোনোদিন মোবাইলে হয়ত ‘কেমন আছিস? ভালো আছিস?’– বড়োজোর এমন কিছু সৌজন্য বিনিময় চলতে পারে।

যদিও এত এত ক্লাসমেটের মধ্যে আমরা গুটিকতক ক্লাসমেট শামার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, কিন্তু এটা ঠিক, আমার প্রতি ওর একটা আলাদা ‘বিশেষ’ দৃষ্টি থাকবে, আমার প্রত্যাশা কখনো এত উঁচুতে ওঠে নি। ওর চোখে ‘আলাদা’ হয়ে ওঠার মতো তেমন কোনো এক্সট্রা-অর্ডিনারি কোয়ালিটিও ছিল না আমার। সব বন্ধুবান্ধব মিলে ওর সাথে যেটুকু সময় কাটিয়েছি, কারো প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত আমাদের সবার উপর ওর দৃষ্টি সমান মনে হতো।

কিন্তু শামার সাথে যে সময়টুকু কাটিয়েছি, ও দূরে যাবার পর সেই স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝেই মোচড় দিয়ে উঠতে থাকলো। দল বেঁধে ওর বাসায় ছুটে যেয়ে আড্ডা দিব, শামা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলবে, এগুলো দেখতে মন আনচান করতে লাগলো।

মাস তিনেক পর শামার ফোন পেলাম একদিন। খুব উচ্ছল কণ্ঠ শামার। ‘হ্যাঁ, কী রে? ভুলে গেছিস? একদিনও একটা ফোন দিলি না যে?’ ওহ শামা! ওহ শামা! আমার বুকটা বার বার ‘ওহ শামা’ বলে চিৎকার করে উঠলো- তাহলে তুইও আমার কথা ভাবিস? আমার প্রতি তোরও এতটা অভিমান- আমি তোকে ভুলে গেছি! শামা যদ্দিন গ্রামে ছিল, কালেভদ্রে দু-একটা প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া আমাকে কখনো কল করে নি মোবাইলে। আমার মুখচোরা স্বভাব ছাড়াও সহজাত সঙ্কোচের কারণে আমি নিজেও কোনোদিন শামাকে কল করি নি। তাই আমার ঘূণাক্ষরেও এমনটা কখনো মনে হয় নি, আমার ফোনের জন্য শামার কিছুটা ‘অপেক্ষা’ বা ‘আক্ষেপ’ থাকতে পারে।
আমি নিজেকে সংযত করে বলি, ‘তুইও তো একদিনও খবর নিলি না।’
‘আড়ি করিস না। সময় পাইলেই কল দিবি, বুঝছিস?’
শামা অনেক উৎফুল্লভাবে কথা বললো। ঢাকা শহর ওর ভালো লাগছে খুব। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস আরো বেশি ভালো লাগছে। অল্পদিনেই অনেক বন্ধু হয়েছে। এ জায়গাটাতে একটু কষ্ট পাই। আমি যাকে প্রেমিকা হিসাবে চাই, তার আর কোনো বন্ধু থাকতে পারবে না। এটা যে-কোনো প্রেমিকের জন্যই খুব কষ্টকর। আমার প্রতি প্রেমিকার ভালোবাসা জনে জনে ভাগ হয়ে যাক, পৃথিবীতে এতটা উদার কোনো প্রেমিক নেই। কিন্তু নিজেকে ধিক্কার দিতেও কসুর করি না। শামাকে আমি প্রেমিকা ভাবছি কেন? আমি যে তার ক্লাসমেটের চাইতেও অধিক কিছু- শামার পক্ষ থেকে আজও এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি। একপক্ষীয় ভালোবাসায় প্রেমিকের হৃদয় রক্তক্ষরণ ছাড়া আর কিছু পায় না। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকি।


এরপর আমি প্রতিদিনই শামার ফোনের অপেক্ষায় থাকতাম। কখনো নিজ থেকেও ফোন করতে চেয়েছি, কিন্তু করি নি। ও বললো আর অমনি ফোন করে বসবো! কথাটা ও কতখানি মন থেকে বলেছে তা আমি বুঝতে চেয়েছি। নিজ থেকে একটা ফোন করে চটুল হতে চাই নি আমি। হয়ত এটা আমার আদেখলেপনাও ভাবতে পারে শামা। আমি চেয়েছি, আমার প্রতি সত্যিকারেই শামার কোনো টান আছে কিনা সেটা দেখতে। যার সাথে অন্তরঙ্গতা থাকে, সে সময়ে-অসময়ে কল করতে পারে। শামা এতদিনে একদিন মাত্র কল করলো- এতেই বোঝা যায় আমার প্রতি ওর কত ক্ষীণ অনুভূতি কাজ করে।

শামা আর একদিনও ফোন করলো না, কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সে গ্রামে এলো বেড়াতে। বাসায় এসে প্রথম ফোনটা সে আমাকেই দিয়েছে বলে জানালো। এ জিনিসটা আমার আত্মবিশ্বাস ঢের বাড়িয়ে দিল। ‘তোরা কাল সকালে বাসায় আয়, কথা আছে।’ শামা বললো। আবার আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত হই। আত্মবিশ্বাস নামতে থাকে। শামা শুধু আমাকে একাই ওদের বাসায় যেতে বলতে পারতো। ওর সাথে একা বসে নিরিবিলি কথা বলতে অনেক অনেক ভালো লাগতো আমার। আমি জিজ্ঞাসা করতাম, ‘শামা, তুই কি ভালো ছিলি আমাদের ছেড়ে? আমাদের ছেড়ে শহরে থাকতে কষ্ট হয় নি তোর?’ তারপর একসময় ‘আমরা’ থেকে ‘আমি’তে নেমে এসে বলে বসতাম, ‘বল শামা, তোর বুকে হাত রেখে বল, আমার জন্য তোর কি একটুও মন কাঁদে নি?’ নাহ্, এভাবে কোনোদিন বলার মতো সুযোগ হবে না আমার। একান্ত সামনাসামনিও যদি দিনভর বসে থাকি, আমি বড়োজোর বলতে পারবো, ‘একটা কবিতা বল তো!’ কিংবা বলতাম, ‘তুই নাচ শিখলি না কেন রে? তুই নাচলে খুব ভালো লাগতো’।

শামাকে দেখে চমকে গেলাম আমরা সবাই। ও আগের চাইতে সুন্দর হয়েছে অনেক। ভারি মিষ্টি লাগছে ওকে। হাসতে হাসতে কথা বলতে শুরু করলো শামা, ওর কথার তুবড়িও আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। এবং অল্পক্ষণেই শামা আমাদেরকে একটা চমকপ্রদ খবর দিল। বললো, ও একটা নাটকে অভিনয় করার অফার পেয়েছে। নায়িকা হবে সে এবং একজন নামকরা নায়কের বিপরীতে নামকরা পরিচালকের নির্দেশনায়। শীঘ্রই শুটিং হবে।
শামা খুব উচ্ছ্বসিত। অন্যান্য ক্লাসমেটরা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু আমি চুপসে গেলাম। আমার জীবন থেকে শামা চিরতরে হারিয়ে গেল তাহলে! ওর সাথে আমার আর ‘কোনোকিছু’ হবার সম্ভাবনা একেবারেই থাকলো না, বুঝতে পারলাম। আমার আরো বেশি খারাপ লাগতে লাগলো এই ভেবে যে, শামাকে এখন আর আগের মতো পাওয়া যাবে না। নাটকের নায়িকা হলে সে হয়ে যাবে সেলিব্রেটি। ওর চারদিকে তখন এত ভিড় থাকবে যে, তা ভেদ করে ভেতরে ঢোকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি ভাবলাম, আগে তো যাই হোক, টুকিটাকি কথা হতো, এখন হয়ত শামা আমাকে ফোন করার সময়ই পাবে না। কিংবা, পেলেও ও হয়ত নিজের দাম বজায় রাখতে আমার মতো ‘নিঃস্ব’ কারো কাছে ফোন করে সময় নষ্ট করবে না।

কিন্তু আমার ধারণা ভুল হলো। শামা শহরে চলে যাওয়ার পরের দিনই আমাকে কল দিল। খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে শামা। কবে শ্যুটিং হবে, লোকেশন কোথায়, কী কী ড্রেস পরতে হবে, শামা এসব নিয়ে আমার সাথে আলাপ করলো। আলাপ করতে করতেই জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোর খুব ভালো লাগছে না?’
আমি একটু চুপ থাকি। ওর মন বোঝার চেষ্টা করি। ও আবার বলে, ‘বল না, ভালো লাগছে না তোর? আমার খুব ভালো লাগছে।’ আমি সৌজন্য রক্ষা করে বলি, ‘হ্যাঁ, তুই নায়িকা হবি, আমার ভালো লাগবে না তো কার ভালো লাগবে?’ তবে, ‘তোর খুব ভালো লাগছে না’ কথাটা খুব ব্যক্তিগত মনে হওয়ায় আমি আশান্বিত হয়ে উঠি। আমার ভালোলাগাটা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ; নিজের আর্ট বা ক্রিয়েটিভিটি দ্বারা আমাকে খুশি করতে চায় শামা। এটা আমাকে প্রভূত আনন্দ দিতে থাকলো।


একদিন শ্যুটিং শুরু হলো। শ্যুটিং-এর জন্য ওদের কক্সবাজার যেতে হচ্ছে। প্রথম নাটকেই খুব রোমান্টিক কিছু সিকোয়েন্স থাকবে। বাতাসে চুল আর উড়না উড়িয়ে সে সৈকতের পানিতে হাঁটতে থাকবে, উলটো দিক থেকে নায়ক আসবে। আমার কাছে খুব কমন এবং সাদামাটা সিকোয়েন্স মনে হলো। কিন্তু শামা খুব এক্সাইটেড।
টানা একসপ্তাহ ওরা কক্সবাজার রইল। এর মধ্যে মাত্র একবার শামার সাথে আমার কথা হলো। সে অভিভূত এবং এতই অভিভূত যে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।

নাটকটা কোনো টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হলো না, এটা রিলিজ করা হলো ইউটিউবে। আমাকে ফোন করে মাত্র ১৫ সেকেন্ডে এ খবরটা দিয়েই শামা কথা শেষ করে দেয়। বুকে ধড়পড়ানি নিয়ে নাটক দেখতে শুরু করলাম। ৪২ মিনিটের নাটক। ৭ মিনিটের মাথায় শামার আবির্ভাব। আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো, কারণ, শামাকে বাস্তবের চাইতে আরো অনেক বেশি সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া দেখাচ্ছে। ও যত বেশি সুন্দরী হবে, আমার কাছ থেকে তত দ্রুত আরো দূরে চলে যাবে। ও আমার না হয়ে, হয়ে যাবে সকলের। আমি সময় টেনে টেনে সামনে যাচ্ছি। শুধু শামার অংশই দেখছি। নায়কের সাথে চোখাচোখি হলো শামার। খুব নিবিড়ভাবে তাকানোর একটা দৃশ্য। আমার হিংসা শুরু হলো এখান থেকেই। নায়কের চোখ বরাবর খুব গভীর একটা চাহনি ছুঁড়ে দিলে বাস্তবিকই হিংসায় আমি জ্বলে ছারখার হতে থাকলাম। যে-চোখে অসীম মোহ নিয়ে আমার দিকে তাকাবে, সেই চোখ কীভাবে শামা অন্য যুবকের চোখের উপর ফেলে?

অনেক যন্ত্রণা নিয়ে ৪০ মিনিট পর্যন্ত পৌঁছুলাম। স্পষ্টত এর পরের সিকোয়েন্সে যথারীতি মিলন হবে। নায়কের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে নায়িকা। সেই দৃশ্য চলে এলো অবশেষে- শামা সামনে হেঁটে যাচ্ছে। স্লো মোশনে হাঁটছে শামা। এইতো এখন লম্বা কদম ফেলে ধীর কদমে সামনে এগোচ্ছে শামা। এরপর থামলো দুজন – মুখোমুখী দাঁড়িয়ে। মাঝখানে কয়েক ফুটের দূরত্ব। হাত প্রসারিত করে সামান্য ঝুঁকতেই ছবি ফ্রিজ হলো- আর মনে হলো, আমার বুক থেকে বিরাট একটা পাহাড় নেমে পড়লো। শামার শরীর অন্য কেউ জড়িয়ে ধরুক, এ দৃশ্য আমি দেখতে চাই না। কিন্তু যখন আমি ভাবতে থাকলাম- সামনে ঝুঁকে পড়ে নায়কের বুকে শামা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন আমার মন সত্যিই খুব অশান্ত হয়ে উঠলো।

আবার শুরু থেকে শুরু করলাম। সঘন রোমান্সে পরিপূর্ণ একটা নাটক। কথার পৃষ্ঠে কথা; কথাপ্রধান নাটকটা শামার বাচনভঙ্গীতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রেমিকা হিসাবে শামা যে অসামান্য চৌকষ ও বরিষ্ঠা, এ নাটকে সেটা সে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। শামার জায়গায় অন্য কোনো নায়িকা হলে এটা আমার দেখা সেরা নাটক হতো; অথচ এটাকে এখন সবচাইতে কষ্টের আধার মনে হচ্ছে। শামা অমন করে হাসলো কেন? নায়কের মন পাওয়ার জন্য, মান ভাঙানোর জন্য কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! তীব্র ঈর্ষায় আমি পুড়ে যেতে থাকলাম।


নাটকটা খুব নাম করলো ইউটিউবে। কমেন্টে নায়কের প্রশংসা ভূরি ভূরি হলো, সেই তুলনায় নায়িকার প্রশংসা কিছুটা কম বৈকি। কিন্তু দর্শকরা শামাকে খুব পজিটিভলি নিয়েছেন, এবং এ নাটকটা শামার কেরিয়ার গঠনে একটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে, তা নিশ্চিত।
আমার ধারণা ছিল, অতি শীঘ্রই শামা আমাকে কল করবে। আমার মতামত জানতে চাইবে। আমাকে খুব উচ্ছল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোর ভালো লাগছে না?’ আমার একজন প্রিয়‘তমা’ বান্ধবী একজন সেলিব্রেটি, এ এক বিরাট গর্বের বিষয়। এ গর্বে আমার বুক উঁচু হবে। আমার তো খুব ভালো লাগারই কথা। শামা আমার মুখ থেকে সেটা শুনে নিশ্চিত হতে চায়।

কয়েক সপ্তাহ পর একদিন শামার ফোন। খলবলে কণ্ঠেই বললো, ‘কী রে, কিছু বললি না যে! তোর ভালো লাগে নি?’ আমি ওর ফোন পেয়েই গলে যাই।
‘খুব ভালো লেগেছে। অনেক অনেক ভালো লেগেছে নাটকটা।’
‘তাই? সত্যিই? আমাকে কেমন লেগেছে, বল তো?’
‘খুব সুন্দর লেগেছে তোকে?’
‘আচ্ছা বলতো, আমাকে দেখতে কার মতো লাগে?’ শামার এ প্রশ্ন শুনে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। আমি শুধু শামাকেই দেখে থাকি, শুধু শামাকেই দেখি। শামাকে শুধু শামার মতোই দেখতে লাগে। দেখতে কার মতো শামা- এ প্রশ্ন কোনোদিন মনেই আসে নি, তুলনা করবো কীভাবে, কার সাথে?
‘শোন, প্রডিউসার ভাইয়া কী বলে জানিস? বলে, আমি নাকি অবিকল মীনা কুমারী।’

কয়েক মাসের মধ্যে শামার আরো তিনটা নাটক হলো। একদিন খুশিতে খলখল করতে করতে একটা সুখবর জানালো, আগামী ১৭ তারিখে ওর একটা নাটক টিভিতে প্রচারিত হবে। খুব দুর্দান্ত একটা নাটক। আমি যেন আমাদের সব ক্লাসমেটকে খবরটা জানিয়ে দিই। আমাকে বার বার বললো, কেউ যেন নাটকটা মিস না করে।
ইতোমধ্যে শামার একটা সেলিব্রেটি ইমেজ আমাদের ক্লাসমেটদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এলাকার অনেক মানুষ, বিশেষ করে যারা অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করে ইউটিউব দেখে, তাদের মধ্যে ‘দেশের মেয়ে’ হিসাবে একটি বাড়তি জনপ্রিয়তাও সৃষ্টি হয়েছে।
আমার ভালো লাগলো যে, ওর সুখবরটা অন্য বন্ধুদের জানাতে শামা আর কাউকে না, স্বয়ং আমাকে বলেছে। যে কাছের, বা আস্থার, তাকে এ কাজ দেয়া যায়। আবারও আমার আশা জেগে ওঠে।
কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে টিভিতে নাটক প্রচারের খবর বলতে যেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম- অনেকের কাছে ঢের আগেই এ খবর পৌঁছে গেছে। আরো একটা বিষয় জেনে খুব বিস্মিত হলাম, অনেকের সাথেই শামার নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। আমার ধারণা অন্ধ ছিল, শামা একমাত্র আমাকেই মাঝে মাঝে ফোন করে থাকে; আমি একাই ওর নাটকের একনিষ্ঠ বিমুগ্ধ দর্শক, এমনকি নাটকের খবরাখবর প্রচারের মুখপাত্রও আমি একাই।


নাটকে বলতে গেলে অল্প সময়েই শামার নাম ছড়িয়ে পড়লো। ওর সব নাটকই টিভিতে এবং সেই সাথে ইউটিউবেও প্রচারিত হতে লাগলো। একটা নাটকে গানের দৃশ্য ছিল এবং সেই গানে বৃষ্টিতে ভিজে নায়কের হাত ধরাধরিসহ কিছু ঘনিষ্ঠতাও ছিল। এসব দেখে এখন আর আগের মতো কষ্ট লাগে না। আমি মেনে নিয়েছি, আমার জীবনে শামা কোনোদিন আসবার নয়। নিভে যাওয়া মীনা কুমারীর মতো শামাকে সারাজীবন দূর থেকেই দেখে যেতে হবে।
সবচাইতে দারুণ খবরটা এলো পরের বছর। অনেক বড়ো বাজেটের একটা ছায়াছবি হবে এবং শামা সেই সিনেমার নায়িকা নির্বাচিত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, পাঁচটা দেশে শ্যুটিং হবে- থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, সিংগাপুর, শ্রীলংকা, ভারতের সিমলা এবং ইটালিতে হবে একটা বিশেষ এপিসোড। শামা আনন্দ ও উত্তেজনয়া ডগমগ করছে।

এরপর অনেকদিন শামার সাথে যোগাযোগ হয় না। ওর কোনো খবর পাই নি কারো কাছে। নতুন কোনো নাটকও নেই, সে ব্যস্ত সিনেমা নিয়ে। নিজের হীনমন্যতা কাটিয়ে একদিন শামার নাম্বারে কল দিলাম। আমার বুক ঢিভঢিভ করছিল। কল রিসিভ করলো একজন পুরুষ কণ্ঠ। পরিচয় জানতে চাইলে জানালেন তিনি শামা ম্যাডামের পিএস।
‘একটু কথা বলতে চাইছিলাম।’
‘ম্যাডাম এখন রেস্টে আছেন।’
শামা ম্যাডামের হয়ত একান্ত ব্যক্তিগত আরেকটা নাম্বার আছে। সেটা চাইতে পারতাম, কিন্তু তার জবাবে পিএস সাহেবের কোনো অনভিপ্রেত কথা শুনতে হয় আশঙ্কা করে সেটা চাই না। পিএস সাহেবকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, ম্যাডামকে প্লিজ জানাবেন, আমি তার ক্লাসমেট এবং অবশ্যই একজন ফ্যান। ‘জি, অবশ্যই’ বলে পিএস কল রাখলেন।

শামা আর ফোন ব্যাক করলো না। আমি অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন। ওকে আমি পাব না জানি। আমার প্রতি ওর কোনো প্রেম নেই, সেটাও সুস্পষ্ট। তবু, মন খুব চায়, শামা আমাকে কিছুদিন পর পর ফোন করে বলুক, ‘কী রে, ভালো আছিস তুই? খবর কী তোর? আমাকে ভুলে গেছিস কীভাবে, বল তো?’ দেশের এক খ্যাতনামা নায়িকার সাথে আমার পরিচিয় রয়েছে, যিনি আমার বান্ধবী, এ কথা আর দশজনকে বললে তারা আমাকে ভিড় করে ধরবে। কতকিছু জানতে চাইবে! আমার গৌরব আকাশ ছুঁয়ে যাবে। প্রেম না পাওয়া এক প্রেমিকের জন্য এটাই হলো বড়ো সান্ত্বনা।
কোনো কোনো সময়ে মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি লোপ পায়, লজ্জা বা হায়ার অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। আমিও বেহায়ার চূড়ান্ত হয়ে, মনকে প্রবোধ দিতে না পেরে আরেকদিন শামাকে ফোন দিলাম। যথারীতি পিএস সাহেব ফোন ধরলেন। আমার সৌভাগ্য যে, তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। আমার কথা ম্যাডামকে বলেছিলেন, তা বললেন। মনে হলো অপ্রীতিকর একটা কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু বলতে চেয়েও শেষমেষ বললেন না। তবে, তিনি এ দারুণ সংবাদটা দিয়ে শেষ করলেন- ম্যাডামের ছবির রেড কার্পেট প্রিমিয়ার শো হবে পরের মাসের ২৩ তারিখে। এ নিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত আছেন।
তবু আমি অপেক্ষায় ছিলাম, একটা মিনিট বা মুহূর্তের জন্য হলেও শামা ওর এই সাফল্যের দিনে আমাকে ফোন করবে। বলবে, ‘তুই খুশি হোস নি? দেখ, আমি এ দেশের প্রথম হিরোইন, যার ছবির রেড কার্পেট হচ্ছে।’

গত কয়েক বছরে বেশ ক’বার ঢাকা এসেছি। অনেক বার ইচ্ছে করেছে, শামার বাসায় যেয়ে ঘুরে আসি। যাই নি। শামা কখন কোথায় থাকে, দেশে কী বিদেশে! একজন নামজাদা নায়িকার বাসায় যাব, কত মানুষই তো যায়, সবাই কি দেখা পায়? ভেতরে ঢুকতে না পেরে গেট থেকে ফিরে আসবো, নিজেকে অতখানি খাটো ও অপমানিত করতে চাই নি। আরো কত সংকোচ কাজ করেছে মনের ভেতরে!

রেড কার্পেট প্রিমিয়ার শো শেষ হওয়ার কিছুদিন পর আমাদের একজন ক্লাসমেট, যে স্থানীয় এক ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির বড়ো ছেলে, কথাচ্ছলে আমাকে জানিয়েছিল, শামা এত করে বলার পর সে ‘না’ বলতে পারে নাই; ওর পারসোনাল ইনভাইটেশন পেয়ে সে রেড কার্পেট প্রিমিয়ার শো-তে গিয়েছিল। রেড কার্পেট দুর্দান্ত হয়েছে। ছবিটাও অসাধারণ।

আমাদের পুরো জীবনটাই ছোটো-বড়ো অজস্র পরাজয় ও ব্যর্থতার গ্লানিতে ভরপুর। এই গ্লানির ভেতরে ডুবে থাকতে আমাদের না জানি কত বাসনা! অতীত রোমন্থনেই যেন সর্বসুখ। Our sweetest songs are those that tell of saddest thought. আমরা হেরে যাই, ডুবে যাই, আর তার কষ্টের গান গাইতে থাকি জীবন ভর।
আমি ঘুরে দাঁড়াই। নিহত প্রেমের জন্য নিজেকে কুরে কুরে নিঃস্ব করে আমার কী লাভ? কেবল দুঃখের গান গাইতেই এ জীবন নয়, দুঃখ নিংড়ে বের করে আনতে হবে হেমের নির্যাস। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি। আমি নিজেকে সন্ধান করি। বেরিয়ে আসে এক অসাধারণ আবিষ্কার। দেখি, আমার ভেতরে রয়েছে কিছু অমূল্য সম্পদ, আমার সূক্ষ্মতম অনুভূতি, আমার অভিমান, আমার আত্মসম্মানবোধ, যা আমাকে অনেক অনেক দিন পর্যন্ত যেচে শামাকে ফোন করতে দেয় নি। যেচে আমাকে শামার বাসায় নিয়ে যায় নি। আমাকে বলতে দেয় নি, ‘শামা, আমি তোকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, শামা।’ এবং যেদিন সমস্ত আত্মসম্মান বিকিয়ে নিজ থেকে শামাকে ফোন করেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে, ওটা খুব দরকার ছিল। নইলে শামাকেও চিনতে পারতাম না, আর খুঁজে পেতাম না নিজের আবিষ্কারকেও।

১৯ জুলাই ২০২০

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে নিয়ে আরেকটি গল্প

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।
বইটি লেখার পর বহুদিন চলে যায়। হঠাৎ একদিন মনে পড়ে, হায়, যাকে নিয়ে একটা বই লেখা হয়ে গেল, জীবদ্দশায় সেই মেয়েটি জানতেই পারলো না সে একটা ‘জীবন্ত ইতিহাস’! আমার এমন একটা ইচ্ছে মনের ভেতর প্রবলতর হলো- মেয়েটার হাতে বইটা তুলে দিয়ে তাকে চমকে দেব; এতে সে না জানি কত খুশি ও চমৎকৃত হবে, আর তাতে আমিও যে প্রচণ্ড আনন্দ পাব, তা বলাই বাহুল্য।

‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসে মেয়েটির নাম ‘জুঁই’। ওটা একটা গল্প হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই বাস্তব নামটি পালটে দেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে আলাপ হচ্ছিল একদিন আফরোজার সাথে। আফরোজা জোর দিয়ে বলে, বাস্তবেও মেয়েটির নাম ‘জুঁই’ ছিল এবং সে বেগম আয়েশা গার্লস পাইলট হাইস্কুলের ফার্স্ট গার্ল ছিল, ওদের বাড়ি পালামগঞ্জ। আমি ততোধিক জোর দিয়ে বলি যে, মেয়েটা ছিল নারিশা গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী, ওদের বাড়ি মেঘুলা ছিল। আফরোজার সাথে আমার বিতর্ক শেষ পর্যন্ত বিতণ্ডায় পরিণত হয়- সে বলে, তোদের মধ্যে আগে থেকেই জমজমাট প্রেম ছিল। পরে মেয়েটা তোকে ‘রিজেক্ট’ করেছিল। সেই রিজেকশনের রিভেঞ্জ নেয়ার উদ্দেশ্যেই এতদিন পর এই বই লিখেছিস। ক্রোধে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।

উপন্যাসটি লিখেছিলাম ঘটনা ঘটবার প্রায় বিশ বছর পর। যদিও এটাকে ‘ঘটনা’ বলছি, আদতে এটা কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা জাতীয় কোনোকিছু নয়। স্কুলজীবনের শেষ ধাপে গিয়ে, এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সময় ‘অ’র সাথে আমার একটা ‘সম্পর্ক’র মতো সৃষ্টি হয়েছিল; এই ‘সম্পর্ক’ ব্যাপারটা নিয়েও আমার নিজের মনেই অনেক দ্বিধাগ্রস্ততা রয়েছে, অর্থাৎ আমি নিশ্চিত নই আমাদের মধ্যে সত্যিকারেই কোনো ‘সম্পর্ক’র মতো কিছু সৃষ্টি হয়েছিল কিনা। আমি শুধু জানতে পেরেছিলাম, শাহজাহানের কাছ থেকে আমার কবিতার খাতাটা ‘অ’র হাতে পৌঁছুবার পর আমার তারুণ্যমুখর কবিতার প্রতি ওর কিছু মুগ্ধতা জন্মেছিল।

আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহজানের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এই সম্পর্ক সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু ‘অ’-কে এক কপি বই দেয়ার কথা শাহজাহানকে বলতে খুব সঙ্কোচ বোধ হলো। সে কী ভেবে বসে, সেটাই ছিল সঙ্কোচের বড়ো কারণ।

একটা মেয়ের সাথে আপনার পরিচয় হলো, দু-একদিন দেখাসাক্ষাৎ হলো, স্বল্প আলাপ হলো। আপনার সাথে ‘সম্পর্ক’ সৃষ্টি হওয়ার মতো কিছু একটা ঘটে গেলে এ থেকেই তার আভাস পেয়ে যাবেন। ‘অ’ আর আমার মধ্যকার মনের দূরত্ব বা ঘনত্ব বোধগম্যতার অতীত ছিল। ওর সাথে পরিচয় হবার পর পরীক্ষা চলাকালে আর মাত্র একদিন সামনাসামনি দেখা হয়েছিল, কিন্তু কোনো কথা হয় নি; অথচ, এই অল্প সময়ের মাঝখানে সে আমার ব্যাপারে আমার বন্ধুদের সাথে অনেক আলাপ করেছে; সেই আলাপের পরিধি এত ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল যে, এ কথা আমার বন্ধুরা, বিশেষত শাহজাহান যখন আমাকে শোনাতো, মনে হতো ‘অ’ আমার প্রতি অনেক অনেক ‘আগ্রহী’ হয়ে উঠেছে।
আমাদের দুজনের গ্রাম ছিল দু’দিকে; আমাদের পরীক্ষা হয়েছিল ভিন্ন এক গ্রামে – জয়পাড়া। পরীক্ষা শেষে আমরা যার যার গ্রামে চলে গেলাম। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সাথে আমি ওদের গ্রামে গিয়ে পৌঁছুতাম। আরো কাকতালীয় ব্যাপার ছিল এই যে- কেমন করে যেন ‘অ’র সাথে আমার দেখা হয়ে যেত। কিন্তু আমরা কখনো মুখোমুখী হতে পারি নি। হয়ত গ্রামে একটা মেলা হচ্ছে, কিংবা জারিগানের আসর; আমার চোখ চারদিকে ‘অ’-কেই খুঁজতো, এবং হঠাৎ একসময় আবিষ্কার করতাম- জটলার কোনো এক কোনা থেকে অনেক বান্ধবীকে নিয়ে সে এবং তারা একসাথে আমি এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই ওরা একযোগে উধাও হয়ে যেত। কালে আমার অবস্থা এমন হলো, আমি যদি কোনো ভিনগ্রহেও যেয়ে উঠতাম, আমার চোখ চারদিকে শুধু ‘অ’-কেই খুঁজতো।

‘অ’র সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল শিমুলিয়া গ্রামে। আমার আরেক সহপাঠী ফরিদ আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা চইচই করে সারাটাদিন সারাগ্রাম ঘুরে বেড়ালাম। দুপুরে কফিলদের বাড়িতে গিয়ে ভাত খেলাম। বিকালে শুভ আর খায়েরও আমাদের সাথে এসে মিলিত হলো। ওরা সবাই আমার সহপাঠী; সবাই কলকল খলখল করতে করতে হাঁটছিল, কিন্তু আমার মন খুব উস্‌খুশ করছিল- হায়, ‘অ’-কে আজ দেখতে পেলাম না, বা ‘অ’র সাথে আজ দেখাই হলো না! ঠিক এমন সময় একদঙ্গল মেয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। বাতাসে ওদের ওড়না উড়ছিল। বেণির মাথায় গোল করে পাকানো লালফিতার ফুল দুলছিল। আমি ওদের উড়ন্ত ওড়না আর ফুলবেণির এপাশ-ওপাশ দোলখাওয়া দেখছিলাম। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ যে-মেয়েটি মুখে হাসি ছড়িয়ে একঝলক পেছন-ফিরে তাকালো, সে ছিল ‘অ’ এবং আমার হৃদয় বিদীর্ণ করে মুহূর্তেই সে হাস্যচ্ছন্দে সখীদের সাথে বাড়ির আড়ালে হারিয়ে গেল। তারপর শিমুলিয়া গ্রামে আর যাওয়া হয় নি। ‘অ’র অনেক খোঁজ নিয়েছি। কেউ আমাকে জানায় নি ‘অ’ ভালো নেই, ‘অ’ আমাকে অনেক খুঁজেছে, ‘অ’ আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে চক্ষু লাল করেছে। অনেকদিন পার হয়ে গেলে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর যেদিন শাহজাহানের সাথে দেখা হলো, ওকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ মনের উষ্ণতা আর নিগূঢ় ভালোবাসা বিনিময় করলাম, আর বারংবার ওর শরীরে আমার হৃদ্‌স্পন্দন ছড়িয়ে জানতে চাইলাম, শাহজাহান, তুই আমাকে শুধু এটুকু বল- স্বামীর ঘরে গিয়েও, সন্তানের জননী হওয়ার পরও, আমাকে ভেবে ভেবে আজও ‘অ’ চোখের জল ফেলে, যেমন আমি নিজেও স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু ‘অ’-কে খুঁজতে থাকি।

‘অ’-র কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম; কিন্তু শাহজাহানের সাথে আড্ডায় বসলে স্কুলের আম্রবাগানে টগবগে দুপুর নেমে আসে, যেখানে আমরা সহপাঠীরা আজও, অনন্তকাল ধরে আড্ডার আসর গেড়ে বসে আছি, অদূরে কাঁঠালবাগের ছায়ায় মেয়েরা আমাদের দিকে বার বার ফিরে ফিরে চায়, আর মুচকি হাসিতে আমাদের প্রাণ ছিঁড়ে ফালি ফালি করে। আমি কোনোকালেই কোনো আড্ডার মধ্যমণি হতে পারি নি। কফিলের মুখে কথার তুবড়ি ফোটে। খায়েরের গল্পে আড্ডা জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি শুধু শুনি, মনের সাধ মিটিয়ে ওদের আড্ডা উপভোগ করি। ‘অ’র কথা অনেক আগেই ভুলে গিয়েছি। শাহজাহান জম্পেশ গল্প শুরু করে। ও সবার কথা বলে। শাহনাজ ওর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে; পারুল বিয়ে করিয়েছে ছেলেকে; করিম নানা হয়েছে সবার আগে; নয়ন আর শায়লার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত টিকলো না- আহা, কত না মধুর ছিল ওদের প্রেম। আমি অধীর উন্মুখ থাকি- এ বুঝি শাহজাহান ‘অ’র কথাটাও তুলবে। কিন্তু শাহজাহান শেষ পর্যন্ত ওর নিজের প্রেমকাহিনি বলতে শুরু করে। দীর্ঘক্ষণ আবেগ মিশিয়ে গল্প বলার পর সে সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘প্রেমিকা হিসাবে মেয়েরা যত সেরা, বিয়ের পর ততখানিই নিরামিষ, রোমান্সের একফোঁটাও থাকে না, রসকষ সব শুকাইয়া যায়। এটা দাও, ওটা দাও, সেটা নাই কেন? খালি ডিমান্ড আর ডিমান্ড। সারাদিন চেঁচামেচি। শুকনা কাঠ। তক্তা। বুঝলি?’
আমি আর আগ্রহ চেপে রাখতে পারি না। বলি, ‘আচ্ছা, অযুতির কথা বল।’ কথাটা বলেই আমি চমকে উঠি- কী করে হঠাৎ ‘অযুতি’ নামটা মনে পড়ে গেল!
শাহজাহান মাথা উঁচু করে জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকায়।
আমি মুখ মলিন করে হাসি। ও জিজ্ঞাসা করে, ‘অযুতি যেন কোনটা?’
‘আরে ঐ যে, তোদের পাড়ার মেয়ে। সেই মেয়েটা। ঐ যে…’
শাহজাহানের চোখ আরো সরু হলে আমি বলি, ‘অযুতি কি জানে, ওরে নিয়া আমি একটা মস্ত উপন্যাস লিখে ফেলেছি? ‘অন্তরবাসিনী’ যার নাম?’
শাহজাহানের হুঁশ হয়। ও অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। অনর্গল হাসতে হাসতে বলে, ‘আমারে আর হাসাইস নারে পাগল। হাসতে হাসতে আমি মইরা গেলাম। আমারে ধর ধর। আমি হাসতে হাসতে মইরা গেলাম।’ তারপর একটু দম নিয়ে বলে, ‘ব্যবসা বাণিজ্য, জমিজমা নিয়া ও এখন মহাব্যস্ত। ফুইল্যা ডোল হইয়া গেছে। হাঁটলে মনে হয় একটা হাতি হাঁইটা যাইতেছে। মুখ ভইরা খালি পান চিবায়। কথা বলতে গেলে পানের পিক ছুইটা আসে আমাদের শরীরে। বইটই পড়ার কি বেল আছে অযুতির? ও এখন সংসারের পাক্কা গিন্নী।’
আমি একটু বিমর্ষ ও উদাস হয়ে পড়ি। অযুতির উঠতি যৌবনের একটা সুন্দর ছবি এতদিন আমার চোখে ভাসতো। একটা হালকাপাতলা শ্যামলাবর্ণ মেয়ে, যে নেচে নেচে ছোটে, খিল খিল করে হাসে, যার হাসিতে পৃথিবীর বুক ভরে ওঠে, যার চুলের গন্ধে বাতাস মূর্ছা যায়, সে-মেয়ে আজীবন প্রেমিকা হয়েই থাকবে যে-কোনো প্রেমাকাঙ্ক্ষী যুবকের বুকে। তার বয়স বাড়তে পারে না, অগোছালো, ভারী শরীরে নিতম্ব দুলিয়ে যত্রতত্র পানের পিক ফেলা বেরসিকা হৃদয়হীনা হতে পারে না অযুতি।
‘ধূর, কী কস?’ আমি শাহজাহানের কথা অবিশ্বাসের সুরে উড়িয়ে দিতে চাই।
ও স্বর একটু নামিয়ে বলে, ‘কথা মিথ্যা না। একদম গ্যাছে অযুতি। মানুষের টাকাপয়সা মাইরাধইরা এখন একটা টপ ক্রিমিনাল হইয়া গেছে। কবে যে ক্রস ফায়ারে খতম কইরা দেয়, বলা যায় না।’
আমি চমকে উঠি। ‘হায় হায়! একী সর্বনাশ! এতখানি? আমার বিশ্বাস হয় না রে! অসম্ভব!’
শাহজাহান ‘হুহ্’ বলে একটুকরো শব্দ করে, যার অর্থ অত্যন্ত অস্পষ্ট।
অযুতির ব্যাপারে শাহজাহান হয়ত অনেকখানি বাড়িয়েই বলে থাকবে। ওর এই বাড়িয়ে বলার কারণ আমার কাছে গোপন কোনো রহস্য মনে হয় না। অযুতির প্রতি আমার একটা বাড়তি আগ্রহ বা আকর্ষণ সৃষ্টি হোক, যার ফলে একটা অশুভ পরিণতি নেমে আসুক আমার বা অযুতির সংসারে, শাহজাহান নিশ্চয়ই এটা চায় না। এ ছাড়া আর কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। এমনও না যে, অযুতির সাথে স্বয়ং শাহজাহানেরই একটা অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, ও চায় না আমার আকস্মিক অভ্যুদয়ে তাতে ছেদ পড়ুক। ও কখনোই এ ধাঁচের কেউ নয়।
আমার ধারণা যে মিথ্যা নয় তা বুঝতে পেলাম আরেকদিন, যখন শাহজাহানকে বললাম, ‘চল, অযুতিকে একদিন দেখতে যাব। ওর হাতে ‘অন্তরবাসিনী’ না দিয়া আমি শান্তি পাচ্ছি না।’
শাহজাহান খুব শান্ত স্বরেই বললো, ‘তুই যেই অযুতিরে নিয়া উপন্যাস লিখেছিস, আজ তারে দেখলে খুব কষ্ট পাবি। মনে হবে বই লেখাটাই একটা বিরাট অপচয় হইয়া গেছে। ওরে দেখলে ওর দিকে ফিরাও তাকাবি না। মেয়েরা বুইড়া হইলে এমনই হইয়া যায়।’ তারপর আমারে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আমি জানি তোর মনের মধ্যে সেই ১৬ বছরের একজন অযুতি বাস করে। খামাখা একটা সত্যকে কবর দিতে চাস কেন?’ শাহজাহানের শেষ কথাটা আমার কানের কুহরে অজস্রবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো- ‘খামাখা একটা সত্যকে কবর দিতে চাস কেন? খামাখা একটা সত্যকে কবর দিতে চাস কেন?’

আমি এরকম গল্প শুনেছি- প্রেমে ব্যর্থ একজন পুরুষ বয়সের শেষ প্রান্তে গিয়ে বহুকাল আগে হারানো প্রেমিকাকে একনজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। অনেক শ্রম বিসর্জনের পর প্রেমিকার সন্ধান পান। একদিন সেই প্রেমিকার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। প্রেমিকাকে দেখার ইচ্ছে প্রবল হলেও চক্ষুলজ্জার কারণে মুখ ফুটে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেন না। তিনি যৌবন কালের মতো প্রেমিকার বাসার চারপাশে বার কয়েক ঘুরলেন, তারপর সামনের মুদি দোকানের বেঞ্চিতে বসে সময় কাটালেন। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বউঝিরা বের হয়, বয়োবৃদ্ধ মহিলারাও কেউ কেউ এদিকে আসলেন-গেলেন, কিন্তু পুরোনো প্রেমিকার দেখা মেলে না কিছুতেই। বেলা শেষে বিষণ্ণ বদনে ফিরতি পথে রওনা হলেন পুরুষপ্রেমিক। তখন নাতির হাত ধরে কূঁজো হয়ে লাঠিতে ভর করে খুটখুট শব্দে ও-পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তার হারিয়ে যাওয়া বিগতযৌবনা প্রেমিকা, যার সাথে তার চোখাচোখি হলো, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পেলেন না, একদিন তারা উন্মত্ত প্রেমিকপ্রেমিকা ছিলেন- পরস্পরকে না পেয়ে যাদের বুক ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল।

অযুতির চেহারাটা ভারি মিষ্টি। মিষ্টি একটা পাখির মতো সে একডাল থেকে আরেকডালে ছুটে যায়। প্রজাপতির মতো রঙিন ও ঝলমলে ওড়না বাতাসে উড়িয়ে সে দৌড়ে চলে। আমি নেশাগ্রস্তের মতো অযুতির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখ নড়ে না। অযুতি আজও এমনি। আমি কেবলই ভাবতে থাকি।
শাহজাহানকে আর তোয়াক্কা করি না, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি নিজ হাতে অযুতিকে ‘অন্তরবাসিনী’ তুলে দেব। ওর বিস্ময়াভিভূত মুখ দেখে আমিও বিস্মিত হতে চাই- এর চেয়ে বড়ো আনন্দ আর কিছু নেই।
একদিন আফরোজাকে নিয়ে অযুতির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হই। আমার হাতে সুন্দর মোড়কে বাঁধাই করা দুটি ‘অন্তরবাসিনী’। কীজন্য দু’কপি নিচ্ছি, সেটা আমি নিজেও জানি না। হতে পারে- এককপি অযুতির হাতে দেবার পর সে হয়ত দ্বিতীয় কপিটি চাইবে অন্য কাউকে গিফট করার জন্য। তাকে নিয়ে একটা বই লেখা হয়েছে, এ কথা খুব কাছের মানুষকে জানানোয় অনেক গর্ব হবে তার।

আমরা ভেতরে উত্তেজনা। আমার কল্পনাবিলাসী চোখে অযুতি যদিও তার সেই আগের জায়গাটিতেই স্থির রয়েছে, তবু আমি মনকে প্রস্তুত রাখলাম গল্পের প্রেমিকার চাইতেও অপ্রত্যাশিত কিছু মোকাবেলা করার জন্য। আমি জানি না, কেন এই অন্তিম বেলায় আমার এ নেশা হলো অযুতিকে খুঁজে বের করার; অযুতির হাতে এ বইটা তুলে দিলে এর মূল্যই বা কতখানি বাড়বে, তা আমি জানি না; কিংবা অযুতির মুগ্ধতা দেখে আমার যে-তৃপ্তি ঘটবে, সেই তৃপ্তিরই বা কী মূল্য আছে, তাও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু আমি প্রাণপণে চাইছি এ বইটি অযুতির হাতের একটু স্পর্শ পাক। বইটি হাতে নিয়ে অযুতি একবার আমার চোখে তাকিয়ে থাকুক, এক মুহূর্তের জন্য, দেখুক, একবার যে-ভালোবাসার জন্ম হয়, তা শত আগুনে জ্বলতে জ্বলতে অনিঃশেষে অফুরন্ত হয়; অনেক অনেক ভালোবাসার গভীরে তা ঢাকা পড়ে গেলেও কখনো নির্বাপিত হয় না।
আমরা অযুতির বাড়িমুখে যেতে থাকি। টুকিটাকি কথা বলি। চারদিকের প্রকৃতি দেখি। প্রকৃতি বদলে যায়। সবকিছু বদলে যায় প্রতিদিন। মানুষ বদলায়। বদলে যায় মানুষের মন। ২৭ বছর চলে গেছে। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে, অযুতিকে দেখার প্রথম দিন থেকেই আমার মনের নিভৃত একটা কোণে সে গভীর একটা স্থান দখল করে নিয়েছিল। বয়স থমকে থাকে না; যৌবন এবং রূপও চিরস্থায়ী নয়। আমরা বদলে গেছি। অযুতিও আগের অযুতি নেই। আমি এই বর্তমানের অযুতির সামনে গিয়েই দাঁড়াবো। ওর ঝলসে যাওয়া রূপ ভেদ করে অন্তরের কুঠরিতে যে শাশ্বত সৌন্দর্য ফুটে আছে- আমার মন বাড়িয়ে সেই সৌন্দর্যকে ছোঁব।

বাড়িতে যাওয়ার পর অবিকল অযুতির মতো দেখতে দুটো মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমাদের বুঝতে সময় লাগলো না যে এরা দুজন অযুতিরই গর্ভজাত কন্যা। ওদের মিষ্টি হাসিতে ঘর ছেয়ে গেল। কথাবার্তা চলতে চলতেই ওরা সবচাইতে কষ্টের সংবাদটি জানালো, ওদের মা আর বেঁচে নেই, বছর তিনেক হলো মারা গেছেন। সহসাই আমাদের মন বেদনায় ভারী হয়ে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। মেয়ে দুটোর মুখও কালো হতে থাকে।
আরো কিছু সময় পরে আমরা উঠে পড়ি। ওরা দুজন রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় আমাদের। বিদায় নিয়ে পথে যেতে যেতে আমরা বার কয়েক ফিরে তাকাই। হঠাৎ আমি ঘুরে দাঁড়াই। ওরা তখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি এগিয়ে আসি ওদের সামনে। আমার সাইড ব্যাগ খুলি। আসার সময় দুটো টবলারেন চকোলেট কিনেছিলাম অযুতির বাচ্চাদের জন্য, দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। চকোলেট দুটো বের করে ওদের দুজনের হাতে দিই। আমার ‘অন্তরবাসিনী’ অন্তরেই থেকে যায়। ওদের হাতে এ বই দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কেন ইচ্ছে হচ্ছিল না তার কোনো ব্যাখ্যাও নেই আপাতত।
আমি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। আদরের একটা ভাষা আছে। ওদের চোখ ভিজে উঠলো সেই ভাষার স্পর্শে। হয়ত আমারও চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়বে এখনই, তার আগেই উলটো ঘুরে আমি হাঁটতে থাকি। একবার শুনলাম ওরা বলছে- ‘মামা, আবার আসবেন।’ আমি পেছনে না তাকিয়েই হাত নাড়িয়ে ওদের কথার জবাব দিই, তারপর আফরোজাকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকি।


২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮২ বছর বয়সে সুচিত্রা সেন মৃত্যুবরণ করেন। তার আগে ১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। এর পর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে তাঁকে দিল্লী যেতে হবে। তিনি ঘর থেকে মানুষের সামনে বের হন নি এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও গ্রহণ করেন নি। ইন্দ্রাণী, সাগরিকা, বিপাশা, শিল্পী, পথে হলো দেরী, সাড়ে চুয়াত্তর, দেবদাস, চাওয়া পাওয়াসহ অজস্র ছায়াছবিতে অভিনয় করে সুচিত্রা সেন আমাদের হৃদয়ে একটা চিরস্থায়ী রূপ ধারণ করে আছেন। ৮২ বছর বয়সে দেখতে কেমন হয়েছিলেন তিনি, আমরা জানি না। তিনি তাঁর অগণিত ভক্তহৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথা ভেবেই হয়ত জনসাধারণ্যে বেরিয়ে নিজের ক্ষয়ে যাওয়া রূপ আর বুড়িয়ে পড়া যৌবন প্রকাশ করতে চান নি। সাগরিকা বা সাড়েচুয়াত্তরে যেমন দেখেছি সুচিত্রা সেনকে, তিনি আজও তেমনি হাস্যোজ্বল রোমান্টিকতাময়, চিরকাল তেমনি অটুট থাকবেন।

অযুতির সাথে আমার দেখা হলো না। অযুতির সাথে আর দেখা হবেও না কোনোদিন। অযুতি বুড়িয়ে গেছে, পান খেয়ে বিদ্‌ঘুটে করে রাখে মুখ- শাহজাহানের এ কথা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আমি চোখ বুজলেই আজও দেখতে পাই, কবিতার মতো স্নিগ্ধ লাবণ্যময়ী একটা মেয়ে গোধূলির রাঙা আঁধারীতে হাত নেড়ে নেড়ে আমাকে বলছে, আচ্ছা, কীভাবে এত ভালো কবিতা লেখেন, বলুন তো?

৬ এপ্রিল ২০১৯

আকাশযাত্রা

প্রথম পর্ব – অবতারণা

এটা একটা গল্প। মনে মনে এ গল্প বহু আগে লেখা শেষ হয়ে গেছে। এরকম অসংখ্য গল্প মনে মনে লেখা শেষ হয়ে জড়ো হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। সেগুলো খাতায়, ব্লগে বা ফেইসবুকের পাতায় কখনো লেখা হয় নি, কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না। সময় নেই। সময় পেলেই ওগুলো মনে মনে পড়ি। অনেক গল্প মুহূর্তে সৃষ্টি হয়ে একটু পরই হারিয়ে যায়, অর্থাৎ, ওটা কী গল্প কোন গল্প ছিল তা নিজেই ভুলে যাই। ওটার কথা ভাবতে ভাবতে আরো অনেক গল্প লেখা হয়ে যায়, কিন্তু হারানো গল্পটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, এমন থিমের উপর একটা কবিতাও আছে আমার। কবিতার নামটা অবশ্য এখন মনে পড়ছে না।

কিন্তু আপনারা ভাবুন তো, ‘আকাশযাত্রা’ শব্দটি দ্বারা আপনাদের মনে আদৌ কোনো গল্পের চিত্র ফুটে ওঠে কিনা। কিংবা, আপনারা ঠিক কী ধরনের গল্পের কথা কল্পনা করতে পারছেন, তা আমাকে বলুন। আপনাদের চিন্তার সাথে আমার চিন্তাপথের একটা সামঞ্জস্য কিংবা বৈসাদৃশ্য বোঝার জন্যই সবিনয়ে এটা জানতে চাইছি।

পুরোনো গল্পগুলো সচরাচর রাতে শুয়ে পড়ার পর, যখন দৃশ্যমান বস্তুগুলো ধীরে ধীরে চোখের ভেতর ডুবে যেতে থাকে, তখনই উদ্ভাসিত হতে থাকে। একটার পর একটা, উপর্যুপরি গল্পগুলো মগজে ভিড় করে, কিলবিল করে মগজের তন্তুগুলোর ভেতর, কামড়ায়, সুড়সুড়ি দেয়। আমাকে লিখে রাখার জন্য প্রণোদিত করে। কিন্তু, আমি ঘুমোতে চাই। এবং চোখ বন্ধ করি।

বাইরের ঝলমলে আলো থেকে সুমিহি রশ্মিগুলো চাঁদের জোসনার মতো, কিংবা রোদের ঝিকিমিকিতে বাতাসে বাঁকখাওয়া বৃষ্টির ঝাঁকের মতো আমার ছিমছাম অন্ধকার ঘরের জানালা দিয়ে নরম নীরব শব্দে ঢুকে পড়ে এক মনোরম দোদল্যমান আলো-আঁধারীর সৃষ্টি করে। সফেদ মশারি আচ্ছাদিত আমার নির্জীব খাটিয়ার চারপাশটা তখন রাজকীয় পালঙ্কের মতো মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।

গতরাতে শুতে একটু দেরি হলো। গতরাতটা ছিল আমার গজলের রাত। আমার একেকটা রাত, একেকটা সময়, বলা চলে একেকটা সপ্তাহ একেক ধরনের গানের ভেতর প্রবাহিত হয়। গানে আমি সর্বভুক। সব ধরনের গান থেকেই আমি নির্যাস পেতে ভালোবাসি। তবে, রাগপ্রধান গানে আমার অনুরাগ সবচাইতে বেশি। ধীরলয়ে গান বাজতে থাকবে। সুরে সুরে অন্ধকার জীবন্ত হবে; আমার ঘরের শূন্যতা দুলে উঠবে সুরের মূর্ছনায়; আমি জেগে থাকবো, কিংবা ঘুমিয়ে- গানে গানে আমারও সর্বাঙ্গ দুলবে। আমার মনে হবে, আমি বেহেশতখানায় সুখনহরের উপর শুয়ে আছি। সুখে উপচে পড়ছে পৃথিবীর হৃদয়। আমার খুব ভালো লাগে। আমি হারিয়ে যেতে থাকি, জাগরণে, কিংবা স্বপ্নের ভেতরে।

এমন সময় আমার খাটিয়াটি দুলে উঠলো। আমার চোখ মুদে আসছে ঘুমে, কিংবা আবেশে, সুখের আতিশয্যেও হতে পারে। আমি দেখতে পাই, দক্ষিণ দিকের দেয়ালটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে খুলে গেল, যেমন বিরাটকায় ফটকের দরজা দুজন প্রহরী দু’দিকে টেনে খুলে দেয়। আমি খাটিয়ার আরামপ্রদ শয্যায় শুয়ে আছি। খাটিয়াটি ধীরে ধীরে বের হয়ে এলো। ধীরে ধীরে…
ধীরে ধীরে ধীরে…
আকাশে মেঘ নেই। চাঁদ নেই। আছে শুধু অগুনতি তারারা। শহরের সর্বোচ্চ অট্টালিকার ছাদ পেরিয়ে আমার আকাশযান খাটিয়া আমাকে নিয়ে নভোবিহারে উড়ে চলছে। মন্থর গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে।। বাড়ছে। বাতাস কেটে উড়ে যাচ্ছি।
আমি উড়ে যাচ্ছি, উড়ে যাচ্ছি…
শো শো শব্দে বাতাস কেটে, দু’দিকে উচ্ছ্বসিত তরঙ্গ তুলে উড়ে যাচ্ছি…
সুদৃশ্য গ্রামগুলো দেখে আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আকাশের ভেতর ভেসে আছে গ্রামগুলো; গ্রামগুলো বসে আছে ঢেউতোলা নদীর পাড় ধরে। ছুটে চলছে নদী কলকল সঙ্গীতের ছন্দে। গ্রামের মাথা ছাপিয়ে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেবদারু, বটগাছ, এক-মাথা তালগাছ। এগুলো আলোর গাছ। ঝলমল করছে আলোর নানাবাহারের গাছগুলো। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ নানান রঙের আলোয় ভরা গাছের পাতাপল্লব। বনের পর বন। সুঠাম দেহে সটান দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র ঘন গাছের পায়ের ফাঁক গলে বহুদূর আমার দৃষ্টি চলে যায়। ধু-ধু, ধু-ধু দৃষ্টি চলে যায়, শুধু গাছ আর গাছ, গাছের পর গাছ, ঝলমলে আলো গাছ, চোখ-ধাঁধানো স্বপ্নের মতো গাছ।

বন-বনানির উপর দিয়ে আমি খাটিয়ায় ভেসে চললাম। আলোর সমুদ্র থই থই করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে পরীরা। ওরা যখন আমার পাশ দিয়ে উড়ে যায়, ওদের পাখার নরম ঝাপটায় আমার মন আন্দোলিত হয়। এমন সময়, অনেক পরীর মাঝখান থেকে পাখির মতো নেমে এসে আমার পাশে বসলো হেলেনা। হেলেনাকে দেখলাম কত বছর পর তা আমার হিসাবে নেই। কিন্তু ও আমাকে মিষ্টি হেসে বললো- এখানে সময়ের হিসাব রাখে না কেউ। তুমিও সময় ভুলে যাও।

দ্বিতীয় পর্ব – রামালার প্রেম

রামালা স্কুলজীবন থেকেই গানে নাম করেছিল। স্কুলের যে-কোনো কালচারাল ফাংশানে ওর গান ছিল মূল আকর্ষণ। শুধু আমাদের স্কুলেই না, অন্যান্য স্কুলেও ওকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হতো, আর থানা সদরে সম্মিলিত ফাংশনগুলোতে ওর জন্য শুধু আমরা সহপাঠীরা না, আমাদের পুরো স্কুলই গৌরব বোধ করতো।
স্কুল সেকশন পেরিয়ে যখন কলেজে উঠলো রামালা, ওর নামডাক আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। স্থানীয় ক্লাবগুলোতে মাঝে মাঝে শহর থেকে বড়ো শিল্পী এনে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে অবধারিতভাবে রামালার ডাক পড়তো। মজার বিষয় হলো, আমন্ত্রিত শহুরে শিল্পীদের দু-চারটা গানের পরই দর্শক সারি থেকে সমস্বরে ‘রামালা’ ধ্বনি উঠতো। রামালা একবার স্টেজে উঠলে সেদিন অন্য শিল্পীরা ফ্লপ হতো।

সে সময়ে আমরা আজকের মতো ‘সেলিব্রেটি’ শব্দটার সাথে বহুল পরিচিত ছিলাম না, আমরা ‘তুমুল নামডাক’ শব্দটা ব্যবহার করতাম, যার সাথে আজকের ‘সুপার সেলিব্রেটি’ শব্দটাই প্রযোজ্য।

যে-কোনো গানের আসরে রামালা আমাকে সঙ্গে নিত। ওর পাশে আমাকে বসিয়ে গান গাইত। বলাই বাহুল্য, রামালার পাশে বসতে পারা আমার জন্য তুমুল সুখ ও আনন্দের ছিল, ভালো লাগতো খুব, এবং এই ভেবে গর্ব হতো যে রামালার মতো একটা মেয়ের সাথে আমার সখ্য বা ঘনিষ্ঠতা আছে। এ নিয়ে আমার অন্য বন্ধুরা ঠাট্টা-মশকরা কম করতো না; কেউ কেউ গোপনে গোপনে হিংসাও করতো, তা ওদের চোখ ও আচরণ দেখেই বোঝা যেত।


একদিন রামালা ক্লাসে এলো শাড়ি পরে। ছাত্ররা মুগ্ধ হলো, খুব করে রামালার দিকে তাকালো, প্রকাশ্যে বা চোরা চোখে। মেয়েরাও কম তাকালো না ওর দিকে, এবং আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ওর খুব প্রশংসা করলো ওরা। মেয়েদের এরূপ তীর্যক রসালো ঠাট্টাবাক্যে আমি অবাক হলাম। তাহলে কি ওরা জানে, আমি রামালার প্রেমাসক্ত? আশ্চর্য তো! আমার কোনো আচরণে আমি নিজেও টের পাই নি রামালার প্রতি আমার কিছু দুর্বলতা আছে। যতটুকু আছে, তা যে-কোনো ছেলের যে-কোনো মেয়ের প্রতিই আছে। তাহলে? তাহলে রামালাই হয়ত সখীদের সাথে তার প্রেমের কথাটি আলোচনা করে থাকবে।

ক্লাস ছুটি হলে হইচই করে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। আমার বাড়ি উত্তর দিকে, রামালারা দক্ষিণ দিকে যায়। আমি হই-হুল্লোড়ের ভিড়ে বন্ধুদের সাথে গলাগলি করে, হেলেদুলে হাঁটছি। হঠাৎ পেছন হতে লম্বা স্বরে ‘সোনারু’ বলে দুটো ডাক শোনা গেলে আমি ঘুরে তাকাই, দেখি রামালা হাত উঁচু করে ডাকতে ডাকতে আমার দিকে ছুটে আসছে। বাতাসে ওর ক’গোছা চুল মাথার দু’পাশে দুলছে। হাসিমুখে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি অবাক হই না, কারণ, রামালা আমাকে এভাবেই হঠাৎ হঠাৎ ডেকে থাকে; অবাক হলো না আমার সহপাঠীরাও; ওরা এরকম প্রায়শ দেখে থাকে, তাই ওরা যথারীতি দু’পাশে সরে গিয়ে গালিচা-অভ্যর্থনার পথের মতো মাঝখানে রামালার আসার পথ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আমার হাত ধরে রামালা বললো, ‘যাবি? যাবি না? চল যাই।’ বলেই রামালা আমাকে হনহন করে টেনে নিয়ে চললো। আমার সহপাঠীরা এবার অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেভাবে প্রতিবার ওরা অবাক হয় আর আমার চোখ বরাবর কিছু ঈর্ষার ধারালো তীর ছুঁড়ে মারতে থাকে; কারণ, আমি রামালার মতো সুন্দরী গায়িকার ভাগ্যবান পাণিগ্রাহী।

আমরা চলতে চলতে, চলতে চলতে, দ্রুত চলতে চলতে বাড়িমুখো তামাম ছাত্রছাত্রীকে পেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলাম! আমাকে টেনে নিয়ে আগে আগে হাঁটছে রামালা, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, কিংবা নির্বোধ কিংবা অন্ধের মতো আমি ওর পেছনে ছুটছি। এতক্ষণ চেনা পথ ধরেই হাঁটছিলাম; সে পথ ছাড়িয়ে হঠাৎ অচেনা পথের শুরু। আমরা ছুটছি, কোথায় কোন গৃহের পানে রামালা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, আমি জানি না। রামালাকে সে-কথা জিজ্ঞাসা করি, সে-ফুরসৎ হয় না। বড়ো আলোখেলা রাস্তা থেকে আমরা গাছঢাকা অন্ধকার সরু একটা রাস্তায় নেমে গেছি। হ্যাঁ, অন্ধকার! আবছা অন্ধকার থেকে আমরা ঘন অন্ধকারের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লাম। আমরা ছুটছি। কী নেশায়, কার হাতছানিতে ছুটছি এখনো জানি না। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে সরু রাস্তা পার হয়ে সামনে আলোর প্রান্তর। এ আমরা কোথায় এলাম! আশ্চর্য সুন্দর দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমরা দাঁড়ালাম। আমাকে ছেড়ে দিয়ে রামালা অবাক হয়ে সামনে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে! কী সুন্দর হৃদয়গলানো নিসর্গ! এতবড়ো মাঠ আগে দেখি নি কোথাও। আমাদের দু’পাশে গ্রামের সারি লম্বা হয়ে বহুদূর চলে গেছে। সামনে ঘাসবিছানো মাঠ ধু-ধু দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। উপরে আকাশ গোধূলির রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। রামালা দু’হাত মেলে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বুক ভরে যাচ্ছে ঠান্ডায়, তাই না সোনা?’ ঝিরঝিরে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, রামালা ঠিকই বলেছে। ‘আয়। আয় না সোনা’। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে ডাকে রামালা।
হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরে পড়লো। আসমানে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। কোথা থেকে কখন মেঘ জমলো আকাশে? আকাশ কালো হয়ে গেছে। তাইতো পথের ভেতরটা এত অন্ধকার ছিল, আমি মোটেও বুঝতে পারি নি।
দু’দিকে ডানা মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে রামালা। ভালো লাগছে আমার। আমার অনেক ভালো লাগছে। আমিও দু’দিকে ডানা মেলে দিই। এই বৃষ্টিতে পাখিরা যেভাবে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ায় আকাশে, আমারও তেমনি উড়তে সাধ হচ্ছে। আকাশ থেকে বৃষ্টির কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া মাটির প্রান্তর আর বৃক্ষ-বনানি দেখতে কত সুন্দর, আমার তা দেখতে তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি বৃষ্টিতে ভিজছি। বৃষ্টিতে রামালা ভিজছে।
নৃত্যের ছন্দে চারদিকে পাক খাচ্ছে রামালা। ধীরে ধীরে দুলছে রামালা। ওর চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিবিধৌত চুলগুলো অনন্য সুন্দর।
আমি রামালাকে দেখি। খুব গভীরভাবে, ঘন হয়ে দেখি। রামালা আপ্লুত। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। সমগ্র প্রকৃতি মূর্ত হয়েছে রামালার অবয়বে। যুবতী রামালা রমণী হয়ে উঠেছে কখন যেন; আমিও যেন থইথই যৌবনে পড়ে আছি কবে থেকে। এই যে গোধূলির আলো-আঁধারীময় বাংলা, আর স্নিগ্ধ কবিতামাখানো রামালা, ওর চুল, চুলের সিঁথি, ঠোঁটের স্মিতহাসি- একাকার হয়ে মিশে আছে। বৃষ্টিস্নাত শাড়ি-পরিহিতা রমণীর চেয়ে সুন্দরতর আর কিছু নেই। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। একধ্যানে দেখি বাংলার মুখ, আর দেখি রামালাকে।
‘সোনা!’ অস্ফুট স্বরে রামালা ডাকে। আমার সামনে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রামালা। ওর চাঞ্চল্য মুহূর্তে স্তিমিত। ওর দৃষ্টি দূর সমুদ্রের তরঙ্গতুফানে স্থির।
‘হুমম’। আমি অল্প শব্দে সারা দিই।
‘সামনে আয় তো সোনা’।
আমি এগিয়ে রামালার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
‘আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়া। আমার বুক ঘেঁষে দাঁড়া।‘
আমি রামালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওর চোখে তীব্র আগুনের ফলা।
‘আমার চোখের দিকে তাকা, একদম মণি বরাবর চোখ রাখ।’ তারপর রামালা নিজেই একটু সামনে এগিয়ে আসে, একটু ঝুঁকে আমার নাকের সাথে নাক লাগিয়ে, ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ছুঁইয়ে, বুকে বুক ঠেসে একদম আমার চোখের মণি বরাবর ওর চোখের মণি ছুঁড়ে মারলো।
হঠাৎ কী যেন ঘটতে থাকলো।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মগজতন্তুগুলো অতিশয় মিহিসুরে রিনরিন করে বাজছে। ঝিম ধরে আসছে পৃথিবী। সূক্ষ্ম একটা কাঁপুনি, তিরতির করে মগজ থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। খুব জোরে সোনারুকে সাপটে ধরে আছি। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। না, সোনারু নয়, কাঁপছে রামালা। না, তাও না, সোনারু এবং রামালা – আমরা দুজনেই কাঁপছি। এভাবে কতক্ষণ কেটে যায়, টের পাই না। যখন টের পাই, তখন বুঝতে পারি, আমার খুলির ভেতর একটা মিশ্রিত মগজ কাজ করছে। অর্থাৎ, আমার মগজটা আর আমার একার মগজ নয়, এখানে রামালার মগজটাও ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, আমি নিজেই রামালা।
আমিই রামালা?
‘রামালা…’। আমি ‘রামালা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। না, আমি রামালা নই, আমার শরীরের উপর থেকে রামালা আস্তে ওকে সরিয়ে নেয়। আমার সামনে রামালা দুলছে। ওকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দুলতে দুলতে ঘাসের উপর বসে পড়ে সে; আমিও ওর সামনে যেয়ে বসে পড়ি। এখন কি রাত? আকাশে জোসনা? চারদিকে আলো খল খল করছে। অপরূপ নিস্তব্ধতায় আমরা ডুবে যেতে থাকি।
‘সোনা!’ নিস্তব্ধতা ভেঙে রামালা বলে, ‘আজ তোকে নিয়ে একটু খেললাম। আমি তোর মগজটা নেড়েচেড়ে উলটপালট করে দিলাম! ভালো লাগছে না তোর?’
‘সর্বনাশ! কী বলছিস এসব?’ আমি রামালার কথায় বিস্মিত হই।
‘তোর উপর একটা পরীক্ষা চালাচ্ছি।‘ আমার চোখ থেকে লেজার রশ্মির মতো খুব ধারালো একটা রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। এটাই সেই ধারালো ম্যাজিক সিজার, যা সবকিছু কাটবে, আবার জোড়াও লাগাবে। সেই রশ্মি দিয়ে খুব ছোট্ট একটা কণা, নিউট্রনের মতো, তোর চোখের মণিতে ঢুকিয়ে দিব।
‘তুই একটা ডাইনি তো!’ দুম করে ওর মুখের উপর বলে দিই; রামালা যেন সত্যিই একটা ডাইনি হয়ে গেল। ওর চোয়াল খুব শক্ত হলো। আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ থেকে। আমাকে হয়ত ভয় দেখাচ্ছে রামালা। না, আমি সহজে ভয় পাই না। কিন্তু রামালা ধীরে ধীরে নরম হতে থাকলো।
রামালা বলতে থাকে, ‘শোন সোনারু, আমি তোর ব্রেইনের ভেতর ঢুকে পড়বো। অতিক্ষুদ্র একটা দানার ভেতর আমার ব্রেইনের সবখানি মেমোরি ঢুকিয়ে নেব। তোর চোখ বরাবর একটা ফুঁ দিব, তারপর রেটিনা দিয়ে সুড়সুড় করে তোর নিউরনে ঢুকে পড়বো। তোর মগজ ঘাঁটাঘাঁটি করে উচ্ছিষ্ট অংশটা রেখে আবার আমার ব্রেইনে চলে আসবো।‘ এ বলে রামালা দুষ্টুহাসি ছড়িয়ে দিল মুখে।
আমি একটু উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা রামা, কেন শুধু শুধু আমাকে নিয়ে খেলছিস? জগতে কি আর কেউ ছিল না?’
রামালা হাত বাড়িয়ে আমার গাল টেনে ধরলো। বললো, ‘আগের জন্মে তুই আমাকে খুন করেছিলি। এই জন্মে আমি তোকে খুন করবো।’ বলেই রামালা খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো, এবং একসময় অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। ওর অট্টহাসি প্রকৃতির দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে হতে বহুদূর ছড়িয়ে পড়লো।
আমি ভয় পাচ্ছি না। ভয়ের ব্যাপার ছিল কিনা, বা এখনো ভয় পাওয়া উচিত কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি যে রামালাকে ভয় পাচ্ছি না, মূল বিষয় হলো এটা। পূর্ব জন্মটন্ম নিয়ে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। রামালা এখন অত্যধিক ঘোরের ভেতর প্রলাপ বকছে। ও আমাকে কত গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে তা এই আজগুবি প্রলাপ থেকেই বুঝতে পারছি।
তবে, ওর একটা বিষয় আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগতে শুরু করলো।
এটা একটা অভিনব আইডিয়া বটে। মানুষের ব্রেইন কোনোদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব হবে কিনা, ভবিষ্যতের বিজ্ঞান সেটা জানবে। তবে, ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের চাইতে একচিলতে মেমোরি কার্ডের ভেতর একটা মানুষের সমগ্র স্মৃতিসম্ভার, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা জড়ো করা সহজতর কাজ। ‘ডাইনি’ রামালা কি সে-ধরনের কিছু করতে যাচ্ছে? এতে মানবজাতির কী উপকার সাধিত হবে, ওকেই তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে।
‘হ্যাঁ, সেটাই বলছি।’ ওরে সর্বনাশ! আমার মনের কথা রামালা ধরে ফেলছে দেখি!
‘হ্যাঁ, এখন তুই আলাদা করে কিছু ভাবতে পারবি না।‘ ঠান্ডা গলায় রামালা বলে উঠলো।
‘প্রথম দিকে কৃত্রিম উপায়ে বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে একটা সূক্ষ্ম মেমোরিকার্ডে ঢোকানো হবে। এই মেমোরিকার্ডটি মাথার একপাশে চামড়ার নীচে গেঁথে দিতে হবে। সেকেন্ড জেনারেশন স্টেজে আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিন্সসহ প্রতিভাধর জীবিত ব্যক্তিদের ডিএনএ থেকে তাদের বুদ্ধিমত্তা সংগ্রহ করে একত্র করা হবে। একত্রিত বুদ্ধিমত্তাকে কনসেন্ট্রেট করে মূল বুদ্ধিমত্তার চাইতে বহুগুণ শক্তিশালী বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা হবে। এগুলো অনুরূপ এক-চিলতে চিপসে ঢোকানো হবে। এগুলো কপি করা যাবে। মেধাবীদেরকে আরো মেধাবী এবং অমেধাবীদেরকে মেধাবী করার কাজে এ চিপস ব্যবহৃত হবে। থার্ড জেনারেশন স্টেজে চিপসকে লিকুইড ফর্মে রূপান্তর করা হবে। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বুদ্ধিমত্তা পুশ করা হবে। ফলে হবে কী, পৃথিবীতে স্টিফেন হকিন্সের প্রতিভার পুনরাবির্ভাব ঘটবে। আইনস্টাইন, নিউটনের পুনরাগমন ঘটবে। মানব সভ্যতা সক্রেটিস, এরিস্টটলের মতো দার্শনিকদের মেধা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতিভার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক মহামানবীয় প্রতিভা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। উন্নত বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে মানবসভ্যতার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকবে। ফোর্থ জেনারেশন স্টেজে সংগৃহীত সমন্বিত প্রতিভার চিপসটি বায়বীয় কিংবা ‘লাইট’ ফর্মে রূপান্তর করা হবে। চোখের দৃষ্টি দিয়েই একজনের বুদ্ধিমত্তা অন্যজনের শরীরে ট্রান্সফার করা যাবে। আমরা যত্রতত্র রামালার মতো অসংখ্য সুকণ্ঠী গায়িকাকে দেখতে পাবো…’। আমার মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর এই যে ভাবনাগুলো কিলবিল করছে, এটা আমি না, রামালার ভাবনা। রামালার মগজ এখন আমার মগজে ঢুকে পড়েছে। আমার কথাটা রামালার, এবং রামালার কথাটা আমার, এবং আমাদের দুজনের কথাটাও… নাহ, আর ভাবতে পারছি না।
‘সোনা!’ রামালার কথায় আমি সম্বিৎ পাই। একটা জলবতী স্নিগ্ধ কবিতা এক অপরূপ ভঙিমায় আমার সামনে বসে আছে। ওর মুখের হাসিটিতে পৃথিবী মধুর হয়ে উঠছে।
এখন দিন, নাকি রাত, আমরা জানি না। কোথায় আছি আমরা জানি না। আমরা হাত ধরে মুখোমুখী বসে আছি। চারদিকে অন্ধকার, নাকি জোসনা, আমরা ভুলে গেছি। ভুলতে ভুলতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন আমি এবং রামালা দুজনেই ক্লাসে। একজন সাহিত্যের শিক্ষক বোর্ডে বেশকিছু অদ্ভুত আকৃতির ছবি এঁকে বলছেন, ‘এরা হলো অন্যগ্রহের মানুষ। অন্যগ্রহের মানুষ দেখতে আমাদের মতো নয়; কেউ পাথর, কেউ পাহাড়, কেউ গাছের মতো, কেউ-বা বায়বীয় বা তরল পদার্থের মতো; কেউ আবার এমন, যাদের আকৃতি আমাদের কল্পনার অতীত। এদের চলাচলও কিন্তু আমাদের মতো না; এরা কল্পনাগামী, অর্থাৎ, এরা যেখানে যাবার কথা কল্পনা করে, মুহূর্তে সেখানেই চলে যায়। এরা একই সাথে অনেক জায়গায় অবস্থান করতে পারে; যার কল্পনাশক্তি যত বেশি, সে তত বেশি জায়গায় এবং তত বেশি দূরবর্তী স্থানে যাতায়াত ও অবস্থান করতে পারে। আমাদের পৃথিবীতেও মানুষ একদিন কল্পনাগামী হবে। প্রথমে তারা বাতাস, পরে ইথারে ভ্রমণ করতে পারবে। এরপর তারা…’
রামালা হঠাৎ দাঁড়িয়ে স্যারকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকলো, ‘স্যার, এ গল্পগুলো প্লিজ না করুন। ইউনিভার্সের অন্য কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ইউনিভার্সে পৃথিবীর মতো ৪০ বিলিয়ন গ্রহ এবং অগুনতি উপগ্রহ আছে। পৃথিবীর বয়সই ৫০০ কোটি বছর। ইউনিভার্সের বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। ৫০০ কোটি বছরে যদি পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ ঘটতে পারে, ১৪ বিলিয়ন বছরে অনেক আগেই ইউনিভার্সের অন্য কোথাও প্রাণীর সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে আজও কোথাও প্রাণের সন্ধান পৃথিবীর মানুষ পায় নি; অন্য কোথাও প্রাণী থাকলে তাদের আমাদের চাইতেও বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার কথা, যেহেতু ইউনিভার্সের বয়স পৃথিবীর বয়সের চাইতে অনেক বেশি। এবং আমরা তাদের খুঁজে না পেলেও অন্তত তারা এতদিন আমাদের খুঁজে বের করে ফেলতো।’ আশ্চর্য, পুরো ক্লাস হাততালি দিয়ে উঠলো, এবং স্যার অবাক হয়ে রামালার দিকে তাকিয়ে আছেন।
এবং রামালা, না, রামালা না, হ্যাঁ, রামালা আমার মগজে ঢুকে পড়ে আরেকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘স্যার, আপনি সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে বিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন, এটা হাস্যকর বটে।‘
শিক্ষক আহত হলেন না, কিংবা তার কোনো ভাবান্তর হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘ডিয়ার সান, আমি সাহিত্যের শিক্ষক বলেই এতখানি কল্পনা করতে পেরেছি। এখন বিজ্ঞানের যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে আমার কল্পনাকে ছুঁয়ে দেখুক।’ রামালা চুপসে গেল, না, আমিই আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। ক্লাসে কোনো শব্দ নেই। কেউ নেই ক্লাসে। বোর্ডের সামনে একটা ব্ল্যাক মার্কার হাতে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে রামালা।

সকালে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে একটা গান গাইছিলাম। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সুন্দরী হেলেনা বলে উঠলো, ‘বাহ, তোমার কণ্ঠটা দারুণ তো!’ তাই তো! আমি নিজেই অবাক হচ্ছি আমার কণ্ঠ শুনে। হেলেনার কথায় আমি খুব পুলকিত হই। ওর চোখে মুগ্ধতার ঝিলিক। আমি আরো গলা ছেড়ে, আরো যত্ন করে গান গাইতে থাকি। গান গাওয়া শেষ হলে দেখি, হেলেনা আমার কাঁধের উপর মাথা নুইয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে আছে।
‘গাও না বাবু, গাও। আরো গাও।‘
আমি একের পর এক গান গাইতে থাকি। নিজের গানে নিজেই মুগ্ধ হতে থাকি। এবং অবাক হতে থাকি- আগে তো কখনো এভাবে গাইতে পারি নি!
আমার গানে হেলেনা পাগল হয়ে গেল।
যখন তখন হেলেনা আমাকে গান গাইতে বলে।
যেখানে-সেখানে হেলেনা আমার গলায় গলায় জড়িয়ে থাকে।
আমাকে ছাড়া কিচ্ছুটুকুন বোঝে না হেলেনা। প্রেমে পাগলিনী এমন মেয়েদের কার না ভালো লাগে?
একদিন গান গাওয়ার পর আবেশে জড়িয়ে ধরে অনর্গল চুমো খেতে থাকে হেলেনা। আমি ওকে বুকে টেনে নিই। ওর চোখে চোখ রাখি। খুব গভীরভাবে ওর মণি বরাবর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিই। তারপর ওর মগজে ঢুকে পড়ি। হ্যাঁ, আমি রামালা। হেলেনার মগজ খুবলে ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে আসি।

বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বারান্দায় গ্রিল ধরে সন্ধ্যারাঙা বৃষ্টি ঝরা দেখছে রামালা। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁইছে। পিঠের উপর একগাঁদা চুল ছড়িয়ে পড়েছে। চুলের সাথে আঁচল উড়ছে বাতাসে। রামালা আমাকে ডাকছে না ওর কাছে যেতে। ও না ডাকলে আমি কখনো কাছে যাই না।
ও প্রতি উইকএন্ডে আমাকে গান শোনাতে আসে। সারাদিন নানান জায়গায় গান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আজকে এই অনুষ্ঠান, কালকে ওখানে ওপেন এয়ার কনসার্ট, টিভিতে লাইভ প্রোগ্রাম! ওর ব্যস্ততার শেষ নেই। ও এখন দেশের সেরা শিল্পীদের একজন। আমাকে যদি একজন শিল্পীর নাম বলতে বলো, আমি বলবো সে রামালা। আমার ভালো লাগে রামালার গান। রামালা যখন আধো নিমীলিত চোখে গান গাইতে থাকে, তখন ওকে ধ্যানী সন্ন্যাসিনী মনে হয়। তখন সাধ হয়, ওর কোলের উপর মাথা রেখে ওর গলা ধরে ঝুলে থাকি।
রামালা আমার বাসায় খালি গলায় গান গায়। বাসায় কোনো গিটার কিংবা হার্মোনিয়াম নেই। এসব থাকলেও আমি ওর খালি গলায় গাওয়া গানই শুনতাম। এতেই ওর প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। ওর কণ্ঠে অমৃত ঝরে পড়ে, আমি তাতে গলে যাই, আর মিশে যেতে থাকি।
‘শোন!’ এটা রামালার কাছে যাবার ইঙ্গিত।
আমি রামালার পেছনে যেয়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াই। আমার দু’হাত ওর দু’দিকে প্রসারিত দু’হাতের উপর মেলে ধরি। রামালার শরীর আস্তে সামান্য ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে সামনে বারান্দার গ্রিল দরজা খোলার মতো খুলে গেল, রামালা একটু ঝুঁকে পড়ে আলগোছে শূন্যে ঝাঁপ দিল। পড়তে পড়তে দু’দিকে দুটো ডানা মেলে ধরলো আকাশে। তারপর বাতাসের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে বৃষ্টির পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে আমাকে পৃষ্ঠে সওয়ার করে আকাশে উড়তে থাকলো রামালা। হিম হয়ে আসে শরীর। আমি রামালাকে শক্ত করে জড়িয়ে ওর শরীরের ওম নিতে থাকি। কখনো উর্ধে উঠে যাই ঈগলের মতো, আবার ঢেউয়ের মতো দুল খেতে খেতে নীচে নামতে থাকি। কতদিনের বাসনা ছিল আকাশে ওড়ার, ভূ-পৃষ্ঠে কুয়াশাচ্ছন্ন বনানি দেখার, আজ আমি প্রাণ ভরে সেসব দেখছি। পাহাড়, নদী পেরিয়ে, বৃষ্টি আর আকাশের শূন্যতা কেটে রামালা আমাকে নিয়ে উড়ে চলেছে। কখনো বাতাসের বেগে, কখনো আরো দ্রুত। আমার গ্রামকে মনে পড়লো, আর এ কী অদ্ভুত! মুহূর্তেই দেখতে পেলাম, আমি আমার গ্রামের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই তো, এই মাঠে আমি, নূরু, জসীম- একসাথে কত খেলেছি! অমনি দেখতে পাই, ওরা আমার সামনে এসে হাজির। আমরা মাঠের মাঝখানে বসে বিকেলের নরম আলোতে আড্ডা দিচ্ছি আর চানাচুর খাচ্ছি।
‘মা!’ বলতেই নিজেকে দেখতে পাই, আমি এক ৭ বছরের খোকা। উঠোনে বাতাসে ধান ঝাড়ছে মা, আর আমরা ভাইবোনেরা ধানের খড়ে লাফালাফি করে খেলা করছি। একদিন বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিল। কী তুখোড় আর উদ্দাম এই দিনগুলো! ভোঁ ভোঁ দৌড়াই, সারাদিন ঘুড়ি নিয়ে মাতামাতি, গাছগাছালির ফল কুড়িয়ে বেড়াই, পাখির বাসায় হানা দিই, যখন-তখন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে হলডুগানি খেলি। এভাবে কতদিন কেটে যায়, আমার হিসাব থাকে না। স্কুলে যাওয়ার পথেই একটা ডঙ্গুল ফলের গাছে। আমি, নুরু আর জসীম প্রতিদিন সেই গাছ থেকে ফল পাড়ি। চলে যাওয়ার সময় বাড়ির আড়াল থেকে গলা বের করে ছোট্ট চোখে একটা মেয়ে তাকিয়ে থাকে, ওর নাম হেলেনা।
‘সোনা!’ কার ডাক শুনে চোখ খুলে ঘুরে তাকাই।
চারদিকে আলোর সমুদ্র থইথই করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে পরীরা। ওরা আমার পাশ দিয়ে উড়ে যায়, ওদের পাখার নরম ঝাপটায় আমার মন আন্দোলিত হয়। হেলেনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, খুব মিষ্টি করে হাসছে হেলেনা।

২৩ জুন ২০২০

মশার জীবন

কামালুদ্দিন পাগাম সাহেব ডানে সালাম ফেরালেন, এমন সময় টের পেলেন তার ডান হাতের উপরে একটা মশা কামড় বসিয়েছে। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘরে মশার সমারোহ বাড়তে থাকে। আর তিনিও মাগরিব শেষ করেই মশারি খাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। খাওয়াদাওয়া, টিভি দেখা ভেতরে বসেই চলে।
নামাজে দাঁড়িয়ে পারতপক্ষে তিনি নড়াচড়া করেন না। তবে কঠিন কামড়ের চোটে মাঝে মাঝেই তার হাত আপনিআপনিই উঠে যায়; খুব আলোগোছে কামড়খাওয়া জায়গায় নরম করে হাত বুলিয়ে মশা তাড়িয়ে দেন এবং হালকা করে আঙুলে ঘষা দিয়ে চুলকানি উপশম করেন। হাতের দাপটে যাতে কোনো মশা মারা না পড়ে যায়, সেদিকে খুব খেয়াল রাখেন। নামাজরত অবস্থায় মশামাছি, পিঁপড়া, ইত্যাদি মারা মাকরূহ। এটা তাঁর স্ত্রী বলেছেন। তিনি নিজে কখনো সত্যমিথ্যা যাচাই করেন নি।
মশাটি খুব গভীরে শূঁড় ঢুকিয়ে দিয়ে আরামসে রক্ত টানতে শুরু করে দিয়েছে। ততক্ষণে তিনি বামে সালাম ফিরিয়ে মশাটির উপর চোখ স্থির করে গভীরভাবে তাকালেন। তিনি ভাবছেন, দেখা যাক মশাটি কতখানি রক্ত খেতে পারে। পুঁচকে মশাটা রক্ত খেতে খেতে একসময় টগবগে হয়ে উঠবে, পেছনে পাখার নীচে স্বচ্ছ চামড়ার ভেতর একদলা টলটলে রক্তও বেড়ে উঠতে থাকবে। এরকম রক্তাভ মশা দেখতে তার খুব মজা লাগে। প্রায় প্রতিদিন সকালবেলা এরকম মজার খেলা দেখেন পাগাম সাহেব। কিছু মশা রক্ত খেয়ে উৎকট কালো আকার ধারণ করে মশারির গায়ে ঝিম মেরে বসে থাকে। ওগুলোকে তখন নেশাগ্রস্ত মদ্যপের মতো মনে হয়। মশারির কোনা ধরে ঝাঁকি দিলে, কিংবা হাত দিয়ে সরাতে গেলে আহত পাখির মতো সামান্যটুকু উড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে বসে ওরা।
মশারা মূলত খুব চতুর ও চটপটে প্রাণী। উড়ন্ত মশাকে দেখে খুব নাদুস-নুদুস ও অলস, গোবেচারা প্রাণী মনে হয়; কিন্তু কখনো উড়ন্ত মশাকে ধপ করে দু’হাতে চাপ দিয়ে ধরতে পেরেছেন? শরীরের উপর বসলেই বা কয়টা মশাকে ধাপ্পড় দিয়ে মারতে পেরেছেন? মশার চোখ চারদিকে। ওরা আপনার মনের খবরও পড়তে জানে। আপনি থাপ্পড়ের জন্য হাত উঠানোমাত্র ওরা খবর পেয়ে যায় আর মুহূর্তেই চম্পট। মশাদের অতো বলদ ভাবতে নেই।

‘আর কত খাবি রে বাবা? পেট ভরে নাই এখনো?’ পাগাম সাহেব মনে মনে বলেন। ব্যথা আর চুলকানির এক অদ্ভুত মিশ্রণ। প্রায় অসহ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। শরীরে এত রক্ত নিয়ে এ মশাটা উড়তে পারবে না। রক্ত খাওয়া শেষ হলে কোনোমতে ডানা ঝাপটে হাতের পাতা থেকে সে পাশাপাশি একটা কাপড়ের গাদায় অন্ধকারে ঢুকে পড়ে জনমের মতো ঘুমিয়ে পড়বে, তারপর যখন তার ঘুম ভাঙবে, তখন কতদিন পার হয়ে যাবে সে জানবে না। আচ্ছা, মশারা কি শুধু রক্তই খায়? না, তা হবে কেন? যেসব মশা বনেজঙ্গলে থাকে, যারা কোনোদিন অন্য পশপাখি চোখে দেখে নাই, তারা হয় জন্ম থেকেই অনাহারী, অথবা ময়লা-আবর্জনা খেয়ে বড়ো হয়েছে। সেই হিসাবে, যেসব মশা রক্ত খাওয়ার সুযোগ পায়, বিশেষ করে মানুষের রক্ত, সেগুলোকে খুবই ভাগ্যবান মশা বলতে হবে। আশরাফুল মাখলুকাতের রক্ত খেয়ে তাদের জীবন হয়ে যায়।

হাতের দিকে পাগাম সাহেব তাকিয়ে আছেন। মশাটি ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। রাতে ঘুমের সময় যেসব মশা মশারির ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে, সেগুলো খুব নিরুপদ্রপে চামড়া ফুটো করে সময় নিয়ে মনের সুখ মিটিয়ে রক্ত পান করার সুযোগ পায়। পাগাম সাহেব এই মশাটিকেও সেই সুযোগ দিচ্ছেন। তিনি টের পাচ্ছেন, চামড়ার নীচে সুঁইয়ের মতো মশার শূঁড়টা ঢুকে আছে, আর সেই শূঁড় দিয়ে তরতর সুড়সুড় করে রক্ত টেনে নিয়ে একদম পাকস্থলির গভীরে ছেড়ে দিচ্ছে সেই রক্ত। কামড়ের জায়গাটা শিরশির করতে করতে এবার তিনি ব্যথায় একটু কোঁ করে উঠলেন। শরীরটাও একটু দুলে উঠলো কিংবা কেঁপে উঠলো। নাহ, আর সহ্য হচ্ছে না। না। না! না! সপাৎ করে তার বাম হাতটা উঠে এলো। কিন্তু তিনি খুব সতর্ক। হাতের পাঁচটা আঙুল তিনি মেলে ধরেছেন। ধীরে ধীরে সেই হাত থাবার মতো নেমে আসছে মশার দিকে। মশাটা এখন পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত। তার কোনোদিকে খেয়াল কিংবা ভ্রূক্ষেপ নেই। সে টের পাচ্ছে না তার মাথার উপর নিষ্ঠুর খড়্গ নেমে আসছে। হাতের থাবা একটু দ্রুত গতিতে নেমে এসে মশার শরীরে লাগবে, ঠিক অমন সময়ে মশাটা মৃদু পাখা নাড়ালো, তারপর উড়বার চেষ্টা করতেই পাগাম সাহেবের আঙুলের সাথে ধাক্কা লেগে ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে গেলো। পাগাম সাহেব বাম হাতে কামড়খাওয়া জায়গাটি ঘষছেন আর দেখছেন, আহত মশাটি উড়বার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু উড়তে পারছে না। একটু পর সে এক জায়গায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে থামলো। পাগাম সাহেবের মজা দেখা শেষ হয় নাই। তিনি সামনে ঝুঁকে পড়ে নীচু হয়ে মশাটিকে দেখতে থাকলেন। ওটা যেন হাতির মতো শূঁড় উঁচু করে তাকে অভিবাদন জানালো। পিটপিট করে তার দিকে তাকাচ্ছে। পাগাম সাহেবের মনে দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো। ঠিক দুষ্টুবুদ্ধিও বলা যাবে না, তার মনে একটা শিশুসুলভ ইচ্ছে জাগলো। তিনি হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে দু আঙুলের নখের মাথায় মশাটির পাখা চিমটি দিয়ে ধরে তুলে এনে ডান হাতের তালুতে রাখলেন। এবার চোখের খুব কাছে এনে ওর দিকে তাকালেন। তালুর উপরে ওটা পা চেগিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। না জানি কত রক্ত সে খেয়েছে। শরীর তার এত ভারী হয়েছে যে, নড়তেই পারছে না। পাগাম সাহেবের মুখ দিয়ে ‘চু-চু-চু’ শব্দ বেরিয়ে এলো। একবার তার মেয়ে অনেকগুলো হেলিকপ্টার আকৃতির প্রজাপতি ধরে এনে পাখা ছিঁড়ে টেবিলের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। ওগুলো তখন হেঁটে বেড়িয়েছিল। মেয়ে তাতে খুব মজা পেয়েছিল। পাগাম সাহেব এবার এই মশাটিরও পাখা ছিঁড়ে ফেলবেন বলে ভাবলেন। তিনি খুব আনন্দের সাথে, নিবিড় চিত্তে, সন্তর্পণে মশাটির পাখা আলাদা করে দিলেন। পাখাবিহীন মশাটি আগের মতোই তার হাতের তালুতে চেগিয়ে নড়াচড়া করতে লাগলো। কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলেন না তিনি। কিন্তু খুব মজা পেলেন। যাও রক্তচোষা মশা, দেখো তোমার রক্ত চোষার পরিণাম। রক্ত চুষতে এসে ধরা পড়লে, সারা জনমের জন্য পাখাই হারিয়ে ফেললে। রক্ত খাওয়ার সাধ এবার মিটলো তো?

কিন্তু তিনি ক্ষান্ত হলেন না। অর্থাৎ, তার খেলা এখনো শেষ হয় নি। তিনি মশাটাকে একটা পরিষ্কার কাঁচের উপর রাখলেন। ভদ্র লোকের মতো মশাটি কাঁচের উপর স্থির হয়ে থাকলো, যেমনটা সে হাতের তালুতে ছিল। পাগাম সাহেব উপুড় হয়ে সামান্য ফুঁ দিলেন, তাতে মশাটা ছোটো একটা হালকা দানার মতো ঘুরতে ঘুরতে একটু দূরে সরে গেলো। মরে যায় নি তো? নাহ। তিনি খেয়াল করে দেখলেন শূঁড় নড়ছে। পা নড়ছে। কিন্তু হঠাৎ তার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে। কী ছেলেমানুষি কাণ্ডই না তিনি করছেন! তার কি এসব খেলার বয়স আছে? এসব মশামাছি নিয়ে খেলাধুলা করা কি মানুষের কাজ! তিনি নিজের উপর খুব বিরক্ত হোন।
কিন্তু অবাক হলেন তিনি। হঠাৎ করে এই মশাটি নিয়ে খেলা করার এই অদ্ভুত ইচ্ছে কেন হলো তার? তিনি সুস্থ আছেন তো! হ্যাঁ, তিনি সুস্থ। সুস্থ মনেই তার মনের ভেতর আরেক উদ্ভট প্রশ্নের উন্মেষ ঘটলো। এই যে মশাটি নিয়ে তিনি খেলছেন, যার দুটো পাখা তিনি ছিঁড়ে ফেললেন- তার পরও মশাটি প্রায় নির্বিকার, পাখা ছাড়াই পা চেগিয়ে হাঁটছে- এতে কি মশার শরীরে একটুও ব্যথা লাগে নি? চোট লাগে নি? আমার শরীর আর এই মশার শরীরে পার্থক্য কী? আমি মানুষ, খিদে লাগলে খাবারের জন্য হন্যে হয়ে যাই, সারাবিশ্ব তোলপাড় করি, মশারাও কি তাই করে না? কী পার্থক্য একটা মানুষের জীবনে আর এই তুচ্ছ মশার জীবনে? একজন মানুষের হাত কাটা গেলে, পা কাটা গেলে যে যন্ত্রণা পায়, একটা মশার পা ছিঁড়ে ফেললে কি যন্ত্রণা তার চাইতে কিছু কম হয়? পথ চলতে কত পিঁপড়ে পিষ্ট হয় পায়ের তলায়; আমরা কি কখনো ভেবেছি- এই পিঁপড়েরাও মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করেছে? আমরা কি কখনো ভেবেছি- একটা তাজা মাছ যখন ঘ্যাচঘ্যাচ করে বটিতে কোটা হচ্ছে, তখন ঐ মাছটাও আর্তনাদ করতে থাকে! বড়োজোর একটা মুরগি, একটা ছাগল বা গরু জবাইয়ের সময় আমরা কিছুটা ভাবি, যাতে এদের কষ্টটা দীর্ঘস্থায়ী না হয়; কিন্তু, এক থাপ্পড়ে একটা মশা, একটা মাছি, পায়ের এক ঘষায় একদঙ্গল পিঁপড়া, বা তেলাপোকা যখন শেষ করে দিই, তখন কি একবারও মনে হয়- এদেরও জীবন ছিল, যা মাত্র এক ফুঁৎকারে নিভিয়ে দিয়েছি? তাহলে মানুষের জীবনের এত মূল্য, আর তুচ্ছ কীটপতঙ্গের কোনো জীবনই নাই?
পাগাম সাহেব ভাবলেন- মানুষ আসলে মনে করে মানুষ ছাড়া আর কারো জীবন নাই; অন্য প্রাণীদের দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা নাই। আমরা একপাল গরুর সামনে গরু জবাই করি; খোয়াড়ভর্তি হাঁসমুরগির সামনে হাঁসমুরগি জবাই করি। আমরা মনে করি- ওরা এই জবাই করাকে জবাই মনে করে না, মনে করে খেলা। ওরা সেই খেলা দেখতে থাকে প্রাণ ভরে। মানুষের মতো এত নিষ্ঠুর প্রাণী কি দ্বিতীয়টি আর আছে?
পাগাম সাহেব ভেবেচিন্তে দেখলেন, প্রকৃতিতে এর একটা অদ্ভুত ভারসাম্য বিরাজমান রয়েছে। মানুষ যেমন এক-মুহূর্তে পিঁপড়ার জীবন, মশার জীবন, তেলাপোকার জীবন কেড়ে নিতে পারে, মাছ-মুরগি-গরু-ছাগলকে যেমন প্রাণী না ভেবে খাবার হিসাবে ভক্ষণ করে থাকে- এই মানুষরাই আবার হয়ে ওঠে বাঘের খাবার, সিংহের খাবার, হাঙরের খাবার। একটা রানাপ্লাজা কেড়ে খায় ১১৩৪টা জীবন, নিমতলীতে এক লহমা আগুন পুড়িয়ে ছাই করে ১২৪টা তরতাজা প্রাণ। বাস নামক একটা দানব মুহূর্তে আবরার নামক একটা যুবাকে খেয়ে ফেলে। পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় একটা দুর্ধ্বর্ষ বিমান ও তার উদরভর্তি ১৪৭টা মানুষ। একটা যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, হিরোশিমার বোমা- লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষকে মিশিয়ে দেয় মাটির ধুলোয়।

কামালুদ্দিন পাগাম সাহেব কাচের উপর থেকে প্রায় নিথর-হয়ে-পড়া কালচে বিন্দুর মতো পাখাহীন মশার টুকরোটি ডান হাতের তালুতে তুলে নিলেন। ওটার শূঁড় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। পা-গুলো একবার মনে হয় নড়ছে, আবার মনে হয় জড়ো পদার্থের মতো শক্ত হয়ে গেছে। তিনি একধ্যানে বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মনে হচ্ছে তার হাত নেই, পা নেই। তিনি নড়তে পারছেন না। তিনি পাশের ঘর থেকে স্ত্রীকে ডাকবেন, তার গলা ফেটে স্বর বেরুচ্ছে না। যেন হাতের মশাটিও মৃত্যুর কালে তার প্রাণাধিক স্ত্রীকে ডেকে খুন হচ্ছে, কান্নায় তার বুক ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু তারও কণ্ঠ যেন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে।

২৬ মার্চ ২০১৯

আঙ্গুরি

এবারের গল্পটা আমাদের সহপাঠী পলাশুদ্দিন তমালকে নিয়ে। ওর গল্পটা বহুদিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ নিয়ে আঙ্গুরির সাথে মাঝেমধ্যে আলাপও করেছি। আঙ্গুরি উৎফুল্ল হয়ে বলতো- খুব ভালো হবে গল্পটা। লিখে ফেলো। গল্পের বাঁক, রহস্য কোথায় কী হবে, সে আমাকে বলতো।
পলাশুদ্দিন তমাল আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিল। আঙ্গুরি তার প্রেমে পড়েছিল। গল্পে সেই প্রেমের কাহিনিটাই বলবো বলে ভাবছি। কিন্তু তাতে কোনো ট্র্যাজেডি না থাকলে কি গল্প জমবে? আঙ্গুরি খুব অনুনয় করে বললো- না, ট্র্যাজেডি করো না প্লিজ।

আমাদের পলাশুদ্দিন তমাল খুব নিরীহ, ভাবুক এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের। সে শুধু দূর থেকে দেখে আর কল্পনা করে। কাছে গিয়ে মুখটি খুলে বলতে পারে না- ‘বাহ, তোমার নখগুলো সুন্দর তো!’ মেয়েটি হয়ত এ কথায় অবাক হয়ে ফিরে তাকাবে আর কপাল কুঁচকে চোখ সরু করে বলবে- ‘এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি; হুট করেই মেয়েদের নখ দেখে বখাটে ছেলেরা।’ অমনি সে লাজে সংকুচিত হয়ে মাথা নীচু করবে আর মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেবে- এতকিছু থাকতে সে মেয়েটির নখ দেখতে পেলো কীভাবে? তার চুলগুলো খুব লম্বা; কোমর অব্দি ঝুলে পড়েছে। বলতে পারতো, ‘তুমি কিন্তু খুব সুন্দর করে হাঁটো!’ তখন পলাশুদ্দিন তমালের খুব মন খারাপ হবে, অপমানিত বোধ করবে। আর বেশ কিছুদিন উদাসভাবে আকাশের মেঘ দেখে বেড়াবে।

তারপর একদিন বিকেলে পলাশুদ্দিন তমাল আমার কাছে আসবে। তার চোখমুখ উজ্জ্বল। খাটের উপর আয়েশ করে শুয়ে শুয়ে খুব সুন্দর করে গল্পটা আওড়াবে- ‘হায়, মেয়েরা এমন হয় না কেন?’ তার চোখে একটা মেয়ে ভেসে উঠবে, যাকে সে দেখে নি কোনোদিন, চেনে না; কোনো এক অদ্ভুত কারণে একদিন সেই মেয়েটি তার সামনে এসে পড়বে।

পলাশুদ্দিন তমালের হাত ধরে মেয়েটা এমনভাবে কথা বলতে লাগলো যে তারা বাল্যকাল থেকেই পরিচিত, এক ক্লাসে পড়েছিল বহুকাল ধরে, এমনকি মেয়েটা তাকে ‘তুই’ ‘তুই’ করে কথা বলতে বলতে যখন কাঁধে হাত রাখলো এবং একসময় দুষ্টুমি করে মাথার চুল ধরে ঝাঁকি দিল, তখনো পলাশুদ্দিন তমাল শুধু অবাক হয়েই বলতে থাকলো, ‘আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনি ভুল করছেন।’
‘না, কোনোকালেই ভুল হবে না। আমরা পালামগঞ্জ হাইস্কুলে একসাথে পড়েছি, জয়পাড়া কলেজে একসাথে পড়েছি, এমনকি তুই আমাকে সাইকেলে করে নিয়ে আসতি তাও ভুলে গেছিস? আমার নাম আঙ্গুরি। মনে নাই?’
স্কুল আর কলেজের নাম ঠিক আছে। সাইকেলের কথাটাও ঠিক আছে। বাকি কিছুই ঠিক নাই। ‘আঙ্গুরি’ কারো নাম হতে পারে, এমনকি এমন অপরূপা একটা মেয়ের নাম আফরিনা কিংবা তাসলিমা না হয়ে পশ্চাৎপদ ‘আঙ্গুরি’ নামটা কেন হলো তাও সে বুঝতে পারছে না।
‘আমরা একসাথে জয়পাড়া হলে সিনেমা দেখতাম। মনে নাই? নদের চাঁদ সিনেমা দেখার পর বাড়ি ফিরতে আমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল। তোর বাপে তোকে খুব মেরেছিল। মনে নাই?’
‘নদের চাঁদ’ সিনেমা সে দেখেছিল, সেটা ঠিক। কিন্তু সাথে ছিল শাহজাহান আর শাহজাহানের বউ। সেই রাতে শাহজাহান পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, তারপর থেকে উধাও।
মেয়েটা ওর বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘তুই কিন্তু খুব দেমাগ দেখাচ্ছিস। আমার মতো সুন্দরী একটা মেয়ে আগ বাড়াইয়া কথা বলতেছে তো, তাই এখন তোর দাম বেড়ে গেছে। আমার নাম আঙ্গুরি। মনে পড়ে?’
‘নাহ! আপনি ভুল করছেন।’
‘আরে ঐ-ঐ-ঐ হারামি- আমি আঙ্গুরি আঙ্গুরি আঙ্গুরি। বড়ো বাড়ির আঙ্গুরি। চোখ বড়ো কইরা আমার চোখের দিকে চাইয়া দেখ। আমি আঙ্গুরি।’ বলতে বলতে আঙ্গুরি পলাশুদ্দিন তমালের দুইগাল দুইহাতে টেনে ধরে একদম মুখের কাছাকাছি গিয়ে বললো- ‘এত হারামি হইলি কেমনে, আমারেও ভুইলা গেলি? একটা সুন্দরী মেয়েরে কেউ ভুলবার পারে, এইটা আমারে বিশ্বাস করতে বলিস?’

পলাশুদ্দিন তমাল এখানে এসে থামে। ওর চোখের সামনে আঙ্গুরির গাল টেনে ধরার দৃশ্যটা আমার চোখেও ভেসে ওঠে। সে খুব আবেশিত হয়। জানালা দিয়ে বহুদূর ওর দৃষ্টি চলে যায়, যেখানে ধানফলানো মাঠের দিগন্তে দুটো ছায়া ধীর ছন্দে দুলতে থাকে। মিষ্টি আলো ওর সমস্ত অবয়বে।

‘এমন গল্প মেলানো যায় না। অন্যকিছু কল্পনা করিস না কেন?’ আমি বলি।
পলাশুদ্দিন তমাল ধীরে ধীরে বলে, ‘আমি কি মেলাতে চাই? একটা মমতাবতী মেয়ে, আমার প্রতি খুবই অনুরক্ত, অথচ আমি তাকে চিনি না, আমার হাত ধরে সে গা লেপ্টে থাকে, আমি বিরক্তির ভান করি, আসলে এটা আমি খুব করে চাই- অনন্ত সময়ের এমন একটা স্নিগ্ধ গল্প চাই। আহা, যদি এমন হতো!’

পলাশুদ্দিন তমাল একদিন একটা মধুর স্বপ্ন দেখলো। সারাদিন সে আনন্দে ঘুরে বেড়ালো। আমাকে একবার এসে বলেও গেলো স্বপ্নের কথাটা, কিন্তু গল্পটা বললো না, কারণ, বলে ফেললেই মজাটা শেষ হয়ে যাবে। আমিও গল্পটা জানার জন্য খুব উদ্‌গ্রীব হলাম এবং বার কয়েক মিনতিও করলাম, কিন্তু সে বললো না। একদিন বিরস মুখে এসে বললো- ‘স্বপ্নটায় আর মজা পাচ্ছি নারে।’
‘কেন?’
‘ধূর!! এত দেখলে কি আর মজা থাকে?’

একটা মেয়ে এক রাতে বিপদে পড়েছিল। খুব অভিজাত বংশের মেয়ে। সাউথ সিটির এক পার্কে বসে সে রাতের আকাশ আর ঝলমলে ঢাকা শহর দেখছিল। বেকার পলাশুদ্দিন তমাল সেই পার্কে খোলা সামিয়ানার নীচে ঘাসের বিছানায় শুয়ে আকাশে জোসনা খুঁজছিল। ঐ সময়ে কয়েকটা লম্পট এসে মেয়েটার সাথে বাজে আচরণ করতে থাকলে পলাশুদ্দিন তমাল তাকে নায়কোচিত বীরত্বে রক্ষা করে নিজের কুটীরে নিয়ে যায়। মেয়েটা সেই দরিদ্র কুটীরে কয়েকদিন থাকে এবং পলাশুদ্দিন তমালের সাথে নানা জায়গায় ঘুরে আনন্দে সময় কাটায়। তার ভালো লাগে পলাশুদ্দিন তমালের সাহচর্য। সে খুব প্রীত হয় এবং মনের মধ্যে একটা ভাব জন্ম লয়। একদিন নর্থ সিটির কয়েকজন পুলিশ এসে মেয়েটাকে উদ্ধার করে। পলাশুদ্দিন তমাল জানতে পারে, মেয়েটার নাম ঐশ্বরিয়া রাই। সে বিশ্বসুন্দরীরের মধ্যে সুন্দরীতমা। সে বাংলাদেশে এসেছিল ভারতের শুভেচ্ছা দূত হিসাবে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেদ করে সে রাতের ঢাকা দেখতে বেরিয়েছিল। কুটীর থেকে বিদায় নেয়ার সময় সে হোটেলের ঠিকানা দিয়ে যায় এবং দেখা করতে বলে।
যেদিন পলাশুদ্দিন তমাল টাকা ধার করে দামি পোশাক ও জুতা কিনে বাবু সেজে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলো, তখন লাউঞ্জে নামিদামি সেলিব্রেটিরা তাকে বিদায় জানানোর জন্য সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছেন। নিজের পরিচয় বিশদ ভাবে বিধৃত করার পর সে সারিতে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলো। সদাশয়া ঐশ্বরিয়া তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ঠিক সেভাবেই মিষ্টি করে হাসলেন, যেভাবে আগের সবার সাথে হাসি বিনিময় করেছেন, যেমন করে স্বল্প-পরিচিত কিংবা অপরিচিত মানুষদের সাথে সৌজন্য বিনিময় করতে হয়। পলাশুদ্দিন তমাল খুব আশা করেছিল, আজকের এই মহতী ক্ষণে এই নামজাদা ব্যক্তিবর্গের সামনে মহাশয়া তাকে সপ্রশংস সম্মানে আলিঙ্গনাবদ্ধ করবেন। হয়ত-বা দু-চার কথার কথার পর অতি অবশ্যই কোনো এক রাতে ভীষণ বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করার কথা বলে প্রভূত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। কিন্তু ঐশ্বরিয়া চোখের ঝলকে একটু রোশনাই ছুঁড়ে দিয়েই পরের মানুষটার সামনে গিয়ে যখন কাঁটায় কাঁটায় ১০ মিনিট ধরে হাত নেড়ে নেড়ে, ঘাড় দুলিয়ে, হাসি ছড়িয়ে খোশগল্প করে ঐ মানুষটার চোখের উপর চোখ রেখেই পরের জনের সামনে পা বাড়ালেন, তখন সে আবিষ্কার করলো- ‘তুচ্ছ’ আর ‘অভিজাত’-এর মাঝখানে যে পার্থক্য- তা কোনোদিন পূরণ হবার নয়। সে মনে করলো, তার পায়ের কাছে যে একদঙ্গল দূর্বাঘাস দলিত হচ্ছে, ওগুলোর বিক্ষিপ্ত ডালপালায় বা মাটির শরীর ঘেষে খাদ্যান্বেষণে ছুটে চলা পিঁপড়াদের মধ্যে সেও একজন, যে কিনা সামনে বিচরণত একটা সাদা হাতি দেখে বিস্ময়ে মূক হয়ে তাকিয়ে আছে।

পলাশুদ্দিন তমাল কোনোদিন ‘রোমান হলিডে’ বা ‘সাদমা’ ছায়াছবি দেখে নি। তা সত্ত্বেও কী করে তার মনে এই গল্প জন্ম নিল তা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। নিজেকে এমন চরিত্রে কল্পনা করাকে কোন অভিধায় ডাকা হয় আমার জানা নেই। ‘রোমান হলিডে’ বা ‘সাদমা’ ছায়াছবির গল্পকারদের স্বভাবও ঠিক এমনটাই কল্পনাবিলাসী হয়ে থাকবে। মানুষ মাত্রই কল্পনাপ্রিয় এবং অভিমানী। অভিমান হলো আমার সবচাইতে দামি সম্পদ। কল্পনায় প্রতিটা মানুষই নিজের অভিমানকে ফুলিয়ে বড়ো করে আর সগৌরবে সমুন্নত রাখে।


পলাশুদ্দিন তমালের এসব ভাবতে ভালো লাগে যে, সবাই তাকে খুব ভুল বোঝে, অথচ সকল ভুলের উর্ধ্বে থেকে নিজেকে নির্লোভ, নির্দোষ, দৃঢ়চেতা, সৎ ও দুঃসাহসিক ভাবতে সে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসে।
একদিন দুপুরে হঠাৎ পলাশুদ্দিন তমাল এসে হাজির। ওকে দারুণ চঞ্চল ও খুশি দেখাচ্ছিল।
‘দোস্ত, সেই স্বপ্নের কথাটা শুনবি?’
আমি হেসে দিয়ে বলি, ‘এতে নাকি আর মজা নাই?’
‘হুম। পরে ভেবে দেখলাম, স্বপ্নটা আসলে খুবই মজাদার।’ তারপর পলাশুদ্দিন তমাল ওর স্বপ্নের কথা বলতে থাকে।

গুলিস্তানের গোলাপ শাহ’র মাজার থেকে বাসে উঠলাম। দেশের বাড়ি বেড়াতে যাব। ঢাকা-মাওয়া সড়ক ধরে শ্রীনগরের ভেতর দিয়ে দোহার উপজেলায় ঢুকবো।
সকাল সাড়ে আটটার বাস কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় ছাড়লো। ৪০ সিটের বাসে জনা দশেক প্যাসেঞ্জার। এর আগে এত অল্প মানুষ নিয়ে গাড়ি ছাড়তে দেখি নি।
বাবুবাজার ব্রিজের গোড়ায় গিয়ে বাস থামলো। একজন দুজন করে উঠতে উঠতে প্রায় সবগুলো সিট ভরে গেল। পাশের সিটটা তখনও খালি পড়ে আছে দেখে আমি অবাক হচ্ছিলাম।
বাস ছেড়ে দিল। ব্রিজ পার হবার পর যেখানে গাড়িটি থামলো সেখানেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটি তরতর করে বাসে উঠে পড়লো, আর আমার মনে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। ভেতরে একটি মাত্র সিটই খালি রয়েছে, অতএব সম্রাজ্ঞী এই সিটে না বসে কোথায় বসবেন?
‘এক্সকিউজ মি!’ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখি মেয়েটি খুব মিষ্টি হেসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ‘আপনার পাশে কি বসতে পারি?’ আমি গলে গেলাম। ‘অবশ্যই। অবশ্যই।’ বলতে বলতে বসা থেকে প্রায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলাম।
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ।’ আরেকবার মিষ্টি হেসে আমার দিকে সে তাকালো, আর আমার বুক কাঁপতে থাকলো।
‘দেশে যাচ্ছেন বুঝি!’
‘জি! আপনি?’
‘আমিও। কোথায় নামবেন?’
‘হলের বাজার।’
‘বাহ, দারুণ তো! আমিও ওখানে নামবো।’
মেয়েরা এত সহজে ছেলেদের আপন করে নিতে পারে তা আমি এ জীবনে বিশ্বাস করি নি। সে আমার সেল নাম্বার নিল, তার সেল নাম্বার আমাকে দিল। তারপর আমাদের মধ্যে অনর্গল কথা চলতে থাকলো। সে যখন হাসে, মনে হয় তার হাসির সাথে আমি মিশে থাকি। সে যখন গাঢ় চোখে আমার দিকে তাকায়, আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই। সে খিলখিল করে হাসে, খলখল করে তার সর্বাঙ্গে আলো ঝরে।

একটা বিদ্‌ঘুটে ব্যাপার ঘটতে থাকলো। মেয়েটার বামপাশে উলটো সাইডে বসা একটা লোক বার বার আমার দিকে ক্রূর চোখে তাকাচ্ছিল। হিংসা! পরশ্রীকাতরতা! পুরুষ মানুষ এমনই। একটা সুন্দরী মেয়ে আমার পাশে বসেছে, আর অমনি তার গতর জ্বলতে শুরু করেছে। তবে, মেয়েটিও এ বিষয়টি খেয়াল করেছে। সেও মাঝে মাঝে লোকটার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে ইশারায় জবাব দিয়ে দিচ্ছে- বামন হয়ে চাঁদের পানে হাত বাড়িয়ো না। খবরদার!

হলের বাজারে বাস থামলে আমরা নেমে পড়ি। মেয়েটি কোন দিকে যাবে আমি জানি না। সে একটা রিকশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘আসুন না!’ আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে সে আমাকে তার রিকশার সঙ্গী হতে আহ্বান জানালো। আমি একবার জোরে মাটিতে পা ঠুকলাম- নাহ, স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই এসব ঘটছে।… এটুকু আমি কল্পনা করছিলাম।
এরপর যা দেখলাম তার জন্য আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েটি রিকশায় উঠলো, আর তার পাশে গিয়ে চেপে বসলো ঐ লোকটা, বাসের ভেতরে যে-লোকটা তার উলটো সাইডে বসে ছিল।
যেতে যেতে দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলো। আমি তাদের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম। কিছু দূরে গিয়ে মেয়েটা ঘাড় উঁচু করে একবার পেছনে তাকালো, তারপর হাত নাড়িয়ে টা-টা জানালো আর শেষবারের মতো সুন্দর করে হাসলো।

আমি উৎসুক হয়ে পলাশুদ্দিন তমালকে জিজ্ঞাসা করি, ‘তারপর?’
সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। বলে, ‘তার আর পর কী? আঙ্গুরি বাসায় চলে গেল, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।’
আমি চেয়ে দেখি, পলাশুদ্দিন তমাল একধ্যানে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, আমার চোখের গভীরে কোন্ রহস্য লুকিয়ে রেখেছি, ও হয়ত সেগুলো হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকলো।

পলাশুদ্দিন তমাল দীর্ঘক্ষণ ওয়েটিং রুমে বসে থাকার পরও ব্যারিস্টার সাহেবার সাক্ষাৎ পায় না। এত ব্যস্ত তিনি! শহরের নামজাদা, ডাকসাইটে অ্যাডভোকেটগণ তার কাছে নস্যি, তার বাগ্মিতার তোড়ে সবাই ফালি ফালি হয়ে যায়।
ওর ঝিমুনি পাচ্ছিল। এমন সময় দরজা খুলে যায়; খট খট শব্দে পা ফেলে বের হোন ব্যারিস্টার সাহেবা। হাই হিলের শব্দে উঠে দাঁড়াতেই আঙ্গুরির সাথে চোখাচোখি হয়।
‘ওহহো রে!! কী সর্বনাশ! আমি একদমই ভুইলা গেছিলাম যে তুই আসছিস।… কী যে করি! আচ্ছা, তুই কি প্লিজ কষ্ট কইরা একটু কাল সকালে আসবি? অলরেডি আমি লেট, একটা মিটিঙে যাইতে হবে।’
এরপর পলাশুদ্দিন তমাল আর কিছু ভাবতে পারে না। ওর গল্পগুলো এভাবেই হঠাৎ শুরু হয়ে হঠাৎ মাঝপথে থেমে যায়, কখনো পরিণতি পায় না, বা ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’ ধরনের হয় না।

আমি পলাশুদ্দিন তমালের এ গল্পটার একটা সার্থক সমাপ্তি সৃষ্টি করার কথা ভাবতে থাকি। তবে, আমার কাছে মনে হয় হুট করেই ওর কল্পনায় গল্পগুলো শুরু হয়ে যায়, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে, যেখানে ওর অভিমান খুব তীব্র ও ঘনীভূত হয়, যেখানে ওর নির্মোহ ব্যক্তিত্ব প্রকটভাবে জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে, যার কাছে পূর্বাপর সবকিছু ম্লান ও তুচ্ছ হয়ে যায়, সে ঐ অবস্থানটা ধরে রাখতে চায় অনন্তকাল ধরে; কারণ, এখানেই ওর পরম সুখ। সেজন্য ওর গল্পের কোনো সমাপ্তি নেই, কিংবা বলা যায়- এটাই ওর গল্প সমাপ্তির বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু গল্পের শেষটা কী হবে তা মেলাতে গিয়ে আমাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। অন্যের গল্পে সমাপ্তি টানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না কোনোকালেই, যা আমার ছাত্রজীবন থেকেই মজ্জাগত। আমরা স্কুল-কলেজে বা ক্লাবের কালচারাল ফাংশানে ধারাবাহিক ‘গল্প বলা’ প্রতিযোগিতা করেছি। আমাকে কেউ কোনোদিন দলে রাখতে চায় নি, কারণ, আমি গল্প ভালো বুঝতে পারতাম না, আমার অংশে এসে এমন গুলিয়ে ফেলতাম যে, আমার পরের জন আর তা গুছিয়ে উঠতে পারতো না, ফলে আমাদের দলের সাড়ে-সর্বনাশ ঘটতো, আর আমার ব্যক্তিগত পয়েন্টে সামান্য মার্সি-নাম্বার ছাড়া আর কিছুই জুটতো না।

একবার হলো কী, আমাদের ৪জনের দলে আমি ৩ নম্বরে। শুরুটা হলো শাহজাহানকে দিয়ে এভাবে- ‘জামালুদ্দিন লাগাম একদিন স্কুলে যাচ্ছিল। ঐ পথে সোহানাও যাচ্ছিল। এমন সময় বৃষ্টি এলো। সোহানা বৃষ্টিতে ভিজে কাকের বাচ্চা হইয়া গেলো। সে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার জুড়ে দিল। জামালুদ্দিন লাগামের কাছে কোনো ছাতা ছিল না, তাই সে সোহানাকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে পারলো না।’
করিম ছিল দ্বিতীয় গল্পকার; বলা শুরু করলো- ‘এমন সময় সেখানে একটা রিকশা এলো; সোহানা রিকশায় উঠে হুড টেনে দিল। জামালুদ্দিন লাগাম একলাফে রিকশায় উঠে সোহানার পাশে গিয়ে বসলো। সোহানা লজ্জা পাইয়া রিকশা থেকে নেমে গেলো। জামালুদ্দিন লাগাম একাই রিকশা নিয়া হাঁটতে লাগলো।’
তখন আমার পালা। আমি বলা শুরু করলাম- ‘জামালুদ্দিন লাগামও রিকশা থেকে নেমে গেলো এবং তার হাতের ছাতা ফুটাইয়া সোহানাকে দিল। সোহানা বললো, তোমার ছাতা আমি একা ইউজ করবো কেন, তুমিও ছাতার নীচে আসো। তারা দুইজনে ছাতার নীচে গেলো। ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টির মধ্যে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাইতে লাগলো। চলতে চলতে তারা মিষ্টি মধুর কথা বলতে থাকলো। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ভালোবাসা শুরু হলো। একদিন তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো। গল্পটা এখানেই শেষ হইল।’
পুরো অডিয়েন্সে হাসাহাসি। আমাদের সবার অংশেই যথেষ্ট হাসির উপাদান ছিল। কিন্তু আমার অংশ ছিল মারাত্মক। আঙুরি ছিল আমার পরের গল্পকার। সে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না, কারণ, ওর বলার কিছু অবশিষ্ট নাই। করিম বললো জামালুদ্দিন লাগামের কাছে ছাতা নেই, আর আমি ওর হাতে ছাতা ধরাইয়া দিলাম; যে-সোহানা রিকশায় পাশে বসতে লজ্জা পেলো, সেই আবার জামালুদ্দিনের সাথে একই ছাতার নীচে চলে গেলো। এবং, বলা নেই কওয়া নেই, ভালোবাসাবাসিও শুরু করাইয়া দিলাম। এখানেই শেষ না, পালিয়ে গিয়ে বিয়েও করিয়ে দিলাম! আমাদের দলের সবাই আমার উপর ভীষণ চটে গিয়েছিল। এবং আমরা ব্যাপক ব্যবধানে পরাজিত হওয়ায় রাগে-দুঃখে আঙ্গুরি আমার চুল ধরে পিঠে একটা ভয়াবহ কনুই বসিয়ে দিয়েছিল।

পলাশুদ্দিন তমালের গল্পটা আমি দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে, এর নির্যাসটুকু নিয়ে পূর্বাপর সাজিয়ে নিলাম আমার মতো করে। আদতে এ গল্পটা আমার, অথবা পলাশুদ্দিন তমাল- যে কারোরই হতে পারে; কিংবা হতে পারে আপনাদেরও যে কারোর।

আমাদের আঙ্গুরি যেদিন বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সংসদ সদস্য হয়ে শপথ গ্রহণ করলো, গর্বে আমাদের বুক ভরে উঠলো। বিভিন্ন এলাকা থেকে সদলবলে নেতাকর্মীরা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আঙ্গুরির বাংলোয় এসে ভিড় করলো। একদিন আমরা সহপাঠিরাও আঙ্গুরিকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য আমাদের স্কুলের মাঠে বিরাট আয়োজন করলাম।
সকাল থেকেই আমাদের আনন্দ ধরছিল না। আহা, এমন সৌভাগ্য কয়জনের ভাগ্যে জোটে? এই সেই আঙ্গুরি, যার সাথে আমরা এই স্কুলে একই ক্লাসরুমে বসে পড়ালেখা করেছি, একই ল্যাবরেটরিতে ব্যাঙ আর তেলাপোকা ব্যবচ্ছেদ করেছি; জ্বলন্ত রোদে মাঠের চোরকাঁটা তুলেছি। আঙ্গুরি খুব দুষ্টুমি করতো। চোরকাঁটা তুলে আমাদের গায়ে ছুঁড়ে মারতো। একবার পলাশুদ্দিন তমাল খুব রেগে গিয়ে আঙ্গুরির পিঠে ধুমধাম করে তিনটা কিল বসিয়ে দিলে ‘ওরে বাবারে’ বলে আঙ্গুরি মাঠের মাঝখানে শুয়ে পড়ে গলা ফাটিয়ে কেঁদে দিয়েছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা কিছু বুঝে উঠতে পারি নি, কিন্তু হেডস্যার একটা সোমত্ত মেয়ের গায়ে হাত তোলার অপরাধে পলাশুদ্দিন তমালের পিঠে একটা আস্ত খেজুরের ডাউগা ভেঙে এর বিচার করেছিলেন।
আঙ্গুরি প্রাণ খুলে হাসলে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে যেত। আমরা আঙ্গুরিকে খুব ভালোবাসতাম। ওর মতো মেধাবী, মিশুক আর প্রাণোচ্ছল সহপাঠিনী সবার ভাগ্যে জোটে না। ও আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। ওর সবচাইতে বড়ো গুণ, ও সবাইকে আপন করে ভালোবাসতে পারে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পলাশুদ্দিন তমাল অনুপস্থিত। আঙ্গুরির মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। আমাদের মাসুদ, শুভ, শামীমা, বীথি, প্রমুখ সহপাঠী নেতারা মাননীয়া সাংসদের উদ্দেশ্যে যাবতীয় স্তুতিবাক্য বর্ষণ ও পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষ করলে আঙ্গুরি বললো- তোরা চল, ওর বাসায় যাই।
জীর্ণ কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এলো পলাশুদ্দিন তমাল। ওর গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, কাঁধে গামছা। চেহারায় কোনো হীনমন্যতা নেই, লজ্জা নেই এত সাধারণ বেশভূষায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ানোর জন্য, যেন আমরা ওর ঘরের মানুষ, সহোদর-সহোদরা, প্রতিদিনকার ঘরোয়া অভ্যাসের মতোই স্বাভাবিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় সে আমাদের সাথে আলাপ শুরু করলো।
‘আসলি কীভাবে? গাড়ি কই?’ পলাশুদ্দিন তমাল ঠান্ডা স্বরে প্রশ্নটা করে।
আঙ্গুরি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা কলকল খলবল করছি।
‘আমরা হেঁটে এসেছি। তোদের গ্রামে আসার রাস্তাটা খুব বাজে।’
‘হু।’ পলাশুদ্দিন তমাল যথাস্বভাবে বলে।
‘আমারে অভিনন্দন জানা। বল, কংগ্রাচুলেশনস।’ আঙ্গুরির কথায় সে মিটিমিটি হাসে, তারপর বলে, ‘তোর জন্য অনেক অনেক দোয়া।’
পাড়াপ্রতিবেশী, সারা গাঁ থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। কেউ কেউ সড়কে শ্লোগান তুলছে নেত্রীর নামে।
পলাশুদ্দিন তমালের মা আনন্দে ছটফট করতে করতে এক গ্লাস লেবুর শরবত এনে দিলেন আঙ্গুরির হাতে। আঙ্গুরি শরবত নেয়ার আগে নীচু হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলে খালাম্মা আরো উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তার এই ভাঙা বাড়িতে কোনোদিন মেম্বার চেয়ারম্যানরাও আসেন না। শুধু ভোটের মওশুম এলে তাদের দেখা মেলে। কিন্তু আজ তার বাড়িতে চাঁদের হাট- খোদ এমপি সাহেবা এসে হাজির। তাঁর ছেলের বান্ধবী এমপি, যাকে ‘তুমি-তুমি’ করে কথা বলা যায়- এ গর্বে তার বুক ফুলে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করছেন, এই মেয়েটি যেন মন্ত্রী হয়। মন্ত্রী হয়ে আবার এলে তিনি মন্ত্রীর মাথায় হাত রেখে দোয়া করবেন।
বেশ কিছুক্ষণ তারা এ বাড়িতে থাকার পর বিদায়ের পালা।
‘তুই চল আমাদের সাথে।’ আঙ্গুরি বলে পলাশুদ্দিন তমালের উদ্দেশে।
‘নাহ, একটু ক্ষেতে যাইতে হবে।’
‘আমি তোদের গ্রামে একটা কলেজ করার প্লান করছি। তোদের ডাইয়ারকুম গ্রামটা খুব ব্যাকডেটেড।’
পলাশুদ্দিন তমালের বাম ঠোঁটের কোণটা সামান্য একটু বেঁকে গেলো।
এই তো মোক্ষম সময়। খালাম্মা এগিয়ে এসে বললেন, ‘ও মা, আমাদের কলেজটা পরে হইলেও চলবো। এই যে রাস্তাটা আছে না, এই রাস্তাটা বানাইয়া দেও। আমরা যাতে এক বাড়ি থনে আরেক বাড়ি যাইতে পারি। ভোটের আগে সবাই বলে রাস্তা কইরা দিব, কিন্তু পরে আর কেউ করে না।’
আঙ্গুরির মুখে সামান্য অন্ধকার দেখতে পাই। ওর মাথা নীচু হয়ে আসে।
পলাশুদ্দিন তমাল আমাদের সাথে বাড়ির বাইরে এসে বিদায় জানালো। আমরা ওদের ভাঙা কুঁড়েঘর পেছনে ফেলে একটি ভাঙা রাস্তায় নামলাম, যেটি অনাদিকাল থেকে হয়ত অনন্তকাল পর্যন্ত ভাঙাই থাকবে, আমাদের আঙ্গুরি কলেজ, ইউনিভার্সিটি করে দেবে এই গ্রামে, কিন্তু ভাঙা রাস্তাটি মেরামত করে দিয়ে ওদের এ-পাড়া, ও-পাড়া, অন্যগ্রামে যাওয়ার পথ সুগম করে দেবার কোনো তাগিদই হয়ত মিলবে না ইহজনমেও।

২৯ মার্চ ২০১৯

ফুটনোট

এই ব্লগে এটা আমার প্রথম পোস্ট। ফেইসবুক ও অন্যান্য ব্লগ থেকে পরিচিত অনেককে এখানে দেখে ভালো লাগছে। আগে এই ব্লগে রেজিস্টার করেছিলাম কিনা, নিশ্চিত নই, কোনো নিকও খুঁজে পাই নি, তাই নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করলাম। আমার অন্য একটি ব্লগনেইম হলো ‘সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই’।

সবাই ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল।